সংসার পর্ব-০২

0
416

#সংসার
#লেখা_Bobita_Ray
পর্ব-০২

ঘড়িতে রাত দশটা বেজে এগারো মিনিট। এতরাতে একটা অপরিচিত মেয়েকে ইনবক্সে নক দেওয়া কী ঠিক হবে? ভাবতে ভাবতে অবাধ্য আঙুলগুলো ছোট্ট করে একটা মেসেজ টাইপ করে ফেলল। রূপায়ন ইতঃস্তত করে মেসেজটা সেন্ট করে দিল। তারপর অধীর আগ্রহে উত্তরের অপেক্ষা করতে লাগল।
মেয়েটি বোধহয় ফোন হাতে নিয়েই বসে ছিল। ঝটপট সেই পোস্টের স্ক্রীণশর্টসহ উত্তর দিল।
‘সত্যিই কী আপনি এই পোস্টটা করেছেন?’
রূপায়ন বেশ অবাক হলো। লিখল,
‘মিথ্যে বলব কেন?’
মেয়েটি লিখল,
‘না মানে আপনাকে দিয়ে আটজন, এই পর্যন্ত সেই পোস্টের মালিক দাবি করেছে।’
কী যুগ আসলো রে বাবা? একটা পোস্ট নিয়েও মানুষ এমন করতে পারে! রূপায়নের জানা ছিল না। রূপায়ন লিখল,
‘আপনাকে আর কে কে মেসেজ দিয়েছে। আমি জানি না। তবে এই পোস্টটা আমিই করেছি। যাইহোক কিছু বলার থাকলে বলতে পারেন। আমার দেরি হচ্ছে, আমি ঘুমাব।’
‘আরেহ্ মশাই রাগ করছেন কেন? আমার সত্যিই এই পোস্টের মালিককে কিছু বলার আছে। আগে বলুন আপনার বয়স কত?’
রূপায়ন এবার একটু বিরক্তবোধ করল। অপরিচিত একটা মেয়েকে সে নিজের বয়স বলবে কেন? আজব।
তবে রূপায়ন যে এই পোস্টটা সত্যিই করেছে তার প্রমাণ দিল।
মেয়েটি দীর্ঘ একটি মেসেজ লিখল,
‘শুনুন আমার নাম: অনুপমা ঘোষ। বয়স: একুশ বছর। দেখতে, খুব একটা খারাপ না। পড়াশোনা এস.এস.সি পাশ। মা-বাবা নেই। ছোটবেলা থেকেই জেঠু, জেঠীমার সংসারে অনাদর, অবহেলায় বড় হয়েছি।
জেঠু নিজের মেয়েদের অনেক পড়াশোনা শিখিয়ে ভাল ঘর দেখে, পাত্রস্ত করলেও আমার বেলায় বেশি বয়সী, কিংবা বউ মারা গেছে, এক, দু বাচ্চার বাপ, এই টাইপ ছেলেদের আমাকে বিয়ে করার জন্য ধরে আনে। কেন বলুন তো? ভাল ঘরে বিয়ে দিতে গেলে তো ছেলেপক্ষকে অনেক টাকাপয়সা যৌতুক দিতে হবে। আমার মতো অনাথ, মেয়ের পেছনে এতটাকা খরচ করতে, তাদের বয়েই গেছে।
আপনার পোস্টটা পড়ার পর, আপনার জন্য আমার অদ্ভুত মায়া হচ্ছে। কেন হচ্ছে জানি না। তবে বিয়ে যখন আমাকে বেশি বয়সী কোন পুরুষকেই করতে হবে। তবে আপনাকে করলে মন্দ কী? আপনার যদি আমার এই মেসেজটা পড়ার পর আমার প্রতি একটুও আগ্রহ কাজ করে, তবে জানাবেন।

এই পর্যন্ত সাড়ে সতেরো বার মেসেজটা পড়া হয়ে গেছে। রূপায়ন কী উত্তর দেবে, ভেবেই পেল না। তবে রূপায়নের খুব ভাল লাগছে। অপরিচিত একটা মেয়ে, রূপায়নকে চিনে না, জানে না, কোনোদিন দেখেনি। তারপরও সরাসরি বিয়ের কথা বলে দিল। সত্যিই এই জেনারেশনের মেয়েগুলো অনেক এগিয়ে। রূপায়ন সময় নিয়ে টাইপ করল,
‘মেসেজে এত কথা বলা যায় না। আমরা কী ফোনে কথা বলতে পারি?’
মেয়েটি মেসেজ দেখল। তবে সাথে সাথে উত্তর দিল না। প্রায় তেরো মিনিট পর, নিজে থেকেই কলব্যাক করল। রূপায়ন রিসিভ করে বলল,
‘হ্যালো..?’
‘কেমন আছেন?’
মেয়েটির কোকিল কণ্ঠ৷ শুনতে বেশ লাগল। রূপায়ন মাথা চুলকে, লাজুক হেসে বলল,
‘ভাল আছি। কিছু মনে করবেন না। একটা প্রশ্ন করি?’
‘অবশ্যই? ‘
রূপায়ন বলল,
‘আপনি বললেন জেঠু, জেঠীর কাছে মানুষ হয়েছেন। তবে টাচফোন পেলেন কোথায়?’
‘ছোটবেলা থেকেই টাকা জমানোর বদঅভ্যেস আছে আমার। টাকা জমিয়ে রাতুলদাদাকে দিয়েছিলাম। দাদা আর কিছু টাকা ভরে কিনে দিয়েছে। রাতুলদাদা আমার জেঠুর ছেলে।’
‘ওহ’
‘আপনার মা আপনাকে বিয়ে দেয় না কেন? আপন মায়েরা আবার এমনও হয় না কী?’
‘আসলে আমার মাকে পুরোপুরি দোষ দেওয়া যায় না। ছোটবেলায় বাবাকে হারিয়ে সংসারের হাল ধরেছি। একটানা অনেকবছর একাহাতে সংসার সামলেছি। প্রতিবেশীরা প্রায়ই আমার মায়ের কান ভাঙায়৷ আমি বিয়ে করে যদি সংসারে আর খরচ না দেই! যদি বউ নিয়ে আলাদা হয়ে যাই! সেই ভীতি থেকেই আমার মা ভুলেও আমার বিয়ের কথা বলে না। এখন তো আরও বলে না। কারণ আমার বোনেরা মাকে বলতে দেয় না। ঘরে বউ এলে, তাদের যদি বাবার বাড়ি আসা বন্ধ হয়ে যায়। কিংবা তাদের বড়দা যদি আর দায়িত্ব পালন না করে। অনেকটা সেই ভয় থেকে। তবে ইদানীং আমার একাকীত্ব একটুও ভাল লাগে না। প্রচণ্ড মাথা ব্যথা হলে, কিংবা জ্বর এলে একাকী ছটফট করি। ঔষধ খেয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বিছানায় পরে থাকি। তখন খুব করে চাই, কেউ আমার অসুখে অস্থির হোক, পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিক৷ গভীররাতে ঘুম ভেঙে, তার ঘুমন্ত মায়াবী মুখটা দেখে, বাকি রাতটুকু কাটিয়ে দেই। তবে লজ্জায় কাউকে বলতে পারি না।
‘আমাকে তো বলে দিলেন!’
‘আপনি তো আমার বাড়ির লোক না।’
‘যদি বলি, আপনার বাড়ির লোক হতে চাই?’
‘আপনি অনেক ছোট। আমার থেকে অনেক বেশিই ছোট। এত ছোট মেয়েকে বিয়ে করা ঠিক হবে না বোধহয়।’
‘আপনার বয়স কত?’
‘ছত্রিশ+’
‘মাত্র পনেরো বছরের বড় ছোট আমরা। আমার বয়সে কোন সমস্যা নেই।’
‘এখন আপনার আবেগ কাজ করছে। তবে এই আবেগ বেশিদিন থাকবে না। তখন আমাকে অসহ্য লাগবে আপনার।’
‘বয়সে ছোট দেখেই যে ইমম্যাচিউর হবো, ভাবলেন কীভাবে? আপনার ধারণাও নেই। আমার জন্য কী টাইপ ছেলে দেখা হচ্ছে। বেশি বয়সী ছেলেকেই যখন বিয়ে করতে হবে, আপনাকে করলে ক্ষতি কী?’
‘আমার বাড়ি থেকে আমাকে আর জীবনেও বিয়ের কথা বলবে না।’
‘কিন্তু আপনি তো বিয়ে করতে চান! বলেন চান না?’
-‘হ্যাঁ চাই।’
-‘তাহলে আপনার পরিচিত কাউকে নিয়ে আমাদের বাসায় আসুন। আমার জেঠুকে বিয়ের কথা বলুন।”
-‘ইয়ে মানে.. তারা কী ভাববে?’
-‘কিছুই ভাববে না। তারা আমাকে ঘাড় থেকে নামাতে পারলেই বরং হাফ ছেড়ে বাঁচে।’
রূপায়ন সাহস করে বলল,
‘ওকে ঠিকানা দিন তাহলে?’
‘আমাকে দেখে নিবেন না একবার?’
‘কাল সামনাসামনিই দেখব।’
‘যদি পছন্দ না হয়?’
রূপায়ন লাজুক হেসে বলল,
‘পছন্দ না হলেও বিয়ে করব। উল্টো আপনারই আমাকে পছন্দ হবে না।’
অনুপমাও হালকা হেসে রূপায়নের কথা রিপিট করল,
-‘পছন্দ না হলেও আপনাকেই বিয়ে করব।’

কথা বলতে বলতে রাত গভীর হয়ে গেছে। কারো ফোন রাখার তাড়া নেই। দুজন, দুজনের ভাললাগা, মন্দলাগা, সুখ, দুঃখের গল্প করেই রাতটা কাটিয়ে দিল। ভোরের দিকে ফোন রেখে রূপায়ন ঘুমিয়ে গেল। ইতিমধ্যে মা বার কয়েক ডেকে গেছে। রূপায়ন বেলা এগারোটার সময় ঘুম থেকে উঠল। মা বিরক্ত হয়ে বলল,
-‘আজ দোকানে যাবি না?
রূপায়ন রুটি ছিড়ে খেতে খেতে বলল,
‘না।’
‘সেকী কেন?’
-‘একটাদিন কাজে না গেলেও কৈফিয়ত দিতে হবে মা? কই অরুপকে তো কিছু বলো না?
নন্দিতাদেবী দমে গেলেন। ছোট ছেলেকে বিয়ে দেবার পর থেকেই বড়ছেলেটার মন মেজাজ ঠিক থাকে না। ভাল কথা বললেও কেমন খিটমিট করে। নন্দিতাদেবী সবই বুঝে। তবে ভয়ে কিছু বলে না। যদি মুখ ফুটে বড়ছেলেটা বিয়ের কথা বলে ফেলে! মেয়েগুলো রীতিমতো নন্দিতাদেবীকে শাসিয়েছে। সত্যিই তো বড়ছেলেটা বিয়ে করলে সংসারের সব দায়িত্ব পালন করবে কে?

রূপায়ন জলখাবার খেয়ে, দাড়ি শেভ করল। মাথায় কালার লাগাল। তারপর সময় নিয়ে স্নান করল। গায়ে দামী সাদা শার্ট জড়িয়ে নিয়ে, হাতে ঘড়ি পরতে পরতে আয়নায় একঝলক নিজেকে দেখে নিল। রূপায়ন দেখতে লম্বাচওড়া, পেটানো শরীর, মাথায় ঘন চুল। টিকালো নাক, শ্যামবর্ণ মুখ। এত বয়স হয়েছে, দেখলে বোঝার উপায় নেই। একদেখায় যে কেউ পছন্দ করে ফেলবে। শারীরিক ভাবেও একদম ফিট।
-‘এত সেজেগুজে কই যাচ্ছিস?’
-‘মেয়ে দেখতে যাব।’
অরুপ চমকে উঠল। বড় বড় চোখ করে বলল,
-‘এই বয়সে তুই বিয়ে করবি বড়দাভাই?
-‘তুই আমার ছোট হয়ে বিয়ে করেছিস। আমি তোর বড়দাদা হয়ে বিয়ে করলে, ক্ষতি কী তাতে?’
অরুপ ব্যঙ্গ করে বলল,
-‘হুহ…বুড়ো বয়সে ভীমরতি।
রূপায়ন কথাটা গায়ে মাখল না। শুধু একপলক ছোটভাইয়ের মুখপানে তাকাল। বিয়ের কথা শুনেই এই অবস্থা। বউ নিয়ে বাড়ি এলে কী হবে, কে জানে!

ঠিকানা অনুযায়ী, একটা গ্রামের আঁধাপাকা বাড়ির উঠানে এসে দাঁড়াল রূপায়ন। সাথে একজন বয়স্ক ঘটক এনেছে।
-‘কাকে চাই?
একজন বয়স্ক ভদ্রলোক, পরনে লুঙ্গি, ভারী শরীরে গামছা জড়ানো। রূপায়নদের দেখে এগিয়ে এলো।
ঘটক তেলতেলে হাসি দিয়ে বলল,
-‘খবর পেয়েছি, আপনাদের বাড়ি বিয়ের উপযুক্ত মেয়ে আছে। তাই দেখতে এলুম।
ভদ্রলোক হাঁক ছেড়ে ডাকলেন,
-‘কইগো রাতুলের মা শিগগিরই আসো? অতিথি এসেছে।
ভদ্রমহিলা আঁধমাথা ঘোমটা টেনে ছুটে এলেন। ভদ্রলোক নিচু কণ্ঠে ফিসফিস করে কিছু বলতেই ভদ্রমহিলা হাসি হাসি মুখ করে বলল,
-‘আপনারা ভেতরে এসে বসুন?

বসার ঘরে রূপায়ন আর ঘটককে বসতে দেওয়া হলো। ভদ্রলোক সোফায় গা এলিয়ে দিয়ে অনুপমার গুনগান করছে। ভদ্রমহিলা চা, জলখাবার দিল। তারপর অনুপমাকে বসার ঘরে নিয়ে আসা হলো। রূপায়ন সবে গরম চায়ে চুমুক দিয়েছে। হঠাৎ দরজায় অনুপমাকে দেখে থমকে গেল। চা টা আস্তে করে টি-টেবিলের ওপর নামিয়ে রাখল। পশ্চিম আকাশে লাল রঙা সূর্যটা একটু একটু করে ডুবে যাচ্ছে। একপশলা মিঠে রোদ জানালার ফাঁক গলে, অনুপমার সুন্দর মুখখানিতে লুটিয়ে পরেছে। দেখতে কী যে ভাল লাগছে। একটা মেয়ে দেখতে এতটা সুন্দর হয়? না কী রূপায়নের চোখেই এত সুন্দর লাগছে? সুন্দর মুখখানি জুড়ে একরাশ স্নিগ্ধতা। এই রূপকথার রাজকন্যা রূপায়নের বউ হবে? ভাবতেই মনটা খুব পুলকিত হলো। বুকটা গর্বে ভরে গেল।
-‘মা নাম কী তোমার?
-‘অনুপমা।’
-‘আহা.. সেই কোকিল কণ্ঠ। লোকে বলে, যার কণ্ঠ সুন্দর তার চেহারা সুন্দর হয় না। তবে আশ্চর্যজনক ভাবে এই মেয়ের কণ্ঠও সুন্দর। চেহারাও মায়াকাড়া।
ঘটক বলল,
-‘ছেলেমেয়ে আলাদা করে একটু কথা বলুক? কী বলেন?
-‘অবশ্যই অবশ্যই। অনুপমা, ওনাকে তোমার ঘরে নিয়ে যাও। সাথে পাশের বাড়ির ছয় বছরের মেয়ে নীতিকেও পাঠিয়ে দিল জেঠী।
রূপায়ন ধীর পায়ে অনুপমার সাথে গেল। ঘরে গিয়ে একটা চেয়ার টেনে বসল। অনুপমার দিকে একপলক তাকিয়ে আস্তে করে বলল,
‘গতকাল রাতে মিথ্যেকথা বললেন কেন?’

(চলবে)