সংসার পর্ব-০৩

0
307

#সংসার
#লেখা_Bobita_Ray
পর্ব-০৩

‘গতকাল রাতে মিথ্যেকথা বললেন কেন?’
অনুপমা বিষাদমাখা মায়াবী চোখ তুলে তাকাল। কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধাণে চার চোখের মিলন হলো। ওই ওতটুকু দৃষ্টি বিনিময়ে, রূপায়নের বুকের ভেতর তানপুরার করুণ সুর বেজে উঠল। ভেতরে ভেতরে ছটফটিয়ে উঠল। গতকাল রাতে অনুপমা ফোনে যতটা চটপটে স্বরে কথা বলছিল। সামনাসামনি ততটাই স্থির। অনুপম বড় করে দম ছাড়ল। পূর্বের কথার রেশ ধরে বলল,
-‘কী হলো? কথা বলবেন না?
অনুপমা মাথা নীচু করে ছোট করে উত্তর দিল।
-‘কী মিথ্যে বলেছি?’
রূপায়ন শব্দহীন হাসল। বলল,
-‘এত সুন্দর মেয়েটা সত্যিই কী আমার বউ হতে চায়? না, আমি দিবাস্বপ্ন দেখছি? গতকাল রাতে আমায় ফোনে কেউ একজন বলেছিল, ‘সে দেখতে খারাপ না।’ তবে এতটা? আমি সত্যিই একদম আশা করিনি।
অনুপমা খুব লজ্জা পেল। রূপায়ন মুগ্ধ দৃষ্টিতে অনুপমাকে দেখছে। ‘শাড়িতেই নারীর আসল সৌন্দর্য।’ কোমড় পর্যন্ত ঢেউ খেলানো সুন্দর চুলগুলো ছেড়ে দেওয়া। ফর্সা মুখে কোন প্রসাধনীর ছোঁয়া নেই। শুধু ভাষা ভাষা দুচোখে মোটা করে কাজল টেনেছে। কপালের মাঝখানে খুব যত্ন করে একটা লালটিপ পরেছে। ব্যস এতটুকু সাজেই দেখতে কী ভাল লাগছে।
রূপায়ন বলল,
-‘বিয়েটা ভাল দিনক্ষণ দেখে, কোন মন্দিরে সেরে ফেলতে চাই! আপনি কী বলেন?
অনুপমা কেঁপে উঠল। নাকের ডগায় বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে মুখটা মুছে নিয়ে বলল,
-‘আপনার যা ভাল মনে হয়। আপনার বাড়ির কেউ থাকবে না বিয়েতে?’
-‘না। এতে কী আপনার ফ্যামিলির কোন আপত্তি আছে?’
-‘হয়তো নেই।’
-‘অনুপমা?’
প্রথমবার রূপায়নের কণ্ঠে নিজের নাম শুনে অনুপমা আবেশে চোখদুটো বন্ধ করে ফেলল। আস্তে করে বলল,
-‘কী?’
-‘এখনো সময় আছে। ভেবে বলুন! সত্যিই কী আমায় বিয়ে করতে চান? আসলে আপনাকে বিয়ে করে আমার বাড়িতে নিয়ে গেলে, প্রথম প্রথম আপনাকে অনেক তিক্ততা সহ্য করতে হবে। কটুকথাও শুনতে হতে পারে। কারণ সবসময় আপনাকে সেইভ করার জন্য আমি বাড়িতে থাকব না।
-‘সেই ছোটবেলা থেকে লোকের বেশিকথা শুনে, তিক্ততা হজম করে বড় হয়েছি। চটপটে স্বভাবের জন্য জেঠীর হাতেও খুব মাইর খেয়েছি। আমার কোন সমস্যা হবে না। তবে আমার একটা বদঅভ্যেস আছে।
-‘কী?’
-‘কেউ যদি আমায় দশটা বেশি কথা শোনায়। তাহলে আমিও দুটো শুনিয়ে দেই। এবং মুখের উপর চটাস চটাস উচিত কথা বলে দেই। আপনাকে বিয়ে করায় আপনার মা বা বোন যদি আমার সাথে বা আপনার সাথে অন্যায় ভাবে বেশি খারাপ ব্যবহার করে। তাহলে একটা সময় পর, আমিও কিন্তু আর চুপ থাকব না।
-‘আরেহ্ বা..বিয়ের আগেই শাশুড়ী, ননদের সাথে ঝগড়া করবেন, আমায় বলছেন?’
-‘উহুম, ভুল বললেন। আগ বাড়িয়ে আমি কারো সাথে ঝগড়া করি না। তবে কেউ যদি আমায় অযথা ঘাটাতে আসে, তাকে ছেড়ে দেই না।
-‘ একসময় আমি তাদের প্রিয়জন ছিলাম। এখন প্রয়োজন হয়ে গেছি। তারপরও দায়িত্ব গুলো হাসিমুখে পালন করে যাই। কী করব বলুন? এতবছরের অভ্যাস সহজে কী ছাড়া যায়? তবে স্বামী হিসাবে আমি আপনারও সমস্ত দায়িত্ব পালন করব। কোনকিছুর অভাব রাখব না। আপনাকে কখনো অভিযোগ করার সুযোগও দেব না।
রূপায়ন উঠে দাঁড়াল। বলল,
-‘আসছি! আপনাকে আর বসার ঘরে যেতে হবে না। ভাল থাকবেন।

ঘটক মেয়ের জেঠুকে বলল,
-‘সদরে ছেলেদের নিজস্ব দোতলা বাড়ি আছে। ছেলের বাজারে রঙের বড় দোকান। ছেলেরা দুইভাই, তিনবোন। অল্প বয়সে বাপ মারা গেছে। তাই বড়ছেলে হিসাবে সংসারের হাল ধরে সবগুলো ভাইবোনকে মানুষ করে বিয়ে দিয়েছে। সেই ফাঁকে নিজের বিয়ের বয়সটাও কবে পেরিয়ে গেছে। বোন তিনজনের বিয়ে হয়ে গেছে। বাড়িতে বিধবা মা, ছোটভাই- ভাইবউ আর ছেলে থাকে। আপনাদের মেয়ের বিয়ে হলে বেশ সুখেই থাকবে। তাছাড়া ঠিকানা দিয়ে যাব। আপনারা খোঁজ নিয়েও দেখতে পারেন। এমন ছেলে লাখে একটা মিলে।
জেঠু সংকোচ করে বলল,
-‘ইয়ে..মানে আপনাদের কিছু আবদার আছে না কী?
-‘না না.. ছেলে যৌতুক নিয়ে বিয়ে করবে না। এবং আপনাদের আপত্তি না থাকলে ভাল দিনক্ষণ দেখে, বিয়েটা কোন মন্দিরে সেরে ফেলতে চায়। বিয়ের যাবতীয় খরচ ছেলে বহন করবে।
আনন্দে জেঠীর চোখ-মুখ জ্বলজ্বল করে উঠল। বিড়বিড় করে বলল, ‘ভালোই হলো, অপয়া মেয়েটাকে বিদায় করতে এক পয়সাও লাগবে না। অতিরিক্ত উত্তেজনায় জেঠী বলে বসল,
-‘আমাদের আর গিয়ে দেখার দরদার নেই। আমরা রাজি।
জেঠু, জেঠীকে চোখ রাঙানি দিল। চাপা কণ্ঠে বলল,
-‘চুপ করো বদল মহিলা। বোধবুদ্ধি লোপ পেয়েছে তোমার? এভাবে বললে, তারা কী ভাববে?
জেঠী দমে গেলেন। রূপায়ন বসার ঘরে এসে বসল। জেঠু বললেন,
-‘বাবা তোমার যে এত বয়স চেহারা দেখে, বোঝা যায় না।
উত্তরে রূপায়ন মৃদু হাসল। জেঠী বলল,
-‘রাতে চারটে ডালভাত খেয়ে যাবেন।
রূপায়ন বলল,
-‘আজ আর কিছুই খাব না। অন্যদিন। আমার কার্ডটা রাখুন। দিনক্ষণ ঠিক করে আমাকে জানাবেন। আর একটা কথা!
জেঠু বলল,
-‘কী বাবা?
রূপায়ন ইতঃস্তত করে বলল,
-‘বিয়েতে কিন্তু আমার বাড়ির লোক থাকবে না।
-‘আমাদের কোন সমস্যা নেই।
-‘আজ উঠি।
-‘আচ্ছা দেখেশুনে যাইয়ো।

গাড়িতে বসেই রূপায়ন অপরিচিত নাম্বারে ব্যস্ত হাতে কল দিল। অনুপমা ফোন রিসিভ করে বলল,
-‘কে?
-‘এতটুকু সময়ের মাঝেই ভুলে গেলেন?
-‘ফোন নাম্বার পেলেন কোথায়?
-‘ওই পিচ্চি মেয়েটার কাছ থেকে নিয়েছি।
অনুপমা শব্দহীন হাসল। রূপায়ন বলল,
-‘ আপনার বালিশের নীচে হাজার দুই টাকা রাখা আছে। পছন্দমতো কিছু কিনে নিবেন।
-‘অযথা এতগুলো টাকা রেখেছেন কেন?
-‘প্রথম দেখতে গেলে কিছু দিতে হয়। এটা নিয়ম। তবে সরাসরি আপনার হাতে দিলে যদি অপমানবোধ করেন। তাই সাহস পাইনি।
অনুপমা বলল,
-‘আপনার এত বয়স কিন্তু বোঝা যায় না। না কী মিথ্যে কথা বলেছিলেন?
-‘সত্যিই বোঝা যায় না?
-‘না।
-‘আমায় দেখতে কেমন লাগে?
-‘অনেক ইয়াং। কথাটা বলেই দাঁতে জিভ কাটলো অনুপমা। রূপায়ন শব্দহীন হাসল। ফিসফিস করে বলল,
-‘থাক আর লজ্জা পেতে হবে না। এখন রাখছি। রাতে কথা হবে।
-‘আচ্ছা।’

রাতে বাড়ি ফিরে বসার ঘরে দেখল। রূপায়নের দুইবোন, মা, ছোটভাই, ভাইবৌ সবাই বসে আছে। রূপায়ন বোনদের দেখে এগিয়ে গেল। হাসিমুখে বলল,
-‘কী ব্যপার তোরা কখন এলি? ভালো আছিস?
রুপা বলল,
-‘ভাল থাকি কী করে বড়দাভাই? শুনলাম তুই না কী বিয়ে করছিস?
রূপায়ন চমকে উঠল। তবে প্রকাশ করল না। ধীর গলায় বলল,
-‘কে বলেছে তোদের? অরুপ?
-‘মিথ্যে কিছু বলেছে কী?’
রূপায়ন দৃঢ় কণ্ঠে বলল,
-‘ আমি যদি বিয়ে করিও তোদের কী সমস্যা?
-‘বুড়ো বয়সে লোক হাসাবি? আবার বলছিস আমাদের কী সমস্যা?
রূপায়ন তাচ্ছিল্য করে একটুখানি হাসল। মায়ের চোখের দিকে তাকিয়ে বলল,
-‘মা আমাকে দেখে বলো তো? আমি সত্যিই বুড়ো হয়ে গেছি?
নন্দিতাদেবী কিছুই বলল না। যেন মুখে কুলুপ এঁটেছে। তবে ছেলেমেয়েরা যে যাই বলুক। তিনিও মনে মনে চান, রূপায়ন বিয়ে করুক। সবার মতো রূপায়নেরও একটা নিজের সংসার হোক।
রূপায়ন ক্লান্ত শরীরটা সোফায় এলিয়ে দিয়ে বসল। অরুপ বলল,
-‘সত্যিই তুই মেয়ে দেখতে গিয়েছিলি আজ?
-‘হ্যাঁ।’
-‘মানে কী আমাদের কাউকে না বলে, তুই একা একা বিয়ের জন্য মেয়ে দেখতে চলে গেলি? এই বয়সে এসে তুই এতই বিয়েপাগল হয়ে গেছিস বড়দাভাই?

(চলবে)