#সংসার
পর্ব ২৯
ধারাবাহিক গল্প
নাহিদ ফারজানা সোমা
তিতলী এসেছে বাপ-মা’কে দেখতে বোনের বাসায়। তিতিরের আদর যত্নে নিশাত অনেকটা সুস্থ। তিতির বাপ-মায়ের মাথা থেকে পা পর্যন্ত টেষ্ট করেছে, যেখানে যা সমস্যা তার সমাধান করতে চেষ্টা করছে। বুবুন, লুম্বিনী, তুতুনের সাহচর্যে ভালো আছেন নাজমুল -নিশাত। তারপরও বাড়ি ফিরে যেতে চাচ্ছেন প্রবল ভাবে। জামাইয়ের বাড়িতে বেশি থাকা ভালো দেখায়না যদি জামাই-মেয়ের কোনো দরকার না থাকে। জামাইয়ের দুঃসময়ে নিজেদের হাজার সমস্যা থাকলেও চলে আসতে হয়, দেখাশোনা করতে হয়, এটাই নাকি উচিৎ।
তিতলী খুব ভালো একটা জব অফার পেয়েছে। মেয়েটার অ্যাকাডেমিক নলেজ,আউট নলেজ, ইংরেজিতে নলেজ_ সব নলেজই খুব ভালো।একজন ইঞ্জিনিয়ার হিসাবে সে আদনানের চেয়েও দক্ষ ছিলো।
সবার এক মত, তিতলী চাকরিতে জয়েন করুক। কিন্তু তিতলী মনস্হির করতে পারছেনা। সকাল নয়টা থেকে সন্ধ্যা ৬ টা পর্যন্ত অফিস। অরণ্য -অরণীর কি হবে? ওদের খাওয়া, গোসল, স্কুল,লেখাপড়া? দাদা -দাদির তো খেয়াল রাখার ইচ্ছা , চেষ্টা কিছু নেই। ময়না খালার মতো বিশ্বস্ত কেউ থাকলে হতো।
নিশাত বললেন, “এই যে আমরা এখানে, ইরফান -আয়মান বাসায়তো বুয়ার আন্ডারেই থাকে। ওদের বাপ-মা ভোরে বের হয়, রাতে ফিরে। ইরফান বড় হয়েছে, আয়মানতো ছোট। ওরা তো ঠিক সামলে নিতে পারে।তাহলে তোরা দুই বোন এতো খুঁতখুৃঁত করিস কেন?”
তিতলী বললো, ” আমার ভয় লাগে। আদনানের বন্ধুর বড় ভাই মেডিসিনের বড় ডাক্তার। ভাবী গাইনোকোলোজিস্ট। দু’জনেই মহা ব্যস্ত। দিন নাই, রাত নাই, বাইরে। এক ছেলে, ক্লাস সিক্সে পড়ে। ছেলের জন্য সাত সকালে টিউটর , তারপরে স্কুল, তারপরে কোচিং, বাসায় আসার পরে আবার
টিউটর। ছেলে সকালে পাউরুটি, মাখন দুধ খেয়ে যায়, সারাদিন ফাস্ট ফুড খাওয়ার জন্য যথেষ্ট টাকা দেওয়া হয়, সন্ধ্যা সাতটার দিকে এক বুয়া এসে ভাত তরকারি রেঁধে যায়। পরশু রাত দশটায় বাবা এসে বাসায় ঢুকেছে। কলবেল টিপছিলো, কেউ দরজা খুলেনি দেখে তালা খুলে ঢুকেছে।এসে দেখে ভাত, তরকারি কিছুই নাই।বুয়া আসে নাই। ছেলে বাথরুমে। শাওয়ারের আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। বিরক্ত বাপ ফ্রিজ খুলে ব্রেড বাটার খেয়ে ঘুম। মা এসেছে রাত বারোটায়। স্বামী ঘুম, ছেলে শাওয়ার নিচ্ছে রাত দুপুরে, বুয়া আসেনি যখন স্বামী -ছেলের একজন ভাতটাতো রেঁধে রাখতে পারতো রাইস কুকারে, আগের দিনের তরকারি ওভেনে গরম করে নিজেরা খেতে পারতো, মায়ের জন্যও কিছু রাখতো, তা না, স্বার্থপরের মতো একজন রুটি-মাখন খেয়ে ঘুমাচ্ছে , আরেকজন প্রায় দিনের মতো রাত দুপুরে শাওয়ার নিচ্ছে। মা রাগ করে এক গ্লাস দুধ খেয়ে ঘুমিয়ে পড়লো।ভোর পাঁচটায় মায়ের কাছে নার্সিং হোম থেকে ফোন আসলো।রোগীর ইমারজেন্সি সিজার লাগবে।মা কোনোভাবে ফ্রেশ হয়ে দৌড়ালো। বাপের ঘুম ভাঙলো সাড়ে সাতটায়। আটটায় অফিস। সেও হুড়মুড়িয়ে দৌড়ালো।দুপুর বারোটায় মায়ের মোবাইলে ফোন আসলো ছেলের স্কুল থেকে।দুইদিন ধরে ছেলে স্কুলে আসছেনা। গতকাল আসেনি,আজও না। মা ছেলেকে ফোন দিলো।রিং হয়,কেউ ধরেনা। মায়ের মেজাজ তখন তুঙ্গে। এক অপারেশন থিয়েটার নিয়ে দুই সিএ’র মধ্যে ঝগড়া। পরে মা ওটির দখল পেলো। অপারেশন শেষ হতে হতে বিকাল চারটা। এরমধ্যে সোসাইটির ম্যানেজারের ফোন। তাদের সদর দরজার ফাঁক দিয়ে পানি গড়িয়ে আসছে। মা বিরক্ত হয়ে তার স্বামীকে ফোন করতে বললো।দুনিয়ার সব হ্যাপা তাকে সামলাতে হয়। বাপ ম্যানেজারের ফোন পেয়ে জানালো সে চেম্বার মিস করতে পারবেনা,এখন যাওয়া সম্ভব না। সুতরাং মা’কে আবার ফোন। মা যেয়ে তালা খুলে ফ্ল্যাটে ঢুকলো। পচা পচা গন্ধ। পানি আসছে ছেলের রুম থেকে। বাথরুম বন্ধ। শাওয়ারের পানির আওয়াজ। বাথরুমের দরজা ভাঙা হলো। ছেলে মরে কাঠ হয়ে পড়ে আছে। তার অ্যাজমা ছিলো। পোষ্ট মর্টেমে জানা গেলো, আনুমানিক ৩২ ঘন্টা আগে ছেলের মৃত্যু হয়েছে বাথরুমে। আগের দিন সকাল দশটা -এগারোটার দিকে। বুয়া আসেনি, সন্ধ্যার টিউটরও আসেনি, পরের দিন সকালের টিউটর এসে দরজায় বেল দিয়েছিলো, কেউ দরজা না খোলায় বাচ্চাকে ফোন দিয়েছিলো, ছেলে ফোন না ধরায় টিউটরের কর্তব্য শেষ।
বোঝো কি অবস্থা। বাপ-মায়ের দায়িত্ব জ্ঞান আর ক্যারিয়ারের চিন্তা কোন লেভেলের। সারাদিন বাচ্চাকে দেখেনি, বাপ বা মা কেউ বাথরুমের দরজা ধাক্কিয়ে ছেলেটাকে ডাকেওনি। এখন মাতম করে কি হবে? এমন ক্যারিয়ারিস্টদের বিয়ে করা,বাচ্চা নেওয়া অপরাধ। বোথ মেল অ্যান্ড ফিমেল।”
সবাই স্তব্ধ হয়ে রইলো। কি মর্মান্তিক বাস্তব ঘটনা।
নিশাত নীরবতা ভঙ্গ করলেন।ফোন করলেন ইরফান -আয়মানকে। দু’জনের সাথেই কথা বললেন।এমনিতেই দিনে দুই তিনবার অন্ততঃ তাদের ফোন করেন, স্কুলে যাওয়ার আগে, স্কুল থেকে ফেরার পরে, রাতে।
তিতির বললো,”তুই জয়েন কর।আমি অরণ্য -অরণীকে স্কুল থেকে এনে এখানে রাখবো। তুই অফিস ফেরত নিয়ে গেলি, না পারলে আমি দিয়ে আসলাম। তোদের দুই গাড়ির একটা আমার এখানে পাঠাস। আটটায় স্কুল, ওদের বাপকে বলবি পৌঁছে দিয়ে আসতে, বারোটায় অরণী, দেড়টায় অরণ্যের স্কুল ছুটি। আমি বারোটার আগেই স্কুলে পৌঁছে যাবো।”
“একদিনের ব্যাপার না আপা। এভাবে হয়না।”
“না হওয়ার কারণ নেই। আমি তো এখন ডিম পাড়া মুরগির মতো ঝিমাইনা।”
“লুম্বিনী, তুতুন? ”
” ওদের এখন একাই পাঠাই গাড়িতে। দুই ড্রাইভারই বিশ্বস্ত। মায়ের অসুখের সময় থেকে একা ছেড়ে দিয়েছি। অতোসব চিন্তা করিসনা।জয়েন কর।”
নাজমুল সাহেব -নিশাত বললেন, “তোর উপরে চাপ বেশি হয়ে যাবেনা তিতির? ”
“না। যখন তোমাদের কাছাকাছি বাসায় থাকতাম, তখন অফিস থেকে ফিরে বুবুন -রাজ -লুম্বিনীর সাথে ইরফান আয়মানকেও সামলেছি। ”
তিতিরের ভীষণ পরিবর্তন হয়েছে। স্বাভাবিক ভাবে কঠিন সত্য বলতে পারে।
আদনান বাধ সাধলো তিতলীর চাকরিতে, “আমিতো অনেক কামাই করি, তোমার চাকরির কি দরকার? ”
তিতলী উত্তর দেয়ার দরকার মনে করলোনা।
“তোমার বোন একদিন বাচ্চাদের আনা নেওয়া করবে, দ্বিতীয় দিনে তার মাথা ব্যথা হবে, তৃতীয় দিনে পাগলামি উঠবে, তখন? ”
তিতলী কথা না বলে উঠে গেলো।এই টেনশন তারও হচ্ছে। আপার বাসায় একটা না একটা কিছু তো ঘটতেই থাকে।
লুম্বিনীর পুড়ে যাওয়ার ধাক্কাটা তিতিরের জন্য আশীর্বাদের মতোই অনেকটা। কঠিন মূল্য দিতে হয়েছে লুম্বিনীকে। দুই দফা প্লাস্টিক সার্জারি হলেও বেশ কিছু সমস্যা থেকে গেছে। তবে এই দুর্ঘটনা আর দুর্ঘটনা পরবর্তী সবার আচরণ তিতিরকে আমূল পাল্টে দিয়েছে। নরম সরম, মানুষের কথা গিলে হজম করা মেয়েটা পাথরের মতো শক্ত হয়ে গেছে, অসীম মানসিক শক্তির অধিকারী হয়েছে, পাথরের মতো মুখ করে সবার প্রতি দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে। পরিবর্তনটা অন্যদের জন্য খুব অস্বস্তিকর। নাজমুল -নিশাত -বুবুন অপরাধবোধে ভুগে, অনেকেই ভয় পায় যেমন বুবুনের চাচা-ফুপুর দল।আসিফও অস্বস্তিতে ভুগে।
লুম্বিনীকে হাসপাতাল থেকে বাসায় আনার পরে আসিফের ভাইবোনদের কি যে মাতব্বরি। দল বেঁধে আসবে, উহ-আহ্-ঈস করবে, কপালে কয়েকটা ভাঁজ ফেলে গভীর দুশ্চিন্তা দেখাবে, খাবে-দাবে, চা-নাশতার অর্ডার একটু পরপর। কিন্তু ভাইঝির জন্য এক হালি কলাটাও কিনবেনা।ভীষণ কৃপণ আসিফের ভাইবোনেরা। সেই সাথে মাতব্বর।
তৃতীয় দিনে লুম্বিনীকে ড্রেসিং করার সময় সেজ ননদ ভীষণ জ্বালাতে লাগলো। “এভাবে না, ওভাবে ব্যান্ডেজটা ঘুরাও। আরে করছো কি? এই ওষুধ কি এমনভাবে লাগায়? ” আরও নানা কথা।
তিতির ড্রেসিং থামিয়ে শান্ত গলায় বললো, ” আপনি এই রুম থেকে যান। আপনি ডাক্তার-নার্স কিছুই নন।জীবনে কারোর সেবাযত্ন করেননি।ওষুধের , ড্রেসিং এর কি বুঝেন আপনি? যান, বের হয়ে যান। যাওয়ার সময় রুমের দরজাটা লক করে দিবেন মনে করে।এই সাধারণ জ্ঞানটুকুও নেই আপনার,তাই বলা।”
“দুই পয়সার ডাক্তার, এতো সাহস, আমার সাথে বেয়াদবি ! ”
“বের হন। নইলে সিস্টারকে দিয়ে ধাক্কা দিয়ে আমি আপনাকে বার করাবো।”
একদিন দুপুরে ভাইবোনরা খাবার টেবিলে আসর গুলজার করছে, তিতির এসে দাঁড়ালো। আসিফের সামনেই বললো, ” এটা বিয়ে বাড়ি নয়। কোনো আনন্দ উৎসবের ঘটনাও ঘটেনি এখানে। প্রতিদিন আপনাদের আসার দরকার নেই। আপনারা না লুম্বিনীর এতোটুকু কাজে লাগেন, না বুবুন-তুতুনের উপকারে লাগেন। ময়না খালা,আমেনাকে অনেক পরিশ্রমের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। তাদের পরিশ্রম রোজ এসে একশো গুণ বাড়িয়ে দিবেননা। ”
অসভ্য ছোট ননদটা চেঁচিয়ে উঠেছিল রাগে, দেবরও, ” তোমার সাহস এতোটা বাড়লো কবে? আমাদের ভাইয়ের বাসায় আমরা আসবোনাতো তোমার বাপের গুষ্টি এসে বসে থাকবে? অ্যাই, আমরা সবাই আজ রাতে থেকে যাবো, বুঝেছো বড় আপা? যখন যার খুশি আসবো,থাকবো।দেখি, এই প্যাঁচা মুখি কি করে? ”
আসিফও একই সময়ে গর্জে উঠেছিলো,” আমার বাসায় আমার ভাইবোনদের অপমান করার সাহস কোথা থেকে আসে? ”
” আসলে তোমাদের মতো অসভ্য আচরণের অভ্যাস আমার নেই। থাকলে
জুতো দিয়ে মেরে তোমাদের মুখের মানচিত্র পাল্টে দিতাম। এখন ওঠো, বাড়ি থেকে বের হও। আল্লাহর কসম, না উঠলে তোমার ছোটো দুই ভাইবোনকে ঘাড়ধাক্কা দিয়ে আমি বের করে দিবো।আমার মেয়ে অসুস্থ , আর তোমরা দিন নাই, রাত নাই, ডাইনিং টেবিল দখল করে আড্ডা মারো? আর তোমাদের আড্ডা মানেইতো নিজেদের ছাড়া বাকি সবার নামে নিন্দা, মিথ্যা কথা। ওঠো।এই ক্রুসিয়াল পিরিয়ডে যন্ত্রণা করবেনা। বাড়ির সবার রেস্ট দরকার।”
ছোটোটা আবার চিৎকার করে বললো, ” অপদার্থ , চেহারা দেখলে ঘেন্না লাগে, নিজের অপরাধ ঢাকার জন্য এখন ভাব ধরেছে। ভড়ংবাজ। তুই নিজে যা এখান থেকে।”
তিতির শরীরের সবটুকু শক্তি দিয়ে চড় লাগালো ছোট ননদের গালে। কোথায় যে ছিলো এতো শক্তি ! বেয়াদব মেয়েটা চেয়ার থেকে পড়ে গেলো।ঠোঁট কেটে রক্ত বের হয়ে এলো গলগল করে। কেউ কিছু করার আগেই চুল ধরে হ্যাঁচকা টানে মেয়েটাকে মেঝে থেকে দাঁড় করিয়ে আরেকটা চড় কষালো তিতির। হাতে একটা ছুরি নিয়ে বললো, “আজ তোমার নোংরা জিভটা কেটে ফেলবো আমি।”
তিতির যে এমন করতে পারে, দুঃস্বপ্নেও কল্পনা করতে পারেনি আসিফ আর তার ভাইবোনেরা। ভীরু, মিষ্টভাষী, সবার সুখের জন্য প্রাণপাত করা এই মেয়েকে তারা চেনেনা। তিতির বলেছিলো ঠান্ডা গলায়, ” বুবুন -তুতুন আসার আগে সবাই বের হয়ে যাও। বাঁচতে চাইলে বেরিয়ে যাও।এই ছুরির পোচ দিতে এতোটুকু হাত কাঁপবেনা আমার। তোমরা জীবনে আমাকে শান্তি দাওনি,অসভ্যতা করেছো, মেনে নিয়েছি, কিন্তু আমার বাচ্চারা যেন রাহুমুক্ত থাকে। ওদেরকে আর কোনো গ্যাঞ্জাম ফেস করতে দিবোনা আমি।”
হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো আসিফ। বের হয়ে গিয়েছিলো বুবুনের চাচা-ফুপুর দল।
লুম্বিনীর ডাকে সম্বিৎ পেয়ে ওর ঘরে ঢুকেছিলো আসিফ,
“কি হয়েছে? ডাকছো কেন? ”
“তোমার ভাই বোনরা আমার মা’কে এতো বাজে বাজে কথা বলে, তুমি চুপ থাকো কেন? ”
“Mind your language. আমার ভাইবোন তোমার কি হয়? চাচা -ফুপু বলতে কষ্ট হয়? ”
“চাচা-ফুপু বলতে ঘেন্না লাগে । এখন তোমাকেও আমার ভালো লাগেনা। মা’কে বাজে কথা বলে সবাই পার পেয়ে যায় তোমার সামনে। শেম। দশজনের সামনে আমার নিরপরাধ মা’কে চড় মেরেছো তুমি। তুমি বিলো অ্যাভারেজ একটা মানুষ। তোমাকে আমি এক ফোঁটাও ভালোবাসিনা। ”
চলবে
#সংসার
পর্ব ৩০
ধারাবাহিক গল্প
নাহিদ ফারজানা সোমা
আদনানদের বাড়ি রণক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। আদনানের মা বিলাপ করে কাঁদছেন। আদনানও গজগজ করছে।
আদনানের মা কাঁদতে কাঁদতে বললেন, ” আমি বাসায় থাকতে স্কুল শেষে আমার নাতি নাতনি যাবে পরের বাড়ি? আমি তাহলে মানুষ না? তোর বাপ তাহলে মানুষ না? ”
তিতলী বললো, ” আপনারা এখন একটু আরাম করবেন। অরণ্য -অরণী আপনাদের দুপুরে বিশ্রাম নিতে দিবেনা।দেখেনইতো, কি চঞ্চল। আপনারা সন্ধ্যার চা খেতে খেতেইতো আমরা চলে আসবো, ইনশাআল্লাহ। ”
” তোমার বুড়ো বয়সে চাকরি নেওয়ার কি দরকার ছিলো? কি দেয়নি তোমাকে আমার ছেলে? এতো খাই খাই কেন? মন ভুলানো কথা বলতে এসেছো? আসল ব্যাপার আমি বুঝিনা? আমি মানুষ না? আমি ছেলেপেলে মানুষ করিনি? আমার কাছে আমার নাতি নাতনি অনিরাপদ? ”
তিতলী শান্ত গলায় বললো, ” একে একে আপনার প্রশ্নগুলোর উত্তর দিই। আমার বুড়ো বয়সেও চাকরি করা দরকার। আমি বিয়ের পরে কোন কর্তব্যে ত্রুটি রাখিনি, আপনার ছেলের ভালো-মন্দ খেয়াল করেছি, দুইটা সন্তানের জন্ম দিয়ে তাদের লালন পালন, বড় করা, পড়ানো, স্কুলে দেওয়া, অসুখ হলে চিকিৎসা একা হাতে করেছি, তাদের নিরাপত্তা নিয়ে যতোদিন টেনশন ছিলো ততোদিন অনেক অফার থাকলেও সেগুলো অ্যাকসেপ্ট করিনি,বাচ্চাদের প্রায়োরিটি দিয়েছি।যন্ত্রণা ছাড়া আপনারা কিছু না দিলেও বছরের পর বছর রান্না করে আপনাকে, আপনার অন্য দুই ছেলেমেয়ে,আপনার গুষ্টিকে খাইয়েছি। এখন আমি আমার টেকনিক্যাল নলেজ অ্যাপ্লাই করতে চাই।তাই বুড়ো বয়সে চাকরিতে ঢুকতে চাচ্ছি। বুড়ো বয়স আপনার মতো কূট কাচালি আর অন্যের ক্ষতি করে পার করতে চাইনা। আপনার ছেলে আমাকে কি দিয়েছে? সুখ -শান্তি -সম্মান-স্বীকৃতি কিছুই দেয়নি, তবে কিছু স্বার্থপর , কুটিল আত্মীয় স্বজন উপহার দিয়েছে।ভালো উপহার দুইটা দিয়েছে, আমার দুই ছেলেমেয়ে। খাই খাই স্বভাব আমার নেই , তাহলে অনেক আগেই আপনার ছেলেকে, তার বাড়ির দলিল,গাড়ি, টাকা পয়সা হাপুস হুপুস করে খেয়ে ফেলতাম যেমন ভাবে আপনি আপনার স্বামীকে খেয়ে ফেলেছেন।চতুর্থ প্রশ্নের উত্তর, আমি ভদ্র পরিবারের মেয়ে।তাই ভদ্র ভাবে কথা বলা আমার অভ্যাস, কারোর মন ভোলানোর দরকার আমার নেই। আপনি মানুষ কি না? ঠিক বুঝতে পারছিনা। না, আপনি আপনার ছেলেপিলেকে মানুষ করেননি। ছোটো ছোটো বাচ্চাদের পালার জন্য নিজের শাশুড়ি, ননদ, গরীব আত্মীয়কে ঝি’র মতো ব্যবহার করেছেন। সর্বশেষ প্রশ্নের উত্তর , হ্যাঁ , আপনার কাছে আমার ছেলেমেয়ে অনিরাপদ। আপনি টিভিতে বা আপনার কোনো আত্মীয়ের সাথে কূট কাচালিতে ব্যস্ত থাকবেন, ছেলেমেয়ে দুটো কি খেলো, গোসল করলো নাকি করলোনা, পড়ে হাত পা ভাঙলো কিনা, কিছুই আপনার চোখে পড়বেনা। আরও বড় বিষয়, ওরা আপনার কাছ থেকে গালাগালি, নোংরা ভাষা, গরীব মানুষদের ছোটো করে দেখা, গীবত করা,মিথ্যা বলা, হিন্দি সিরিয়াল দেখা শিখবে। ”
কুরুক্ষেত্র শুরু হয়ে গেলো। শাশুড়ি আর তাঁর ছেলে চিৎকার করতে থাকলেন গলা ছেড়ে। তিতলী বললো, “আস্তে।আশেপাশে ভদ্র মানুষরা থাকেন।”
শাশুড়ি গলা ছেড়ে বললেন, “আমার উপর ভরসা নেই। ভরসা অপয়া বোনের উপর যে নিজের ছেলেপুলেই সামলাতে পারেনা। অলক্ষুনে মহিলাটার কাছে বাচ্চাদের বড় কোন ক্ষতি হয়ে যাবে, আমার কথা মিলিয়ে নিস,আদনান।”
তিতলী চিবিয়ে চিবিয়ে বললো, ” আর একটা কথা আপনি বা আপনার গুষ্টির কেউ যদি আমার বোন বা অন্য কোন ফ্যামিলি মেম্বারদের সম্পর্কে বলেন, তাহলে আমি কতোটা ভয়ংকর হবো, আপনি কল্পনাতেও আনতে পারবেননা। আপনি খুব নীচ। আমার বিয়ের পর হতে যাবতীয় ডাক্তারি সুবিধা নিয়েছেন আমার অলক্ষুণে বোনের কাছ থেকে। তার কাছ থেকে আদর যত্ন, সম্মান, দাওয়াত, উপহার যা পেয়েছেন , নিজের মেয়ের কাছে তার ধারে কাছে কিছু পাননি। অকৃতজ্ঞ মানুষ একটা। আর আপনার পেট থেকে ভালো কি জিনিস ই আর বের হবে।”
রাজ্যের অশান্তি নিয়ে তিতলী চাকরিতে ঢুকলো। অরণ্য -অরণীকে নিয়ে তারও মন খুঁতখুঁত করছে গোড়া থেকে। আপার আন্তরিকতা নিয়ে তার টেনশন নেই, টেনশন হলো আপার কর্মদক্ষতা নিয়ে। কতোটুকু সামলাতে পারবে বাচ্চাদের? গোসল,খাওয়ার দিকে খেয়াল রাখতে পারবে ঠিকমতো?
এদিকে আসিফ জিজ্ঞেস করলো তিতিরকে, ” রেগুলার বোনের ছেলেমেয়েদের স্কুল থেকে আমার বাসায় নিয়ে আসবে, মুখে তুলে খাওয়াবে, গোসল করাবে, পড়াবে, আমার নিজের বাচ্চারা নেই? ”
“আছে। তারা ভালোই আছে।”
” কয়দিন ভালো থাকবে? পুরো বিকাল, সন্ধ্যা চারজন মিলে হৈ হৈ, খেলাধূলা। তুতুন, লুম্বিনী রেস্ট নিবে কখন? পড়বে কখন? ”
” বিকাল তো রেষ্ট নেওয়ার বা পড়ালেখার সময় না। এটা খেলারই সময়।”
” লুম্বিনী -তুতুন স্কুল থেকে ফিরে বিকাল পাঁচটায়। তারপর তাদের খাওয়া দরকার শান্তিমতো, রেষ্ট দরকার। তোমার বোনপো-বোনঝির জন্য সেটা সম্ভব হয়না। তাদের মনোরঞ্জনের জন্য তখন তুতুন -লুম্বিনীকে খাওয়া ফেলে খেলতে হয়।”
“এতে ওদেরও মনোরঞ্জন হয়। ”
“বাসায় এতো হৈ হুল্লোড় আমার পছন্দ নয়।”
” বাসায় তুমি থাকো রাত নয়টা দশটা থেকে সকাল আটটা পর্যন্ত । দুই একদিন বিকালে কিছুক্ষণের জন্য বাসায় এসেছিলে দরকারে।”
” আমার মূল বক্তব্য হলো,পরের জন্য যেন আমার ছেলেমেয়েদের কোনরকম ক্ষতি না হয়। মায়ের উদাসীনতার জন্য আবার কারোর গায়ে গরম তেল না পড়ে, কারোর মাথা না ফাটে।”
“খুব ভালোই জানো, লুম্বিনীর অ্যাকসিডেন্ট আমার অবহেলায় ঘটেনি। বারবার এ কথাটা বলো নিজের সুবিধার জন্য। বৌ তোমার যত্ন আত্তি করেনা, মা হিসাবেও খুব খারাপ, ছেলের বৌ-ভাইয়ের বৌ হিসাবে তো পৃথিবীর নিকৃষ্টতম মেয়ে। জেনেশুনে এগুলো বারবার বলো নিজের একটা ব্যাকগ্রাউন্ড তৈরির জন্য। গত তিন বছর ধরে নোংরামি চালিয়ে যাচ্ছো মেয়ের বয়সী ডিউটি ডাক্তার নাজলীর সাথে, এটার পেছনে একটা রিজন দেখাতে হবেনা? ”
আসিফ ভয়ংকর চমকে উঠলো।
“তোমার মতো নোংরা লোকের সাথে তাও আছি, ঘটনা জানলে বুবুন, লুম্বিনী, তুতুন খুব হার্ট হবে, সেজন্য। মেয়েটাকে বিয়ে তুমি করবেনা কারণ মেয়েটা তোমার জৈবিক চাহিদা পূরণের একটা মাধ্যম বই আর কিছু নয়। তোমার রেপুটেশন তুমি খারাপ করবেনা। ঐ মেয়ের সাথে মেন্টাল অ্যাটাচমেন্টও তোমার নেই কারণ তুমি খুব ভালো জানো, ঐ মেয়ে তোমাকে ভালোবাসেনা, ভালোবাসে তোমার রেপুটেশন এবং প্রপার্টি। ঐগুলোর জন্য সে শকুনের মতো অপেক্ষা করছে। দুই দুশ্চরিত্রের মিলেছে ভালো।”
আসিফ হতভম্ব। তিতিরের প্রতিটা কথা সত্য। কিন্তু এগুলো কেউ জানেনা। কেউ না। আসিফ খুব সতর্ক এই বিষয়ে। তাহলে তিতির আদ্যোপান্ত জানে কিভাবে?
চলবে।