সংসার সমরাঙ্গন পর্ব-০২

0
15

#সংসার_সমরাঙ্গন (০২)
রূপন্তি রাহমান (ছদ্মনাম)

ডাইনিং এর পরিবেশ মুহুর্তে থমথমে হয়ে গেলো। আচমকা তনয়া এমন একটা কান্ড ঘটাবে তা কেউই কল্পনা করেনি। ক্রোধে উত্তাল হয়ে উঠলেন মেহেরুন্নেসা।

ক্রোধ দমিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে উচ্চারণ করলেন,

‘তুই কি তোর বউকে কিচ্ছু বলবি না মাহমুদ?’

মাহমুদ বলার আগেই জবাব দেয় তনয়া।

‘বউকে বলার আগে অবশ্যই মাকে বলতে হবে। কারণ শুরুটা মা’ই করেছে।’

‘তোমার এতোবড় সাহস তুমি আমার মায়ের মুখে মুখে তর্ক করছো?’

‘এটা তোমাদের বংশগত পরম্পরা মুনিরা। তোমাদের বংশের বউরা বিয়ে হয়ে এসেই শ্বাশুড়ির সাথে গলাবাজি করে। বিশ্বাস না হলে তোমার মাকে জিজ্ঞেস করো। সেই তুলনায় আমি তো তিন বছর সময় নিয়েছি।’

‘তুই এখনো কাপুরুষের মতো চুপ থাকবি? কিচ্ছু বলবি না? তোর বউ যা নয় তাই বলে যাচ্ছে।’

বিষন্ন হাসি ফোটে ওঠে তনয়া মুখে। অভিমানের ঝড় ওঠে কণ্ঠনালিতে।

‘বউয়ের প্রতি অন্যায় হওয়া দেখেও যে পুরুষ চুপ থাকে সে কাপুরুষ বৈ সুপুরুষ নয়।’

কথাটা ইগোতে লাগে মাহমুদের। চোখ গরম করে সে তনয়ার দিকে তাকালো।

‘এবার কিন্তু বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে তনয়া। সংযত হও।’

‘তোমার মা যখন অযথাই রান্নায় একের পর এক ভুল ধরছিলো তখন বাড়াবাড়ি ছিলো না?’ তনয়ার কন্ঠে বাঘিনীর মতো তেজ।

এতকিছুর মাঝে নিজের মতো খেয়ে চলেছেন খালেকুজ্জামান। এসবে যেন তার কিছুই যায় আসে না এমন একটা ভাব। এমন একটা দৃশ্য যেন মেহেরুন্নেসার রাগকে আরো উত্তপ্ত করে ফেলল।

‘তোমার সামনে তোমার ছেলের বউ আমার সাথে তর্ক করছে আর তুমি গোগ্রাসে গিলে যাচ্ছো। তোমার ছেলের মতো তুমিও চুপ থাকবে?’

প্লেটের অবশিষ্ট খাবারটুকু খেয়ে নিলেন খালেকুজ্জামান। হাত ধুয়ে উঠে দাড়ালেন তিনি।

‘চুপ তো আমি ত্রিশ বছর আগেও ছিলাম। তখন যেহেতু কিছু বলতে পারিনি। আমি আজও কিছু বলতে চাই না।’

তিনি দাঁড়ালেন না আর হনহনিয়ে চলে গেলেন কক্ষে।

থাকলেন না মেহেরুন্নেসাও। খাওয়া অসমাপ্ত রেখেই মুনিরার হাতটা চেপে ধরে স্থান ত্যাগ করলেন তিনিও।

হাতটা ধুয়ে উঠে দাঁড়ায় মাহমুদ। স্থির কন্ঠে বলল,

‘তোমার জন্য কতগুলো মানুষ অভুক্ত থাকবে। কাজটা কি ঠিক করলে?’

একপেশে চোখে তাকালো তনয়া।

‘আমি কিছুই করিনি। এটা যার যার কর্মফল।’

_____________________

রাতের ঘড়ির কাঁটা তখন বারোটার ঘর ছাড়িয়েছে। ঘড়ির কাঁটার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তনয়াকে হেনস্তা করার ফন্দি আঁটায় ব্যস্ত মেহেরুন্নেসা। আচমকা তনয়ার এমন প্রতিবাদী কন্ঠ তিনি কোনোমতেই মেনে নিতে পারছেন না। মনে মনে পণ করলেন আজকের ঘটনার জন্য একটা শিক্ষা তিনি তনয়াকে দিবেনই।

‘খিদেয় পেট চুঁ চুঁ করছে আম্মা।’ পেট চেপে বলে উঠে মুনিরা।

তিনি উষ্মা প্রকাশ করলেন। তার ভ্রু বিরক্তির ভাঁজে কুঁচকে গেলো।

‘সারাদিন খাই খাই ছাড়া তোর কোনো কাজ নেই? বিস্কুট আছে যা বিস্কুট খা।’

‘ভাতের খিদে বিস্কুটে মিটবে না।’

‘তাইলে এককাজ কর আমার মাথা চিবিয়ে খা।’

মুখ কালো করে ফেলে মুনিরা। দরজায় ঠকঠক শব্দে নড়েচড়ে বসে দুজন।আবারও ঠকঠক শব্দ হতে মুনিরা বলে উঠে,

‘কে?’

‘আম্মাকে নিয়ে ভাত খেয়ে নাও মুনিরা। তরকারিতে আর বাড়তি ঝোল নেই। তাও না খেলে বলো। পেঁয়াজ কাঁচামরিচ কে’টে রেখে এসেছি। ডিম ভেজে দিবো।’

‘এতো দরদ দেখাতে হবে না। দরদ থাকলে তখন ওভাবে তরকারিতে পানি ঢেলে দিতে না। তুমিই গিলো।’

তনয়া ক্ষুব্ধ হলো। কিন্তু নিজের ক্ষোভ গোপন করে শান্ত গলায় উত্তর দিলো,

‘দরদ দেখানোর মতো মানুষও না তোমরা। পেঁয়াজ আর কাঁচামরিচ ফ্রিজে রাখছি। ইচ্ছে হলে ডিম ভেজে খেয়ে নিও।’

_____________

অন্ধকারে কপালে হাত ঠেকিয়ে শুয়ে আছে মাহমুদ।
প্লেট হাতে রুমে প্রবেশ করে তনয়া। ওয়ারড্রবের প্লেটটা রেখে আলো জ্বালালো। কপাল থেকে হাত সরায় মাহমুদ। তনয়াকে এক পলক দেখে পাশ ফিরে মুখ ঘুরিয়ে নিলো সে।

‘ভাত নিয়ে এসেছি। খেয়ে নাও।’

‘খিদে নেই আমার।’

‘প্রতিবাদ করায় খুব গায়ে লেগেছে বুঝি?’

মাহমুদ উঠে বসলো। গাম্ভীর্যে ভারী কন্ঠে বলল

‘আজকের কান্ডটা না ঘটালেই পারতে।’

‘দিনের পর দিন আমি যখন অকারণে কথা শুনেছি তখন মনে হয়নি এসব ঠিক হচ্ছে কিনা? আমরা সমবয়সী বলে এটা নিয়েও কথা শুনিয়েছে তোমার মা। তখনও তুমি চুপ ছিলে।’

তনয়া উত্তরের আশা করলো না। ওয়ারড্রব থেকে চাদর বের করে ফ্লোরে বিছিয়ে নিলো। বালিশে হাত দিতে মাহমুদ ঝট করে হাতটা ধরে ফেলে।

‘পাগলামি না করে বিছানায় শুয়ে পড়ো। ফ্লোরে ঘুমালে তোমার ঠান্ডা লেগে যাবে।’

‘কোথায় ঘুমালে আমার কি হবে তোমার এতো চিন্তা না করলেও চলবে।’

নত স্বরে মিনমিন করে জবাব দেয় মাহমুদ,

‘তোমার চিন্তা আমি না করলে আর কে করবে?’

‘আমার জন্য তোমার আদৌও চিন্তা হয়?’

মাহমুদের হাত থেকে আস্তে করে হাতটা ছাড়িয়ে নিলো তনয়া। তার কন্ঠে অভিমানের ভার যেন আরো স্পষ্ট হয়ে উঠল।

‘মাহমুদ, এক বিছানায় ছ-সাত ঘন্টা ঘুমালেই স্বামী হওয়া যায় না। স্বামী হতে গেলে দায়িত্বও পালন করতে হয়।’

হতবুদ্ধি চোখে তনয়ার বিবর্ন মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো সে। নির্লিপ্ত কণ্ঠে বলল,

‘তুমি কি চাও আমি মায়ের সঙ্গে ঝগড়া করি?’

উল্টোদিকে মুখ করে শুয়ে পড়ে তনয়া। ম্লান হয়ে উঠে তার কন্ঠ।

‘ঝগড়া করার কথা তো আমি বলিনি। শুধু চাই ঠিক টা কে ঠিক আর ভুল টা কে ভুল বলো।’

মাহমুদ ফিচেল হাসলো।

‘সেটা করতে গেলেই তো ঝগড়া বেঁধে যাবে। তার চেয়ে ভালো না চুপ থাকা?’

তনয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলে। ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি নিয়ে বলল,

‘এক নারীর কাছে বাধ্য সন্তান হতে গিয়ে আরেক নারীর কাছে স্বামী হয়ে উঠতে পারো না। পারো না ব্যালেন্স করতে কোনো সম্পর্ককে।

‘আজ তো করলে প্রতিবাদ। আর কি চাও।’

পাশ ফিরে তাকালো সে।

‘যেদিন শুরু হয়েছিল সেদিন আমার ঢাল হয়ে দাঁড়ালে আজ আমাকে এমন রূঢ় প্রতিবাদ করতে হতো না। সহ্য করতে করতে পিঠ দেয়ালে ঠেকেছে আমার। আর পিছানোর সুযোগ নেই। এখন সামনে পা বাড়িয়ে প্রতিবাদ করার পালা।’

‘এমন করো না তনয়া। তারা বয়স্ক মানুষ। বদদোয়া লেগে যাবে।’

তীক্ষ্ণ বিদ্রুপে ভরা হাসি দিলো তনয়া।

‘বদদোয়া লাগার জন্য বয়স্ক হতে হয় বুঝি?’

মাহমুদ মাথা নিচু করে ফেলে।

‘আমি যে এতোগুলো দিন মানসিক অত্যাচার সহ্য করলাম তার বেলায় বদদোয়া লাগবে না মাহমুদ? রুহের হায় বলে তো একটা কথা আছে।’

‘উনি আমার মা তনয়া।’ মাহমুদের অসহায় কন্ঠ।

‘আর আমি কে?’

মাহমুদ শূন্য চোখে চেয়ে রইলো।

‘বাজি ধরে ছিলে না আমার সাথে?’

কুণ্ঠায় দৃষ্টি নামিয়ে নিলো মাহমুদ।

‘ বলেছিলে না মুখে বকাবকি করলেও আমাকে ভীষণ ভালোবাসে তোমার মা। প্রেডিকশন দিয়েছিলে না কথাটা বলার সাথে সাথে তেড়ে আসবে তোমাকে মা*র*তে। বাস্তবতা দেখলে? আমাকে কতটা অপছন্দ করেন তিনি।’

মুখটা আরো ম্লান হয়ে গেলো মাহমুদের।

‘তোমার প্রেডিকশন না মিললে আমি কি করবো বলেছিলাম মনে আছে তোমার? এখন থেকে সেটাই হবে।’

মাহমুদ কাতর চোখে তাকাতেই তনয়া অস্পষ্ট হাসি দিলো।

‘প্রতিবাদ! এখন থেকে যখনই আমার সাথে অন্যায় হবে তখনই আমি প্রতিবাদ করবো। গত তিনবছরে যখন আমার হয়ে দুটো কথা তুমি বলতে পারোনি। এখন আমার ব্যাপারটা না হয় আমাকেই বুঝে নিতে দাও।’

__________________

মধ্যরাত! দরজায় ধড়াম করে শব্দ হতেই ধড়ফড়িয়ে উঠে বসেন খালেকুজ্জামান। আকস্মিক ঘুম ভেঙে যাওয়ায় শরীর কাঁপছে তার। অন্ধকারে ঘামছেন ভয়ে।

মেহেরুন্নেসা আলো জ্বালাতেই দেখা গেলো খালেকুজ্জামানের চোখেমুখের আতঙ্ক।

মেহেরুন্নেসা হনহনিয়ে এসে খালেকুজ্জামানের সামনে দাঁড়ালেন। বিস্ফোরিত কন্ঠে বললেন,

‘তোমার ছেলের বউয়ের এতো বাড় বেড়েছে এই মুহুর্তে যদি তুমি এর কোনো বিহিত না করো তাহলে এই সংসারে হয় ওই মেয়ে থাকবে নয় আমি।’

নির্বোধের মেহেরুন্নেসার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন তিনি। মস্তিষ্ক ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। পাশে ছোট্ট টেবিলে ঢেকে রাখা পানির গ্লাস হাতে নিয়ে এক ঢোকে খালি করে ফেললেন সেটা। চোখ বুঁজে ধাতস্থ করলেন নিজেকে। মস্তিষ্ক শরীর স্বাভাবিক হতেই জিজ্ঞেস করলেন,

‘কী হয়েছে?’

তিনি ফুঁসতে ফুঁসতে জবাব দেন,

‘আমরা নাকি দরদ দেখানোর মতো মানুষ না। কোন পাকা ধানে মই দিয়েছি আমি তোমার ছেলের বউয়ের?’

‘কেন বলেছে এই কথা?’

মুখ ঘুরিয়ে অন্যদিকে তাকালেন মেহেরুন্নেসা। মুখ ভারী করে উত্তর দেন,

‘খাওয়ার জন্য ডাকতে এসেছিল।’

খালেকুজ্জামান দীর্ঘশ্বাস ফেলেন।

‘বহুবছর আগে যখন মায়ের সাথে তোমার তর্ক বিতর্ক হতো কোনোদিন ডেকেছো খাওয়ার জন্য?’

তিনি আরো ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলেন,

‘আশ্চর্য এতোবছর আগের কথা এখন তুলছো কেন? তাছাড়া সবসময় দোষ তোমার মায়ের থাকতো।’

‘বহুবছর আগের ঘটনায় তোমার শ্বাশুড়ির দোষ থাকলে আজকের ঘটনায় তোমার ছেলের বউয়ের শ্বাশুড়ির দোষ। তাও কপাল ভালো তোমার ছেলের বউ তোমাকে খাওয়ার জন্য ডেকেছে। আমার মায়ের নসীবে তো এটাও জুটেনি।’

দাঁতে দাঁত পিষেন মেহেরুন্নেসা।

‘এতো কান্ড ঘটালো তোমার ছেলের বউ। কিচ্ছুটি বলবে না তুমি? এই সংসারে আমার কি কোনো মূল্য নেই?’

‘বহুবছর আগে আত্ম অহমিকা আর সাদা চামড়ার দোহাই দিয়ে মাকে দিয়ে সমস্ত কাজ করাতে আমি তখন নিরব দর্শকের মতো দেখতাম। সময়ে পরিক্রমায় আজ তুমিও শ্বাশুড়ি হয়েছো। আমি আজও দর্শকের মতো সব দেখবো।’

‘তার মানে,,

‘তার মানে হচ্ছে এই সব তোমারই কর্মফল।’

খালেকুজ্জামান কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লেন। চট করে কাঁথা থেকে মাথা বের করে তাকালেন তিনি।

‘ঘুমানোর আগে আরো একটা কথা বলি তোমাকে। বাংলায় একটা প্রবাদ আছে, “খড়ি আনে চুলোর মুখ, শ্বাশুড়ি আনের বউয়ের মুখ।” সুতরাং তোমার ছেলের বউকে তুমিই প্রতিবাদী বানিয়েছো।’

#চলবে