#সংসার_সমরাঙ্গন (১৫)
রূপন্তি রাহমান (ছদ্মনাম)
তনয়া একেবারে থমকে গেলো। মেহেরুন্নেসার মুখে এমন কটু কথা শুনবে কল্পনাও করেনি সে। তাকে কেন এতো কুৎসিত আর বিদঘুটে নাম দেওয়া হচ্ছে বুঝতে পারছে না। মনে হচ্ছে চারপাশের সবকিছু তালগোল পাকিয়ে গেছে।
‘আপনি এসব কি বলছেন আম্মা?’ গলা কাঁপছিলো তনয়ার।
তিনি কপাল চাপরে কেবল আহাজারি করছেন।
‘আল্লাহ, আল্লাহ তুমি বাঁচাও। আমার স্বামীর সারাজীবনের সঞ্চয়। আল্লাহ আমার স্বামী যেন এই কালনাগিনীর ফাঁদে পা না দেয়।’
‘মাহমুদের মা তুমি কি পাগল হয়ে গেলে? আন্দাজে কিসব বলছো তুমি? তুমি আদৌও সব শুনেছো ও কি বলেছে?’ খালেকুজ্জামানও অবাক না হয়ে পারলেন না।
মেহেরুন্নেসা মেঝেতে লুটিয়ে পড়লেন। যেন ভেঙে পড়েছে সমস্ত জগৎ। উদ্ভ্রান্তের মতো আচরণ করছেন তিনি। হইচই শুনে মাহমুদ আর মুনিরাও বেরিয়ে এলো।
‘আমি কিছু শুনতে চাই না! আজ স্পষ্ট বুঝছি, মেয়েটা টাকার লোভে তোমাকে বশে রেখেছে। ওর নজর শুধু তোমার টাকায়। আমার মেয়েকে সরিয়ে দিয়ে সংসারটা দখলে নিয়ে আমার ওপর শাসন চালাতেই সব চালাচ্ছে।’
‘এমন করছো কেন আম্মা? কি হয়েছে?’ -কিছু বুঝতে না পেরে প্রশ্ন করলো মাহমুদ।
‘তোর বউ! তোর বউ বসে আছে তোমার বাপের পেনশনের টাকা গুলো আত্মসাৎ করার জন্য। আল্লাহ! ও আল্লাহ! তোমার কাছে লাখ লাখ শুকরিয়া সহজ সরল মানুষটার ব্রেইন ওয়াশ করার আগেই আমি সব শুনে ফেলেছি।’
‘মাহমুদের মা তুমি শান্ত হও। তুমি সবটা শুনোনি। তনয়া এমন কিছুই বলেনি।’
‘তনয়া! তুমি আব্বাকে কি বলেছো? আব্বার পেনশনের টাকার কথা কেন আসছে?’
‘ তোমায় সবটা বুঝিয়ে বলছি আমি।’
‘তুমি আমার ছেলেকে কী বুঝাবে? আমি সব শুনেছি। খবরদার আমার ছেলেকে উল্টো পাল্টা কিছু বলবে না।’
‘আম্মা এবার কিন্তু আপনি বাড়াবাড়ি করছেন। সংযত হয়ে কথা বলুন।’
মেহেরুন্নেসা উঠে এলেন। তনয়ার সামনে এসে দাঁড়ান। চোখ দিয়ে তার আগুনের ফুলকি ছুটছে। রাগে কাঁপছেন তিনি।
‘চুরি তো চুরি, আবার সিনাজুড়ি! কাকে ধমকাচ্ছো তুমি?’
‘না আমি চুরি করেছি আর না আপনাকে ধমকাচ্ছি। শুধু বলছি সংযত হয়ে কথা বলুন। আপনি সেন্সে নেই এখন।’
‘সেন্স আমার ঠিকই আছে। তাই তো সময়মতো তোমার ছলচাতুরী ধরতে পেরেছি। লোভী মেয়েছেলে কোথাকার। টাকার গন্ধ পেলে লালা পড়ে জিহ্বা দিয়ে।’
‘আম্মা!’ চিৎকার করে উঠলো তনয়া।
‘কে লোভী? আমি? আমি লোভী হলে আমার ক্যারিয়ার ছেড়ে এই সংসার গাধারখাটুনি খাটছি? দিনরাত আপনার কথা হজম করছি? আপনার নামের পাশে শোভা পাওয়া শব্দগুলো জোরপূর্বক আমার নামের পাশে বসাবেন না।’
‘কি বলতে চাইছো তুমি? আমি লোভী?’
‘আমার বলা না বলায় কিছু যায় আসে না। আপনার কথাবার্তা আর আচার-আচরণে সব প্রকাশ পায়।’
মাহমুদ তনয়ার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল। চোখ দুটো সংকীর্ণ হয়ে এসেছে। কুঁচকে আছে ভ্রুযুগল। শক্ত হয়ে গেছে তার চোয়াল। নিজেকে সংযত রাখার চেষ্টা করছে সে। তার গলায় কাঁপুনি নেই। বরং স্বরটা আগের চেয়ে গভীর ও ঠান্ডা হয়ে গেছে—যে ঠান্ডায় ঝাঁজ লুকিয়ে থাকে।
‘তনয়া, মুখ সামলে কথা বলো। তুমি কিন্তু আমার মায়ের সাথে কথা বলছো।’
তার কণ্ঠস্বর ভারী, অথচ বিপজ্জনকভাবে নিচু। শিরদাঁড়া সোজা, বুক দ্রুত ওঠানামা করছে, কিন্তু হাতে কোনো অনিয়ন্ত্রিত নড়াচড়া নেই। এই নিয়ন্ত্রিত রাগটাই যেন সবচেয়ে ভয়ংকর। এক মুহূর্তের জন্য তার ডান হাতের আঙুলগুলো মুষ্টিবদ্ধ হলো। তারপর আবার আলগা হয়ে গেলো। চোখেমুখে দৃঢ়তা। কিন্তু দৃষ্টিতে এমন এক শীতল হুঁশিয়ারি। যেন যে-কেউ এতে জমে যাবে।
ঘরটা এক মুহূর্তের জন্য থমথমে হয়ে গেল। চকিত চোখে তাকিয়ে আছে তনয়া। মাহমুদের এমন রাগী দৃষ্টি তাকে অবাক করে দিচ্ছে।
‘তোমার এই গলার জোর এতোক্ষন কোথায় ছিলো?’ খুব শান্ত গলায় জানতে চাইলো তনয়া।
মাহমুদ অগ্নি দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে।
‘আমি জানতে চাইছি, তোমার এই গলার জোর এতোদিন কোথায় ছিলো?’ চিৎকার করে উঠলো সে। রাগে থরথর করে তার শরীর কাঁপছে।
‘তুমি তার মাকে লোভী বলে আখ্যায়িত করবে আর সে চুপ থাকবে?’
‘মা যে তার বউকে কালনাগিনী, লোভী বলে আখ্যা দিলো সে বেলায়?’ টলমল চোখে মেহেরুন্নেসার দিকে চেয়ে ক্লান্ত কন্ঠে ফিরতি প্রশ্ন করে তনয়া।
এক পা দুই পা করে এগিয়ে মাহমুদের মুখোমুখি এসে দাঁড়ায় সে। রাগে দপদপ করে জ্বলতে থাকা মাহমুদের চোখজোড়ায় নিবন্ধ করে তার টলমল চোখ।
‘আমায় যখন কথাগুলো বলল তখন গায়ে লাগেনি তোমার? তখন রাগ হয়নি তোমার? লোভী কে আমি? এই লোভী কে?’
মাহমুদের কলার চেপে ধরে তনয়া। খালেকুজ্জামানকেও তোয়াক্কা করলো না সে।
এককোনায় গুটিসুটি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে মুনিরা। ভয়ে গলা দিয়ে কোনো শব্দ বের হচ্ছে না তার। ড্রয়িং রুমটা যেন ছোটখাটো রণক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। তনয়া অতর্কিত মাহমুদর কলার চেপে ধরতেই চমকে উঠলো।
মেহেরুন্নেসা যেন আকাশ থেকে পড়লেন। বিস্ময়ে হা হয়ে গেলো তার মুখ।
‘এই অসভ্য মেয়ে তোমার সাহস তো কম না। তোমার শ্বশুর এখানে দাঁড়িয়ে। আমি আছি। তুমি আমার ছেলের কলার ধরো। এই সাহস তোমায় কে দিয়েছে?’
‘আমাদের স্বামী স্ত্রীর মাঝে আপনি নাক গলাবেন না।’
তেতে উঠলেন তিনি। ফুঁসতে ফুঁসতে বললেন,
‘মাহমুদের বাবা দেখলে তুমি? তোমার সামনে আমায় কিভাবে বললো। তারপরও তুমি কিছু বলবে না? সং এর মতো দাঁড়িয়ে থাকবে?’
তনয়ার এমন রণমুর্তি দেখে অবাক চোখে তাকিয়ে আছেন খালেকুজ্জামানও। সবকিছু ছেড়ে ছুড়ে যেন আজ তার রাগটাই প্রাধান্য পাচ্ছে বেশি। গ্রাহ্য করছে না কাউকেই। হয়তো ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙেছে। নয়তো চুপ থাকতে থাকতে দেয়ালে পিঠ ঠেকেছে।
‘আমার এখানে কিছুই বলার প্রয়োজন মনে করছি না। আজকাল তোমরা নারীরাই তো সর্বেসর্বা। সংসারে পুরুষদের তোমরা গোনায় ধরো নাকি তাদের কথার দাম দাও? দুটো ধমক আর একটু চেঁচিয়েই মনে করো তোমরাই সংসারের সব। তোমাদের কথাতেই পুরুষরা চলবে।’
খালেকুজ্জামানের কথার দিকে ধ্যান নেই তনয়ার। সে কেবল মাহমুদের কাছ থেকে উত্তর চায়।
‘কি হলো উত্তর দিচ্ছো কেন? আমি বললাম ওমনি গায়ে লেগে গেলো। তোমার মা যে আমায় আগে বললো সে বেলায় গায়ে লাগেনি? হাত পুড়িয়ে রান্নার পরও হাজার কথা হজম করেছি। একা হাতে সংসারটা গুছিয়ে রাখার পরও তোমার মায়ের রোষানলে দগ্ধ হয়েছি বারংবার। তখন তোমার গলার জোর কোথায় ছিলো? মায়ের বদদোয়া লেগে যাবে বউয়ের আহাজারি লাগবে না?’
তনয়া থামলো। হাত ছাড়িয়ে নিলো কলার থেকে। তখনই নজর গেলো ফোস্কা পড়া জায়গাটায়। কখন যে চাপ লেগে ফোস্কা টা গলে গিয়েছে পায়নি সে। হয়তো বা রাগের কাছে যন্ত্রণাও ঘেঁষতে পারেনি।
‘দিনের পর দিন তুমি চুপ ছিলে। মায়ের বয়স হয়েছে। মা এ্যান। মা হ্যান। এসব বলে গা বাঁচিয়ে চলেছো।’
হাতটা মাহমুদের সামনে ধরে তনয়া। চোখের ইশারা করে হাতের দিকে। মাহমুদের চোখ সেদিকে যেতেই আঁতকে উঠলো সে।
‘কাল সারাদিন খাটুনির পরে যখন হাতে গরম তেল পড়ে তখন তোমার মা কি বলেছিলো মনে আছে? তখন তো তোমার মায়ের বলা বন্ধ করতে পারোনি। তোমার গলায় এমন জোর ছিলো না। কোনোদিন তোমার মায়ের করা অন্যায়ের প্রতিবাদও তুমি করতে পারোনি। কেন? আমি পরের মেয়ে তাই? আজ আমি একটু বললাম ওমনি গায়ে ফোস্কা পড়ে গেলো?’
বলতে বলতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে তনয়া। গলা শুকিয়ে এসেছে, শ্বাস ভারী হয়ে উঠেছে তার। তিন বছরের চেপে রাখা রাগ, অভিমান—সব উগলে দিচ্ছে একসাথে। যেন এতদিন ধরে জমে থাকা আগুন আজ আর আটকে রাখা সম্ভব হচ্ছে না।
‘আজ তুমি তোমার মায়ের চোখে সুপুরুষ হলেও মনে রাখবে স্ত্রীর চোখে তুমি কাপুরুষ।’
‘এক চড়ে তোমার সব দাঁত ফেলে দিবো তনয়া। আমার ছেলেকে উল্টোপাল্টা কিছু বললে আমি কিন্তু সহ্য করবো না।’
‘এই! আমি আপনাকে চুপ থাকতে বলেছি না? একদম চুপ থাকবেন। আমাদের মাঝখানে একটা নিঃশ্বাসও ফেলবেন না। তিনবছরে অনেক বলেছেন। আজ আমার পালা।’
মেহেরুন্নেসা তেড়ে আসতে নিলেই তনয়া আরো গর্জে ওঠে।
‘যেখানে আছেন সেখানেই থেমে যান। আপনার নাড়ি নক্ষত্র সব আমার মুখস্থ। আপনার বিয়ের পর দাদির সাথে কি করেছেন সব জানি। আপনার শ্বাশুড়ির সাথে করা ব্যবহারটা আমি আপনাকে ফিরিয়ে দিতে পারতাম সেটাই উচিৎ হতো আপনার জন্য। আফসোস মায়ের দেওয়া শিক্ষার জন্য আমি সেটা করিনি।’
মাহমুদ সহ হতভম্ব উপস্থিত সকলেই। আজ এক অন্য তনয়াকে দেখছে তারা। রাগের উত্তাপ এতোটাই যে সকলের বলা বন্ধ হয়ে গেলো। মাহমুদ কেবল এক আকাশসম বিস্ময় নিয়ে দেখছে। যেন তার এতোদিনের চেনা তনয়া আর আজকের তনয়ার মধ্যে আকাশ-পাতাল পার্থক্য।
‘আমি কখনো জবাব দিয়েছি, কখনো চুপ থেকেছি—কারণ আমারও মা আছে, ভাইয়ের স্ত্রী আছে। ভাই দেশে নেই, আমি যা করব, তা হয়তো আমার মায়ের সঙ্গেও হতে পারে। তোমার মা কিছু না জেনেই এত কথা বললেন—তিনি কি জানেন, আমি আব্বার সাথে কী নিয়ে কথা বলছিলাম? আর আব্বা কি এতটাই বোকা যে অকারণে তার সব টাকা আমাকে দিয়ে দেবেন?’
‘জ্ঞান দিতে এসেছে। আমার মেয়ের চরিত্রে কলংক লাগাতে চেয়েছিলো তাকে মনে হয় এমনি এমনি ছেড়ে দিবো। বুঝবে কি করে সন্তানের নামে কিছু বললে মায়ের কেমন লাগে। সন্তানের মর্ম বোঝার ক্ষমতা আছে নাকি। বাঁজা মেয়ে একটা। তিন বছর হয়ে গেলো এখনো নাতি নাতনির মুখ দেখাতে পারলো না আমায়।’
তনয়া শীতল চোখে মেহেরুন্নেসার দিকে তাকালো। ‘বাঁজা মেয়ে’ শব্দটা এতোটাই বিষাক্ত যে তনয়ার অস্তিত্ব বরাবর আ*ঘা*ত করে। কোনো মেয়েকে মানসিক ভাবে তিলে তিলে মে’রে ফেলতে এই একটা কথাই যথেষ্ট।
তনয়া অপেক্ষা করলো মাহমুদের। তার উত্তরের। এক মিনিট! দুই মিনিট! এমন করে কয়েক মিনিট। না, উত্তর পাওয়া গেলো না। নতমস্তকে দাঁড়িয়ে আছে কেবল। তনয়া মেহেরুন্নেসার চোখে চোখ রাখে। বিদ্রুপের সুর টানে গলায়।
‘সে কি মাহমুদ তুমি তোমার মাকে বলোনি? সমস্যা টা যে তার ছেলের মধ্যে।’
#চলবে
#সংসার_সমরাঙ্গন (১৬)
রূপন্তি রাহমান (ছদ্মনাম)
আচমকাই থমকে গেলো পরিবেশ। যেন একটু আগে ঝড় বয়ে গেছে, সবকিছু এলোমেলো করে দিয়ে গেছে তার তাণ্ডবে। অথচ কিছুক্ষণ আগেও চিত্রটা ছিল ভিন্ন। দাবার চাল ছিলো উল্টো দিকে।
ঘরজুড়ে নেমে এসেছে এক অদৃশ্য আঁধার। বাতাস ভারী হয়ে উঠছে, চারপাশের শব্দ যেন হারিয়ে গেছে। কেবল নীরবতাই গুঞ্জন তুলছে। কেউ কিছু বলছে না, অথচ নিস্তব্ধতার মাঝেই যেন অসংখ্য অনুচ্চারিত শব্দ ঘুরে বেড়াচ্ছে—বিস্ময়, অভিমান আর একরাশ অনিশ্চয়তা।
মেহেরুন্নেসা ধীরে ধীরে এগিয়ে এলেন। মাহমুদের চোখ-মুখ হাতড়ে দেখলেন উদ্বিগ্ন ভঙ্গিতে।
‘নিজের দোষ ঢাকতে তোর বউ মিথ্যে বলছে, তাই না রে?’—তার কাঁপা কাঁপা কণ্ঠস্বরে চিন্তার ছাপ স্পষ্ট।
মাহমুদ মায়ের হাত দুটো বুকের ওপর এনে চেপে ধরলো। এক অদ্ভুত হাসি খেলে গেলো তার চোখে মুখে। তারপর একটিমাত্র শব্দ উচ্চারণ করলো— ‘না।’
মেহেরুন্নেসা দু’কদম পিছিয়ে গেলেন। উদ্ভ্রান্তের মতো আপনমনে বিড়বিড় করতে লাগলেন,
‘না, না! আমার ছেলের কোনো সমস্যা নেই! সে সুস্থ, সবল, বলিষ্ঠ পুরুষ! ওর কি করে সমস্যা থাকব? এই মেয়ে! এই মেয়ে মিথ্যে বলছে!’
মেহেরুন্নেসার কথায় তাচ্ছিল্যের হাসি ফুটলো তনয়ার মুখে।
‘দুনিয়া উল্টে যাক, তবু ছেলের বউয়ের দোষ ধরা ছাড়া আপনি কিছুই দেখবেন না। তাই তো?’
খালেকুজ্জামান উত্তেজিত কণ্ঠে বলে উঠলেন,
‘কী সমস্যা মাহমুদের? ডাক্তার কবে দেখিয়েছো তোমরা? চিকিৎসার কথা কিছু বলেনি? আর এতদিন আমাদের জানালে না কেন?’
তার কণ্ঠস্বর কাঁপছিল। যেন একসঙ্গে হাজারো চিন্তা তাকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছে। চোখেমুখে উদ্বেগের ছাপ, ভ্রু কুঁচকে গেছে, ঠোঁট কাঁপছে অজান্তেই।
তনয়া ক্লান্ত দৃষ্টিতে খালেকুজ্জামানের দিকে তাকিয়ে নিঃসঙ্গ হাসলো।
‘সব প্রশ্নের উত্তর না হয় আপনার ছেলেই দিক। আমার কথার প্রয়োজন ফুরিয়েছে এই সংসারে।’
হনহনিয়ে রুমের দিকে এগিয়ে গেলো সে। কয়েক মুহূর্তের মধ্যে ফিরে এলো পার্স আর মোবাইল হাতে। তার বোরকা আগে থেকেই গায়ে ছিল।
‘আব্বা, আমি যখন মুনিরার ব্যাপারটা নিয়ে কথা তুললাম, তখন আপনাদের উচিত ছিল তাকে জেরা করা। সত্য-মিথ্যা যাচাই করা। কিন্তু আপনারা তা না করে উল্টো আমাকেই দোষ দিলেন। আমি হয়তো কিছু একটা বুঝেছিলাম। যাই হোক, দোয়া করি, আমিই যেন ভুল প্রমাণিত হই।’
তারপর মুনিরার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো তনয়া।
‘কোনটা সত্যি আর কোনটা মিথ্যে সবচেয়ে ভালো জানো তুমি। আমায় দোষ দিয়ে তোমার মা যে বড় মুখ করে তোমাকে ডিফেন্ড করেছে, সেই মুখ সর্বদা অক্ষুণ্ণ রেখো।’
শেষবারের মতো বাসাটা একপলক দেখে নিলো সে। প্রতিটা কোণায় তার ছোঁয়া লেগে আছে। তিন বছরে একটু একটু করে গড়ে তোলা এই সংসারটা তার স্বপ্ন, ভালোবাসা আর পরিশ্রমের ফসল।
দেয়ালের রং থেকে জানালার পর্দা, খাটের চাদর, সোফার কুশন—সবকিছুতেই তার স্পর্শ। বুকশেলফের তাকে সাজানো বই থেকে রান্নাঘরের তাকে রাখা মসলার কৌটাগুলো পর্যন্ত সে নিজ হাতে গুছিয়েছে, যেন সংসারের উষ্ণতা টিকে থাকে।
তার হাতের ছোঁয়ায় গড়ে তোলা সংসারটা নিঃশব্দে তার গল্পগুলো ধরে রেখেছে। আজ সেই গল্পের শেষ অধ্যায় লেখার সময় হয়ে এসেছে। সংসারের সেই উষ্ণতা কেবল পরিণত হবে স্মৃতিতে।
তার ঠোঁট কেঁপে উঠলো। কণ্ঠস্বরে কোনো আবেগ নেই, শুধু শূন্যতা—
‘আপোষ করতে করতে আমি ক্লান্ত। ধৈর্যের বাঁধ ভেঙেছে, হাঁপিয়ে উঠেছি। এবার শেষটা আমি নিজেই টানছি। এই সংসারে আমার কোনো প্রয়োজন নেই, কোনোদিন ছিলও না। আমার সাধের সংসারের ইতি আমি এখানেই টানলাম। তালাকনামা পাঠিয়ে দিও। তোমার মায়ের পছন্দসই কাউকে ঘরে তোলো।’
মাহমুদ হতভম্ব। সে কিছু একটা বলতে গিয়েও থেমে গেলো। তার মুখে কোনো ভাষা নেই, চোখেমুখে যেন ধাক্কা খাওয়া এক অপরাধীর অসহায়তা।
খালেকুজ্জামান যেন বিশ্বাস করতে পারছিলেন না।
‘কিসব পাগলামি তনয়া? ঠোকাঠুকি তো সব সংসারেই হয়। তাই বলে এমন সিদ্ধান্ত নেবে? পাগলামি করো না!’
‘আমি আমার সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিয়েছি, আব্বা।’
‘অবুঝের মতো পাগলামি করো না।’
তনয়া ধীরে মাথা নাড়লো।
‘অনুরোধ করবেন না, আব্বা। আমি রাখতে পারবো না। খারাপ লাগবে আমার।’
তাই বলে নিজের হাতেগড়া সংসারটা এভাবে ফেলে চলে যাবে?’
‘এই সংসারটা আমার কখনো ছিলোই না।’
খালেকুজ্জামান কথা খুঁজে পেলেন না।
তনয়া দরজার দিকে এগিয়ে গেলো। পিছনে পড়ে রইলো এক নিঃশব্দ সমাপ্তি।
__________________
সিএনজি চলছে আপন গতিতে, যেন একটানা ছুটে চলা জীবনের প্রতিচিত্র। রাস্তার ল্যাম্পপোস্টগুলো ফিকে আলো ছড়াচ্ছে, মাঝে মাঝে আলোর রেশ এসে পড়ছে তনয়ার মুখে, আবার মিলিয়ে যাচ্ছে অন্ধকারে।
পিচঢালা পথের দু’পাশে সারি সারি গাছ, বাতাসে তাদের পাতাগুলো কাঁপছে নিঃশব্দে। পথের ধারে কোথাও আধা-জ্বলা দোকানের আলো, কোথাও রাস্তার ধুলায় ছাপা পড়া অগোছালো মানুষের ছায়া। কোনো জায়গায় রাস্তা ফাঁকা, আবার কোথাও লাল সিগন্যালে দাঁড়িয়ে থাকা গাড়ির সারি।
সিএনজির ইঞ্জিনের একটানা শব্দ কানে বাজছে, মাঝে মাঝে পাশ কাটিয়ে যাওয়া বাসের কর্কশ হর্ন কেটে দিচ্ছে রাতের নিস্তব্ধতা।
আকাশে মেঘের আনাগোনা, চাঁদের আলো মাঝে মাঝে উঁকি দিচ্ছে, আবার ঢেকে যাচ্ছে ধূসর অন্ধকারে। চারপাশের জগতটা যেন চলমান, কিন্তু তনয়ার জন্য সব থমকে আছে—একটা শুন্যতা ছড়িয়ে আছে তার চারপাশে।
তনয়া অনুভব করছে ড্রাইভার বারবার তাকে দেখছে, কিন্তু সে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায় না। তার দৃষ্টি স্থির, অনুভূতিগুলো যেন অবশ হয়ে গেছে। পোড়া হাতটা তার নিজের কাছেই এখন এক সাধারণ চিহ্ন, তবু অন্যের চোখে সেটা যেন একটা প্রশ্নচিহ্ন হয়ে দাঁড়ায়।
সে জানে, কিছু ক্ষত থাকে যা কেবল শরীরে নয়, মনের গভীরেও দাগ ফেলে যায়—যার ব্যথা কেউ দেখতে পায় না, কেউ বোঝে না।
‘একটা কথা জিগাই আপা?’
বাইরে থেকে দৃষ্টি ফেরায় তনয়া। নিস্তেজ গলায় জবাব দিলো, ‘বলুন।’
‘আপনার হাতের পোড়া দাগটা কিসের?’
হাতটা আড়াল করার চেষ্টা করে তনয়া। ফিচেল হেসে পুনরায় উত্তর করলো,
‘ও কিছু না। আমার অসতর্কতার ফল।’
ড্রাইভার সামনে দৃষ্টি স্থির রাখে। নিজে নিজেই বলতে থাকে,
‘বছর খানিক আগে আমার ছোট বোনটারে বিয়ে দিছিলাম। যৌতুকের জন্য ওরা আমার বোনটারে রোজ মা*র*তো। আমার বাপ মা নাই। আর্থিক অবস্থার কথা চিন্তা করে বোন আমারে কিছু বলে নাই। চুপচাপ অত্যাচার সহ্য করতো। একদিন এমন মা*র মারছে সরকারি হাসপাতালে আমার বোনটা আজ পনেরো দিন ধরে ভর্তি। কেউ দেখতেও আসে নাই।’
ড্রাইভারের গলা ধরে আসে। দেখতে না পেলেও তনয়া স্পষ্ট বুঝতে পারলো লোকটার চোখে পানি।
‘আমার জন্য ও আর ওর জন্য আমি ছাড়া আমাদের আর কেউ নাই। সিএনজি চালাতে পারি আপা কিন্তু বোনটার কোনো শখ আমি অপূর্ণ রাখি নাই। সারা গায়ে মা*রের কালসিটে দাগ। আমার বোন আমারে ফেরত দিয়ে দিতো। এতো মা*র*লো কেন?’
‘মামলা করেন নাই?’
‘বোন দেয় না।’
‘তাই বলে নীরবে,,,,,,,
থেমে যায় তনয়া। সেও তো নীরবেই সব সয়েছে।
‘মানুষের মতো দেখতে হলেও সবাই মানুষ হয় না। তাই কোনো মেয়ের শরীরে আঘাতের চিহ্ন দেখলে আমার ভয় হয়। বোনটার কথা মনে পড়ে।’
ড্রাইভারের কথা থেমে গেলে চারপাশ আরও ভারী হয়ে উঠল, যেন নীরবতাই এখন সবচেয়ে প্রবল ভাষা। সিএনজির একটানা গুঞ্জন, বাতাসের ফিসফিসে শব্দ—সব মিলিয়ে যেন একটা চাপা বিষাদ ছড়িয়ে পড়েছে তার ভেতর-বাইরে।
তার চোখ দুটো কেবল শূন্য দৃষ্টিতে সামনে তাকিয়ে রইলো। দুজনের যন্ত্রণার মাঝে মিল নেই। আবার কোথাও না কোথাও ভীষণ মিল রয়েছে। তনয়ার নিঃশ্বাস ভারী লাগছে, কিন্তু সে সেটা চেপে রাখলো। ভেতরে এক চাপা ঝড় বইছে।
ড্রাইভারের সিটে বসা কোনো এক ভাগ্যবতীর ভাইকে দেখে তনয়ার মনে পড়ে যায় নিজের ভাইয়ের কথা। সে দ্রুত মোবাইল বের করলো। কল করলো তার ভাইয়ের নাম্বারে। দু’বার রিং হতেই রিসিভ হলো।
‘কেমন আছিস?’
‘কোথায় থাকিস তুই? এতোক্ষণ লাগলো কেন রিসিভ হতে?’
ওপাশ হাসির শব্দ শোনা যায়। বোনের পাগলামিতে হেসে লুটোপুটি খাচ্ছে ভাই।
‘আমার খোঁজ খবর নিস না তাই একটু শাস্তি দিলাম।’
‘খবরদার আজই শেষ। এমন ভুল আর কখনো করবি না। চেষ্টা করবি আমি কল করার আগেই রিসিভ করার।’
থতমত খেয়ে যায় তপু। মাথা চুলকে বলে, ‘কল করার আগেই রিসিভ করে কেমনে?’
‘আমি ওতো কিছু জানি না। তুই এটাই করবি এখন থেকে।’
‘আচ্ছা! আচ্ছা! এখন বল কেমন আছিস তুই।’
প্রশ্নটা এড়িয়ে যায় তনয়া। পাল্টা প্রশ্ন করে তপুকে।
‘আমি যদি সারাজীবনের জন্য বাড়িতে চলে আসি তোরা কি আমায় তাড়িয়ে দিবি?’
‘সেকি কথা? তাড়িয়ে দেবো কেন?’
তপু থেমে গেলো। কিছু একটা ভাবলো সে। চোখমুখ কঠিন হয়ে আসে তার। চাপা স্বরে বলল,
‘ও বাসায় কিছু হয়েছে? কেউ কিছু বলেছে তোকে? মাহমুদ! মাহমুদ কিছু বলেছে তোকে?’
তনয়া উত্তর দেয় না। চুপ করে থাকে। তনয়ার উত্তর না পেয়ে তপু অস্থির হয়ে পড়লো।
‘উত্তর দিচ্ছিস না কেন তনু? কে কি বলেছে তোকে আমায় বল। নাকি তোর শ্বাশুড়ি,,,,
তপুকে থামিয়ে দিলো তনয়া।
‘ তুই শুধু জেনে রাখ আমি বাড়ি যাচ্ছি। কেন আর কিসের জন্য যাচ্ছি এটা কখনো জানতে চাইবি না। মাকে কল করে জানিয়ে দে আমি বাসার কাছাকাছি আছি। আমাকে দেখলে যেন কোনো প্রশ্ন না করে। কেউ একটা প্রশ্ন করলে আমি বাসায় ঢুকবো না। এমন কোথাও যাবো যেন সারাজীবন আমাকে খুঁজে না পাস।’
খট করে মোবাইল কে’টে দিলো তনয়া। থম মে’রে বসে রইলো সে। ড্রাইভার পিছু ফিরে একবার তনয়াকে পরখ করে মনোযোগ দেয় নিজের কাজে।
মিনিট পনেরো পার হতেই তনয়ার বাসার সামনে সিএনজি থামলো। সিএনজি থেকে নেমেই ভাড়া বাবদ একটা এক হাজার টাকার নোট ড্রাইভার কে দিলো।
‘আপনার বোনের জন্য ফলমূল কিনে নিয়েন এটা দিয়ে।’
ড্রাইভার নিতে অস্বীকৃতি জানায়।
‘এটার দরকার নেই আপা। শুধু দোয়া করবেন ওর জন্য।’
‘রেখে দেন। আপনার বোনকে বলবেন এক বোন আজ থেকে তাকে মোনাজাতে রাখবে। সে যেন ভেঙে না পড়ে।’
_________________________
বাসার পরিবেশটা গুমোট হয়ে আছে। এক অদ্ভুত নীরবতা বিরাজ করছে সেখানে। মুষলধারে বৃষ্টি হওয়ার আগে আকাশের মতো ভারী। বাতাস নেই, গরম নিঃশ্বাস যেন ঘরটাকে আরও বন্ধ করে দিয়েছে। ঘরের কোণে কোণে এক ধরনের অস্বস্তি ভেসে বেড়াচ্ছে। যেখানে নিঃশব্দভাবে চাপা কষ্ট জমে থাকে। বাতাসের তাজা কোনো অনুভূতি নেই, সব কিছু গাঢ়, যেন প্রাণের সকল গতি থেমে গেছে। সব কিছু স্তব্ধ, নিস্তেজ।
রাত প্রায় সাড়ে আটটা। চার প্যাকেট বিরিয়ানি নিয়ে বাসায় ফিরে মাহমুদ। মুখোমুখি হয় খালেকুজ্জামানের। তিনি বাঁকা চোখে মাহমুদ কে পা থেকে মাথা পর্যন্ত পরখ করলেন। হাতে বিরিয়ানির প্যাকেট দেখে বেশ অবাক হলেন তিনি। বিস্মিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন,
‘তোমার হাতে বিরিয়ানির প্যাকেট!’
প্যাকেটগুলোর দিকে তাকিয়ে ম্লান হাসে মাহমুদ
‘সবার মনস্কামনা পূর্ণ হয়েছে। সেই খুশিতে আনলাম।’
কঠিন হয়ে এলো খালেকুজ্জামানের মুখাবয়ব। রাগে হাতজোড়া মুষ্টিবদ্ধ করে নিলেন। দাঁতে দাঁত পিষে বললেন,
‘জানোয়ার একটা।’
মাহমুদ কথাখানি গায়ে মাখলো না। বিরিয়ানির প্যাকেট টেবিলের উপর রেখে মেহেরুন্নেসার কাছে যায়।
এশার নামাজ শেষ করে সেখানে বসেই তছবি জপছেন তিনি। মাহমুদ কে কাছে আসতে দেখে বিস্তর হাসলেন। একটু চেপে জায়গা দিলেন মাহমুদ কে বসার জন্য। মাহমুদ বসার বদলে গুটিশুটি হয়ে শুয়ে মেহেরুন্নেসার কোলে মাথা রাখলো। তিনি আলতো করে মাহমুদের চুলে বিলি কে’টে দিচ্ছেন।
‘আম্মা, আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি তনয়াকে ছেড়ে দিবো। এরপর তুমি যাকে পছন্দ করবে সেই মেয়েকে বিয়ে করবো।’
#চলবে