সঙ্গিন প্রনয়াসক্তি পর্ব-৪৮+৪৯

0
11

#সঙ্গিন_প্রনয়াসক্তি🍁🍁
#পর্বঃ৪৮
#লেখনীতে_suraiya_rafa
(ক,পি করা নিষিদ্ধ 🚫)
(কঠোরভাবে প্রাপ্তমনস্কদের জন্য)

দিনের শেষ প্রহরে প্রকৃতি জুড়ে সন্ধ্যে নামার হাতছানি। অদূরের পাখিরা ডানা ঝাপ্টে ঘরে ফেরার সুর তুলেছে, সারাদিন উত্তাপ ছড়িয়ে বেড়ানো তেজস্ক্রিয় সূর্যটাও মেঘের আড়ালে গা ঢাকা দিয়ে ধীরে ধীরে মিলিয়ে গিয়েছে পশ্চিম আকাশে, সেথায় এখন কাঁদা মাটির ন্যায় লেপ্টে আছে সিঁদুর রঙা এক ফালি নিয়ন আলোর ছটা। আর তো কিছুক্ষণ তারপরই নিকোশ আধারে তলিয়ে যাবে ধরনী।

সন্ধ্যার আয়োজনটা আজ ক্রীতিক কুঞ্জে বেশ ঘটা করেই পালন করা হচ্ছে। সন্ধ্যা নামার সাথে সাথে ডাইনিং টেবিল ভরে উঠেছে নানান রকম সুস্বাদু নাস্তার বহরে।
অর্ণব, এলিসা, তার ক্যাথলিন সেখানে বসে বসে পাকোড়া চিবুচ্ছে, অরু আর সায়রও উপস্থিত, তবে ওদের মনটা ভালো নেই।

নীল আকাশের ভারী মেঘের ঘনঘটার মতোই কালো হয়ে আছে ওদের মুখশ্রী।
অরু মুখটা মলিন করে সেই তখন থেকে শূন্য চোখে গালে হাতদিয়ে বসে আছে দেখে এলিসা খেতে খেতে শুধালো,
— এ্যাই মেয়ে ,কি হয়েছে তোমার? মুখ কালো কেন? নিশ্চয়ই জেকে কিছু বলেছে?

অরু জোরপূর্বক হেসে জানালো,
— তেমন কিছু নয় আপু, আসলে আপাকে খুব মিস করছি। সব সময় ,সব পরিস্থিতিতে একসাথে ছিলাম আমরা দু’বোন, অথচ এখন দেখো আজ তিনদিন হয়ে গেলো আপা শশুর বাড়িতে পরে আছে।

মনেমনে বললো,
— তোমাদের জেকে আর কিইবা বলবে, সে’তো তো আমার সাথে কথাই বলেনা সেই বিয়ের দিন থেকে।

অরুর কথায় ভারী দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে এলিসা করুন স্বরে বলে,
—- তা ঠিক বলেছো অনুকে তো আমরাও মিস করছি, তার উপর বউ ভাতের দিন আমরা গেলেও জেকে তো তোমাকে যেতেই দিলোনা আর।

বউ ভাতের দিনের কথা মনে পরতেই আরও একদফা দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এলো অরুর চিত্ত চিড়ে। সেদিন শুধু শুধু ক্রীতিক ওকে যেতে দিলোনা, বউ ভাতের দিন অনুর কাছে যেতে না দেওয়ার দুঃখ টা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতেই অরু ডুব দিলো সেদিনের ঘটনায়।একে একে মনে পরতে লাগলো ক্রীতিকের বিরক্তিকর কর্মকান্ড গুলো।

বউ ভাতের আয়োজনে সামিল হতে একে একে ক্রীতিক কুঞ্জের গেইট ছাড়িয়ে বেরিয়ে যেতে লাগলো অতিথিদের গাড়ির বহর।
একেবারে শেষে যে গাড়িটা পরে রইলো সেটাতেই আপাতত ওঠার প্রস্ততি নিচ্ছিলো, সায়র, অর্ণব,এলিসা, ক্যাথলিন আর অরু।

কালকের কাহিনির পরে অরুর যে বউ ভাতে যাওয়ার খুব ইচ্ছে তেমনটা নয়,কিন্তু সবার জোরাজুরি আর অনুকে এক নজর দেখার স্পৃহার দরুন নিজেকে আর দমিয়ে রাখতে রাখতে পারলো না অরু।

না গেলে নিশ্চয়ই আপা মন খারাপ করবে,সেই ভেবেই আপার মন খারাপকে নিষ্ক্রিয় করে দিতে, অগত্যা, রেডি হয়ে অরু ও বেড়িয়ে পরলো সবার সাথে।

সায়র ড্রাইভিং সিটে বসে গাড়ি স্টার্ট করতে করতে পেছন তাকিয়ে বললো,
—- সবাই এসেছে তো?

অরু তখনও ওঠেনি, ভারী সুতোর কাজ করা ফুল স্লিভ, ফুল নেক গাউনটা সামলে আস্তে ধীরে উঠতে যাবে, ঠিক তখনই পেছন থেকে কেউ একজন বলে,
—- তোরা চলে যা, ও যাবেনা।

আগন্তুকের কথায় অরু বিষ্ফরিত নয়নে পেছনে চেয়ে দেখলো, বাসায় পরার সফেদ রঙা ওভার সাইজ টিশার্ট আর ওভার সাইজ খাকি ট্রাউজার পরে এলোমেলো চেহারা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ক্রীতিক। এক হাত পকেটে গুজে, অন্য হাতে ধরে রেখেছে আইপ্যাড আর হেডফোন,
নির্ঘাত ডার্ক রোমান্টিক অডিও বুক শুনছিল।

চোখ ছোট করে ভাবছে অরু, মনেমনে বলছে,
—- সারাদিন হেডফোন লাগিয়ে এসব শুনবে আর আমার উপর ভুলভাল এ’ক্সপেরিমেন্ট প্রয়োগ করবে, খারুস লোক একটা।
সে যাই হোক কিন্তু এখন উনি কি বললো?

অরুর ভাবনার সুতো ছিড়লো এলিসার রুদ্ধ আওয়াজে, ও ক্রীতিকের কথার পাছে খেঁকিয়ে উঠে বললো,
—-যাবেনা মানে? আমরা সবাই যাচ্ছি তাহলে অরু কেন যাবে না?

ক্রীতিক শান্ত স্বরে বললো,
— কারণ আমি যাচ্ছি না, আমার অনেক কাজ রয়েছে পেন্ডিং।

এবার সায়র গলা উঁচিয়ে বললো,
— তোর কাজ তুই কর গিয়ে, ওকে কেন যেতে দিবি না?

সায়রকে তীক্ষ্ণ চোখে ভস্ম করে দিয়ে, ক্রীতিক সবার উদ্দেশ্যে বলে,
—–আমি যেহেতু যাচ্ছিনা, সেহেতু আমার বউয়ের ও যাওয়া হচ্ছে না। তাছাড়া আমার অরুর সাথে দরকারি কাজ আছে, ইটস ভেরী পার্সোনাল।

ক্রীতিকের এহেন ঘুরানো প্যাচানো কথায় কেউ আর দ্বিতীয়বার প্রশ্ন করার সাহস দেখালো না, আবার প্রশ্ন করতে গেলে সবার সামনে কি জানি কিই ঠাস করে উত্তর দিয়ে বসে তখন আবার মান সম্মানের প্রশ্ন। তার চেয়ে ইজ্জত বাঁচিয়ে চলে যাওয়াই উত্তম, যার বউ তার কাছেই বরং থাকুক।

অরুর কোনো মতামত না নিয়েই সবাই চোখের পলকে হুঁশশ করে বেরিয়ে গেলো।

চলতি গাড়িটার দিকে নিস্প্রভ চোখে চেয়ে থেকে ভারাক্রান্ত আওয়াজে অরু বলে ওঠে,
—- এটা কি হলো? আপা তো রাগ করবে। এটা কিইই করলেন আপনিইই?

অরুর দুঃখের বিলাপ ক্রীতিকের কান অবধি পৌঁছেছে বলে মনে হচ্ছে না, উল্টে ও অরুর কব্জি চেপে ধরে টান’তে টা’নতে নিয়ে গেলো দু’তলায় নিজের রুমে। পুরো ক্রীতিক কুঞ্জ খালি পরে আছে, একটা সার্ভেন্ট অবধি অবশিষ্ট নেই, সবাই রওনা করেছে বউ ভাতের অনুষ্ঠানে, বাড়িতে রয়ে গিয়েছে শুধু ক্রীতিক আর অরু।

এতো বড় বাড়িটা হুট করে ফাঁকা হয়ে যাওয়ায় অরুর গা ছমছম করছে, তারউপর ক্রীতিক এমন টানা হেঁচড়ে করছে দেখে অরুর এবার সত্যিই ভয়ে গা শিউরে উঠলো। ও নিজের সর্ব শক্তি দিয়ে হাতটা ছাড়ানোর চেষ্টা চালিয়ে কাইকুই করে বলে ওঠে,
—- ছাড়ুন না, লাগছে আমার।

ক্রীতিক রুমে এনে দরজায় ছিটকিনি লাগিয়ে তবেই অরুর হাত ছাড়লো।
অরু দম নিলোনা ব্যথাতুর হাতটা অন্য হাত দিয়ে ঘষতে ঘষতে বললো,
—- কি হয়েছে যেতে দিলেন না কেন?

ক্রীতিক নিজের এক ভ্রু উঁচিয়ে বললো,
—- কালকের ঘটনার পরেও আমার কাছে কৈফিয়ত চাইতে আত্না কাপছে না তোর?

অরুর মেজাজটা বিগড়ে আছে, একে তো আপার সাথে দেখা হওয়ার সুযোগটা মাটি, তার উপর ক্রীতিকের এমন জোর জব’রদস্তি, আর এই মূহুর্তে বিগড়ানো মেজাজটাকে সামলে নেওয়ার কোনো ইচ্ছেও নেই ওর, অগত্যা নিজের নাকটা সিকোয় তুলে, ঝাঁজিয়ে উঠে অরু বলে,
—- না কাঁপছে না, কারন আপনি আমার স্বামী, স্বামীর সাথে কথা বলতে কারও আত্না কাঁপে শুনেছেন কখনো?

ক্রীতিক বুঝলো ওর দূর্বলতাটা অরু ভালোমতোই রপ্ত করেছে,কিভাবে কথা এগোলে ক্রীতিক দমে যাবে সেটা অরু শিখে গিয়েছে। তাই ওর সাথে তর্কে না গিয়ে ক্রীতিক কথা ঘুরিয়ে গম্ভীর মুখে বললো,
—- এসব হাবিজাবি পোশাক এক্ষুনি চেঞ্জ কর,রাগ লাগছে আমার।

অরু ত্যক্ত গলায় বললো,
— চেঞ্জ করার জন্য হলেও তো রুমে যেতে হবে, যেতে দিন?

— না এখানেই কর।

— কিহ!

অরুর হতবিহ্বল মুখের পানে তাকিয়ে কয়েক সেকেন্ডের জন্য ক্রীতিকের ঠোঁটের আগায় খেলে গেলো এক চিলতে কপট হাসি, এই ভীত হরিণীটাকে ভরকে দিতে ওর বেশ লাগে।

কিন্তু পরক্ষনেই গতকাল অমিত অরুকে স্পর্শ করেছে, সেই দৃশ্যটা মানস্পটে ভেসে উঠতেই সঙ্গে সঙ্গে চোয়াল শক্ত হয়ে এলো ক্রীতিকের। ও কয়েক কদম এগিয়ে গিয়ে অরুর মুখোমুখি হয়ে দাঁড়িয়ে, চুলের পেছন থেকে অরুর সরু ঘাড়টা চেপে ধরে মুখের কাছে মুখ নিয়ে গাঢ় গলায় বলে,
—- উল্টা পাল্টা চিন্তা করা বন্ধ কর, আমি তোকে আদর সোহাগ করার জন্য ড্রেস চেঞ্জ করতে বলিনি,অবশ্য আমার আদর তুই ডিজার্ভ ও করিস না।

কথা শেষ করে অরুকে নিজের থেকে দূরে সরিয়ে দিলো ক্রীতিক। ক্রীতিক প্রচন্ড রাগে বো’ম হয়ে আছে ব্যাপারটা বুঝতে পেরে অরু নিচু স্বরে বললো,
—- এখানে পড়বো টা কি? জামা কাপড় তো সব রুমে।

ক্রীতিক স্টাডি টেবিলে গিয়ে ল্যাপটপ নিয়ে বসে বললো,
—- ক্লজেটে অনেক গুলো ওভার সাইজ টিশার্ট আছে যেটা ইচ্ছে পর।

তৎক্ষনাৎ অরু চোখ পাকিয়ে বলে ওঠে ,
—- আপনি কি পা’গল? এটা আপনার ক্যালিফোর্নিয়ার বাড়ি নয় যে চাইলেই আমি আপনার হাটু সমান টিশার্ট পরে ঘুরে বেড়াবো, এটা ক্রীতিক কুঞ্জ, বাংলাদেশের ক্রীতিক কুঞ্জ।

ক্রীতিক ল্যাপটপ স্ক্রিনে চোখ নিবদ্ধ রেখেই জবাব দিলো,
—- বাড়িতে কেউ নেই, যা বলছি চুপচাপ তাই কর।

অরু জানে ক্রীতিকের জিদের কাছে ওর হার মানতেই হবে, তাই অযথা কথা বাড়িয়ে নিজের সময় আর এনার্জি খরচ করলো না ও আর, ক্লজেট খুলে বড় দেখে একটা সাদা টিশার্ট নিয়ে ঢুকে গেলো ওয়াশরুমে।

অরু যখন বেরিয়ে এলো, তখনও ক্রীতিক আগের ন্যায় স্টাডি টেবিলেই বসে আছে, অরুর পায়ের আওয়াজে এক ঝলক ওর দিকে তাকিয়ে ক্রীতিক বলে,
—- তুই কি প্ল্যান করে আমার সাথে ম্যাচিং কালারের টিশার্ট পরেছিস নাকি? এই সব প্ল্যান ফ্ল্যান করে থাকলে ভুল করছিস, তোর অ’ন্যায়ের কোনো ক্ষমা নেই। এখন দাঁড়িয়ে না থেকে চুপচাপ পড়তে বস।

ক্রীতিকের শেষ কথায় অরু যেন আকাশ থেকে পাতালে পরলো, কপালে বিরক্তির একশো একটা ভাজ টেনে নাকটা চুড়োয় তুলে অরু বললো,
—- পড়তে বসবো মানে?

ক্রীতিক নির্লিপ্ত গলায় বলে,
—- এতে এতো অবাক হওয়ার কি আছে? আমি ছিলাম না বলে পড়াশোনার বারোটা বাজিয়েছিস, এখন থেকে এসব একাডেমি ফ্যাকাডেমি যাওয়া বন্ধ,অমিতের মতো নোভেলিস্ট হওয়ার ভুত মাথা থেকে ঝেড়ে ফেল,অমিত কিংবা ওর পেশা সবকিছু থেকে একশো হাত দূরে থাকবি তুই। এ্যাম আই ক্লিয়ার?
এখন পড়তে আয়, আজকের লেসন এর উপর কিছু এসাইনমেন্ট দেবো তোকে, কাম হেয়ার।

অরু নির্লিপ্ত মুখে এগিয়ে এসে চেয়ারে বসে পরলে, ক্রীতিক ওর সামনে ল্যাপটপ এগিয়ে দিয়ে নিজে লেকচার শুরু করে। সময় নিয়ে একে একে প্রত্যেকটা পয়েন্ট ধরে ধরে অরুকে বোঝায়, কোথাও বুঝতে সমস্যা হচ্ছে কিনা সেটাও বারবার জিজ্ঞেস করে। এভাবে লেসন দিতে দিতে কয়েকঘন্টা অতিবাহিত হলে ক্রীতিক অরুকে কিছু শর্ট কোশ্চেন সলভ করতে দিয়ে নিজে পুনরায় ল্যাপটপে মনোযোগী হয়।

ক্রীতিক অন্যদিকে খেয়াল দিয়েছে, সেটা বোধগম্য হতেই অরু এগিয়ে এসে ক্রীতিকের সামনের চেয়ারটাতে বসে ওর দিকে ঝুঁকে কিছু বলতে যাবে, তৎক্ষনাৎ ঘোর আপত্তি জানিয়ে ক্রীতিক বলে,
—- খবরদার একদম কাছে আসবি না আমার। যা বলার দূর থেকে বল।

অরু দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ক্রীতিকের থেকে দূরত্ব বজায় রেখে মুখ কাঁচুমাচু করে বললো,
—- দেখুন আমার ইকোনমিকস পড়তে একটুও ভালো লাগেনা,সত্যি বলছি।আমি বাংলা সাহিত্য পড়তে চাই।

অরুর কথাটা বোধ হয় মোটেই ভালো লাগেনি ক্রীতিকের,ও নিজের হাতে থাকা পেপার ওয়েটটা মুঠিতে নিয়ে চোয়াল শক্ত করে বলে,
—- তুই বলতে চাইছিস আমার সাবজেক্ট নয়,বরং অমিতের সাবজেক্ট তোর ভালো লাগে তাইতো?

অরু তরিৎ গতিতে না সূচক মাথা নাড়িয়ে উদ্বিগ্ন গলায় বলে,
—- না না তেমন কিছু নয়, আপনি ভুল বুঝছেন। কিন্তু ইকোনমিকস….

—- হয়েছে আর বলতে হবেনা, এটুকুতেই অনীহা ধরে গিয়েছে আমার প্রতি। সারাজীবন থাকলে নিশ্চয়ই বিরক্ত হয়ে যাবি?

ক্রীতিকের কথায় অরু বারবার না সূচক মাথা নাড়ায়, কিন্তু ক্রীতিকের জিদ তো কুন্ডলী পাকিয়ে বেড়েই চলেছে।

ও এটা কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না যে, অরু ওর সাবজেক্ট রিজেক্ট করে অমিতের সাবজেক্ট পড়তে চাইছে, হাউ ডেয়ার শি?

ক্রীতিক মেজাজ হাড়িয়ে অরুকে তৎক্ষনাৎ রুম থেকে বের করে দিয়ে দরজা লক করে দিলো। ক্রীতিকের এমন হুটহাট রেগে যাওয়াতে এই মূহুর্তে অরু নিজেও বেশ বিরক্ত, তাই ওকে আর আগ বাড়িয়ে ডাকতে গেলো না অরু, চুপচাপ হাঁটু সমান টিশার্ট টাকে আরেকটু টেনেটুনে নিচে নামিয়ে, লম্বা চুল গুলো চুড়ো করে বাঁধতে বাঁধতে এগিয়ে গেলো নিজের রুমের দিকে ।

*****************************************

আড়মোড়া ভেঙ্গে অরু যখন ঘুম থেকে জাগে তখন সূর্য মাঝ আকাশে। জানালা গলিয়ে দুপুর বেলার তীর্যক সূর্য রশ্মি এসে শরীরে আঁচড়ে পরতেই চোখ মুখ কুঁচকে গেলো অরুর। সেই যে তখন ক্রীতিকের রুম থেকে ফিরে শুয়েছিল, তারপর কখন যে ঘুমের রাজ্যে তলিয়ে গিয়েছে তা আর টের পায়নি অরু, যখন টের পেলো তখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল প্রায়।

ক্রীতিক আশেপাশে কোথাও নেই, তবুও ক্রীতিকের মাস্কি সুবাসটা চারিদিকে ভুর ভুর করছে, কোথা থেকে ভেসে আসছে এই সুঘ্রাণ তার উৎস খুঁজতেই গিয়েই অরুর খেয়াল হলো ও ক্রীতিকের টিশার্ট পরে আছে, পরক্ষণেই নিজের শরীরের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে অরু, কেন যেন এই টিশার্ট টা পরে মনে হচ্ছে ক্রীতিক ওকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রেখেছে।

আর এই গন্ধটা, ভাবতে ভাবতে গলার কাছ থেকে টিশার্টটা টেনে নাকে ছোঁয়ালো অরু, এটা বোধ হয় আজকাল পরেছে ক্রীতিক, ওই জন্যই এতো সুন্দর ম্যানলি সুঘ্রাণ বেরোচ্ছে। সিগারেট, আফটার শেভ, স্যান্ডাল উড পারফিউম,শুকিয়ে যাওয়া ঘাম সবটা মিলেমিশে এক অকৃত্রিম নেশাতুর প্রভাব বিস্তার করে অরুর মস্তিষ্কের নিউরনে নিউরনে।হৃদ মাঝারে ক্রীতিকের জন্য পা’গলপারা অনুভূতির জোয়ার উগরে দিতে অরুর বোধ হয় এতোটুকুই যথেষ্ট। অষ্টাদশীর প্রথম প্রেম বলে কথা, আবেগ তো টইটম্বুর হবেই।

অরু এসব ভেবে ভেবে আর সময় নষ্ট করে না, কারন ক্রীতিকের কথা ভাবতে বসলে ওর দিন পেরিয়ে রাত ঘনাবে তবুও এই মানুষটাকে ভালোবাসার কোনো কারন মাথায় আসবে না ওর। এমন ছন্নছাড়া বদ মেজাজী মানুষকে কেউ ভালোবাসাবে অরু ছাড়া?

প্রকট গর্ববোধে মনে মনে নিজেই নিজের পিঠ চাপড়ালো অরু, তারপর জামা কাপড় পাল্টে নিচে গিয়ে জোগান দিতে বসলো দুপুরের খাবারের।

বউকে রান্না করে নিজ হাতে খাওয়ানোর মতো হাসবেন্ড ম্যাটেরিয়াল পুরুষ ক্রীতিক নয়, হয়তো নিজেও অরুর সাথে জিদ দেখিয়ে না খেয়ে বসে বসে কাজ করছে।
তাই অরুই দ্রুত হাত চালিয়ে ভাত,ডাল রান্না করলো, ফ্রিজের লেফটওভার তরকারি গুলো গরম করলো, আর সাথে ক্রীতিকের জন্য মিক্সড স্যালাড বানালো।

সবকিছু তৈরী করে অরু খাবার দাবার সব ডাইনিং এ সাজিয়ে নিচতলা থেকে টেলিফোন করলো ক্রীতিকের নাম্বারে। ক্রীতিক ফোন তুলে রুদ্ধ আওয়াজে বললো,
— কি চাই?

অরু কিছুটা কপটতা অবলম্বন করে নাক টেনে ফুপিয়ে উঠে বললো,
—- আ..আমার হাত কেটে গিয়েছে, অনেক র’ক্ত পরছে আপনি তাড়াতাড়ি নিচে আসুন।

অরুর বলতে দেরি হলো ক্রীতিকের ধরফরিয়ে নিচে নেমে আসতে দেরি হলোনা, এমনকি তাড়াহুড়োয় পায়ের স্লিপারটাও পরেনি ও, খালি পায়ে দৌড়ে এসে অরুকে এদিক ওদিক ঘুরিয়ে ক্রীতিক উদ্বিগ্ন স্বরে বলে,
—- কি হয়েছে বেইবি, কোথায় লেগেছে?

—- আমি ঠিক আছি, কোথাও লাগেনি।

অরুর মিটিমিটি হাসি আর কথাটা বোধগম্য হতেই ক্রীতিকের ম্লান হয়ে যাওয়া সুপ্ত রাগটা পুনরায় ভলভলিয়ে ওঠে মস্তিষ্ক জুড়ে, ও তৎক্ষনাৎ বাজপাখির ন্যায় ছো মে’রে অরুর গলাটা হাল্কা চেপে ধরে আ’গুন চোখে তাকিয়ে বলে,
—- আমার সঙ্গে এই ধরনের মশকরা করার সাহস কোথায় পেলি তুই? তুই জানিস একটুর জন্য আমার হার্টবিট স্টপ হয়ে গিয়েছিলো? আমি কয়েক সেকেন্ড আগেও এটা ভেবে দিশেহারা হয়ে যাচ্ছিলাম যে কতখানি কে’টে গেলো তোর,কাটা যায়গা থেকে ঠিক কতটা র’ক্ত ঝরছে , আর তুই কিনা আমার সাথে এই সব সেনসিটিভ বিষয় নিয়ে মশকরা করছিস? হাউ দেয়ার ইউ অরু? অনেক সাহস বেড়ে গিয়েছে তোর।

ক্রীতিকের বরফ কেটে ফেলার মতো ধা’রালো কথায় শুষ্ক ঢোক গিললো অরু, কোনো মতে সাহস জুগিয়ে মিনমিনিয়ে বললো,
—- খেতে ডাকলে তো জীবনেও আসতেন না, তাই এভাবে ডেকেছি।

অরুর কথায় ক্রীতিক এবার আরও রেগে গেলো, রাগে ফোঁসফাস করে বলে উঠলো ,
—- আমার দূর্বলতা নিয়ে টানাটানি করা বন্ধ কর অরু, আই হেইট বিট্রে্।

কথা শেষ করতেই খাবার টেবিলে চোখ আটকে গেলো ক্রীতিকের। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়েছে, অথচ ওরা দুজনার একজন ও কিছু খায়নি এখনো।

অরু অভুক্ত সেটা মাথায় আসতেই অরুর গলাটা ছেড়ে দিয়ে ওকে নিয়ে বেসিনে চলে যায় ক্রীতিক, অতঃপর অরুর ঘর্মাক্ত মুখে পানির ঝাপটা দিয়ে নরম স্বরে বলে,
—- আর কখনো এমন মশকরা করিস না হার্টবিট, আমাকে মানাতে তোর নিজেকে নিয়ে মিথ্যে কথা বলার প্রয়োজন নেই, সময় হলে আমি নিজেই মেনে যাবো, তোকে ছেড়ে কোথায় যাবো আমি বল? তুই ছাড়া কেইবা আছে আমার?

******************************************

সেদিনের কথাগুলো ভেবে আরেক দফা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল অরু, ক্রীতিক তখন কথা দিয়েছিল মেনে যাবে, আর রাগ করে থাকবে না, কিন্তু কিসের কি?

এখনো অরুর সাথে প্রয়োজন ছাড়া কথা বলেনা ক্রীতিক। যেটুকু বলে সেটাও ধমকের সুরে, সত্যি বলতে অরু শুধুমাত্র অনুকে নয়,ক্রীতিককেও মিস করছে, ওর ভালোবাসা গুলো ভীষণ মিস করছে অরু।

অর্ণব অরুর মলিন মুখের দিক থেকে চোখ সরিয়ে সায়রের দিকে চাইলো, সায়রের ও একই হাল,কয়েক সেকেন্ড অন্তর অন্তর খালি ফুসফাস দীর্ঘশ্বাস ছাড়ছে ছেলেটা। অর্ণব পাকোড়া ভর্তি মুখ নিয়ে সায়রের দিকে ভ্রুক্ষেপ করে অস্পষ্ট আওয়াজে শুধালো,
—- অরুর না-হয় অনুর জন্য মন খারাপ, ছোট বেলা থেকে একসাথে বড় হয়েছে এখন দু’বোন দুই বাড়িতে, কিন্তু তোর কি হয়েছে? তোর ভারী নিঃশ্বাসের আওয়াজে তো উপর ওয়ালার ও মন গলে যাবে বলে মনে হচ্ছে।

অর্ণবের কথার পাছে সায়র বুক ভার করা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে কিছু বলতে যাবে, তার আগেই হুড়মুড় করে সদর দরজা ঠেলে অন্দরমহলে প্রবেশ করে ক্রীতিক আর আজমেরী শেখ।

ওদের পেছন পেছন প্রত্যয় ও এসেছে । তাদের সবার বেশভূষা আর হাতের ফাইলপত্র দেখে মনে হচ্ছে মাত্রই অফিস থেকে ফিরলো তারা, তবে আজমেরী শেখ আর ক্রীতিক দু’জনারই চোখ মুখ গম্ভীর হয়ে আছে।

দু’জনার তীক্ষ্ণ চোখ দেখে মনে হচ্ছে, পারছে না দুজন দু’জনকে কাঁচা গি’লে খেতে, আর ওদের মধ্যে চাপা পরে প্রত্যয় অসহায়ের মতো শুধু এদিক ওদিক তাকাচ্ছে।

ভেতরে প্রবেশ করে দু’জন দুজনার চোখের দিকে কঠিন দৃষ্টিপাত করে, দু’জনই বড় বড় পা ফেলে দুই দিকের সিঁড়ি বেয়ে তরতরিয়ে উপরে চলে গেলো তারা। নিজের মা আর স্বামীর এমন স্নায়ু যু’দ্ধ দেখে অরু হকচকিয়ে ওঠে, সহসা দৌড়ে এসে প্রত্যয়কে উদ্দেশ্য করে বলে,
—- কি হয়েছে প্রত্যয় ভাইয়া?সব ঠিক আছে তো?

প্রত্যয় বিরক্তিতে চিড়বিড়িয়ে উঠে, তেঁতো গলায় বললো,
—- এই যে অরু, তোমার মা আর তোমার বর কে সামলাও। প্রতিদিন মিটিং এ তারা টেন্ডার নিয়ে একজন আরেক জনের পিছনে লেগেই থাকে। জামাই শাশুড়ী যদি একটু হলেই একজন আরেকজনের পেছনে লেগে যায়, তাহলে অন্য শেয়ার হোল্ডাররা কি করবে শুনি? মাঝখান থেকে আমি বেচারা সব কিছু সামলাতে সামলাতে টেনশনে ভর্তা হয়ে যাচ্ছি, এদের টেনশনে টেনশনে আমি যদি এ্যাটাক,ফ্যাটাক করে বসি তাহলে তোমার আপার কি হবে বলোতো?

খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, সত্যিই তো প্রত্যয় ভাইয়া এই বয়সে পটল তুললে আপার কি হবে? তার উপর আপা যদি শোনে প্রত্যয় ভাইয়ার মৃ:ত্যুর পেছনে একমাত্র দায়ী তার ছোট বোনের একমাত্র স্বামী জায়ান ক্রীতিক চৌধুরী, তাহলেতো সব সম্পর্ক শেষ।

—- কি ভাবছো?

প্রত্যয়ের ডাকে ভ্রম কেটে গেলো অরুর। ও তৎক্ষনাৎ সাবধানে প্রশ্ন ছুড়ে বললো,
—- মায়ের কি হয়েছে?

প্রত্যয় বললো,
—- শেয়ার হোল্ডারদের দুটো টেন্ডারই ক্রীতিক ভাই পেয়েছে, নতুন জয়েন করে একই সাথে দুটো টেন্ডার পাওয়া মুখের কথা নয় অরু, অনেক খাটুনির কাজ। ক্রীতিক ভাই কষ্ট করেছে, দিন রাত খেটেছে, কিন্তু মা এটাকে পজিটিভলি নিচ্ছে না। টেন্ডার গুলো যাতে হাতছাড়া হয় সে জন্য বিভিন্ন ভাবে চেষ্টা করছেন মা, যা পরবর্তীতে ক্রীতিক ভাইয়ের কানেও চলে এসেছে। ওই জন্যই আর আরকি….

অরুকে আর খুলে বলতে হলোনা, ও যা বোঝার বুঝে গিয়েছে। ব্যক্তিগত জিদ এখন কোম্পানির কাজেকর্মেও প্রকাশ পাচ্ছে, আজকাল এসবের জন্য অরুর নিজেকেই সবচেয়ে বেশি অপ’রাধী মনে হয়, কেন যে ভালোবাসতে গেলো জায়ান ক্রীতিক কে?

আচ্ছা অরু না ভালোবাসলে জায়ান ক্রীতিক কি ওকে ছেড়ে দিতো? ভাবছে অরু। অরুর ভাবনার ছেদ ঘটে উপর তলা থেকে ক্রীতিকের ডাকে,
—- বেইবি একগ্লাস ঠান্ডা পানি।

অরু উপরের দিকে তাকিয়ে সস্থির নিঃশ্বাস ছাড়লো, আজ প্রায় তিনদিন পর ক্রীতিক আবারও ডাকছে অরুকে,যার ফলে বুকের ভেতরটাতে শীতল ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেলো ওর, একটু আগের সন্দেহ, দোটানা সবকিছু মূহুর্তেই হাওয়ায় উবে গেলো। পাছে এসে জড়ো হলো একরাশ সস্থি আর ব্যকুলতা।

ক্রীতিক ডাকছে তার মানে রাগ পরেছে,কথাটা ভেবেই অরু আর অপেক্ষা করে না পানি নিয়ে সোজা চলে যায় উপরের ঘরে।

তবে রুমে এসে ক্রীতিককে পায়না অরু, ওয়াশরুম থেকে পানির কলকল আওয়াজ বেরোচ্ছে, মনে হয় শাওয়ার নিচ্ছে ক্রীতিক, তাই বেডসাইড টেবিলে পানির গ্লাসটা রেখে চুপচাপ রুম থেকে বেরিয়ে যায় ও।

********************************************

সেই যে সন্ধ্যা বেলাতে একটু খানি চোখের দেখা হলো তারপর আর কোনো খোঁজ নেই ক্রীতিকের।

এখন মাঝরাত, মেঘের চাঁদরে ঢাকা পরেছে শুক্লপক্ষের চাঁদ, বাড়িতে সবাই ঘুমিয়ে আছে।

মা ও সন্ধ্যা বেলাতে দরজায় খিল দিয়েছে, মামিরাও ঘুমাচ্ছে, এলিসা ক্যাথলিন ও ঘুমে বিভোর, ঘুম নেই শুধু অরুর দু’চোখে, ও কতক্ষণ পানি খাওয়ার ছলে নিচে আসছে তো কতক্ষন করিডোরে উঁকি ঝুঁকি দিচ্ছে, মাথায় শুধু ঘুরপাক খাচ্ছে একটাই প্রশ্ন এতো রাতে কোথায় যেতে পারে মানুষটা?

অবশেষে অরুর অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে রাত আড়াইটা নাগাদ বাড়িতে ফেরে ক্রীতিক। ক্রীতিক ভেতরে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গে রাগ অভিমান সমস্তটা ভুলে গিয়ে এক ছুটে নিচে চলে আসে অরু। নিচে এসে ক্রীতিকের মুখোমুখি হয়ে দাড়াতেই ক্রীতিক শান্ত গলায় বলে,
—- ঘুমাস নি?

—- কোথায় গিয়েছিলেন আপনি?

অরুর প্রশ্নে ক্রীতিক বাধ্য স্বামীর মতো জবাব দিলো ,
—- বিয়ের আসর থেকে মেয়ে ভাগিয়ে আনতে।

ক্রীতিকের এহেন কথায় অরুর দুনিয়া দুলে উঠলো, ও তৎক্ষনাৎ হিং’স্র বা’ঘিনীর ন্যায় ঝাপিয়ে পরে দু’হাতে ক্রীতিকের ডেনিম শার্টের কলারটা খামচে ধরে কাঁদো কাঁদো গলায় বললো,
—- ঘরে বউ থাকা সত্বেও একটা মেয়ে ভাগিয়ে আনতে লজ্জা করলো না আপনার? একটু মনমালিন্য ঝগড়াঝাটি হয়েছে বলে আপনি এমন একটা কাজ করবেন? নাকি এখন আর আমাকে ভালো লাগেনা? আমার মাঝে কি অনুপস্থিত যা ওই মেয়ের মধ্যে আছে? কেন করলেন এটা?

জীবন দিয়ে দেবো তবুও আপনার ভাগ আমি কাউকে দেবোনা।
জায়ান ক্রীতিক শুধু আমার,কই সেই হ’তচ্ছাড়ি ওকে আজ আমি ঝাঁটা দিয়ে পিটিয়ে বিদায় করবো।

অরুর এসব কা’ন্নাকাটি আর আহাজারিতে বিরক্ত হয়ে শেষমেশ ওকে একটা রাম ধমক দিলো ক্রীতিক,
—- জাস্ট স্টপ ইট অরু। সেই তখন থেকে বলেই যাচ্ছিস, বলেই যাচ্ছিস, আমাকে এক্সপ্লেইন করার সুযোগটা দিয়েছিস? কিভাবে বলবো আমি?

ক্রীতিকের ধমকে কেঁপে উঠল অরু, পরবর্তীতে দ্বিতীয় আর একটা কথাও মুখ থেকে বের করার সাহস দেখালো না আর। শুধু চুপচাপ মাথা নুইয়ে চোখের পানি ফেলছিল, ক্রীতিক একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে অরুকে মানানোর মতো করে বললো,
—- আমি আমার জন্য মেয়ে ভাগাতে যায়নি বেইবি।

—- তাহলে?

ক্রীতিকের আর কষ্ট করে অরুর প্রশ্নের উত্তর দিতে হলোনা, তার আগেই ওর পেছনে উপস্থিত হলো আরও দুজন ব্যক্তি, অরু ক্রীতিকের থেকে একটু খানি সরে দাড়িয়ে পেছনে তাকিয়ে দেখতে পায়,
—- সায়র আর নীলিমা হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে। নীলিমার পরনে লাল টুকটুকে বিয়ের শাড়ি, চোখ দুটো অ’শ্রুসীক্ত। ওর লাল লাল চোখদুটো দেখেই বোঝা যাচ্ছে মেয়েটা অনেক কেঁদেছে।

অরু নীলিমার দিকে এগিয়ে গিয়ে হতবাক হয়ে বললো,
—- কি হয়েছে নীলিমার?

ওদের পর পরই অর্ণব আর এলিসা ভেতরে প্রবেশ করতে করতে হাসি মুখে বললো,
—- বিয়ে হয়েছে, আমাদের সায়রের সাথে।

নীলিমা কেঁদে উঠলো তৎক্ষনাৎ,
—- আব্বাজাআআন।

সায়র হতবাক হয়ে ওর ক্রন্দনরত মুখের দিকে তাকিয়ে বললো,
—- এখনো আব্বাজান আব্বাজান করবে? পালিয়ে এসেছি তো আমরা।

ওদের কারোর কথার আগামাথা বুঝতে না পেরে অরু একই সাথে অনেক গুলো প্রশ্ন ছু’ড়ে বলে,
—- এলিসা আপু তুমি না ঘরে ছিলে? আর নীলিমার তো আজ আকদ হওয়ার কথা ছিল, তাহলে সায়র ভাইয়া…..?

অরুর সকল প্রশ্নকে অগ্রাহ্য করে ওর হাতটা টেনে ক্রীতিক বলে,
—- সব প্রশ্ন কাল করতে পারবি, অনেক রাত হয়েছে আমি ঘুমাবো, তাছাড়া ওদেরকেও সকাল সকাল ইন্ডিয়ার ফ্লাইট ধরতে হবে, চল এবার।

অরুর মাথাটা এমনিতেই ঘুরঘুর করছে, চোখের সামনে সব কিছু জটলা পাকিয়ে আছে, আর ক্রীতিক কিনা ঘুমাবে? এমন একটা ঘটনার পরে আদৌও ঘুম পায় কারও?আশ্চর্য!

অরু তৎক্ষনাৎ নিজের হাতটা ঝাড়ি মে’রে ক্রীতিকের থেকে ছাড়িয়ে বললো,
—- আপনার ঘুম পেলে আপনি গিয়ে ঘুমান, আমাকে কেন টানছেন?

ক্রীতিক চোয়াল শক্ত করে বললো,
— কেন টানছি বুঝতে পারছিস না?

অরু নাক ফুলিয়ে ত্যাড়া কন্ঠে বললো,
—- না বুঝতে পারছি না,বলুন?

ক্রীতিক এদিক ওদিক তাকিয়ে বললো,
—- উপরে চল বলছি।

— না এখানেই বলুন।

ক্রীতিক আর নিজেকে সংবরণ পারলো না, তখনই অরুকে কোলে তুলে নিয়ে উপরে যেতে যেতে সবার মধ্যেই বলে উঠলো,
—- তোর জামার মধ্যে মুখ ঢুকিয়ে ঘুমাবো তাই।

রুমের সামনে এসে ক্রীতিক দরজা খোলার উদ্দেশ্যে অরুকে কয়েক সেকেন্ডের জন্য কোল থেকে নামালে, অরু সেই সুযোগে ক্রীতিকের হাতে জোরে কামড় মে’রে দৌড়ে পালিয়ে যায়, ক্রীতিক ও আজ পন করে নিয়েছে ও আজ আর অরুকে ছাড়বে না,কিছুতেই না।

তাই ক্রীতিক ও এবার চুপচাপ এগিয়ে যেতে লাগলো অরুর পিছু পিছু।

অরু ছুটতে ছুটতে ছাঁদে চলে এসেছে, ক্রীতিক নিশ্চয়ই এতো রাতে ঘুম বাদ দিয়ে অরুকে তাড়া করে ছাঁদে চলে আসবে না? সেই ভেবে সস্থির নিঃশ্বাস নিলো অরু।

মাঝ রাতে আকাশে চাঁদ নেই, আছে কেবল
ঝিরিঝিরি মৃদু বাতাস, যে বাতাসে এলোমেলো হয়ে উড়ছে অরুর এক হাটু রেশমের মতো লম্বা চুল। অরু খোলা আকাশের দিকে মুখ তুলে দু’চোখ বন্ধ করে প্রান ভরে নিঃশ্বাস নিয়ে যেই না চোখটা খুললো,অমনি কোথা থেকে যেন ছুটে এসে ঝড়ের গতিতে অরুকে চেপে ধরে ওর ঠোঁটের মাঝ বরাবর দাঁত বসিয়ে দিলো ক্রীতিক।

অকস্মাৎ তীব্র ব্যথায় মৃদু আর্তনাথ করে উঠলো অরু, তরিৎ বেগে দু’হাতে খামচে ধরলো ক্রীতিকের শার্ট। একেবারে অরুর ঠোঁট থেকে কয়েক ফোটা র’ক্ত পান করে তবেই ওকে ছাড়লো ক্রীতিক। ছাড়া পেয়ে ইতিমধ্যে ফুলে ঢোল হয়ে যাওয়া ঠোঁটে হাত ছুয়িয়ে অরু আতঙ্কি’ত স্বরে বললো,
—- কি করেছেন এটা? র’ক্ত বেরোচ্ছে কেন?

ক্রীতিক কপট হেসে বললো,
—- কি ভেবেছিলি ছেড়ে দেবো?

অরু অভিমানি গলায় বললো,
— আপনি কখনো ছাড় দিয়েছেন আমাকে? সবসময়ই তো ব্যথা দিতে থাকেন।

কথা শেষ করে অন্য দিকে ঘুরে চোখ মুছলো অরু। ক্রীতিক ওর সংস্পর্শে এসে দাঁড়িয়ে অরুর খোলা চুলে চুমু খেয়ে ওর মাথার উপরে নিজের চিবুক ঠেকিয়ে শান্ত গলায় বলে,
—- আর আদর করিনা বুঝি?

অরু জবাব দেয়না, ক্রীতিক অরুকে ঘুরিয়ে ওর দু’গালে চুমু খেয়ে বলে,
—– আমি মে’রেছি আবার আমিই আদর করে দিচ্ছি, আর কোথায় কোথায় মে’রেছিলাম বল, সব আদর আজ একসাথে পুষিয়ে দেবো।

অরু ক্রীতিকের সুঠাম বুকে ধাক্কা মে’রে বলে,
—- লাগবেনা আপনার আদর। আমি কেউ নই আপনার, যান এখান থেকে।

ক্রীতিক সামান্য ঝুঁকে গিয়ে অরুর নাকটা হালকা টেনে দিয়ে বলে,
—- তুই ছাড়া কে আছে আমার, হুম?

ক্রীতিকের কথা গায়ে না লাগিয়ে, অরু পুনরায় পেছনে ঘুরে দাঁড়ালে, ক্রীতিক পেছন থেকেই ওকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে নির্লিপ্ত গলায় বলে,
—- তুই ছাড়া আমার কেউ নেই অরু, তুই ছাড়া আমার পৃথিবীটা মরীচিকার মতো , কোনো আলো নেই, কোনো রঙ নেই, কোনো সুঘ্রাণ নেই, অমার অরু নেই। আমার চোখে পৃথিবীর সমস্ত সৌন্দর্যের প্রতীক শুধু তুই, আমি পৃথিবীতে খুব একা বলেই হয়তো উপর ওয়ালা তোর মাঝে আমার সমস্ত সুখ রেখে দিয়েছে, নয়তো তুইই কেন বল?

হার্টবিট, আজকে এতো কথা তোকে কেন বলছি, জানিস ?

ক্রীতিকের প্রশ্নে অরু না সূচক মাথা নাড়ালে ক্রীতিক পুনরায় বলে,
—- কারণ তুই আমার বেঁচে থাকার অঙ্গীকার অরু, তোকে আমি এভাবেই সারাজীবন হৃদয়ের গহীনে আগলে রাখতে চাই,যখন ইচ্ছে হবে দু’হাতে তুলে আদর করবো, তারপর আবার সযত্নে লুকিয়ে রাখবো। আমার শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত তোকে আগলে রাখার দ্বায়িত্ব শুধু আমার।
even l will protect you, till my last breath baby…and l promise that.

তুই কেবল হৃদয় উজাড় করে আমাকে ভালোবাসবি, আমার জন্য পা’গল থাকবি, যেমনটা আজকে হয়েছিলি। বাকি পুরো দুনিয়া আমি একাই সামলে নেবো । আমার জীবনে তুই ছাড়া অন্য দ্বিতীয় নারী না কোনোদিন ছিল, আর না কোনো আসবে।জায়ান ক্রীতিক শুধু তোর বেইবি, শুধু তোর।

ক্রীতিকের কথা শেষ হতেই অরু আচমকা ঘুরে ক্রীতিকের গলা জড়িয়ে ধরে রিনরিনে আওয়াজে বলে,
—- আমি তোমাকে ভালোবাসি জায়ান ক্রীতিক, খুব ভালোবাসি, অকারণেই ভালোবাসি, ভালোবাসায় এতো কারন লাগেনা, তুমি আমার সেই লাগামহীন ভালোবাসা, যে ভালোবাসার গভীরতা আমি চাইলেও কোনোদিন উপলব্ধি করতে পারবো না,কখনোই না।

ক্রীতিক নিজেদের অধর যুগলের মাঝে থাকা দূরত্বটুকু ঘুচিয়ে গভীর চুম্বনের তালে বলে,
—- আই লাভ ইউ টু বেইবি।

ধীরে ধীরে ক্রীতিকের ভালোবাসার স্পর্শ গভীরতা লাভ করতেই অরু ছিটকে দূরে সরে যায়। ক্রীতিক দু’কদম এগিয়ে গিয়ে ব্যকুল কন্ঠে বলে,
—- কি হয়েছে কাছে আয়?

অরু ক্রীতিকের চোখে চোখ রেখে না সূচক মাথা নাড়ালে ক্রীতিক আসল ঘটনা বুঝতে পেরে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে, জিভ দিয়ে অধর ভিজিয়ে বলে,
—- ইটস ওকে, মুখে বললেই তো হয়,এতো ভ’য় পাওয়ার কি আছে আমি কি মানুষ নই নাকি? এখনও পেট ব্যথা করছে?

অরু এবারও চুপচাপ না সূচক মাথা নাড়ালে ক্রীতিক ওর কপালে চুমু এঁকে দিয়ে বলে,
—- ঠিকাছে নিচে চল অনেক রাত হয়েছে, আমাদের ঘুমানো প্রয়োজন।

******************************
সকাল সকাল এয়ারপোর্টে এসেছে ওরা সবাই, নীলিমার আব্বাজান ওদের নাগাল পাওয়ার আগেই সায়রের বাড়ি দার্জিলিং এর উদ্দেশ্যে ইতিমধ্যে বেরিয়ে পরেছে ওরা।

ইমিগ্রেশন শেষ করে নীলিমা আর সায়র ভেতরে প্রবেশ করলে, বাইরে থেকে দাঁড়িয়ে মুখটা মলিন করে অরু বলে,
—- ইশ! দার্জিলিং ভ্রমনে যাওয়া আমার ছোট বেলার শখ, অথচ নীলিমা কত সহজেই চলে যাচ্ছে।

ক্রীতিক পাশে দাড়িয়ে ফোন স্ক্রল করছিল, অরুর কথা শুনে মাথা তুলে ক্রীতিক শুধায়,
—- যেতে চাস, দার্জিলিং এ??

অরু কোনোকিছু না ভেবেই হ্যা সূচক মাথা নাড়ালো, তৎক্ষনাৎ অরুর হাতটা ধরে ক্রীতিক চট করে বলে ওঠে,
—- চল তাহলে।

অরু হতবিহ্বল কন্ঠে বলে ওঠে,
—- কি বলছেন? পাসপোর্ট নেই,টিকেট নেই কিভাবে যাবো?

—- সব আছে আমার কাছে।

ক্রীতিক এক প্রকার ছুটছে অরুর হাতটা ধরে, অরুও ক্রীতিকের সাথে দ্রুত পা ফেলে হাঁটতে হাঁটতে বললো,
—- আর জামা কাপড়?

ক্রীতিক বললো,
—- যা যা লাগবে সব কিনে দেবো, এখন দ্রুত চল, নইলে ফ্লাইট মিস হয়ে যাবে।

অরুও এবার আর ঘাবড়ালো না, দু’হাতে শক্ত করে ক্রীতিকের বলিষ্ঠ হাতটা ধরে সামনে এগিয়ে যেতে যেতে আবদারের সুরে বলে,
—- আমার একটা হ্যাট চাই, আর একটা ক্যামেরাও।

ক্রীতিক মৃদু হেসে অরুর কপালে শব্দ করে চুমু খেয়ে বলে,

—- এজ ইউ উইশ বেইবি।

চলবে……..

#সঙ্গিন_প্রনয়াসক্তি 🍁🍁
#পর্বঃ৪৯
#লেখনীতে_suraiya_rafa
(ক,পি করা নিষিদ্ধ 🚫)
(কঠোরভাবে প্রাপ্তমনষ্ক ও মুক্তমনাদের জন্য)

“দার্জিলিং”নামটা শুনলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে মেঘে ঢাকা, বৃষ্টিভেজা,সবুজে ঘেরা এক অপার্থিব দৃশ্যপট। উঁচু নিঁচু পাহাড়, সারি সারি চা বাগান, ছোট বড় ঝরনা, জানা অজানা বুনোফুল আর মেঘমল্লার আস্তরণে মুড়িয়ে থাকা এই পাহাড়ি শহরটাকে প্রকৃতি প্রেমীদের সর্গ রাজ্য বললে খুব একটা ভুল হবেনা বৈকি।

দার্জিলিং এর আরও একটি প্রধান আকর্ষন হলো, ব্রিটিশ আমলের তৈরি সেই আশির দশকের কয়লা চালিত টয় ট্রেন। সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে প্রায় ছয়হাজার সাতশত ফুট উচ্চতায় অবস্থিত এই পাহাড়ি শহরের নামকরণের সুস্পষ্ট কোনো ইতিহাস নেই, তবে লোকমুখে শোনা যায়,”দর্জেলিং” শব্দ থেকেই দার্জিলিং এর উৎপত্তি । দর্জে মানে বজ্র আর লিং মানে হলো দেশ, এককথায় দার্জিলিং মানে বজ্রেরদেশ।আবার অনেকের মতে সতেরো’শ পয়ষট্টির দিকে কোনো এক লামা এদেশের মাটিতে পা রেখেছিলেন তার নামানুসারেই দার্জিলিং নামকরণ করা হয়।

শুধু মাত্র যে দার্জিলিং তেমনটা নয়, চোখের খোরাক, মনের বাসনা মেটাতে এর পরবর্তী নর্থ সিকিম, সিটং সবগুলোই যেন প্রকৃতির বক্ষস্থল। শহুরে একঘেয়ে জীবনের ভার বইতে বইতে ক্লান্ত পরিশ্রান্ত মানুষগুলোকে একটু খানি সস্থির সঞ্চার খুজে দিতেই বোধ হয় উপরওয়ালার এই নিদারুণ সৃষ্টি।

চা পল্লবে ঘেরা সুউচ্চ পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থিত হোম’স্টে র যে ছোট্ট ছোট্ট কটেজ গুলো রয়েছে, তারই মধ্যে একটা কটেজের খোলা বারান্দায় বেতের চেয়ার আর বেতের কারুকাজ করা রেলিং এ কনুই ঠেকিয়ে গালে হাত দিয়ে বসে আছে অরু। ওর মোহাবিষ্টের মতো চোখ দুটো পাহাড়ি ঢাল বেয়ে নামা সারি সারি চা বাগানে নিবদ্ধ,চা বাগানের পাশ দিয়েই কলকলিয়ে বয়ে যাচ্ছে সরু ঝর্ণার বহর,কাচের মতো দেখতে ঝর্ণার সেই স্বচ্ছ পানিতে টুপটাপ ঝড়ে পরছে হাওয়ায় উড়ে আসা রংবেরঙের বুনোফুল।

সকাল সকাল মেঘের চাদরে ঢাকা পরেছে প্রকৃতি,অথচ
মাত্রই একপশলা বৃষ্টি হলো ঝমঝমিয়ে, ঝড়ে পরা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বৃষ্টি কনা গুলো সযত্নে ঠায় নিয়েছে চা পাতার গায়ে, নিয়ন সূর্যকীরনে সেই বৃষ্টি কনা গুলো ঝিল ধরছে বারেবারে, যেন এক নজরে দেখলে মনে হবে, চা-পাতা উপর কেউ সযত্নে স্বচ্ছ হিরের টুকরো সাজিয়ে রেখেছে।

অরু সেই সকাল থেকে বসে বসে মুগ্ধ নয়নে দেখেই যাচ্ছে এসব। দেখতে দেখতে চোখ জুড়িয়ে আসছে তবুও মন ভরছে না, বারবার ভাবনারা এক জায়গাতেই আটকে যাচ্ছে, প্রকৃতি এতো অপরূপ কেন? দু’গালে হাতদিয়ে চারিদিকে মুগ্ধ হয়ে চেয়ে নয়ন জুড়াচ্ছে অরু, আর মনেমনে ভাবছে কালকের কথা,

কাল ক্রীতিকের সাথে ওমন তাড়াহুড়ো করে ফ্লাইটে উঠে আরও একদফা ঝটকা খেয়েছিল অরু। অরুর পড়নে তখন হালকা গোলাপি টপস আর সুতির ঘাগড়া ছিল,লম্বা চুল গুলো ছিল ক্লাচার দিয়ে বাঁধা, ওর পেছন পেছনই উঠেছিল ক্রীতিক,ফ্লাইটে ওঠার পরেও ক্রীতিক এমন একটা ভাব করছিল যেন ও আরেকটা দেশে নয়,বরং মতিঝিল থেকে হাতিরঝিল যাচ্ছে। চারিদিকের পরিস্থিতিতে একটু ও মাথাব্যথা নেই, আর না আছে কোন হেলদোল, ফোন স্ক্রল করছে তো করছে করছেই।

ওর কান্ডে একপর্যায়ে বিরক্ত হয়ে পেছনে ঘুরে অরু শুধায়,
— আমাদের সিট কোথায়?

ক্রীতিক ফোন থেকে চোখ সরিয়ে আলগোছে নিজের চুলে আঙুল বোলাতে বোলাতে বলে,
—- বিজনেস ক্লাসে।

— আপনি এতোটুকুর মধ্যে বিজনেস ক্লাস কিভাবে ম্যানেজ করলেন? আশ্চর্য!

অরুর কথায় ক্রীতিক নির্বিকার ভঙ্গিতে উত্তর দিলো,
—- সামনে চল দেখতে পাবি।

অরু ত্যক্ত দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ক্রীতিককে রেখেই গটগটিয়ে বিজনেস ক্লাসের দিকে এগিয়ে গেলো। কেভিন ক্রু দের সাহায্যে বিজনেস ক্লাস খুঁজে নিয়ে, দরজাটা খুলে অরু ভেতরে পা রাখার সঙ্গে সঙ্গে ভীষণ ভাবে চমকালো, সাথে ভয় ও পেলো মারা’ত্মক।

কারন ওকে দেখেই ভেতর থেকে এলিসা,অর্ণব, ক্যাথলিন ওরা সবাই একযোগে চেঁচিয়ে উঠে বললো,
— সারপ্রাইজ!

অকস্মাৎ চিৎকারে হকচকিয়ে উঠলো অরু,সবাইকে এখানে এভাবে দেখতে পেয়ে মস্তিষ্ক আপাতত হ্যাং হয়ে আছে ওর, তাই অরু কোনোকিছু না ভেবে আবারও পেছনে ঘুরলো ক্রীতিকের কাছে যাওয়ার উদ্দেশ্যে, তবে পেছনে ঘোরার সঙ্গে সঙ্গে একটা শক্ত ঢেউ খেলানো পুরুষালী বুকে ধাক্কা খেয়ে থমকে গেলো অরু, তাড়াহুরো করে মাথা তুলতেই দেখতে পেলো এটা ক্রীতিক।

পরনে নেভি ব্লু হুডি আর ব্ল্যাক ওভার সাইজ ডেনিম,সামনের চুলগুলোকে সামলাতে মাথায় আটকানো কালো টুপি,আর ঠোঁটের কোনে লেগে আছে এক রহস্যময় হাসি, অরু ধরতে পারলো না ক্রীতিকের এই হাসির আসল কারন।অগত্যা, চোখ বড়বড় করে বিস্ময়ে ক্রীতিকের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো অবুঝের মতো ।

ক্রীতিক ওর রহস্যময় হাসির অবসান ঘটিয়ে কাঁধ বাকিয়ে অরুর চোখে চোখ রেখে শান্ত স্বরে বললো,
—- হ্যাপি ফার্স্ট হানিমুন জার্নি বেইবি।

ক্রীতিকের কথাতে অরুর চোয়াল ঝুলে পরার উপক্রম , এমন একটা আকস্মিক ঘটনায় আপনা আপনি ওর দু’হাত চলে গেলো নিজের মুখের উপর । অরু একবার ওদের সবার দিকে তাকাচ্ছে, তো আরেকবার ক্রীতিকের দিকে, এদিক ওদিক তাকিয়েই অস্ফুটে বলে ওঠে,
—- তারমানে এটা প্রি-প্ল্যান?

ক্রীতিক হ্যা সূচক মাথা নাড়ালে অরু পুনরায় ঠোঁট ফুলিয়ে বলে,
—- তাহলে আমাকে ব্যাগ গোছাতে কেন বললেন না? আমিতো কিছুই নিয়ে আসিনি।

ক্রীতিক ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,
—-উহুম, মন খারাপ করতে হবে না,সব কিনে দেবো বেইবি, এনিথিং ইউ নিড।

.
জামাকাপড়ের কথা মনে পরতেই অরু সম্বিত ফিরে পেয়ে নিজের শরীরের দিকে চাইলো, কাল রাতে ঝুম বৃষ্টিতে ভিজে ওরা কোনমতে হোম’স্টে তে এসে উঠেছিল, রাতের বেলা এমন পাহাড়ি এলাকায় বৃষ্টির মাঝে দোকানপাট সবই বন্ধ ছিল যার ফলরূপ জামা কাপড় আর কেনা হয়নি অরুর।

রাতে টপস খুলে গায়ে ক্রীতিকের হুডি চড়িয়ে ঘুমিয়েছে, আর এখনো সেভাবেই। কিন্তু এভাবে আর কতক্ষণ বসে থাকবে ও, তাছাড়া ক্রীতিক ও তো কোনো জামাকাপড় আনেনি, জামা কাপড় তো দূরে থাকে টুথব্রাশ টুথপেষ্ট টা পর্যন্ত নেই ওদের কাছে।

বিষয়টা বোধগম্য হতেই বারান্দা ছেড়ে বেডরুমে প্রবেশ করলো অরু। ক্রীতিক এখনো কম্ফোর্টার মুড়ি দিয়ে খালি গায়ে ঘুমুচ্ছে। বিয়ের বয়স বেশ কয়েক মাস হলেও, অরু ক্রীতিকের একসাথে এক ঘরে রাত্রি যাপন করা হয়েছে হাতে গোনা কয়েকবার মাত্র। সেখানে কাল রাতে ওরা দুজন সত্যি কারের আর পাঁচটা স্বামী স্ত্রীর মতোই একসাথে একঘরে এক বিছানাতে ঘুমিয়েছে,বিষয়টা অরুর চিত্তে প্রশান্তির ঝড় বয়িয়ে দেয়, হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসাটুকু উগড়ে আসে বারবার। হুটহাট মনে হতে থাকে উনি সত্যিই আমার পাশে? সত্যিই?অবিশ্বাস্য!

অরু যে কয়েকদিনই ক্রীতিকের সাথে ঘুমিয়েছে, ও খেয়াল করেছে ক্রীতিক সবসময় উপুর হয়ে ঘুমায়, ওর চওড়া পুরুষালী পৃষ্ঠদেশ কখনোই কম্ফোর্টারের আড়ালে ঢাকা পরেনা। বিষয়টা বরাবরই অরুর আকর্ষন কেড়ে নিতে সক্ষম। এই লোক ঘুমের মাঝেও ম্যানলি আচরণ করে। অরু ভেবে পায়না ক্রীতিক এমন কেন? একটু কি কিউট হওয়া যায়না? সবসময়ই ডার্ক চকলেট হতে হবে? একটু আধটু মিল্ক চকলেট হলে ক্ষতি কি?.

অরুর মন গহীনের অযাচিত প্রশ্নের উত্তর দিলো না গাঢ় ঘুমে বিভোর হয়ে থাকা ক্রীতিক। অরু মনের ভাবনা মনে পুষে রেখেই এগিয়ে গিয়ে কাঠের তৈরি তকতকে মেঝেতে হাঁটু মুড়ে ক্রীতিকের শিওরে বসে পরে, এরপর হাত বাড়িয়ে ওর ঘাড় ছুঁই ছুঁই এলোমেলো চুল গুলোতে নিজের নরম তুলতুলে আঙুল চালাতে চালাতে আনমনে বলে ওঠে,
—- আমার কেন যেন বিশ্বাস হচ্ছে না আপনি আমার এতোটা কাছে, আপনি কি সত্যিই সেই জায়ান ক্রীতিক? যার বিছানায় ভুল করে ঘুমিয়ে ছিলাম বলে আমাকে চোখ দিয়েই ভ’স্ম করে দিয়েছিলেন?

আপনি কি সেই জায়ান ক্রীতিক? যার সামনে একটু আওয়াজ করে কেঁদে ছিলাম বলে আমাকে কনকনে ঠান্ডার মাঝেই বাইরে বের করে দিয়েছিলেন? আমারতো এখনো সেই শুরু থেকে এই পর্যন্ত চোখ বন্ধ করলে মনে হয় সবটা স্বপ্ন।এতো ভালোবাসা, এতো আবেগ, আপনার এই মাত্রাতিরিক্ত আসক্তি সবকিছু আমার মতিভ্রম মনে হয় মাঝেমাঝেই ?যেন এক্ষুনি ভ্রম কেটে যাবে আমার, আর আপনিও আমাকে রেখে হারিয়ে যাবেন সেই সূদুর ক্যালিফোর্নিয়ায়। দিন যাবে, মাস যাবে, বছর যাবে আপনার দেখা আর আমি পাবোনা। সেই আগের মতো, এর ওর মুখে শুধু নামটাই শুনবো আপনার, ক্রীতিক কুঞ্জের ছোট সাহেব জায়ান ক্রীতিক চৌধুরী।

কিন্তু এবার তো আমি আর সহ্য করতে পারবো না সেই দ’হন, বলুন? সত্যি বলছি তেমনটা হলে আমি ম’রেই যাবো,কারন ক্রীতিক কুঞ্জের ছোট সাহেব তো কেবল ক্রীতিক কুঞ্জেরই মালিক নয়, আমার মন,প্রান, আত্না সবকিছুর দখলদারি ও যে একমাত্র তার।

জায়ান ক্রীতিক, আপনি হরণ করেছেন আমার হৃদয়, ভালোবাসার সংজ্ঞা না জানা এক তরুণীর বুকে আপনি ভালোবাসার বি’ষা’ক্ত তী’র নিক্ষেপ করেছেন, সূত্রপাত করেছেন প্রকান্ড জলোচ্ছ্বাসের। আর এখন আমার মনে ভালোবাসার তুফান বাঁধিয়ে দিয়ে, আমার স্বপ্ন ভেঙে হারিয়ে গেলে আপনার খবর আছে।
যেদিন আপনাকে খু্ঁজে না পাবো, সেদিন আমিও হারিয়ে যাবো অলীক আকাশে, সবচেয়ে উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়ে ক্যালিফোর্নিয়ার রাতের আকাশে ঘুরে বেড়াবো, তখন খুঁজবেন তো আমাকে? মনে পরবে তো আমার কথা?

হুট করেই স্বপ্নের মতো করে পাওয়া মাত্রাতিরিক্ত ভালোবাসার উচ্ছাসে,একরাশ কাতরতা ঘীরে ধরেছে অরুর হৃদয় , এতোটা সুখ ওর কপালে সইবে কিনা তা নিয়েও সন্দিহান মেয়েটা, ওর কাছে জায়ান ক্রীতিক মানে অমূল্য সম্পদ, যা ও না চাইতেও নিজের করে পেয়েছে, হারিয়ে যাওয়ার ভ’য় তো একটু থাকবেই, এই মূহুর্তে সেই ভয়েই জর্জরিত হয়ে টুপটাপ অশ্রুকনা বিসর্জন দিচ্ছে অরু।

ক্রন্দনরত অরুর ফোপাঁনোর আওয়াজে ঘুমের মাঝেই একটু নড়েচড়ে উঠলো ক্রীতিক, ঘুমঘুম গলায় অস্পষ্ট আওয়াজে ডেকে উঠলো অরুকে,
— বেইবি.. কোথায় তুই?

ক্রীতিক মাত্রই নড়েচড়ে উঠেছে দেখে অরু তাড়াহুড়ো করে চোখের পানিটুকু মুছে নিজেকে স্বাভাবিক করে, শান্ত স্বরে বললো,
— এই যে, উঠুন এবার, শপিং এ যেতে হবে তো। আমাদের পড়ার কিছু নেই তো এখানে বাথরব ছাড়া ।

অরুর কথার পাছে ক্রীতিক বালিশে মুখ ঘষতে ঘষতে হাস্কিস্বরে বললো,
— কেন, নেই কেন? কালকে তো কিছু করিনি।

অরু এবার উঠে দাড়িয়ে বিরক্ত স্বরে বললো,
— কাল যে এক কাপড়ে দার্জিলিং চলে এলেন, তা ভুলে গিয়েছেন?

অরুর কথায় এতোক্ষণে টনক নড়লো ক্রীতিকের, তবে ওর মধ্যে শপিং এ যাওয়ার কোনোরকম হেলদোল দেখা গেলোনা, ও শরীরের কম্ফোর্টারটা আরেকটু ভালোভাবে গায়ে চড়িয়ে নতুন উদ্যমে ঘুমাতে ঘুমাতে অস্পষ্ট আওয়াজে বললো,
— ওয়ালেটে ইন্ডিয়ান কার্ড আছে যেটা খুশি নিয়ে যা, আমি এলিসাকে ফোন করে বলে দিচ্ছি ও তোর সাথে যাবে।

—এই অচেনা দেশে শুধুমাত্র এলিসা আপুকে ভরসা করে আপনি আমাকে একা ছেড়ে দেবেন?

ক্রীতিক জুতসই আরাম করে শুয়ে বললো,
— আমি সঙ্গে গেলে ঠিক তোকে যেভাবে আগলে রাখতাম, এলিসাও সেভাবেই রাখবে, আই বিলিভ ইন হার। এখন যা তো, ঘুমাতে দে,নয়তো রাইড করতে পারবো না।

—- আপনি এখানেও রাইডিং এ যাবেন, তাও এই পাহাড়ি রাস্তায় বৃষ্টির মাঝে?

— উমম,হুমমম।

অরুর কথার প্রতি উত্তরে ঘুমের দেশে তলিয়ে যেতে যেতে জবাব দিলো ক্রীতিক।

.
অরু শপিং এর উদ্দেশ্যে বেরিয়েছে অনেকক্ষন, বেলা বেজেছে দশটা কি এগারোটা, ক্রীতিক এখনো ঘুমে তলিয়ে আছে, কি জানি কতদিনের ঘুম একসাথে ঘুমাচ্ছে ও। তবে ক্রীতিকের এই আরামের ঘুম বোধ হয় খুব একটা সহ্য হলোনা ওর ব্যাংক ম্যানেজারের,সেই সকাল থেকে মুঠো ফোনের ভাইব্রেট বাজিয়ে ম্যানেজার সাহেব কল দিয়েই যাচ্ছেন তো দিয়েই যাচ্ছেন।

ভাইব্রেটের কাঁপা আওয়াজে একপর্যায়ে ঘুম ছুটে গেলে নড়েচড়ে উঠে ফোন রিসিভ করলো ক্রীতিক। এপাশ থেকে হ্যালো বলার সঙ্গে সঙ্গে ম্যানেজার সাহেব সালাম জানিয়ে উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলে ওঠে ,
— স্যার আপনি বোধ হয় ঘুমিয়ে, বিরক্ত করার জন্য দুঃখিত স্যার, বাট স্যার ইটস আর্জেন্ট।

— হ্যা বলুন।

ক্রীতিকের অনুমতি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে লোকটা বললো,
—- স্যার সকাল সকাল আপনার ব্যাংক একাউন্ট থেকে কয়েক লক্ষ টাকা উইড্রো করা হয়েছে।

ক্রীতিক মুখ থেকে একটু বিরুক্তিকর আওয়াজ বের করে বললো,
— সো হোয়াট?

ম্যানেজার সাহেব ভেবেছিল ক্রীতিক হয়তো অবাক হবে কিংবা প্রোপার ইনফেকশন জানতে চাইবে, কিন্তু তেমন কিছু না হওয়াতে তিনি ভরকে গিয়ে বললেন,
—- না মানে স্যার হুট করে সকাল সকাল এতোগুলা টাকা..

ম্যানেজারের কথা শেষ হওয়ার আগেই ক্রীতিক মাঝ পথে বলে ওঠে,
— ডোন্ট ওয়ারী ইট’স জাস্ট মাই ওয়াইফ।

ম্যানেজার সাহেব তৎক্ষনাৎ নিজের বোকামিতে খামি খেয়ে দূর্বল গলায় বললো,
— ওহ ওকে স্যার,দেন ইট ওয়াজ মাই মিসটেক,আ’ম রিয়েলি সরি।

তারপর ওপাশ থেকে ভেসে এলো কল কেটে দেওয়ার পিক পিক আওয়াজ।
ম্যানেজার সাহেব কল কেটে দিলে,হাতের ফোনটা বিছানার একপাশে ছুঁ’ড়ে ফেলে দিয়ে, ক্রীতিক আবারও চোখ বুজে মৃদু হেসে অস্ফুটে বললো,
— বউটা বড় হচ্ছে, স্বামীর টাকা কিভাবে ওড়াতে হয় তার যথাযথ ট্রেনিং নিচ্ছে, গুড জব এলিসা।

**********************************************

ক্রীতিকের কটেজের পাশেই যে কটেজটা অবস্থিত তার বেলকনিতেই আপাতত বসে আছে নীলিমা। কোনোরকম চেয়ারে কিংবা স্টুলে নয় মেঝেতে বসে আছে মেয়েটা,পরনে এখনো সেই দু’দিন আগের বাসী বেনারসি। ডাগর ডাগর চোখ দুটো ক্লান্তিতে কোটরে ঢুকে গিয়েছে, মুখশ্রী মলিন।

সেই মলিন মুখেই নিস্প্রভ চোখে বাইরে তাকিয়ে আছে নীলিমা, বক্ষপিঞ্জর থেকে ক্রমাগত উগরে আসছে চাপা দীর্ঘশ্বাস। নীলিমা যখন ওর জীবনের সাথে ঘটে যাওয়া চাঞ্চল্যকর ঘটনাগুলো ভেবে ভারী দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো, ঠিক সেসময় রুমে প্রবেশ করে সায়র, সায়রের চোখ মুখও ভীষণ গম্ভীর, সব সময়ের চঞ্চল হাসিখুশি, ঠান্ডা মস্তিষ্কের সায়র সত্তাটা হুট করেই কাল থেকে কেমন উধাও।

সায়রের হাতে কিছু শপিং ব্যাগ ছিল, ও সেগুলোকে নীলিমার সামনে ধরে গম্ভীর গলায় বললো,
— চেঞ্জ করে নাও।

নীলিমা ঝগড়া করার অবস্থায় নেই, তাছাড়া সায়রের চোখ মুখ দেখেও মনে হচ্ছেনা যে ও ঝগড়া করতে ইচ্ছুক, তার উপরে দুদিন ধরে এক কাপড়ে থাকার দরুন শরীরটাও কেমন কুটকুট করছে, তাই উপায়ন্তর না পেয়ে প্যাকেট গুলো হাতে নিলো নীলিমা। আসলে গতকাল অরু বেশকিছু জামাকাপড় দিয়েছিল নীলিমাকে, কিন্তু অরুর তুলনায় নীলিমা একটু গুলুমুলু আর লম্বা হওয়ায় সেগুলো নীলিমার হয়নি, কারন অরু বেশির ভাগই লং স্কার্ট আর টপস পড়ে, আর না তখন জামার কাপড় নিয়ে ওর কোনোরকম খেয়াল ছিল। অগত্যা এক কাপড়েই একদেশ থেকে পারি দিয়ে আরেক দেশে চলে আসতে হলো নীলিমাকে।

নীলিমা কাপড় নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে গেলে, সায়র গিয়ে বারান্দায় দাড়ালো।

বারান্দার রেলিং এ দু’হাত ভর করে দাঁড়িয়ে চারিদিকে চোখ বোলাতেই বুক চিড়ে একফালি তপ্ত দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো সায়রের। এটা মূলত সায়রের হোম’স্টে,শুধু একটা নয়, দার্জিলিং, সিটং মিলিয়ে বেশ কয়েকটা হোম’স্টে রয়েছে সায়রের।

সবগুলোই সায়রের বাঙালী ম্যানেজার দ্বায়িত্ব নিয়ে দেখা শুনা করেন। সায়রের পৈতৃক নিবাস দার্জিলিং এ। তবে পূর্বপুরুষ আর বন্ধু মহল বাংলাদেশী হওয়ায় বাংলাটা ওর ভালোই আয়ত্তে। সায়রের বাবা মা নেই, বাড়িতে কাকা জেঠা দুঃর্সম্পর্কের আত্নীয় স্বজন যারা রয়েছেন তাদের সাথেও সায়রের একেবারে যোগাযোগ নেই বললেই চলে, এককথায় বলা যায় পুরো পৃথিবীতে একটা নীলিমা আর একটা শক্ত ভীতের মতো বন্ধুমহল ছাড়া সায়রের আপন বলে কেউ নেই।

তাইতো নিজের শহরে ফিরে নতুন বউ আর বন্ধুদের নিয়ে , নিজের সবচেয়ে পছন্দের হোম’স্টে তেই উঠেছে সায়র। এখন শুধু অপেক্ষার পালা, সায়রের নব্য বিবাহিতা রাগীনি সবকিছুর জন্য সায়রকে আদৌও ক্ষমা করে মেনে নেবে?নাকি মা বাবার মতো সেও তার নিজস্ব পথ বেছে নিয়ে সায়রকে একা করে দিয়ে চলে যাবে?

সায়রের ভাবনার ছেদ ঘটে কাঠের দরজা খোলার খুটখাট আওয়াজে, সম্বিত ফিরে এলে সায়র পেছনে তাকিয়ে দেখতে পায় নীলিমা দাঁড়িয়ে আছে, পরনে ওর কিনে দেওয়া ফ্লোরাল প্রিন্টের সুতির চুড়িদার।

সায়রের পছন্দ বরাবরই অতুলনীয়,যার ফলরূপ বন্ধুমহলের অগাধ বিশ্বাস একবার সায়রের চোখ যেটাতে আটকে যায় সেটা সুন্দর হবেই হবে। সেক্ষেত্রে বলা যায় সায়রের চোখ নীলিমাতে আটকে গিয়েছিল তাই নীলিমাও যথেষ্ট সুন্দরী রমনী। আর এই মূহুর্তে সায়রের কিনে দেওয়া জামা পড়ে ওকে আরও বেশি আকর্ষনীয় আর লাবন্যময়ী লাগছে সায়রের দু’চোখে।

বারবার মনে হচ্ছে বাইরের অপরূপ প্রকৃতির মাঝে নীলিমাকে বসিয়ে দিলে প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য ও বোধহয় ফিকে হয়ে যাবে এই শ্যামলতা তরুনীর কাছে। কি সুন্দর মেয়েটা, ফ্লোরাল চুড়িদারে চাপা গায়ের রঙটাও কেমন জ্বলজ্বল করছে। আজকে বোধহয় নতুন করে আবারও সায়র মুগ্ধ হলো তার রাগীনির রূপে। তবে মুখে টু শব্দও করলো না, নীলিমার দিকে এগিয়েও গেলো না, বরং চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো যথাস্থানে।

সায়র কোন কথা বলছে না দেখে নীলিমাই ধীর পায়ে এগিয়ে এলো, সায়রের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে মনেমনে নীলিমা ভাবছে,
— কি হলো লোকটার? এতোদিন তো কথা বলে বলে পা’গল করে দিতো, অযথা বিরক্ত করতো, ভুলভাল জোক্স শোনাতো, অথচ আজ এমন একটা পরিস্থিতিতে চুপ করে আছে কেন? এমন একটা ভাব যেন উনি আমাকে নয়, আমিই ওনাকে বিয়ের আসর থেকে তুলে এনে বিয়ে করেছি। আশ্চর্য!

নীলিমা সামনে এসে চুপচাপ দাড়িয়ে আছে দেখে সায়র নির্লিপ্ত কণ্ঠে শুধালো,
— কিছু বলবে? জামা কাপড় সব ঠিকঠাক হয়েছে?

নীলিমা নিজের নিচু মাথাটা এদিক ওদিক নাড়িয়ে ইতস্তত কন্ঠে বললো,
— ইনারের সাইজ ঠিক হয়নি।

নীলিমা এতো সহজে কথাটা বলে দিলো যে, ওর কথাটা শুনে সায়রের আচমকা কাশি উঠে গেলো, ও কাশতে কাশতে নিজেকে সামলে নিয়ে বললো,
— আসলে, আমিতো জানতাম না, তাই ওইভাবে আরকি বুঝতে পারিনি।সমস্যা নেই বিকেলে সবাই ঘুরতে বের হবে তখন এক ফাঁকে কিনে দেবো, আমাকে একচুয়াল সাইজটা বলে দিও।

নীলিমা সঙ্গে সঙ্গে চোখ তুলে ভ্রুকুটি করে বললো,
— আপনি কিনে দেবেন?

সায়র কাশতে কাশতে মাথা চুলকে এদিক ওদিক তাকিয়ে বোকাদের মতো বললো,
—- এখানে আমি ছাড়া কিনে দেওয়ার মতো আর কেউ আছে?

***********************************************

দু’হাত ভর্তি শপিং ব্যাগ নিয়ে মাত্রই হোম’স্টে ফিরলো অরু, দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়েছে অথচ সূর্যি মামার দেখা নেই আজ । শহরের দিকে যা ও একটু সূর্যরশ্মী চোখে পরেছে, পাহাড়ের চূড়ায় উঠতে উঠতে সেটাও মিলিয়ে গিয়েছে।

চারিদিক মেঘাচ্ছন্ন, পেজা তুলোর মতোন মেঘেদের ভেলায় সবুজ চা বাগানকে গাঢ় সবুজ লাগছে, কি অপরূপ দৃশ্য, অরু আরও একদফা মুগ্ধ হতে হতে কটেজে ফিরে এলো, দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করে শপিং ব্যাগ গুলো একপাশে রেখে অরু এদিক ওদিক ক্রীতিক কে খুঁজতে ব্যস্ত হয়ে পরে।

ও এমন একটা পর্যায়ে আছে যে, ক্রীতিককে ঠিক কি বলে সম্মোধন করবে সেটা ভেবে পায়না, ভালোবাসা যখন চরম শিখরে পৌঁছে যায়,কিংবা একান্ত কাছাকাছি মূহুর্ত গুলো, তখন তো নাম ধরেই ডেকে ফেলে, কিন্তু সচরাচর নাম ধরে ডাকাটা অরুর কেমন মুখে বাঁধে, কারণ সম্পর্ক যাই হোক ক্রীতিক ওর চেয়ে বারো বছরের বড়। এদিকে কিছু একটা বলে ডাকা যাচ্ছে না দেখে অরু চোখ দিয়ে খুঁজে খুঁজে হয়রান, এক পর্যায়ে উপয়ান্তর না পেয়ে অরু ভাইয়া বলেই ডেকে উঠলো ক্রীতিককে,
— ক্রীতিক ভাইয়া শুনছেন,কোথায় আপনি?

অরু ডেকে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে ক্রীতিক ওকে টান মে’রে বারান্দায় নিয়ে এসে দেওয়ালে চেপে ধরলো, কপালটা ভীষণ ভাবে কুঁচকে রেখে শক্ত গলায় বললো,
— কে তোর ভাইয়া?

অরুর মুখে জবাব নেই, ও তাকিয়ে আছে ক্রীতিকের দিকে, আজ এই প্রথম ক্রীতিককে গ্লাস পড়তে দেখলো অরু, চিকন ফ্রেমের বড়বড় দুটো জুতসই গ্লাসে তাকে মারাত্মক সুদর্শন লাগছে, আজকাল ল্যাপটপে কাজ করলেই চোখে গ্লাস লাগায় ক্রীতিক। আর এই মূহুর্তে চশমা পরিহিত ক্রীতিককে এতোটা কাছে দেখে শুষ্ক একটা ঢোক গিললো অরু, পরক্ষনেই ভেতরের উথাল পাথাল অবাধ্য অনুভূতি গুলো দমাতে চোখ নামিয়ে নিলো নিচে চাইলো ও।

অরু নিচে চেয়ে আছে দেখে ক্রীতিক ওর দিকে সামান্য গ্রীবা নামিয়ে হিসহিসিয়ে বললো,
—- কে তোর ভাইয়া, আন্সার মি্?

অরু জবাব দিলো না,মাথা নিচু করে ঠোঁট কামড়ে দাঁড়িয়ে রইলো শুধু।

—- ডু ইউ থিংক আ’ম ইওর ব্রাদার?

ক্রীতিকের কথায় অরু এবার তাড়াহুড়ো না সূচক মাথা নাড়ালে ক্রীতিক পুনরায় বলে,
— ওকে ফাইন,তাহলে আমার গ্লাস খোলো।

তৎক্ষনাৎ অরু চকিতে মাথা উঁচিয়ে ক্রীতিকের চোখে চোখ রাখলো, নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না ও, কি বললো মাত্র ক্রীতিক? খোলো?

প্রথমবার তুমি সম্মোধনে হুট করেই কেমন যেন একটা বউ বউ শিহরণ ছড়িয়ে গেলো অরুর সর্বাঙ্গ জুড়ে। অরু কাঁচুমাচু করছে দেখে ক্রীতিক পুনরায় বললো,
—- আমি কিছু বলেছি, আমার চশমাটা খুলে ফেলো অরু।

অরু এবার কথা শুনলো ক্রীতিকের, নিজের কম্পিত দু’হাত বাড়িয়ে খুলে ফেললো ক্রীতিকের গ্লাস, গ্লাস তখনো অরুর হাতেই ছিল, ক্রীতিক আর সেটাকে রেখে দেওয়ার অপেক্ষা করলো না, তার আগেই ধৈর্য হারা হয়ে তরিৎ গতিতে অধর ডোবালো অরুর ওষ্ঠাধরের ভাঁজে। অরুর ঠোঁটে একের পর এক গাঢ় চুমু একে দিতে দিতে ক্রীতিক হিসহিসিয়ে বললো,
— এবার বল কে তোর ভাইয়া? ভাইয়ারা কি বোনদের সাথে এমন কিছু করে, যা আমি করছি?

অরু তৎক্ষনাৎ চোখ খিঁচে না সূচক মাথা নাড়ালো।

ক্রীতিক সেভাবেই অরুর হাতটা তুলে চোখের সামনে এনে দু’জনার কাপল রিং গুলো ইশারা করে বললো,
—- দেখতো তোর অনামিকা আঙুলে আমার দেওয়া রিংটা চকচক করছে, এটা কারা দেয় জানিস?

অরু এবার হ্যা না দুইদিকেই মাথা নাড়ালো, ক্রীতিক একহাতে ওর তুলতুলে কোমল বাঁকানো কোমড়টা শক্ত চেপে ধরে বললো,

— লাভার’রা। আমি তোর লাভার, তাই তোকে এটা দিয়েছি, এটার মানে হচ্ছে তুই শুধু আমার প্রোপার্টি, তোকে আর কেউ এপ্রোচ করতে পারবে না। নো ওয়ান।

ক্রীতিকের কথায় ওকে শান্ত করার উদ্দেশ্যে, অরু চোখ বুজে জলদি জলদি হ্যা সূচক মাথা নাড়ালো। ক্রীতিক এবার অরুর বন্ধ চোখের দিকে তাকিয়ে বাঁকা হেসে দু-হাতে ওর টপস টা ধরে ধীরে ধীরে উপরে তুলতে শুরু করে। এই পর্যায়ে এসে অকস্মাৎ চোখ খুলে ক্রীতিকের দু’হাত চেপে ধরলো অরু।

ক্রীতিক সঙ্গে সঙ্গে অরুকে ছেড়ে দিয়ে, দু’পকেটে হাত গুঁজে একটা একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়লো। তারপর টেবিল থেকে একগ্লাস পানি নিয়ে ঢকঢক করে সেটা পান করে ধপ করে বসে পরলো বেতের চেয়ারে। অরু একটু মাথা তুলে ক্রীতিকের আগাগোড়া পরখ করে মিনমিনিয়ে শুধালো,
— রাগ করেছেন?

ক্রীতিক জবাব দিলোনা, অরুকে টেনে এনে নিজের উরুর উপর বসিয়ে ওর কাঁধে নাক ঘষতে ঘষতে অসহায় স্বরে বললো,
—- আর কতদিন হার্টবিট? ইটস বদারিং মি। আই কান্ট উফফ!

ক্রীতিক বেশ বিরক্ত, ব্যাপারটা বুঝতে পেরে অরু নরম স্বরে বললো,
— আমি সরি।

অরুর হঠাৎ ক্ষমা পার্থনায় ক্রীতিক নিজের মাথা তুলে শুধালো,
— তুই কেন সরি হচ্ছিস?

— এই যে বারবার আপনার মেজাজ খারাপ করে দেওয়ার জন্য।

অরুর কথায় ক্রীতিক জিভ দিয়ে অধর ভিজিয়ে নিজেকে সামলে নিয়ে ঠোঁটের ভাঁজে কিঞ্চিৎ হাসির রেখা টেনে বললো,
— ইট’স ন্যাচারাল বেইবি, এতে আমি মন খারাপ করিনি, তুই বড় হয়ে গিয়েছিস এটা আমাদের দু’জনার জন্যই ঠিক কতবড় ব্লেসিং,সেটা ভবিষ্যতে বুঝতে পারবি। এখন চল।

অরু অবাক হয়ে প্রশ্ন ছুড়লো,
— কোথায় যাবো?

ক্রীতিক ওকে কোলে তুলে বেডরুমের দিকে নিয়ে যেতে যেতে বললো,
—- তোর পছন্দের শহরে এসেছিস অথচ ঘুরে দেখবি না? নাকি আজকে সারাদিন আমার সাথে….
ক্রীতিককে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে অরু হকচকিয়ে বলে ওঠে,

—- নাহ যাবো তো।

ক্রীতিক ওর মাথায় হাত বুলিয়ে মৃদু হেসে বলে,
—- লেটস গো বেইবি।

*************************************************

অরুর মতে পুরো দার্জিলিং শহরটাই বিষ্ময়কর, এখানে আলাদা করে দেখতে যাওয়ার কিছু নেই, কটেজের বারান্দায় বসে বসেও দার্জিলিং এর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আহরণ করা যায় নির্বিগ্নে। তবুও সবাই মিলেমিশে আজ বেশ কয়েকটা টুরিস্ট এরিয়তে ঘুরে বেরিয়েছে ওরা।

সারা বিকেল ঘোরাঘুরি করে এখন স্ট্রিট মার্কেটে ঢুকেছে সবাই। ক্রীতিক ভিড়ভাট্টার মধ্যে নেই। তাই একটা বাইক রেন্ট করে অরুকে নিয়ে সোজা বেরিয়ে পরেছে রাইডিং এ।

পাহাড়ের বাঁকে বাঁকে সরু রাস্তা ধরে খুব ধীর গতিতে রাইড করছে ক্রীতিক,পাছে না বড়বড় খাদ দেখে অরু আবার ভয় পেয়ে যায় সেই চিন্তায়।

কয়েকঘন্টার রাইডিং শেষে ওরা যখন আবার শহর মুখী হলো তখনই পেট্রোল নিতে পেট্রোল পাম্পে ঢুকে পরে ক্রীতিক। ও অরুকে একটা যায়গায় দাড় করিয়ে বললো,
— বেইবি ওয়েট আ মিনিট, ওকে?

অরু হ্যা সূচক মাথা নাড়িয়ে সায় জানালে, ক্রীতিক গাড়িতে পেট্রোল তুলতে এগিয়ে যায়। ক্রীতিক যখন নিজের কাজে গভীর মনোযোগী তখনই পেছন থেকে একজন অত্যাধুনিক গোছের সুন্দরী মহিলা রিনরিনে আওয়াজে ডেকে উঠলো ওকে,
— হেই জায়ান ক্রীতিক ওরফে মিস্টার অভদ্র।

পরিচিত অপরিচিতর মাঝে ঝুলতে থাকা এক নারী কন্ঠস্বর শুনে আস্তে করে ঘাড় ঘোরালো ক্রীতিক, পেছনে তাকিয়ে চোখ মুখ স্বাভাবিক রেখে স্পষ্ট কন্ঠে জবাব দিলো ,
— ইয়েস?

ক্রীতিক ঘাড় ঘোরানোর সঙ্গে সঙ্গে মেয়েটা আন্তরিকতা সরূপ শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো ওকে। ক্রীতিক ও থতমত খেয়ে ওর পিঠে হালকা হাত ছোঁয়ালো।

ওদিকে মেয়েটার কান্ডে চোখ বড়বড় হয়ে গেলো অরুর, অধর জুগল আলাদা হয়ে গেলো আপনা আপনি, দু’হাত মুঠি বদ্ধ রেখে নিজেকে কোনোমতে সামলে অরু মনেমনে বললো,
—- ওনাকে ছেড়ে দিন আপু, উনি আমার, শুধু আমার।

মেয়েটা ক্রীতিককে অভিবাদন সূলভ হাগ করে, একগাল হেসে বললো,
— চিনতে পেরেছো, হু আই এ্যাম?

ক্রীতিক একটু চিন্তা করে বললো,
— শ্রাবনী রাইট? বাংলাদেশে আমাদের সাথে নর্থসাউথে পড়তে। আর তোমার বোন তো সানফ্রান্সিসকোতে পড়াশুনা করে, সায়নী অর সামথিং।

শ্রাবনী হেসে বললো,
—- হ্যা ও দেশে এসেছে বলেই দার্জিলিং এ বেড়াতে আসা, বাই দা ওয়ে তোমার খবর কি? সেই যে নর্থসাউথ থেকে গ্রাজুয়েশনের আগেই বেরিয়ে গেলে, তারপর তো আর খোঁজই পেলাম না।

ক্রীতিক হাতের কাজ সারতে সারতে বললো,
— এই চলছে।

—- বিয়ে করেছো?

শ্রাবনীর কথায় ক্রীতিক হ্যা সূচক মাথা নাড়িয়ে পাশ ঘুরে আঙুল দিয়ে ইশারা করে বলে,
— ইয়েস, মিট মাই ওয়াইফ, আব…

কথা মাঝ পথেই আটকে গেলো ক্রীতিকের, কারণ অরু এখানে নেই। এখানে তো দূরে থাক পুরো পেট্রোল পাম্পের আসেপাশেও নেই। চারিদিকে চোখ বুলিয়ে ক্রীতিক শ্রাবনীকে তৎক্ষনাৎ বিদায় জানিয়ে বললো,
— আমি আসছি।

শ্রাবনী উপর নিচ মাথা নাড়ালে, ক্রীতিক দ্রুত চলে যায় সেখান থেকে, ক্রীতিক চলে যেতেই শ্রাবনী কাঁদো কাঁদো গলায় বিড়বিড়ালো,
—- আমার ক্রাশের ও বিয়ে হয়ে গেলো?

গাড়ি থেকে নেমে পেছন দিক দিয়ে সায়নী বলে উঠলো,
— ওইটা আমারও ক্রাশ দি ভাই। তার চেয়েও বড় কথা জেকে স্যারের ওয়াইফ আমার ভালো ফ্রেন্ড।
শ্রাবনী দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,
— আমরা মেয়েরা সবসময় রেড ফ্ল্যাগের প্রেমে পড়ি কেন বলতো?
সায়নী ঠোঁট উল্টে শান্ত স্বরে বললো,
— হু নোজ।

.
রাস্তার এদিকে ওদিক খুঁজতে খুঁজতে অবশেষে অরুর দেখা পেলো ক্রীতিক।
ও দেখলো দু’হাঁটুতে মুখ গুঁজে ফুটপাতে বসে আছে অরু। এভাবে অরুকে বসে থাকতে দেখে ক্রীতিক এগিয়ে এসে বললো,
—- কি হয়েছে এখানে বসে আছিস কেন? তুই যে এতদূর চলে এলি, একবারও আমাকে বলে এসেছিস? তোর সাহস কি করে হলো এমন একটা অচেনা যায়গায় আমাকে না জানিয়ে এতো দুর চলে আসার?

ক্রীতিকের আওয়াজ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অরু উঠে দাড়ালো, অতঃপর ওর কথার কোনোরূপ জবাব না দিয়েই একপ্রকার অগ্রাহ্য করে হাটা ধরলো অন্যদিকে,

অরুর এহেন কান্ডে পেছন থেকে ক্রীতিক ডেকে চোয়াল শক্ত করে দৃঢ় গলায় বলে,
— অরু কোথায় যাচ্ছিস?

অরু যেতে যেতে জবাব দিলো,
— আপনি থাকুন আপনার বান্ধবীকে নিয়ে আমি চললাম।

অরুর কথায় একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এলো ক্রীতিকের বুক চিড়ে, অতঃপর অনেকটা জিদি গলায় অরুকে উদ্দেশ্য করে ক্রীতিক বলে উঠলো,
—- যেখানে খুশি যা,তার আগে তোকে ছাড়া কিভাবে বাঁচবো সেটা শিখিয়ে দিয়ে যা।

এবার হাঁটার গতি পুরোপুরি থেমে গেলো অরুর, আর এক পা ও সামনে বাড়ানোর শক্তি নেই ওর, ও ওখানেই আটকা পরেছে, ক্রীতিকের প্রনয়াসক্তির অদৃশ্য শেকলে বাধা পরেছে ওর পা দু’টো ।

অরু দাড়িয়ে পরেছে দেখে, ক্রীতিক একটু একটু করে এগিয়ে গিয়ে পেছন থেকে শক্ত করে গলা জড়িয়ে ধরলো অরুর, এরপর ওর কানের কাছে ঠোঁট নিয়ে হাস্কিস্বরে বললো,

— আমায় ছেড়ে কোথায় যাবি তুই? আমি যেমন অতিরিক্ত ভালোবাসা দিই ,তেমনি ক’ষ্টটাও অতিরিক্তই দিই, মাইন্ড ইট হার্টবিট।

আজকে প্রথমবার তাই ও’য়া’র্নিং দিলাম, দ্বিতীয়বার আমাকে ছেড়ে যাওয়ার কথাটা উচ্চারণ করার স্পর্ধা দেখানোর আগেই তুই শেষ। আই রিপিট মে’রে ফে’ল’বো একদম।

চলবে……