সন্ধ্যে নামার আগে পর্ব-২৫+২৬

0
306

#সন্ধ্যে_নামার_আগে
#লেখিকা_সুমাইয়া_জাহান
#পর্ব_২৫

(৫৮)

অলকানন্দপুর গ্রামে পা রাখার সঙ্গে সঙ্গে উত্তরী সমীরণ রুমাইসার শরীর ছুঁয়ে গেলো। ঘণ কুয়াশা বেধ করে যত সামনে সে এগিয়ে যেতে লাগলো ততোই যেনো সে তার হৃদপিণ্ডের অসারতা অনুভব করতে শুরু করলো। অলকানন্দপুরের বাতাসে আগরবাতির তীব্র সুগন্ধ ভেসে বেড়াচ্ছে। রুমাইসা যত সামনে এগোলো গন্ধটা ততোই তার নাকে তীব্র হয়ে লাগতে শুরু করলো। আগরবাতি গন্ধটা তার বুকে কম্পন ধরিয়ে দিচ্ছে যেনো মনে করিয়ে দিচ্ছে তার বাবা আর এই পৃথিবীতে নেই তাকে ছেড়ে চলে গেছে অনেক দূরে।

খেতের আইল ধরে ধীর পায়ে হাঁটছে রুমাইসা। স্মরণ তার থেকে দু পা এগিয়ে। আর মাত্র কয়েক মিনিটের পথ বাকি তারপর তারা বাড়ি পৌঁছাবে। রুমাইসার পা আর চলতে চায় না। বুকের ভেতরটা কেমন ধুক ধুক করছে। যত সামনে এগুচ্ছে ততোই যেনো তার পায়ের তলার মাটি সরে সরে যাচ্ছে। বাবার মৃত মুখটা সে কি করে নিজের চোখে দেখবে, তার ভেতর কি এতটা শক্তি আদৌ আছে? বাড়ির কাছাকাছি আসার পূর্বেই রুমাইসা বাড়ির ভেতর হতে ক্রন্দন সুর ভেসে আসতে শুনলো। তার পা দুটো যেনো আর সামনে এগুতে চাইছে না। শক্তি যেনো পুড়িয়ে আসছে। চোখ দুটোতে আঁধার নেমে আসছে সামনে চলার পথ সে খুঁজে পাচ্ছে না।

রুমাইসাকে দাঁড়িয়ে যেতে দেখে হাঁটা থামিয়ে দিলো স্মরণ। তাদের মাথার উপর দিয়ে কয়েকটা কাক একসাথে ডানা ঝাপটে উড়ে চলে গেলো। রুমাইসা হাঁটা থামিয়ে ঘাড় উঁচু করে তাদের তাকিয়ে দেখলো, একটুকরো রুটি নিয়ে কাড়াকাড়ি করছে কাকগুলো। স্মরণ রুমাইসাকে লক্ষ্য করে দেখলো আকাশের দিকে তাকিয়ে কি যেনো দেখছে সে।

“মিস রুমাইসা কি হলো?”

“কাক গুলো উড়ে গেলো।”
স্মরণ নিজেও একবার কাকগুলোর দিকে তাকিয়ে তারপর আবার রুমাইসার দিকে দৃষ্টি ফেললো। মেয়েটার চোখ শুকিয়ে যেনো কোটর থেকে বেড়িয়ে আসছে। বিধ্বস্ত চেহারায় অন্যমনষ্ক হয়ে কাকগুলোকে দেখছে। স্মরণের বুঝতে বাকি রইলো না রুমাইসা এখন আর নিজের মধ্যে নেই। অধিক শোকে সে নিজেকে অন্য জগতে হারিয়ে ফেলেছে।

“মিস রুমাইসা কি করছেন আপনি চলুন।”

“হু।”
বলে রুমাইসা আবার চলতে লাগলো কিন্তু অন্যমনষ্ক হয়ে হাঁটায় সে বারবার হোচট খেয়ে লাগলো। স্মরণ ব্যাপারটা লক্ষ্য করে শেষে নিজে কয়েক পা পিছিয়ে এসে রুমাইসার এক হাত শক্ত করে চেপে ধরলো তারপর বলল,

“কষ্ট হচ্ছে?”

“না ভয় হচ্ছে।”

“আমি আছি তো পাশে।”

“চলুন ফিরে যাই। বাবাকে এই অবস্থায় দেখার শক্তি বা সাহস কোনোটাই আমার নেই।”

“মিস রুমাইসা আমি আছি আপনার সাথে বিশ্বাস করুন। এই দেখুন আপনার হাত ধরে আছি।”

রুমাইসা এবার কাতর দৃষ্টিতে স্মরণে চোখের দিকে তাকালো স্মরণ ইশারা তাকে বুঝিয়ে দিলো যে তার কিছু হবে না সে আছে তার পাশে।

বাবার নিথর দেখের পাশে ঠায় বসে আছে রুমাইসা। তার চোখ বেয়ে দুই ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়লে সেটা মুছে নিয়ে বলে,

“মায়ের মতো তুমিও আমায় একা রেখে চলে গেলে বাবা? বলেছিলো তো সবাই ছেড়ে গেলেও কখনো তুমি আমায় ছেড়ে যাবে না, তবে কেনো চলে গেলে? ও আচ্ছা বুঝেছি অভিমান করেছো আমার উপর তাই না? ঠিক আছে আমিও তাহলে কাঁদবো না দেখো। আমিও তোমার উপর অভিমান করেছি এই যে দেখো একটুও কাঁদছি না।”
বলে খাটিয়ের উপর মাথা ঠেকিয়ে অসারের মতো বসে রইলো সে। মনোয়ারা বেগম বারকয়েক এসে রুমাইসাকে সেখান থেকে তুলে নেয়ার চেষ্টা করলো কিন্তু রুমাইসা কিছুতেই যেতে রাজি হলো না। তার এক কথা বাবাকে ছেড়ে সে কোথাও যাবে না এমন কি বাবাকেও কোথাও যেতে দিবে না। রিমা সমীর এসে কতক্ষণ রুমাইসাকে জড়িয়ে কান্না করলো কিন্তু রুমাইসা তখনো চুপচাপ মূর্তির মতো বসে রইলো। এতটুকু জল তার চোখের কোণ বেয়ে গড়িয়ে পড়লো না। লোকে বলে অল্প শোকে কাতর অধিক শোকে পাথর। রুমাইসারও ঠিক সেই অবস্থা।

রুমাইসা বাড়ি আসার পর থেকে শেহওয়ারকে আর কোথাও দেখা গেলো না। এইদিকে করিম সাহেবকে দাপন করার সময় হয়ে গেছে। গ্রামের কয়েকজন মহিলা এসে রুমাইসাকে ধরে তুলল। একটু পর জানাজা দেয়ার জন্য করিম সাহেবকে নিয়ে যাওয়া হবে।

স্মরণ, আজমল আহমেদ এবং রমিজ সহ আরো একজন খাটিয়া কাঁধে তুলে নিলো। রুমাইসা একপাশে দাঁড়িয়ে সে দৃশ্য দেখতে লাগলো। হঠাৎ তার কি হলো কে জানে সবাইকে অবাক করে বাবা বলে জোরে চিৎকার করে উঠলো। স্মরণ সহ বাকি সবাই রুমাইসার চিতকারে কিছুটা ভড়কে গেলো।
রুমাইসা দ্বিতীয়বার চিৎকার করে বলল,

“তোমরা আমার বাবাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছো? বাবা কোথাও যাবে না আমি বাবাকে কোথাও যেতে দিবো না। মামা তুমি সবাইকে বলে দাও বাবা কোথাও যাবে না।”বলে কাঁদতে কাঁদতে রুমাইসা জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লো।

(৫৯)

স্মরণের বুকে মাথা ঠেকিয়ে ঘুমিয়ে আছে রুমাইসা। তাকে একহাতে বুকের সাথে আগলে রেখে অন্য হাতে খাবার খাচ্ছে স্মরণ। নীলা জামান পাশে বসে চুপচাপ তার খাবার খাওয়ার দৃশ্য চোখে ধারণ করছে। করিম সাহেবকে দাপন করার পর বাড়িতে আত্নীয় স্বজনের ভিড় কিছুটা কমেছে। দাপনের কাজ সেরে স্মরণ যখন বাড়িতে ফিরলো তখন সে রুমাইসাকে অচেতন অবস্থায় একটা ঘরের কোণে পড়ে থাকতে দেখল। আশেপাশে মানুষ থাকার সত্যেও কেউ তাকে ধরে তুলছে না দেখে সে নিজেই ছুটে গিয়ে রুমাইসাকে পাঁজাকোলে তুলে নেয়। ঘর ভর্তি মানুষজন তার এমন কান্ড দেখে হা করে তাকিয়ে রইলো অথচ কেউ তাদের সাহায্য করার জন্য এগিয়ে গেলো না। স্মরণ বুঝতে পারে না একটা অনাথ মেয়ে যে কিনা কিছু সময় আগে বাবাকে হারিয়ে শোক সামলাতে না পেরে জ্ঞান হারিয়ে অচেতন অবস্থায় পড়ে আছে তাকে দেখেও কেনো কেউ তার কাছে এগিয়ে এসে তার জ্ঞান ফেরানোর চেষ্টা করছে না। আর জ্ঞান ফেরানো তো দূর কেউ একবার এগিয়ে এসে দেখছেও না পর্যন্ত। নিলুফার বেগম নিজেও সেখানে উপস্থিত ছিলেন অথচ রুমাইসার প্রতি তিনি কোনো প্রকার দয়া তো দেখালেন না বরং আড়চোখে একবার তাদের দেখে অন্য দিকে ঘুরে বসলেন।

রুমাইসাকে কোলে করে ঘর থেকে বেড়িয়ে আসার সময় কয়েকজন মহিলার কথা স্মরণের মস্তিষ্কে গিয়ে আঘাত করলো। মহিলারা তাদের দিকে আড় চোখে তাকিয়ে মুখ টিপে টিপে হাসছে। স্মরণের অবশ্য বুঝতে অসুবিধা হলো না যে তারা ঠিক কি কারণে হাসছে। তবে তাদের এমন আচরণে প্রথমে সে অবাক হলেও এখন আর হয় নি কারণ যারা একটা মেয়ে অনাথ হয়ে যাবার পরো যখন মৃত বাবার পাশে বসে ক্রন্দনরত মেয়েটাকে কটূকথা বলতে ছাড়ে নি তারা আর যাই হোক রুমাইসাকে কোনো পরপুরুষ কোলে তুলে নিয়েছে সেটা ভালো নজরে দেখবে না, তাই সেদিকে আর তেমন কোনো পাত্তা না দিয়ে রুমাইসাকে সে বুকের সাথে জড়িয়ে অন্য একটি ঘরে চলে গেলো।

রুমাইসাকে ঘুমের ওষুদ দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রেখেছে স্মরণ। অতিরিক্ত কান্নার কারণে বাবার অচেতন হয়ে পড়ছিলো রুমাইসা তাই তাকে ঘুমের ওষুদ দিয়ে নিজের বুকের সাথে জড়িয়ে রেখেছে সে। নীলা জামান এক প্লেট খাবার এনে স্মরণের সামনে রেখে নিজেও একটা চেয়ার টেনে কিছুটা অদূরে বসলেন। স্মরণ একবার তার দিকে দৃষ্টি পাত করে বলল,

“আমার কিন্তু খিদে পায় নি মণি মা।”

“সে আমি জানি। কিন্তু সারাদিন এতটা ধকল গেছে তোমার উপর একটু না খেলে কি আর,,,।”

“তুমি খেয়েছো?”

“হু। রুমাইসাকে শুয়ে দিয়ে তুমি একটু ঠিক করে বসে খাও তো।”

স্মরণ রুমাইসার মুখের দিকে তাকিয়ে কিঞ্চিৎ হাসলো তারপর বলল,

“ঘুমিয়ে আছে ঘুমের ব্যাঘাত ঘটুক চাই না। আমি এইভাবেই খেতে পারবো।”

নীলা জামান আর কোনো কথা বললেন না চুপচাপ স্মরণের খাবার খাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলেন।

“এই বাড়ির মানুষগুলো এত আশ্চর্যের কি করে বলতে পারো মণি মা? একটা মানুষেরও কি মেয়েটার জন্য মায়া হয় না।”

“নিজের মামারই যখন মায়া হয় নি প্রতিবেশী আর কি মায়া করবে বলো। যাই হোক আমি চাই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তুমি ওকে নিয়ে শহরে ফিরে যাও। মেয়েটা এখানে থাকলে বেশিদিন বাঁচবে না।”

“তুমি কবে ফিরবে?”

“জানি না তবে এখানেও আর পড়ে থাকার ইচ্ছে নেই। যা ঘটার তা তো ঘটেই গিয়েছে এরপর আর এখানে পড়ে থাকা অনর্থক।”

“চলে যাবে ভাবছো?”

“না গিয়ে কি উপায় আছে? আচ্ছা তুমি খেয়ে নাও আমি আসছি তা হলে।”

নিলুফার বেগম উঠে চলে যেতে লাগলে স্মরণ তাকে পেছন থেকে ডেকে বলল,

“শেহওয়ার কেনো আমার মুখোমুখি হলো না বলতে পারো? আচ্ছা আমার কথা না হয় বাদ দিলাম কিন্তু মিস রুমাইসা?”

“তোমাদের দুজনের কারো সামনে গিয়েই দাঁড়ানোড় মত মুখ নেই ওর তাই হয় তো সামনে আসে নি।”
বলে দ্রুত ঘর ছেড়ে বেড়িয়ে গেলেন তিনি। স্মরণ প্রশস্ত শ্বাস ছেড়ে রুমাইসার ঘুমন্ত মুখের উপর দৃষ্টি দিলো। মেয়েটার জন্য তার সত্যিই খুব মায়া হচ্ছে। বুকের ভেতর তীব্র যন্ত্রণা হচ্ছে কিন্তু কেনো হচ্ছে সে জানে না। শুধু কি রুমাইসা অনাথ হয়ে গেছে বলে নাকি তার পেছনে অন্য কোনো কারণ।

(৬০)

পুকুর ঘাটে বসে পানিতে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বসে আছে স্মরণ। আজ সারাদিন যা যা ঘটলো তা মনে মনে নাড়াচাড়া করতে করতে বুক ছিড়ে একটা প্রশস্ত নিশ্বাস বেড়িয়ে এলো তার। করিম সাহেবের মৃত্যুর সাথে সাথে পুরো বাড়ির পরিবেশ যেনো নিমিষে বদলে গেছে। নিলুফার বেগম কারো সাথে দেখা করেন নি এখন পর্যন্ত। রিমা, সমীর এবং মনোয়ারা বেগম এক ঘরে বসে কোরান শরিফ পাঠ করছেন। রুমাইসাকে কড়া ডোজের ঘুমের ওষুধ দেয়ায় সে এখনো ঘুমিয়ে আছে। আজমল সাহেব বিকেলে কোথাও একটা যাবার কথা বলে বেড়িয়েছেন আর এখনো ফেরেন নি। স্মরণ রুমাইসাকে শুইয়ে দিয়ে নিজে পুকুর ঘাটে এসে দাঁড়িয়েছে।

“স্মরণ!”

শেহওয়ারের কন্ঠে নিজের নাম শুনে পেছনে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলো স্মরণ। ঘাটের উপরে দাঁড়িয়ে আছে শেহওয়ার। তাকে সেখানে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে স্মরণ নির্জীব গলায় বলল,

“কিছু বলবি?”

“রুসা ঘুমিয়েছে?”

“দেখেছিস নিশ্চই।”

“হুম।”
বলে কয়েকটা সিঁড়ি পেরিয়ে স্মরণের পাশে এসে দাঁড়াল শেহওয়ার। স্মরণ ক্ষণকাল মৌন থেকে বলল,

“আজ হঠাৎ আমার সাথে তোর কথা বলার ইচ্ছা হলো দেখে অবাক হলাম।”

“এটা তো হওয়ার ই ছিলো। আর হঠাৎ কেনো বলছিস সেদিন তোর মেডিকেল ক্যাম্প ও তো।”

“সেসব ছাড়। সেদিন যে তুই নিজের জন্য আছিস নি সেটা তো অজানা নয়।”

“রুসা কেমন আছে।”

“সেটা না হয় তাকেই জিজ্ঞেস করিস।”
শেহওয়ার কিঞ্চিৎ হাসলো। সে আর যাই হোক রুমাইসার সামনে গিয়ে দাঁড়াবে না। স্মরণ শেহওয়ারকে পরখ করে বলল,

“তুই ঠিক কি করতে চাইছিস বলতো। তুই জানতিস মিস রুমাইসা আমার কাছেই আছে তাও যে নিশ্চুপ ছিলি অবাক হলাম।”

“আমি চাই নি রুসা আমার কাছে ফিরে আসুক। আর আমি চাইলেও সে আসতো না কারণ।”

“কারণ?”

“সে অনেক কথা। তবে যা হয়েছে খুব খারাপ হয়েছে আজ হয় তো আমার জন্য ফুফাজান দুনিয়া ছেড়ে গেছেন।”

“এসব বলতে এসেছিলি?”

“না।”

“তবে?”

“তেমন কিছু না। আমি ওইদেশে ফিরে যাচ্ছি। তুই রুসাকে দেখে রাখিস।”

“হঠাৎ এত মহান হচ্ছিস নিশ্চই তার পেছনে উদ্দেশ্য আছে।”
স্মরণের শেষের কথায় হোহো করে হেসে উঠলো শেহওয়ার। তার এই হাসি স্মরণের খুব পরিচিত। সে জানে শেহওয়ার এত সহজে নিজের জায়গা ছেড়ে দেয়ার পাত্র নন। সে নিশ্চই কিছু না কিছু করবে আর তা হাসিই সেটা বলে দিচ্ছে। তবে শেহওয়ার যা কিছুই করুক না কেনো রুমাইসার কোনো ক্ষতি সে করতে দিবে না। মেয়েটাকে যে বড্ড বেশি ভালোবেসে ফেলেছে তা সে নিজেই বুঝতে পারে না।

চলবে,,,।

#সন্ধ্যে_নামার_আগে
#লেখিকা_সুমাইয়া_জাহান
#পর্ব_২৬

(৬১)

রুমাইসার মেট্রিক পরীক্ষার মাত্র কয়দিন বাকি। করিম সাহেব মারা যাবার বেশ কিছুদিন কেঁটে গেলেও রুমাইসা এখনো গ্রামেই অবস্থান করছে। বাবার রেখে যাওয়া স্মৃতি আর পুত্রশোকে অসুস্থ হয়ে পড়া মনোয়ারা বেগমকে একা রেখে স্মরণের সঙ্গে শহরে ফিরে যাবার তেমন কোনো আগ্রহ সে দেখায় নি। স্মরণ নিজেও খুব একটা জোর করে নি এই ব্যাপারে কারণ সে চায় না রুমাইসার ব্যাক্তিগত সিদ্ধান্তে সে হস্তক্ষেপ করুক। তাছাড়া মেয়েটা পিতৃবিয়োগে যথেষ্ট শোক পেয়েছে এই সময় তার উপর নিজের সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয়াটা বোকামি। তাছাড়া কয়েকটা দিন বাদে রুমাইসার মেট্রিক পরীক্ষা এই সময় তাকে এতটা চাপে রাখা ঠিক হবে না ভেবেই স্মরণ তাকে রেখে নিজেই একা শহরে ফিরে গেছে।

করিম সাহেবের মৃত্যুর পর থেকে নিলুফার বেগম একেবারেই চুপচাপ হয়ে গেছেন। কারো সাথে খুব একটা বেশি কথা বলেন না তিনি। নিজের মতো একটা ঘরে পড়ে থাকেন। মাঝে মাঝে রিমা কিংবা রুমাইসা গিয়ে তার কি লাগবে না লাগবে জিজ্ঞেস করে আসে। প্রয়োজন ছাড়া তিনি তাদের সাথেও কথা বলতে খুব একটা আগ্রহ দেখান না। রিমা অবশ্য বিষয়টাকে হাল্কাভাবে নিলেও রুমাইসার কাছে সেটা মোটেই সুবিধার মনে হলো না। বেশ কয়েকদিন যাবত সে লক্ষ্য করছে বাড়ির সকলে যখন ঘুমিয়ে পড়ে তখন নিলুফার বেগমের ঘর থেকে কারো কথার আওয়াজ ভেসে আসে। যেহেতু সে অনেকটা রাত জেগে পড়াশুনা করে তাই বিষয়টা আপনা আপনি তার নজড়ে পড়েছে।

প্রতিদিনের মতো আজও রুমাইসা পড়ার টেবিলে বসে বইয়ের পাতা উলট পালট করছে। ঘড়িতে তখন রাত বারোটা কি সাড়ে বারোটা বাজে। নিজের ঘরে হারিকেনের আলো মৃদু বাড়িয়ে সে মনোযোগ দিয়ে বই পড়ছে আর ঠিক সে সময় সে ঘরের বাহিরে কারো চাপা কন্ঠস্বর শুনতে পেলো। কেউ একজন তার ঘরের পাশে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে ফিসফিস করে কথা বলছে। রুমাইসা ক্ষণকাল কান পেতে বুঝার চেষ্টা করলেও তেমন কিছুই সে শুনতে পেলো না। তাই সে বই বন্ধ করে চেয়ার ছেড়ে উঠে দরজার দিকে এগিয়ে গেলো। দরজার খোলার জন্য সে দুই পায়ের আঙ্গুলে ভর দিয়ে ছিটকিনি খুলতে যাবে তখনি রিমা ঘুম জেগে উঠে বলল,

“আপা এত রাইতে তুমি কই যাও?”

রিমার কথায় কিঞ্চিৎ চমকে উঠলো রুমাইসা। ফিরে দরজার কাছ থেকে সরে এসে রিমার কাছাকাছি গিয়ে বসে গলা নামিয়ে বলল,

“চুপ আসতে কথা বল।”
রিমা কিছুটা অবাক হয়ে রুমাইসার দিকে তাকাতেই রুমাইসা আবার বলল,

“দরজার বাহিরে কাউকে কথা বলতে শুনছিস রিমা?”

রিমা তৎক্ষণাৎ ঘুম থেকে উঠায় কিছু বুঝতে পারলো না তবে ক্ষানিকটা সময় অতিবাহিত হতে সেও ব্যাপারটা লক্ষ্য করলো।

“এত রাতে কে কথা কয় আপা?”

“আমিও সেটা ভাবছি। চল দরজা খুলে দেখি।”
বলে রুমাইসা এগোতে লাগলে রিমা তার ওড়না একপাশ টেনে ধরলো। রিমার কাছ থেকে বাধা পেয়ে রুমাইসা ঘুরে দাঁড়াতেই রিমা বিছানা ছেড়ে নেমে বলল,

“আপা এত রাইতে আমাগো দরজা খোলা উচিৎ হইবো না। একটা কাজ করি চলো আমাগো এই আলমারির পেছনে যে দরজা আছে ওইটার পেছন দিক দিয়ে বাহির হই তাইলে আর কেউ বুঝবার পারবো না।”

“কিন্তু এই দরজাটা তো বন্ধ। তাছাড়া আলমারি সরাতে গেলে অনেকটা দেরি হয়ে যাবে।”

“তাহলে কি করন যায়?”

“আচ্ছা চল দুজন মিলে চেষ্টা করে দেখি আলমারিটা সরানো যায় কিনা।”

রুমাইসার সাথে সাথে রিমাও আলমারি সরানোর চেষ্টা করলো। প্রায় কয়েক মিনিটের চেষ্টায় দুজনই সেটা সরাতে সফল হলো।

“আপা এবার যাই চলো।”

“না দাঁড়া এখন নয়।”

“ক্যান?”

“আমার মনে হয় যে এখানে দাঁড়িয়ে কথা বলছিল সে এখান থেকে সরে গেছে।”

“তাইলে কি করমু এহন?”

” তুই এখানেই দাঁড়া আমি আসছি।”

“আপা!”

“কিচ্ছু হবে না। আমি এক্ষুনি আসছি।”

বলে রুমাইসা ঘর থেকে বেড়িয়ে গেলো।

(৬২)

চেয়ারম্যান বাড়ির দোতলার কাছারিঘরের সামনে একটা চেয়ার পেতে বসে আছে স্মরণ। সামনে বিস্তর জুড়ে নিশুতি রাতের আঁধার। আকাশে গুটিকতক তারা টিমটিম করে জ্বলছে। বাতাসে সিগেরেটের দোয়া উড়িয়ে দিতে দিতে স্মরণ পাশে বসে থাকা রমিজকে লক্ষ্য করলো। বেচারা তার থেকে কয়েক হাত দূরে গায়ে চাদর জড়িয়ে পাটিতে বসে ঝিমাচ্ছে। স্মরণ একবার ভাবলো তাকে ডেকে বলবে ভেতরে গিয়ে শুতে কিন্তু পরক্ষণে কি ভেবে আর বলল না।

“রমিজ সাহেব এত কষ্ট করে এত দূর পর্যন্ত না এলেও পারতেন।”

স্মরণের কথায় কিছুটা নড়েচড়ে বসলো রমিজ কিন্তু কিছু বলতে পারলো না। ঘুমের রেশ এখনো তাকে ছেড়ে যায় নি। স্মরণ একবার তার দিকে তাকিয়ে কিঞ্চিৎ হাসলো, বলল,

“ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ুন রমিজ সাহেব। অযথা এখানে বসে শীতে কষ্ট করতে হবে না।”

“না ডাক্তার সাহাব আমি এহানেই ঠিকাছি, আপনে গিয়া ঘরে ঘুমান।”

স্মরণ আর কথা বাড়ালো না অন্ধকার দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বসে রইলো। এই তো ঘন্টা দুইয়েক আগে সে নিশ্চিন্দপুর এসে পৌঁছেছে। ভাগ্যক্রমে ট্রেন থেকে নামতেই তার রমিজের সাথে দেখা হলো। রমিজ তাকে স্টেশন দেখে কিছুটা অবাক হয়েছিলো। কাউকে কোনো খবর না দিয়ে হঠাৎ মাঝ রাতে স্মরণের গ্রামে উপস্থিত হওয়ার কারণ প্রথমে বুঝতে না পারলেও কথায় কথায় খানিকটা পর জানতে পারলো। স্মরণ আর কেউ নয় রুমাইসার জন্যই গ্রামে ফিরে এসেছে। মেয়েটাকে সে এখানে একা রেখে গিয়ে খুব একটা স্বস্তি পাচ্ছিলো না। মনের মাঝে অজানা ভয় কাজ করছিলো। তাই সে রাতে হাসপাতাল থেকে ফিরে আর একমুহূর্ত দেরি করে নি গ্রামের উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে পড়েছিলো। স্মরণ আসতে আসতে রমিজকে প্রায় সকল কথাই বলে। শহরে যাবার আগে তাকেই সে পরোক্ষভাবে রুমাইসাকে দেখে রাখার দায়িত্ব দিয়ে গিয়েছিলো।

বারান্দায় বসে থাকতে থাকতে স্মরণের ঘোর লেগে এলো। হঠাৎ উপর থেকে কিছু পড়ার শব্দে চমকে উঠে পাশে তাকাতে দেখলো রমিজ নেই। স্মরণ ইতিউতি করে চারপাশে তাকাতেই সিঁড়ির কাছে কাউকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলো। আবছা অন্ধকারে লোকটার ছায়া দেখে সে বলল,

“রমিজ সাহেব ওখানে কি করছেন।”

একটু পর রমিজ গলা খাদে নামিয়ে বলল,

“ডাক্তার সাহাব মনে অয় এইহানে কেউ আইছিলো। আপনে যখন ঘুমে আচ্ছন্ন হইয়া পড়লেন তখন আন্ধার দিয়া কাউরে সিঁড়ি বাইয়া উপরে উইঠা আইতে দেখলাম। আমি জাইগা আছি লক্ষ্য কইরা লাফাইয়া নিচে পড়ছে।”

“এত রাতে এখানে কে আসবে? ভুল দেখেছিলেন নিশ্চই।”

“না ডাক্তার সাহাব ভুল দেহি নাই। আমি আন্ধারে মানুষ দেখলে চিনিবার পারি। এই লোকটা কেডা আমি কিছুডা হইলেও ধরবার পারছি।”

রমিজের কথায় স্মরণ কিছুটা চিন্তিত হয়ে পড়লো। এখন তার সন্দেহটাই যেনো ঠিক বলে মনে হচ্ছে। ভাগ্যিস সে এসে পড়েছিলো না হয় খারাপ কিছুও ঘটতে পারতো।

হারিকেনের আলোয় রমিজ কাছারিঘরের চারপাশ ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করে দেখে এলো। স্মরণ ঘরে পায়চারি করতে করতে শেষে বারান্দায় এসে দাঁড়াল। মাথায় তার হাজারটা চিন্তা, না চাইতেই সে নানান জটিলতায় জড়িয়ে যাচ্ছে। একটা মেয়ের পুরো দায়িত্ব তার কাঁধে। তাকে আগলে রাখা, বিপদ থেকে রক্ষা করা, তার স্বপ্নগুলোকে নিজের করে নেয়া যেনো এখন তার প্রধান কর্তব্যে পরিণত হয়েছে। মাঝে মাঝে মানুষ না চাইতেই কিছু অঘোষিত দায়িত্ব কর্তব্যের শেকলে বাঁধা পড়ে, স্মরণেরও তাই হয়েছে। যে মেয়েটাকে সে কয়েক মাস আগেও চিনতো না, যার সাথে তার পূর্বে কখনো দেখা পর্যন্ত হয় নি সেই মেয়েটার প্রতি যে তার এতটা দায়িত্ববোধ তৈরী হবে কে জানতো। স্মরণ মাঝে মাঝে নিজেই ভেবে পায় না রুমাইসা নামের সদ্য যৌবনে পদার্পণ করা মেয়েটি কেনো তার এতটা জুড়ে জড়িয়ে রয়েছে। কেনোই বা সে বার বার ছুটে আসে তার টানে আর কেনোই বা তাকে আগলে রাখার এত চেষ্টা? কই এর আগে তো তার সাথে এমনটা কখনো ঘটেনি। জীবনে চলার পথে তো কত নারীর সাথেই তার দেখা হয়েছে, বন্ধুত্ব হয়েছে কই তাদের কারো জন্যই তো সে স্বার্থহীনভাবে নিজের সবটুকু দিয়ে আগলে রাখার চেষ্টা করে নি কিংবা তাদের সুখে সুখ অথবা দুঃখে ব্যতীত হয় নি তবে কেনো এই একটি নারীতেই সে তার সকল কিছু উজার করে দিচ্ছে। কেনোই বা তার সকল যন্ত্রণা, কষ্ট নিজের করে নিতে ইচ্ছে করে, না ভেবে পায় না সে।

কাছারিঘরের নিচতলায় এসে রমিজ হাঁক ছেড়ে স্মরণকে ডাকলো। স্মরণ রাশভারী গলায় রমিজকে জিজ্ঞাস করলো,

“কিছু বুঝতে পারলেন রমিজ সাহেব?”

“হ ডাক্তার সাহাব আপনে যেইডা ধারণা করছেন ওইডাই হইছে। তবে আমি ভাবি তার এত সাহস কেমনে হইলো চেয়ারম্যান বাড়িতে আইসা,,,।”

“সে আপনি বুঝবেন না। উপরে উঠে আসুন আজ আর সে এখানে আসবে না তবে আমি যদি ঠিক হই তবে সে অন্য পথে হাঁটতে শুরু করবে। তবে তার আগে আমাকে কাল মিস রুমাইসার সাথে একবার দেখা করতে হবে।”

“কিন্তু আপনে তো কইলেন আপনে রুমাইসার লগে দেখা করবেন না, জানতে দিবেন না যে আপনে এইহানেই আছেন।”

“ডিসিশন চেইঞ্জ করেছি। কালই সকালেই আমরা অলকানন্দপুর যাচ্ছি।”

(৬৩)

বাড়ির পেছনের গেইট দিয়ে কেউ একজন দ্রুত বেড়িয়ে যেতে দেখলে রুমাইসা কিছুটা আড়াল হয়ে বুঝার চেষ্টা করে লোকটা কে। কিন্তু অন্ধকারের আবছা আলোয় সে লোকটাকে চিনতে পারলো না। তার যতদূর ধারণা লোকটা নিলুফার বেগমের ঘর থেকে বেড়িয়ে সোজা বাড়ির পেছনের গেইট দিয়ে বেড়িয়ে গেছেন।

রুমাইসা কিছু সময় সেখানে দাঁড়িয়ে থেকে পরে অন্ধকারে পা টিপে টিপে নিলুফারের ঘরের দিকে এগিয়ে গেলো। অধিক রাত হলেও নিলুফার বেগমের ঘরে এখনো আলো জ্বলছে। ঘরের কাছাকাছি এসে দরজার কবাট খুলতে গেলেই হঠাৎ চমকে উঠে। নিলুফার বেগম সাদা শাড়ি পরে তার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। এত রাতে তাকে নিজের ঘরের সামনে দেখে সন্দেহ ভাজন দৃষ্টি নিক্ষেপ করে জিজ্ঞাস করে বললেন,

“এত রাইতে তুই এইহানে কি করিস রুমাইসা।”

রুমাইসা নিলুফারকে এভাবে ঘরের বাহিরে দেখে ঘাবড়ে গেলো তাই সে সঙ্গে সঙ্গে কিছু বলতে পারলো না। নিলুফার বেগম তাকে ক্ষীণ দৃষ্টিতে পরখ করে দেখে বললেন,

“এত রাইতে আমার ঘরের সামনে কি তোর।”

“না আসলে তোমাকে দেখতে এসেছিলাম ঘুমিয়েছো কি না, আর কিছু লাগে কি,,,।”

“তোরে এত কইছে কে আমার খবর নিতে? আমি নিজেই নিজের খেয়াল রাখতে পারি আগ বাড়াইয়া তোরে কিছু করতে হইবো না। যা নিজের ঘরে গিয়া ঘুমা।”

রুমাইসা আর কোনো কথা বাড়াল না চুপচাপ নিলুফারের কথা মেনে নিয়ে সেখান থেকে প্রস্থান করলো। তবে তার মনে এখন সন্দেহ টা আরো জোড়াল হয়ে উঠেছে। নিলুফার বেগমের আচরণ তার মোটেই ঠিক লাগছে না। তাছাড়া এত রাতে তিনি না ঘুমিয়ে বাহিরে কি কিরছিলেন আর ওই লোকটাই বা কে যে উনার ঘর থেকে বেড়িয়ে গেলো?”

চলবে,,,।