সম্রাজ্ঞী পর্ব-৩৪+৩৫

0
211

#সম্রাজ্ঞী
#লিয়ানা_লিয়া
#পর্ব_34

বাগানের রজনীগন্ধারা আজ বেজায় মনোক্ষুন্ন। বেগমের মন রক্ষায় যেই রজনীগন্ধাদের সুলতান এই বাগানের সবচেয়ে সুউচ্চ স্থান দিয়েছিল তাদের বেহাল দশা। দুমড়ে-মুচড়ে পড়ে আছে প্রাণ হারিয়ে। শুকিয়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত সুবাস ছড়াচ্ছে মন মাতানো। ভেঙে পড়া রজনীগন্ধাদের উপরে এবড়োখেবড়ো অবস্থায় পড়ে আছে ক্ষতবিক্ষত একটি লাশ। সৈনিকের লাশ। রাতের আঁধারেই বোধহয় প্রাণ ত্যাগ করেছে সে। কী হিং’স্রভাবে ছিড়ে ফেলা হয়েছে তার পোশাক। কামড়ে তুলে নেওয়া হয়েছে ডান গালের মাংস। শরীর জুড়ে অগণিত আঁচড়ানোর চিহ্ন। গলার নিচের মাংস ছিড়ে পড়ে আছে পাশেই। রক্ত নেই কোথাও। যেন সযত্নে পরিষ্কার করা হয়েছে প্রতিটি রক্তের ফোঁটা। শরীরের বিভিন্ন স্থানের মাংস তুলে নেওয়া হয়েছে নৃশংসভাবে। সকাল সকাল বাগান পরিষ্কার করতে এসেই এই দৃশ্য দেখেছে একজন সেবক। তার চিৎকার-চেঁচামেচিতে জরো হয়েছে সকলে। তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে লাশ পরিক্ষা করছে মাহতাব। প্রধান দ্বারের সৈনিক রাতে এই বাগানে কী করছিলো মাথায় ধরলো না। বাগানের বাইরের পাহাড়ারত সৈনিকরা এ ব্যাপারে কিছুই বলতে পারছে না। রাতে তারা কোনো চিৎকার-চেঁচামেচি শোনেনি। আর না তো কাউকে বাগানের ভেতরে আসতে দেখেছে। প্রধান ফটকের সৈনিকদের নিকট থেকেও তেমন কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। সকলের এক কথা। বাইরে থেকে ভেতরে কেউ আসেনি। অথচ একজন সৈনিকের বিভৎস লাশ পড়ে আছে মহলের বাগানে। তবে কি ভেতরের কেউ?

মাহতাব অবাক হয়ে তাকালো সুলতানের দিকে। সে গম্ভীর ভঙিতে আশেপাশ পর্যবেক্ষণ করছিলো। মহলের ভেতর এসে সৈনিকের খু’ন! তাও এতো নৃশংসভাবে! যেন কোনো জন্তু জানোয়ার ছিড়ে খেতে চেয়েছিলো কিন্তু শেষ পর্যন্ত খেতে পারেনি। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে পাহাড়ারত সৈনিকরা। আকস্মাৎ গর্জে উঠলো সুলতান।

“রাতের আঁধারে মহলে খু’ন হয়ে যাচ্ছে অথচ কেউ কিচ্ছু দেখেনি। ম’রে গিয়েছিলি তোরা? হাজার হাজার সৈনিক কি ধুয়ে ধুয়ে পানি খাওয়ার জন্য রেখেছি আমি? রাত বিরেতে খু’নি ঢুকে পড়ছে মহলে। তোরা কী করিস? মশা মারছিলি বসে বসে?”

নির্বাক, নিশ্চুপ সকলে। এই ঘটনায় তারাও থমকে গিয়েছে। কীভাবে কী হলো? কখন হলো? সে আশ্চর্যজনকভাবে কেউ কিচ্ছু টের পেলো না! সুলতানের কথার জবাব দেওয়ার মুখ তাদের নেই। রাগে সজোরে দোলনায় লাথি বসিয়ে দেয় সুলতান। কড়মড় শব্দে ভেঙে পড়ে সাথে সাথেই। শিউড়ে ওঠে উপস্থিত জনতা। লাশ ছেড়ে উঠে এলো মাহতাব। সুলতানকে শান্ত করার উদ্দেশ্যে কিছু বলবে, আবারো চেঁচামেচি শুরো করলো সুলতান।

“একবার নয়, দু’বার নয়, বারবার একই কাহিনী। অজ্ঞাত খু’নি বারবার কীভাবে মহলে ঢুকে পড়ে তোদের আড়ালে? এ পর্যন্ত কতগুলো সৈনিকের এমন বিভৎস মৃ’ত্যু হয়েছে তাদের প্রাণের কি কোনো দাম নেই? আদৌ কি কোনো মানুষ এই হ’ত্যাগুলো করে না কি জন্তু জানোয়ার করে সেটাও জানিস না তোরা। নাকে তেল দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলি সবাই?”

সুলতান শাহজিল চুপচাপ সবকিছু দেখছে। গম্ভীর আর নির্জীব তার ভাবভঙ্গি। ছেলেকে এভাবে উত্তেজিত হতে যেতে দেখে দৃষ্টি সরালো লাশ থেকে। এগিয়ে গিয়ে হাত রাখলো সুলতানের কাঁধে। আলতো চাপড় মে’রে বলল, “শান্ত হও শাহজাইন। ওদের ব’কে লাভ নেই। ওরা তো ঠিকই দায়িত্ব পালন করেছে। ওদের দোষ কোথায়?”

হাত মুষ্টিবদ্ধ করে রাগ দমনের চেষ্টা চালালো সুলতান। বড়বড় শ্বাস নিয়ে চোখদুটো বন্ধ করলো। এতে খানিক কাজ হলো। কিছুটা শান্ত হলো সে। সরল গলায় বলল, “বারবার এত মৃ’ত্যু আমি নিতে পারছি না আব্বাজান। হাঁপিয়ে উঠেছি আমি। নিজেকে শান্ত রাখা আর সম্ভব হচ্ছে না।”

“এটা নিশ্চয় ঐ উমারের কাজ। এভাবে আমাদের উস্কে দিতে অথবা দূর্বল করতে চাইছে।”

“এটা কিছুতেই উমারের কাজ নয় আব্বা। আমি নিশ্চিত এ ব্যাপারে। উমারের এতবড় কলিজা হয়নি যে আমার মহলে লোক পাঠাবে।”

“তুমি যুদ্ধের ব্যবস্থা করো শাহজাইন। হাত গুটিয়ে বসে থাকার সময় নেই।”

“কিন্তু এই হ’ত্যা?”

“এর তদন্ত যুদ্ধ থেকে ফিরে এসেও করা যাবে। এখন আপাতত লাশটা দাফনের ব্যবস্থা করো।”

পিতার কথাতেই সম্মতি জানালো সুলতান। যুদ্ধটা আগে জরুরী। উমার কোনো পদক্ষেপ নেওয়ার আগেই আক্রমণ করতে হবে। দপ দপ করে আগুন জ্বলছে যেন মাথায়। ফয়েজ ব্যতীত প্রতিটি খু’নই এরকম নৃশংসভাবে হয়েছে। ফয়েজের খু’নটা কেন অন্যরকমভাবে হলো? একাধিক খু’নি নয়তো? হতে পারে ভিন্ন ভিন্ন খু’নি এই হ’ত্যাকান্ড ঘটাচ্ছে। সে এতটুকু নিশ্চিত যে ফয়েজের খু’নি আর একের পর এক সৈনিক হ’ত্যাকারী খু’নি দু’জন এক নয়। তবে এই খু’নি মাইরা নয়। মাইরার লক্ষ কেবল আর কেবল এলিজা ছিলো। ফয়েজ বা অন্য সৈনিককে খু’ন করে তার কী লাভ? নাহ, কোনো লাভ নেই। শনির দশা লেগেছে বুঝি সাম্রাজ্যের উপর। কিছুদিন আগেই উমারের ষড়যন্ত্রে পড়ে শত শত সৈনিককে হারাতে হয়েছে আবার এখন নতুন মৃ’ত্যু। হাজারটা প্রশ্ন মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। ফয়েজ বেগমকে শত্রুর নাম বলতে পারলে তাকে কেন বলতে পারলো না? এতগুলো দিন বন্দিশালায় অত্যাচার সহ্য করেও কেন শত্রুর নাম নিলো না? বেগমকেই কেন বলতে চাইল সে? ফয়েজের হ’ত্যা অন্যান্য সৈনিকদের থেকে আলাদা কেন? মাইরা যদি শুধু বেগমকে মা’রতে চায় তবে এই খু’নিগুলো কারা? তোহফার ওষুধে বিষ মিশিয়েছিল কে? কী লাভ তোহফার জবান বন্ধ করে? না কি ধীরে ধীরে বিষ দিয়ে হ’ত্যা করতে চেয়েছিল তোহফাকে? মাইরা কাকে ভাড়া করেছিল বেগমকে মা’রতে? কে সেই হত্যাকারী যাকে বেগম বাঁচাতে চায়? মাইরা সেবক দ্বারা সেই হত্যাকারীকে ভাড়া করেছিলো যার দরুন সে তাকে দেখেওনি, চেনেও না। এমনকি ঐ নির্বোধ মাইরা ধরা পরার ভয়ে নিজের সেই সেবককে নিজ হাতে হ’ত্যা করেছে। নাহলে অনেক আগেই সেই সেবকের সাহায্যে সে পৌঁছে যেত হ’ত্যাকারীর নিকট। খু’নি কেন নৃশং’সভাবে হ’ত্যাগুলো করছে? সে চাইলে স্বাভাবিকভাবেও মারতে পারতো। তার মহলেই তার বিরুদ্ধে কেউ কেন ষড়যন্ত্র করবে? নিজের জ্ঞান থাকতে সে কখনো কারোর ক্ষতি করেছে বলে মনে পড়ে না। তবুও কেন এত ক্ষোভ খু’নির?

আর চিন্তা করতে পারছে না সে। মাথায় যন্ত্রণা শুরু হয়ে যাচ্ছে। সহস্রাধিক প্রশ্ন অথচ কোনো উত্তর নেই তার নিকট। ফটক ঠেলে দৌড়ে আসছে জারনাব। আগে কখনো এমন ঘটনা দেখেনি সে। তাই কৌতূহল নিয়েই এসেছে। রজনীগন্ধার গাছগুলোর উপর পড়ে থাকা লা’শের দিকে নজর পড়তেই গগণ কাঁপিয়ে চেঁচিয়ে উঠলো সে। কী ভয়ংকর মৃ’ত্যু! চোখ খিচে বন্ধ করে থরথর করে কাঁপছে। সহ্য করতে পারছে না লা’শের দুর্দশা। বারবার যেন চোখের সম্মুখে ভেসে উঠছে সাহাদের মৃতদেহটা। সেই ফ্যাকাশে চেহারা। তলোয়ারের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হওয়া দেহখানা। অসাড় হয়ে আসা শীতল শরীরটা। আর নিতে পারলো না সে। জ্ঞান হারিয়ে ঢলে পড়লো মাটিতে। সব ফেলে ছুটে এলো মাহতাব। মাটিতে পা ছড়িয়ে বসে জারনাবের মাথাটা কোলে তুলে নিলো। ঘাবড়ে গেছে বলিষ্ঠ পুরুষ। গালে আলতো থাপ্পড় দিয়ে ব্যস্ত হয়ে ডাকলো, “জুঁই, জুঁই, ওঠো। কিছু হয়নি। দেখো, দেখো আমার দিকে।”

শ্বাস প্রশ্বাসের গতি কমে এসেছে জারনাবের। কোনো সাড়া নেই। পাগল পাগল লাগলো মাহতাবের। চিৎকার করে বলল, “কেউ পানি আনো দ্রুত।”

ছুটে গিয়ে পানি এনে দেয় ফাইজা। ছো মেরে পানির পাত্র নিয়েই পানির ঝাপটা দিতে লাগলো মাহতাব। চিন্তায় ঘাম ছুটে যাচ্ছে তার। ঘামছে তরতর করে। বারবার জারনাবের মুখে হাত রেখে বড় আদরের সাথে ডাকছে, “জুঁই, দেখো আমার দিকে। চোখ খোলো। কিচ্ছু হয়নি। দেখো। জুঁই।”

তার পেছনেই নীরবে দেখে গেল তানহা। দৃষ্টিতে তখনও অসীম শূন্যতা। হ্যাঁ ভালোবেসেছিল সে। এই পুরুষটাকে ভালোবেসেছিল। পুরুষটার মনের কথা না জেনেই ভালোবেসেছিল। কিন্তু এই পুরুষের চোখে অন্যজনের জন্য অপার মায়া দেখেছে সে। দেখেছে প্রিয়তমাকে ভালোবেসে, প্রিয়তমার ঠিকানা না জেনে, সে আদৌ আছে কি-না কিচ্ছু না জেনেই কীভাবে বছরের পর বছর তার জন্য অপেক্ষা করা যায়। নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে তাই। প্রকাশ করবে না নিজের অনুভূতি। প্রিয় পুরুষের ভালো থাকাকেই নিজের ভালো থাকা মেনে নেবে। ওয়াসিফা সুলতান চোখমুখ কুচকে চেয়ে আছে। দৃশ্যটা সে একদমই ভালো চোখে দেখেনি। টিপ টিপ করে ধীরে ধীরে চোখ মেলল জারনাব। আঁখি মেলতেই এক ঝটকায় খামচে ধরলো মাহতাবের পোশাক। ভীত হয়ে তার শরীরের সাথে মিশে রইল। তার উষ্ণ শ্বাস পেটে লাগতে শিহরিত হলো মাহতাব। দ্রুত সরে বসে বলল, “ভয় পাচ্ছো? আমি আছি তো। কিচ্ছু হয়নি, কিচ্ছু না। আমি আছি তোমার পাশে।”

ভীত আর কাতর দৃষ্টিতে তার মুখের দিকে তাকালো জারনাব। সহসা তার পোশাক ছেড়ে দিয়ে অনেকটা দূরে সরে বসলো। রাগে খামচে ধরলো নিজের গাউন। ছি! কী করছিল সে? এতক্ষণ আজমাইনের শরীরের সাথে মিশে ছিলো। ঘৃণা হলো নিজের উপর। তবে সেই ঘৃণা কাবু করতে পারলো না তার ভয়কে। আবারো আতঙ্কিত দৃষ্টিতে আড়চোখে তাকাতে চাইল লা’শটির দিকে। ততক্ষণাৎ তাকে আড়াল করে একদম সামনে এসে দাঁড়ালো মাহতাব। ভীত মুখটা দুহাতের আজলা ভরে তুলে ধরলো। ব্যস্ত হয়ে বলল, “তাকিয়ো না। তাকিয়ো না ওদিকে। ভয় পাবে আবার।”

আকস্মাৎ কাজে খানিক অবাক হয় জারনাব। ঘটনা বুঝতেই এক ঝটকায় হাত সরিয়ে দেয়। রাগান্বিত দৃষ্টিতে চেয়ে কিছু কড়া কথা বলতে চায়। তার জন্য চিন্তিত মাহতাবের মুখটার দিকে চেয়ে খানিক দমলো। তবুও আঙুল উচিয়ে ঝাঁঝালো গলায় বলল, “তুমি কীভাবে আমাকে স্পর্শ করলে আজমাইন? ছি! কেন এলে এভাবে আমার কাছে? এখানে এত সেবিকা থাকতে কী প্রয়োজন ছিল তোমার এভাবে আমাকে ধরার?”

অনুতাপ স্পষ্ট মাহতাবের মুখে। ব্যথিত গলায় বলল, “আমি এভাবে তোমার কাছে আসতে চায়নি জুঁই। আসলে, আসলে তোমাকে ওভাবে দেখে ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। মাথা কাজ করছিল না। চিন্তায় কী করেছি না করেছি বুঝতে পারিনি।”

“তুমি ভালো করোনি আজমাইন। কাজটা একদম ভালো করোনি। বিধবাদের শরীরে অন্য পুরুষের শ্বাস মিশ্রিত বাতাস লাগলেও কলঙ্কিত হয় তারা।”

“জুঁই।”

“তোমার থেকে এমন অবিবেচিত কাজ আশা করিনি আজমাইন।”

“কিন্তু জুঁই, আমি তো শুধু……..”

ছুটে সেই স্থান ত্যাগ করলো। অসহায় চোখে তাকালো মাহতাব। আব্দুর রহমান যেন উপলব্ধি করলো কোনো গোপন অনুভূতি। গাঢ় চোখে তাকালো মাহতাবের দিকে। আশ্বস্ত করে বলল, “কিছু মনে করো না বাজান। জানোই তো ওর মনের অবস্থা।”

মাথা দুলায় মাহতাব। কাজটা ঠিক হয়নি। কষ্ট পেয়েছে জুঁই। এভাবে ভুল করতে থাকলে কাছে আসার বদলে আরো দূরত্ব সৃষ্টি হবে। ক্ষমা চাইতে হবে তাকে। মেয়েটার কষ্টের কারন সে হতে চায় না। সুখের কারন হতে চায়। তার কিশোর হৃদয়ে আবেগের ঝড় এনেছিল যেই কিশোরী তাকে সে আগলে রাখবে শেষ নিশ্বাস পর্যন্ত। অতীতে কে এসেছে তার জীবনে, কী ঘটেছে সেসবের প্রতি কোনো আগ্রহ নেই তার। ভবিষ্যতে শুধু তার হবে এই নারী, শুধুই তার। ক্ষমা চাইতে হবে। কিন্তু এখন অনেক কাজ। সুযোগ নেই। পরে সময় করে ক্ষমা চেয়ে নেবে। এগিয়ে এলো সুলতান। ধীর স্বরে বলল, “মাহতাব।”

“আদেশ করুন মহামান্য।”

“চাইলে তুমি যেতে পারো। সৈনিকরা সব কাজ করে নেবে নিজেদের মতো।”

“মাফ করবেন মহামান্য। এখন এই কাজটাই বেশি জরুরী আমার জন্য। সৈনিকদের আমাকে প্রয়োজন হবে। আপনি যান। আমি লাশ দাফন-কাফনের ব্যবস্থা করছি।”

“এলিজা কোথায় শাহজাইন?”

মায়ের প্রশ্নে ঘুরলো সুলতান। মনে পড়লো বেগমের কথা। এসব নৃশংসতার মাঝে সে একদম ভুলে বসেছিল মেয়েটার কথা। কামরায় একা রেখে এসেছে মেয়েটাকে। কপালে ভাঁজ পড়লো মুহুর্তেই। ছটফট করে উঠলো দৃষ্টিজোরা। ওয়াসিফা সুলতান পুনরায় শুধায়, “সবাই এখানে কিন্তু এলিজা নেই কেন শাহজাইন? এতবড় ঘটনা ঘটে যাচ্ছে আর সাম্রাজ্যের সম্রাজ্ঞীর কোনো খবর নেই।”

“এলির শরীরটা ভালো নেই আম্মা। একটু অসুস্থ। ভোররাতে বেশ কয়েকবার বমি করেছে। দুর্বল হয়ে পড়েছে। তাই ডাকিনি আমি। ঘুমাক কিছুক্ষণ।”

“তো তুমি আগে বলবে না? চিকিৎসা করা হয়েছে না কি ওভাবেই ফেলে রেখেছো?”

“ও ঠিক আছে। চিন্তা করবেন না। যাচ্ছি আমি।”

দ্রুত মহলের দিকে এগোচ্ছে সুলতান। মাঝপথে থেমে গেল কিছু একটা ভেবে। কয়েক পা পিছিয়ে এসে শক্ত গলায় বলল, “পাহাড়ার দায়িত্বে থাকা সৈনিকদের সরিয়ে নতুন সৈনিক নিযুক্ত করো মাহতাব। এরা যেভাবে দায়িত্ব পালন করছে তাতে বাইরের খু’নি ভেতরে ঢুকে আমার পরিবারকে নিশ্চিহ্ন করে দিলেও এরা টের পাবে না। কোনো প্রকার গাফিলতি সহ্য করবো না আমি।”

আগে তোহফার কামরায় গেল সে। তোহফাকে নিশ্চিতে ঘুমাতে দেখে স্বস্তির শ্বাস ফেলল। সেবিকাদের সতর্ক করে চলে এলো নিজ কামরায়। পালঙ্কে নিষ্প্রাণভাবে শুয়ে আছে বেগম। খোলা চুল ছড়িয়ে আছে বালিশের ওপর। বুক পর্যন্ত চাদর টানা। বন্ধ চোখদুটো বড্ড দুর্বল লাগছে। কোনো শব্দ ছাড়া ধীর পায়ে শিয়রে বসলো সুলতান। সাবধানে হাত রাখলো কপালে। নাহ, জ্বর তো আসেনি। তাহলে হুট করে কী হলো? খাবার দাবারের কারনে কোনো সমস্যা হলো না কি? নিষ্পলক দৃষ্টিতে চেয়ে থেকে আলতো করে অধরটা ছুঁইয়ে দেয় কপালে। তলোয়ার পাশে সরিয়ে রেখে দীঘল ঘন চুলগুলোর মাঝে আঙ্গুল গলিয়ে দেয়। ধীরে ধীরে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে হারালো গভীর ভাবনায়। এই অবস্থায় কীভাবে মেয়েটাকে উত্তরীয় সাম্রাজ্যে পাঠাবে? হুট করে কিছু মনে পড়তেই ব্যস্ত হয়ে উঠে দাঁড়ালো। সিন্দুক খুলে বের করে আনলো সেদিনের সেই অসম্পূর্ণ চিত্র। যেখানে রং-তুলিতে বেগমকে সম্পূর্ণরূপে ফুটিয়ে তুলতে পারলেও সুলতানের শরীর আঁকা হয়নি সম্পূর্ণ। অসম্পূর্ণ চিত্রটা দেখলে ভয় ধরে তার। না জানি এই অসম্পূর্ণ চিত্রের মতো সেও অসম্পূর্ণ থেকে যায় এলির জীবনে। ভয়ানক যুদ্ধ বাঁধবে এবার। এই মৃ’ত্যু খেলায় বাঁচা-ম’রার কোনো নিশ্চয়তা নেই। আল্লাহ সহায় হলে আবারো ফিরবে এই মায়াময়ীর কাছে। আজরাইল যদি বাঁধ সাধে তাহলে কি তাকে ভুলে যাবে এলি? শুরু করবে সবকিছু নতুন করে? তার জীবনের অধ্যায় থেকে মুছে যাবে সুলতান শাহজাইন নামক পুরুষটি। এই নারীর তীব্র রজনীগন্ধার সুবাসের মাঝে কোথাও মিলবে না তার অস্তিত্ব। হাঁসফাঁস করে শক্ত পুরুষ। প্রিয়তমা স্ত্রীর প্রতিটি নিশ্বাসের সাথে সে অনুভব করতে চায় নিজেকে। একি! চিত্র সে সম্পূর্ণ! চিত্রতে স্পষ্ট সফেদ গাউন পরিহিতা নারীর পাশে ঘিয়ে রঙা রাজকীয় পোশাকে দন্ডায়মান সুলতান। তার মাথার সফেদ পাগড়িটা নারীর সফেদ তাজের কাছে বড্ড মানানসই। কিন্তু সে তো নিজের শরীর শুধুমাত্র কোমর পর্যন্তই অঙ্কন করতে পেরেছিলো। কে সম্পূর্ণ করেছে এই চিত্র? এলি?

অবচেতন মন খলবলিয়ে উঠলো হঠাৎই। এলি এঁকেছে তার চিত্র! তাই বুঝি এতো নিখুঁত লাগছে তাকে? তার প্রেয়সী নরম হাতে রং-তুলির আদলে ভালোবেসেছে তাকে। অধর প্রসারিত হয় অজান্তেই। এলি ভুলবে না তাকে। ভালোবাসবে। তার অস্তিত্ব বিলীন হবার পরেও ভালোবাসবে। তার শরীরের রজনীগন্ধার সুবাসে আজীবন মিশে থাকবে সুলতান শাহজাইন। এই অনুভূতি এত মধুর কেন? চিত্রটা আবার সিন্দুকে ভরে রেখে জানালার বিশাল পর্দা মেলে দিলো। বসলো বেগমের পাশে। আলতো করে নিজের মুঠোয় পুরে নেয় বেগমের দুর্বল চিত্তে এলিয়ে রাখা হাতটা। হাতের অপর পিঠে চুমু এঁকে দেয় বড্ড আদরে।

“এই চেহারায় কি জাদু রেখেছো আমার জন্য? যতবার দেখি ততবার কেন বাঁচার স্বাদ জাগে?”

“কত স্বপ্ন তোমাকে নিয়ে আমার হৃদয়ে। অথচ জীবনের কোনো নিশ্চয়তা নেই! সাধ্য থাকলে সমস্ত নিয়ম ভেঙে থেকে যেতাম এই হাতে হাত রেখে।”

মৃদুস্বরে হাসলো সুলতান। পূর্বের দিনগুলোর কথা ভেবে দুঃখ ভোলানোর প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। মৃত্যুর প্রতি তার এত ভয়? না কি এই নারীর হৃদয় থেকে হারিয়ে যাবার আতঙ্ক? আবারো বিড়বিড়িয়ে আওড়ায়, “তোমায় আঁকড়ে ধরতে কত নিয়ম ভেঙেছি আমি। কত বিধান জুরেছি নতুন করে। তার খবর জানো তুমি?”

হুট করে মেজাজটা খারাপ হয়ে গেল। ধুর! গোল্লায় যাক যুদ্ধ! রসাতলে যাক সাম্রাজ্য! সে আজই ছেড়ে দেবে সুলতানের আসন। নিকুচি করেছে এসব দায় দায়িত্ব! এলিকে নিয়ে চলে যাবে দূর পাহাড়ে। বারবার সাম্রাজ্যের ভালোর জন্য কখনো দ্বিতীয় বিবাহ করার তছরুপ ওঠে তো কখনো দুই যুগ পরে বউকে পেয়ে আবার তাকে দূরে ঠেলে দিয়ে যুদ্ধ নামক মৃত্যুকুপে ঝাঁপিয়ে পড়তে হয়। কখনো তো সমস্ত সীমা পাড় করে গিয়ে দারিয়ার মতো বিষধর নারীর সান্নিধ্য দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করতে হয়! ছি ছি! ঘিন ঘিন করে ওঠে পুরো শরীর। অসহ্য! তেতো এই জীবন! অজান্তেই কখন ঘুমন্ত বেগমকে টেনে এনেছে উরুর উপর। কোলের ওপর বসিয়ে নেওয়ার পরেও ঘুম ভাঙে না নারীর। ঘুমন্ত মাথাটা বুকের সাথে ঠেকিয়ে নিয়ে দু’হাতে জাপটে ধরে দুলছে মৃদুবেগে। মেজাজটা বোধহয় ঠিক হলো খানিক। চকাস করে গালে চুমু বসিয়ে দিতেই চোখ মেলল বেগম। চোখ ছোট ছোট করে উপলব্ধি করার চেষ্টা করে নিজের অবস্থান। অবস্থান নির্নয় করতে সক্ষম হলো কিছুক্ষণ পরে। নড়চড়া বন্ধ করে সুলতানের বুকের কাছের কাপড় খামচে ধরে আবারো মাথা এলিয়ে দেয়।
ততক্ষণাৎ নাক সিটকে বলল, “উমমম! বমির গন্ধ আসছে আপনার পোশাক থেকে।”

হাসে সুলতান। রাগ, দুঃখ সব বিলীন হয়েছে কিছুক্ষণ পূর্বেই। তবুও বিরক্ত গলায় বলল, “কয়বার পোশাক বদলানো যায়? পোশাক বদলাতে বদলাতে হাঁপিয়ে গেছি আমি। আর সম্ভব না। এইভাবে থাকলে থাকো নাইলে ভাগো।”

“আবার! আবার এভাবে কথা বলেছেন? রাগ তো কাল ভাঙিয়ে দিয়েছিলাম আমি।”

“কচু ভাঙিয়েছিলে।”

“আচ্ছা তাই না কি? আবার ভাঙাতে হবে?”

“থাক। এমনিতেই অনেক মেহেরবানি করেছো সকাল থেকে। বমি করে করে গন্ধ বানিয়ে ফেলেছো আমাকে! তোমার লজ্জা করে না স্বামীর শরীরে বমি করতে? এটা তো রীতিমতো সুলতানকে অপমান করা।”

“স্বামী আমার, তার শরীর আমার, বমিও আমার। তাহলে সুলতানের অপমানটা কোথায় হলো? সুলতানকে বলে দিবেন আমার বমি করার সময় যেন আল্লাদ করে এগিয়ে না আসে। তাহলে আর বমি লাগবে না।”

“কে আসবে? বণিক? এবার আসলে গলায় পাথর বেঁধে নদীতে ভাসিয়ে দেব ওটাকে।”

“জ্বলে?”

“না, আরাম লাগে। এতটাই আরামদায়ক ব্যক্তি যে অল্পদিনেই বিরক্তির তালিকার শীর্ষে নিজের স্থান গড়ে নিয়েেছে।”

বিকেল হতেই মাহতাব বেগমকে উত্তরীয় সাম্রাজ্যে নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। ঘোড়া সাজাচ্ছে সৈনিকরা। সারাটা দিন কাজের চাপে আর যাওয়াই হয়নি জারনাবের কাছে। বোকা মেয়েটা রাগে-অভিমানে কান্না বাঁধিয়ে ফেলেছে না কি কে জানে। তাই দ্রুত পাগড়ি চাপিয়ে ছুটল সেদিকে। কিন্তু নিজ কামরার চৌকাঠ পেরোনোর পূর্বেই এক তোড়া ফুল ভেসে উঠলো চোখের সম্মুখে। কী ফুল চিনতে পারলো না সে। তবে রাগ হলো প্রচণ্ড। কার এতবড় সাহস হয়েছে? ফুলের তোড়া ধরে রাখা মোলায়েম নারী হাত আরো রাগান্বিত করলো তাকে। কিন্তু মুখের সামনে থেকে তোড়া সরিয়ে রমনী সামনে আসতেই চমকে উঠলো সে। রাগ বুঝি পালিয়ে গেল জানালা খোলা পেয়ে। অবাক হয়ে বলল, “জুঁই!”

“আমি দুঃখিত আজমাইন।”

অনুতপ্ত হয়ে বলল জারনাব। এগিয়ে এলো দ্বার ঠেলে। তবে খুব বেশি এগোলো না। মাহতাবের থেকে কিছুটা দূরত্ব রেখে দাঁড়ালো। মাহতাব বিস্ময়ের চরম সীমায় পৌঁছেছে। কথা বন্ধ হয়েছে উত্তেজনায়। জারনাব পুনরায় অপরাধী গলায় বলল, “তখনকার ব্যবহারের জন্য আমি সত্যিই দুঃখিত আজমাইন। হুট করে কী বলে দিয়েছি। তুমিতো জানোই আমার বোধ কম। ক্ষমা করে দাও।”

এবার যেন চোখে সরষে ফুল দেখছে মাহতাব। মাথাটা বোধহয় ভনভন করে ঘুরছে। এখনি পড়ে যাবে। হ্যাঁ, অজ্ঞান হয়ে যাবে সে। সেখানেও বাঁধ সাধলো বোকা নারী। কান্নামিশ্রিত কন্ঠে বলল, “ক্ষমা করবে না? সত্যিই দুঃখিত আমি।”

“এবার তুই ম’রবি মাহতাব। দোয়া-দরূদ যা মনে আছে পড়ে নে।” বিড়বিড়ায় মাহতাব।

অধৈর্য হয় জারনাব। সত্যি সত্যি ফ্যাচফ্যাচ করে কেঁদে দিলো সে। ভীত গলায় বলল, “তোমাকে কি জ্বীনে আছর করেছে আজমাইন?”

“হ্যাঁ, জ্বীনেই আছর করেছে মনে হচ্ছে। নাহলে এসব ভুলভাল দেখতাম না, শুনতাম না।” সংকিত গলায় বলল মাহতাব।

“তাহলে দ্রুত এই ফুলটা ধরো। আমি পালিয়ে যাই এখান থেকে। আমি খুব ভয় পাই জ্বীনদের।”

ভীত গলায় কথাখানা বলে এদিক-ওদিক দেখছে জারনাব। আতঙ্ক তার দৃষ্টি জুরে। বোকা বোকা কথাতে চোখ ছোট ছোট করে তাকালো মাহতাব। এবার সে নিশ্চিত এটা তার ভ্রম নয়। সত্যিই জারনাব এসেছে। আর এই উদ্ভট সুন্দর কথাগুলো তাকে বলেছে। ব্যস্ত হয়ে হাত বাড়িয়ে ফুলের তোড়া নিয়ে নেয় সে। হাঁফ ছাড়লো জারনাব।

“জ্বীন চলে গেলে আমাকে ক্ষমা করে দিও।”

বলতে না বলতে ছুটে বেরিয়ে গেছে জারনাব। হতভম্ব মাহতাব চোখ বড়বড় করে চেয়ে থাকলো সেদিকে। ঘটনা কী ঘটলো এতক্ষণ তার মোটেই বুঝে আসলো না। স্বপ্ন দেখলো না কি জেগে জেগে?

এদিকে উত্তরীয় সাম্রাজ্যে যাওয়ার কথা তুলতেই রেগেমেগে মহল ছেড়ে বেরিয়ে গেছে বেগম। না তো সাথে ঘোড়া নিয়েছে আর না তো অস্ত্র বা সৈনিক সাথে নিয়েছে। তার ধারণা সুলতান তাকে নিজের থেকে দূরে সরাতে চায়। তাই উত্তরীয় সাম্রাজ্যে পাঠাতে চাইছে বীনা কারনে। মুখটা হাঁ করে দাঁড়িয়ে আছে সুলতান। কী হলো এটা? শরীরে রক্তের চেয়ে রাগ বেশি এই মেয়ের। মাহতাবের ও খোঁজ নেই আজ। কোন জান্নাতের বাগানে ঢুকেছে সেই ভালো জানে। অবশ্য সে আন্দাজ করতে পারছে মাহতাবের হাওয়া হবার কারন। হুঁশ ফিরতেই হন্তদন্ত হয়ে ছুটলো প্রধান দ্বারের দিকে। ততক্ষণে বেগম কতদূর চলে গেছে তার ঠিক নেই। ডেকে উঠলো ওয়াসিফা সুলতান, “তুমি কোথায় চললে শাহজাইন? ভুলে গেছো যুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু করতে হবে?”

পেছনে ফেরার সময় নেই সুলতানের নিকট। ঘোড়াশালের দিকে ছুটতে ছুটতে গলা উচিয়ে বলল, “সৈনিকদের যুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু করে দিতে বলবেন আম্মা। কাল সকালেই চলে আসব আমি। আর মাহতাবের হুঁশ ফিরলে বলবেন তোহফাকে নিয়ে আসতে উত্তরীয় সাম্রাজ্যে।”

একা একা জঙ্গলের মাঝ দিয়ে হাটছে বেগম। বিরক্ত আর রাগে লাল হয়ে আছে নাকটা। কতবড় স্বার্থপর এই সুলতান। তাকে বলে কি-না বাপের বাড়ি চলে যেতে! আর আসবেই না ফিরে। অবশ্য এভাবে বেরিয়ে আসার আরো একটা কারন আছে। সুলতান ঘুরেফিরে বারবার শুধাচ্ছে সেদিন কে তাকে পাহাড় থেকে আক্রমণ করেছিলো। মরিয়া হয়ে উঠেছে নাম শুনতে। সে জানে একবার নাম জানতে পারলেই সুলতান মে’রে ফেলবে আব্বাজানকে। তাই রাগের বাহানায় চলে এসেছে এভাবে। এখন অস্বস্তি লাগছে। এভাবে এতদূর হেঁটে যাওয়া যায় না কি?

“কী সুন্দরী? একা একা কোথায় চললে?”

চমকায় বেগম। পাঁচটা লোক দাত কেলিয়ে এগিয়ে আসছে তার দিকে। কালো পোশাকে আবৃত তারা। হাতে বড়বড় ছুড়ি। আতঙ্ক ধরে বেগমের মনে। এই জঙ্গলের মাঝে এরা কী করছে? ডাকাত না কি? কিন্তু তার কাছে তো এখন তেমন কোনো অলংকারও নেই। তাজটাও খুলে এসেছে।

“হাত ফাঁকা। মনে হচ্ছে না তোমার কাছে অর্থ বা গহনা কিছু পাবো। এত মূল্যবান পোশাক আর ফাঁকা হাত। মানা গেল না।”

পিছিয়ে যায় বেগম। এই মাঝ জঙ্গলে এমন একটা পরিস্থিতিতে পড়তে হবে সে কল্পনাও করেনি। তার সাথে কোনো অস্ত্রও নেই। এতোগুলো পুরুষের হাতে হাতাহাতি খুব বিশ্রি ব্যপার।

তাদের মধ্যে থেকে একজন পুরুষ হঠাৎ এগিয়ে বিশ্রি অঙ্গভঙ্গি করে বলল, “আরে অর্থ, গহনা নেই তো কী হয়েছে? তাজা একটা ফুল তো পেয়েছি। ফুলের ঘ্রাণ নিয়েই পুষিয়ে নেব আজ।”

লোলুপ দৃষ্টিতে তারা নজর বুলালো তার শরীরে। গা ঘিন ঘিন করে ওঠে বেগমের। ইচ্ছে করছে এখনি ধর থেকে মাথাগুলো আলাদা করে দিতে। কিন্তু এখন অস্ত্র ছাড়া এভাবে হাতাহাতি করাটা বোকামি আর নোংরা একটা ব্যপার। আরো কয়েক পা পিছিয়ে গেল ছুটে পালিয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্যে। তখনই পেছন থেকে ভেসে এলো রাশভারি পুরুষালি কন্ঠস্বর।

“ফুল নিবি, ফুলের কাঁটা নিবি না?”

চলবে……

#সম্রাজ্ঞী
#লিয়ানা_লিয়া
#পর্ব_35

অটবীর নির্জনে চার পায়ে ভর করে দাঁড়িয়ে আছে বাদামি বর্ণের অশ্ব। শরীরে কোনো রাজকীয় সাজসজ্জা নেই তবুও যেন সে রাজা। এই নির্জন জঙ্গলের একমাত্র রাজা। পিঠে করে বয়ে এনেছে বলিষ্ঠদেহি এক সুদর্শন সুপুরুষ। পিঠের পাশ দিয়ে ঝুলছে তির-ধনুক। একলাফে নেমে দাঁড়ায় পুরুষ। অশ্বের শরীরে হাত বুলিয়ে বুঝিয়ে দিলো ‘অপেক্ষা করো নিজের মালিকের ফিরে আসা পর্যন্ত’। বেগমের দিকে নোংরা আকাঙ্খা নিয়ে এগিয়ে আসা পাঁচ পুরুষ থমকে গেছে নিজ নিজ স্থানে। চোখগুলো কোটর ছেড়ে বেরিয়ে আসার জোগাড়। অস্ত্র ধরা হাতগুলো কেঁপে চলেছে একাধারে। ভীত দৃষ্টিতে চেয়ে শুকনো গলায় আওড়ায়, “সুলতান।”

ভরসার মানুষের উপস্থিতিতে বদলেছে বেগমের শংকিত দৃষ্টি। পেছনে ফিরে তাকালো না তবুও। নিজের মূল্যবান ইজ্জত, সম্মান হারিয়ে ফেলার ভয় কমলো না এত দ্রুত। চোখদুটো বন্ধ করে রইল। হৃদযন্ত্রটা অত্যধিক ধ্বক ধ্বক করে পিঞ্জর ভেঙে বেরিয়ে আসবে যেন। আনমনে বারংবার বলে চলে, “আল্লাহ, আল্লাহ, আল্লাহ।”

তার দিকে অগ্রসর পা দুটো থেমে যায় ততক্ষণাৎ। উপলব্ধি করলো ইজ্জত হারানোর ভয়ে কুঁকড়ে গেছে তার প্রাণপ্রিয় স্ত্রী। রাগের দেখা মিলল না পুরুষের দৃষ্টিতে। বরং মিলল আফসোস। সে কেন আরেকটু আগে পৌঁছাতে পারলো না? বন্ধ চোখে নারী ঘন ঘন শ্বাস ফেলতেই দ্রুত এগিয়ে গিয়ে তার হাত শক্ত করে ধরে সুলতান। অসীম ভরসা ঢেলে বলল, “ভয় পেয়ো না এলি। আমি এসেছি।”

উত্তর না পেয়ে বিচলিত হলো না একটুও। ব্যস্ত হয়ে সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। বেগমের মাথাটা বুকের খানিকটা উপরে আঁকড়ে ধরে সম্মোহনী গলায় বলল, “কিচ্ছু হবে না তোমার।”

সাড়া দেয় না বেগম। নিরাপদ বক্ষে আরো গুটিয়ে নেয় নিজেকে। অত্যন্ত আদরে মাথায় হাত বুলিয়ে সুলতান ডাকে, “এলি, এলি। আমার বাঘিনী।”

একহাত পিঠে ঠেকিয়ে আরো চেপে নেয় নিজের দিকে। হিজাবে ঢাকা মাথায় অবিরত হাত বুলিয়ে আবারো ডাকলো, “এলি, এলি চোখ খোলো। দেখো আমি এসেছি। তাকাও আমার দিকে।”

কালো পোশাক পরিহিত পাঁচ পুরুষ মাথা নুইয়ে হাঁটু মুড়ে বসে পড়েছে সম্মুখে। অস্ত্র ফেলে হাতজোড় করে নত মস্তকে জানায়, “মাফ করে দিন মহামান্য। আমরা জানতাম না উনি রাজবংশীয় নারী। জানলে কখনোই এমন ভুল করতাম না। ক্ষমা করুন, দয়া করে ক্ষমা করে দিন আমাদের।”

অগ্নি দৃষ্টিতে তাকালো সুলতান। ঠোঁটে আঙ্গুল চেপে হিসহিসিয়ে বলল, “আহ! এত কথা কীসের?”

ঠিক তখনই আবার বেগমের পিঠের দিকের হিজাব টেনে ঠিক করে দিতে দিতে কোমল গলায় বলে, “এলি, কিছু হয়নি তো। তাকাও।”

মাথা উঠিয়ে সোজা সুলতানের চোখে চোখ রাখে বেগম। লাল হয়ে আছে সুন্দর চোখদুটো। অস্থির হয় সুলতান। দুহাতে ভীত মুখটা আঁকড়ে ধরে। উত্তেজিত কন্ঠে জাহির করে, “উঁহু, আর ভয় পায় না। আমি এসে গেছি তো।”

দৃষ্টি সরিয়ে নেয় বেগম। আলতো স্বরে ডাকে, “সুলতান।”

“এলি।”

আচমকা বেগমের পায়ের সামনে হাঁটু গুছিয়ে বসে পড়ে সুলতান। দ্রুত সরে যেতে নিলো বেগম। হাত টেনে ধরে সুলতান। বিরক্ত গলায় বলে, “নড়ো না। দাঁড়াও।”

গাউনের নিচের অংশে কাঁটা বেঁধে ছিলো। ওগুলোই টেনে টেনে ছাড়াচ্ছে সুলতান। এভাবে এই লোকগুলোর সামনে পায়ের কাছে বসে পড়াতে ইতস্তত বোধ করে বেগম। হয়তো হেঁটে আসার সময় জঙ্গলের কোথাও থেকে কাঁটা লেগে গিয়েছিল। খেয়াল করেনি সে। একে একে সবগুলো কাঁটা ছাড়িয়ে উঠে দাঁড়ায় সুলতান। বেগমের মাথায় অধরটা ছুঁয়ে দিয়ে হুট করে কোমর থেকে তলোয়ার খুলে নেয়। লোকগুলোর দিকে এগোলেই হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে তারা। ছুটে এসে জড়িয়ে ধরে সুলতানের পা। ক্রন্দনরত কন্ঠে বলে, “মাফ করে দিন সুলতান। দয়া করুন। ওয়াদা করছি আমরা আর কখনোই এই পাপ কাজ করবো না। এবারের মতো ছেড়ে দিন।”

ভ্রুক্ষেপ করে না সুলতান। দলের সর্দার মতো লোকটার থুতনিতে তলোয়ার ঠেকিয়ে মুখটা উঁচু করে ধরে। শক্ত কন্ঠে শুধায়, “এ পর্যন্ত এখান থেকে যাতায়তরত কতগুলো নারীর সম্মান নষ্ট করেছিস?”

“কককারোর না। এই প্রথম ছিলো।”

“সত্যিটা জানতে চেয়েছি আমি।”

“বিশ্বাস করুন মহামান্য। আমরা এর আগে…….”

“সত্যিটা বল। মিথ্যে বললে জিভ টেনে ছিড়ে নেব।” চিৎকার করে সুলতান।

আরো ঘাবড়ে যায় লোকগুলো। কান্নামিশ্রিত কন্ঠে বলল, “সসত্যি বললে আ আপনি আমাদের মে’রে ফেলবেন।”

“তোদের কি মনে হয় মিথ্যে বললে ছেড়ে দেব আমি? সত্যিটা বল। কথা দিচ্ছি, আমি মা’রব না তোদের।”

ভরসা পায় না তারা। ভীত চোখে চেয়ে থাকে নির্বাক হয়ে। সুলতান পুনরায় চিৎকার করে, “বলবি না কি গলার ভিতর ঢুকিয়ে দেব তলোয়ার?”

“না না, বলছি, বলছি আমরা।”

“হুম, বল। শুরু কর।”

“এ পর্যন্ত সাতজন নারীর……..”

“হয়েছে। বুঝেছি। এবার বল, লুটপাট করেছিস কতজনের থেকে?”

“মহামান্য।”

গলা শুকিয়ে কাঠ হয়েছে তাদের। এত অন্যায় জানার পর কীভাবে সুলতান তাদের না মে’রে ছেড়ে দেবে? না কি ওয়াদা ভঙ্গ করবে সুলতান হয়ে? উদিত কঠিন হিং’স্রতা দমিয়ে নেয় সুলতান। আকাশসম রাগ ঠেলে গিলে নেয় বেগমের দিকে চেয়ে। এতগুলো নারীর সম্মানহানি করেছে এই জানো’য়ারগুলো ভাবলেই শরীরের সমস্ত রগ ফুলে উঠছে। রাগে, ঘৃণায় রি রি করে উঠছে শরীর। ওদের কেয়ামত দেখানোর জন্য এই কারনটাই যথেষ্ট। এমন জঘন্য কাজ করেও এরা বেঁচে থাকবে তা কী করে হতে পারে? ইচ্ছে করছে এখনি এগুলোকে উত্তপ্ত কড়াইতে ছেড়ে তেলে ভেজে ফেলতে। ধ’র্ষণ! দুনিয়ার সবচেয়ে নিকৃষ্ট শব্দ। সাতটা নারীর সম্মান নষ্ট করেছে! এই অপরাধের শাস্তি যায় দেওয়া হোক কম হয়ে যাবে। তবুও নিজেকে সংযত করলো সে। ফ্যাসফ্যাসে গলায় বলল, “অস্ত্র তুলে হাতে নে।”

কিছু না বুঝে হতবাক নয়নে চাইল তারা। সুলতান পুনরায় বলল, “অস্ত্র ধর।”

ভয়ে, আতঙ্কে কাঁপা কাঁপা হাতে অস্ত্র ধরে তারা। দৃষ্টিতে শঙ্কা। আকাশসম রাগ দমিয়ে রাখতে হিমশিম খেতে হচ্ছে সুলতানকে। অন্তত শীতল আর হিম ধরিয়ে দেওয়া কন্ঠে রহস্য মিশিয়ে বলল, “জাদু দেখবি? জাদু।অস্ত্র তোদের হাতেও আছে। আমার হাতেও আছে। আমি অস্ত্র চালাবো না তবুও তোরা এক এক করে ম’রবি।”

“মানে!”

বেগমের দিকে ফিরলো সুলতান। হিমশীতল কন্ঠে বলল, “শুনেছো না কি এলি? সাতজন নারীর সম্মান নষ্ট করেছে ওরা। ওদের কী শাস্তি দেওয়া যায় বলোতো?”

বাক্য সম্পূর্ণ করার সাথে সাথেই তার হাত থেকে ছো মে’রে তলোয়ার নিয়ে নিয়েছে বেগম। হুট করে কেউ কিছু বুঝে ওঠার পূর্বেই সর্দার মতো লোকটার পেটে সজোরে ঢুকিয়ে দেয় অর্ধেক তলোয়ার। বজ্রকন্ঠে বলে ওঠে, “মৃ’ত্যু, ওদের শাস্তি একমাত্র মৃ’ত্যু।”

বলতে বলতে রক্তাক্ত তলোয়ার তুলে ততক্ষণাৎ অপরজনের গলায় চালিয়ে দেয়। চামড়া চিরে রক্তের ফোয়ারা ছোটে। চোখের পলকে মৃ’ত্যুর কোলে ঢলে পড়ে দু’জন। জঙ্গলের মাটিতে আছড়ে পড়ে তাদের অসাড় দেহ। কয়েকবার বড়বড় শ্বাস নিয়ে প্রাণ ত্যাগ করে। আকস্মাৎ ঘটনায় চমকে গেছে বাকি তিনজন। অথচ সুলতানের ভাবভঙ্গি খুবই স্বাভাবিক। পিছিয়ে যায় লোকগুলো। আতঙ্কিত কন্ঠে চিল্লিয়ে বলে, “আপনি ওয়াদা ভঙ্গ করছেন সুলতান। আপনি কথা দিয়েছিলেন মা’রবেন না আমাদের।”

“আমি কখন মা’রলাম? মনে হচ্ছে মৃ’ত্যুভয়ে চোখে কম দেখছিস তোরা। মা’রছে সম্রাজ্ঞী, আর দোষ লাগাচ্ছিস সুলতানের শরীরে! ছি ছি! এইটা ঠিক না।” বিস্মিত হয়ে বলল সুলতান। ক্রুর হাসি তার অধরে।

“আপনি আমাদের ধোঁকা দিয়েছে…….”

আর বলা হলো না বাকি কথা। একই সঙ্গে তিনজনের গলা চিরে দেয় বেগমের হাতের ধারাল তলোয়ার। ফিনকি দিয়ে ছুটে বেরোলো রক্তের স্রোত। মাটিতে পড়ে গলা কাঁটা মুরগির ন্যায় দাপিয়ে দাপিয়ে অবশেষে পাড়ি জমায় মৃত্যুর কিনারে। সুলতানের ঠোঁটে হিং’স্র হাসি। সুন্দর ঠোঁটজোড়ায় বড় ভয়ঙ্কর সেই হাসি। নিথর দেহগুলোর সম্মুখে দাঁড়িয়ে তখনও ফুঁসছে বেগম। হেসে একহাতে নিজের সাথে জড়িয়ে নেয় সুলতান। এক পলক মৃ’তদেহগুলোর দিকে চেয়ে তাচ্ছিল্যভরা কন্ঠে বলল, “জানাজা মুবারক।”

খানিকক্ষণ চুপ থেকে আফসোসের সুরে বলল, “তোদের জানাজা কে করবে? ভয় পাস না। শেয়াল, কুকুর করে দেবে সময় মতো।”

বেগমের হাত ধরে ঘোড়ার দিকে এগোতে এগোতে বলল, “চলো, যাওয়া যাক।”

বেঁকে বসলো বেগম। হুট করে ঝাড়া দিয়ে হাত ছাড়িয়ে নেয়। ঝাঁঝালো স্বরে বলল, “আপনি কেন এসেছেন? চলে যেতে বলেছেন, চলে যাচ্ছি। কে বলেছে আপনাকে আসতে?”

“তোমার জেদ দিনকে দিন বেড়েই যাচ্ছে এলি। আরেকটু দেরি হলে কী হতো বলোতো?”

“যায় হোক। আপনার কী? চলে যেতে বলেছেন তাহলে আবার এসেছেন কেন?”

“ব্যপার কী? আজকাল তোমার মেজাজ একটু বেশিই খিটখিটে মনে হচ্ছে?”

“আমার মেজাজ খিটখিটে হয়েছে? আমার! আর আপনি যে জোর করে আমাকে উত্তরীয় সাম্রাজ্যে পাঠানোর জন্য উঠে পড়ে লেগেছিলেন তার বেলা?”

নিখুঁতভাবে কথাটা এড়িয়ে গেল সুলতান। ঘোড়ার পিঠে ঝুলিয়ে রাখা থলে থেকে তাজ বের করে বলল, “আসো, পরিয়ে দেই। এটা পড়া থাকলে অন্তত এই ঝামেলাটা হতো না। ওরা চিনতো যে তুমি সাধারন কেউ নও।”

“পরবো না আমি এটা।”

“পরতে হবে।”

“বললাম তো পরব না। এই সাম্রাজ্যে থাকবোও না। এই সম্রাজ্ঞীর তাজও পরবো না। সরান এটা।”

“আমার কিন্তু রাগ উঠে যাচ্ছে এলি।”

“তো?”

রেগে যাওয়ার বদলে বাঁকা হাসছে সুলতান। এক পা দু’পা করে বেগমের দিকে এগোতে ছুটে পালাতে নেয় বেগম। খপ করে তার হাত চেপে নিজের খুব কাছে টেনে আনলো। বিরক্ত কন্ঠে বলল, “আরে দাঁড়াও। যাচ্ছ কোথায়?”

জোরজবরদস্তি করে কোনোরকম তাজটা পরিয়ে দিয়ে হাঁফ ছাড়লো। এবার শান্তি লাগছে যেন। তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকালো বেগমের দিকে। হুম, একদম তার বেগম বেগম লাগছে এখন। তাজ ছাড়া অবিবাহিত লাগছিল। মোটেই ভালো লাগছিল না। বিশ্রি লাগছিল। তার উদ্ভট মুখভঙ্গি পছন্দ হলো না বেগমের। ভ্রু কুচকে বলল, “এভাবে কী দেখছেন? আমি যাবো না আপনার সাথে। রামান সাম্রাজ্যে তো কখনোই না।”

“আমি তোমাকে রামান সাম্রাজ্যে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে আসিনি। এসেছি উত্তরীয় সাম্রাজ্যে পৌঁছে দিয়ে আসতে।”

মনটা বেজায় খারাপ হলো বেগমের। সে ভেবেছিলো সুলতান তাকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে এসেছে অথচ সে তো এসেছে নিজ হাতে তাকে তাড়িয়ে দিতে। তাকে বুঝি আর ভালো লাগছে না? চেহারা নষ্ট হয়ে গেছে? তাই এখন তাকে তাড়িয়ে দেওয়ার এতো তাড়া। সে আর পূর্বের মতো কারোর নজর কাড়ে না। তার প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে মানুষটার কাছে। রাগে-অভিমানে কথা বলার ইচ্ছেও ফুরিয়ে এলো। চুপচাপ ঘোড়ার কাছে গিয়ে শান্ত গলায় বলল,

“চলুন।”

এত সহজে মেনে নেওয়াতে অবাক হয় না সুলতান। স্পষ্ট উপলব্ধি করতে পারছে অভিমানে মুষড়ে পড়েছে তার প্রেয়সী। ইচ্ছা করেই কথাটা বলেছে সে। নাহলে বেগম আবার ফিরে যাওয়ার জেদ ধরতো। কিন্তু এখন রাগে-অভিমানে সেচ্ছাই চলে যাবে উত্তরীয় সাম্রাজ্যে।

“কী হলো? চলুন। দেরি হয়ে যাচ্ছে তো।”

ভাবনা ছেড়ে এগিয়ে যায় সুলতান। প্রেয়সীর মন খারাপ জেনেও ভাঙায় না অভিমান। বেগম নিজেও আর তাকালো না তার দিকে। যথাসম্ভব দৃষ্টি ঘুরিয়ে অন্যদিকে চেয়ে রইল। যে তাকে চায় না তার দিকে কেন দেখবে? বিপত্তি ঘটলো ঘোড়ায় ওঠার সময়। এখানে ঘোড়ায় ওঠার কোনো ব্যবস্থা নেই। তাড়াহুড়োতে সুলতান সাধারণ ঘোড়া নিয়ে চলে এসেছে। ওঠার তো ব্যবস্থা করা নেই। সুলতান অভিজ্ঞ হওয়ায় কোনো প্রকার ব্যবস্থা ছাড়াই উঠতে পারে কিন্তু বেগম? সে গাউন পরে লাফিয়ে কীভাবে উঠবে। তাকে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সুলতান শুধায়, “কী হলো? কোনো সমস্যা?”

“উঠব কীভাবে?”

ঘোড়ার দিকে তাকালো সুলতান। ভ্রু কুচকে কিছুক্ষণ লক্ষ করতেই উপলব্ধি করতে পারলো আসল ঘটনা। আচমকা মৃদু হাসি ফুটে ওঠে তার অধরে। বেগমের আড়ালেই লুকিয়ে নেয় হাসিটা। গম্ভীর কন্ঠে বলল, “এখন আমি তো আর পাগলা প্রেমিকের মতো উরু বা পিঠ পেতে দিতে পারি না যে তুমি সেখানে পা রেখে উঠে পড়বে। এতে আমার ভীষণ অসম্মান হবে। একজন সুলতানের অপমান বুঝতে পারছো?”

“ধুর! যান তো আপনি। উঠা লাগবে না আমার। হেঁটেই চলে যেতে পারবো আমি।”

“কিছুক্ষণ আগে কী ঘটলো ভুলে গেছো? আমি তো আর আমার তলোয়ার তোমাকে দিয়ে দিতে পারি না। আমারও নিরাপত্তার একটা ব্যপার আছে।”

“লাগবে না আপনার সাহায্য।”

“অবশ্য আরেকটা ভালো বুদ্ধি আছে আমার কাছে? তুমি চাইলে সেভাবে উঠতে পারো।”

কপাল কুচকায় বেগম। নিশ্চয় কোনো বাজে বুদ্ধি। সুলতান হেসে বলল, “নীরবতাকেই সম্মতি ধরে নিলাম।”

বলতে বলতে হুট করে ঝুঁকে পড়ে বেগমের উরু জড়িয়ে ধরে শক্ত করে। ততক্ষণাৎ কাঁধে তুলে নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। আকস্মিকতায় চমকে ওঠে বেগম। চিৎকার করে বলল, “কী করছেন? নামান আমাকে। স্বামীরা ভালোবেসে বউকে কোলে নেয় আর আপনি সবসময় বেলাজ, বদমাইশের মতো আমাকে কাঁধে তুলে ফেলেন। নামান বলছি। অসভ্য, নোংরা লোক।”

“আমিও তোমাকে ভালোবাসি।”

“নষ্ট, বাজে পুরুষ।”

“বললাম তো ভালোবাসি।”

“খারাপ একটা।”

“আহ! এলি। আর কতবার বলবো আমিও তোমাকে ভালোবাসি। বারবার কেন ভালোবাসি বলছো?”

“কিহ! কী বললেন আপনি? আমি কখন ভালোবাসি বলেছি? নষ্ট বলেছি নষ্ট।”

“কিন্তু আমিতো ভালোবাসিই শুনলাম।”

দুষ্টু হেসে বিস্মিত বেগমকে তুলে দেয় ঘোড়ার পিঠে। নিজে উঠে বসে ঘোড়া ছোটায় উত্তরীয় সাম্রাজ্যের দিকে। অটবী কাঁপিয়ে ছুটছে অশ্ব।

মহলের বাগানে ক্লান্ত হয়ে বসে আছে মাহতাব। শেহজাদি তোহফাকে নিয়ে উত্তরীয় সাম্রাজ্যে যাওয়ার কথা থাকলেও এখন তা হয়ে ওঠেনি। উমারের গুপ্তচরের খবর পেয়ে হন্তদন্ত হয়ে তাকে ধরতে ছুটতে হয়েছিল। অবশেষে নূর বাজার থেকে ধরতে পেরেছে সেই গুপ্তচরকে। কারাগারে বন্ধি করে মাত্রই এখানে এসে বসেছে বিশ্রাম নেওয়ার জন্য। আবার উত্তরীয় সাম্রাজ্যে যেতে হবে শেহজাদিকে নিয়ে। হঠাৎ নজর পড়লো রজনীগন্ধার গাছগুলোর দিকে। পড়ে থাকা গাছগুলো কেউ আবার সোজা করে লাগিয়ে দিচ্ছে। বাঁচিয়ে তোলার চেষ্টা করছে বুঝি। গাছের আড়ালে থাকায় শুধু হিজাবটুকুই দৃষ্টিগোচর হচ্ছে। অবাক হলো সে। ধমকে উঠলো জোরেসোরে, “এই কে ওখানে? কোন সাহসে বাগানে ঢুকেছো? বেরিয়ে এসো। বেরিয়ে এসো বলছি।”

ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালো জারনাব। হাত ভর্তি কাঁদা নিয়ে ঝাঁঝালো স্বরে বলল, “আস্তে কথা বলতে পারো না তুমি? সবসময় চিৎকার চেঁচামেচি ছাড়া কথায় বলতে পারো না আজকাল। সৈনিক প্রধান হয়েছো বলে কি চিল্লাচিল্লি করতে হবে সবসময়?”

চমকে উঠলো মাহতাব। বোকা মেয়েটা ধমকাচ্ছে তাকে! এই দিন কীভাবে এলো তার জীবনে! অসহায় গলায় বলল, “আমার থেকে তো তুমিই জোরে কথা বলছো জুঁই?”

জীভ কাঁটে জারনাব। হুট করে রেগে গিয়ে জোরে কথা বলে ফেলেছে। ইচ্ছে করে তো বলেনি। আমতা আমতা করে বলল, “তুমিও জোরে বলেছো আমিও বলেছি। ব্যাস! শেষ। এখন চুপ করো। আমাকে কাজ করতে দাও।”

ধীর পায়ে উঠে আসে মাহতাব। ভালো করে দৃষ্টি দিলো জারনাবের দিকে। নাকে কাঁদা, কপালে কাঁদা। নিজের কী অবস্থা করেছে মেয়েটা। তবে সুন্দর লাগছে। সে মুচকি হেসে বলল, “তোমার এসব করার কী দরকার? সেবক-সেবিকা আছে তো। ওদের বললেই করে দিতো।”

“ওরা কেন করবে? গৃহে থাকতে তো জোভিয়ার পছন্দের রজনীগন্ধা গাছ আমি নিজেই লাগিয়েছিলাম। এখানেও আমি নিজেই পারবো।”

“আবার জোভিয়া!”

“কেন? তোমার কী সমস্যা?” তেতে ওঠে জারনাব।

“না না, কোনো সমস্যা নেই। তুমি করো, করো। আমিও আসব না কি সাহায্য করতে?”

“তুমি? তুমি গাছ লাগাবে আজমাইন? ছোটবেলায় আমার কতো গাছ উপরে ফেলে দিতে সব মনে আছে আমার।”

নির্বাক হয়ে চেয়ে আছে মাহতাব। এখন কি ছোটবেলায় করা ভুলের জন্য প্রিয়তমার মন জয় করা যাবে না? মহা মসিবত তো। তার প্রেমেই কেন এত বাঁধা?

চলবে……..গল্পের