#সম্রাজ্ঞী
#লিয়ানা_লিয়া
#পর্ব_36
উত্তরীয় সাম্রাজ্যের বিশাল ফটক পেরিয়ে থেমেছে অশ্ব। সুলতান নেমে বেগমকেও নামিয়ে আনে হাত ধরে। ততক্ষণাৎ হুলুস্থুলু বেঁধে যায় মহল জুরে। সেবক-সেবিকা, সৈনিক সকলে ছুটে আসে আপ্যায়নে অংশ নিতে। হুট করে এভাবে ছুটে আসাতে হকচকিয়ে যায় সুলতান। কাল বিলম্ব না করে সামলে নেয় নিজেকে। বিবাহের পর খুব দরকার ছাড়া এখানে আসা হয় না। বেগম নিজেও আসতে চায় না তেমন একটা। সুলতান ইহসান বানিজ্যিক চুক্তি করতে দক্ষিণী সাম্রাজ্যে গিয়েছেন। তাই এক প্রকার বাধ্য হয়েই এগিয়ে আসতে হয় মারজিয়া সুলতানকে। ঠোঁটের কোণে কৃত্রিম হাসি ফুটিয়ে প্রধান দ্বার ঠেলে এগিয়ে আসে। দু’হাত মেলে ধরে আল্লাদি গলায় ডাকে, “এলিজা, আমার মেয়ে।”
“আম্মাজান, অভিনয়ে বড্ড কাঁচা আপনি।”
বিদ্রুপ করলো বেগম। মায়ের ভালোবাসা চায় সে, অভিনয় নয়। সেই ছোট থেকে সে এই নারীর ভালোবাসা চেয়েছে। চাতক পাখির মতো চেয়েছে। কিন্তু তার সেই স্বপ্ন স্বপ্নই রয়ে গেছে। মায়ের ভালোবাসা পায়নি সে। উঁহু, কখনোই পায়নি। মাইরা যে ভালোবাসা পেয়েছে তার এক কোনাও পায়নি। শিশু বয়সে যখন তার ছোট্ট হৃদয় বারবার আম্মা, আম্মা করে ডেকেছে তখনও এই নারী ছল করে গেছে। নিষ্ঠুর! বড্ড নিষ্ঠুর এই নারী। দৃষ্টি ছলছল করে ওঠার আগেই সুলতান শক্ত করে চেপে ধরে তার হাতটা। বল প্রয়োগ করে সামান্য। আবারো বুঝিয়ে দেয় ‘প্রয়োজন নেই তোমার অন্য কারোর ভালোবাসার। আমি একাই যথেষ্ট তোমার জন্য’। মানলো না যেন বেগমের হৃদয়। কাতর চোখে তাকালো মায়ের দিকে। অস্বস্তিতে পড়লো মারজিয়া সুলতান। পরিস্থিতি সামলে উঠতে দ্রুত হাঁক ছাড়লো, “কে আছো? দ্রুত ফুল নিয়ে এসো। স্বাগত জানাও। কতদিন বাদে তোমাদের শেহজাদি এসেছে।”
অতঃপর ব্যস্ত হয়ে তাদের দিকে চেয়ে বলল, “তোমরা এসো। আমি ভেতরে গিয়ে দেখি তোমাদের কামরা প্রস্তুত হয়েছে কি-না। আসলে জানতাম না তো। খবর পেলে আগেই সব প্রস্তুত করে রাখতাম।”
মুখে রা নেই সুলতানের। গম্ভীর, নির্জীব তার মুখভঙ্গি। রাগান্বিতও বোধহয় খানিকটা। তবে তা প্রকাশিত হলো না। যথাসম্ভব নিজেকে শান্ত রাখলো সে। সবাইকে তাড়া দিতে দিতে দ্রুত মহলের দিকে পা বাড়ায় মারজিয়া সুলতান। মেয়ের কাতর দৃষ্টি এড়িয়ে যেতেই হয়তো সরে পড়তে চাইছে। পেছন থেকে বড় আগ্রহে ডেকে উঠলো বেগম, “আম্মা।”
“হু।” ফিরল মারজিয়া সুলতান। আগ্রহী নয়নে চাইল মেয়ের দিকে।
“ভালো আছো তুমি?”
“হামম, হ্যাঁ ভালো আছি। তুমি কেমন আছো?”
মলিন হাসলো বেগম। অধর চওড়া করে বলল, “আলহামদুলিল্লাহ।”
“জামাইকে নিয়ে ভেতরে এসো। আমি সবকিছু প্রস্তুত করার ব্যবস্থা করছি।”
বলতে বলতে দ্রুত ভেতরে চলে গেলেন। সুলতানকে কিছু জিজ্ঞেস করলেন না। সে জানে কিছু বললেও সুলতান উত্তর দেবে না। উল্টো উপেক্ষা করবে তাকে। প্রথম যখন বিবাহ হয়েছিল তখন অবশ্য সুলতান তার বড় সম্মান আর সুন্দর, স্বাভাবিক আচরণ করতো। কিন্তু তারপর যখন সে ধীরে ধীরে উপলব্ধি করলো এলিজাকে সে মায়ের আদর দেয় না। মাইরা আর এলিজাকে দুই চোখে দেখে তখন থেকেই কথা বলা কমিয়ে দেয়। কখনো দেখা হলে, সামনে পড়ে গেলেও উপেক্ষা করে। সকলের সামনে বাধ্য হয়ে যতটুকু না বললেই না ততটুকুই বলে। এখন যেহেতু সুলতান ইহসান উপস্থিত নেই তাই সেই স্বল্প বাধ্যবাধকতাও নেই। তিনি চলে যেতেই সুলতান বিরক্ত মুখে বলল, “তুমি কেন এর থেকে ভালোবাসা আশা করো এলি? কী প্রয়োজন এমন মানুষের ভালোবাসা?”
“আপনি বুঝবেন না। চলুন ভেতরে যাই। চাইলে এখান থেকেও চলে যেতে পারেন। আপনি তো আমাকে এগিয়ে দিতে এসেছিলেন। সে কাজ তো হয়েই গেছে।”
গাঢ় দৃষ্টিতে চাইল সুলতান। মলিন মুখটা হতাশ করলো তাকে। শক্ত করে হাত ধরে রেখেই বলল, “পরে যাব। এতো তাড়া কীসের? চলো ভেতরে যাই।”
“হুম।” ছোট্ট করে উত্তর দিলো বেগম।
মহলের দিকে কয়েক পা এগোতেই ইট-পাথরের গাঁথুনি দেওয়া রাজকীয় রাস্তার দুই ধারে দাঁড়িয়ে যায় সহস্রাধিক সেবক-সেবিকা। সকলের হাতে হাতে ফুলের ডালা। হাতে তুলে সেই ফুল ছুড়ে দিচ্ছে তাদের দিকে। ঝরঝর করে ফুলের বৃষ্টি হচ্ছে মাথার উপর। মহলের দ্বারে পা রাখতেই মাথা নুইয়ে সম্মান প্রদর্শন করে সকলে। আচমকা স্বল্প বয়সী একজন সেবিকা ধীর গলায় বলে বসে, “কত সুন্দর সুলতান শাহজাইন। আমার তো নজরই সরছে না।”
পাশে দাঁড়ানো অপরজন বলে, “আসলেই বড় সুদর্শন এই পুরুষ।”
দু’জনই সেবিকা হয়েছে নতুন নতুন। বয়স আর কত হবে। বড়জোর ষোলো-সতেরো। কিশোরী, আবেগপ্রবণ মেয়েরা বুঝতে সক্ষম হলো না যে তাদের ধীর স্বরে বলা কথা সকলে শুনতে পাচ্ছে। চোখ বড়বড় করে তাকায় সুলতান। কাশি উঠে যায় ততক্ষণাৎ। এতটুকু মেয়ে বলে কী! বেগমের পা থেমে যায় অচিরেই। তাদের দিকে এগিয়ে যেতেই একজন প্রবীণ সেবিকা এসে হাতজোড় করে বলল, “ক্ষমা করে দিন। ওরা বুঝতে পারেনি। নতুন এসেছে তো। বুঝতে পারে না কোথায় কী বলতে হয়। নির্বোধ তারা।”
উত্তর দিলো না। বরং তাকে পাশ কাটিয়ে মেয়েগুলোর দিকে এগোচ্ছে বেগম। একদম সম্মুখে দাঁড়িয়ে তীক্ষ্ম গলায় শুধায়, “সুন্দর, হ্যাঁ? সুদর্শন?”
থতমত খায় মেয়েরা। চোখে-মুখে ভয়। তাদের মুখভঙ্গি স্পষ্ট বলে দিচ্ছে তারা ভাবতেও পারেনি তাদের কথা কেউ শুনে ফেলবে। কতবড় বোকা! সমস্বরে আমতা আমতা করে বলে, “আআসলে, তেমন কিছু না। এমনি, এমনিই আর কী। মু মুখ ফসকে বেরিয়ে গেছে।”
“আচ্ছা? স্বীকার করছো মুখ ফসকে এই শব্দগুলোই বেরিয়েছে?”
“না না মানে।” ঘাবড়ে যায় তারা। ভয়ে ভয়ে স্বীকার করে নিয়েছে কখন বুঝতেই পারেনি। হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকে বেগমের দিকে।
“আহাম্মক কতগুলো।” বিড়বিড়ায় সুলতান।
“তোমাদের বয়স কত?” শুধাল বেগম।
“সতেরো।”
“আর যাকে সুন্দর, সুদর্শন বলে আখ্যায়িত করলে। নজরই সরছে না যার উপর থেকে তার বয়স জানো?” শান্ত ভঙ্গি বেগমের। ভ্রু কুচকে চেয়ে থাকে সুলতান। কী করতে চাচ্ছে এই মেয়ে?
“জানিনা তবে পঁচিশ-ছাব্বিশ হবে হয়তো। এর চেয়ে বেশি হবে না।”
ফট করে বলে ফেলে মেয়েগুলো। চমকাল আশেপাশে সেবিকারা। বোকা মেয়েদুটোর মাথা পুরোপুরি খারাপ হয়ে গেছে না কি? তখন থেকে ভুলভাল বলছে ম’রার জন্য! মৃদু হাসলো বেগম। অধর বাঁকিয়ে বড় আয়েশি ভঙ্গিতে বলল, “পঁচিশ-ছাব্বিশ? এই বুইড়া লোকটাকে দেখে তোমাদের কাছে পঁচিশ-ছাব্বিশের যুবক মনে হলো? খুবই বাজে নজর পছন্দ।”
উপস্থিত সকলেই এবার হাঁ করে তাকালো সুলতানের দিকে। এহেন কথাতে গলা খাকারি দিয়ে আশপাশ দেখতে থাকে সুলতান। বুইড়া! আর সে? এত দ্রুত তাকে বুইড়া বানিয়ে দিলো এলি? দু’দিন পর তো বলবে এই বুইড়া লোকের সাথে আমি থাকবো না। বুইড়া বলতে বলতে যদি বলে বসে ভালোবাসি না বুইড়া লোককে? তখন! তার আকাশ কুসুম ভাবনায় বাঁধ সাধে বেগম। অত্যধিক শীতল কন্ঠে বলল, “চৌত্রিশ, চৌত্রিশ বছর বয়স। মানে তোমাদের বয়সের দ্বিগুণ বয়স। বাবার বয়সী না হলেও প্রায় কাছাকাছি। নাও এখন চাচ্চু ডেকে ভুল সুধরে নাও।”
“চাচ্চু!”
“হ্যাঁ চাচ্চু। এত অবাক হচ্ছো কেন? ভালো মেয়েদের মতো চাচ্চু ডেকে ফেলো তো।”
“কিন্তু…….”
“ডাকো।”
সজোরে ধমকে উঠলো বেগম। আকস্মাৎ ধমকে কেঁপে ওঠে মেয়েগুলো। কাঁপা কাঁপা কন্ঠে আওড়ায়, “চচচাচ্চু।”
“ওনার দিকে তাকিয়ে ডাকো।”
“চচাচ্চু।” আবারো ডাকলো মেয়েরা। এবার দৃষ্টি সুলতানের দিকে রেখে ডেকেছে। কন্ঠে ভয়, আতঙ্ক। দৃষ্টি চঞ্চল, উত্তেজিত।
পিঠের নিম্নভাগে হাতের বন্ধন এঁটে দাঁড়িয়ে রয় সুলতান। মেয়েগুলোর খুব কাছে এগিয়ে যায় বেগম। দু’জনের মাঝে দাঁড়িয়ে মাথায় আলতো হাত বুলিয়ে বলে, “এইতো, লক্ষী মেয়েদের মতো কথা। অনেক ভদ্র তোমরা।”
ভয়ে আরো আড়ষ্ট হয়ে দাঁড়ায় মেয়েরা। অধর প্রসারিত করে জোরপূর্বক হাসে বেগম। সকলের আড়ালে তাদের কানের খুব কাছে হীম ধরানো কন্ঠে ফিসফিসিয়ে বলে, “নজর, আর জবান দুটোই নিয়ন্ত্রণ করতে শেখো। নয়তো বলার জন্য জবান থাকবে কিন্তু দেখার জন্য এই চোখদুটো আর থাকবে না।”
থরথর করে কাঁপে মেয়েরা। হুমকি! ঠান্ডা মাথার হুমকি বোধহয় একেই বলে। সুলতানের হাত ধরে হনহনিয়ে মহলে ঢুকে পড়ে বেগম। এদিক-ওদিক তাকাতে এগিয়ে আসে মারজিয়া সুলতান। সাথে দু’জন সেবিকা। হাতে থালাভর্তি মিষ্টি। হাসিমুখে শুধায়, “মিষ্টি খেয়ে প্রবেশ করবে না?”
“এত নিয়ম কানুনের কোনো প্রয়োজন নেই। এলি অসুস্থ। খাবার দাবারে সমস্যা হয়েছে। মিষ্টি খাওয়া যাবে না আর আমি খাব না। এগুলো সরিয়ে নিলে ভালো হয়।” রাশভারি কন্ঠে বলল সুলতান।
ইতস্তত করে মারজিয়া সুলতান। বেগম বলে ওঠে, “না আমি খাব। দাও।”
সুলতান রাগি দৃষ্টিতে তাকালেও স্বস্তি পায় মারজিয়া সুলতান। কেউ না খেলে অপমানিত হতো সে। মিষ্টি খাইয়ে দেয় নিজ হাতে। তৃপ্তির দেখা মেলে বেগমের মুখভঙ্গিতে। থালা থেকে পানির পাত্র উঠিয়ে পানি পান করে মায়াভরা দৃষ্টি নিক্ষেপ করে মায়ের দিকে। শুধায়, “খেয়েছো?”
“হ্যাঁ।”
“আব্বাজান কবে আসবে?”
“কাল পরশু চলে আসবে। তোমরা কামরায় গিয়ে বিশ্রাম করো। আমি সেবিকাদের বলছি খাবারের ব্যবস্থা করতে।”
বলার মতো আর কোনো কথা খুঁজে পায় না বেগম। কামরায় প্রবেশ করতে নিয়ে আবার দাঁড়িয়ে পড়ে। দ্রুত পেছনে ফিরে ব্যস্ত হয়ে শুধাল, “মাইরা কোথায়? ওকে তো দেখছি না?”
আবারো ঘুরে তাকালো মারজিয়া সুলতান। উপলব্ধি করতে পারছে না মেয়েটা কি ইচ্ছে করেই কথা বলতে চাইছে তার সাথে? গলা ঝেড়ে বলল, “জানি না কোথায় গেছে। চেনোই তো। রাগ করে হুটহাট কোথায় চলে যায়। অবশ্য পত্র পাঠিয়েছে খোঁজাখুঁজি না করতে। রাগ মিটলে চলে আসবে।”
“ওহ।”
মারজিয়া সুলতান চলে গেলে দীর্ঘশ্বাস ফেলে কামরায় ঢুকে পড়ে বেগম। তার কামরা এটা। সুবিশাল কামরার দক্ষিণে বিশাল জানালা। পর্দা টাঙানো রয়েছে। একপাশের দেয়ালের অনেকটা জুড়ে দর্পণ। রাজকীয় পালঙ্ক, আরামদায়ক কেদারাসহ বিভিন্ন আসবাবপত্রে ভরপুর। পালঙ্কের পাশে কৃত্রিম ফুলের রাজকীয় কারুকার্য খচিত ফুলদানি। মাথার উপরে দেয়ালে লাগানো নান্দনিক বাতি। সুলতানকে বসতে বলে বেরিয়ে যেতে ধরে বেগম। হাত টেনে আটকায় সুলতান। শুধায়, “এলি, মন খারাপ?”
“না।”
সুলতানের দিকে ফিরলো না বেগম। যথাসম্ভব এড়িয়ে হাত ছাড়াতে নিলে ধমকে ওঠে সুলতান, “এভাবে মোচড়াচ্ছ কেন? কী সমস্যা?”
“ছাড়ুন।”
“কেন? আমি ছুঁলে ফোস্কা পড়ছে?”
“হ্যাঁ পড়ছে। পৌঁছে দিতে এসেছিলেন। দেওয়া শেষ। চলে যান এখন।”
“চলে যাব?”
“হ্যাঁ, চলে যান। এখনি চলে যান। দরদ দেখাতে হবে না আর।”
গটগট পায়ে দ্বারের দিকে এগিয়ে যায় সুলতান। ডেকে ওঠে বেগম, “তোহফা কখন আসবে?”
পেছনে ফেরে না সুলতান। সম্মুখে চেয়ে কঠিন গলায় বলল, “আসবে সন্ধ্যার আগেই। মাহতাব নিয়ে আসবে। আর কিছু?”
“না, যান।”
বেরিয়ে যায় সুলতান। ছলছল দৃষ্টিতে চেয়ে পালঙ্কে বসে পড়লো বেগম। খামচে ধরলো চাদর। মন মেজাজ বেজায় খারাপ। তখনই দ্বার আটকানোর শব্দে চকিতে ফিরলো। সুলতান! সুলতান আবার ফিরে এসেছে! ছলছল চোখ আড়াল করার সুযোগ হয় না। রাগান্বিত দৃষ্টিতে চাইল সুলতান। অসন্তুষ্ট চিত্তে দু’হাত বাড়িয়ে বলল, “কাছে এসো।”
“আপনি! আপনি আবার কেন এসেছেন?”
“আমার বেগমের ছলছল দৃষ্টি আমার সহ্য হয় না তাই। এখন কাছে আসো তো। অযথা কাঁদছ। বেকুব একটা।”
দৃষ্টি ঘুরিয়ে অন্যদিকে চেয়ে চুপচাপ বসে আছে বেগম। তেতে উঠলো সুলতান। মেয়েটা বড্ড বেশিই জেদি হয়ে উঠেছে আজকাল। বড়বড় পা ফেলে বেগমের কাছে গিয়ে তার হাত ধরতেই এক ঝটকায় ছাড়িয়ে নিলো বেগম। লাল চোখে ঝাঁঝালো গলায় বলে ওঠে, “ছোবেন না আমাকে। সাম্রাজ্য থেকে তাড়িয়ে এখানে ফেলে রেখে যাচ্ছেন আবার দরদ দেখাচ্ছেন কেন? একদম ছোবেন না আমাকে।”
“তুমি এত খিটখিট করছো কেন এলি? কিছু হয়েছে? আমাকে বলো?”
“আপনি সরুন তো। ভালো লাগছে না আমার।”
বুকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয় সুলতানকে। দু’পা পিছিয়ে রাগান্বিত দৃষ্টিতে ফিরে তাকালো সুলতান। কী হয়েছে বলবেও না আবার সে ছুঁলেও ফোস্কা পড়ে যাচ্ছে! মস্করা পেয়েছে না কি? নাকি তাকে আর ভালো লাগছে না এখন? গম্ভীর কন্ঠে শুধাল, “কী ভালো লাগছে না? আমাকে?”
“হ্যাঁ।”
“ভালোবাসো না আমাকে তুমি?” আকস্মাৎ চিৎকার করে ওঠে সুলতান। তাকে ভালো লাগছে না মানেটা কী?
হুট করে চিৎকার শুনে চমকে ওঠে বেগম। দ্রুতই নিজেকে সংবরণ করে দাঁত কিড়মিড় করে ওঠে। চিৎকার করার মতো কী বলেছে সে? জেদি গলায় বলল, “না বাসিনা। ভালোবাসি না আমি। রাত দিন সর্বক্ষণ শুধু ভাবতে থাকেন এলি আমাকে ভালোবাসে না? আবার পরমুহূর্তেই ভাবেন, না বাসে, ভালোবাসে। আশ্চর্য! ভালো না বাসলে তোহফা কি নদীতে ভেসে ভেসে এসেছিলো? নাকি আকাশ থেকে টুপ করে পড়েছিল? শুধু উল্টো পাল্টা ভাবনা। বাসব না ভালো। শুনেছেন আপনি?”
“ভালোবাসবে না?”
“না।”
“ছোবো না?”
“না।”
রাগে গর্জে ওঠে সুলতানের হৃদয় মহল। সে প্রকাশ করে না সেই কঠিন গর্জন। হিং’স্র হয় আঁখিজোড়া। অধর বিকৃত হয়। চোয়াল কেঁপে ওঠে রাগে। আনমনে শক্ত করে চেপে ধরে তলোয়ার। কোমরের বন্ধন ছেড়ে বের করে আনে একটানে। অবাক হয়ে চেয়ে থাকে বেগম। আচমকা তেড়ে আসে সুলতান। কাছাকাছি এসে তলোয়ার চেপে ধরে বেগমের বুকের উপর বরাবর। সামান্য চাপ দিলেই যেন গেঁথে যাবে হৃদয় চিরে। তলোয়ারের তীক্ষ্মতা টের পাচ্ছে বেগম। সুলতান অতিরিক্ত রাগ চেপে ফ্যাসফ্যাসে কন্ঠে বলল, “ভালোবাসবে না? কাছে আসতে দেবে না?”
অবাক হয় না বেগম। অভ্যস্ত সে। নীরব থাকে কিছুক্ষণ। হুট করে বাঁকা হেসে একটানে তলোয়ার নিজের আয়ত্তে আনে। দক্ষ হাতে তলোয়ারের দিক পরিবর্তন করে নিমেষেই চেপে ধরে সুলতানের গলায়। বল প্রয়োগে চামড়া ছিড়ে যাবার জোগাড়। গলায় ধারালো তলোয়ারের অস্তিত্ব পেয়েও তাল হারালো না সুলতান। বিচলিত করে না তাকে। বরং গাঢ় দৃষ্টিতে একধ্যানে চেয়ে থাকে বেগমের দিকে। কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে আচমকা পেছনের দিকে সামান্য হেলে ঝুঁকে এসে কামড়ে ধরে তলোয়ার। বেগমের হাত থেকে কেড়ে নিয়ে ঠোঁটের ফাঁকে দাঁত দিয়ে চেপে ধরে আছে। দৃষ্টির হিং’স্রতা হারিয়ে গেছে পলকেই। সম্মোহনী দৃষ্টিতে বেগমের দিকে চাইতেই আৎকে ওঠে সে। ব্যতিব্যস্ত হয়ে বলল, “আরেহ! কী করছেন? ছাড়ুন ওটা। ফেলে দিন। গাল কেঁটে যাবে। দেখি আমি ধরছি। হাঁ করুন।”
বেগম তলোয়ারের হাতল ধরে চোখের পলক ফেলে ইশারা করে ছেড়ে দিতে। সম্মোহিত হলো যেন সুলতান। মুখ হাঁ করে সুযোগ করে দেয় তলোয়ার সরিয়ে নেওয়ার। সঙ্গে সঙ্গেই তলোয়ার সরিয়ে নিয়ে চোখ রাঙিয়ে তাকালো বেগম। ঝাঁঝালো স্বরে কিছু বলতে নেবে অমনি আষ্টেপিষ্টে জড়িয়ে ধরলো সুলতান। টেনে হিচড়ে হিজাব খুলে ছুড়ে মারে মেঝেতে। একহাতে চোয়াল চেপে ধরে খসখসে অধর ছোঁয়ায় গলার উপরিভাগে। সময় যায় অথচ অধর সরিয়ে নেয় না। শক্ত করে চেপে ধরে রইল অনেকটা সময়। শিহরিত বেগম হাত থেকে ফেলে দেয় তলোয়ার। গরম শ্বাসের উষ্ণতায় ছলকে উঠছে শিরা উপশিরা। মুঠো করে ধরে সুলতানের পাগড়ি। পাগড়ি খুলে চুল এলোমেলো হলো। কোনো রকম শক্তি জুগিয়ে চুলগুলো মুঠোয় চেপে টেনে সরিয়ে দেয় সুলতানের মাথা। ধপ করে পালঙ্কে বসে বড়বড় শ্বাস ফেলে রাগান্বিত স্বরে বলল, “খারাপ, নষ্ট লোক। সুযোগ খোঁজেন সবসময়।”
পালঙ্কে তার শরীর ঘেষে বসে সুলতান। বেগমের দিকে এক পলক চেয়ে হেসে ওঠে শব্দ করে। হাসতে হাসতে আধ শোয়া হয়। রাগে ফোঁস করে শ্বাস ফেলে বেগম। ততক্ষণাৎ সুলতান উঠে পালঙ্কের পাশে রাখা পানির পাত্র এগিয়ে ধরে সম্মুখে। একহাতে কানের ওপাশে চুল গুঁজে দিয়ে বলে ওঠে, “পানি খাও।”
বাক্য ব্যায় করলো না বেগম। গলা শুকিয়ে গেছে। দ্রুত পানি নিয়ে পান করলো। তার পানি খাওয়ার মাঝেই সুলতান তীক্ষ্ম গলায় আবেগ ঢেলে বলে উঠল, “এমন সুন্দরী, তেজি বেগম থাকলে মন কেন জানও দিতে আপত্তি নেই।”
বেগমের গলায় পানি আটকে যায় নিমেষেই। কাশতে কাশতেই পাত্রের পুরো পানি ছুড়ে দেয় সুলতানের মুখে।
হন্তদন্ত হয়ে পালঙ্ক থেকে নেমে দাঁড়ালো সুলতান। বাঁকা হেসে পানি ভর্তি মুখ নিয়ে এগিয়ে আসে বেগমের দিকে। ধরার আগেই ছুটে পালঙ্কের ওপারে চলে যায় বেগম। একটানে পালঙ্কের চাদর টেনে তুলে সজোরে ছুড়ে ফেলে সুলতানের মুখে। চুপচাপ চাদরে মুখ মুছে শান্ত হয়ে বসলো সুলতান। কোনো কথাবার্তা ছাড়াই বেগমকে টেনে নিজের কাছে বসিয়ে নেয়। বেগমের মুখের পাশের চুলগুলো আঙ্গুলে পেঁচিয়ে বোধহয় জাদুকরী কন্ঠে জাহির করলো, “তোমাকে আমার চাই সুন্দরী। আমার হিং’স্রতার জলন্ত আগুনে শীতল বর্ষণ রূপে তোমাকে চাই।”
চলবে………