#সম্রাজ্ঞী
#লিয়ানা_লিয়া
#পর্ব_43
“আপনাকে আমার ভাইয়ের স্ত্রী হিসেবে শ্রদ্ধা করবো নাকি তার হত্যাকারী হিসেবে ঘৃণা করবো সম্রাজ্ঞী এলিজা সুলতান?”
সকাল সকাল শেহজাদি তানহার উচ্চারিত কটূক্তি ভরা বাক্যে বেগম বিচলিত হলো কিনা বোঝা গেল না। সে তার কক্ষের বিশাল দর্পণের সামনে বসে যত্ন সহকারে নিজের সাজসজ্জা করে যাচ্ছিল। হঠাৎ দ্বারে কড়া দেওয়া ব্যতীত কাউকে প্রবেশ করতে দেখে চরম ক্ষিপ্ত হলেও তানহাকে দেখে রাগটা দমন করেছিল। তবে তানহার এহেন তিক্ত কথাই সে আশা করেছিল। যেদিন থেকে সে সুলতানকে ছাড়া সাম্রাজ্যে ফিরেছে সেদিন থেকেই সকলের তিক্ত কথা হজম করতে করতে এক প্রকার গা সয়ে গেছে। তানহার মতো এই মহলের অনেকেই হয়তো ভাবে সুলতানকে সে হত্যা করেছে ক্ষমতার লোভে। অথচ তারা জানে না এমন হাজার হাজার সাম্রাজ্য সে পায়ে মাড়িয়ে যেতে পারে তার সুলতানের জন্য। আফসোস! মানুষটা আজ তার সাথে নেই! তানহার দিকে মনোযোগ না দিয়ে পুনরায় নিজের হিজাব ঠিক করতে লাগলো সে। রাগান্বিত তানহা পূর্বের চেয়ে উত্তেজিত স্বরে বলে উঠলো,
“আমার ভাইকে হত্যা করে তার ক্ষমতা পেয়ে বেশ আনন্দেই আছো দেখছি। বিন্দুমাত্র লজ্জা নেই তোমার? তোমার স্বামী মারা গেছে মাত্র কয়েক মাস আর তুমি এভাবে নির্লজ্জের মতো সাজসজ্জায় ব্যস্ত থাকো?”
“আমি সাজসজ্জায় ব্যস্ত থাকলে এই বিশাল সাম্রাজ্য কি তুমি পরিচালনা করো তানহা?”
দর্পণের দিকে চেয়েই বলল বেগম। রাগে শরীর রি রি করে উঠলো তানহার। সারাজীবন যেকোনো পরিস্থিতিতে নির্বিকার থাকা তানহা আজ চিৎকার করে উঠলো, “এই সাম্রাজ্য, এই ক্ষমতার লোভেই তো নিজের স্বামীকে হত্যা করেছো তুমি। এখন পেটে থাকা সন্তানকে কাজে লাগিয়ে আমার আম্মাকেও বশ করে নিয়েছো।”
রাগে কামরার সৌন্দর্য বাড়াতে সাজিয়ে রাখা রূপার তৈরি ফুলদনিটা সজোরে আছড়ে ফেলল সে। শব্দ তুলে বেঁকে গেল ফুলদানিটা। ছোট থেকে আম্মার অবহেলা সহ্য করেছে সে তবে কোনোদিন মুখ ফুটে একবার প্রতিবাদ করেনি। তার ভাই তাকে এত ভালোবাসা দিয়েছে যে আম্মার অবহেলা তার নিকট ঠুনকো লেগেছে। আর সেই ভাইকে কিনা হত্যা করলো তারই প্রিয়তমা স্ত্রী। এ যে সহ্য সীমার বাইরে। আজও যদি সে নিরব থাকে তবে তার ভাইয়ের সেই ভালোবাসার মূল্য কবে চোকাবে? বেগম একবার নরম দৃষ্টিতে মেঝেতে গড়াগড়ি করা ফুলদানির দিকে চাইল। পুনরায় তানহার দিকে চেয়ে শান্ত কন্ঠে বলল,
“তোমার ভাইয়ের স্ত্রী আমি। তোমার গুরুজন। আমার সামনে তোমার এরকম দূর্ব্যবহার শোভা পায় না।”
সশব্দে কেঁদে উঠলো তানহা, “কেন আমার ভাইয়ের জীবনে এলে তুমি? কেন? না তো তুমি আমার ভাইয়ের জীবনে আসতে আর নাতো আমার ভাইকে এতো দ্রুত …………।”
“তোমার অভিযোগ শেষ হলে তুমি যেতে পারো তানহা। আমার এখনো তৈরি হওয়া বাকি।” স্বাভাবিক ভঙ্গিতে কথাখানা বলতে বলতে উঠে দাঁড়ালো বেগম।
“খুনি তুমি, খুনি। আমার ভাইয়ের খুনি। কোনোদিন তোমাকে ক্ষমা করবো না আমি। এই সন্তান যতদিন তোমার গর্ভে আছে ততদিনই তুমি নিরাপদে সুখ করে নাও। আমার ভাইয়ের অংশ যেদিন তোমার পেটের মায়া ত্যাগ করবে সেদিনই তোমাকে হত্যা করবো আমি। তুমি ভুলে গেছো আমিও একজন শেহজাদি। অস্ত্রবিদ্যা আমিও জানি। তাছাড়া তুমি কি ভেবেছো আমার আম্মা তোমাকে ক্ষমতা দিচ্ছে, স্বাধীনতা দিচ্ছে, সেচ্ছাচারিতা করার অধিকার দিচ্ছে বলে সে তোমাকে ছেড়ে দেবে? উঁহু, কখনোই না। বরং তোমাকে সুযোগ দিচ্ছে তোমার গর্ভে থাকা আমার ভাইয়ের সন্তানের জন্য। একজন উত্তরাধিকারের জন্য। যতক্ষণ উড়তে পারো উড়ে নাও।”
ভ্রুক্ষেপ করলো না বেগম। এ সম্পর্কে সে পূর্ব থেকেই অবগত। ভালোই জানে সকলের মনোভাব। কেন এখনো তার উপর কোনো আঁচড় পড়েনি। তাচ্ছিল্য হেসে মেঝে থেকে ফুলদানিটা তুলে সাজিয়ে রাখতে রাখতে হঠাৎই হাঁক ছাড়লো, “তোহফা, আম্মুজান এদিকে এসো তো। দেখো কে এসেছে।”
মূহূর্তের মাঝেই দ্বারের পর্দা সরিয়ে ছোট ছোট পায়ে দৌড়ে এলো তোহফা। এসেই তানহার দিকে চেয়ে মিষ্টি একটা হাসি ছুড়ে দিলো। বেগম পুনরায় বললেন,
“ফুফিজান তোমাকে খুঁজছিল? কোথায় ছিলে তুমি?”
থতমত খেয়ে যায় তানহা। দ্রুত নিজের রাগ-জেদ নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা চালালো। নিজেকে স্বাভাবিক করে ফিরে তাকালো। তার দিকেই এগিয়ে আসছে তোহফা। হাত ধরে ঝাঁকিয়ে নিষ্পাপ কন্ঠে শুধাল,
“খুঁজছিলে?”
“হুম… না মানে হ্যাঁ, খুঁজছিলাম তো।”
তানহা কটমট করে তাকালো বেগমের দিকে। সে জানে বেগম ইচ্ছা করেই এটা করেছে। এই মহিলার রক্তে মিশে গেছে চালাকি। সেদিকে ধ্যান নেই বেগমের। তোহফা আবারো বলল, “তাহলে কোলে নাও আমাকে?”
ঝুঁকে পড়ে পরম যত্নে কোলে তুলে নিলো তানহা। এটাই যে একমাত্র কারন তার ভালো থাকার। আদর করে চুম্বন করলো তোহফার দুই গালে। বেগম ক্রুর হেসে বলে উঠলো, “ফুফিজানকে একটু আদর দিয়ে দাও তো আম্মু। আদর করে রাগ কমিয়ে দাও।”
মুখ তুলে তাকালো তোহফা। আধো আধো স্বরে আওড়ালো, “রাগ করেছো তুমি? কেন রাগ করেছো? তোমার খেজুর কেড়ে নিয়েছে কেউ? ভয় পেয়ো না, আমাকে বলো। দেখো আমি কীভাবে তাকে শাস্তি দিয়ে দেই।”
রাগ ভুলে বিষম খেলো শেহজাদি তানহা। তার ছোট্ট শেহজাদি যে এতো কথা বলা শিখবে তার ধারনাও ছিলো না। এতো এতো দুঃখের মাঝে এই উপহারটা বড় প্রশান্তি দেয় তার ভেঙে যাওয়া হৃদয়টাকে। তখনই বাইরে থেকে মাহতাব আর জারনাবের জোরালো কন্ঠ ভেসে আসতে লাগলো। বেগমের দিকে একবার রাগান্বিত দৃষ্টি নিক্ষেপ করেই তোহফাকে নিয়ে বেরিয়ে গেল শেহজাদি তানহা। পুনরায় দর্পণের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে বেগম। আজকার নিজের ভাগ্যের উপর বড্ড মায়া হয় তার। স্বামীর ভালোবাসায় উন্মাদ বেগমই কিনা সেই স্বামীর খুনি হলো শেষে ? হাহ! কপাল! পেটে আলতো করে হাতটা রেখে দর্পণের মাঝে তাকালো একরাশ মায়া নিয়ে। সে অনুভব করতে পারছে তার ভেতরে বেড়ে ওঠা নিষ্পাপ অস্তিত্বকে। অশ্রু এসে জমলো নোত্রযুগলে। জড়িয়ে আসা কন্ঠে বিড়বিড়িয়ে বলল,
“স্বার্থপর, স্বার্থপর এই সাম্রাজ্য। উত্তরাধিকার চায় তাদের। যেকোনো মূল্যে উত্তরাধিকার চায়। সকলের একটাই আশা- ‘পুত্র সন্তান’ যে হবে এই সাম্রাজ্যের পরবর্তী সুলতান। জানি এই বাচ্চার জন্যই এখনো জীবিত আছি আমি। বাচ্চা ভূমিষ্ঠ হতেই প্রয়োজন ফুরিয়ে যাবে আমার। নিকৃষ্ট রূপ প্রকাশিত হবে সকলের। আমার সেই দুর্দিন বড়ই নিকটে অবস্থান করছে। শীঘ্রই এই রাজ পরিবারের মানুষগুলোর ভয়াবহ নিষ্ঠুরতার শিকার হতে হবে আমাকে। আমার তোহফা কি থাকতে পারবে আমাকে ছাড়া?”
ততক্ষণে বাইরের চিৎকার চেঁচামেচি দিগুন বেড়ে গেছে। প্রবল আকার ধারণ করেছে জারনাবের উচ্চকন্ঠ। একইসাথে সমানে মাহতাবের কন্ঠও আসছে। ধীরে ধীরে শেহজাদি তানহা, মামা হাদিদ, সুলতান শাহজিল, রাঁধুনি হাফসা, ফাইজাসহ সকলের কন্ঠই শ্রবণগোচর হচ্ছে। কী হচ্ছে বাইরে উপলব্ধি করতে পারলো না সে। দ্রুত অশ্রু মুছে কোমরের বন্ধনীতে তলোয়ার গুঁজে কামরা ছেড়ে বেরিয়ে এলো। মহলের বিশাল বিশাল প্রস্তুত স্থানগুলো বড়বড় পা ফেলে পার করে এসে রন্ধনশালার থেকে কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে পড়লো। রন্ধনশালার সম্মুখে বিশাল জটলা। চিৎকার চেঁচামেচি প্রকট আকার ধারণ করেছে। সৈনিক, সেবক-সেবিকাদের ভিড় লেগে গেছে প্রায়। অবাক হতে বাধ্য হলো বেগম। হনহন করে এগিয়ে গেল জটলার দিকে। তাকে দেখে একে একে সমস্ত সৈনিক, সেবক-সেবিকা সরে দাঁড়িয়ে স্থান ফাঁকা করে দিলো। রন্ধনশালার দ্বারের উপর পুরাতন রাঁধুনি হাফসার হাত শক্ত করে চেপে ধরে আছে জারনাব। চোখে তার অগ্নিশিখা। রাগে থরথর করে কাঁপছে। পারলে যেন হাফসাকে চোখ দিয়েই ঝলসে দিতো। তাকেই শান্ত করার চেষ্টা করছে মাহতাব। জোড়ালো কন্ঠে বারংবার ছেড়ে দিতে বলছে হাফসাকে। পাশেই ভীত মুখে দাঁড়িয়ে আছে ফাইজা। ভয়ে চোখমুখ শুকিয়ে গেছে তার। বাকিরাও সমানে জারনাবকে হুঁশিয়ারি দিয়ে যাচ্ছে হাফসাকে ছেড়ে দিতে কিন্তু জারনাব শুনলে তো। সে তার কর্মে অটল। বেগমকে আসতে দেখে রাগান্বিত দৃষ্টিতে চাইল সুলতানের মামা হাদিদ। সে রাগে কিছু বলার পূর্বেই সুলতান শাহজিল গম্ভীর স্বরে বলে উঠলো,
“এসব কী শুরু করেছো? তোমরা দুই বোন মহলটাকে একেবারে জংলি পাড়া বানিয়ে ছেড়েছো। তোমার বোনকে বলো এখনি হাফসাকে ছেড়ে দিতে। সে এই মহলের বহু পুরাতন রাঁধুনি। এভাবে অকারনে তার উপর হাত উঠানোর অধিকার নেই কারোর। এসব অন্যায় অনাচার সহ্য করবো না আমি। সাবধান করে দিচ্ছি তোমায়।”
বেগম অবাক হতে বাধ্য হলো বড় বোনের এই রূপ দেখে। সহজ-সরল, নম্র জারনাবের এমন কঠিন আচরণের সঙ্গে তার আলাপ নেই। দ্রুত কন্ঠে বলে উঠলো,
“কী হচ্ছে এসব বুবু? ছেড়ে দাও ওনাকে।”
বেগমের কন্ঠে হাফসার মুখভঙ্গি আরো ভীত হলেও জারনাব তাকে ছাড়লো না। বরং টেনে হিঁচড়ে নিয়ে এলো বেগমের সামনে। রাগান্বিত স্বরে বলল, “ওর আসল রূপ তুমি জানো না জোভিয়া। জানো না ও কী করেছে।”
“কী করেছে হাফসা?” হতবাক স্বরে শুধায় বেগম।
“প্রতারক, মহা প্রতারক – বেইমান এই রাঁধুনি। সকলের আড়ালে শত্রুর গুপ্তচর হয়ে বসবাস করছে এই মহলে।”
“প্রতারক! তোমার কোথাও ভুল হচ্ছে বুবু। হাফসা আমাদের অনেক পুরাতন রাঁধুনি।”
বেগম শান্ত হয়ে বিষয়টার সমাধান করতে চাইল। অথচ জারনাবের কথাতে যেন মুহুর্তেই বিস্ফোরন হলো মহল জুরে, “ওষুধের ভেতর অল্প অল্প করে বিষ মিশিয়ে ধীরে ধীরে তোহফাকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়া সেই বিশ্বাসঘাতক আর কেউ নয়। এই হাফসাই রাঁধুনির বেশে গুপ্তশত্রুর হুকুমে এসব করেছে। সেই বিষের প্রভাবেই তোহফার জবান বন্ধ ছিলো এতদিন। এই নোংরা কাজের জন্য মোটা অংকের অর্থ পেতো এই প্রতারক।”
কিছুক্ষণ পূর্বে ফাইজাকে ডাকার উদ্দেশ্যে আচমকাই রন্ধনশালায় প্রবেশ করে ফেলে জারনাব। সেসময় হাফসা একাই ছিলো সেখানে। পত্র লিখছিলো মনোযোগ দিয়ে। আচমকা জারনাবকে দেখতেই হন্তদন্ত হয়ে পত্রখানা লুকিয়ে ফেলে নিজের পেছনে। সন্দেহ হওয়ায় জারনাব যখন পত্রটা দেখাতে বলে তখনই আমতা আমতা করতে শুরু করে হাফসা। এর মাঝেই অন্যান্য রাঁধুনিরা ফিরে আসে রন্ধনশালায়। ফাইজার সাহায্যে হাফসার সাথে একপ্রকার জোরজবরদস্তি করেই পত্রখানা কেড়ে নেয় জারনাব। পত্রের লেখাগুলো পড়তেই যা বোঝার বুঝে নেয়। অজানা সেই শত্রুর উদ্দেশ্যেই পত্রটা লেখা হয়েছিল। জারনাবের মুখে সমস্ত বিবরণ শুনে অবিশ্বাসের আর কোনো অবকাশ থাকে না বেগমের নিকট। তবুও হাত বাড়িয়ে পত্রখানা তার দিকে এগিয়ে দিলো জারনাব। যেখানে স্পষ্ট ভাষায় লেখা রয়েছে,
“আপনি আমার প্রতি অবিচার করছেন মালিক। আমার কাজের বিনিময়ে নির্ধারিত অর্থ আমি পাচ্ছি না। আপনার কথাতে আমি কি না করেছি। প্রতারণা করেছি রাজ পরিবারের সাথে। শেহজাদি তোহফার ওষুধে বিষ মিশিয়েছি নিজ হাতে। অর্থের জন্য নিকৃষ্ট থেকে নিকৃষ্ট কাজ করতেও দ্বিধা করিনি। সেই অর্থই আপনি আমাকে দিচ্ছেন না? এভাবেই চলতে থাকলে আপনার পরিচয় রাজ পরিবারের সকলের নিকট প্রকাশ করে দিতে বাধ্য হব আমি। আপনি অতি বুদ্ধিমান। আমার ইঙ্গিত বুঝতে পেরেছেন নিশ্চয়? আশা করছি পত্র হাতে পাওয়া মাত্রই অর্থ পেয়ে যাবো আমি। নাহলে……………”
উপস্থিত সকলের স্তব্ধ চাহনি হাফসার উপর থেকে সরে গিয়ে সেই পত্রের উপর ঠেকল। পত্র পড়ে রাগে-দুঃখে নিজের গাউন খামচে ধরলো বেগম। এপর্যন্ত যাকেই সে বিশ্বাস করেছে সেই তার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। প্রথমে মাইরা, এখন আবার হাফসা! তার এত ছোট বাচ্চাটাকেও মা’রতে চেয়েছিলো? তাও শুধুমাত্র অর্থের লোভে! এত লোভ! আর যেন সহ্য করতেই পারছে না বেগম। সুলতান শাহজিল ঘৃণিত কন্ঠে বলে উঠলো,
“ছি ছি! হাফসা।”
অন্যরা সকলে বেগমের সিদ্ধান্তের দিকে চেয়ে থাকলেও আগুনের শিখার ন্যায় ফুঁসলে উঠলো তানহা। তোহফাকে তার ব্যক্তিগত সহকারী আনাবিয়ার কোলে দিয়ে কোমরের তলোয়ার খুলতে খুলতে তেড়ে গেল হাফসার দিকে। জারনাব এমনিতেই রেগে ছিলো। এমত অবস্থায় সে হাফসাকে ধাক্কা দিয়ে এগিয়ে দেয় তানহার তলোয়ারের সম্মুখে। কন্যার আক্রমণাত্মক আচরণে অবাক হলো সুলতান শাহজিল। শাহজাইনের মৃত্যুর পর থেকেই এসব বিপরীতমুখী অবস্থা দেখে আসছে সে। তানহার শান্ত রূপ বদলে গেছে, এলিজা সকলের সাথে কঠিন আচরন করতে শুরু করেছে, জারনাবও আজ সীমা অতিক্রম করে ফেলেছে। তানহাকে তেড়ে আসতে দেখে ঘাবড়ে গেল হাফসা। এক ছুটে বেগমের পায়ে গিয়ে পড়লো। দু’হাতে পা জড়িয়ে ভিক্ষা চাইল নিজের প্রাণ,
“আমাকে ক্ষমা করুন সুলতানা। অর্থের লোভে অন্ধ হয়ে গিয়েছিলাম আমি। আমি কথা দিচ্ছি জীবনের বাকিটা সময় পুরোটাই আপনার চরণতলে কাটাবো আমি। দয়া করে আমায় প্রাণে মারবেন না।”
চেঁচিয়ে উঠলো তানহা,
“প্রাণ ভিক্ষা চাইছিস? শেহজাদিকে বিষ খাইয়ে এখন প্রাণ ভিক্ষা চাইছিস তুই? নির্লজ্জ, লোভী, জালিম- কত বিশ্বাস করেছিলাম তোকে যে আমার ভাইয়ের কলিজার টুকরোর ওষুধের দায়িত্ব দিয়েছিলাম তোর উপর। আর তুই সেই কলিজায় বিষের মিশ্রণ ঢেলে দিলি! আজ তোকে হত্যা করেই নিজের হাত রক্তে রঞ্জিত করবো আমি।”
বেগমের পায়ে পড়ে থাকা হাফসা আরোও গুটিয়ে গেল বেগমের কাছে। সুচতুর হাফসা জানে প্রাণ ভিক্ষা পেলে সে এখানেই পাবে। যতই কঠিন হোক বেগমের আচরন, তবুও তার প্রতি মায়া-দয়া এই একজনের শরীরেই আছে। বেগমের কোমল হৃদয়ের ফায়দা উঠিয়ে প্রাণ বাঁচানোই তার লক্ষ্য। তানহা ছুটে এসে আঘাত করতে গেলে মাহতাব বাঁধা প্রদান করে। নিজের তলোয়ার দিয়ে কৌশলে তানহার তলোয়ার হাত থেকে ছুড়ে ফেলে। তলোয়ারের সাথে তলোয়ারের সংঘর্ষে পরিবেশ অশান্ত হয়ে ওঠে। তলোয়ার মেঝেতে পড়তেই রাগান্বিত দৃষ্টিতে ঘুরে তাকালো তানহা। মাহতাবকে দেখে হতবাক স্বরে শুধায়, “সৈনিক প্রধান?”
মস্তক নুইয়ে নিলো মাহতাব। বিনয়ী কন্ঠে বলল, “ক্ষমা করবেন শেহজাদি। অপরাধীকে শাস্তি দেওয়ার অধিকার একমাত্র বেগমের।”
মাহতাবের আচরণে তানহার ভাঙা হৃদয় আর অবচেতন মন দুটোই ব্যথিত হলো। ফিরে তাকালো জারনাবের প্রতিক্রিয়া দেখতে। তবে তার দৃষ্টির কোথাও সৈনিক প্রধানের অস্তিত্ব নেই, কোথাও না। রাগান্বিত কন্ঠ ভেসে এলো জারনাবের,
“কী করছো আজমাইন? বাঁধা দিচ্ছ কেন? তুমি কি শুনতে পাচ্ছ না কী করেছে এই রাঁধুনি। মরে যেতে দাও ওকে।”
“শান্ত হও জুঁই। সবকিছুর সমাধান রাগ আর আক্রোশ দিয়ে হয়না। এই অপরাধের শাস্তিটা নাহয় বেগমের হাতেই ছেড়ে দাও।”
সকলের দৃষ্টি গিয়ে আবদ্ধ হলো বেগমের উপর। যে কিনা এখনো পর্যন্ত নিরবে দাঁড়িয়ে ছিলো কোনো প্রকার হেলদোল ছাড়া। ধীরে সুস্থে আলতো হাতে হাফসাকে ছাড়িয়ে তার সামনে ঝুঁকে এলো বেগম। নরম কন্ঠে শুধাল,
“কে সেই গুপ্ত শত্রু?”
আমতা আমতা করে কেঁদে উঠলো হাফসা। ক্রন্দনরত কন্ঠে বলল, “বিশ্বাস করুন সুলতানা তাকে আমি কোনোদিন দেখিনি। শুধু তার পত্র আসতো আমার নিকট। স্বচক্ষে দেখার সুযোগ পাইনি কোনোদিন। বড় ধুর্ত সেই ঘাতক।”
“তুমি বোধহয় ভুলে যাচ্ছ হাফসা যে তোমার পত্রের একটা অংশে বড়বড় অক্ষরে তুমি লিখেছো ‘আপনার পরিচয় রাজ পরিবারের সকলের নিকট প্রকাশ করে দিতে বাধ্য হব আমি’।”
“আআআআমি ওটা শুধু সেই ঘাতককে ভয় দেখাতে লিখেছি। বাস্তবে তাকে আমি কখনোই দেখিনি।”
“যোগাযোগ কীভাবে হতো?” আবারো প্রশ্ন করলো বেগম।
“গভীর রজনীতে সকলে যখন ঘুমে নিমজ্জিত থাকতো সেসময় রন্ধনশালা অন্ধকার করে রাখা হতো। এই সুযোগটাই ব্যবহার করেছে সে। জানালার ওপার থেকে পত্র রেখে দিত আমার জামাকাপড়ের থলের মধ্যে। আমিও নিজের উত্তর লিখে পত্রটা আবার ওখানেই রাখতাম। সেখান থেকেই অন্ধকারে নিয়ে যেত সে। প্রতিবার এভাবেই পত্র আদানপ্রদান হতো আমাদের। আমি শুধু হাতে গোনা কয়েকবার তার ছায়া দেখেছি। মুখ দেখতে পারিনি। অযথায় মিথ্যা বলে অর্থ নিতাম যে তাকে দেখে ফেলেছি আমি।” কাঁপা কাঁপা কন্ঠ হাফসার।
আবারও এগিয়ে এলো জারনাব। মুখভঙ্গি শান্ত অথচ ক্ষুব্ধ কন্ঠে বলে উঠলো, “দেখোনি? তার মুখ দেখোনি? সত্যিই দেখনি? ছল করে অর্থ নিয়েছো এতদিন? যার জন্য কাজ করেছো তাকেও ধোঁকা দিয়েছো? ভয়ঙ্কর ঘাতকের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করতে কলিজা কাঁপেনি তোমার? অর্থলোভী নারী!”
“তুমি কি থামবে জুঁই? তোমার স্বভাবসুলভ সরল আচরন পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে এই মহলের দন্দের মাঝে পড়ে।” মৃদুস্বরে ধমকে উঠলো মাহতাব।
আচমকা ধমকে সামান্য কেঁপে উঠলো জারনাব। মাহতাবের দিকে একবার অভিমানী দৃষ্টি নিক্ষেপ করেই পিছিয়ে গেল সে। এই মহল আর রাজ পরিবারের দন্দের কারনে সে তার কত মূল্যবান জিনিস হারিয়ে ফেলেছে চিরজীবনের জন্য। তা কি জানেনা আজমাইন? পার্শ্ব সাম্রাজ্যের সাথে নদী নিয়ে দন্দের কথা কি ভুলে গেছে? এই সাম্রাজ্যের দন্দই তো ছিনিয়ে নিয়েছে তার সাহাদকে। যাকে সে প্রাণের চেয়েও বেশি ভালোবেসেছিল। রামান সাম্রাজ্য তাকে বিধবার তকমা দিয়েছে। কী দোষ ছিলো তার সাহাদের? এই সাম্রাজ্যের সৈনিক হওয়াটাই তার জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়েছিল। কেউ কি বাঁচাতে পারতো না তার সাহাদকে? কেউ বাঁচাইনি, কেউ না। হঠাৎ সকলের অগোচরে ক্ষোভের জন্ম নিলো যেন মায়বী ঐ দৃষ্টিতে।
তানহা এখনো রাগে গজগজ করছে কিন্তু কিছু বলতে পারছে না। বেগম পুনরায় শীতল কন্ঠে শুধাল,
“তারমানে কখনো দেখোনি তুমি সেই গুপ্ত শত্রুকে?”
“না সুলতানা। দয়া করে বিশ্বাস করুন আমার কথা।”
“শত্রুর দেওয়া সেই পত্রগুলো কোথায় এখন?”
“ওগুলো তো পুড়িয়ে দিয়েছি আমি।”
শান্ত ভঙ্গিতেই উঠে দাঁড়ালো বেগম। কোমরের বন্ধনী থেকে তলোয়ার বের করতে করতে আফসোসের কন্ঠে আওড়ায়,
“তাহলে আর তোমাকে বাঁচিয়ে রেখে কী হবে? কোনো লাভ তো নেই। শত্রুকে পেলে তাও ভেবে দেখতাম প্রাণ ভিক্ষা দেওয়া যায় কিনা?”
“না না, আমাকে মারবেন না। বলছি আমি বলছি। আমার কাছে শেষের পত্রটা এখনো আছে। লুকিয়ে রেখেছি তাকে ভয় দেখিয়ে অর্থ হাতানোর লোভে।”
তাচ্ছিল্য হাসলো বেগম। বলল, “পত্র এনে দিতে নতুন করে বলা লাগবে নাকি তোমাকে? অবুঝ অপরাধী পছন্দ নয় আমার।”
হাফসা উপলব্ধি করতে পারলো তার মায়াকান্নায় কাজ হবে না আজ। বেগম তাকে ছাড়বে না। একটা শেষ সুযোগের আশায় ছলচাতুরির আশ্রয় নিলো সে। বলে উঠলো, “দিতে পারি তবে আমার একটা শর্ত আছে।”
“শর্ত শোনার সময় নেই আমার। জানাজা মোবারক হাফসা।”
তলোয়ার হাতে দু কদম এগিয়ে এলো বেগম। তড়িঘড়ি করে চিৎকার করে উঠলো হাফসা, “আমি শুধু আর একটা দিন বাঁচতে চাই। প্রাণ ভিক্ষা চাইছি না, শুধু একটা দিন চাইছি। আমিও এ সাম্রাজ্যের প্রজা। আমারও মৃত্যুর পূর্বের শেষ ইচ্ছা পূরণ করার দায়িত্ব রাজ পরিবারের। আমাকে হত্যা করলে ঐ পত্র কেউ কখনোই পাবে না এমন স্থানে লুকিয়ে রেখেছি আমি।”
কথা বলে উঠলো সুলতান শাহজিল, “পত্রখানা জরুরী সেই শত্রুকে খুঁজে বের করতে। হাতের লেখা থেকে আমরা তাকে চিহ্নিত করতে পারি। একটাদিনেরই তো ব্যপার। ওকে এখনি হত্যা করাটা আবশ্যক নয় বরং শত্রুর পরিচয় উন্মোচন করাটাই আবশ্যক।”
অগত্যা মেনে নেওয়া হলো হাফসার শর্ত। হাফসার ভাষ্য অনুযায়ী রন্ধনশালায় ব্যবহৃত কাঠের তৈরি পাত্র ভেঙে বের করে আনা হলো একখানা পত্র। যেখানে গোটা গোটা অক্ষরে লেখা রয়েছে,
“আমার প্রতিশোধ সম্পন্ন হয়েছে। সুলতান শাহজাইনের মৃত্যুর মধ্য দিয়েই আমার অপরাধ জীবনের সমাপ্তি ঘটেছে। আমি চাই না আমার হয়ে তুমি আর কোনো অপরাধ সংঘটিত করো। তোমার আমার আদান-প্রদান, সংযোগ এখানেই শেষ। আমি আমার প্রতিশোধ পূর্ণ করেছি। শেষ করে দিয়েছি সুলতান শাহজাইনকে। এলিজা সুলতানকেও শেষ করে দিতাম কিন্ত কোনো এক কারনে সেই সিদ্ধান্ত বদলে ফেলেছি আমি। কারনটা অবশ্যই তোমাকে বলতে বাধ্য নই। আর তোহফা বাচ্চাটা মায়াবী। প্রথমদিকে তাকে মারতে চাইলেও এখন অযাচিত কারনবসত তার প্রতি মায়া জন্মে গেছে আমার পাথর হৃদয়ে। পরবর্তীতে তোহফার ক্ষতি করার চেষ্টাও করো না হাফসা। তার ফলাফল ভয়ংকর হবে। পরিশেষে বলবো, আমি নতুন এক জীবনের শুভ সূচনা করতে চাইছি আমার এই অপরাধের জীবনে ইতি টেনে।”
পত্র পড়ে বিস্ময়ের সীমা রইল না যেন। কে সেই শত্রু যার তোহফার প্রতি হঠাৎ মায়া জন্মে উঠলো? বেগমকেই বা কেন ছেড়ে দিলো? এলিজা সুলতানকে কেন মারতে চায় না সে? শুধুমাত্র সুলতানই কি তার লক্ষ্য ছিলো?
হাফসা বলে উঠলো, “পত্র তো দিয়ে দিয়েছি এবার ছেড়ে দিন আমাকে।”
বাঁকা দৃষ্টিতে তাকালো বেগম। উপহাসের স্বরে বলল, “এমন তো কথা ছিলো না হাফসা। একটা দিন দিয়েছি তোমাকে তবে সেই দিনের সূচনা হবে কারাগারের চার দেয়ালের মধ্যখানে। মাহতাব, ওকে এখনি কারাগারে নিক্ষেপ করো।”
চলবে…….
#সম্রাজ্ঞী
#লিয়ানা_লিয়া
#পর্ব_44
সাত সকালে কারাগার থেকে টেনে হিচড়ে বের করা হচ্ছে হাফসার মৃতদেহ। মধ্যরাতেই হয়তো হত্যা করা হয়েছে তাকে। যার দরুন সকাল হবার পূর্বেই লাশ শক্ত হতে শুরু করেছে। ফয়েজের মতোই একইভাবে বুকে খঞ্জর ঢুকিয়ে মারা হয়েছে হাফসাকে। না, তাকে সম্রাজ্ঞী শাস্তি দেয়নি। শাস্তি দিয়েছে অজ্ঞাত খুনি, এই মহলের সবচেয়ে বড় শত্রু। কারাগারের তালা অক্ষত রেখেই সে প্রবেশ করেছিল কারাগারে। এর থেকেই বুঝা যায় এই মহল কতটা আয়ত্তে আছে সেই গুপ্ত শত্রুর। ভোরের আলো ফুটতেই মেঝেতে পড়ে ছিলো হাফসার মৃতদেহ আর একখানা রক্তমাখা পত্র। পত্রের একপাশ রক্তে ভিজে জপজপ করছে। একজন সৈনিক পত্রখানা তুলে এনে বেগমের হাতে দেয়।
“প্রথমেই আমি সম্মানিত সম্রাজ্ঞীর নিকট দুঃখ প্রকাশ করছি নিজের অঙ্গীকার ভেঙে পুনরায় হত্যাকান্ড চালানোর জন্য। কিন্তু আমিই বা কী করতাম? এই রাঁধুনির এতবড় সাহস! সে কিনা আমাকে ধোঁকা দেয়? আমাকে! মিথ্যা বলে আমার থেকে দিনের পর দিন অর্থ হাতিয়ে নিয়েছে। বড়ই লোভী ছিলো এই নারী। সেই অর্থে আরাম- আয়েস করার সুযোগ যদিও বেচারি পায়নি তবুও বড্ড সরল মৃত্যু দিয়েছি ওকে আমি। শান্তির ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছি। আমার জানা মতে ওকে একটাদিন পর এমনিতেই ফাঁসি দেওয়া হতো অথবা কর্তন করা হতো ধোঁকায় ভরা মাথাটা কিন্তু কী জানো তোমরা? ওকে নিজ হাতে না মারতে পারলে নিজেকে অনেক তুচ্ছ মনে হচ্ছিল। তাই সম্রাজ্ঞীর শাস্তির অপেক্ষা না করেই বাধ্য হলাম হত্যা করতে। সব শেষে একটা কথা শুনবে এলিজা সুলতান? আমার ভাগ্যটা খুব খারাপ, খুব খুব খারাপ। এতবড় দুনিয়ায় আমার একটা প্রিয়জন নেই। অভাগা আমি!”
পত্র পড়া শেষ করে গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলল বেগম। ডেকে উঠলো উচ্চস্বরে, “মাহতাব।”
সাথে সাথেই সাড়া দিলো মাহতাব, “বলুন সুলতানা।”
“তোমাকে ঠিক এক প্রহর সময় দিলাম। সূর্য মধ্যাকাশে বিচরণ করার পূর্বেই এই মহলের প্রতিটা মানুষের হাতের লেখনী সম্মুখে চাই আমার। সৈনিক, সেবক-সেবিকা, রাঁধুনি, এমনকি রাজ পরিবারের মানুষগুলোও যেন একখানা ছোট পত্র লিখে নিচে নিজের নাম সাক্ষর করে দেয়। পত্র লেখার সময় তুমি নিজে দাঁড়িয়ে থেকে তদারকি করবে যেন সামান্য এদিক থেকে ওদিক না হয়। চাইলে কারোর সাহায্য নিতে পারো। বুঝতে পেরেছো আমার কথা?”
“অবশ্যই সুলতানা।”
ধীর পায়ে কারাগার থেকে চলে গেল বেগম। হাতে রক্তে ভেজা পত্রখানা সযত্নে চেপে ধরেই নিজ কামরার উদ্দেশ্যে রওনা করলো। চিন্তিত মুখখানি একেবারেই নিস্তেজ। সুন্দর সেই দুই নয়নে কোথাও সস্তির দেখা নেই। উঁচু পেট নিয়ে চলাফেরা করতে কিছুটা সমস্যা হলেও বরাবরের মতোই নিজের আত্মবিশ্বাস ধরে রেখেছে সে। যথাসম্ভব নিজেকে শক্ত রাখার প্রয়াস থেমে নেই। গোটা একটা সাম্রাজ্য যে তার উপর নির্ভরশীল কিন্তু আর কতদিন এভাবে? তার গর্ভে থাকা ছোট্ট প্রাণের অস্তিত্ব যত বাড়ছে, দিনকে দিন এগিয়ে আসছে তাকে দুনিয়ার আলো দেখানোর সময় ঠিক ততটাই শারীরিক, মানসিক সমস্যায় ভুগছে বেগম। ক্রমশ তার শরীর দূর্বল হয়ে পড়ছে। শরীরে শক্তি পায় না আগের মতো। জানা নেই আগামীতে কী হবে? ধীরে ধীরে তার শরীর এতোটাই দূর্বল হয়ে পড়ছে যে এই সাম্রাজ্য বাঁচানো তো দূরের কথা নিজেকেই রক্ষা করতে পারবে না সে। নিজেকে কেমন অসহায় লাগে আজকাল।
“তুমি কি আমাকে একটু সাহায্য করবে জুঁই?”
হঠাৎ মাহতাবের কথাতে চমকে উঠলো জারনাব। এতক্ষণ তার ধ্যান শুধুই হাফসার মৃতদেহর দিকে ছিলো। একদৃষ্টে চেয়ে দেখে যাচ্ছিল কারাগারের দিকে। অন্যদিকে মনোযোগ ছিলো না বিধায় মাহতাবের কথা ঠিকঠাক শুনতে পারেনি সে। তড়িঘড়ি করে বলে উঠলো,
“হু?”
“কী ভাবছো এতো?” শুধাল মাহতাব।
“না, কিছুনা। বলো কী বলবে?” কথা কাটিয়ে নিতে চাইল জারনাব।
লক্ষ্য করলো মাহতাব। হুট করে সামান্য সন্দিহান কন্ঠে বলে উঠলো, “সেদিন তো বাগানের মৃতদেহ দেখে তুমি ভয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলে। আজ কীভাবে হাফসার মৃতদেহ দেখছো? তাও এত স্বাভাবিকভাবে!”
এভাবে কথাখানা জিজ্ঞেস করাতে কিছুটা হকচকিয়ে উঠলো বোধহয় জারনাব। কাটা কাটা স্বরে কিছুটা রাগ করেই বললো,
“দেখতে দেখতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি আমি। আর কতো ভয় পাবো? তুমি কি দেখোনি সেদিনের লাশের অবস্থা? কতটা ভয়ানক ছিলো! কতটা নিষ্ঠুরভাবে মাংসগুলো খুবলে নেওয়া হয়েছিল। সেটা সহ্য করতে পারিনি আমি। আর এই রাঁধুনির মৃতদেহ একদম স্বাভাবিক। তাই ভয় লাগছে না আমার। তাছাড়া এসব দেখতে দেখতে সয়ে যাচ্ছে। নিজের ভয় কাটিয়ে উঠার চেষ্টা করছি আমি।”
নিজের করা প্রশ্নে খানিক লজ্জিত হয়েছে মাহতাব। নিজের উপরেই রাগ হলো তার। বারবার সে কীভাবে নিজের অজান্তেই জুঁইকে কষ্ট দিয়ে ফেলে। আসলেই হৃদয়হীন সে! অপরাধীর মতো বলে উঠলো,
“আমি দুঃখিত জুঁই। আমি আসলে ওভাবে বলতে চাইনি।”
উত্তর আসলো না অপরপাশ থেকে। অভিমানেই হয়তো মুখ ঘুরিয়ে রেখেছে জারনাব। ডাকলো মাহতাব,
“জুঁই?”
এবারও কথা বলল না জারনাব। সফেদ হিজাবটা টেনে খানিক ঠিক করে গটগট করে হাঁটা শুরু করলো কামরার উদ্দেশ্যে। পিছনে পিছনে এগিয়ে আসলো মাহতাব নিজেও।
“মহলের সকলের লেখনী সংগ্রহ করতে আমাকে একটু সাহায্য করতে পারবে তুমি?” পুনরায় বলল সে।
“পারবো না। তোমার কাজ তুমি করো।”
“তোমার বোনের নির্দেশ যখন করতে তো হবেই। কিন্তু আমাকে কে সাহায্য করবে? তুমি ছাড়া আর কে আছে আমার এখানে?”
এবার দাঁড়িয়ে পড়লো জারনাব। একনজর কটমটে চাহনি নিক্ষেপ করলো মাহতাবের দিকে। নারাজ স্বরে আওড়ালো, “ঠিক আছে, ঠিক আছে। আর বলতে হবে না সৈনিক প্রধান। চলুন, সাহায্য করছি কিন্তু খবরদার আমার সাথে বেশি কথা বলার চেষ্টা করবেন না আপনি। রাজি?”
“তা আর বলতে? প্রয়োজন ছাড়া একটা কথাও বলবো না। কথা দিলাম। নিজের কাজ নিয়ে আমি খুবই গুরুতর। সেখানে কোনো আবেগ নেই।”
কথা বলতে বলতে এগিয়ে গেল তারা। এতবড় মহলের সবার লেখনী সংগ্রহ করা তো চাট্টিখানি কথা নয়। কারাগারের সম্মুখে দাঁড়িয়েই তাদের চলে যাওয়া দেখে গেল তানহা। হাফসার মৃতদেহর দিকে চেয়ে তার চেহারাতে যে অজানা খুশি খেলা করছিলো, দৃষ্টিতে যে হিংস্রতা ফুটে উঠেছিল মুহুর্তেই তা নিভে গেল। আবেগ নিয়ন্ত্রণ করে নিয়েছে সে অনেক আগেই। সে একজন শেহজাদি তার সাথে সামান্য এক সৈনিক প্রধান কখনোই যায় না। অহংকার নয়, এ যেন মনের শান্তনা। পুনরায় হাফসার দিকে চেয়ে তখনই আবার ক্ষোভে ফেটে পড়লো যেন। হিংস্রতা ভর করলো হিজাবে ঢাকা মুখখানাতে। হিতাহিতবোধশূন্য হয়ে সজোরে নিজের তলোয়ার চালনা করলো হাফসার মৃতদেহে। আক্রোশের সাথে চেঁচিয়ে উঠল,
“ধংস হয়ে যা তুই।”
এদিকে ততক্ষণে শুরু হয়ে গেছে লেখনী সংগ্রহ। মামা হাদিদ কিছুটা বেঁকে বসলেও মাহতাবের কঠোরতার কাছে একপ্রকার হার মেনেই বাধ্য হয়ে নিজের লেখনী দিয়েছে। কোনোপ্রকার দ্বিমত ছাড়াই নীরবে নিজের লেখনী দিয়েছে ওয়াসিফা সুলতান। তবে এখনও নিশ্চুপ সে। পুত্রের শোকে সেই যে নীরব হয়েছে তিনি, তা আর ফুরায় না। তানহা পত্র দেয়নি। জোর করেও কোনো কাজ হয়নি। তার একটাই কথা সে পত্র দিতে পারবে না। দেবে না মানে দেবে না। কেন দেবে না? কিসের জন্য? এমন কোনো কারনই সে উল্লেখ করেনি। বিচক্ষণ সুলতান শাহজিল কিছু বলার আগেই পত্র লিখে নিচে নিজের সাক্ষর দিয়ে দিয়েছে। একে একে ফাইজা, আবদুর রহমানসহ সকলের লেখনী জমা করা হলো। বেগমের নিকট সমস্ত লেখনী জমা দিতে যাওয়ার আগ মুহুর্তে মাহতাব বলে উঠলো,
“এখানে তোমার লেখনীও লাগবে জুঁই। একখানা পত্র লিখে দাও।”
অবাক দৃষ্টিতে চাইল জারনাব। বিরক্তভরা কন্ঠে জাহির করলো, “আমার লেখনী! আমি কি শত্রু নাকি যে লেখনী দেবো?”
“কে শত্রু তা আমরা কেউ জানি না। এটাই বেগমের হুকুম। যা মানতে আমরা সকলে বাধ্য।” কঠোর স্বর মাহতাবের।
“আমি বাধ্য নই।”
“তুমি বাধ্য জুঁই। এটাই নিয়ম তাই শুধু শুধু কথা বাড়িয়ো না।”
“এবার তুমি বেশি বাড়াবাড়ি করছো আজমাইন।” রাগান্বিত কন্ঠ জারনাবের।
“এখানে লেখনী না দেওয়ার বা রেগে যাওয়ার কোনো কারন আমি দেখছি না। সরলভাবে লেখনী দিয়ে দিলে এত কথাই খরচ করতে হতো না আমার। আমি জানি তুমি শত্রু নও কিন্তু এটা যে বাধ্যতামূলক। একটু বুঝার চেষ্টা করো।”
“তুমি কি আমাকে সন্দেহ করছো আজমাইন?” আনমনে শুধাল জারনাব।
“ছি ছি! আমি তোমাকে সন্দেহ করতে যাবো কেন? আমিতো জানি জুঁই এরকম কিছু করতেই পারে না কখনো। শুধু নিজের দায়িত্ব নেভাতে তোমার লেখনী নিচ্ছি।”
আর কথা বাড়ালো না জারনাব। ইতস্তত ভঙ্গিতেই ছোট্ট একখানা পত্র লিখে দিলো তাড়াহুড়ো করে। সূক্ষ্ম কন্ঠে আওড়ালো,
“এতোটা বোকা নয় গুপ্ত শত্রু যে নিজ হাতে পত্র লিখে রেখে যাবে কারাগারের ভেতর। তোমার কি মনে হয়? এভাবে তাকে ধরা যাবে?”
“অনেক বড়বড় অপরাধীও মাঝেমাঝে ছোট ছোট ভুল করে বসে। তাই চেষ্টা করে দেখতে তো দোষ নেই।”
বলতে বলতে পত্র হাতে নিয়ে চলে গেল মাহতাব। বেগমের কাছে জমা দিতে হবে এখন। রাজসভার বিশাল রাজকীয় সিংহাসনে বসে আছে বেগম। ভারী পেট নিয়ে এতো উঁচু সিংহাসনে বসে থাকতে কষ্ট হলেও বসে আছে সে। শত্রুকে খুঁজে পাওয়ার এটাই আপাতত একমাত্র উপায়। তাই সে নিজে উপস্থিত থেকে লেখনী মিলিয়ে দেখতে চাইছে আসলে কে সেই শত্রু। রাজ পরিবারের সদস্যরাও সেখানে উপস্থিত হয়েছে একে একে। মাহতাব এসে বেগমের সম্মুখে সমস্ত পত্রগুলো রেখে দিলো। মাথা নুইয়ে নত মস্তকে জানিয়ে দিলো,
“আমাকে ক্ষমা করবেন সুলতানা। শেহজাদি তানহার লেখনী আমি আনতে পারিনি।”
“সেকথা আমার পূর্বেই জানা ছিলো মাহতাব। তোমার কোনো দোষ নেই এখানে। যে আসল অপরাধী সে কখনো প্রমান জমা দিতে চাইবে না এটাই স্বাভাবিক।”
কথাখানা বলতে বলতে অদূরে কেদারায় বসে থাকা তানহার দিকে চাইল সে। বাঁকা আর অত্যন্ত গুরুগম্ভীর সেই দৃষ্টি। দূর্বল শরীর আর সায় দিচ্ছে না তবুও সিংহাসন চেপে ধরে বসে আছে বেগম। কঠিন গলায় তানহার উদ্দেশ্যে কিছু বলতে নেবে এমন সময় উঠে দাঁড়ালো তানহা। উচ্চস্বরে বলল,
“আমাকে অপরাধী বলছো তুমি? এই সাম্রাজ্যের শেহজাদি আমি। প্রমাণ ছাড়া আমাকে দোষারোপ করার কোনো অধিকার তোমার নেই।”
“তাহলে লেখনী কেন দাওনি? ভয়ে?” ভ্রু কুচকে শুধাল বেগম।
কটমট করে উঠলো তানহা। রাগান্বিত স্বরে আরও কিছু বলার পূর্বেই প্রতিবাদ করে উঠলো সুলতান শাহজিল, “সাবধান এলিজা! আমার কন্যার সাথে এরূপ আচরন সহ্য করবো না আমি।”
“তাহলে আপনার কন্যাকে বলে দিন যেন সে লেখনী জমা দিয়ে দেয়। নতুবা শাস্তি ঘোষণা করতে বাধ্য হবো আমি।” শক্ত কন্ঠ বেগমের।
পিতাকে এই প্রথম তার জন্য প্রতিবাদ করতে দেখে তানহা চরম খুশি হয়েছে। জীবনের প্রথম সে অনুভব করতে পারলো তার প্রতি পিতার কিছুটা হলেও টান আছে, পিতৃত্বের টান। ভুলে গেল বেগমের সাথে হওয়া বাকবিতণ্ডা। সেসময় মামা হাদিদ কিছু বলতে নিতেই কঠিন দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো বেগম। সাবধান করে বলল,
“সম্রাজ্ঞীর মুখে মুখে কথা বলার অধিকার সকলের নেই। কারাগারে দিন কাটাতে না চাইলে ভদ্রলোকের মতোই বসে থাকুন মামা।”
“তানহা? লেখনী দিয়ে দাও। শেহজাদিরও একটা দায়িত্ব থাকে শত্রুকে খুঁজে পেতে সাহায্য করবার।”
উত্তেজিত পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হলো সুলতান শাহজিলের কথাতে। পিতার কথাতে কিছুটা সময় নিয়ে ভাবলো তানহা। অতঃপর চুপচাপ একখানা পত্র লিখে দিলো। বেগমের সম্মুখে দাঁড়িয়ে মাহতাব নিজেও একখানা পত্র লিখলো। অতঃপর বেগমের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,
“এটা আমার লেখনী। মাফ করবেন আগে দেইনি কারন আমি সকলের সম্মুখে লিখতে চাইছিলাম।”
বেগম একে একে সকলের লেখনী পর্যবেক্ষণ করে শত্রুর লেখা পত্রের সাথে মিলিয়ে দেখছে। দুর্ভাগ্যবশত কারোর লেখনীই ঠিক শত্রুর লেখনীর সাথে মিলছে না। এমত অবস্থায় রাজসভার দ্বারের সামনে থেকে ভেসে এলো একটি পুরুষালি কন্ঠস্বর,
“আমার লেখনী নেবে না?”
উপস্থিত সকলে প্রায় একসাথেই পেছনে ফিরে তাকালো। চমকে উঠে সম্মুখে দৃষ্টি রাখলো বেগম। মানুষটিকে কেউ হয়তো আশা করেনি। তার দরুন সকলের দৃষ্টিতে অবাকের ছায়া। বাক্যটা যে বেগমের উদ্দেশ্যেই ছিলো এতে কোনো সন্দেহ নেই। ক্রমশই এগিয়ে আসছে পুরুষটি।
চলবে…….গল্পের