#সম্রাজ্ঞী
#লিয়ানা_লিয়া
#পর্ব_47
বেদনায় ভরা রাজ মহলের মাঝে আরো একটা নতুন বেদনার সূচনা। জন্মের পূর্বেই বিলীন হলো ছোট্ট প্রাণ। এতোমাস ধরে নিজের মাঝে ধারণ করা প্রাণের অস্তিত্ব নিঃশেষ হয়ে গেল। অথচ বেগম সেই শোকটাও অনুভব করতে পারলো না। কাঁটায় গাঁথা ভাগ্য যে তার! সুখ বেশিদিন সয় না! ফাইজা যখন অঝোরে অশ্রু বিসর্জন দিতে দিতে প্রায় ক্লান্ত ঠিক সেসময় খট করে খুলে গেল বন্ধ দ্বার। কোথা থেকে যেন তড়িৎ বেগে ছুটে এলো জারনাব। বেগমের রক্তে ভেজা শরীরখানা পাগলের মতো তাড়াহুড়ো করে ছুঁয়ে দিলো। মাথাটা তুলে নিজের কোলে নিয়ে ঘাবড়ানো কন্ঠে ডাকলো,
“জোভিয়া, জোভিয়া।”
রীতিমতো ছটফট করছে জারনাব। বারবার ঝাঁকিয়েও যখন বেগমের কোনো সাড়াশব্দ পেল না তখনই আচমকা হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো। ততক্ষণে সে নিজেও বেগমের রক্তে মেখে গিয়েছে। কাঁপা কাঁপা হাতে বেগমের শ্বাস প্রশ্বাস পরিক্ষা করলো। অসাড় শরীরখানা কোলের মাঝে রেখেই দ্বারের পানে চেয়ে চিৎকার করে ডাকলো,
“আজমাইন, আজমাইন, তাড়াতাড়ি এসো।”
পেটটা বারকয়েক ছুঁয়ে দিয়ে ক্রন্দনরত কন্ঠে আওড়ায়,
“জোভিয়া, কিছুই হবে না তোমার। তুমি ভালো হয়ে যাবে বোন।”
বেগমের সুন্দর মুখখানা ফ্যাকাশে হয়ে আছে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে। দেহ জুরেই মলিনতার ছাপ। ঠান্ডা হয়ে আসছে তার শরীর। শরীর ছুঁয়ে এই মুহূর্তে জারনাব এতটাই ভয় পেয়ে গেল যেন সে নিজেই জ্ঞান হারাবে। তার অশ্রু গড়িয়ে বেগমের শরীরে পরছে ফোঁটায় ফোঁটায়। বেগমের কপালে চুম্বন করে আবারও আওড়ালো,
“ঠিক হয়ে যাবে। সব ঠিক হয়ে যাবে। কিছুই হয়নি তোমার।”
অতঃপর চিৎকার করে ফাইজার উদ্দেশ্যে বলল,
“কী করেছো তুমি ওর সাথে? ওর এ অবস্থা কেন?”
“আআমি কিছু করিনি বিশ্বাস করুন। সুলতানের মামা ওনার পেটে লাথি মেরে পালিয়ে গেছে।” ভীত কন্ঠ ফাইজার।
দ্বার ঠেলে হুরমুরিয়ে প্রবেশ করলো মাহতাব, তানহা, সুলতান শাহজিল, ওয়াসিফা সুলতান। সকলের পেছনে আনাবিয়ার কোল থেকে তোহফা ভেজা গলায় শুধাল,
“আম্মু, আম্মু মেঝেতে শুয়ে আছে কেন?”
তার কথায় কান দেওয়ার সময় নেই কারোর। বিস্মিত নয়নগুলো ঘুরে যাচ্ছে বেগমের অসাড় শরীরটাকেই। তোহফা পুনরায় শুধাল,
“আম্মু কথা বলছে না কেন?”
তানহা খুব একটা ভ্রুক্ষেপ না করে চুপচাপ তোহফাকে কোলে তুলে নিলো। ভাইয়ের হত্যাকারীর এই পরিণতিতে খারাপ লাগার কথাও নয়। তার চেয়ে তোহফার মাথায় হাত বুলিয়ে তাকে বোঝানোর চেষ্টা করছে সে। মাহতাব হন্তদন্ত হয়ে এগিয়ে গেল জারনাবের দিকে। কেঁদেকেটে বেহাল দশা জারনাবের। বেগমের দিকে এক পলক চেয়ে নজর সরিয়ে নিলো মাহতাব। মর্মান্তিক এই দৃশ্য যে কোনোদিন দেখতে হবে তা কেউ কল্পনাও করেনি। চিকিৎসার ব্যবস্থা করার বদলে ক্রোধে ফেটে পড়লো ওয়াসিফা সুলতান। বেগমের অবস্থা দেখেই অভিজ্ঞ নারী সে বুঝে গেছে গর্ভের সন্তান আর বেঁচে নেই। রাজ পরিবারের উত্তরাধিকারের অস্তিত্ব ভেসে যাচ্ছে এই রক্তের সাথে। মৃত পুত্রের শেষ অংশটুকুও এভাবে নিঃশেষ হতে দেখে এতগুলো মাস বাদে সে কথা বলে উঠলো। ঠিক কথা নয়, একপ্রকার হুংকার ছেড়েই বলল,
“অলক্ষী! আমার শেষ ভরসাতেও মাটি ফেলে দিলো। ও শাহজাইনের খুনি জেনেও এতগুলো দিন মুখ বন্ধ করে সহ্য করেছি যে অন্তত ওর মাধ্যমে সাম্রাজ্য পরবর্তী উত্তরাধিকার পাবে।”
সুলতান শাহজিল সান্ত্বনার সুরে বলে উঠলো,
“অবশেষে তুমি কথা বললে ওয়াসিফা। তবে আমার মতে এখানে ওর কোনো দোষ নেই। এতবড় সর্বনাশটা তোমার ভাই-ই করেছে।”
“ও কেমন সম্রাজ্ঞী যে নিজের সন্তানকে বাঁচাতে পারে না?” প্রতিবাদ করে উঠলো ওয়াসিফা সুলতান।
“তুমি তো জানোই যে এসময় নারীরা দূর্বল হয়ে পড়ে। তাছাড়া এলিজা যথেষ্ট সচেতন। হয়তো ও আন্দাজ করতে পারেনি হাদিদ এমন একটা প্রহার ওকে করবে। হাদিদকে এই মহলে রাখাই ঠিক হয়নি তোমার।”
মানতে নারাজ ওয়াসিফা সুলতান বরং বেগমকে মারতে তেড়ে গেল তলোয়ার নিয়ে। আক্রোশের সাথে বলল,
“ওকে আজ আমি মেরেই ফেলব। শাহজাইনকে ঐ মেরেছে আমি নিশ্চিত। লোভী মেয়ে! ক্ষমতার লোভে আমার একমাত্র পুত্রকে মেরে ফেলল!”
দ্রুত তার বাহু চেপে আটকালো সুলতান শাহজিল। রাগান্বিত স্বরে বলল, “পাগল হয়ে গিয়েছো তুমি? ওকে মারলে তুমি হয়তো শান্তি পাবে কিন্তু সাম্রাজ্য শান্তি পাবে না। তোমার হাতে এলিজার মৃত্যু হলে ওর পিতা সুলতান ইহসান আজই যুদ্ধ ঘোষণা করবে রামান সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে। পুত্রের মৃত্যুর বদলা নিতে গিয়ে গোটা সাম্রাজ্যকে তুমি হুমকির মুখে ফেলতে পারো না। তাছাড়া ও এখন এমনিই আধমরা। চিকিৎসা না পেলে এমনিতেই মারা যাবে।”
“মরবে না। বড় কঠিন প্রাণ ওর। দেখো এখনো কীভাবে বেঁচে আছে। শ্বাস-প্রশ্বাস চলছে তা আমি স্পষ্ট অনুভব করতে পারছি। চিকিৎসা না পেলেও বেঁচে থাকবে ও। শুধু বাঁচাতে পারে না নিজের সন্তানকে।”
“শান্ত হও ওয়াসিফা। আমি বুঝতে পারছি শাহজাইনের সন্তানের মৃত্যু তুমি সহ্য করতে পারছো না। বিষয়টা আসলেই খুব দুঃখজনক কিন্তু পুত্রের মৃত্যুর চেয়ে বেশি নয় নিশ্চয়? সেদিনের মতো আজও নিজেকে সংবরণ করে নাও। শাহজাইন আর নেই কিন্তু এই সাম্রাজ্যকে তো বাঁচাতে হবে আমাদের।”
পিছিয়ে এলো ওয়াসিফা সুলতান। তলোয়ার ফেলে দিয়ে সুলতান শাহজিলের বাহুতে মুখ রেখে হু হু করে কেঁদে উঠলো। বিলাপ করে বলে উঠলো,
“আমার পুত্রকে মেরে ফেলল, আজ তার অংশটাকেও শেষ করে দিল তবুও কিছু বলবো না আমি? এ কেমন দায়িত্ব আমার? নিজ সন্তানের হত্যাকারীকে ছেড়ে দেবো যুদ্ধের ভয়ে!”
তানহা তখনও নিশ্চুপ। বেগমের কী হলো না হলো, মরলো কী বাঁচলো তাতে তার কিছুই যায় আসে না। এভাবে না মরলে সে নিজেই মেরে দিতো এই মহিলাকে। ভালোই হয়েছে নিজেই মরে যাচ্ছে। তোহফা আম্মুর কাছে যাওয়ার জন্য কান্না করছে দেখে তাকে কোলে নিয়ে হনহনিয়ে চলে গেল সে। তোহফা তার ভাইয়ের সন্তান। এই মহিলার কোনো অধিকার নেই তোহফার উপর। বাকবিতণ্ডার মাঝে চিকিৎসার কোনো ব্যবস্থা না হওয়ায় হতাশ হয়ে মাহতাব এগিয়ে এলো তাদের দিকে। মস্তক নুইয়ে নত স্বরে আওড়ালো,
“আমি কি চিকিৎসার ব্যবস্থা করবো? সুলতানার অবস্থা খুবই খারাপ। এতো রক্তক্ষরণে বেশিক্ষণ বাঁচবেন না তিনি।”
“এই ছেলে, বেশি সাহস দেখিও না। কোনো চিকিৎসা হবে না ওর। মরুক এভাবে পড়ে থেকে।” চিৎকার করে উঠলো ওয়াসিফা সুলতান।
বেগমের মাথাটা সযত্নে ধরে রেখেই ছলছল নয়নে ঘুরে তাকালো জারনাব। কোমল সেই কন্ঠ হারিয়ে খানিকটা উচ্চস্বরে বলে উঠলো,
“চিকিৎসা না হলে এমন এতোবড় মহল দিয়ে কী হবে? যেখানে সম্রাজ্ঞীর মৃত্যু হয় বিনা চিকিৎসায়।”
সুলতান শাহজিল রেগে কিছু বলতে নিলেই হন্তদন্ত হয়ে দৌড়ে এলো মাহতাব। ফিসফিসিয়ে বলল,
“চুপ করো জুঁই। আমি ওনাদের বুঝাচ্ছি। তুমি এভাবে বললে পরিস্থিতি আরোও খারাপ হবে। একটু ধৈর্য ধরো।”
“কী করে ধৈর্য ধরবো আজমাইন? বোনটা আমার শেষ হয়ে যাচ্ছে আর এরা আছে এদের স্বার্থ আর তর্ক-বিতর্ক নিয়ে। জোভিয়ার জীবনের মূল্য ওদের কাছে নাই থাকতে পারে কিন্তু আমার কাছে আমার বোন সবচেয়ে মূল্যবান। ওর কিছু হলে মরে যাবো আমি, বাঁচবো না আমি আজমাইন। বাঁচাও ওকে। চিকিৎসার ব্যবস্থা করো।” উন্মাদের মতো চিৎকার করে উঠলো জারনাব। নিজের অবস্থান ভুলল যেন। তোয়াক্কা করলো না কাউকেই।
ক্রমেই সময় পেরিয়ে যাচ্ছে। বেগমের অবস্থা আরোও করুন হচ্ছে। নিশ্বাসের গতি কমে আসছে। মস্তিষ্ক হয়তো তখনও সজাগ। তাইতো বন্ধ চোখের কোনা চুইয়ে অশ্রু ঝরছে দুয়েক ফোঁটা। এই অশ্রু হয়তো ওয়াসিফা সুলতানের ধারাল কথাতেই জন্ম নিয়েছে। মাহতাব আবারো গিয়ে অনুরোধ করলো,
“দয়া করে চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে দিন। এভাবে মানুষটা মরে যাবে চোখের সামনে? সুলতান থাকলে এতক্ষণে মহল মাথায় তুলে ফেলতো।”
“তাকেই তো মেরে ফেলেছে ও। আমি বলেছি চিকিৎসা হবে না মানে হবে না।” এক রোখা উত্তর ওয়াসিফা সুলতানের।
বোনের অসাড় শরীর নিয়ে প্রহর গুনছে জারনাব। কখন চিকিৎসা হবে আর কখন জোভিয়া ভালো হবে। সেসময়ের নিজের ব্যবহারের জন্য ভেজা কন্ঠে আফসোসের সুরে আওড়ালো,
“জানি আমার অমন ব্যবহার করা উচিত হয়নি। সেসময় বিধবা কথাটা আর সাহাদ ছাড়া কিছুই ভাবতে পারছিলাম না আমি। তুমি তো জানো জোভিয়া? পাগলের মতো ভালোবাসি আমি সাহাদকে। তোমাকেও বুঝি তেমন করেই ভালোবেসেছি। তাইতো আজ এই মৃত্যুসম যন্ত্রণা হচ্ছে আমার। কিন্তু তোমাকে বাঁচাবো আমি। সমস্ত ক্ষমতার উর্ধে গিয়ে তোমাকে বাঁচাবো। সাহাদের মতো এভাবে আমাকে ছেড়ে যেতে দেবো না তোমাকে।”
বুকে বড্ড যন্ত্রণা অনুভব করছে। দম বন্ধ হয়ে আসবে যেন। নিষ্পলক দৃষ্টিতে চেয়ে রইল বোনের দিকে। হায়! আফসোস! সাহাদের মৃত্যুর জের ধরে এই সাম্রাজ্যের ধংস কামনা করেছিল সে। অথচ ভুলেই বসেছিল সে যেই সাম্রাজ্যের ধংস চাচ্ছে সেই সাম্রাজ্যের সম্রাজ্ঞী তার বোন। যার সামান্য কষ্টও সহ্য করতে বেগ পেতে হয় জারনাবকে। যাকে দুটো বছর সযত্নে নিজের কাছে আগলে রেখেছিল সে। যে তার সম্মান রক্ষার্থে সর্বদাই রুখে দাঁড়িয়েছে। ওয়াসিফা সুলতান কামরা ত্যাগ করতেই বেগমের মাথাটা মেঝেতে রেখে ছুটে গেল জারনাব। সুলতান শাহজিলের পা ধরে ভেঙে পড়লো কান্নায়,
“দয়া করে চিকিৎসার ব্যবস্থা করুন। আমি কথা দিচ্ছি ও সামান্য সুস্থ হলেই ওকে নিয়ে চলে যাবো আমি। এই সাম্রাজ্য ছেড়ে বহু দূরে চলে যাবো আমরা।”
“কককী করছো জুঁই? ছাড়ো।”
ছুটে এলো মাহতাব। টেনে উঠানোর চেষ্টা করলো জারনাবকে। সেই সাথে জারনাবের বোনকে বাঁচানোর উন্মাদনা দেখে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে বসলো যেভাবেই হোক বেগমের চিকিৎসা করাবে সে। প্রয়োজনে দায়িত্বের জাল ছিন্ন করে বেরিয়ে আসবে। সৈনিক প্রধানের পদ ত্যাগ করবে নির্দ্বিধায়। রাজ পরিবারের সকলকে বন্দি করে হলেও বেগমের চিকিৎসা করাবে সে। জুঁইয়ের এই কান্না যে তার হৃদয় ভেঙে দিচ্ছে। সহ্য করা দায় এই হাহাকার ভরা দুই নয়ন! ভাবনা ভুলে আবারো বলল,
“ওঠো জুঁই। সুলতানার চিকিৎসা হবে। কেউ হুকুম দিক বা না দিক। তুমি চাইছো তাই চিকিৎসা হবে। উঠে এসো।”
অবাক নয়নে চাইল সুলতান শাহজিল। মাহতাবের দৃষ্টির দৃঢ়তা দেখে কিছু একটা ভাবলো। অতঃপর বেগমকে এক পলক দেখে নিয়ে জারনাবের উদ্দেশ্যে বলল,
“ঠিক আছে। চিকিৎসা হবে কিন্তু ওয়াসিফা জানলে ওকে মেরেই ফেলবে হয়তো। তাই সাবধান, কালকের মধ্যেই ওকে নিয়ে মহল ছেড়ে চলে যাবে।”
আর কিছু না ভেবে মাহতাব দ্রুত চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে ছুটলো। হৈ হৈ করে সৈনিকদের উদ্দেশ্যে হাঁক ছাড়লো। বেগমকে টেনে কোনোমতে অসাড় শরীরটা কোলে তুলে নিলো জারনাব। বেগমের কপালে আবারো চুম্বন করে বলল, “এইতো এক্ষুনি ভালো হয়ে যাবে তুমি। রক্তক্ষরণ বন্ধ হয়ে কিছুটা সুস্থ হলে কালকেই তোমাকে নিয়ে চলে যাবো আমি। অনেক দূরে চলে যাবো আমরা। তারপর তোমার চিকিৎসা করাবো। এই স্বার্থপর মানুষের মাঝে রাখবো না আর।”
ততক্ষণে খবর রটে গেছে সাম্রাজ্য জুরে। একজন দুজন করতে করতে সেই খবর পৌঁছালো বণিকের কাছেও। জাহাজের মালামাল গুনে দেখছিলো বণিক। সেসময় হঠাৎ একজন নাবিক এসে বলল,
“জানো নাকি আবরার? কী সর্বনাশা ঘটনাটা ঘটে গেছে।”
আমলে নিলো না বণিক। নিজ কর্মে মনোনিবেশ করে বলল,
“গণনা করছি। বিরক্ত করো না তো। ভুলে গেলে আবার নতুন করে গুনতে হবে।”
“আরেহ রাখো তোমার কাজ। মহলের ঘটনা জানো কিছু? যেই সাম্রাজ্যে বানিজ্য করছো সেই সাম্রাজ্যের রাজ বংশের খবর রাখা উচিত তোমার। আর কাকেই বা কী বলছি? তোমার তো আজকাল নিজের কাজেই কোনো ধ্যান নেই। সবসময় উদাস থাকো। যাকগে থাক, শুনবে না যখন তাহলে যাই আমি।”
নাবিক পা বাড়ালেও ততক্ষণে কাজ থেমে গেছে বণিকের। হন্তদন্ত হয়ে আগ্রহী স্বরে শুধায়,
“কী হয়েছে মহলে?”
লোকটা অচিরেই বলে বসলো, “সম্রাজ্ঞী তো মরে যাচ্ছে। শোনোনি?”
“মমমরে যাচ্ছে মানে?” আৎকে উঠলো বণিক। হাত থেকে পড়ে গেলো বাণিজ্যিক মাল।
লোকটা খানিকটা অবাক হলো তার এমন প্রতিক্রিয়া দেখে। তবুও বলল,
“অতোসতো জানি না ভাই। শুনেছি সম্রাজ্ঞীর অবস্থা খুবই খারাপ। মারা যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। কী ভাগ্য বলো আমাদের? কয়েক মাস আগেই সুলতান মরলো। এখন সম্রাজ্ঞীরও এ অবস্থা। গর্ভের সন্তানটাও নাকি মারা গেছে। প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়েছে। লোকজন তো দেখতে যাচ্ছে কিন্তু মহলে কঠিন পাহাড়া। কাউকেই ঢুকতে দিচ্ছে না।”
আর কিছুই বলার সুযোগ পেলো না লোকটা। আচমকা জাহাজভর্তি মালামাল ফেলে রেখে পাগলের মতো ছুটে যেতে লাগল বণিক। জুতা ছাড়াই উত্তপ্ত বালুর মাঝে পা ফেলে রুদ্ধশ্বাসে দৌড়াতে লাগলো মহলের দিকে। আহাম্মক বনে গেল লোকটা। বড়ই হতবাক হলো বণিকের এহেন আচরণে। হুট করে হলোটা কী? লোকটা জানেও না কতবড় কথাটা বলে ফেলেছে সে।সন্দেহ বসত সেও বণিকের পিছু নিলো। মহলের কাছে আসতেই দেখা গেল প্রধান দ্বার বন্ধ। সৈনিকরা কিছুতেই ভেতরে যেতে দিচ্ছে না। কিছুই মানলো না আজ বণিক। উন্মাদ হয়েছে যেন সে। মহলের প্রধান দ্বার ধরে চিৎকার করে ডাকলো,
“জোভিয়া।”
চলবে……..
#সম্রাজ্ঞী
#লিয়ানা_লিয়া
#পর্ব_48
গগণের বুকে জমে থাকা বিচ্ছেদগুলো আজ ঝরঝর করে আছড়ে পড়ছে পৃথিবীর দিকে। দুঃখের বোঝা ভারী করেই হয়তো অসময়ের কালো মেঘে সেজেছে প্রকৃতি। কখনো বিকট শব্দে গর্জন করছে, কখনো বা বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। গতকাল থেকে একটানা বৃষ্টিপাতে বিপাকে পড়েছে সকলেই। রাত থেকেই হুট করে মেঘ করেছে, বৃষ্টি শুরু হয়েছে তো আর থামাথামির নামটা পর্যন্ত নেই। স্তব্ধ হয়ে আছে পরিবেশ। যেন এই বুঝি তাণ্ডব শুরু করবে! মহলে চিকিৎসা চলছে বেগমের। ছোট্ট একটি কামরায় শুয়ে আছেন তিনি। তাজটা নেই মাথায়। রক্তে ভেজা গাউনটা পরিবর্তন করার সুযোগ হয়নি। রক্ত শুকিয়ে খরখরে হয়ে গেছে। হিজাববীহিন খোলা চুলগুলো এলোমেলো হয়ে ছড়িয়ে আছে পালঙ্কে। অবহেলায় মেঝেতে পতিত হচ্ছে তারা। সকালেই হুঁশ ফিরেছে তার। অথচ সন্তানের শোকে চোখদুটো বন্ধই রেখেছে সে। খুলতে ইচ্ছা করছে না বোধহয়। অথবা দেখতে ইচ্ছা করছে না এই নিষ্ঠুর পৃথিবী! একের পর এক বিভিন্ন অজানা গাছের শেকড়, পাতার রস খেয়ে তেতো মুখটা নিয়েও অবলীলায় চুপ করে আছে। দুপুর হতে চললো কিন্তু সে একটা কথাও বলেনি সকাল থেকে। কথা বলতে পারছে না নাকি সে কথা বলতে চাইছে না? জানা নেই।
কাল থেকে জারনাব সেভাবেই তার শিয়রে বসে আছে। না খেয়ে, চিন্তিত মুখখানা আরোও শুকিয়ে গেছে। মাহতাব কয়েকবার খেতে বললেও সাড়া দেয়নি সে। একধ্যানেই কেবল চেয়ে আছে বোনের দিকে। সে জানে জোভিয়ার হুঁশ ফিরেছে কিন্তু তাকাচ্ছে না কেন চোখ খুলে? কথা কেন বলছে না? কষ্ট হচ্ছে কি? ভাবতেই ঘাবড়ে গেল সে। আমতা আমতা করে শুধাল,
“জজজোভিয়া।”
“দদেখো আমার দিকে। চোখ খোলো।”
সাড়া না পেয়ে আরোও বিচলিত হয়ে শুধায়,
“কথা বলো আমার সাথে। বেশি কষ্ট হচ্ছে? বলো আমাকে?”
উত্তর না পেয়েও আবার বলল,
“কিছু খাবে তুমি?”
ছলছল নয়নজোরা কেবলই ঘুরে যাচ্ছে বেগমকে। কিছুক্ষণ থেমে আবারো আগ্রহী স্বরে আওড়ালো,
“তুমি জানো আমি মনে মনে এই সাম্রাজ্যের ধংস চেয়েছিলাম? সাহাদকে হারিয়েছি আমি এই সাম্রাজ্যের জন্য কিন্তু ভুলে গিয়েছিলাম এই সাম্রাজ্যের সম্রাজ্ঞী যে তুমি জোভিয়া। তোমার ধংস যে আমি নিজের অজান্তেও চাইতে পারি না। তোমাকে হারালে চির নিঃশ্ব হয়ে যাবো আমি। সেই সুযোগ আর ওদের দেবো না। আজ রাতেই তোমাকে নিয়ে চলে যাবো। আর আসবো না এই সাম্রাজ্যে। স্বার্থপর মানুষগুলোর মাঝে রাখবোই না তোমাকে।”
বেগমের মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে শুধায়,
“যাবেনা তুমি আমার সাথে? আমি, তুমি আর আব্বাজান আবার নতুন করে কুঠির সাজাবো। তোহফা হবে সেই কুঠিরের আলোর নিশান।”
ধীরে ধীরে চোখ মেলল বেগম। নড়াচড়া করার শক্তি হলো না। তবুও বহু কষ্টে ধীর স্বরে বলে উঠলো,
“কোথায় যাবো বুবু? সুলতান ছাড়া সেই কুঠিরে শ্বাস নেবো কীভাবে আমি?”
তার কন্ঠ শুনে যেন আকাশের চাঁদ পেল জারনাব। দ্রুত হাতে নিজের চোখ মুছতে মুছতে বলল,
“সুলতান তো এই মহলেও নেই আর না তো পৃথিবীর বুকে তার অস্তিত্ব আছে। অন্তত তুমি নিশ্চিন্তে তো থাকতে পারবে সেখানে। প্রাণের ভয় থাকবে না সেই কুঠিরে। আর এখানে থাকলে স্বার্থপর মানুষগুলো বাঁচতে দেবে না তোমাকে। মেরে ফেলবে ওরা। এখানে সবাই স্বার্থপর, সবাই। আজ রাতেই আমরা সব ছেড়ে বহু দূরে চলে যাবো জোভিয়া।”
নীরবে আবারো চোখদুটো বন্ধ করে নিলো বেগম। আনমনে ভাবছে “চলে যাবে? এই মহল ছেড়ে চলে যাবে? কিন্তু সুলতান তো আসবে। আবার তার কাছে আসবে।”
কয়েক মাস ধরে নিজের মাঝে গোপন করে রাখা কথাগুলো আজও বললো না সে। গোপনই রইল কিছু অজানা কথা।
ওদিকে বণিকের হাল বড়ই নাজুক। সেই গতকাল থেকে এখনো অব্দি প্রধান দ্বার ছেড়ে একচুল নড়েনি সে। একটানা বৃষ্টিতে ভিজে চুপচুপে হয়ে ধীরে ধীরে মিইয়ে যাচ্ছে তবুও চাতক পাখির ন্যায় চেয়ে আছে মহলের দিকে। তালাবদ্ধ দ্বার খুলে হাজার হাজার সৈনিক পেরিয়ে ওপারে যাওয়ার সাধ্য নেই যে! মহলে বহিরাগতদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। বেগমের সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনা যেন বাইরে প্রকাশ না হয় এই ভয়ে। কিন্তু প্রেমিক মন যে মানে না! মহলের ভেতরে কী হচ্ছে? আদৌ জোভিয়া বেঁচে আছে কিনা জানা নেই! তবুও যেন একপলক দেখার তৃষ্ণা, দু’টো কথা শোনার আকুলতা। দাঁড়িয়ে থাকতে না পেরে দ্বারের লোহা চেপে ধরে বালুর মাঝে বসে পড়লো বণিক। নিষ্প্রাণ দৃষ্টিতে তাকালো মহলের দিকে। বুকে চাপা কষ্ট বুঝি ধুয়ে যেতে চায় এই বৃষ্টির সাথে তাল মিলিয়ে। বুকের কাছের পাঞ্জাবীখানা খামচে ধরে মিনমিনিয়ে আওড়ালো,
“ভালো হয়ে ওঠো জোভিয়া। আমাকে এই দম বন্ধ করা অনুভূতি থেকে মুক্তি দাও।”
হাঁসফাঁস করছে বারংবার। বারবার জিজ্ঞেস করেও জোভিয়ার ব্যাপারে কোনো উত্তর মেলেনি সৈনিকদের থেকে। তারা কিছুই জানে না অথবা বলা নিষেধ। এক সময় ব্যাকুল হয়ে পাহাড়ারত সৈনিকদের উদ্দেশ্যে বলল,
“একটাবার প্রবেশ করতে দাও। কথা দিচ্ছি লুকিয়ে গিয়ে একবার দেখেই চলে আসবো। কেউ টের পাবে না।”
শুনেও না শোনার ভান ধরে রইল সৈনিকেরা। বারবার বলেও যখন উত্তর মিলল না তখনই হঠাৎ নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে চিৎকার করে উঠলো সে,
“কেন যেতে দিচ্ছ না আমাকে? কী করেছো জোভিয়ার সাথে? কেন এই লুকোচুরি? কোন অপরাধ ঢাকতে এতো কঠিন পাহাড়া?”
তবুও নিশ্চুপ সৈনিকেরা। উত্তর দেওয়ার কোনো লক্ষণই নেই তাদের মাঝে। বারবার হতাশ হয়ে, জোভিয়ার অবস্থা জানতে না পেরে অস্থিরতা বাড়ে বইকি কমে না। বসে থেকেই দ্বার সর্ব শক্তি প্রয়োগ করে দ্বার ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে পুনরায় চিৎকার করে বলল,
“খোলো, খুলে দাও দ্বার। জোভিয়াকে না দেখে যাবো না আমি। ঢুকতে দাও আমাকে।”
চিৎকার-চেঁচামেচিতে অতিষ্ঠ হয়ে এক পর্যায়ে বেরিয়ে এলো মাহতাব। বৃষ্টির বেগ কমে যাওয়ায় মহলের প্রধান দ্বারে এসে দাঁড়ালো সে। বণিকের অবস্থা দেখে মায়া হলেও বেশ রাগান্বিত স্বরে শুধাল,
“কী সমস্যা তোমার? এখানে এভাবে অসভ্যতামি করছো কেন?”
তাকে দেখতেই হন্তদন্ত হয়ে উঠে দাঁড়ালো বণিক। উদ্গ্রীব হয়ে বলে বসলো,
“জোভিয়া, জোভিয়া কেমন আছে? ঠিক আছে তো? আমি দেখবো ওকে।”
বারবার দুঃখ পেয়েও মানুষটাকে এমন পাগলামি করতে দেখে কেন যেন রাগ হলো মাহতাবের। তাই খানিক বিরক্ত কন্ঠেই বলে উঠলো,
“না, মরে গেছে। চলে যাও তুমি।”
তাকে চমকে দিয়ে আকস্মাৎ ছলছল করে উঠলো বণিকের দুই নয়ন। বৃষ্টিতে ভিজে লাল হয়ে যাওয়া চোখদুটোতে যেই হাহাকার ছিলো তা অশ্রুতে রূপান্তরিত হলো। ভেজা কন্ঠে আওড়ালো,
“তুমি জানো না সৈনিক প্রধান, এই বাক্য কতটা বিষাক্ত ছিলো। ভালোবাসোনি তুমি। বুঝবে কীভাবে এই যন্ত্রণা?”
নির্বাক হয়ে চেয়ে রইল মাহতাব। ভালোবাসেনি! সত্যিই সে ভালোবাসেনি?
বণিক পুনরায় শুধায়,
“জোভিয়া কোথায়? ঠিক আছে তো?”
“হ্যাঁ, এখন মোটামুটি শঙ্কামুক্ত তবে পুরোপুরি সুস্থ নয়।” গম্ভীর কন্ঠ মাহতাবের।
“আমাকে একবার দেখতে দেবে?”
বড্ড আকুতি নিয়ে কথাখানা বললেও গলল না মাহতাব। বরং রেগেমেগে বলল,
“ভেতরে প্রবেশ নিষিদ্ধ। আমি তোমাকে দেখার অনুমতি দিতে পারি না। এই ঝুম বৃষ্টির মাঝে কোন সুখে দ্বার ধরে বসে আছো? চলে কেন যাচ্ছ না তুমি?”
“জোভিয়াকে না দেখে যাবো না আমি।”
রাগান্বিত মাহতাব খানিকটা উচ্চস্বরেই বলে উঠলো,
“ঠিক আছে। তাহলে ভিজতে থাকো এখানে পড়ে পড়ে। কিন্তু একটা কথা জেনে রাখো। কোনো লাভ হবে না এমন পাগলামি করে। সুলতানা সুস্থ হলেও সে তোমার সাথে দেখা করবে না।”
কথা সম্পূর্ণ করেই হনহনিয়ে চলে গেল মাহতাব। কিছুদূর গিয়ে কী ভেবে আবার ফিরে তাকালো। বণিক এখনো সেভাবেই দাঁড়িয়ে আছে দ্বার ধরে, অসহায়ের ন্যায় চেয়ে আছে মহলের দিকে। হতাশার তপ্ত শ্বাস ফেলে সামনে এগোতে লাগলো মাহতাব। ভালোবাসা কী বিশ্রি জিনিস! সে কখনো নিজের হবে না জেনেও অজস্র এই পাগলামি কেবল একজন প্রেমিকের দ্বারাই সম্ভব। লোকটা বৃষ্টির মাঝে কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবে আর এভাবে? কখনো হয়তো ঢলে পড়বে বালুর মাঝে! তবুও অপেক্ষা করবে বেগমকে এক নজর দেখার জন্য। অজস্র ভালোবাসা বুকে থাকলে কী হবে? সাধ্য নেই যে এই বিশাল ফটক ভেঙে চুরমার করে দিয়ে প্রিয় মানুষটাকে দেখার! ভালোবাসা ঠিক কত রংয়ের হয়? বণিক যেই নারীকে দেখার আশায় বৃষ্টির মাঝে তড়পে যাচ্ছে ঠিক সেই নারীর সান্নিধ্য পেতে সুলতান ধ্বংস করে দেয় সবকিছু। বণিকের স্থানে সুলতান থাকলে হয়তো তার জন্য সসম্মানে খুলে দেওয়া হলো এই ফটক। নতুবা সুলতানের হাতেই চূর্ণবিচূর্ণ হতো বিশাল এই দ্বার। সুলতান নিশ্চয় বণিকের মতো অনুরোধ করতো না। বরং সৈনিকগুলো ভয়ে কাঁপতো থরথরিয়ে। তাই হয়তো বলা হয় একেক মানুষের ভালোবাসার রং-রূপ একেক রকম। ভিন্নতা রয়েছে প্রতিটা ভালোবাসায়।
যন্ত্রণায় ছটফট করছে বেগম। তার অবস্থা হুট করেই আবার খারাপের দিকে যাচ্ছে। জারনাবও চিৎকার করে কান্না করছে বোনের যন্ত্রণায়। সেবিকার মুখে এহেন কথা শুনতেই সেদিকে ছুটে যেতে লাগলো মাহতাব।
অদূরে কোথাও বিকট শব্দে ডেকে চলেছে নাম না জানা পাখিরা। পার্শ্ব সাম্রাজ্যের ধ্বংসস্তূপের মাঝেই দাঁড়িয়ে আছে ভাঙাচোরা পরিত্যক্ত মহল। শ্যাওলা জমেছে মহলের গায়ে। যার চতুর্দিকে নানারকম লতাপাতায় ছেয়ে গেছে। কাক বাসা বেঁধেছে আঙিনায়। যে কেউ এই মহল দেখলে ভয়ে শিউরে উঠবে অথচ তারই মাঝে মহলের কোনো এক আধা ভাঙা কামরায় ঢিপ ঢিপ শব্দে চলছে কারোর হৃদস্পন্দন। চারদিকের দেওয়াল ধসে পড়েছে। ছোট্ট একটা পালঙ্ক ব্যতীত কিছুই নেই সেখানে। পালঙ্কের উপর চাদর বানিয়ে পেরে রাখা হয়েছে একটি পাগড়ি। ময়লা লেগে বিশ্রি হয়ে গেলেও তা থেকে এখনো আভিজাত্য যায়নি। সেখানে শায়িত বেহুঁশ পুরুষের শরীরের ময়লা পোশাক, অবহেলায় বেড়ে ওঠা বড়বড় চুল-দাঁড়ি, নোংরা নখ থেকে শুরু করে অপরিষ্কার শরীর, সবকিছুই যেন তার অপার সৌন্দর্য ঢেকে দিয়েছে। মুড়িয়ে ফেলেছে মানুষটাকে। কামরার চতুর্দিকে তলোয়ার হাতে পাহাড়ারত রয়েছে বেশকিছু সৈনিক। তাদের পোশাক পরিচ্ছদ বলে দিচ্ছে তারা উত্তরীয় সাম্রাজ্যের সেনা। কামরায় পড়ে থাকা বিভিন্ন গাছগাছালির শিকড়-বাকড়, ছোট্ট ছোট্ট শিশি ভর্তি অজানা পাতার রস, ঔষধি গাছের বাকলসহ চিকিৎসার নানান সামগ্রী প্রমাণ কথে দিচ্ছে এই ভাঙাচোরা পরিত্যক্ত মহলে দীর্ঘদিন ধরে কারোর চিকিৎসা চলছে।
ধীরে ধীরে বেশ অনেকটা সময় অতিবাহিত হয়েছে কিন্তু এই চিকিৎসার যেন শেষ হয়না। কতগুলো মাস ধরে উত্তরীয় সৈনিকরা এখানে এসে পাহাড়ায় রয়েছে। আকস্মাৎ আজ সমস্ত অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে চোখ মেলে তাকালো শায়িত পুরুষ। এক দন্ড দেরি না করেই ধীরে সুস্থে উঠে বসে নিজের শরীরের দিকে তাকাতেই চমকাল যেন। জোর হাতে শরীরের বিভিন্ন ক্ষতস্থানে লাগানো শেকড়-বাকড় টেনে খুলে ফেলল। তা দূরে ছুড়ে ফেলে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে থাকলো নিজেকে। ক্ষতচিহ্নগুলো যে তীরের ফলার কারনেই সৃষ্টি তা চিনতে বিন্দুমাত্র কসরত করতে হলো না। আশপাশে নজর বুলিয়ে নিজের অবস্থান বোঝার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলো। উঠে দাঁড়াতে কিছুটা সময় নিলো সে। অধির আগ্রহ নিয়ে আশেপাশে খোঁজ করলো কারোর। কাউকে না পেয়ে সহসাই ডেকে উঠলো,
“এলি, এলি।”
কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে আবারো ডাকলো,
“এলি।”
বারবার ডেকেও আসলো না সেই নারী। সাড়া দিলো না তার ডাকে। বরং তাকে উঠতে দেখে খুশি হয়ে এগিয়ে এলো সৈনিকেরা। বেগমের বদলে হুট তাদের এগিয়ে আসতে দেখে ক্রোধ ফুটে উঠলো পুরুষের চেহারায়। আচমকাই এক সৈনিকের গলা চেপে ধরলো। তলোয়ার কেড়ে নিয়ে হুংকার ছেড়ে বললো,
“তোরা কারা? এলি কোথায়? বল, কোথায় এলি?”
হন্তদন্ত হয়ে পাশের সৈনিকরা ছুটে এলো। নমনীয় কন্ঠে বলল,
“শান্ত হন সুলতান। আমরা আপনার শত্রু নই। আমরা উত্তরীয় সাম্রাজ্যের সেনা। আপনার সুরক্ষায় এখানে পাহাড়ায় ছিলাম এতোদিন।”
উত্তরীয় সাম্রাজ্যের সেনা শুনেও শান্ত হতে পারে না সুলতান। হাতে জোর প্রয়োগ করে আরোও ঝাঁঝালো কন্ঠে শুধাল,
“কে নিযুক্ত করেছে তোদের?”
“শেহজাদি এলিজা, আপনার বেগম।”
সাথে সাথেই সৈনিকের গলা ছেড়ে দিলো সুলতান। রাগ নিয়ন্ত্রণ করে শান্ত হয়ে বসলো পালঙ্কে। আশপাশ পর্যবেক্ষণ করতে করতে শুধায়,
“এটা কোন জায়গা? আমার মহলে কেন চিকিৎসা করা হয়নি আমার? এই ধ্বংসস্তূপের মাঝে কেন ফেলে রাখা হয়েছে?”
“এটা পার্শ্ব সাম্রাজ্যের ভাঙা মহল। যেটা যুদ্ধের সময় ভেঙে ফেলা হয়েছিলো। এখানেই এতদিন গোপনে আপনার চিকিৎসা চলেছে এবং চিকিৎসায় ব্যবহৃত প্রতিটা জিনিস উত্তরীয় সাম্রাজ্যের। রামান সাম্রাজ্যের কারোর নিকট আপনার জীবিত থাকার খবর নেই। সেখানে সকলের নিকট মৃত আপনি। শেহজাদি এলিজা সমস্ত ব্যবস্থা করে আমাদের এখানে রেখে গেছে। সেই সাথে আপনার সম্পর্কিত সমস্ত তথ্য গোপন রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে আমাদের।”
“কেন?” অবাক হয়ে শুধাল সুলতান।
“তার উত্তর আমাদের নিকট পাবেন না আপনি। আমাদের যতটুকু বলা হয়েছে ততটুকুই করেছি আমরা।”
“এলি নেই কেন এখানে? এলি কেন চলে গেছে আমাকে ছেড়ে?”
উদ্গ্রীব সুলতানকে বলার মতো কোনো উত্তরই ছিলো না সৈনিকদের নিকট। তাই তারা নীরব রইল। হঠাৎ কিছু একটা ভেবে সুলতান আবারো আকুল কন্ঠে শুধাল,
“আমার সন্তান?”
“যতদূর জানতাম শেহজাদি তোহফা ভালো আছেন। কিন্তু কিছুদিন হলো রামান সাম্রাজ্যের সাথে আমাদের সকল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। শেহজাদি এলিজার পক্ষ থেকে কোনো বার্তা পাচ্ছি না আমরা। তাই আমাদের কাছে আপনার অনাগত সন্তান সম্পর্কে কোনো তথ্য নেই। তবে হয়তো তার ভূমিষ্ঠ হবার সময় এসে গেছে।”
চোখদুটো চিকচিক করে উঠলো সুলতানের। তার সন্তান!
বিকেল হতেই আকাশের ঘন কালো মেঘ কেঁটেছে। সূর্য লাল রূপ ধারণ করেছে। বৃষ্টির ছিটেফোঁটাও নেই এসময়। চতুর্দিকে লালচে আভা। বণিকের পিছু করে আসা নাবিক গাছের সাথে শরীর এলিয়ে দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো। মাত্রই সে দেখে এসেছে বণিক এখনো ঐ দ্বারের সামনে দাঁড়িয়ে বেগমকে ডেকে চলেছে। হঠাৎ পার্শ্ব সাম্রাজ্যের দিক থেকে নোংরা কাপড় পরিহিত কাউকে ঘোড়ায় চড়ে আসতে দেখে সন্দেহ নিয়ে পথ আটকে দাঁড়ালো। চোখ বড়বড় করে জানতে চাইল,
“তোমার পোশাক আর চেহারার হাল দেখে তো মনে হচ্ছে না এই ঘোড়ার মালিক তুমি? চুরি করেছো? আর পার্শ্ব সাম্রাজ্যে যাওয়া নিষেধ তুমি জানো না? ওদিকে কী করছিলে?”
মাঝ রাস্তায় থামিয়ে হুটহাট বাজে প্রশ্ন করাতে কিছুটা বিরক্ত হলো মানুষটা। তবুও একবার নিজের পোশাকের দিকে নজর দিলো। আসলেই অনেক নোংরা হয়ে আছে। মুখ তো চুল-দাঁড়িতেই ঢেকে গেছে। তাকে চেনার কোনো অবকাশই বাকি রাখেনি এলি। অন্তত চুল, দাঁড়ি, নখ এসব তো পরিষ্কার রাখতে পারতো। ছি ছি! তার ভাবনার মাঝেই নাবিক আবারো শুধাল,
“কী হলো? কথা বলছো না কেন? কোথায় যাচ্ছ? আর এই ঘোড়া কার?”
“আমার শশুড়ের।”
“ছি ছি! তুমি শশুড়ের জিনিস ব্যবহার করো? লজ্জা করে না?”
“না, লজ্জা করে না। আর কোনো প্রশ্ন?” বিরক্ত হচ্ছে মানুষটা।
নাবিক পুনরায় শুধাল,
“কোথায় যাচ্ছ?”
“মহলে।”
চোখ কপালে তুলল নাবিক। অবাক হয়ে বলল,
“কিহ! শোনোনি? মহলে বহিরাগতদের প্রবেশ নিষিদ্ধ। যাও যাও, নিজ গৃহে ফিরে যাও।”
কথা বাড়াতে চাচ্ছিলো না সুলতান। তাই বলল,
“কাজ আছে। পথ ছাড়ো।”
নাবিক এবার বিলাপ করেই বলে উঠলো,
“তোমার জায়গায় আমি হলে ঐ মহলে তো মরে গেলেও পা রাখতাম না। ছি! সম্রাজ্ঞীর চরিত্র এমন হলে সাম্রাজ্যবাসী কী শিক্ষা পাবে?”
ভ্রু কুচকে চাইল সুলতান। ভাবলো হয়তো ভুল শুনছে। তাই পুনরায় শুধাল,
“কী বললে? সম্রাজ্ঞীর চরিত্র এমন মানে?”
“পুরো সাম্রাজ্যের সবাই জেনে গেছে আর তুমি জানো না? কোন লোকে থাকো ভাই? আমাদের জাহাজের বণিক আবরার জাওয়াদ আর সম্রাজ্ঞী এলিজার গোপন সম্পর্ক চলছে। বণিক তো সেই কাল থেকে মহলের সামনে গিয়ে বসে আছে সম্রাজ্ঞীকে দেখার জন্য। চিন্তা করেছো, কতটা খারাপ চরিত্র এই সম্রাজ্ঞীর। এমন সাম্রাজ্যে বাস করছি আমরা।”
নাক সিটকে একটানে বলে গেল নাবিক। অথচ একটাবার তাকিয়ে দেখলো না সামনের মানুষটার ক্রোধান্বিত মুখশ্রী। তখনই সুলতান আক্রোশে গর্জে উঠলো,
“মুখে লাগাম দে।”
হুট করে গর্জে ওঠাতে চমকে গেল নাবিক। এভাবে চিৎকার করার কী হয়েছে? হতবাক স্বরে শুধায়,
“তোমার আবার কী হলো? খারাপ চরিত্র তো খারাপ বলবো না! আমি নিজ চোখে দেখে এসেছি। সম্রাজ্ঞী এলিজার চরিত্র এমন নোংরা হবে আমি তো বিশ্বাসই করতে পারিনি।”
ঘোড়া থেকে নেমে নাবিকের কাছে এগিয়ে এলো সুলতান। নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করে বলল,
“এসব ভুল ধারণা। সম্রাজ্ঞী এলিজার প্রতিটা শ্বাস-প্রশ্বাস পবিত্র।”
“রাখো তোমার পবিত্র? যা দেখেছি তাই বলছি। আমিতো বারবার বলবো সম্রাজ্ঞীর এলিজা নোংরা চরিত্রের একজন নারী। যে কি-না সামান্য বণিকের সাথে পরকীয়া স্থাপন করে তার আবার পবিত্রতা!”
অতিরিক্ত রাগ নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলো সুলতান। ঘাড় সামান্য বেকিয়ে কিছুক্ষণ চেয়ে রইলো নাবিকের দিকে। আকস্মাৎ নাবিকের খুব কাছে এসে হিসহিসিয়ে বলে উঠলো,
“আমাকে চিনিস তুই?”
তার লাল লাল চোখদুটো দেখে হুট করেই যেন ভয় বাসা বাঁধলো নাবিকের হৃদয়ে। পিছিয়ে গেল কয়েক পা। ভীত অথচ রাগান্বিত কন্ঠে বলে উঠলো,
“এরকম করছো কেন? কে তুমি? চেনার কী আছে তোমাকে? সম্রাজ্ঞী এলিজার সাথে তোমারও গোপন সম্পর্ক আছে……………..”
বাক্য আর সম্পূর্ণ করা হলো না নাবিকের। পূর্বেই তার গলা চেপে ধরেছে সুলতান। ক্রোধের শেষ সীমানায় পৌছে হাতে আরোও বল প্রয়োগ করলো। জমিন থেকে সামান্য উঁচু করে ধরে হুংকার ছেড়ে বলল,
“আজই ফিরে আসলাম আর আজই আমার হাতে মরতে চলে আসলি? তোর ভাগ্য ভালো যে আমার নিকট কোনো অস্ত্র নেই। নয়তো এতো সহজভাবে মরা হতো না তোর।”
দুই হাতে টেনেও সুলতানের হাত সরাতে পারছে না নাবিক। গরগর শব্দ ছাড়া মুখ দিয়ে একটা কথাও উচ্চারিত হচ্ছে না। শ্বাস নিতে না পেরে চোখদুটো বড়বড় করে শুধুই ছটফট করছে। কিছুক্ষণ এভাবে চলার পর শ্বাস যখন বন্ধ হবার উপক্রম তখনই তাকে সজোরে মাটিতে আছড়ে ফেলল সুলতান। নাবিকের ভিতু চেহারাখানা দেখতে তার দিকে ঝুঁকে এসে ভয়ঙ্কর কন্ঠে বিড়বিড়িয়ে আওড়ালো,
“বল সম্রাজ্ঞী এলিজা পবিত্র।”
“হুঁ?” মাটিতে বসেই পেছাতে পেছাতে হতবাক হয়ে বলল নাবিক।
“বল।” চিৎকার করে উঠলো সুলতান।
“হ্যাঁ হ্যাঁ, সম্রাজ্ঞী এলিজা পবিত্র। সে নিষ্পাপ। আমাকে ছেড়ে দাও।”
আকুতির কন্ঠে বলল নাবিক। তখনই তাকে অবাক করে দিয়ে বাঁকা হাসলো সুলতান। রহস্য করে পুনরায় বলল,
“ছেড়েই তো দিয়েছি। আমার হাতে তো কোনো অস্ত্রই নেই।”
সুলতান বেশ শান্ত স্বরে কথাখানা বললেও তাকে এতো কাছ থেকে দেখে যেন কিছু একটা ঠাহর করলো নাবিক। বড়বড় চুল দাঁড়ির আড়ালে ঢাকা চেহারাখানা ভালো মতো লক্ষ্য করে আমতা আমতা করে আওড়ালো,
“কককে তততুমি?”
উত্তর আসলো না অপরপাশ থেকে। বরং ক্রমশ এগিয়েই আসছে সুলতান। এক পা, দু’পা করে নাবিকের মাথার কাছে এসে দাঁড়ালো। সুলতান যত ঝুঁকে আসছে তার দিকে ততই হতভম্ব হচ্ছে নাবিক। পূর্বের তুলনায় আরোও বিস্মিত হলো তার নয়নজোরা। শেষবারের মতো কাটা কাটা স্বরে আওড়ালো,
“সুলতান শাহজাইন শাহ।”
চলবে……