#সম্রাজ্ঞী
#লিয়ানা_লিয়া
#পর্ব_55
মাইরাকে দাফনের জন্য মহলের নিজস্ব কবরস্থানে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। সুলতান, মাহতাবসহ মহলের প্রতিটা পুরুষ সেখানে উপস্থিত। নারীরা যথারীতি প্রধান ফটকের ভেতর থেকেই লোহার শিক গলিয়ে অদূরের খাঁটিয়ার দিকে চেয়ে রইল। কবরস্থানে নারীদের যাবার অনুমতি নেই। উত্তরীয় সাম্রাজ্য থেকে মাইরার পিতা-মাতাও চলে এসেছে সৈন্যসমেত। তবে মৃত্যুর অনেক সময় পেরিয়ে যাওয়ায় আর পানিতে ভাসমান থাকায় লাশের অবস্থা খুব ভালো নয়। তাই লাশ উত্তরীয় সাম্রাজ্যে নেওয়ার সাহস করলো না কেউ। এখানেই দাফনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। সুলতান ইহসান অশ্রুসিক্ত নয়নে নিজ কন্যার দাফনে অংশগ্রহণ করেছেন। সেখানে উপস্থিত আছেন সুলতানের পিতা শাহজিলও। চতুর্দিকে কেমন শোক শোক রব। বিশাল কবরস্থানের রাজকীয় দ্বার খুলে সকলে যখন খাঁটিয়া নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করছে। জানাজার ব্যবস্থা শুরু হয়েছে। তখনই আকস্মাৎ ঘন কালো নিকষ মেঘে ছেয়ে যায় গগণ। শোক প্রকাশে উদ্বিগ্ন হলো রামান সাম্রাজ্যের আকাশ-বাতাস। অসময়ের ঝড়ো হাওয়ায় এলোমেলো হচ্ছে সবকিছু। পোশাক উড়ছে উর্ধ গগণে। প্রকৃতি নারাজ! কিন্তু কেন? এ কেমন খেল দেখাচ্ছে প্রকৃতি? ভ্রু কুচকাল সুলতান। বিড়বিড়িয়ে অকপটে বলল,
“প্রকৃতি শোকাহত। হাহ! সে একজন অপরাধী ছিলো!”
প্রত্যুত্তরে কেউ যেন গায়েবি স্বরে কপট রাগ দেখিয়ে আওড়ালো,
“নিষ্ঠুর সুলতান। সে তোমার আত্মীয়, তোমার মেহমান। শুধুমাত্র নিজের বেগমকে বাঁচাতে কারোর মৃত্যুতে খুশি হচ্ছো তুমি! এই তোমার মানবতা? কোথায় তোমার মনুষ্যত্ব?”
“অপরাধীর কোনো ক্ষমা নেই আমার নিকট।”
শক্ত, কঠিন উত্তর সুলতানের। চোয়ালদ্বয় শক্ত হলো মাইরার কুকর্ম মনে করে। বেগমকে হত্যা করতে চেয়েছিল! এতোবড় সাহস!
“তুমিও তো কম নির্মমতা দেখাওনি বেগম এলিজার খাতিরে? সেও লোভে পড়ে অন্যায় করেছে। তাছাড়া সে এখন মৃত! এখন তো অন্তত ঘৃণা করা ছেড়ে দাও।”
“মৃত ব্যক্তিকে ক্ষমা করা যায়, দোয়া করা যায় কিন্তু ঘৃণা কী আর মেটানো যায়?”
কথাখানা অস্ফুটে উচ্চারণ করে নারাজ সুলতান তিক্ত চোখে চেয়ে রইল মাইরার খাঁটিয়ার দিকে। মাইরার কারনামা চাইলেও ভুলতে পারে না সুলতান। সে এমন এক নারী যে তার বেগমের ক্ষতি চেয়ে গেছে চিরজীবন। এমনকি এলিকে হত্যারও চেষ্টা করেছে! তার বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিয়েছে উমারকে। দারিয়ার সঙ্গে হাত মিলিয়েছে! মহল থেকে নথি চুরি করে শত্রুর হাতে তুলে দিয়েছে। আর কত অন্যায়? কত অন্যায়ের শাস্তি মওকুফ করবে সুলতান? তবুও তো তাকে হত্যা করেনি এলির কথাতে। বন্দি করে রেখেছিল। মাহতাবকে বলেছিলো সাম্রাজ্যের শেষ সীমানায় তার নির্মানকৃত একটি গৃহ আছে সেখানে মাইরাকে বন্দি বানিয়ে রাখতে। মাইরা বেরিয়ে আসলো কীভাবে? আর তাকে হত্যা করলো কে? কোন উদ্দেশ্যে? তার চেয়ে বড় কথা মাইরা বন্দিদশা থেকে মুক্ত হলো কীভাবে? এমনকি মাহতাব মাইরার লাশ নদী থেকে ওঠানোর সময়ও সেখানে উপস্থিত ছিলো না। এর উত্তর সে মাহতাবের থেকে নেবে মহলে ফিরেই।
কী আশ্চর্য! আজ এই শোকের দিনেও মাহতাব সকলের অগোচরে কবরস্থান ছেড়ে বেরিয়ে এলো। দ্বারের বাইরে থেকে সরু চোখে তাকালো মাইরার খাঁটিয়ার দিকে। অধর বাঁকিয়ে তাচ্ছিল্য হাসলো। সুলতানের অনুমতির তোয়াক্কা না করে হাঁটা দিলো মহলের উদ্দেশ্যে। পার্শ্ব সাম্রাজ্য থেকে সুলতান ফিরে আসার পর থেকেই মাহতাবের এই ধৃষ্টতা! সুলতানের আশেপাশে তাকে খুব কমই দেখা যায় এখন। যখন যেখানে ইচ্ছা চলে যায়। কারোর অনুমতির অপেক্ষা করে না সে। গটগট পায়ে জানাজা ছেড়ে চলে যায় মাহতাব। সৈনিকরা কয়েকজন লক্ষ্য করলেও প্রশ্ন তুলবে কে? সাহস কোথায় এতো?
অচেতন বেগমকে কামরায় শুইয়ে রেখে গেছে সুলতান। এই দূর্বল অবস্থায় বেগম পুনরায় মাইরার জন্য কান্নাকাটি করে নিজের শরীরের অবস্থা আরোও খারাপ করুক তা সে চায় না। তাই বেগম জেগে ওঠার পূর্বেই দাফনের প্রয়াস। অথচ সে জানতেও পারলো না তার অনুগত সেবিকা বেগমকে বিষমিশ্রিত শরবত পান করতে দিয়েছিল। সেবিকা বড্ড চতুরতার পরিচয় দিয়েছে বটে। সকলে যখন মাইরাকে নিয়ে ব্যস্ত তখনই আস্তে করে পাত্র তুলে নিয়েছে বেগমের কামরা থেকে। তবে প্রশ্ন তো থেকেই যায়। সেবিকা কার হুকুমে করেছে এসব? কে মারতে চায় বেগমকে?
নিভু নিভু চোখে পল্লব মেলল বেগম। পালঙ্ক ছেড়ে মাথা তুলতেই দূর্বলতা অনুভব করলো। পাশ ফিরে পুনরায় শরীর এলিয়ে দেয় পালঙ্কে। আফসোস হলো নিজের প্রতি। আবার কবে পূর্বের ন্যায় শক্তি সামর্থ ফিরে পাবে? কবে এই দূর্বলতা কাটিয়ে উঠবে? ঘোর কাটতে মস্তিষ্ক সজাগ হলো। স্মৃতিতে হানা দিলো মাইরার মৃতদেহ। মাইরার গলায় আঁকা গভীর ক্ষতচিহ্ন। বেগমের অশ্রুসিক্ত দুই নয়ন বোনের শোকে, দুঃখ-কষ্টে জর্জরিত হলো। ডুকরে কেঁদে উঠলো হৃদয় আঙিনা। হুট করে স্বরণে এলো মাইরার ক্ষতচিহ্ন। একবার, দু’বার, বারবার স্মৃতিতে ভাসতে লাগলো সেই ক্ষত। সাম্রাজ্যের খাতিরে কম লাশ দেখেনি। ক্ষতচিহ্নের সমস্ত ধরন যেন নখদর্পণে তার। হত্যাকারী বাম হাতে তলোয়ার চালিয়েছে এতে কোনো সন্দেহ নেই। দ্রুত কামরা থেকে বেরিয়ে এলো মাইরার খোঁজে। মাইরাকে এক পলক দেখার আশায়। অথচ তার সমস্ত আশা ধূলিসাৎ হলো যখন শুনলো মাইরাকে দাফনের জন্য নিয়ে যাওয়া হয়েছে বেশ খানিকটা আগেই। থামলো না বেগম। একরাশ আশঙ্কা আর হতাশা সাথে নিয়ে পৌঁছালো মাহতাবের কামরায়। দ্বারে করাঘাত করে দূর্বল কন্ঠে ডাকলো,
“মাহতাব।”
ভেসে এলো মাহতাবের গম্ভীর পুরুষালি কন্ঠ,
“আসুন।”
দ্বার ঠেলে ভেতরে এসেই বেগম তড়িৎ প্রশ্ন ছুড়ে দিলো,
“কে তুমি?”
পালঙ্কে বসে আনমনে জারনাবকে নিয়ে ভাবছিলো মাহতাব। হঠাৎ বেগমের এহেন প্রশ্নে চকিতে ফিরলো। অবাক হয়ে শুধাল,
“কী বলছেন সুলতানা? আমি মাহতাব। আপনি চিনতে পারছেন না আমাকে?”
“আমি তোমার নাম জানতে চাইনি জালিম। তোমার আসল পরিচয় জানতে চেয়েছি?”
মৃদু চিৎকার করলো বেগম। রাগে থরথর করে কাঁপছে সে। নয়ন তখনো নোনাজলে ভেজা। কন্ঠ ধরে আসছে।
মাহতাব হতভম্ব স্বরে শুধাল,
“আমার পরিচয় মানে!”
“তোমার পরিচয় মানে তোমার পিতা-মাতা? তোমার নিজের অস্তিত্ব কোথায় এই মহল ছাড়া?”
মাহতাব উৎসুক চোখে তাকালো বেগমের দিকে। ভ্রু কুচকে কয়েক পল কেবল চেয়েই রইল। বেগম পুনরায় রাগে ধ্যান-জ্ঞান ভুলে ক্ষিপ্ত হয়ে বলল,
“মাইরাকে কেন হত্যা করেছো?”
“মাইরাকে আমি কেন হত্যা করতে যাবো? আপনি ভুল ভাবছেন সুলতানা। আমার মনে হয় আপনার বিশ্রাম প্রয়োজন।”
বলতে বলতে কয়েক পা এগিয়ে আসলো মাহতাব। হাত বাড়িয়ে থামিয়ে দিলো বেগম,
“দাঁড়াও! খবরদার আমার কাছে আসবে না। আপন সেজে অনেক ধোঁয়াশায় রেখেছো এতোদিন। আর নয়। এবার তো নিজেকে প্রকাশ করো।”
“আপনার কোথাও ভুল হচ্ছে…..”
“ভুল এতোদিন হয়েছে তোমাকে বিশ্বাস করে। এই সাম্রাজ্যে একমাত্র তুমিই আছো যার বাম হাতে ডান হাতের তুলনায় বল বেশি। বাম হাতে তলোয়ার তুমিই চালাও সেকথা সকলেই জানে। আর মাইরার ক্ষত স্পষ্ট বলে দিচ্ছে শক্তিশালী কেউ বাম হাতে তলোয়ার চালিয়েছে। একাজ তুমি ছাড়া আর কে করবে? বলো? কেন মেরেছো আমার বোনকে? আর কী অজুহাত দেখাবে?”
নিজ স্থানে ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইল মাহতাব। কয়েক মুহুর্ত নির্বাক, নিষ্প্রাণ দৃষ্টিতে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলো। বেগমের কঠিন অথচ যন্ত্রণায় জর্জরিত মুখের দিকে চেয়ে হঠাৎই অধর বাকালো। মেকি হাসলো। তীক্ষ্ম হলো ঐ চোখের চাহনি। রামান সাম্রাজ্যের সাহসী বীর যেন শয়তানের আদলে আবির্ভূত হলো এক নিমেষে। মস্তক বাঁকিয়ে তাচ্ছিল্য করে বলল,
“হুহ! জেনে গেছে। গুপ্ত শত্রুকে ধরে ফেলেছে সম্রাজ্ঞী।”
বেগমের নির্বিকার ভঙিমা পর্যবেক্ষণ করে কর্কশ শব্দে হেসে উঠলো শব্দ করে। নির্মম, নিষ্ঠুর সেই হাসি। হাসতে হাসতে ঢলে পড়ার জোগাড়। পেটে খিল ধরবে যেন হাসতে হাসতেই। আচমকা হাসি থামিয়ে চোয়ালদ্বয় কঠিন করে তুলল। নির্দয় স্বরে দৃষ্টি শক্ত করে বলল,
“দেরি করে ফেলেছিস তুই।”
“মাহতাব!”
বিস্ময়ে স্বর আটকে আসছে বেগমের। সে তো শুধু মাইরার খুনের কথা জানতে চেয়েছিল। অথচ মাহতাব কী বললো? গুপ্ত শত্রু! মাহতাব নিজে সেই শত্রু যার তালাশ এতদিন ধরে করা হচ্ছে! মহলের ভেতর শত্রু নিয়ে এতোদিন কিনা তারা শত্রু তালাশ করে বেরিয়েছে! ধীরে ধীরে ভাসতে লাগলো সেইসব স্মৃতি যেগুলোকে তারা অতি সহজেই বিশ্বাসের দরুন উপেক্ষা করে গেছে। হাফসার থেকে উদ্ধার করা সেই চিঠি! সকলে যখন লেখনী দিচ্ছিলো মাহতাব সেদিন বাম হাত ছেড়ে ডান হাত দিয়ে লিখেছিলো। পার্শ্ব সাম্রাজ্যে যখন তাদের উপর আক্রমণ হয়েছিলো তখনও মাহতাবই জানতো তারা ওখানে একা আছে। কারাগারের চাবি মাহতাবের নিকট থাকায় সহজেই কারাগারে ঢুকে ফয়েজ আর হাফসাকে হত্যা করতে পেরেছে। কেন এতোদিন এসব লক্ষ করলো না বেগম? অতিবিশ্বাস আজ তাদের ধংস বয়ে আনলো। মাহতাব পুনরায় রুক্ষ কন্ঠে জাহির করলো,
“হ্যাঁ আমিই সে। যাকে তোরা এতোদিন ধরে খুঁজে যাচ্ছিস। কত বোকা তোরা? কতই না বিশ্বাস করেছিলি আমাকে। মাইরার ব্যপার যখন জেনেই গিয়েছিস তখন আর ভনিতা করে লাভ নেই। অনেক বর্ষ অপেক্ষা করেছি আমি। এখন সময় এসেছে নিজের উদ্দেশ্য পূরণ করবার।”
বিস্ময়ে বাকরুদ্ধ বেগম। এতোবড় বিশ্বাসঘাতকতা! পুরো শরীর অবশ হলো এই কঠিন সত্যের মুখোমুখি হয়ে। মাহতাব আবারো বলল,
“কতবার তোদের মারার চেষ্টা করেছি। কিন্তু খোদা তোদের কী ভাগ্য দিয়েছে! সালাম সেই ভাগ্যে! বারবার বেঁচে গিয়েছিস। আরেহ মাইরা তোকে হত্যার পরিকল্পনা একা করেনি। তার সাথে আমিও ছিলাম। আমিই তাকে ইন্ধন জুগিয়েছি তোকে হত্যা করে সাম্রাজ্য দখল করতে। ঐ বোকা মেয়েটা আমার সমস্ত পরিকল্পনায় পানি ঢেলে দিয়েছে। আর ফয়েজ! ওহ হ্যাঁ ফয়েজের কথা তো বলাই হয়নি। ওকেও আমিই হত্যা করেছি। ফয়েজ বারবার সুলতানকে বলতে চেয়েছে কিন্তু বেচারার দুর্ভাগ্য! সেসময় সুলতানের সাথে আঠার মতো লেগে থাকতাম আমি। অবশেষে সুযোগ বুঝে শেষ করে দিয়েছি। তোহফাকেও মারতে চেয়েছিলাম তবে তোর মেয়েটা ভারী মিষ্টি! বারবার কী আদুরে স্বরে চাচ্চু বলে ডাকে তাই মায়া জন্মে গেল। ছেড়ে দিলাম। আর হাফসার মৃত্যু তো অবধারিত ছিলো।”
“মাইরাকে কেন মারলে তুমি?”
“ওকে তো মরতেই হতো একদিন। আমার সমস্ত রহস্য জানতো যে তোর বোন। শেষে কিনা তোদেরকে জানিয়ে দিতে চাইল সবকিছু? প্রতারণা করতে চেয়েছিল আমার সাথে তাই মেরে দিয়েছি। আগের হত্যাগুলো পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী ডান হাত দিয়ে করলেও মাইরার বেলায় রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারিনি আমি। ফলস্বরূপ বাম হাতে তলোয়ার চালিয়ে ধরা পড়ে গেলাম তোর নিকট। যায় বলিস, চালাক আছিস তুই। চতুর সম্রাজ্ঞী! কীভাবে চালাকি করে সুলতানের মৃত্যু ঘোষণা করলি। পার্শ্ব সাম্রাজ্যে লুকিয়ে বাঁচিয়ে দিলি ওকে। ওকে তো আজ হোক কাল হোক মরতেই হবে। তুই খুব ভালোবাসিস নিজের স্বামীকে? আজ তোর মৃত্যুর পর কে বাঁচাবে তোর স্বামীকে। সে তো জানেও না আমিই তার সবচেয়ে বড় শত্রু। তোকে মারার পরিকল্পনা অবশ্য বাদ দিয়েছিলাম জুঁই মহলে আসার পরে। সে যে বড্ড ভালোবাসে তোকে। খুব কষ্ট পাবে তোর মৃত্যুতে। যাকগে! আমি সামলে নেবো।”
“বুবু! বুবুর প্রতি তোমার ভালোবাসাও কি মিথ্যে ছিলো মাহতাব? কী নিখুঁত অভিনেতা তুমি!”
“উঁহু, নাহ। ভুল ভাবছিস সম্রাজ্ঞী। জুঁইকে আমি ভালোবাসি। আমার জীবন, আমার প্রতিশোধ সবকিছুর উর্ধে গিয়ে ভালোবাসি তাকে। আমার গোটা জীবন যখন মিথ্যার বেড়াজালে আবদ্ধ তখন সেখানে একটাই সত্যি ছিলো। তা হলো জুঁই! আমার জুঁই। জানি না ঐ সাহাদটা কবে, কীভাবে ওর মনে স্থান করে নিলো। তবে নিয়তি! ওকে শহীদ করে বাঁচিয়ে দিলো আমার হাত থেকে।”
“কীসের প্রতিশোধ? সুলতান কী ক্ষতি করেছে তোমার? কেন মারতে চাও আমাদের?”
“সুলতান শাহজাইন! লোকটা তোকে খুব ভালোবাসে। বেগমকে কীভাবে ভালোবাসতে হয় সেটা তার থেকেই শেখা উচিত। কিন্তু আমার সাথে যে অন্যায় করেছে ওর পিতা-মাতা তার জন্য তো ওকে মরতেই হবে। প্রতিশোধের গল্প শুনবি? আমার অনাথ হবার গল্প?”
নিষ্প্রাণ দৃষ্টিতে অপলক চেয়ে আছে বেগম। এতো সত্য হজম করা চাট্টিখানি কথা নয়। তবুও মুখিয়ে রইল প্রতিশোধের কারন জানতে। যুদ্ধ করার মতো অবস্থা তার শরীরের নেই এখন। দূর্বল শরীর একটা তলোয়ার হয়তো দু’বারের বেশি নাড়াতে পারবে না। কথার জালে আটকে আচমকা আক্রমণ করে বসলো মাহতাব। নিজের পাগড়ি দিয়ে চেপে ধরলো বেগমের মুখ। মুখ বেঁধে দিয়ে কোনোরকম নড়াচড়ার সুযোগ না দিয়ে টেনে খুলে নিলো বেগমের হিজাব। হিজাব দিয়ে হাত বেঁধে দিয়ে ছুটে গিয়ে দ্বার বন্ধ করে দিলো। শক্তিশালী নির্মম হাতে বেগমের গলা চেপে ধরলো আক্রোশে। ক্রোধে চোখদুটো লাল হয়ে উঠেছে মাহতাবের। খুন চেপেছে ওর মাথায়। কঠিন কন্ঠে হিসহিসিয়ে বলল,
“তোকে কেন বলবো প্রতিশোধের কারন। এতো সময় নেই আমার। দাফন শেষ হলেই মহলে চলে আসবে তোর স্বামী।”
লজ্জায়, ঘৃণায় মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছে করলো বেগমের। ছলছল চাহনি আজ রুক্ষ হলো না। কেবল মনে হলো, আজ তাকে বাঁচতে হবে। যেভাবেই হোক বাঁচতে হবে। আজ সে হার মেনে নিলে এই শয়তানটা সুলতানকে ছাড়বে না। আপন সেজে ছুড়ি বসাবে তার ভালোবাসার শরীরে। বাঁচতে হবে। সুলতানকে জানাতে হবে সমস্ত সত্যি। গলা চেপে বেগমকে দেয়ালে ছুড়ে ফেলল মাহতাব। কপাল ফেটে গড়গড়িয়ে রক্ত বেরিয়ে এলো। ব্যথায় বেগমের করা আর্তনাদ মুখের বাঁধনের আড়ালে লুকিয়ে গেল। আজ ফের বিবর্ণ হলো বেগমের দুনিয়া। প্রকৃতি বুঝি সেসময় বিদ্রুপ করে সুলতানকে জানান দিলো,
“প্রকৃতির এই নিকষিত রূপ, এই শোক ঐ অপরাধী মাইরার জন্য নয় সুলতান। তোমার বেগমের পবিত্র সত্তার যন্ত্রণায় প্রকৃতি আজ নাখোষ!”
মাহতাব পুনরায় নির্দয় হাতে বেগমের চুলের মুঠি চেপে ধরলো। টেনে উঠিয়ে বসালো। যন্ত্রণায় চোখ বন্ধ করে নিলো বেগম। তাকে কষ্ট পেতে দেখে ক্রুর হাসে মাহতাব। আরোও কষ্ট দিতে বেগমের নরম চোয়াল বলিষ্ঠ হাতে ঠেসে ধরলো। শয়তানি হেসে বলল,
“মৃত্যুর পূর্বে আরেকটা কথা জেনে যা। আমি শুধু ফয়েজ, হাফসা আর মাইরাকেই হত্যা করেছি এখন পর্যন্ত। কিন্তু বাগানের ঐ ক্ষত বিক্ষত সৈনিকের লাশ কীভাবে এসেছে আমি জানি না। ওদের বিভৎসভাবে কে মেরেছে তাও জানি না। আর তোরা সবগুলো খুনের দায় আমার উপর দিয়ে বসে আছিস। আমি কেন লাশ খুবলে খেতে যাবো। থুহ!”
ধারালো নখ দেবে ক্ষত সৃষ্টি হলো বেগমের অধরকোনে। রক্ত দেখে শান্তি পেল মাহতাব। হাতে আরোও বল প্রয়োগ করে ভেঙে দিতে চাইলো নরম চোয়াল। অন্যহাতে চুলের মুঠি ধরে টেনে উঠিয়ে সজোরে থাপ্পড় মেরে বসলো। কী নির্মম! বেগমের সুন্দর গালে পাঁচ আঙ্গুলের ছাপ স্পষ্ট। অঝোরে অশ্রু গড়িয়ে পড়লো দু’চোখ বেয়ে। দূর্বল বেগম নিতে পারলো না এমন কঠিন অত্যাচার। বাঁধনের আড়ালে অস্ফুটে আওড়ালো,
“আল্লাহ! আর যে সহ্য হয় না!”
নিষ্ঠুর মাহতাব অধর ছড়িয়ে হাসে বেগমের কষ্টে। বিদ্রুপ স্বরে বলল,
“ইস! সুলতান দেখলে শোকেই মরে যাবে।”
তখনই আবার তাকে ছুড়ে ফেলল মেঝেতে। দুই বাহু শক্ত করে পেছনে মুচড়ে ধরলো বাঁধনসহ। এতোটাই জোরে যেন হাতদুটো ভেঙে গুড়িয়ে যায়। যন্ত্রণায় দু’চোখে অন্ধকার দেখলো বেগম। মস্তিষ্ক, মন দুটোই যেন আর্তনাদ করে বলল,
“আসুন সুলতান। এই শয়তান যে আমাকে হত্যা করতে সক্ষম হলে আপনাকেও হত্যা করবে। কে জানাবে আপনাকে ওর নিষ্ঠুর সত্যি?”
“সুলতানকে ডাকছিস মনে মনে? ডাক ডাক, বেশি করে ডাক তোর সুলতানকে। বড্ড বার বেড়েছিলি তুই। তোর কারনে বারবার সুলতানকে মারতে ব্যর্থ হয়েছি আমি। বিচক্ষণ নারী! আর তোকে সুযোগ দেবো না। জুঁইয়ের খাতিরেও নয়।”
বলতে বলতে আকস্মাৎ পালঙ্ক থেকে বালিশ এনে বেগমের মুখের ওপর চেপে ধরলো। সর্বশক্তি দিয়ে বেগমের শ্বাস রোধ করতে করতে কর্কশ কন্ঠে বলল,
“এভাবে না মারলেও চলে। তুইতো এমনিই মরবি। বিষের প্রভাব তোর দূর্বল শরীর নিতে পারবে না। তোর শরবতে আমি যে বিষ মিশিয়েছিলাম তা তোর সেবিকাও জানতো না। বিষের প্রভাব ধীরে ধীরে শুরু হয় তাই বেঁচে আছিস এখনো। কিন্তু ঝুঁকি নিতে চাই না আমি। তাই বিষের কাজ আগেই করে দিচ্ছি।”
মৃত্যুসম কষ্টে শরীর এলিয়ে দিয়েছিল বেগম। এ’কথা শুনতেই আকস্মাৎ সে ছটফট করে উঠলো কাঁটা মুরগির মতো। মাহতাবের হাত থেকে ছাড়া পেতে পা দিয়ে এলোপাথারি লাথি দিতে লাগলো মেঝেতে। চোখ বড়বড় করে ডানে-বামে মস্তক ঝাঁকিয়ে কিছু একটা বলার চেষ্টা করছে। বাঁধনের আড়াল থেকে কেবল গোঁ গোঁ শব্দ বেরোলো। ছাড়লো না মাহতাব। আরোও শক্ত করে বালিশ ঠেসে ধরলো। বেগমের শেষ সময়েও সে বলতে চাইলো,
“ঐ শরবত আমি খাইনি। বুবু খেয়েছে। বাঁচাও আমার বুবুকে, নয়তো তোমার ভালোবাসা আজ আমার সাথেই খাঁটিয়ায় উঠবে।”
চলবে………
#সম্রাজ্ঞী
#লিয়ানা_লিয়া
#পর্ব_56
মাইরার দাফন সম্পন্ন করে সকলে ফিরে এসেছে মহলে। সুলতান ইহসান মহলের এক কোনে উদাস হয়ে বসে আছেন। অথচ সে জানতেও পারলেন না তার অন্য কন্যাও মৃত্যুর খুব নিকটে পৌঁছে গেছে। শোক যেন পাল্লা দিয়ে ভারী হয় তার। মহলের কোনো এক বন্ধ কামরায় তার বড় কন্যা মৃত্যুর প্রহর গুনছে। মারজিয়া সুলতান আহাজারি করে কান্না করছে মেয়ের শোকে। অন্যান্যদের অবশ্য তেমন মাথাব্যথা নেই। তবুও ওয়াসিফা সুলতান তার পাশে বসে সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করছে। সুলতান শাহজিল সঙ্গ দিচ্ছে সুলতান ইহসানকে। হাজার হলেও তারা তার মহলের মেহমান, তার নিকটাত্মীয়। অন্যদিকে সকলের আড়ালে নিজেকে কামরায় লুকিয়ে রাখা আব্দুর রহমানের মনটাও আজ বিচলিত। তার দুই কন্যাই যে শেষ নিঃশ্বাস নিচ্ছে। সেখানে পিতা হয়ে কীভাবে অনুভব করবে না সেই কঠিন ব্যথা?
সুলতান মহলে ফিরেই বেগমের দেখা পেতে ব্যাকুল হলো। কামরায় না পেয়ে দ্বারের সৈনিকদের শুধাল,
“তোমাদের সম্রাজ্ঞী কোথায়?”
“তিনি তো কামরা থেকে বেশ কিছুক্ষণ আগেই বেরিয়ে গেছেন। আর ফিরে আসেননি।”
“বেরিয়ে গেছে? অসুস্থ শরীর নিয়ে আবার কোথায় যাবে এসময়?”
খানিক চিন্তিত হলো সুলতান। খুঁজতে খুঁজতে মহলের মাঝখানের বিশাল গোলাকার স্থানটাতে এসে পৌঁছালো। নাহ, এখানেও নেই। এখানে সকলেই আছে শুধু এলি নেই। অবাক হয়ে আওড়ালো,
“তানহা, তোহফাও মহলে নেই। তাহলে কোথায় গেছে এলি? জারনাবের কামরায়?”
একজন নারীর কামরায় যাওয়াটা শোভনীয় মনে হলো না। তাইতো আগে মাহতাবের সাথে জরুরী আলোচনাটা সেরে নিতে চাইলো। মাহতাবের কামরায় এসেও আরেক বিপত্তি। কামরা ভেতর থেকে বন্ধ। দ্বারে কোনো সৈনিকও নেই যে শুধাবে। মাহতাব নিজ কামরার সম্মুখে সৈনিক নিযুক্ত করা পছন্দ করেনি কোনোদিনই। সেই যে কয়েক বর্ষ পূর্বে মাহতাব সৈনিক হয়ে এই সাম্রাজ্যে এলো। তারপর বহুবার নিজের বীরত্বের পরিচয় দিয়ে সৈনিক প্রধানও হলো। তবে কখনোই নিজ প্রয়োজনে এই মহলের কোনো কিছু ব্যবহার করতে চায়নি সে। সবসময় নিজের উপার্জিত অর্থই ব্যায় করেছে। কাঠের ভারী রাজকীয় কারুকার্য খচিত দ্বারের ওপার থেকে কোনো শব্দ বাইরে আসাও দায়। অতঃপর বাধ্য হয়েই ডাকলো,
“মাহতাব।”
কিছুক্ষণ বাদেও উত্তর না পেয়ে পুনরায় ডাকলো,
“মাহতাব।”
কক্ষের ভেতরের দৃশ্য বড়ই নির্মম! হাত-মুখ বাঁধা অবস্থায় মেঝেতে পড়ে ছটফট করছে বেগম। মুখে পাঁচ আঙ্গুলের কালশিটে দাগ। চুলগুলো এলোমেলো, অগোছালো। সুন্দর মুখাবয়বে অশ্রুর ঝর্ণাধারা। কপালে শুকনো রক্ত, সুন্দর ঠোঁটের কোন কাটাছেঁড়া। গলায়, চোয়ালে চেপে ধরার নিষ্ঠুর ছাপ। সে কী নির্মমতা! বাঁচতে চাওয়ার কত আকুলতা! আর তার বুবু? বুবু তো কোনো অপরাধ করেনি। তবুও কি তারই কারনে আজ অকারনে প্রাণ হারাতে হবে সেই মায়ের আদলে গড়া মায়াবী রমনীকে?
বেগমের দুই চোখের আকাশ পরিমাণ অসহায়ত্ব যেন বারংবার, শতবার হাহাকার করে বলে যাচ্ছে,
“বাঁচাও আমার বুবুকে। আমার প্রাণের বিনিময়ে হলেও বাঁচাও তাকে।”
সেসময় যখন সেবিকা তাকে শরবত পান করতে দিয়েছিল। হুট করে সেখানে জারনাব এসে শরবতের পাত্র টেনে নিয়ে এক শ্বাসে পুরো শরবত পান করে মুচকি হেসে বলেছিলো,
“বড্ড বেশি তেষ্টা পেয়েছিলো। বহুদিনের তেষ্টা আজ মিটে গেল চিরতরে।”
জারনাবের সেই কথার মর্মার্থ তখন বোঝেনি বেগম। বড় আজব লেগেছিল বুবুর কথাখানা। তবে কি বুবু জেনেশুনে, সেচ্ছাই পান করেছিলো ঐ শরবত? কিন্তু কেন? কী কারনে বুবু? হঠাৎ সুলতানের কন্ঠ পেয়ে সে যেন আশার আলো দেখলো। পা দিয়ে অবিরত মেঝেতে শব্দ করতে থাকলো। এতোক্ষন পাশবিক অত্যাচার সহ্য করে এখন আর শরীর সায় দিচ্ছে না। তবুও শেষ পর্যন্ত চেষ্টা করবে বেগম। তার প্রাণের সাথে যে আরো কতগুলো প্রাণ বেঁধে আছে। তার বুবু, সুলতান। তাদের জন্য হলেও বাঁচতে হবে তাকে।
মাহতাব তখন মেঝেতে মাথা ঝুকিয়ে বসে আছে থম ধরে। কিছুক্ষণ আগেই বেগম ওকে সর্বশক্তি দিয়ে লাথি দিয়ে ফেলে দিয়েছে নিজের ওপর থেকে। ওর হাতের বালিশটা বেগমের পাশেই পড়ে রয়েছে। মেঝেতে মুখ থুবড়ে পড়েছিল মাহতাব। নাকে দৃঢ় আঘাত পেয়ে রক্ত বেরিয়ে এসেছে খানিকটা। বৃদ্ধা আঙ্গুলে রক্ত মুছে শয়তানি হাসলো ও। সে হাসিতে আজ কোনো মাধুর্য নেই। বরং আছে নির্দয়তার অনাবিল রেখা। তাচ্ছিল্য সহকারে তাকালো বেগমের দিকে,
“মৃত্যুর সময়ে এসেও শরীরে এতো তেজ!”
আবারো ডাকলো সুলতান,
“মাহতাব আছো?”
হকচকিয়ে উঠলো মাহতাব। সতর্ক হলো। বেগমকে শব্দ করতে দেখে রাগে খিটমিট করে উঠলো। হিংস্র চাহনি আরো ভয়ঙ্কর হয়। ছুটে গিয়ে বেগমের পা’দুটো মেঝের সাথে শক্ত করে চেপে ধরে নাটকীয় ভঙ্গিতে বিনয়ী স্বরে আওয়াজ দিলো,
“মাফ করবেন মহামান্য। আপনাকে কষ্ট করে এখানে আসতে হলো। আপনি নিজ কামরায় ফিরে যান। আমি এক্ষুনি আসছি।”
“ঠিক আছে, এসো।”
সুলতান চলে যাচ্ছে? বেগম আবারো শরীর উল্টিয়ে জোরালো ধাক্কায় ফেলে দিলো মাহতাবকে। ততক্ষণাৎ উঠে বেগমের গলা চেপে ধরে হিসহিসিয়ে উঠলো মাহতাব,
“চুপ! বেশি তেজ দেখালে তোর সুলতানকেও আজ মেরে ফেলবো।”
তখনও থামলো না বেগম। শরীর মোচড়াচ্ছ মাহতাবের হাত থেকে রেহাই পেতে। বুবু এখনো জীবিত আছে কিনা ভেবে অসহায় চোখে তাকালো মাহতাবের দিকে।তা দেখে হিংস্র হাসলো মাহতাব। ভাবলো মৃত্যুর ভয়ে বেগমের এই অসহায়ত্ব! এই করুণ চাহনি! অথচ প্রকৃতি তখন মাহতাবের উপর তাচ্ছিল্য হাসলো। বিদ্রুপ করে বলল,
“নিয়তির মাইর আর খোদার লীলা! কে বুঝবে? কে রুখবে?।”
“হায় মাহতাব! ওর একাকী জীবন আবার একাকী হবে। ও অজান্তেই নিজ হাতে নিজের ভালোবাসাকে হত্যা করলো। ওর প্রিয় মানুষটার এই করুণ মৃত্যু ওরই হিং’স্রতার পরিণাম। প্রকৃতির ফিরিয়ে দেওয়া উপহার। আহা বীর পুরুষ! কী করে সহ্য করবে সেই মৃত্যু?”
কেউ যেন কঠিন স্বরে জবাব দিলো,
“ওর নির্দয়, কঠিন হৃদয় আজ গলবে। গলে মোম হবে, পুড়ে অঙ্গার হবে।”
“ভেতরে কী হচ্ছে মাহতাব? কীসের শব্দ ওটা?” ভেতর থেকে আজগুবি শব্দ পেয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে সুলতান। যায়নি আর।
চকিতে ফিরলো মাহতাব। ও ভেবেছিলো চলে গেছে সুলতান। অতি রাগে হিতাহিতবোধশূন্য হয়ে বিশাল ভারী কেদারাটা টেনে এনে বেগমের শরীরের উপর চাপিয়ে দিলো। এতো ওজন শরীরে চাপাতে চোখ উল্টে আসে বেগমের। কী যে যন্ত্রণা! অতঃপর মাহতাব নিজেকে সংবরণ করে বলল,
“কেদারাটা পড়ে গেছে। আপনি গিয়ে বিশ্রাম করুন, আমি আসছি।”
অবাক হলেন সুলতান। মাহতাব এভাবে তো কখনো বলে না। ডাকার সাথে সাথে চলে আসে। কথাখানা স্বাভাবিকভাবেই নিয়ে সে চলতে লাগলো নিজ কামরার দিকে। অথচ বাঁধনের আড়ালে বেগমের চাঁপা আর্তনাদ গোঙানিতে রূপ নিলো। মৃদু, সূক্ষ্ম কন্ঠটাও সুলতান যেন অনুভব করলো সেই কন্ঠ। ছুটে ফিরে আসলো। হন্তদন্ত হয়ে দ্বারে থাবা দিয়ে বলল,
“এলি, এলি আছে ভেতরে?”
“আপনার ভুল হচ্ছে মহামান্য? সুলতানা এখানে কীভাবে আসবে? তিনি এখানে নেই।”
বলতেই আবারো পা দিয়ে শব্দ করলো বেগম। সুলতান নড়লো না এক পাও। মস্তিষ্ক বললো,
“সত্যিই তো বেগম এখানে কেন আসবে? বন্ধ কামরায় মাহতাবের সাথে তার কী কাজ? তাছাড়া মাহতাব তো আর মিথ্যা বলতে যাবে না।”
অথচ মনের বারনে দাঁড়িয়ে রইল সুলতান। উদ্বিগ্ন গলায় বলল,
“এলির গলা শুনলাম যেন?”
“সে নেই মহামান্য।”
“তুমি দ্বার খোলো মাহতাব। আমি নিজ চোখে দেখতে চাই একবার।”
“আপনি বোধহয় আমাকে বিশ্বাস করছেন না মহামান্য?”
থামলো সুলতান। হ্যাঁ, সে তো বিশ্বাস করে মাহতাবকে। এলি থাকলে ও নিশ্চয় এভাবে বলতো না? মন এবারেও মানলো না। বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় তার বিশ্বাসের উপর। সে গম্ভীর হয়ে বলল,
“দ্বার খোলো মাহতাব।”
অতঃপর স্তব্ধ। এতোটাই নীরবতা নেমে এলো যেন কামরাটা অনাদিকাল থেকে পরিত্যক্ত। কেউ নেই সেখানে। কেউ থাকে না। আবারো শব্দ হলো, বিকট শব্দ। সুলতানের উপর রেগে বোধশূণ্য মাহতাব বেগমকে তুলে ছুড়ে ফেলেছে দেয়ালে। ওটা তারই শব্দ। আঘাতে আঘাতে জর্জরিত বেগমের করুণ গোঙানিও ভেসে এলো। মাহতাবের শরীরে যেন খোদ শয়তান বাসা বেঁধেছে। কোনো ভয়-ডর নেই ওর দু’চোখে। কেবলই হিংস্রতা আর একরোখা জেদ, রাগ। সুলতানকেও তোয়াক্কা করছে না। দ্বারের বাইরে যখন সৈনিক, সেবক-সেবিকা, রাজ পরিবারের মানুষের হট্টগোল লেগে গেছে। সুলতানের হুকুমে দ্বার ভাঙা হচ্ছে তখনও ও অটল, অনড়। চোয়ালদ্বয় কঠিন, শক্ত। ও বুঝে গেছে আজ ওর রহস্য উন্মোচন হবে। শাস্তি হবে, কঠিন শাস্তি। রাগে আবারো বেগমের চুল টেনে তুলতেই ধরাম করে ভেঙে পড়লো বিশাল ভারী রাজকীয় দরজা। দৌড়ে এলো রাজ পরিবারের সকলে। ভেতরের নির্মম দৃশ্যে আতঙ্কিত হলো ওরা। ভাষা হারালো কিয়ৎ ক্ষণ। কামরার এক কোনে আলুথালু হয়ে পড়ে থাকা বেগমের শরীর গুটিয়ে এলো। লজ্জায় মুখ ফিরিয়ে নিলো।
সুলতান ছুটে এসে নিজের পাগড়ি খুলে বুকে জড়িয়ে নিলো ক্ষতবিক্ষত দেহখানা। মুষড়ে পড়লো পুরুষালি হৃদয়। বুকের পাঁজর টনটন করে উঠলো কিছুক্ষণ পূর্বের দৃশ্য কল্পনা করে। কাঁপা কাঁপা হাতে দ্রুত মুখের বাঁধন খুলে দিয়ে বিস্ফারিত দৃষ্টিতে তাকালো মাহতাবের দিকে। পালিয়ে যাবার প্রয়াস নেই ওর মাঝে। বরং ওর কঠোর মুখশ্রীতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে ঘৃণা। একরাশ ঘৃণা! আকাশ সমপরিমাণ ঘৃণা! ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইল ও।
“গুপ্ত শত্রু।”
মাহতাবের দিকে আঙ্গুল তুলে অস্ফুটে উচ্চারণ করলো বেগম। পুরো কামরার পিনপন নীরবতা বজায় থাকলো। কারোর দ্বিতীয় কোনো প্রশ্ন তোলার অবকাশ রইল না। কেবলই বিস্মিত, হতবাক দৃষ্টিগুলো নিষ্প্রাণভাবে অপলক চেয়ে থাকলো ঠাঁই দাঁড়ানো বীরের দিকে। না না, বীর নয়, অপরাধী সে। মস্তবড় অপরাধী। ক্ষমা নেই যে অপরাধের। এতো নিস্তব্ধতার মাঝে কোথাও যেন বিকট শব্দে কিছু ভেঙে পড়লো। তা ছিলো রামান সাম্রাজ্যের সুলতানের বিশ্বাস। বন্ধুর ন্যায় সৈনিক প্রধানের প্রতি তার অগাধ বিশ্বাস! ভেঙে চুরমার হলো বিশ্বাসেরা। তকমা পেলো অন্ধবিশ্বাসের। বুকটা ভীষণ জ্বালাপোড়া করছে। মস্তিষ্ক ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। মাথা চক্কর দিয়ে উঠলো। নিজ বেগমের ক্ষতবিক্ষত দেহ বুকে নিয়ে নিষ্প্রাণ, ফ্যালফ্যালের দৃষ্টিতে চেয়ে থাকলো। একবার জানতেও চাইলো না,
“কেন? কী কারনে মাহতাব?”
দ্বারের বাইরে সৈনিকদের ভেতর থেকে কেউ যেন বিড়বিড়িয়ে আওড়ালো,
“বিশ্বাসঘাতক!”
তখনই আবার তীব্র ঘৃণার কন্ঠে ভেসে এলো,
“প্রতারক!”
তড়িৎ ঘুরে তাকালো মাহতাব। কান খাড়া করতেই শুনতে পেলো সেসব ঘৃণার শব্দ, তার উদ্দেশ্যে আওড়ানো কটু কথা। দ্বারের বাইরে সহস্রাধিক সৈনিকের ভীর। যেসব সৈনিকেরা মাহতাবের এক কথাতে প্রাণ দিতে প্রস্তুত ছিলো ওরাই আজ থু থু করলো। সম্মানের দৃষ্টিগুলো বদলে গেছে। তাচ্ছিল্য আর ঘৃণা স্থান পেয়েছে সেখানে। মর্মাহত মাহতাবের বিস্ময়ের ঘোর লেগে আসে। হিংস্র চোখদুটো শিথিল হয়ে এলো। মাহতাবের কয়েকজন বিশ্বস্ত সৈনিক ছিলো। যারা সবসময় যুদ্ধের ময়দানে ওর ঢাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। তারাও আজ মুখ ফিরিয়ে নিলো। সম্পূর্ণ একা করে দিলো ওকে। আহত গলায় বলল,
“বিশ্বাস করো তোমরা……….”
“মহামান্য সুলতান! আপনার হুকুমের অপেক্ষায় আমরা। আদেশ দিলে অপরাধীকে কারাগারে নিক্ষেপ করবো। এসব সাংঘাতিক গুপ্ত ঘাতক বাইরে থাকাটা আতঙ্কের।”
সৈনিকদের কথায় কথা আটকে আসে মাহতাবের। পিছিয়ে যায় কিছুটা। তার এতো এতো সম্মান, এতো বিশ্বাস আজ কোথায়? কিছুই নেই ওর।
“বুবু, বুবু কোথায়? আমার বুবুকে বাঁচান সুলতান। ঐ শয়তানটা বিষ দিয়েছে আমার বুবুকে।”
সকলে আবারো ভাবনাচ্যুত হয় বেগমের কন্ঠে। কামরায় আরোও একটা বিস্ফোরন ঘটলো। অথচ সেই বিস্ফোরনে সবচেয়ে বেশি ক্ষতবিক্ষত বোধহয় ঐ শয়তানটাই হলো। নড়ে উঠলো তাল হারিয়ে। ভয়ঙ্কর চোখে তাকালো বেগমের দিকে। কপালের শিরাগুলো অস্পষ্টভাবে ফুটে উঠলো। উন্মাদের ন্যায় তেড়ে এসে রুক্ষ কন্ঠে হুংকার ছেড়ে বলল,
“মিথ্যা! মিথ্যা বলছিস তুই। চালাক নারী! ছলনা করছিস আমার সাথে? বিষ তোকে দিয়েছি আমি। কিছুক্ষণের মধ্যেই মরবি তুই। এই বিষের কোনো প্রতিষেধক নেই। শরীরে প্রবেশ করলে মৃত্যু অবধারিত।”
বলতে বলতে বিশ্রিভাবে হেসে উঠলো মাহতাব। ভয়ানক অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো। সুলতানের বিস্মিত চোখের দিকে চেয়ে আচমকাই সেই হাসি থেমে গেল। মুখভঙ্গি নিস্তেজ হয়ে এলো। সুলতানের দৃষ্টিতে সে কী অবিশ্বাস! ঘৃণা! শুকনো ঢোক গিলল মাহতাব। সুলতান তাকে এভাবে কেন দেখছে?
ওর মন সহসাই ওকে ধমকে উঠলো,
“কষ্ট হচ্ছে তোর? ঐ চোখের অবিশ্বাস, ঘৃণা গ্রহন করতে ভয় পাচ্ছিস? সেই তো তোর আসল শত্রু। ওকেই মারতে এতোদিনের কসরত তোর।”
চমকে উঠলো মাহতাব। তার কি সত্যিই খারাপ লাগছে সুলতানের ঐ ঘৃণাভরা দৃষ্টি? উঁহু! এসবই মায়া, নেহাতই তার ভ্রম মাত্র। সে কেন কষ্ট পাবে ঐ দৃষ্টি দেখে? তার আসল উদ্দেশ্যই তো সুলতান শাহজাইন। এলিজা সুলতান তো সেধে সেধে মরতে এসেছে।
“বিষ! বিষ খাইয়েছে এলিকে?”
আঘাতপ্রাপ্ত সিংহের ন্যায় গর্জে উঠলো সুলতান। ভয়াবহ রাগে শুভ্র মুখখানা লালচে আভায় ঢেকে গেছে। শিরা উপশিরাগুলিও ফুলে উঠেছে। আকস্মাৎ উঠে দাঁড়িয়ে তেড়ে আসে মাহতাবের দিকে। হুট করে সব ঘটে যাওয়ায় সরতে পারেনি মাহতাব। অতিরিক্ত রাগে হিংস্র হয়ে ওর বুক বরাবর সজোরে লাথি বসিয়ে দিলো সুলতান। মেঝেতে আছড়ে পরেও উঠার প্রয়াস নেই মাহতাবের। ও তো হতভম্ব হয়ে ফিরে তাকালো সুলতানের দিকে। যেই সুলতান কখনো ওর সাথে রুক্ষ স্বরে কথা বলেনি সে আজ ওকে হত্যা করতেও পিছপা হবে না। সুলতানের এই হিংস্র রূপের সাথে পরিচিত ও। এলিজার খাতিরে বহুবার দেখেছে এই ভয়ানক হিংস্রতা। তখনও রাগে থরথর করে কাঁপছে সুলতান। কেউ কী দেখলো ঐ হিংস্র, ভয়ানক মুখের আড়ালে লুকিয়ে রাখা বিশ্বাস ভাঙার কষ্ট, হাহাকার, বন্ধু হারাবার অসহায়ত্ব। দেখলো বোধহয় মাহতাব। তখনই সুলতান শক্ত হাতে ওর চোয়াল চেপে ধরে কঠোর কন্ঠে বলল,
“বিশ্বাসঘাতকেও ক্ষমা করে দিতে পারি আমি। কিন্তু তুই তো আমার প্রাণে আঘাত করেছিস!”
প্রতিষেধক নেই! কথাটা খুব কঠিন ঠেকল বেগমের নিকট। বাঁচবে না তার বুবু। মূহূর্তে থমকে গেল তার দুনিয়া। বুক কামড়ে ধরে যন্ত্রণায়, হাহাকারে। ডুকরে কেঁদে উঠলো হঠাৎই। পোশাক খামচে ধরে অসহায় গলায় অবিরত আওড়ালো,
“বুবু, আমার বুবু।”
আবারো বেগমের কাছে ছুটে এলো সুলতান। বেগমের দুই গালে হাত রেখে বলল,
“তোমাকে সত্যিই বিষ দিয়েছে এই জালিম? দ্রুত বলো এলি। চিকিৎসা নিতে হবে তোমার।”
“আমার বুবুকে বাঁচান সুলতান। ঐ বিষ মিশ্রিত শরবত আমার বুবু পান করেছে।”
জোরে জোরে কাঁদতে লাগলো বেগম। উন্মাদের ন্যায় বিলাপ করছে সে,
“মরবি তুই শয়তান, তড়পে তড়বে মরবি, মৃত্যু ভিক্ষা চেয়ে ছটফট করবি! নিজের ভালোবাসাকে নিজ হাতে বিষ দিলি! জালিম।”
“জারনাবকে বিষ দিয়েছে!”
এবার সুলতানের মস্তিষ্ক কাজ করা বন্ধ করে দিলো। মাহতাবের চোখে দেখা জারনাবের প্রতি সেই টান, মায়া সবই কি মিথ্যে ছিলো? নিছক ছলনা ছিলো? তাই যদি হয় তবে পাক্কা অভিনেতার খেতাবটা মাহতাবেরই প্রাপ্য। সকলের দৃষ্টিতে আরোও একবার ঘৃণা ফুটে উঠলো মাহতাবের জন্য। কেউ একটাবার জানতে চাইলো না এমন সুদর্শন বীর পুরুষের এই জঘন্য নৃশংসতার কারন? কী ছিলো তার উদ্দেশ্য?
“ঐ বিষ জারনাবের শরীরে প্রবেশ করেছে!”
নিষ্ঠুর, নির্মম শয়তানটার কোমল হৃদপিন্ড ক্ষণিকের জন্য থমকে গেল। গলে মোম হলো ওর কঠিন হৃদয়। পুড়ে অঙ্গার হলো ওর তীব্র ভালোবাসা। সৈনিকদের পেরিয়ে মাহতাবের রুদ্ধশ্বাসে ছুটে যাওয়া সকলেই দেখলো কিন্তু কেউ আটকালো না। কেন আটকাবে? সে তার ভালোবাসার দিকে ছুটে যাচ্ছে। হয়তো ভালোবাসাকে বাঁচাতে যাচ্ছে। নয়তো শেষবারের মতো মায়াবী ঐ মুখটা দেখতে যাচ্ছে।
“আমাকে নিয়ে চলুন সুলতান। আমি আমার বুবুকে দেখতে চাই। সৈনিকদের বলুন দ্রুত চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে। বুবু কোথায়? এখানে আসেনি কেন? ঐ বিষ তো ধীরে ধীরে কাজ করে। এখনো বেঁচে আছে আমার বুবু। শেষ চেষ্টা করুন সুলতান। যে কোনো মূল্যে বাঁচিয়ে দিন বুবুকে।” তাড়া দিলো বেগম।
“শান্ত হও এলি। জারনাবের কিছু হবে না। মাহতাবের সব মিথ্যে হলেও ওর ভালোবাসা মিথ্যে নয়। ও নিজেই বাঁচাবে জারনাবকে। প্রতিষেধক থাকলে ওর কাছেই আছে।”
জারনাবের কামরার দরজাটা হাট করে খোলা। দরজার কপাটগুলোও হাহাকার করছে আজ ওর জন্যে। পাগলের মতো ছুটে আসলো মাহতাব। হুট করে থমকে দাঁড়ালো দরজার সম্মুখে। ভেতরে উল্টো ফিরে জারনাব দাঁড়িয়ে আছে। অত্যন্ত শান্ত ওর ভঙ্গিমা। নিশ্চল, শিথিল দেহখানা। দৃষ্টির কোথাও নেই মৃত্যুভয়। কাঁপা কাঁপা স্বরে ডাকলো মাহতাব,
“জুঁই!”
“অবশেষে তুমি আসলে। সত্যিই ছুটে আসলে।”
ফিরলো জারনাব। অমনি আঁতকে উঠলো মাহতাব। কলিজা কামড়ে উঠলো যন্ত্রণায়। এমন ভয়ানক দৃশ্য ও বোধহয় কস্মিনকালেও দেখেনি। জারনাবের সুন্দর ঠোঁটগুলো নিল বর্ণ ধারন করেছে। মুখে ভয়ঙ্করভাবে রক্ত লেগে আছে। সাদা হিজাবটাতেও ছিটে ছিটে পড়ছে সেই রক্ত। মাহতাবের দু’চোখ থেকে অবিরত অশ্রু খসে পড়তেই মুচকি হাসলো ও। বিশ্রি আর বেদনাদায়ক দেখালো সেই হাসি।
“কাঁদছ কেন? এই দৃশ্য, এই মৃত্যু তোমার শাস্তি আজমাইন। তোমার সমস্ত অপরাধের শাস্তি।”
শব্দ করে কেঁদে উঠলো মাহতাব। ওর বুকে যেন আস্ত পাহাড় চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। সেভাবেই জমে গেল ও। দু’চোখে কী যেন ভেসে উঠলো? অনুশোচনা, আফসোস নাকি কষ্ট? ওর সামনেই করুণভাবে কেশে উঠলো জারনাব। কাশতে কাশতে আবারো দলা দলা রক্ত ছুটে বেরোলো। রক্তে মুখ, হিজাব ভরে গেল। একসময় দূর্বল হয়ে পড়লো জারনাব। রক্ত দেখে আবারো হাসলো উন্মাদের মতো। সব বাঁধা ডিঙিয়ে আজ দৌড়ে গিয়ে ওকে জাপটে ধরলো মাহতাব। শক্ত করে রক্ত মাখা শরীরটা জড়িয়ে গগণ কাঁপিয়ে কেঁদে উঠলো,
“কেন করলে জুঁই? কেন এতোবড় শাস্তি আমায় দিলে তুমি? এই বিষের যে কোনো প্রতিষেধক নেই। কী করে তোমায় বাঁচাবো আমি? কী করলে এই বিষ তোমার দেহ ছাড়বে? কী করবো আমি? কী করবো?”
“তুমি কাজটা ঠিক করোনি আজমাইন। আমি আমার বোনকে জীবনের চেয়ে বেশি ভালোবেসেছি। সাহাদের পরে জোভিয়াই তো ছিলো বেঁচে থাকার কারন। দু’টো বছর সন্তানের মতো বুকে করে লালন করেছি। তার শরবতে বিষ দিয়ে দিলে তুমি? এই নিষ্ঠুরতা মেনে নেই কী করে? তোমাকে বিষ ঢালতে দেখে খুব কষ্ট পেয়েছিলাম আমি, খুব। আমার জন্য ঐ মেয়েটা কী ছিলো জানো না তুমি, কিছুই জানো না। বয়সে ছোট হয়েও সে আমাকে কীভাবে আগলে রেখেছিল তা কি জানো না তুমি? কীভাবে তুমি ওকে মারতে চাইলে? তোমার সমস্ত অপরাধের কথা আগেই জানতে পেরেছিলাম আমি। গুপ্ত শত্রুর লেখা সেই চিঠি সেদিন ঠিক করে দেখিনি আমি। তবে তোহফাকে পাঠিয়ে দেওয়ার পর জোভিয়া দেখিয়েছে আমাকে। তোমার লেখা চিনবো না আমি? তোমার দুই হাতের লেখাই যে পরিচিত আমার। তবুও মরতে চাইনি বিশ্বাস করো। সাহাদের কাছে যাবার আকুলতাকেও দমিয়ে রেখেছিলাম। বাঁচতে চেয়েছিলাম। কিন্ত তোমার নিষ্ঠুরতা, হিংস্রতা আমাকে বাঁচতে দিলো না।”
“আমাকে ক্ষমা করে দাও জুঁই। কথা দিচ্ছি আর কোনো অপরাধ আমার এই হাত দ্বারা হবে না। কিন্তু তুমি আমাকে ছেড়ে যেও না। এতো কঠিন সাজা আমায় দিও না। কিছুই হবে না তোমার। বমি করার চেষ্টা করো। তাহলে যদি বিষ বেরিয়ে আসে। চেষ্টা করো।”
“আর সময় নেই। বিষ রক্তে মিশে কাজ শুরু করে দিয়েছে আরো পূর্বেই। বিদায় দাও আমাকে আজ।”
বলতে বলতে শরীর এলিয়ে দিলো জারনাব। ঢলে পড়লো মাহতাবের হাতের ওপরেই। নিভু নিভু চোখে চেয়ে শেষবারের মতো আওড়ালো,
“ভাগ্যের কী পরিহাস! কোথায় ছিলাম এক যোদ্ধার স্ত্রী আর আজ দুনিয়া ছাড়লাম এক ভয়ঙ্কর অপরাধীর আলিঙ্গনে!”
“না না, জুঁই। তাকাও, তাকাও আমার দিকে।”
ততক্ষণে চোখ বন্ধ হয়ে গেছে জারনাবের। শেষ নিশ্বাস নিয়ে প্রাণ ত্যাগ করেছে ও। ওর নিথর দেহখানা গুটিয়ে আছে ওরই হত্যাকারীর বাহু বন্ধনে। পশ্চিমা অনিলে শোকের ছায়া। আকাশ বাতাস ভারী করে গগণবিদারি চিৎকার করে উঠলো মাহতাব। বুক চাপড়ে কাঁদতে লাগলো। নিজের ভালোবাসার খুনি ও! এরচেয়ে ভয়ঙ্কর দুঃখ আর কিইবা হতে পারে?
সেসময় মহলের ফটক ধরে এক উন্মাদ, পাগল ভিখারি খিটখিটিয়ে হেসে উঠলো। অট্রহাসিতে ফেটে পড়ে আকাশের দিকে চেয়ে চিৎকার করে বলল,
“নিয়তির খেলা। নিয়তির খেলা।”
চলবে………