সম্রাজ্ঞী পর্ব-৫৮ এবং শেষ পর্ব

0
337

#সম্রাজ্ঞী
#লিয়ানা_লিয়া
#শেষ_পর্ব

গতানুগতিক ধারায় ঠিকই বর্ষ পেরিয়ে যায়। বদলায় মানুষ, বদলায় সম্পর্ক। রয়ে যায় নিয়তির বিচার। ক্রমেই তা নির্মম হতে থাকে। বর্ষ পেরিয়ে গেলেও সাম্রাজ্যকে আজও সুখবর দিতে পারেনি বেগম। প্রবল আঘাতেই গর্ভধারণের ক্ষমতা হারিয়েছিলো সে। সেসময় এ’কথা বেগমের অজানা থাকলেও ধীরে ধীরে ঠিকই উপলব্ধি করতে পেরেছে সকলে। বর্ষ পেরোলেও জারনাবের মৃত্যুশোক কাঁটিয়ে ওঠেনি মহল। বীরের করুন পরিণতি ভোলার নয়। কাল কুঠুরির কয়েদি আবারো নিজেকে বন্ধ করে নিয়েছে অন্ধকার কুঠুরিতে। সাম্রাজ্যকে উত্তরাধিকার না দিতে পেরে ক্ষয়ে যায় বেগমের দৃঢ়তা। তিক্ত হয় ওয়াসিফা সুলতানের ব্যবহার। অপরদিকে দীর্ঘ প্রশিক্ষণ শেষ করে আজ সাম্রাজ্যে ফিরে আসছে দুই শেহজাদি। দীর্ঘদিন পর নিজ সন্তানকে বুকে টানার আশায় ছটফট করছে বেগম। নিজ হাতে পায়েস রান্না করে রন্ধনশালা থেকে বেরোতেই ওয়াসিফা সুলতানকে গম্ভীর মুখে এগিয়ে আসতে দেখা যায়। দাঁড়িয়ে পড়লো বেগম। শুধাল,

“কিছু বলবেন আম্মা?”

“আমার কামরায় এসো। কথা আছে।”

ওয়াসিফা সুলতানের কাটকাট কন্ঠে বিচলিত হলো বেগম। তবুও নিজেকে স্বাভাবিক দেখানোর আপ্রাণ চেষ্টা করলো। শান্ত ভঙ্গিমায় বললো,

“চলুন।”

কামরায় পৌঁছাতেই বাইরে থেকে দ্বার আটকে দিলো সৈনিক। ওয়াসিফা সুলতান রাজকীয় কেদারায় বসে ক্ষুব্ধ অথচ নিস্তেজ দৃষ্টিতে চেয়ে রইল বেগমের দিকে। বসার আদেশ পেয়েও বসলো না বেগম। উদ্বিগ্ন গলায় বলল,

“কী কথা আম্মা? দয়া করে এই আলোচনা দ্রুত শেষ করুন। এতোগুলো দিন নিজের সন্তানকে দেখি না। আজ তোহফাকে এক নজর দেখার উত্তেজনা কিছুতেই সংবরণ করতে পারছি না।”

“থামো। সন্তান? কীসের সন্তান? সেই তো এক কন্যা জন্ম দিয়ে বসে আছো। সাম্রাজ্যকে উত্তরাধিকার দিতে পারছো না। কেমন সম্রাজ্ঞী তুমি? পরবর্তী সুলতান ছাড়া এই বিশাল সাম্রাজ্য চলবে কী করে?”

বেগমের মাথার জ্বলজ্বলে মহা মূল্যবান তাজের সেই দাপট যেন ফিকে পড়ে গেছে। এতো তিক্ত কথাও কী অবলীলায় সয়ে যায় বেগম। দুই বোনের আকস্মাৎ অকাল মৃত্যু, নিজের গর্ভধারণে অক্ষমতা কি তবে বিলীন করলো তার দৃঢ়তা? তার কঠোরতা? কোথায় হারিয়েছে সেই শক্ত মনোবল ? বিস্মিত তার দৃষ্টি।

“তোহফা তো আছে আম্মা। আপনি চিন্তা করবেন না। সঠিক শিক্ষা আর প্রশিক্ষণ পেলে আমার কন্যাই একদিন এই সাম্রাজ্যের হাল ধরবে।”

“কন্যা ধরবে সাম্রাজ্যের হাল?”

“হ্যাঁ।”

“অনন্ত কাল ধরে এই সাম্রাজ্যের শাসক হয়ে এসেছে শেহজাদারা। আর তুমি কিনা নিজের অক্ষমতা আড়াল করতে কন্যাকে সাম্রাজ্যের ভার দেবে?”

“এতে দোষের কিছু নেই।”

“জ্ঞানের কথা আমি শুনতে চাই না এলিজা। আমার শাহজাইন যেখানে শত্রুর খোঁজ করতে ব্যর্থ সেখানে তোমার কন্যা কীভাবে এই সাম্রাজ্য পরিচালনা করবে?”

“আপনি কী চান আম্মা? খুলে বলুন।”

বেগমের দিকে চেয়ে কয়েক পল নীরব রইল ওয়াসিফা সুলতান। বেগমের এহেন কোমলতায় যেন সাহস পেলো সে। বড় করে শ্বাস নিয়ে পুনরায় গম্ভীর স্বরে বলল,

“সাম্রাজ্য একজন উত্তরাধিকার চায়। পরবর্তী সুলতান চায়। যা তুমি কখনোই দিতে পারবে না। সেই হুঁশ আছে তোমার?”

অবাক হয়ে কেবল চেয়েই থাকলো বেগম। বলার মতো কোনো ভাষা খুঁজে পেলো না হয়তো। কিইবা বলবে? কথাতো সঠিকই বলেছে ওয়াসিফা সুলতান। সে মেনে নেয় নিজের অক্ষমতা।

“এই সাম্রাজ্যের সম্রাজ্ঞী হিসেবে তোমার গুরু দায়িত্ব রয়েছে। তোমার উচিত সাম্রাজ্যের ভালো মন্দের খেয়াল রাখার। সাম্রাজ্যের ভবিষ্যত নিশ্চিত করা।”

“আমি আমার দায়িত্ব পালনে সর্বদাই চেষ্টা করে গেছি।”

ভ্রু কুচকে চাইল ওয়াসিফা সুলতান। বেগমের হাবভাব বোঝার চেষ্টা করেও লাভ হলো না। আজকাল সে প্রয়োজন ছাড়া কথাও বলে না। দৃষ্টিতে সেই একরোখা ভাব হাওয়ায় উবে গেছে যেন। বেগমের কন্ঠে আজকাল আর তেজ দেখা যায় না।

“আমি শাহজাইনের জন্য পাত্রী নির্বাচন করেছি।”

চমকাল বেগম, “পাত্রী!”

“হ্যাঁ, শাহজাইনের আবার বিবাহ দেওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় কি আছে? পারবে তুমি সাম্রাজ্যকে একজন শেহজাদা দিতে?”

মস্তক নুইয়ে নিলো বেগম। সুলতান আবার বিবাহ করবে? এমন সর্বনাশা বাক্য যেন ঝলসে দেয় ওর কর্ণগহ্বর। বিচলিত হয়ে বলল,

“কিন্তু আম্মা……..”

“আশা করি তুমি সম্মতি প্রদান করবে। তুমি বুদ্ধিমতী এলিজা। পরিস্থিতি উপলব্ধি করো। নিজের দায়িত্ব থেকে পিছিয়ে যেও না আবেগের বশে।”

বেগমের ছলছল নয়ন স্থির মেঝেতে। ওয়াসিফা সুলতান উপলব্ধি করলো ঐ নয়নের অসহায়ত্ব। তবুও কঠোর থাকলো। সে তো অন্যায় কিছু করছে না। সুলতানদের একাধিক বিবাহ খুবই স্বাভাবিক।

“আমি তোমার থেকে ‘হ্যাঁ’ শুনতে চাই এলিজা। শাহজাইনকে ইতিমধ্যে অবগত করা হয়েছে এ ব্যপারে। এখন শুধু তোমার সম্মতির অপেক্ষা। নিজের দায়িত্বের খাতিরে হলেও শাহজাইনকে তুমি রাজি করাবে। এ ছাড়া আর কোন উপায় নেই তোমার নিকট।”

ব্যাস! আলোচনা এতোটুকুই। অথচ ভেঙে চুরমার হয়েছে কারোর হৃদয়, কোমল মন।
__________________________

রামান সাম্রাজ্যের বিশাল কবরস্থানের এক কোনে একটি নতুন কবর। ঠিক নতুন নয়। বর্ষ পেরিয়ে পুরাতন হয়েছে তার ইট-পাথর। কবরটার মাথার দিকে গুটিকতক রজনীগন্ধার গাছ। গাছের গোড়াগুলো সামান্য ভেজা। যেন কিছুক্ষণ আগেই পানি পেয়েছে তারা। রাজমহলের মানুষগুলোর কবরস্থানে সবসময় পাথর খোদাই করে তার পরিচয় লেখা থাকে। তেমনি এই কবরের পাথর খোদাই করেও বড়বড় অক্ষরে লেখা আছে ‘(পবিত্র)”।

কিছু সময়ের ব্যবধানে ফটক পেরিয়ে ভেতরে আসে বেগম। বিগত এক বছরে রোজ একবার করে এখানে আসে সে। সময় কাঁটায় কবরের পাশটাতে। সতর্ক দৃষ্টিতে চারপাশ দেখে নিয়ে সরাসরি কবরটার দিকে এগিয়ে যায়। সালাম প্রদান করে কিছুক্ষণ দোয়া দরুদ আওড়ালো বিড়বিড়িয়ে। রোজকার ন্যায় আজও তার সুশ্রী মুখ বেয়ে শোকের অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। মিনমিনে স্বরে ডাকলো,

“বুবু, আমার বুবু।”

অতঃপর আবারো চোখ বন্ধ করে দু’হাত তুলল প্রার্থনার আশায়। সবশেষে যখন উঠে দাঁড়ালো তখনও যেন মায়ার টান ত্যাগ করতে পারলো না। একটা বছর এই শোক সে ধারণ করছে নিজের মাঝে। নাজানি আরোও কত যুগ, কত কাল এই শোক লালন করতে হবে তাকে। হয়তো পুরো জীবনটাই কেঁটে যাবে বুবুর অনুপস্থিতি অনুভব করে। সে পুনরায় পেছনে ফিরে ভেজা কন্ঠে আওড়ায়,

“আল্লাহ তোমাকে জান্নাত নসীব করুক। তুমি ভালো থাকো বুবু। খুব ভালো থাকো।”

তখনই কারোর প্রবল ধাক্কায় বেগম ছিটকে পড়লো মাটিতে। ময়লা পড়লো তার রাজকীয় পোশাকে। ব্যথাও পেলো খানিকটা। অথচ সে বিচলিত হলো না। যেন বহুদিন পূর্বেই অভ্যস্ত হয়ে গেছে এই ধাক্কায়। শান্ত ভঙ্গিতে ফিরে তাকালে নজরে আসে একজন পুরুষ। উঁহু, সুস্থ-সবল পুরুষ নয়। মানসিক বিকারগ্রস্ত, বদ্ধ উন্মাদ সে। বড়বড় উষ্কো খুশকো চুল, ছেড়া-ময়লা পোশাক, বড়বড় নোংরা নখ। কী বিশ্রি দেখাচ্ছে! পরিচিত সুন্দর মুখখানা তো কবেই হারিয়ে গেছে। সকলে তাকে পাগল নামে সম্বোধন করলেও বেগম করলো না। বলল,

“মাহতাব।”

মাথা চুলকে, চোখ পিটপিট করে কেবলই চেয়ে থাকে সেই উন্মাদ। যেন মাহতাব নামের সাথে তার কখনো পরিচয়ই হয়নি। সেতো পাগল। সবাই বলে পাগল সে। এই মেয়েটা কতো বোকা। প্রতিদিন শুধু উল্টো-পাল্টা কথা বলে। পাগলটা রাগান্বিত কন্ঠে হুংকার ছাড়লো,

“কেন এসেছিলি? আমার জুঁইয়ের কাছে কেন আসিস তুই? যাহ! চলে যা।”

“কেমন আছো মাহতাব?”

পাগলটার এবার ভীষণ রাগ হলো। সে কী করে খারাপ থাকবে? জুঁইয়ের সাথে সবসময় ভালো থাকে সে। তাও এই মেয়েটা রোজ এসব আজগুবি কথা জিজ্ঞেস করে। পিছিয়ে যেতে যেতে পুনরায় বলল,

“যাহ! যাহ! দূর হয়ে যা।”

“আমার কথা শোনো, তুমি পাগল নও। এক বছর হয়ে গেছে। এবার তো অন্তত মেনে নাও বুবু মৃত। সে আর কখনো ফিরে আসবে না। তুমি কেন রাতদিন এই কবরস্থানে পড়ে থাকো? আর কতদিন এভাবে এখানে অপেক্ষা করবে? তাও একজন মৃত মানুষের জন্য! এখন তো বন্ধ করো এই উন্মাদনা।”

বলতে বলতে মাহতাবের দিকে খানিকটা এগিয়ে আসলো বেগম। উন্মাদ মাহতাব বুঝলোই না সেই কথার অর্থ। উল্টো রেগেমেগে ছুটে এসে ধাক্কা দিয়ে বসলো বেগমকে। পুনরায় বেগম পড়ে যাবার পূর্বেই একজোড়া বলিষ্ঠ হাত জড়িয়ে নিলো তাকে। বিচলিত হয়ে আওড়ায়,

“এলি।”

“সুলতান, আপনি বোঝান না ওকে।”

উদ্বিগ্ন বেগমের দিকে অপলক চেয়ে থাকলো সুলতান। বলল,

“শান্ত হও এলি।”

মাহতাব যেন সুলতানকে দেখে আরোও বিরক্ত হলো। ক্ষ্যাপাটে ভঙ্গিমায় দুই হাতে নিজের উষ্কো খুশকো চুল সজোরে টেনে ধরলো। লাল চোখজোরাতে অজস্র ক্ষোভ উপচে পড়লো। এই লোকটাকে একদম পছন্দ করে না ও। তবুও এই লোকটা রোজ আসে, বারবার আসে। কী অসহ্য! পেছাতে পেছাতে হুট করে সামনের দিকে ছুটে আসলো ও। সুলতানের বাহু খামচে ধরে পোশাক কুচকে দিলো। চিৎকার করে বলল,

“খাবো না আমি। খাবো না। তুই আবার এসেছিস? কেন এসেছিস? তোর আনা খাবার আমি খাবোই না। চলে যা তোরা। এটা আমার আর আমার জুঁইয়ের গৃহ।”

নিস্তেজ ভঙ্গিতে কেবল দাঁড়িয়ে রইল সুলতান। কী নিষ্প্রাণ সেই চোখের চাহনি! সীমাহীন অসহায়ত্ব! বেগম যখন জারনাবের কবর দেখতে আসে তখন সুলতানও আসে এই কবরস্থানে। থলেতে খাবার পুরে এই বিশাল সাম্রাজ্যের সুলতান তা নিজ হাতে বহন করে বয়ে আনে। একজন পাগলের জন্য। এই উন্মাদের ক্ষুধা নিবারণের আশায়। তবুও পাগলের কী রাগ! কী অভিমান! সে খায় না সুলতানের দেওয়া খাবার। ছুড়ে ফেলে দেয়। তবুও পরের দিন আবার খাবার আনে সুলতান। ঢোক গিলল সুলতান। ব্যথা নেমে যায় যেন গলা বেয়ে। ধরা গলায় আওড়ালো,

“আমি খাবার আনিনি। আমার বেগমকে নিতে এসেছিলাম।”

“আনিস নি?”

সরল গলায় শুধাল মাহতাব। মুখটা হঠাৎই কেমন মলিন হয়ে এলো। খুব ক্ষুধা লেগেছে ওর। রোজ তো এই লোকটা খাবার এনে দেয়। লোকটা চলে গেলে ওগুলো কুড়িয়ে এনে জুঁইয়ের সাথে সেই খাবার খায় ও। আজ আনেনি? খাবে কী ওরা?

“তুমি জানো আমি রোজ রোজ কেন তোমার জন্য খাবার নিয়ে আসি?”

“উঁহু, নাহ। হেহে, আমার মতো পাগল তুই। তাই আনিস।”

অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো মাহতাব। খুব হাসি পাচ্ছে ওর। ভীষণ মজা লাগছে। এই লোকটাও পাগল ওর মতো।

“আমার বন্ধুরূপী চিরশত্রুকে দেখতে আসি এক নজর।”

সুলতানের সম্মোহনী কন্ঠে না চাইতেও হাসি বন্ধ হয়ে আসে মাহতাবের। অবুঝ মাহতাব কী যে বুঝলো। অবাক দৃষ্টিতে অপলক চেয়ে ভাবুক স্বরে বলে উঠলো,

“চিরশত্রু? চিরশত্রু আমি? কিন্তু আমিতো পাগল। তুই জানিস না?”

“উঁহু, পাগল নও, প্রেমিক তুমি। নিখুঁত অপরাধীর সাথে সাথে একজন খাঁটি প্রেমিক হয়েছিলে তুমি।”

মাহতাবের এই উন্মাদনা দু’চোখে সয় না আর। তাইতো দ্রুত বেগমকে টেনে নিয়ে কবরস্থান ত্যাগ করলো সুলতান। বেগম তার হাতের বাঁধন থেকে ছুটতে চাইলেও শক্ত করে ধরে রাখলো সুলতান। গাছের আড়ালে রাখা খাবারের থলেখানা নিয়ে এসে ফটকের ভেতরে দিয়ে আসলো। কিছুক্ষণ অদূরে জারনাবের কবরের পাশে বসা উন্মাদকে দু’চোখ ভরে দেখে নিয়ে চলে গেল হনহনিয়ে। সে জানে মাহতাব কিছুক্ষণ পরেই খাবে। না খেলে বাঁচবে কী করে? ক্ষুধার জ্বালা যে বড় জ্বালা। সবাই বলে শত্রুকে খাবার দিতে নেই। হয়তো নেই। তবে বন্ধুকে তো দেওয়ায় যায়। বন্ধুত্বের টান কি মুছে ফেলা যায় শত্রুর নির্মমতায়?

খাবার দেখে খুশিতে আত্মহারা হলো মাহতাব। থলে নিয়ে দৌড়ে কবরের দিকে ছুটে গেলো। উচ্ছ্বসিত কন্ঠে বলল,
“জুঁই, আমার জুঁই। খাবা না তুমি?”

আসলো না জুঁই। খাবারও খেলো না। এমনকি অপরপাশ থেকে কোনো উত্তরও আসলো না। ক্ষুধার্ত মাহতাব যখন হাপুস হুপুস করে খাবার খাচ্ছে তখনই যেন অদূরে কারোর অবয়ব দেখলো ও। আতরের সুঘ্রানে ভরে উঠলো কবরস্থান। হ্যাঁ এই ঘ্রাণ তো জারনাবের হিজাবেই পাওয়া যেতো। এই ঘ্রাণ চেনে ও। হয়তো এটা ওর ভ্রম, চোখের কল্পনা। তবুও যেন ও শুনতে পেলো সেই সরল কন্ঠ,

“আজমাইন।”

হকচকিয়ে উঠলো মাহতাব। পাগলের মতো এদিক ওদিক চেয়ে ডাকলো,

“জুঁই, আমার সামনে এসো। এসো।”

গায়েবি কন্ঠে আবারো যেন উচ্চারিত হলো,
“আমাকে বিদায় দাও।
ছেড়ে দাও সমস্ত মায়া।
ভুলে যাও তোমার ভালোবাসা।”

“তুমি কই যাবা? আসো, আমার সামনে আসো।”

কবরস্থানের চতুর্দিকে ছুটোছুটি করছে মাহতাব। খোঁজ করছে ওর কাঙ্ক্ষিত মানুষটার।

“তুমি বিদায় না দিলে কীভাবে যায় আমি?”

“যাবা না। কোথাও যাবা না তুমি। আমার সাথে থাকবা। বলো থাকবা না?

কিন্তু সমস্ত বাক্য মিথ্যে করে আবারো মিলিয়ে গেলো সেই অবয়ব। মাহতাবের থেকে বিদায় না নিয়েই হারিয়ে যায় আতরের কড়া সুঘ্রান। নাহ, কোথাও নেই ওর কাঙ্ক্ষিত মানুষটা। আজও শব্দহীন কান্নায় মুষড়ে পড়ে মাহতাব। মাটিতে বসে ঠোঁট ফুলিয়ে অভিমানী কন্ঠে আওড়ালো,

“তুমি আমাকে ভালোবাসলেই না জুঁই! বারবার শুধু চলেই গেলে। ফিরে আর এলে না একটাবারের জন্যও।”

ফটকের ওপার থেকে একজোড়া স্তব্ধ দৃষ্টি দেখে যায় সমস্ত ঘটনা। শেহজাদি তানহা মাত্রই সাম্রাজ্যে এসে পৌঁছেছে। মহলে না গিয়ে সোজা এখানে এসেছে ও। প্রশিক্ষণে থাকা অবস্থাতেই পত্র পেয়েছিলো সে। যেখানে বেশ স্পষ্ট ভাষাতে লেখা ছিলো ‘সৈনিক প্রধান আজমাইন মাহতাবই হলো রামান সাম্রাজ্যের গুপ্ত শত্রু’। বহু পূর্বেই ভালোবাসার দাবি ছেড়ে দিলেও ওর দু’চোখ ছলছল করে ওঠে মাহতাবের এই উন্মাদনায়। কাতর কন্ঠে বলল,

“সৈনিক প্রধান, আমিতো কবেই আপনার দাবি ছেড়ে দিয়েছিলাম তবুও কেন এতো কষ্ট পাচ্ছি? বলুন তো আপনি?”
__________________________

শাহ নদীর চর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে সুলতান আর বেগম। সুলতানের হাতটা শক্ত করে ধরে আছে বেগমের হাতটা। অপরূপ সেই দৃশ্য!

সুলতান জোরপূর্বক টেনে এনেছে বেগমকে। কেন? কী কারনে? তা জানা নেই বেগমের। হুট করেই সুলতানের এই সিদ্ধান্ত। বেগম কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর বিরক্ত কন্ঠে বলে উঠলো,

“আমরা কোথায় যাচ্ছি সুলতান?”

“চলে যাচ্ছি এই সাম্রাজ্য ছেড়ে। অনেক দূরে।”

সামনে দৃষ্টি রেখেই গম্ভীর কন্ঠে আওড়ায় সুলতান। চকিতে ফিরলো বেগম। বিস্মিত হয়ে শুধাল,
“মানে?”

থামলো সুলতান। ভ্রু কুচকে তাকালো বেগমের মুখের দিকে। মাথাটা সামান্য ঝুঁকিয়ে এনে বলল,
“কেন? তুমি থাকতে চাও এই সাম্রাজ্যে? আমার বিবাহ দেখার জন্য? সুলতান শাহজাইনের দ্বিতীয় বেগম দেখার জন্য? অবশ্য তুমি চাইলে আমি তৃতীয়, এমনকি চতুর্থ বেগমও দেখাতে পারি তোমাকে। দেখবে?”

শেষের কথাগুলো চিবিয়ে চিবিয়ে বলল। যেন অনেক সময় ধরে নিজের রাগ সংবরণ করে আছে সে। রাগে চোখজোরা লাল হয়ে উঠেছে। চোয়ালদ্বয় কাঁপছে থরথরিয়ে। আম্মা তাকে জানিয়েছে এলিজার সম্মতি আছে তার এই বিবাহে। এ’কথা শুনতেই রেগেমেগে মহল ছেড়ে বেরিয়ে এসেছিলো সুলতান। এতোক্ষনে হয়তো আম্মা তার খোঁজ করা শুরু করে দিয়েছে। বেগম নিশ্চুপ, নীরব। উত্তর দেওয়ার প্রয়াস নেই তার মাঝে। কয়েক পা পিছিয়ে দূরত্ব সৃষ্টি করতেই গটগট পায়ে তেড়ে আসলো সুলতান। শক্ত হাতে বেগমের বাহু চেপে ধরে টেনে আনলো খুব কাছে। চোখে চোখ রেখে হুংকার ছেড়ে বলল,

“কীভাবে এই বিবাহে তুমি সম্মতি দিয়েছো এলি? কোন সাহসে সম্মতি দিয়েছো? বলো?”

নিস্তেজ ভঙ্গিতে কেবলই চেয়ে থাকলো বেগম। উত্তর না পেয়ে ক্ষুব্ধ হয় সুলতান। আক্রোশে ফেটে পড়লো যেন। চোয়ালদ্বয় শক্ত হলো। মৃদু চিৎকার করে উঠলো,

“উত্তর দাও। চুপ করে আছো কেন? সম্মতি দিয়েছো তুমি।”

বাহুতে চাপ বৃদ্ধি পাওয়ায় নড়ে উঠলো বেগম। মৃদু অথচ শান্ত কন্ঠে বলল,
“ছাড়ুন। ব্যথা লাগছে।”

“জবাব দাও। এই বিবাহে তুমি সম্মতি দিয়েছো? হ্যাঁ কি না?”

নিজেকে সংবরণ করা দায় হয়ে উঠলো বেগমের পক্ষে। রুক্ষ দৃষ্টিতে তাকালো। রাগ উপচে পড়লো যেন। ক্রোধের বশীভূত হয়ে দৃষ্টি লাল হয়ে উঠলো। আবারো তার চেহারাতে দেখা দিলো সেই দৃঢ়তা, হারিয়ে যাওয়া কঠোরতা। শক্তি প্রয়োগ করে এক ঝটকায় ছাড়িয়ে নিলো নিজেকে। সুলতানের চোখে দৃষ্টি রেখে কঠোর কন্ঠে বলল,

“হ্যাঁ, সম্মতি দিয়েছি। কী করবেন আপনি? পরবর্তী সুলতান, একজন উত্তরাধিকারের জন্য আর কতদিন অপেক্ষা করবে এই সাম্রাজ্য? আপনি বুঝতে পারছেন না অক্ষম আমি? সাম্রাজ্যের ভবিষ্যত নির্ধারণ করা আপনার দায়িত্ব। তাই এই বিবাহই আপনার জন্য সঠিক সিদ্ধান্ত হবে।”

হতবুদ্ধির ন্যায় চেয়ে আছে সুলতান। একরাশ বিস্ময় তার মুখখানাতে। অবাক হয়ে শুধাল,

“তুমি সত্যিই চাও আমি আবার বিবাহ করি?”

“হ্যাঁ চাই। আর এটাই আমার শেষ সিদ্ধান্ত।”

“এই তোমার শেষ কথা?”

“হ্যাঁ, শুনতে পান নি আপনি? এটাই আমার শেষ সিদ্ধান্ত। আপনি বিবাহ করে নিন। নিজের দায়িত্ব পালন করুন সাম্রাজ্যের ভবিষ্যত নিশ্চিত করুন।”

দৃঢ় কন্ঠ বেগমের। স্থির হয়ে ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইল সুলতান। কয়েক পল তীক্ষ্ম চোখে চেয়ে আচমকাই ঘাড় কাত করে অধর বাকালো, রহস্যময় হাসলো। বেগমের অদ্ভূত ঠেকল সেই হাসি। বিস্ময় নিয়ে চেয়ে থাকলো।

“এই যদি হয় তোমার শেষ সিদ্ধান্ত তবে আমার সিদ্ধান্তও শুনে নাও সম্রাজ্ঞী।”

এবার দৃঢ়তা হারালো বেগম। শূন্য হলো তার দৃষ্টি। তার কথাতে সুলতান কষ্ট পেলো কি? এবার কি তবে চিরতরে হারাতে হবে সুলতানকে? এরই মাঝে বেগমের সমস্ত জল্পনা কল্পনা মিথ্যে করে ওর খুব কাছে এসে দাঁড়ালো সুলতান। শীতল অথচ অত্যন্ত কঠোর তার চোখজোরা। ভয়ে সামান্য পিছিয়ে গেল বেগম। অমনি এগিয়ে এসে সেই দূরত্ব মিটিয়ে দিলো সুলতান। ক্রুর হেসে ফিসফিসিয়ে বলল,

“আপনার সাম্রাজ্যের খাতিরে আমি অনেক ত্যাগ করে ফেলেছি। আর সম্ভব নয় আমার দ্বারা। এবার সেটাই হবে যেটা আমি চাইবো।”

“কী বলতে চাচ্ছেন আপনি?”

“মাননীয়া সম্রাজ্ঞী! আপনাকে এখন, এই মুহূর্তে আজন্মকালের জন্য অপহরণ করা হচ্ছে।”

সুলতানের কথার অর্থ বুঝেই আকস্মাৎ ভয় ভুলে দৌড় লাগালো বেগম। উদ্দেশ্য ছুটে পালিয়ে যাওয়া। কয়েক কদম এগোতেই খপ করে ধরে ফেলল সুলতান। মেকি হেসে বেগমকে জাপটে ধরে কাঁধে তুলে নেয়। বেগমের অগোচরেই মুচকি হাসলো। এহেন কাজে বেগম যেন আহাম্মক বনে গেল। হতভম্ব ভঙ্গিমায় থম মেরে রইল কিছুক্ষণ। অতঃপর হুঁশ ফিরতেই নামার জন্য হাত পা ছুড়তে আরম্ভ করলো। তাতে লাভ হলো না খুব একটা।সুলতান বড়বড় পা ফেলে নদীর তীরে ভিড়িয়ে রাখা বিশাল জাহাজে উঠে পড়লো বেগম সমেত। জাহাজ তীর ছেড়ে মাঝ নদীতে পৌঁছালে ছুটোছুটি বন্ধ করে শান্ত হয়ে যায় বেগম। নামিয়ে দিলো সুলতান। তখনই পাড় থেকে ভেসে আসে একাধিক ঘোড়ার খুড়ের শব্দ। ওয়াসিফা সুলতান সৈন্যসমেত দাঁড়িয়ে আছে বিস্ফোরিত চোখে। চিৎকার করে ডাকলো,

“পাগলামো করো না শাহজাইন। ফিরে এসো বলছি।”

“আম্মা, আপনার জুলুম থেকে রক্ষা পেতে ঐ সুলতানের সিংহাসন আমি সেচ্ছাই, সজ্ঞানে ত্যাগ করলাম। এবার আপনি কার বিবাহ দিয়ে সাম্রাজ্যের ভবিষ্যত নিশ্চিত করবেন সেটা আগে ভাবতে থাকেন। আমি আর ফিরছি না এই সাম্রাজ্যে।”

ওয়াসিফা সুলতানের কটমট চাহনি আরোও শক্ত হয়। অদূরে দেখা যায় বেগমের মেকি হাসি। রহস্যময় চাহনি। হাসি বজায় রেখে ওয়াসিফা সুলতানের চোখে চেয়ে বিড়বিড়িয়ে আওড়ালো,
“এটাতো আমি আগেই ধারনা করেছিলাম আম্মা। শুধু শুধুই আপনি আমার মাথাটা ঝালাপালা করলেন। আমার সুলতান শুধুই আমার। তার ভাগ আমি কাউকেই দেবো না। এতে নির্মম, নিষ্ঠুর, স্বার্থপর হতেও প্রস্তুত আমি।”

সুলতানকে কপাল কুচকে তাকিয়ে থাকতে দেখে গলা খাকারি দিয়ে কিঞ্চিত বিরক্ত স্বরে বলল,
“আবার কী?”

“তোমার মতিগতি তো ভালো লাগছে না এলি। কাউকে অপহরণ করা হলে তাকে চিৎকার-চেঁচামেচি করে সাহায্য চাইতে হয়। সেটাও জানো না?”

বেগম রাগান্বিত দৃষ্টিতে চাইতেই মুচকি হাসলো সুলতান। বেগমের হিজাব টেনেটুনে ঠিক করে দিতে দিতে আদুরে স্বরে বলল,
“তোমার স্থান আমি কাউকে দিতে পারবো না এলি। তুমি আমার কাছে তেমনি মূল্যবান, যেমনি মূল্যবান হলে তাকে বুকে চিরে লুকিয়ে রাখা যায়।”

অজান্তেই অধর প্রসারিত করলো বেগম। নিজের মাথাটা এলিয়ে দিলো সুলতানের উপর। শুধাল,
“কিন্তু সাম্রাজ্য? আপনি কি সত্যিই ফিরবেন না?”

“এতো যত্নে গড়া সাম্রাজ্য ত্যাগ করি কী করে? ফিরবো আমরা। আজই ফিরবো। এটা ছিলো শুধু তোমার মস্তিষ্কের ক্ষয়ে যাওয়া ভূতুরে অংশ ঠিক করার জন্য। আর আম্মাকে পথে আনার জন্য। রইলো উত্তরাধিকার। তোহফা তো আছেই। আমাদের ভবিষ্যত সম্রাজ্ঞী।”

সস্তির শ্বাস ছাড়লো বেগম। সারাদিন নদীতে ঘুরে ঘুরে সন্ধ্যায় তীরে এসে থামলো জাহাজটা। বেগম হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে আসতেই ছোট ছোট পায়ে দৌড়ে আসলো তোহফা। ভুবন ভোলানো কন্ঠে ডেকে উঠলো,

“আম্মু।”

“তোহফা, আমার কন্যা। তুমিই তো রামান সাম্রাজ্যের ভবিষ্যত।”

বেগম আর সুলতান যখন ছুটে এসে কোলে তুলে আদর করতে লাগলো তাদের একমাত্র শেহজাদিকে। তখনই তোহফার সাথে আসা সৈন্যরা পিছিয়ে যায় তাদেরকে নিজস্ব সময় দিয়ে। কিছুটা দূরে ভিড়িয়ে রাখা একটি বাণিজ্যিক জাহাজ থেকে একজোড়া কাতর, ব্যথিত চোখ তাদের উপরেই বিচরণ করে। সুখী দম্পতির আনন্দময় মুহুর্ত ওর বুকে কাঁটার মতো বিধল। সম্রাজ্ঞীর প্রফুল্লতা, হাসতে হাসতে স্বামীর বুকে ঢলে পড়ার মতো সুন্দর দৃশ্যও শোক নামালো ওর হৃদয়ে। দম বন্ধ হয়ে এলো ক্ষণিকের জন্য। নয়নজোরা ছলছল করে উঠলো অজান্তেই। বণিকের ভেজা কন্ঠে বারংবার, শতবার উচ্চারিত হলো,

“জানি, এই তুমি কখনোই আমার হবে না। তাও চাইবো তুমি আবার এসো আমার জীবনে। আবারো নতুন করে, নতুন রূপে অজানা, অপরিচিতা হয়ে এসো। তেজী কন্ঠে আরোও একবার নিজের পরিচয় জানিও। বলে দিও তুমি ভালোবাসো না আমাকে।”

সমাপ্ত–