সর্বনাশিনী পর্ব-১৫

0
473

#সর্বনাশিনী
#সুরাইয়া সাত্তার ঊর্মি
১৫।
“দিলশাদ!”

স্নেহা শক্ত করে চোখ বুজে রাখলো। হঠাৎ করেই ঘামতে শুরু করলো । অনেকক্ষণ এভাবে কেঁটে যাওয়ার পর স্নেহা ধীরে ধীরে চোখ খুললো। এক চিলতে আলোর ঝিলিক স্নেহার বড় বড় চোখ জোড়ায় জ্বালা করতে লাগলো। স্নেহা আবারো চোখ বুঝে ধীরে ধীরে চাইলো। নাহ্… সামনে কেউ নেই, কিছুটি নেই, নেই কোনো মানব অবয়ব। স্নেহা স্থীর শ্বাস ছাড়লো। কিন্তু ঝীম ঝীম করতে লাগলো স্নেহার শরীর। চোখের সামনেই আঁধার নেমে এলো মুহূর্তে-ই। সঙ্গে সঙ্গে লুটিয়ে পড়লো মাটিতে।

অনেকক্ষণ যাবত স্নেহাকে বের হতে না দেখে মাহাদ নিজেই এগিয়ে গেলো ট্রায়াল রুমের দিকে। নক করলো সে,

” আকৃতা? আকৃতা? এতক্ষন সময় লাগছে কেন? আর ইউ ওকে??”

ভিতর থেকে কোনো রা শব্দ এলো না। মাহাদ আবারো নক করলো। কিন্তু? কিন্তু? এবারো কোনো সাড়াশব্দ নেই। মাহাদের কপালে এবার টেনশনের রেখা ফুটে উঠলো। এক ধাক্কা দিয়ে দরজা খুলে ভিতরে ঢুকতেই স্নেহার নিথর দেহ মাটিতে লুটিয়ে পড়তে দেখেই নিজের কোলে তোলে নিলো। ডানে নয়, বামে নয় সোজা হসপিটালে নিয়ে এলো তাকে। কিছুক্ষণ পর ডাক্তার খুশি খুশি কন্ঠে বললেন,

” কংগ্রাচুলেশন মি: মাহাদ, আপনি বাবা হতে চলেছেন।”

মাহাদ থতমত খেয়ে গেলো এমন একটি বাক্য শোনে। ড্যাব ড্যাব করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল,

” কে বাবা? আ..আমি? কিন্তু…!”

ডাক্তার খুশিতে গদ গদ। নিজেরই যেন বাচ্চা কাচ্চা হচ্ছে। বললেন,

” আরে বাবা কোনো কিন্তু নই, জলদি যাও মিষ্টি নিয়ে আসুন, আপনার বউকে মিষ্টি মুখ করান। ”

মাহাদের এবার রাগ উঠলো। খায়া পিয়া কুচ নেহি গিলাস তুড়া বাড়ো আনা’, মাহাদের গল্প এক্কেবারেই তাই! সে তো কখনো আকৃতাকে স্পর্শ করেনি। যাস্ট আজ কোলে নিয়ে ছিলো। কোলে নিলে তো অবশ্য কেউ আর বাচ্চার মা হয়ে যায় না?? মাহাদ বলল,

” আপনার ভুল হচ্ছে ডাক্তার ও আমার বউ না।”

ডাক্তার বড় বড় চোখ করে চাইলেন। এক গাদা ভয়ংকর ভয়ংকর গালির ঝুড়ি খুলে মাহাদকে ধুয়ে দিয়ে বলে উঠলেন,

” আজকালকার ছেলে মেয়েদের যে কি হয়ে গেছে। বিয়ে আগেই বাচ্চা না নাউজুবিল্লাহ। আজ তোমাদের মতোই যুবকদের জন্য, বাচ্চারা অনাথ! আহারে!”

ডাক্তার দুঃখ প্রকাশ করলেন। এদিকে মাহাদের যেন ভরা বাজারে কাপড় খুলে যাবার অবস্থা। ভাগ্যিস বুদ্ধি করে আগেই মুখের মাস্ক পড়ে এসেছিলো। নয়তো কাল সকালের বড় বড় অক্ষরে হ্যাডলাইন হতো… ” বিশিষ্ট পপ সিঙ্গার মাহাদ চৌধুরী করলো অবিবাহিত নারীকে একবার কোলে তোলেই প্রেগন্যান্ট?”

মাহাদ শুকনো ঢুক গিললো। তার মনে হচ্ছে এখনি এদিক সেদিক থেকে হয়তো কোনো পঁচা টমেটো, ডিম কেউ ছুঁড়ে মারবে। কিন্তু তেমন কিছু হলো না। স্নেহা চোখ খুললো। ডাক্তার খুশির ঝলক মুখে টেনে দাঁত কেলিয়ে বলল,

” মি. আকৃতা? আপনি মা হতে চলেছেন!”

স্নেহা চমকালো। সাথে সাথে উঠে বসলো। নিজের পেটের মাঝে হাত রেখে বলল,

“আমি প্রেগনেন্ট……! ”
স্নেহা ফুপিয়ে উঠলো…এটা কি খুশি কান্না? নাকি দুঃখের? কিন্তু সে তো পিল খেয়েছিলো। তাহলো?

স্নেহার ভাবনার মাঝেই মাহাদের থমথমে কন্ঠ ভেসে এলো,

” আকৃতা? এসব কি?”

স্নেহা চোখ মুছলো। পেটের মাঝে হাত রেখেই ভাবলেশহীন ভাবে বলল,

” মি: মাহাদ, আপনার সত্যিটা এবার জানা উচিত আমি আকৃতা নই, আমি স্নেহা।”

মাহাদের পায়ের নিচে থেকে যেন মাটি সরে গেলো। হাত দুটো শক্ত করে নিয়ে নিজের অনুভূতি গুলো দাবিয়ে রাখার চেষ্টা করলো।বলল,

” তুমি… তুমি মিথ্যা বলছো? তুমি আকৃতা? আমি জানি আকৃতা আমি তোমাকে অনেক কষ্ট দিয়েছি, তাই বলে এভাবে আমাকে ফিরিয়ে দিও না!”
লাস্ট কথা টুকুতে ব্যাকুলতা ভেসে উঠলো মাহাদের কন্ঠে।
স্নেহা ফিকে হাসলো। বলল,

“এমন কেনো হয়? আপনি যাকে বেশি ভালোবাসেন, সেই ব্যক্তি আপনাকে কষ্ট দেয়, দূরে ঠেলে দেয়। আবার সেই ব্যক্তি যখন দূরে চলে যেতে চায় বা চলে যায়? তখন আপনারা তাকে কাছে পাবার জন্য লড়াই করেন? ভালোবাসার মানুষকে কখনো হারিয়ে যেতে দিতে নেই মি: মাহাদ। আকৃতা আপনাকে অনেক ভালোবাসতো। আফসোস আপনি বুঝতে পারেন নি সময় মতো!”

মাহাদ পিছিয়ে গেলো। বলল,

” ভালোবাসতো মানে? আ.. কৃ..তা কোথায় এখন?”

স্নেহা মাহাদের দিকে তাকালো। লোকটির কন্ঠ কাঁপছে। আবারো চোখ ফিরিয়ে রাতের আঁধারে ভেসে থাকা তারার দিকে ইশারা করে বলল,

” আমাদের অনাথ আশ্রমে একজন সিস্টার ছিলেন। খুব আদর করতেন আমায়, রাতে যখন বাবা-মার জন্য কান্না করতাম? বলতেন, মানুষ মারা গেলে নাকি তারা হয়ে যায়। যদিও কথাটি এখন বুঝতে পারি ভিত্তিহীন। তবে মনের শান্তির জন্য এখনো আকাশে তাকিয়ে আমার বাবা-মার মুখটি দেখার চেষ্টা করি!”

মাহাদের চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়লো। সুদর্শন মুখ লাল হয়ে গেলো। ছিটকে বেড়িয়ে গেলো স্নেহার কেবিন থেকে। হঠাৎ করে মনে হতে লাগলো তার শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। এখনি নিশ্চয়ই সে দম আটকে মারা যাবে?

এদিকে স্নেহা নিজের পেটের মাঝে হাত বুলিয়ে যেতে লাগলো। আগের বার তার বাচ্চাটি পৃথিবীর বুকে আসার আগেই হারিয়ে গেছিলো। এবার? এবার কি করবে স্নেহা? বাচ্চাটাকে নষ্ট করে ফেলবে? নাকি এই সুন্দর পৃথিবীর মুখ দেখাবে?

—————-

তালুকদার বাড়ির সামনে একটি মেয়ে জীর্ণশীর্ণ শরীরে উপস্থিত হয়েছে। শরীরের নোংরা ছেড়া কাপড় আর অনেক দিনের না গোসল করার ফলে সেহেরকে ভিকেরি মনে হচ্ছে। সায়রা দরজা খুলে এক ভিক্ষুক ভেবে নাক ছিটকে দুর দুর করে তারিয়ে দিতে লাগলো। সেহের নিজের মাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কান্না জড়িত কন্ঠে বলল,

” মা.. মা আমি সেহের তোমার সেহের!”

সায়রা অবাক হয়ে গেলো। কিছুক্ষণ আগে ভিক্ষারি ভেবে যাকে তাড়িয়ে দিচ্ছিলো তাকে কাছে টেনে নিলো। মা-মেয়ে দুজনে ডুকরে উঠে কাদলো। সায়রা বলল,

” তুই কোথায় ছিলি এতদিন? এ হাল কেন তোর? ”

সেহের তার মাকে সব খুলে বলল,

” মা… মা এই সব ওই আকৃতা করেছে!”

সায়রা রাগে কিড়মিড় করে উঠলো। বলল,

” ওকে আজ আমি জমের ঘরে পাঠাবো!”

সেহের আটকালো,

” মা এখন না। পরশু আমার জম্মদিন। সেদিন না হয় ওকে শিক্ষা দিবো!”

সায়রা তালুকদার সেহেরের মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,

” আহারে আমার মেয়েটার কি হাত করেছে ডাইনিটা?”

—————-

দেখতে দেখতে সময়ের পরিবর্তন হতে থাকলো। সেহেরের ধুমধাম জম্মদিনে তালুকদার বংশ ধুমধাম করে আয়োজন করা হলো। এদিকে আমরিন পরিবার শেখ পরিবার সহ সবাইকে দাওয়াত করা হলো। আকৃতা শেখ তার মায়ের সাথে পা রাখলেন হলে। সেহের দূর থেকে দেখে বাঁকা হাসলো। মনে মনে বলল,

” স্নেহা? তুমি আমাকে ছেড়ে দিয়ে অনেক বড় ভুল করেছো, সে বার মারতে পারিনি, কিন্তু এবার? এবার আর ছাড়ছি না তোমায়!”

এদিকে জমকালো সন্ধ্যা টুইস্টের যেন শেষ নেই। বড় বড় নামি দামি মানুষের সামনে সেহের কেক কাটলো। দিলশাদ না চাইতেও রোবটের মতো দাঁড়িয়ে আছে। স্নেহা দূর থেকে লোকটিকে দেখছে। আচ্ছা আজ এই লোকটি যখন জানবে? যেই সেহেরকে তার মায়ের জান বাঁচানোর জন্য, এতটা প্রাধাণ্য দিচ্ছে? সেই সেহের তার মাকে মারতে চেয়েছে কি করবে দিলশাদ?

স্নেহা জুসের গ্লাসে চুমুক দিলো। সেহেরের এবার কেক কাটার পালা। সকলের এটেনশন সেহেরের দিকে। সেহের কেক কাটলো। সেহের তার বাবা মাকে কেক খাইয়ে দিয়ে দিলশাদের মুখে তুলে দিতে নিলো। ঠিক সেই সময় পুরো হলের আলো বন্ধ হয়ে গেলো। আর তখনি সামনের পর্দায় ভেসে উঠলো সেহেরের প্রতিছবি,

” হ্যাঁ আমি খুন করেছি স্নেহাকে, আমি বিন্দু আন্টিকে মারতে চেয়েছি, আমি স্নেহার বাচ্চাকে এই পৃথিবীর মুখ দেখতে দেই নি!”

সকলেই জমে গেছে যেন নিজ নিজ জায়গায়। সেহের থরথর করে কাঁপতে লাগলো। আকৃতা শেখের দিকে কটমট করে তাকিয়ে রইলো সে। আকৃতা জুসের শেষের ঢুক পান করে উঠে দাঁড়িয়ে পড়লো। লাইট ততখনে জ্বলজ্বল করছে হল ঘরটিতে। সেহেরের মনে হলো সেই আধার কেন চলে গেলো? কেন তাকে নিয়ে গেলো না? আকৃতা হাসলো,

” কার্মের ফল সবাইকে পেতে হয় । হয়তো এই দুনিয়ায় নয়তো পরের দুনিয়ায়। একেই বলে কর্মা…!”

স্নেহা হেটে বেড়িয়ে গেলো হল ঘরটি থেকে। খুব ইচ্ছে হচ্ছিলো দিলশাদের মুখটির দিকে একবার দেখবার। তখনি পিছন থেকে ভেসে এলো ধাম করে হওয়া একটি শব্দ। তারপর… তারপর…..

চলবে,