সায়রে গর্জন পর্ব-১০+১১

0
9

#সায়রে_গর্জন
#নীতি_জাহিদ
১০.
( অনুমতি ব্যতীত কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ)

“দুর্গম গিরি, কান্তার-মরু, দুস্তর পারাবার হে!

লঙ্ঘিতে হবে রাত্রি নিশীথে, যাত্রীরা হুঁশিয়ার॥

দুলিতেছে তরী, ফুলিতেছে জল, ভুলিতেছে মাঝি পথ

ছিঁড়িয়াছে পাল কে ধরিবে হাল, আছে কার হিম্মত।

কে আছো জোয়ান, হও আগুয়ান, হাঁকিছে ভবিষ্যত,

এ তুফান ভারি, দিতে হবে পাড়ি, নিতে হবে তরী পার॥
তিমির রাত্রি, মাতৃ-মন্ত্রী সান্ত্রীরা সাবধান!”

মধ্য রাতে বাসায় ফিরতে ফিরতে ঘড়িতে রাত সাড়ে তিনটা। রাস্তায় দুবার পুলিশের সাথে দেখা।চিনতে পেরে ভীষণ অবাক হয়েছে। অন্যরা এই সময়টাতে নাইট বারে, নারী নিয়ে ঘুমে ব্যস্ত অথচ এই এমপি শরীর চর্চায়। কিছুটা ভীতসন্ত্রস্ত হয়েছে। বলা যায় না এরা উচ্চ পদের মানুষ। কে জানে কি কারণে নিশাচর হয়েছে! বাসায় ফিরে ক্লান্ত হয়ে ঘুম দিয়েছিলো।

সকাল সকাল এমন গান শুনে ফোনের দিকে তাকিয়ে আছে। ফোনে ইভেন্ট মেমোরী দেয়া ছিলো। পাঁচবছর আগে এই দিনটাতে দুই বন্ধু একসাথে সেলিব্রটে নেমেছে। আজ ১৫ ই মে। কমিশন্ড পাওয়ার দ্বিতীয় দিন ছিলো। এই গান গেয়ে প্রতিবছর নিজেদের মাঝে উদযাপন করতো। সেদিন লে.কমান্ডার র‍্যাংক পেয়ে মনে হলো অনেক বড় অর্জন হয়ে গিয়েছে। অন্য কমিশন্ড গুলোর চেয়ে তুলনামূলক অনেক বেশি কঠিন ছিলো এবারের পরীক্ষা। রাশেদ ছুটিতে বাড়ি ফিরেই বিয়ে করে নিয়েছিলো পছন্দের পাত্রী তাহিকে। যে সম্পর্কে শাহাদের ছোট বোন। যত ভাববে স্মৃতি তত পীড়া দিবে।

ফযরের নামায আদায় করে তৈরি হয়ে নিলো। বেরিয়ে পড়েছে ইন্দ্রপুরের উদ্দেশ্যে। মিটিং টা পোস্টপন্ড করে দিয়েছে। পাভেল গাড়ি চালাচ্ছে। জ্যামের কারণে ঢাকা ছাড়তেই দেড় ঘন্টা। অফিস আওয়ার শুরু। মানুষ গুলো ছূটছে জীবিকার তাগিদে।

___

ইন্দ্রপুরের বিখ্যাত দিঘি মায়াবিবির দিঘি। এই দিঘি নিয়ে কত লোককথা, রূপকথা, শ্লোক,পুঁথি রয়েছে। প্রতি বুধবার রাতে মায়াবিবির মাঠে পুঁথি পাঠ হয়।গ্রামের প্রতিটি মানুষের মুখে মুখে থাকে এই পুঁথি। পূর্ণিমা রাতে জমজমাট আসর বসে মায়াবিবির মাঠে।এছাড়াও সেদিন ভোর থেকে গ্রামে উৎসব, মেলা হয়। এই গ্রামের মেলা দেখতে আশপাশের গ্রাম থেকে সবাই আসে। শাহীন মায়াদিঘির সামনে দাঁড়িয়ে দিঘির শ্বেতপদ্ম গুলোর দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে আছে। হাতের মুঠোফোনে কাঙ্ক্ষিত নম্বরটা চেপে ডায়াল করলো। ও পাশ থেকে ভেসে আসলো সেই সুর,

– এতক্ষনে তবে মনে পড়লো এই অসহায় অবলা নারীকে?

– আমি তো তারেই দেখছি শান্ত হয়ে,
পদ্মদিঘির পাড়ে
আমি তো তারেই দেখছি যে আমার
চক্ষে ভাসে,বক্ষে থাকে,ফোটে ঠোঁটে
কথার বেশে,
সে তো আমার চক্ষে ভাসে
প্রাণনাশীনি হয়ে,
তৃষ্ণায় আমার বক্ষ ফাটে,
প্রেম পিয়াসীর ছলে,
সে আমার পদ্মফুল
আমার মাঝে ফোটে।
আমি তার মায়াদিঘি
সে আমার কুমুদিনী।
এতেই আমার শান্তি তবে
দুই হৃদয়ের মিলন হবে।।

বিপরীত পাশ থেকে খিলখিল হাসির শব্দে মুখরিত পরিবেশ। চলছে দুষ্টু মিষ্টি আলাপন। ঘড়িতে এখন মধ্য দুপুর। শাহীনের দাদাবাড়িটা কাঠের দোতলা বাড়ি। দাদা থাকাকালীন এই গ্রামের স্বনামধন্য বাড়ি ছিলো। এখনো কাঠের দোতলা বললে সকলে এক নামে চিনে মোতালেব মাহমুদের ‘তারা ভিলা’। শাহীনের দাদীর নাম ছিলো তারামনি খান। খান বংশের নবাবজাদী ছিলেন তিনি। মোতালেব মাহমুদ এই গ্রামের নামকরা মাতবর ছিলেন। নামে কাঠের দোতলা হলেও বাড়িটি আভিজাত্যে পরিপূর্ণ। লোকে বলে গ্রাম হয় ছবির মতোন। ঠিক তাই এই ইন্দ্রপুর শিল্পীর তুলিতে আঁকা সেই সুনিপুণ ছবিখানা যার মূল্য নেই,অমূল্যবান অতুলনীয় রত্ম বাংলাদেশ মাতৃকার। গ্রামের রাস্তা গুলো প্রতি ছয়মাস পর পর সংস্করণ করে এই গ্রামের সকল গণ্যমান্য ব্যক্তিরা। গ্রামটাতে শহুরে ধাঁচের কোনো ছোঁয়াই পেতে দেন নি তারা।সেই কমিটিতে রায়হান সাহেব ও আছেন। দিঘীর পাড় ধরে হাঁটতে হাঁটতে কথা বলছে নওরীনের সাথে। এত কথার মাঝে নওরীন প্রশ্ন করলো,

– আচ্ছা শাহীন তুমি তো ভাবীমাকে দেখেছো উনি কি খুব সুন্দর?

শাহীন মৃদু হাসে।নওরীনের কৌতুহলটা বুঝতে পারে। নওরীন ভাবনার মাঝে পুনরায় প্রশ্ন করে,

– উনি কি আমাদের মত কথা বলে নাকি আরবি,ইরানীতে বলে?

এবার শাহীন অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো। এর আগে নওরীন এমন অদ্ভুত প্রশ্ন করেনি। শাহীন যতটুকু সময় পেত কথা বলার সেই সময়টা নিজেদের কথা বলেই পার হয়ে যেত। শাহীন এতগুলো প্রশ্নের উত্তরে জানালো,

– নীরা পাখি শুনো ভাবীমাকে আমি সেই নজরে দেখিনি। উনাদের বিয়ের প্রায় দুই কি আড়াই বছরে এবারই প্রথম দেখলাম। আম্মু তো ছবিও পাঠায়নি আমাকে ভাবীমার। আম্মুর মতে ছেলের বৌয়েরা ঘরের ইজ্জত,অহংকার,গৌরব। তাই দেখেও এত পর্যবেক্ষন করার সুযোগ পায়নি আর পেলেও করতাম না। উনি আমার ভাইজানের স্ত্রী। ভাইজান আমার কাছে পিতা সমতুল্য আর ভাবীমা মায়ের সমতুল্য। যদি বলো সন্তান হিসেবে মাকে কেমন দেখেছি সেই কথার উত্তর হলো,আমার ভাবীমা দেখতে মাশাল্লাহ চমৎকার। মায়েরা অদ্বিতীয়া, তুলনা হয়না। আর ব্যবহার ও যথেষ্ট মার্জিত। আমার বায়োলজিক্যাল মা আমার জীবনের সব আর ভাবীমা আমার জন্য সম্মানীয়া একজন।আমার ভাইজানের সহধর্মিণী বলে কথা। উনার সাথে কথা হয়েছে দুবার কি তিনবার এই দুইদিনে। আর উনি বাংলাতেই কথা বলেন আমাদের মত স্বাভাবিকভাবে।তবে হালকা টান পাই স্বরে। বাংলা টান নয় নিশ্চিত। হয়তো উনার মায়ের ভাষার টান! তুমি সংসারে আসলে উনাকে দেখতে পাবে। তোমার নিজেকে ছোট মনে করার কিছু নেই এই ভেবে যে উনি বিদেশী মায়ের সন্তান, উনি বিশ্বসেরা। বরং এটাই বলব যে তাকে মায়ের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখো। মা সুন্দর হলে তো সন্তান খুশি হয়। আমরাও ভীষণ খুশি। ঠিক বলেছি না! আর কিছু জানার থাকলে সব নাহয় উনার কাছ থেকে জেনে নিও।

নওরিন হালকা হেসে বলে,

– তুমি খুব ভালো একজন মানুষ। এত সুন্দর করে বললে কথাটা, ভাবীমাকে মা হিসেবে ভাবতে।আমার মন ছুঁয়ে গিয়েছে শাহীন। এই কথা এখন মনে ভাবতেই শান্তি পাচ্ছি। মনে হচ্ছে আমি কি সেই সুযোগ পাবো, এত সুন্দর, সুশীলা নারীকে ভাবীমা ডাকার!

– ইনশাআল্লাহ পাবে। আল্লাহ সৎ স্বপ্ন অপূর্ণ রাখেন না। আমিও আব্বু,আম্মুকে জানাই এরপর ভাইজানকে জানাবো।

-ঠিক আছে। ধন্যবাদ।

গ্রামের লিলুয়া বাতাস মন ছুঁয়ে দিলো। কথা শেষ করে দিঘি ছেড়ে মেঠো পথ ধরতেই নিশাদ, কাব্য, রজত, লিমন ঘিরে ধরলো। নিশাদ শাহীনের কাঁধে হাত রেখে বলে,

– বিয়ে করলাম আমি,আর ফোনে কথা বলতে বলতে লজ্জা পাও তুমি। ব্যাপার কি ছোটদা?

– লজ্জা পাইনি কথা বলছিলাম এক বন্ধুর সাথে। ওদিকে চল। গেস্ট কি সবাই চলে এসেছে?

– চলে আসছে মোটামুটি সবাই। আমার চাচ্চুরা, ফুফিরা।

রাস্তার পাশ ধরে পাঁচজন হাঁটছে আর কথা বলছে। মাঝে মাঝে গ্রামের মানুষদের সাথে করমর্দন করছে।কথা বলছে। লিমন বলে উঠলো আচমকা,

– নিশাদ ভাই তোমার তো অনেক চাচাতো বোন আছে,রাইট? সিংগেল আছে না?

শাহীন পেছন থেকে কান মলে বলে,

– এর চাচাতো বোন তোর কি হয়?

– না… মানে মামাতো বোন। হি হি হি

– তোর এখনো প্লেবয় গিরি যায় নি! শুনলাম ক্যাম্পাসে নাকি দাদাগিরি করে বেড়াস!

– আহ, ছোটদা ছাড়ো। লাগছে। তোমাকে কে বলেছে এসব। আমি অনেক শান্ত বাচ্চা।

কান ছেড়ে দেয় শাহীন। শাহীন দুষ্টু হাসি দিয়ে বলে,

– শুনো বাছাধন,খবর টা আমার কাছে সরাসরি আসেনি। যার বোনকে টিজ করে তিনি উপর মহলকে জানিয়েছেন। উপর মহলের পি এস আমাকে অবগত করেছেন এই সম্পর্কে। দয়া করে ভুল করেও যদি উপর মহলের সামনে পড়ে যাও পাশ কেটে যেও। প্রশ্ন করলে দোষ স্বীকার কইরো।নাহলে ‘তারা ভিলা’ র গোয়াল ঘরে নিয়ে গরুর ভুষি খাইয়ে ছাড়বে,অথবা পিঠে চ্যালা কাঠ ও ভাঙতে পারে।

লিমনসহ বাকিরা ঢোক গিললো। কাব্য জোরে লিমনের পিঠে এক কিল দিয়ে বলে,

– শা*লা টিজ করার আগে দেখবি না কার কোন ক্ষেতের মূলা তুলতেছিস। ঘুরায় ফিরায় একই ঘাটে জল খেতে আসিস কেনো?

রজত ছেলেদের মধ্যে সবার ছোট। শাহীনের বড় ফুফুর ছোট ছেলে। সবে মাত্র নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ে পা দিয়েছে লন্ডনে। লিমন এবং কাব্য সমবয়সী। লিমন মেজো চাচার ছেলে। কাব্য ছোট চাচার ছেলে। নিশাদ দুজনের বয়সে বড়। নিশাদ- শেফালী সমবয়সী। রজত বিস্ময় নিয়ে বলে,

– হোয়াট ইজ উফর মাহল! হ্যাভ ইউ টোল্ড এবাউট বড় ভাইজান!

শাহীন মাথা ঝাঁকায়। রজত মিষ্টি হেসে বলে,

– ওহ রিয়েলী? হোয়াই ইউ আর এফ্রেইডিং, হি নেভার স্কল্ড। হি ইজ সো ইনোসেন্ট। ইজন্ট হি!! সো কিউট!

লিমন খ্যাঁক করে উঠলো,

– আহারে আমার বিলেতি মূলা। উফার মাহল কি! শা*লা উচ্চারন ঠিক কর। হি ইজ ইনোসেন্ট!কিউত! উফ কত্ত সোন্দর,প্যান্টাশটিক কতা,পরানডা শীতল হইয়া গেছে। তোমালে তো বড় ভাইজান ল্যাদা পোলাপানের মত প্যাম্পার করে তাই ইনোচেন্ত লাগে। ব্যাটা চিনিস তুই বড় ভাইজানরে! থাকো তো সাত সাগর তেরো নদীর ওই পাড়ে। বছরে আসো দুই বার আর আসছে বড় ভাইজানের সার্টিফিকেট দিতে।

রজত পাত্তাই দিলো না লিমনকে। উলটো ঝাড়ি দিয়ে বলে,

– দোষ খরেছো তাই বকা খাবা। অবশ্যই ভালো কিছু খরোনি। সো ইউ আর গিল্টি,ইউ হ্যাভ টু গেট পানিশমেন্ট। বাট ইফ ইউ ওয়ান্ট দেন আই উইল রিকমেন্ড ফর ইউ।

– আই সাদা মূলা চুপ কর। তোর এই ভোঁতা মুখ ধোতা বানায়ে দিবে এভাবে ইংরেজি ফর ফর করলে। খরোনি,খরেছো। বাংলা ভাষার এক্কেরে ই-জ্জ-ত মা-ই-রা দিছে।

রজত আগে আগে হাঁটা ধরলো লিমনকে ভ্যাংচি কে*টে।শাহীন এদের দেখে হাসছে। লিমন ধপাস করে মাটিতে বসে শাহীনের পা জড়িয়ে ধরে বলে,

– ও ছোটদা এবারের মত বাঁচায়ে দাও। আর করবো না। এবার করলেও ওই মেয়ের চৌদ্দ না আটাশ আরেহ না থুক্কু বায়ান্ন গুষ্টির ঠিকুজি বের করে এরপর করবো। এবারের মতো উদ্ধার করো।আমি বড় ভাইজানের মা*ই*র খাইতে চাইনা। একটা থা*বা দিলেই তো আমি জায়গায় কু*পো*কা*ত।

শাহীনসহ বাকিরা ভ্যাঁবাচেকা খেয়ে গেলো। শাহীন লিমনকে তুলে বলে,

– আসলে করছিলি টা কি সেটা বল।

লিমন আমতা আমতা করে বলে,

– ইচ্ছে করে করছি শুনো, কিছু থাকেনা ক্যাম্পাসে ন্যাকা ষষ্ঠী। ওটা ওরকম ছিলো মেয়েটা। আমার এক বন্ধুর সাথে বেশকিছুদিন ঘুরছে,এসাইনমেন্ট সব ওর কাছ থেকে করে নিয়ে এরপর চিট করছে। ছেলেটা অনেক কষ্ট পেয়েছিলো।সাদা সিধা ছেলে। আমিও এই পেইন বুঝাতে ওর সাথে সেম কাজ করছি।আমি তো বুঝিনাই মেয়ে আমার প্রেমে হাবুডুবু খেয়ে পিঁপড়ার বিষ খাবে। আরো শুনো ওই ন্যাকার রানী পিঁপড়ার বিষ নাকি নুডুলসের সাথে মিশিয়ে মেয়োনিজ,তেতুলের সস আর টমেটো সস দিয়ে খেয়েছে। এরপর নাকি পেট খারাপ হয়ে তিনদিন হাসপাতালে ছিলো। কিন্তু আমার কথা হলো তুই ম*র*বি যখন মানুষ ম*রা*র বিষ খা,পিঁপড়ার বিষ কেন!

ওর কথা শুনে উপস্থিত চারজন মাটিতে গড়িয়ে,লুটিয়ে ও শরীর কাঁপিয়ে হাসছে। কাব্য তো রীতিমতো হাসতে হাসতে তাল গাছের সাথে হেলান দিয়ে নিচে বসে গিয়েছে। রাস্তার পাশে ঘাসের মাঝে রজত শুয়েই পড়েছে হাসতে হাসতে। নিশাদ মাটির মধ্য উঁবু হয়ে বসে গিয়েছে। শুধু শাহীন দাঁড়িয়ে হাসছে। শাহীন পরিস্থিতি সামাল দিয়ে বলে,

– তোরা থাম, আজকে কপালে দুঃখ আছে।এত হাসি অনেক দিন হাসিনি। শুনেছি উপর মহল কিছুক্ষন আগেই পৌরসভায় চলে এসেছে। সেখানে সকলের সাথে দেখা করে গ্রামে ঢুকবে। বাড়ির দিকে যাওয়া যাক।

নিশাদ শরীরের ময়লা ঝেঁড়ে উঠে বলে,

– আরে দাঁড়াও আসল কাজটাই করা হয়নি। মা ডাব নিতে বলেছিলো সফি নানাদের বাগান থেকে। নানার কাছে যাব চলো।

রজত লাফিয়ে বলে,

– আই লাভ গ্রীন খোখোনাট।

লিমন তেড়ে এসে বলে,

– ছোটদা… ওরে থামতে বলো।আজকে শুরুটা ও করবে মনে হয়। ভাই রে বাংলা বল। বল যে, আমি সবুজ ডাব,কাঁচা ডাব অথবা ডাব খাইতে ভালোবাসি। বল আমার মুখে মুখে।

– আমি খাচা ডাব কাইতে বালোবাসি।

লিমন মুখটাকে বাংলা পাঁচের মত করে একবার শাহীন আরেকবার নিশাদের দিকে তাকিয়ে আছে। পুনরায় অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে।শাহীন লিমনের কাঁধ চাপড়ে বলে,

– ওকে ছাড়, ও তো অবুঝ।আস্তে আস্তে শিখে ফেলবে। চল সফি দাদাদের বাগানে।দাদার সাথে দেখা হয়না অনেক দিন।

___

বাড়ির উঠোনটা খুব সুন্দরভাবে গ্রামীন আন্দাজে সাজিয়েছে গ্রামের ডেকোরেশনের লোকজন। মঞ্জিলা চেয়েছে কাগজের ঝালর, জরি, কলাগাছ,আম পাতা দিয়ে পুরোনো বিয়ের রীতিমতো ছেলের বৌভাতের অনুষ্ঠান করতে। সেই সাথে রয়েছে কাঁচা ফুলে সাজানো, ডাক-ঢোল সানাইয়ের আয়োজন। আগামীকালই বৌভাতের অনুষ্ঠান। মঞ্জিলার বাবার বাড়ি শ্বশুরবাড়ি সব একই জায়গায়। মোতালেব মাহমুদের চাচাতো ভাই রশিদ খালেদের ছেলের সাথেই বিয়ে হয় মঞ্জিলার। সেই বাড়িতে এখন কেউ থাকেনা। মঞ্জিলার বহুদিনের আকাঙ্খা ছিলো বাবার কাঠের দোতলা দেখাবে সবাইকে। দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যা। বাড়ির মেয়েরা উঠোনের অন্য পাশে আনন্দ করছে আসন পেতে। সান্ধ্যকালীন আহার হিসেবে আছে বিভিন্ন রকম পাকোড়া,পিঠা,আচার,হাতে বানানো চিপ্স, গাছের গন্ধরাজ লেবুর শরবত আর কাঁচা আম মাখা। নিশির ফুফাতো বোন, চাচাতো বোনেরাও বসেছে। অনেকের কোলে বাচ্চা। শেহজা ফুফিদের কোলে বসে পিঠা খাচ্ছে। ঠিক তখনই বাড়ি কেঁপে উঠলো পরিচিত বজ্রনাদে । এই উঠোন কাঁপানো প্রতিধ্বনি পরিচিত।ধুকপুক করছে বুক,ধুলো উড়ছে শেহজা ফুফির কোল থেকে লাফিয়ে উঠেলো। উঠোনের মেয়েরা সকলে বাড়ির সদরের দিকে এগিয়ে এলো। মেরুন রঙের রেঞ্জ রোভার ভেলার। এই গাড়িটা তার শখের। সামনের হলুদ হেডলাইট দুটো সন্ধ্যায় পুরো উঠোন টাকে আলোকিত করেছে। উঠোনে এত বাতির পসরাও এখন ফ্যাকাশে লাগছে। সকলের পেছনে বড় ঘোমটা টেনে দাঁড়িয়ে আছে দিয়া। গাড়ির ফ্রন্ট ডোর খুলে ডান পা বাইরে রেখে বের হয়ে এলো। একপাশে মেয়েরা,অন্যপাশে ছেলেরা সব হাজির। বাড়ির বড়রাও বেরিয়ে এসেছে। মনে হয় যেন প্রতিটি মানব এই মানুষটি আসার অপেক্ষায় ছিলো। শাহাদ গাড়ির থেকে বের হতেই শেহজা একটা চিৎকার দিয়ে উঠলো। সাথে সাথে প্রথমবারের মতো মুখ দিয়ে পুরো শব্দ উচ্চারণ করলো,

– বাব্বা। বা বা।

শাহাদ সহ সকলে চমকিত। শাহীন সাথে সাথে উল্লাশে চিৎকার দিয়ে বলে,

– আম্মা বাবা বলছে…

পুরো বাড়ির উঠোন আনন্দিত,উচ্ছ্বসিত। শেহজা বাবা বলেনি মনে হলো বাবার হৃদয় জিতে নিয়েছে। পেছন থেকে দিয়া ওড়নায় দুচোখ মুছে।সে নিজেও চেয়েছিলো মেয়েটা বাবা বলুক। শাহাদ মেয়েকে ঠিক যতখানি আগলে রাখে, বাবা শোনার জন্য সেই আগে যোগ্য। শাহাদ এখনো থমকে আছে। সৎবিৎ পেয়ে পায়ের গতি বাড়িয়ে দিয়ে নিশির কোল থেকে মেয়েকে নিলো। মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলে,

– বা বা আরেক বার বলো। বাবা

শেহজা কি বুঝলো জানা নেই।সেই পুনরায় বললো,

– বা বা

শাহাদ মেয়েকে বুকের সাথে ধরে রেখেছে। বাবা হওয়ার পর যে অনুভূতিটা হয়েছিলো আজকের অনুভূতি তার চেয়ে দ্বিগুণ। মেয়ের কপালে চুমু দিয়ে সকলের দিকে ফিরে মুচকি হাসি দিয়ে বলে,

– ভালো আছো তোমরা?

নিশি বলে উঠলো,

– ভাইজান ভালো তো ছিলাম কিন্তু এখন আরো অনেক ভালো।আমাদের শেহজার কথা শুনে মন খুশিতে লাফাচ্ছে। কখন যে ফুফি ডাকবে।

শাহাদ খুব সুন্দর স্ফীত হাসি দিয়ে ইশারা করলো ঘরে যাওয়ার জন্য। মায়েরা কথা বলতে বলতে ভেতরে নিয়ে চললো। ঘাড় ঘুরিয়ে উঠোনের সাজ দেখেই মঞ্জিলাকে বলে উঠলো,

– গ্রামীন ছোঁয়া, এটা ভালো করেছো ফুফি। দেখতে বেশ লাগছে…

চোখ পড়লো সবচেয়ে পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা নিশ্চল,নিষ্প্রাণ, অনুজ্জ্বল মুখটার দিকে। চোখাচোখি হতেই মুখ ফিরিয়ে নিলো। শাহাদ চোখ ফিরিয়ে ঘরের উদ্দেশ্যে পা ফেলে কদম এগিয়ে নিলো। নেত্রদ্বয় সম্মুখে, কিন্তু মনস্তাত্ত্বিক চিন্তাধারা পেছনে। বাতাসের শো শো আওয়াজে শীতল পরশ।ঘরের দরজায় পা দিতেই পুনরায় পেছন ফিরতেই শুভদৃষ্টি। দিয়ার মুখে হাসি দেখে নিজেকে আর সামলাতে পারলোনা। বোকার মত এক চিলতে আনমনে হাসি দিয়ে দিয়ার দিকে তাকালো।দু অধর আলগা হয়ে গেলো রমনীর। এত মনোরম হাসি!!!!

চলবে…

#সায়রে_গর্জন
#নীতি_জাহিদ
১১.
(অনুমতি ব্যতীত কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ)

সকলের রাতের খাবার শেষ। মেয়েরা দোতলায় থাকবে বলে বায়না ধরেছে। রুমের খাট গুলো মোগল ধাঁচের। দিয়া হাত দিয়ে ধরে খাটের কারুকার্য দেখছে।দিয়ার কাছে এগুলো পুরোনো ব্যাপার।তার দাদাবাড়ির খাট গুলো এমন। রুমের মাটিতে মাদুর বিছিয়েছে মেয়েরা। শেফালী আবিরকে শাহীনের কাছে দিয়ে এসেছে।

– শাহাদ ভাই অনেক ড্যাশিং কিন্তু।

বিদিপ্তার কথা শুনে রুমের প্রতিটা প্রানী ওর দিকে ফিরলো। নিশি চাচাতো বোনের দিকে তাকিয়ে বলে,

– বিদি আপু তুমি কি পাগল হলে,ভাবীজান বসে আছে সামনে আর এসব বলছো!

– আরেহ বাবা এমনি বললাম উনি সামনে থাকলে কি সমস্যা। ব্যাপার গুলোকে নরমালাইজ করা শিখ। অস্ট্রেলিয়াতে তো মেয়েরা উনাকে পাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠতো।

– এটা বাংলাদেশ অস্ট্রেলিয়া নয় বিদি।

মনির কড়া জবাবে বিদিপ্তা চুপ হলোনা বরঞ্চ আরো জোর গলায় বললো,

– সেটাই আমি বুঝাতে চাইলাম,বাংলাদেশে এসব অপশন নেই বলেই রেপের সংখ্যা বাড়ছে।

শাহাদের সাবিনা খালার মেয়ে তাহি। বড্ড বিরক্ত নিয়ে বলে,

– কি অদ্ভুত সব যুক্তি।হাতে পায়ে ধরছি বোন।আমরা তোমার মত অত স্মার্ট না তাও দয়া করে বড় ভাইজানকে নিয়ে এসব বলোনা। শুনতে কেমন লাগে। কই ভাইজান আর কই অস্ট্রেলিয়ান মেয়ে। ছিঃ।

– ওকে স্যরি আর বলবোনা।এভাবে রিয়েক্ট করোনা তোমরা। তবে আমার এইজড পারসোনে বড্ড এলার্জি কিন্তু এই প্রথম উনাকে দেখে ক্রাশ খেয়ে খেলাম। ভাবী প্লিজ রাগ করবেন না আমি আগেই স্যরি বলে নিচ্ছি।এই বাড়িতে সব ছেলেই অনেক স্মার্ট কিন্তু উনাকে দেখেই আমার হার্টবিট বেড়ে গেলো। ফিল করেছি উনাকে আমি।

– চলো ভাইজানের দ্বিতীয় বউ তোমাকে বানিয়ে দিই।

মনি,তাহি একসাথে ধমকে উঠলো শেফালীকে।

– পাগলের মত বকিস কেনো। বেয়াদপ।

– আমি তো মজা করলাম

শিফা বলে উঠলো,

– আপা মজার ও তো সীমা থাকে।

– দুদিন পর ভাইজান এমনিতেই দ্বিতীয় বিয়ে করবে। দেখেছিস দু বছরে একবারো এই মেয়ের সাথে শুতে! আমি আগে বললে দোষ কি! পাত্রী তৈরি থাকলো।

তাহি উত্তেজিত হয়ে চেঁচিয়ে দাঁতে দাঁত খিচে বললো,

– ভাইজান গুনে গুনে তোর থেকে তেরো বছরের বড় শেফালী।তোর কি এতটুকুও লজ্জা লাগেনা ভাইজানকে নিয়ে এসব বলতে। এত নিচে নামলি যে কার সাথে কখন ভাইজান শুবে ওটা নিয়েও তুই আলোচনা সমালোচনা বসাবি।ছিঃ।আমার দুঃখে চোখে পানি আসছে। বাবার আসনে বসাই তাকে আমরা। অন্য সময় হলে চটকানা মারতাম তোকে।

কিছুটা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে চুপ হয়ে গেলো শেফালী। দিয়া কেমন থম মেরে বসে আছে। শাহাদ দ্বিতীয় বিয়ে করবে মানে! এটা কখন সিদ্ধান্ত নেয়া হলো। মেয়ে,জীবিত বউ রেখে কেনো দ্বিতীয় বিয়ে করবে? বুকের ভেতরটা জ্বলছে। ছিলো দূরত্বে তবুও তো তার স্ত্রী ছিলো।শেহজা থাকলে নাহয় মেয়ের বাহানায় উঠে যেত।মেয়েটা বাবার কাছে। বুকের ভেতরটা যন্ত্রণা বাড়ছে। নিজের অজান্তেই গড়িয়ে পড়লো অশ্রু। সাথে সাথে উঠে দাঁড়ায়। সামনে পা ফেলে রুম থেকে বেরিয়ে যেতে চাইলে তাহি আটকে দেয়।

– ভাবীজান বসো। সব মন খারাপ আজকে বাদ। আমার চেয়ে বেশি কষ্ট তো তুমি পাওনা তাই না। শুনো একটু গেম খেলি।কি বলো সবাই! আর শেফালী মুখ বন্ধ রাখবি।

সকলে সজোরে মাথা নাড়ালো। দিয়া চুপটি করে বাধ্য মেয়ের মত বসে পড়লো। আজ কথা আগাতে মন চাইছেনা। একা থাকলে মন খারাপ আরো ঝেঁকে বসবে। শিফা একটা বোতল এনে ঘোরালো। খেলা হবে ট্রুথ এন্ড ডেয়ার। বোতল প্রথমেই ঘুরলো প্রতীক্ষার দিকে। প্রতীক্ষা ট্রুথ নিয়েছে। প্রতীক্ষাকে প্রশ্ন করলো নিশি,

– এই নিয়ে কয়টা বয়ফ্রেন্ড মার খেয়েছে চাচ্চুর কাছে?

প্রতীক্ষা হেসে বলে,

– ছয় নাম্বারটা আম্মু ভাগিয়েছে। আব্বু জানেই না।

সকলে হাসছে। মাত্র অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে তাতেই এই অবস্থা। এরপর পুনরায় বোতল ঘুরালে মনিকার দিকে ঘুরে।মনিকা ও ট্রুথ নিলো।প্রশ্ন করলো তাহি,

– আমি জানি মনি তুই কাউকে খুব ভালোবাসিস, কিন্তু এখনো জানাসনি। মানুষ টা কে?

মনিকা ঘা-ব-ড়ে গেলো।এই প্রশ্নটা করবে ভাবেনি। কিছুটা ভেবে বলে,

– জানাবো খুব দ্রুত সবাইকে।কিন্তু সাহস হয়না বুঝলি। যদি তাকে হারিয়ে ফেলি এই ভয়ে বলিনা। তবে তাকে আমি প্রচন্ড ভালোবাসি। তার যত্ন আমাকে মুগ্ধ করে,তার কথা আমাকে টানে। তার হাসি আমাকে ভাবায়। সুযোগ পেলে তোদের জানাবো আগে।জোর করিস না।

তাহি হেসে সম্মতি জানায়। এরপর বোতল ঘুরাতেই শিফার দিকে ঘুরে।শিফা ভয়ে নিলো ডেয়ার। এরা যেভাবে পছন্দ নিয়ে প্রশ্ন করছে শিফাকে করতে কতক্ষন।সে কিছুতেই বলবেনা পছন্দের মানুষের কথা। ডেয়ার দিলো মনিকা।

– যাকে ভালোবাসিস তাকে ফোন দিয়ে আই লাভ ইউ বল।সবার সামনে।

তেঁতে উঠলো শিফা। যা চায়নি তাই হলো। এভাবে না হলেও অন্যভাবে ঘটতে চললো অঘটনটা।

– অসম্ভব, কাউকে ভালোবাসিনা।ফোন কিভাবে দিব। ফোন নাই আমার কাছে।

– ওকে আমাদের মধ্যে যাকে বিশ্বাস করিস তার ফোনটা নে।

– বাসিনা ভালো কাউকে।

– ডায়েরীটা দেখাবো শাহাদ ভাইকে?

– এই একদম না বলছি।

সকলে নড়ে চড়ে বসলো দেখার জন্য। শেষে দিয়ার ফোনটা নিলো। কল করলো সেই কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তির নাম্বারে। রিং হচ্ছে শিফার বুকের ধকধক বাড়ছে।ফোনটা যেন না ধরে মনে মনে তাই ভাবছে।দূর্ভাগ্যক্রমে ফোন রিসিভ হলো।তাহি কড়া আদেশ করলো,

– তোর নাম বলবি।নাহয় ভাববে ভাবীজানের কাজ, যেহেতু ফোনটা ভাবীজানের। মনে থাকে যেন।

শিফা মাথা নাড়লো। ও পাশ থেকে আওয়াজ এলো,

– হ্যালো আসসালামু আলাইকুম।

শিফা চুপ থাকাতে সকলে মৃদু ধমকে কথা বলতে বললো।

– জ্বি ওয়ালাইকুম আসসালাম। আমি শিফা।

ওপাশ থেকে নিরব। স্তব্ধ। প্রতিউত্তর আসলো,

– হ্যাঁ বলো।কোনো প্রয়োজন!

– ভা ই য়া। না….মানে.. আমি

– হুম

– না প্রয়োজন নেই।

– তাহলে

– আমি আপনাকে ভালোবাসি। আই লাভ ইউ।

সাথে সাথে ফোন কেটে দিলো। ও পাশে থাকা মানুষটা যে কতটা অবাক হয়েছে সেকথা হয়তো কিশোরী বুঝতেই পারেনি। এ যেন মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি ঝরে এলো। দিঘির পাড়ে বসে পদ্ম ফুলগুলো দেখছিলো এতক্ষন। গ্রামে এসেছে অনেকদিন হলো।এই গ্রামে কখনো আসা হয়নি। দিঘির শান্ত পানির দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলে উঠলো,

– মেয়ে না জেনে কত বড় ভুল করছো, তোমার ভাইজান জানতে পারলে আমার লা*শও দেখার নসিব হবে না।

দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো অন্তরের অন্তস্থল থেকে। দুরুদুরু করে কাঁপছে বুকটা। দিঘীর পাড় ধরে হেঁটে মেঠো পথ ধরেছে। গ্রামটা ঘুরে দেখলে হয়তো মনের উপর ভারটা কিছুটা কমবে।

___

– ভাইজান আসতে পারি?

– এসো।

রুমে ঢুকেই ভাস্তিকে কোলে নিলো। ভাইয়ের এবং মেয়ের দুষ্টুমি দেখে ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি ফুটেছে। শাহীন শেহজাকে চাচা ডাকা শেখাচ্ছে। মেয়েটা বাবা ই ডাকছে।

– শাহীন… লিমনকে ডেকে নিয়ে এসো।

শাহীন অসহায় দৃষ্টিতে ভাইয়ের দিকে তাকালো। শাহাদ সেদিকে না তাকিয়েই কাজ করছে। শাহীন অনুরোধ স্বরে বললো,

– ভাইজান মাফ করে দিন,ছোট মানুষ। আর করবেনা বলেছে।

– যা বলেছি তাই করো।

শাহীন ফোন দিয়ে জানাতেই রুমে হাজির হয়েছে লিমন সাঙ্গ পাঙ্গু নিয়ে। শাহাদ ল্যাপটপ থেকে চোখ না তুলেই বললো,

– এতজন কেনো?

রজত এগিয়ে এসে বলে,

– ভাইজান, দে আর এফ্রেডিং… ওহ স্যরি। ওরা ভয় পাচ্ছে। আপনি তো বখা দিতে ফারেন তাই আমাখে নিয়ে আসিছে। এবারের মত ছাড়িয়ে দিন।

শাহাদ শাহীদের মুখের দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুচকে বলে,

– ওর এখানে বাংলা ট্রেইনার কে?

শাহীন দু পাশে মাথা নেড়ে বলে,

– আমি না।

রজত আঙ্গুল দিয়ে বলে,

– লিমন ব্রো।

লিমন তৎক্ষনাৎ ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে বলে,

– ভাইজান কসম, আমি ওকে শুদ্ধ বাংলা শেখাতে চেয়েছিলাম অথচ ও বাংলার মান সম্মান বিদেশের মাটিতে ডুবিয়ে এসেছে ক কে খ বানিয়ে, প কে ফ বানিয়ে..

– থামো। এত সময় নষ্ট করতে চাচ্ছিনা। নিশাদ রুমে যাও। বৌমাকে ছেড়ে তোমার এখানে আসা উচিত হয়নি। কাব্য ঘুমাতে যাও।সকালে অতিথিদের আপ্যায়নে সারাদিন ব্যস্ত থাকবে। রজত তুমি বাংলাতে একটু একটু করে বলা শেখো। শুদ্ধ ভাষা তোমার বড় ভাবীমা খুব সুন্দর পারে।উনার কাছ থেকে শিখে নেবে। এখন ঘুমাতে যাও। লিমন থাকো।

সকলে লিমনের দিকে মনমরা চাহনী দিয়ে বেরিয়ে গেলো।লিমনের চোখে আকুলতা। লিমনকে বসার জন্য ইশারা করলো। লিমন শুকনো ঢোক গিললো।শাহীন ইশারা দিয়ে বুঝালো, আমি আছি। শুরু হলো বিচার পর্ব।

___

এবার বোতল ঘুরলো দিয়ার দিকে। সকলে চিয়ার আপ করে উঠলো। দিয়া ট্রুথ নিতে চায়নি। অনেক রকমের কথা আসতে পারে।শেফালী এক বিন্দুও ছাড় দেবেনা এখন তাই ডেয়ার নিলো। তৎক্ষনাৎ শেফালী বলে উঠলো,

– গান তো ভালো গাও,আজকে নেচে দেখাও।

নিশি ভ্রু কুচকে বলে উঠলো,

-এত রাতে গান ছাড়লে বকা খাবোনা! আর ভাবীজানের কোমড়ে সমস্যা জানো না আপু।উল্টা পালটা ডেয়ার দাও কেনো?

– তাহলে তো গেম হলোনা। খালি গলায় গান গেয়ে নাচুক।

শিফা তিতিবিরক্ত হয়ে দাঁত কটমট করে বললো,

– নাচতে নাচতে গান গাওয়া যায়! আজব কথা বলো।

মনিকা দিয়ার দিকে ফিরে প্রশ্ন ছুঁড়লো,

– ভাবীজান নাচতে পারবেন?

দিয়া মাথা নেড়ে দাঁড়িয়ে পড়লো। তাহি বললো,

– ফোনের সাথে আমার মিনি সাউন্ডবক্সটা লাগা।শব্দ বাইরে যাবেনা বেশি।

নিশি তাহির ব্যাগ থেকে মিনি সাউন্ডবক্স বের করে লাগালো। দিয়া নিজে উঠে গান সিলেক্ট করে কানেক্ট করলো। টেস্টিং এর জন্য বাজাতেই শেফালী বলে উঠলো,

– ওরে ভুতের গান। ঠিকই আছে তোমার সাথে এটাই যাবে।

দিয়া কেমন রহস্যজনক হাসি দিয়ে বললো,

– আপা আমি এটা খুব ভালো পারি।

বাকিরা কেমন উৎসুক হয়ে চেয়ে আছে। মনিকা,তাহি তো একে অন্যের দিকে ভীত হয়ে চোখের ইশারা দিচ্ছে।মনিকা ফিসফিস করে বলে,

– ভাবীজানের কি মাথা ঠিক আছে এত গান ফেলে মঞ্জুলিকা!

– থাম, চুপচাপ দেখে যা।

দিয়া কোমড়ে আনারকলির ওড়না বাঁধলো। এখানে আসার আগে শাশুড়ীর কাছ থেকে অনুমতি নিয়েছে আনারকলি পরার।শ্বাশুড়ি অনুমতি দিলো।গরমে গ্রামে জামাই ভালো। এর মধ্যে শেহজা ছোট। এদিকে কেউ খেয়াল করেনি শেফালী ইচ্ছে করে গানের আওয়াজ বাড়িয়ে দিলো যেন বাকিদের সমস্যা হয়,

আমি যে তোমার,
শুধু যে তোমার
মেরি চাহাতে তো ফিজা মেবহেঙ্গে
জিন্দা রেহেঙ্গে হোকে ফানা
আমি যে তোমার, শুধু যে তোমার

সাথীরে সাথীরে মারতেভি তুঝকো চাহেগা দিল
তুঝেহি বেয়চেনিও মে আয়েগা দিল।।
মেরি গে ছুওকি ছাহেমে, তেরি রাহাতোকে খুশবুহে
তেরে বাগার কেয়া জিনা, মেরে রোম রোম মে তুহে
মেরি চোড়িওকি খান খানছে, মেরি ছাদায়ে আতিহে
ইয়ে দূরিয়া হামেসাহি, নাজদি কাহাম বুলাতিহে
ও পিয়া…
আমি যে তোমার
শুধু যে তোমার….

দিয়া নাচ শেষ করে কোমড় থেকে ওড়না খুলে দাঁড়ায়। নাচের মুদ্রা দেখে বিস্মিত প্রত্যেকে। পুরোদমে প্রফেশনাল নৃত্যশিল্পী মনে হচ্ছে। তাহি চমকিত হয়ে প্রশ্ন ছুড়ে,

– ভাবিজান আপনি নাচ পারেন?

– হুম ক্লাসিকেল পারি।

বিদিপ্তা বললো,

– তুমি পারোনা এমন কিছু আছে ভাবী?

দিয়া একটা চমৎকার হাসি দিয়ে বললো,

– অনেক কিছু,এই ধরো মানুষ খু*ন করতে পারিনা। যদি পারতাম এতদিনে অনেক গুলো লা*শ ফে*লে দিতাম।

গায়ের জামা কাপড় ঝাড়তে ঝাড়তে দিয়ে কথা গুলো বলে উঠলো। অকপটে বলা কথাগুলো শুনে বাকরুদ্ধ হয়ে থাকা প্রতিটি প্রানীর চোখে মুখে আতঙ্ক। হঠাৎ চোখ যেতেই দেখে দরজার ওপাশে শাহাদ মেয়েকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।দিয়া বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে মাথা নোয়ালো। শাহাদ সোজা রুমে ঢুকে যাওয়াতে সবাই দাঁড়িয়ে পড়লো। শেহজাকে দিয়ার কোলে দিয়ে সকলকে চমকে দিয়ে বলে উঠলো,

– প্রথম লা*শটা বোধ হয় আমি হতাম তাই না!

এমন কথা কামরাজুড়ে বাঁজ পড়ার মতো শোনালো।দূর্বলতায় আঘাত করেছে। সামনে দাঁড়ানো মানুষটার বুকে আছড়ে পড়তে মন চায় অন্ধকার দিনগুলোতে। অথচ মানুষটার কাছে নগন্য সে।এতরূপ থাকার সত্ত্বেও সেই রূপ আজ মূল্যহীন। শাহাদ প্রসঙ্গে বদলে বললো,

– এত উচ্চশব্দে গান বাজানোর প্রয়োজন কি! বিবেকবুদ্ধি হারিয়েছো?

শেফালী বলে উঠলো,

– ভাইজান ভাবীজান নাচতে চেয়েছে…

শেহজাকে কোলে নিয়ে নির্বিঘ্নে পা ফেলে দিয়া বেরিয়ে এলো কামরা থেকে। বাকিরা চেয়ে রইলো। শাহাদ গম্ভীর কণ্ঠে বললো,

– ঘুমিয়ে পড়ো সকলে।

শেফালী তখনো ফোড়ন কাটে,

– অসভ্য মেয়ে কিভাবে ভাইজানের মুখের উপর চলে গেলো।

শাহাদ বিরক্তিকর নেত্রে বলে উঠলো,

– তুমি যে কতটা অস্বাভাবিক তা কি তুমি জানো! এদের মাঝে কি করো! ঘুমাতে যাও।

শাহাদের ধমকে কেঁপে উঠে বাকিরা। নিশি তড়িঘড়ি করে সাউন্ডবক্স খুলে ব্যাগে ঢুকায়। শাহাদ বেরিয়ে যায়।প্রতিটি কামরায় অতিথি। শাহাদ এতক্ষন এই কামরায় ছিলো জানে সে। কামরা জুড়ে মানুষটার শরীরের ঘ্রান ভেসে বেড়াচ্ছে। শেহজা খেতে খেতে ঘুমিয়ে পড়েছে। খচ করে দরজা খোলার আওয়াজ হতেই দিয়া সামনে তাকায়। শাহাদ চেয়ার টেনে হেলান দিয়ে বসে মাথায় হাত রেখে বলে,

– ফারাহ…

– জ্বি

– খুব সুন্দর নাচো।

দিয়া বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে আছে শাহাদের দিকে। শাহাদের চোখের উপর হাত। দিয়া প্রশ্ন করে,

– আপনি দেখেছেন?

– হুম। একটা কথা ছিলো?

– কি!

– চাইলে মুক্তি পেতে পারো।

– আমার মেয়েটা!

– আমার কাছেই থাকুক অথবা নিয়ে যেতে পারো মাঝে মাঝে দেখা করতে দিও এই মানুষটাকে।

– থাকতে পারবেন মেয়েকে ছাড়া?

– অনেক কিছু পারিনা করতে হয়?

– কখন দিতে চান ডিভোর্স।

শাহাদ চোখের উপর থেকে হাত না সরিয়েই বললো,

– সেকথা তো বলিনি। সরাসরি বিচ্ছেদে চলে গেলে?

– মুক্তি মানে কি!

– তুমি যা মনে করো।

– আচ্ছা।

শাহাদ উঠে কাঠের বাড়ির বারান্দায় দাঁড়ালো। দিয়া শেহজাকে শুইয়ে দিয়ে নিজেও বারান্দায় চলে আসে।শাহাদ অন্তরীক্ষে চেয়ে আছে। চাঁদটা কেমন হাসছে। মেঘাচ্ছন্ন আকাশ। অথচ দ্যুতি ছড়াচ্ছে বহুদূর। দিয়ার দিকে একবারো লক্ষ্য করলোনা। বেশ কিছুক্ষন কাটে দুজনের নিরবতায়।
অকস্মাৎ দিয়া শরীরের সমস্ত জোর দিয়ে শাহাদকে নিজের দিকে ফিরিয়ে জড়িয়ে ধরে। ফুফিয়ে কেঁদে উঠলো। কেনো বললো ওই সময়টাতে মানুষটার লা*শের কথা। ক্রন্দনরত গলায় বলে উঠলো,

– কেনো বললেন ওই কঠিন কথাটা! আমি আপনার কিছু নাই হতে পারি।আপনি আমার কি জানেন না!

আরো শক্ত পোক্ত ভাবে আকড়ে ধরলো স্বামীকে।আঁৎকে উঠে শাহাদের অন্তরাত্মা। বুকের স্পন্দন নিজের কান অবধি আসছে আর প্রিয়দর্শিনী শুনবেনা তা তো অসম্ভব! শাহাদের টি শার্টের দুটো বোতাম খুলে লোমশ বুকে নিজের অধর ছুঁয়ে দেয় বার কয়েক। পুরুষালি সত্ত্বা কেঁপে উঠে। অদম্য অনুভূতি দমাতে বারান্দার কাঠের গ্রীল আঁকড়ে ধরেছে। শ্বাস প্রশ্বাস বৃদ্ধি পাচ্ছে। দুচোখ বন্ধ আজ। দম আটকে ফেলেছে। যত শ্বাস ছাড়বে হৃদস্পন্দন বৃদ্ধি পাচ্ছে সমানুপাতিক হারে। এ যেন যুদ্ধ চলছে মোলায়েম অনুভূতি এবং কঠিন সত্ত্বার জেদের সাথে।শিথিল হয়ে অনড় পাথরের ন্যায় তখনো দাঁড়িয়ে শাহাদ। আগলে ধরেনি ক্রন্দনরত রমনীকে। বুকে মুখ লুকিয়ে কাঁদছে দিয়া। এতটা বছর পর একান্ত পুরুষের সান্নিধ্যে পেয়ে ভুলেই গিয়েছে সকল গ্লানি। গমগমে স্বরটা কানে বাজছে,

– ঘুমাতে যাও ফারাহ। আমার অস্বস্তি হচ্ছে।

চলবে…