সায়রে গর্জন পর্ব-১৪+১৫

0
40

#সায়রে_গর্জন
#নীতি_জাহিদ
১৪.
( অনুমতি ব্যতীত কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ)

বন্ধু তালিকায় অনেক আগে থেকেই সুদর্শনা আছে।তবে কখনো বার্তা চালাচালি কিংবা অল্প স্বল্প কথোপকথনও হয়ে উঠেনি। নীল শাড়ি গায়ে জড়িয়ে চিকিৎসকের সাদা পোশাক। কি স্নিগ্ন লাগছে দেখতে। হঠাৎ করে মনে হলো, এই রমনী মন কেড়ে নিয়েছে। বুকের বাঁ পাশটা ধক করে উঠলো। খাটে আধশোয়া হয়ে পায়ের উপর পা তুলেছিলো আরাম করে। মনের কোণে এমন ভাবনা আসতেই হুড়মুড় করে উঠে বসে খাঁ খাঁ করে তেষ্টায় ফেটে যাওয়া গলাটা পানি দিয়ে ভিজিয়ে নিলো। হৃদস্পন্দন কমার নামই নেই। নিজের ডান হাত বুকের বাঁ পাশের ধরতেই বুঝতে পারলো অস্বাভাবিক ক্ষীপ্রতার সাথে বুকে লাব ডাব হচ্ছে। বড় বড় দীর্ঘ শ্বাস টেনে নিজেকে শান্ত করে কামরা ছেড়ে বেরিয়ে বারান্দায় এলো। লেবুর তলা টানছে। চুপচাপ গিয়ে গন্ধরাজ লেবুর তলায় বসলো। পরনে থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট এবং ছাই রঙা স্লিভলেস টিশার্ট। পিঠে স্পর্শ পেয়ে তাকিয়ে দেখে কাব্য। গাল ভরা হাসি দিতেই কাব্য পিঠ চাপড়ে বলে উঠলো,

– কিরে ব্যাটা মন খারাপ নাকি,বসে পড়লি যে চুপচাপ?

লিমন সিড়িতেই শুয়ে পড়লো। কাব্যের কথার প্রতিউত্তর না করে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলো। কাব্যের পেছন পেছন নিশাদ ও হাজির হয়েছে তা বুঝতে পারেনি। তিনজনই নিরব। লিমন আচানক বলে উঠলো,

– ভাই অনেকদিন পর মন থেকে শান্তি পেলাম কিন্তু শান্তিটা ক্ষনস্থায়ী। অথচ এই শান্তির পেছনে জীবনের এতগুলো বছর ছুটে বেড়িয়েছি।

কাব্য ঠোঁট উলটে নিশাদকে বুঝালো,

– কিছু বুঝলি?

নিশাদ ও বুঝালো মাথা নেড়ে সে কিছুই বুঝেনি। লিমন পুনরায় বললো,

– এবার আমি একদমই প্রেমে পড়িনি। তবে বিষাদে ডুবেছি। দোয়া করিস যেন বেরিয়ে আসতে পারি।

লিমনকে এসব কাব্যিক কথা বলতে এই প্রথম দেখলো ওরা। শোয়া থেকে উঠে সোজা বাড়ির পথে পা বাড়ালো।বেসুরে কন্ঠে গান ধরলো,

-” বন্ধে মায়া লাগাইছে পিরিতি শিখাইছে
বন্ধে মায়া লাগাইছে পিরিতি শিখাইছে
দেওয়ানা বানাইছে
কি যাদু করিয়া বন্ধে মায়া লাগাইছে”

নিশাদ ও কাব্য ওর যাওয়ার পথে চেয়ে রইলো। কাব্য নিশাদ ভ্রু কুচকে বলে,

– মহাশয় কি মেয়াদোত্তীর্ণ গঞ্জিকা সেবন করিয়াছে? এমন পাগলা পাগলা বিহেভ করতাছে কেন ওয়?

– আমি কেমনে জানি, বড় ভাইজানের ধমক খাওয়ার পর থেকে মাথাটা মনে হয় গেছে। চলো ভিত্রে গিয়া দেখি আবার শোকে পাথ্থর হইয়া কোন আকামটা করে।

..

চায়ের পাতিলের পানি টগবগ করে ফুটছে। আকস্মিক ছিটা এসে হাতে পড়লো। চমকে গিয়ে চুলা বন্ধ করে হাত দিয়ে পাতিল ধরলো। গরম পাতিলের উষ্ণতা পেতেই হাত থেকে ছেড়ে দিলো। পানি পড়লো ছিটকে হাতে পায়ে। চিৎকার না দিয়ে নিশ্বাস আটকে দাঁড়িয়ে রইলো। ভেতরের আর্তনাদ কেনো দেখানো যায়না। অশ্রু গড়িয়ে পড়লো দু গাল বেয়ে। কারো হাতের স্পর্শ পেলো নরম গালে। চোখ খুলে সামনে তাকাতেই দেখে পরিচিত মানুষ দাঁড়িয়ে। বিনা বাক্য বেয়ে হাত ধরে টেনে নিয়ে গেলো বেসিনের কাছে। পানির কল টা ছেড়ে দিয়ে হাত দুটো ধরলো জলধারার তলে। হাত সরাতে চাইলে ধমকে বললো,

– একদম হাত সরাবেন না,চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকুন।

ফ্রিজ থেকে বরফ নামিয়ে তাহির পায়ের কাছে বসে বাম পা নিজের হাঁটুতে নিয়ে বরফ লাগাতে শুরু করলো। আঁৎকে উঠলো তাহি। সরাতে চাইলেই গর্জে উঠলো লিমন,

– কি সমস্যা আপনার! জাত যাবে আমি পা ধরলে? আপনি ধরেন না আপনার রোগীদের! এখন আপনিও অসুস্থ চিকিৎসা করছি আমি, প্রেম নিবেদন নয়। এমন ছটফট বন্ধ করুন নতুবা তুলে আঁছাড় মা;রবো। অবাধ্য সিনিয়র।

থমকে গেলো তাহি। ছেলেটার কথার পিঠে কথা বলার সাহসই হলোনা।শুকনো ঢোক গিললো। লিমন পায়ের বরফ লাগিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলে উঠলো,

– পায়ের টা রাতারাতি সারবে কিন্তু হাতের টা ভোগাবে। অপারেশন করবেন কি করে পোড়া হাতে?

– জানিনা।

– ম্যানেজ করুন। হাতে বার্নল ক্রিম লাগিয়ে দিচ্ছি।সুস্থ হলে তবেই যাবেন এই বাড়ি ছেড়ে।যত্নের ঘাটতি হবেনা। শিফাকে রেখে দিব প্রয়োজনে।

তাহি নাকের পাঠা ফুলিয়ে বলে উঠলো,

– জুনিয়র, জুনিয়রের মতো থাকো।বাড়াবাড়ি করোনা।ফল ভালো হবেনা।

ততক্ষনে লিমন চলে গেলো। তাহি রাগ করে নিজের কামরায় গিয়ে দরজা আটকে বসে রইলো। নিজের কাপড়ের ট্রলি থেকে একটা ছবির ফ্রেম বের করে বুকে জড়িয়ে ধরলো। ঘুমিয়ে পড়লো পোড়া হাত নিয়েই।

___

মজুমদার বাড়ির সুনশান ছাদে বসে আছে শাহাদ। হাতে এক কাপ চা। মৃদু বাতাস বয়ে যায়। মস্তিষ্কে সব ভাবনারা আঘাত হানে। খুব দরকার নোমানকে। আগামীকালই ওকে নাগালে পাওয়া যাবে। মনে পড়ে গেলো,

বছর পাঁচেক আগের কথা,

প্রাতঃকালীন নাস্তা সেরে ইউনিটের দিকে যাচ্ছে শাহাদ। রাশেদকে কয়েকবার ফোন দেয়ার পর ও ফোন ধরছেনা। এই ছেলেটা বড্ড ঘুম কাতুরে। শাহাদ রাশেদের কোয়ার্টারে ঢুকেই এক মগ পানি এনে ঢেলে দিলো ওর গায়ে। লাফিয়ে উঠে বলে,

– চোর চোর এ্যাই কে কোথায় আছিস ধর…

গলা ছাড়ে শাহাদ,

– ক্যাপ্টেন তানভীরকে চল্লিশ রাউন্ড দিতে বলেছি। দশ মিনিটের মধ্য রেডি না হলে আশি রাউন্ড দেয়াবো তোকে দিয়ে কর্ণেল আনোয়ারের অনুমতি আছে। ইনডিসিপ্লিনদের শাস্তি দেয়ার। জুনিয়রগুলো তখন হাসবে তোকে দেখে।

গজ গজ করতে করতে রাশেদ কান্নাভাব নিয়ে বললো,

– তুই কি আমার বন্ধু? সাক্ষাৎ শত্রু।

শাহাদ সোফায় বসে রাশেদের বিস্কুটের কন্টেইনার থেকে এক পিচ পাইনএপল বিস্কুট নিয়ে খেতে খেতে বলে,

– তুই যা মনে করিস। দেরি করলে তোরই লস। আজ আমার ইউনিটের সেনাদের এক্সাম খেয়াল আছে। একটা ও আনফিট হয় তোকে ছুটি নিতে দিব না।মনে আছে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে বলেছিলি না ওদের দায়িত্ব তোর? দায়িত্ব পালনে হেলাফেলা গ্রাহ্য নয়। এনিওয়ে,গুড নিউজ; শিপ ইজ কলিং।

রাশেদ ব্রাশ করতে করতে থমকে গিয়ে চক্ষু ছানাবড়া করে বললো,

– ইজ ইট আ গুড নিউজ!! দোস্ত আমি এবার যামুনা প্লিজ। রোদসীরা আসবে বাড়িতে। আমি না গেলে আম্মা রাগ করবে।

– তাহলে হারি আপ।

রাশেদ তাকিয়ে দেখে ঘড়িতে সাতটা বিশ। তড়িঘড়ি করে তৈরি হয়ে নিলো। দুজন রেডি হয়ে বের হতে হতে রাশেদ ফোন চেক করে থমকে গেলো। নিজের হাত ঘড়িও চেক করলো। শাহাদের দিকে তাকিয়ে বলে,

– শাহাদ… তোর ঘড়িতে কয়টা বাজে?

– কেনো ছয়টা বত্রিশ।

রাশেদ থতমত খেয়ে বলে,

– তুই আসলে একটা বিরাট বা/টপার কিসিম খিলাড়ি। কেমনে পারোস। রুমে ঢুইকা কি টার্গেটই ছিলো আমার বাসার দেয়াল ঘড়িটা এক ঘন্টা এগিয়ে দেয়া?

– ওই কাজ না করলে তোকে আজ আর উঠানো যেতোনা।

– আর বিশ্বাস করমুনা তোরে। তুই এমনি কইরা আমারে বলদ বানাস।

শাহাদ মুচকি হেসে এগিয়ে গেলো স্কোয়াডের দিকে। শাহাদকে চুপ থাকতে দেখে বলে,

– শাহাদ তুই নতুন বুদ্ধি আঁটতেছিস মাথায় তাইনা।

শাহাদ হাসে। এই বন্ধুটা তার প্রিয় সঙ্গী।সারাক্ষন মাতিয়ে রাখে আশপাশের পরিবেশ।

সারাদিনের ব্যস্ততা শেষে বিশ্রাম নিয়ে উঠলো দুজন। পরশু শিপে চলে যাবে তার আগেই রাশেদের এক বন্ধুর সাথে দেখা করতে যাবে দুজন। কক্সবাজারের সবচেয়ে সুন্দর রোড মেরিন ড্রাইভ রোড,হিমছড়ি। নেভাল একাডেমিতে আসলেই এই দিকটাতে ঘুরা হয়। Sun Dancer রেস্টুরেন্ট।এখানে সবচেয়ে পছন্দের খাবার হলো- ভাত, কাঁকড়া মাসালা,কোরাল বারবিকিউ এবং ডাল। খেলেই তৃপ্তি পাওয়া যায়। রাশেদের পরিচিত একজনের সাথে দেখা করতে এসেছে দুজন। রাশেদ চুপিসারে আড়াল থেকে ফোনে কথা বলে শাহাদের পাশে এসে বসলো। শাহাদ রেস্টুরেন্টের বাইরে গাছগুলোর দিকে তাকিয়ে আছে। পাশে দোলনা মত কি যেন ঝুলছে।ভালো করে লক্ষ্য করে দেখলো একটা চাকার টায়ার দিয়ে দোলনা বানানো। ছোট বাচ্চারা দুলছে।এই দৃশ্য দেখতে ভালো লাগছে। রাশেদের উচ্চবাচ্যে ধ্যান ছুটে যায়,

– বন্ধু রাগ করিস না,তোরে না জিগায় একটা কাজ করছি। বিশ্বাস কর আন্টি আমারে সারাক্ষন বলে তোর কথা। তাই আমার এক কাজিনকে আসতে কইছি। একটু দেখা কর। ও বেড়াতে আসছে কক্সবাজার। সুন্দর। পেশায় আইনজীবী। নাম সামরা। মান সম্মানটা রাখিস দোস্ত।

শাহাদের বৃহৎ অক্ষি গোলক দেখে ভয় পেলে গেলো রাশেদ। বন্ধু তার বিয়ে করবেনা পণ করেছে কি অর্থে তাই বুঝ পায়না। এর মাঝেই চলে এলো সামরা। রাশেদকে দেখেই মিষ্টি হাসি দিলো। হাতের কাজের শাড়িতে মেয়েটিকে বেশ মানিয়েছে। সামরা সালাম দিয়ে বসলো। কানের কাছে গুঁজেছে গোলাপ। মেয়েলী ঘ্রান নাকে লাগছে শাহাদের। কেমন যেন স্নিগ্ধ। সামরার চেহারায় মায়া আছে। অনুমতি চাইতেই শাহাদ ইশারায় বসতে বললো। কটমট করে তাকালো রাশেদের দিকে। রাশেদ ও পাশে চেয়ার টেনে বসলো। খাবারের অর্ডার দিয়েই রাশেদের পক পক শুরু।

– সামরা জানিস শাহাদ এই রেস্টুরেন্টের খাবার অনেক পছন্দ করে। এদের সব খাবারের মান অত্যন্ত ভালো।

সামরা মিষ্টি হেসে আড়চোখে শাহাদকে দেখলো। শাহাদ হাতের ফোন স্ক্রল করতে করতে বলে উঠলো,

– এতটা বিচলিত হবেন না মিস সামরা। আমি দুঃখিত।রাশেদ আপনাকে এভাবে নিয়ে এসে দুজনকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে দিলো।

– না না ঠিক আছে।

নিজেদের মধ্যে টুকটাক কথোপকথন হচ্ছে। শাহাদ সেই পারফিউমের গন্ধটা আরো কাছ থেকে অনুভব করছে। মনে হলো যেন ভেসে যাচ্ছে এক সুমিষ্ট ঘ্রানের জগতে যেখানে একটা আবছা মুখ তার দিকে এগিয়ে আসছে। জোরে শ্বাস টানলো শাহাদ। ফুলের ঘ্রান। শাহাদ বন্ধ হওয়া নেত্র খুলে সামরাকে প্রশ্ন ছুড়ে আপনি কোন ব্রান্ডের পারফিউম লাগান। সামরা অপ্রস্তুত হয়ে বললো,

– গুড গার্ল।

– এটা কি কোনো ফুলের?

– হ্যাঁ জেসমিন।

– উঁহু, আমার নাকে অন্য কোনো পারফিউম লাগছে।

রাশেদ বলে উঠলো,

– আমারো লাগছে তবে ওটা মনে হলো কাঁচা ফুল। একটু বেশি স্নিগ্ধ। রজনীগন্ধার মতো।

সামরা বললো,

– এটা পারফিউম না। কোনো ন্যাচরাল স্মেল। হয়তো কেউ ফুল লাগিয়েছে নতুবা কোনো হোম মেড পারফিউম লাগিয়েছে।

– হ্যাঁ হতে পারে।

ব্রিপ ব্রিপ ভাইব্রেশনে ধ্যান ভাঙলো। শাহাদ ফোন হাতে নিয়ে দেখলো তার ব্যক্তিগত খেঁচরের ফোন।যাকে শাহাদ সকলের আড়ালে রেখেছে। পৃথিবীর দ্বিতীয় কোনো প্রানী তার খোঁজ জানেনা। ফোন রিসিভ হতেই জানতে পারলো রগচটা খবর। ফোনটা কেটেই চুপিসারে নেমে আসে মজুমদার বাড়ির ছাদ থেকে। বাড়ির দোরগোড়ায় দেখা হয় চাচা শ্বশুর মঈনের সাথে।

– জামাই, কোথায় যাও?

– কাকা আমি একটু আসছি। একটা কাজ পড়েছে।

– আমিও কি যাবো?

– না না আপনি ভেতরে যান, আপনার ভাইঝি বসে আছে সকলের সাথে দেখা করার জন্য।

বুঝ দিয়েই বেরিয়ে পড়ে রাস্তার উদ্দেশ্যে। পাভেল অনবরত ফোন দিয়ে যাচ্ছে। শাহাদ রিসিভ করছেনা। এক পর্যায়ে ফোন কে*টে বন্ধ করে দিলো। মেইন রোড ঘেঁষে ডান দিকে হাঁটলেই রাবার বাগান। তিনটা ছেলে বাইক থেকে নেমে এলো। ওদের অনুসরণ করার ইশারা দিলো শাহাদকে। বাগানে ঢুকতেই মিলিয়ে গেলো। চারজনের ছায়া।

পাভেল বাইক ছুটিয়ে আসছে। একটা মেসেজ স্পষ্ট বলে দিচ্ছে পুনরায় সেই কান্ড। খুঁজে বেড়াচ্ছে সেই ফাইলটা যাতে প্রমাণ ছিলো বি এন এস সমুদ্রজয়ে ঘটে যাওয়া রেইপের সাথে রাশেদ আবেদীন কোনোভাবে সম্পৃক্ত নয়। অথচ সেদিন কোনোভাবেই রাশেদকে নির্দোষ প্রমাণ করতে পারেনি শাহাদ। এখনী দেহে রক্ত টগবগিয়ে ফুটে উঠে। রাস্তার মোড়ে এসে দাঁড়ায় শাহাদ। পাভেলের বাইক শাহাদের সামনে এসে থামে। শাহাদ শান্ত স্বরে বলে,

– ক্যাপ্টেন আলতাফকে খুঁজে বের করো।

– স্যার বাগানের ভেতরে…

– ওদিকে যেতে হবেনা। প্রবলেম সলভড। কালকে সকালে যেন পত্রিকায় হেড লাইন হয়, তিন ধর্ষনকারীকে উপযুক্ত শাস্তি দিয়েছে ধর্ষিতা।

পাভেল মাথা নেড়ে সম্মতি প্রকাশ করলো। শাহাদ জমিনে নেমে পড়লো।সেচের পানিতে হাতে লেগে থাকা র*ক্ত ধুয়ে নিলো। পাভেলের সাহায্যে গোসল করে নিলো। ভেজা কাপড়ে রওয়ানা দিলো মজুমদার বাড়ির উদ্দেশ্যে। পাভেল রাশেদকে দেখেছে ওদের বিয়ের সময়। খুব সাদামাটা একজন মানুষ। এই মানুষটার ও যে শত্রু থাকতে পারে ভাবাই যায়না। বাড়ির আঙিনায় এসে বাগানের সুপরিচিত গুল্ম উদ্ভিদগুলোর পাশে দাঁড়ালো। ঝোপের মতো হয়ে আছে। তার মাঝে ফুটে আছে সাদা সাদা ফুল। একটা ফুলের দন্ড ছিড়ে নিলো। পাভেল দূর থেকে দাঁড়িয়ে দেখে যাচ্ছে শাহাদের কাজ। মাঝে মাঝে ওর মনে হয় এই মানুষটা রহস্যে ঘেরা। যার হাসিতেও লুকিয়ে থাকে ভয়। শাহাদ পাভেলকে কাজ বুঝিয়ে চলে যেতে বলে গন্তব্যে। নিজেও ঢুকে পড়ে অন্দরমহলে।

__

ধীরে ধীরে দরজা খুলে পা টিপে ভেতরে প্রবেশ করলো। আশপাশে দেখলো সবাই শুয়ে পড়েছে। ক্লান্তি সবার শরীরে। পকেট থেকে বার্নল ক্রিমটা বের করে আলতো করে দুটো হাতে লাগিয়ে দিলো। বার বার ঢোক গিলছে। লাগিয়েই দরজা দিয়ে বেরিয়ে এলো। তাহি চোখ খুলে ওর যাওয়া দেখলো। আত্মসংবরণ করে বললো,

– বড্ড ভুল করছো। পস্তাতে হবে তোমায়। নিষিদ্ধ জিনিসে হাত বাড়িয়েছো।ডানা গজানো ভালো। উড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছ তাও ভালো,কার আকাশে উড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছ তা না ভেবেই উড়তে গেলে যে ডানা হারিয়ে ছটফট করতে করতে নিঃশেষ হিয়ে যাবে।

-তবে তাই হোক।

তাহি চমকে উঠলো। এখানেই ছিলো তাহলে। নিশব্দে কথা শুনছিলো।চমকে যাওয়ার ব্যাপার বুঝতে না দিয়েই নিজেকে সামলে বললো,

– এত রাতে কোনো মেয়ের ঘরে ঢোকা ঠিক নয়,বিধবা মেয়ের ঘরে তো নয়ই।লোকে আমায় বলবে শরীরের জ্বালা বেশি বলে এবার জুনিয়রের দিকে হাত বাড়িয়েছি…

ঠাস করে দরজা আটকানোর শব্দে কেঁপে উঠলো কামরা। তাহি ঠোঁটের কোণে হাসি দিয়ে ভাবে,

– ঠিক মতো লেগেছে। ইমোশনালি আঘাত করতে হবে তোমায়।নতুবা তোমার মত উগ্রচণ্ডীকে দমানো কঠিনই নয়,অসম্ভব হবে। আমার রাশেদ ও তোমার মতো ছিলো।

চলবে…

#সায়রে_গর্জন
#নীতি_জাহিদ
১৫.
(অনুমতি ব্যতিত কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ)

ফোনের ক্যালেন্ডার চেক করে দেখতেই চিন্তারা ঘিরে ধরলো হাতে আছে মাত্র দু মাস। এর মাঝেই যা করার করতে হবে, বাড়ির পরিবেশ অবস্থার কথা ভেবে ভাইজানকে জানানোই হলোনা নিরার কথা। কিছুক্ষন আগেও মেয়েটা কাঁদছিলো। হোস্টেলে মানুষ হওয়া মেয়েটা আশ্রয় হিসেবে চেয়েছে শাহীনের বুক।রায়হান সাহেব বা শাহাদ কেউ একজন দ্বিমত করলেই হয়তো এর প্রতিবাদ করতে পারবেনা।অন্যভাবে, প্রতিবাদ না করলেও কাপুরুষের খাতায় নাম উঠবে। একদিকে নিরা অন্যদিকে শাহাদ। চিন্তিত শাহীন ফোন দিলো শাহাদকে। রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে ভেসে এলো,

– বলো শাহীন, সব ঠিক আছে বাড়িতে?

– জ্বি ভাইজান।

– শেফালীর কি অবস্থা?

– ভালো আছে।

– ভাইজান…

– হ্যাঁ বলো

– একটা কথা ছিলো।

– হুম

– মানে আপনি কিভাবে নিবেন…

– আনবান না করে সরাসরি বলো।

– সেদিন আম্মু বিয়ের কথা বলছিলো না। মেয়ে দেখতে যাবেন আপনারা…

– হুম

– মেয়ে কি পেয়েছেন? আমার তো হাতে দু মাস আছে।

– জানিনা আমি,আম্মু জানে।

– ওহ। আচ্ছা ঠিক আছে ভাইজান।এই জন্যই।

– হুম।

দুজনই চুপ। তৎক্ষনাৎ শাহাদ বলে উঠলো,

– কাপুরুষের মতো ব্যবহার করছো কেনো? আম্মু পছন্দ করলেই কি তুমি বিয়ে করবে? নওরীনকে কথা দিয়েছিলে কেনো?

শাহীনের বুক আচমকা ধুকধুক করা শুরু করেছে।মনে হলো কেউ ৩২০ ভোল্টের শক দিয়েছে। শরীর কাঁপছে।গলা শুকিয়ে কাঠ। অনবরত ঢোক গিলছে। টেবিলের সামনে গিয়ে এক গ্লাস পানি ঢকঢক করে খেয়ে নিলো। কি শুনলো! ভাইজান নওরীনের কথা কিভাবে জানে! পানি খেতেই বিষম খেলো। ও পাশ থেকে পুনরায় স্বর ভেসে এলো,

– আস্তে পানি পান করো। নাকে মুখে উঠে যাচ্ছে।

– ভাইজান আসলে…

– নওরীনের অভিভাবক কে হবে?

– আমি বলতাম ভাইজান আপনাকে…

– বলোনি তো। সে কথায় আর না যাও।

– ভাইজান রাগ করবেন না। নওরীনের কেউ নেই। ওর বাবা মা…

– ঠিক আছে। আমি ঢাকা ফিরে এই ব্যাপারে কথা বলব।

– ঠিক আছে ভাইজান।

– শুভ রাত্রী।

ফোনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন হতেই ধপ করে খাটে বসে পড়ে। আরো এক গ্লাস পানি খেয়ে নওরীনকে ফোন দেয়। ফোন রিসিভ হলো না। চিন্তায় মাথা এলোমেলো হয়ে গেলো। এ যেন যুদ্ধ যাবার আগেই অতর্কিত আক্রমন। চোখ মুখ অন্ধকার, বিবর্ন। ভাইজানের প্রথম প্রশ্নই ছিলো, নওরীনের অভিভাবক কে হবে? আব্বু জানলে তো কুচিকুচি করবে। আব্বু সবসময় বলে পরিবার ভালো না হলে মেয়েরা ভালো শিক্ষা পায়না।সেখানে নওরীনের তো পরিবারই নেই। ভাইজান আব্বুর মুখের উপর কথা বলবেনা, নিজেও ভাইজানের মুখের উপর কথা বলতে পারবেনা। তবে কি এখানেই শেষ!

___

শাহীনের সাথে কথা শেষে পা বাড়ায় বাড়ির ভেতর। সিক্ত বস্ত্র।হাতে ফুলের স্টিক নিয়ে কামরার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। সামনের ক্ষীণ আলো ধীরে ধীরে বাড়ছে। শাহাদ পিছু নিলো সেই আলোর। তাকিয়ে দেখে এন্টিক বাতিদান হাতে অপ্সরী। বাড়িটাকে মাঝা মাঝে রহস্যময় মনে হয়। এই বাতিদানটাও এত পুরনো, এন্টিক পিস নিলামে উঠালেও মিনিমাম হাজার ত্রিশেক টাকা হবে। অদ্ভুত বাতিদান হাতে দিয়া। এই মেয়েটা এত অদ্ভুত কেনো! অন্দরের শয়ন কামরায় প্রবেশ করলো দিয়া,পিছু নিলো শাহাদ। দোলনায় ঘুমে আচ্ছন্ন প্রিয় কন্যা। দিয়া পিছু না ফিরেই বলে উঠলো,

– আপনি ভিজে গেলেন কি করে শেহজার বাবা?

শাহাদ অবাক হয়ে ভাবে এর মধ্যেই দেখে নিয়েছে শাহাদকে। দিয়া ঘুরে তোয়ালে এগিয়ে দিলো। শাহাদ ফুলটা টেবিলে রেখেই দিয়ার হাত থেকে তোয়ালে নিয়ে মাথা মোছা শুরু করলো। এই প্রশ্নটার উত্তর যে কতটা ভয়াবহ এই মেয়ে জানলে প্রশ্ন করতে কয়েকবার ভাবতো।তবে এই দিয়ার রূপ ভিন্ন। মনে হয় যেন কোনো রাজমহলের রাজকন্যা। পরনে সেই গোল রাউন্ড আনারকলি। মাথার এক পাশে ঘোমটা। শাহাদ পোশাক পালটে দিয়ার দিকে না তাকিয়েই বললো,

– আমি প্রিন্সেস নূরজাহানকে দেখিনি। তবে মজুমদার মহলের প্রিন্সেস মেহতাবকে দেখেছি।

বাতিদান সেট করে দিয়া শাহাদের দিকে সন্দিহান চোখে তাকালো। কি বুঝাতে চাইলো! শাহাদ পুনরায় বললো,

– টেবিলের উপর রেখেছি রজনীগন্ধার স্টিক। বাগানের সামনে দিয়ে আসার সময় মনে হলো অনেক দিন আমি এই সৌরভ থেকে বহু দূর।

কিছু একটা ভাবলো দিয়া। শাহাদের প্রতিটা কথার অর্থ ধরতে পেরে স্তব্ধ। মানুষটার শব্দ চয়ন যতটা স্পষ্ট অর্থ ততটাই জটিল। দিয়া রজনীগন্ধার সুগন্ধি দু বছর আগে গায়ে মাখা বন্ধ করেছে।এই সুগন্ধি বানানো দাদী শিখিয়েছিলেন। দাদীজানও শিখেছেন দাদীজানের মায়ের কাছ থেকে। রজনীগন্ধার নির্যাস থেকে ঘরোয়া উপায়ে এই সুগন্ধি বানানো হয়। দাদী দিলরুবা খানম বলতেন,

-“সুগন্ধি মাখবা শুধু স্বামীর জন্য, যতদিন বাপের বাড়িত আছো নিজের জন্য মাখো। বিয়া হলে স্বামীর জন্য,স্বামী মরলে আর মাখবানা। ”

গত দু বছর দিয়া আর এই সুগন্ধি মাখেনি। শাহাদ বিয়ের রাতে বলেছিলো,

– ‘ তোমার এই পারফিউম তোমার সত্ত্বায় মিশে আছে ফারাহ। তোমার আশে পাশে থাকলে মনে হয় আমি কোনো সুন্দর উদ্যানে আছি।যেখানে আমি আর উদ্যানের সবচেয়ে সুন্দর পরীটা দাঁড়িয়ে। আমার অনুপস্থিতিতে এই পারফিউম নিষিদ্ধ তোমার জন্য।’

ঠিকই তো আছে এত বছর অনুপস্থিত ছিলো তাই এই পারফিউম নিষিদ্ধ ছিলো।তবে আজ কেনো ফুল এনে এই বাক্য তুলে ধরলো। শাহাদের অপূর্ব দৃষ্টি এখনো দিয়ার দিকে। দিয়া প্রতিউত্তর করলো ভেবে,

– এই সৌরভ শুধু আমার সন্তানের বাবার জন্য জায়েজ। যেহেতু আমি তার চেয়ে দূরত্বে ছিলাম এবং আছি, তার মনের খাতায় আমার অনুপস্থিতির সংখ্যা সর্বাধিক, সেখানে অন্য পুরুষের জন্য হারাম এই সৌরভ।

দুজনের দৃষ্টি এক বিন্দুতে স্থির।একে অপরের দিকে কঠিন মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে। অপলক দৃষ্টি। কারো চোখের পাপড়ি নড়ে উঠলেই মহা অপরাধ। দুজনের আঁখিতে ধ্বংসা/ত্ম/ক স/র্ব/নাশ। এ যেন নিরব সংকেত আসন্ন কোনো ঘটনার। শাহাদের সেল ফোনের মেসেজের আওয়াজে দৃষ্টিচ্যুত হলো দু জোড়া আঁখি। ফোন চেক করে উঠে দাঁড়াতেই দিয়া পুনরায় বললো,

– প্রিন্সেস নূরজাহান কিন্তু সম্রাট জাহাঙ্গীরের দ্বিতীয় স্ত্রী ছিলেন। অন্যদিকে জাহাঙ্গীর কিন্তু বহু বিবাহ, মদ্যপ,অকর্মক চরিত্রের ছিলেন। আপনি আমাকে কি হিসেবে সিম্বোলাইজ করেছেন। সেই তুলনায় আকবর,শাহজাহান শ্রেষ্ঠ ছিলেন।

– না আমি জাহাঙ্গীর, না শাহাজাহান। আমার ক্ষমতা নেই এত বিয়ে করার। তবে আকবরের সাথে কিঞ্চিৎ মিল আছে। আকবর সনাতনধর্মের মেয়ের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছে আর আমি ইরানী। বেশ ভালো ইতিহাস জানো দেখছি। প্রিন্সেস নূরজাহানের কাজের ধরন তোমার মধ্যে পরিলক্ষিত হয়তো!! আজকে বিকেলের কাজটা না দেখলে বুঝতেই পারতাম না।

দিয়া নিশ্চিত হলো এতক্ষনে। শাহাদ বিকেলেই ওই বাড়িতে ব্যাপারটা ধরে ফেলেছে। পাভেল বলে দিয়েছে। আর রুমের কথোপকথন তো শাহাদ দেখে ফেলেছে তখনি বুঝতে পেরেছিলো। শাহাদের কি হয়েছিলো তা জানতে পাভেলের কাছে গিয়েছিলো দিয়া। পাভেল ফোনে মনি সম্পর্কে তথ্য জোগাড় করছে,তখনই সন্দেহ হয়েছিলো। নিজে খুঁচিয়ে বের করেছে, মনি শাহাদকে অনেক আগে থেকেই চায়। দুয়ে দুয়ে চার মিলিয়ে ফেলেছে তখনই।পেছন থেকে কলকাঠি নেড়েছে শেফালী। উপরে যখন সকলে কথা বলছিলো। মনি হঠাৎ করে পেছন বারান্দার দরজা দিয়ে ঢুকলো। কিছুটা সন্দেহ লেগেছিলো। শ্বাস আটকে আসছিলো।মনে হচ্ছে,কেউ ওকে দৌড়িয়েছে মাইলের পর মাইল। শাহাদের কথা ইঙ্গিতে অনেকেই অনেক কিছু বুঝেনি। দিয়া বুঝতে পেরে নিশ্চুপ ছিলো।সকলের সামনে শেহজাকে কোলে নিয়ে তাহিকে বলেছিলো,

– আপু,আমার কেনো যেনো মনে হচ্ছে আমার কোনো রকম জোড়া লাগানো সংসারও কেউ ভাঙতে চাইছে।সেদিন বলেছিলাম না একটা কাজ পারিনা। এবার মানুষ খু*ন করে আমি সেই কাজটাও সম্পূর্ণ করবো।আমি কেনো কথা বাড়াই না জানেন, আমার বাবা ছিলো শান্তি প্রিয় একজন মানুষ। শিখিয়েছেন কিভাবে ধৈর্য্য ধরতে হয়,তবে আমার মা ছিলেন মহিয়সী। মায়ের কাছ থেকে তলোয়ার চালানো শিখেছি,সাইকেল চালাতে পারি।আমি কিন্তু ঘোড়াও চড়তে জানি। আমার বাবা মায়ের জন্মদিনে মাকে ঘোড়া উপহার দিয়েছিলেন।আমার অনুরোধে দাদাজান সেই ঘোড়াকে নিরাপদ স্থানে রেখে গিয়েছেন। দুনিয়াতে আমার এখন শেহজা আর ওর বাবা ছাড়া কেউ নেই।ওদের ক্ষতি করতে আসলে এবার আমি কারো গলায় ছোরা বসাতে এক মুহুর্ত বিলম্ব করবোনা।

বিকেলের ঘটনা মনে পড়তেই কথা না বাড়িয়ে সামনেই এগিয়া চলে যেতে চাইলো। আচমকা থমকে বললো,

– আমি জানি সত্যি আমি খুব সুন্দর। বাবাজান আর আম্মিজানের অপরূপ সৌন্দর্য্যের সংমিশ্রণ আমি। সেই হিসেবে আপনি আমাকে প্রিন্সেস নূরজাহান না বলে প্রিন্সেস ডায়না বলতে পারেন। সেই বিখ্যাত উক্তি,” আমি যাকে ভালোবাসি, সে ছাড়া পুরো বিশ্ব আমাকে ভালোবেসেছিলো।”

শাহাদ নিষ্পলক চেয়ে রইলো দিয়ার যাওয়ার দিকে।বিছানায় শরীর এলিয়ে দিতেই চোখে হানা দেয় রাজ্যের ঘুম।

___

উৎসব আমেজ শেষ। সকলের কাজে ফেরার সময় হয়েছে। নিজ কামরায় এসেই ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে গেলো। ঢাকা পৌঁছাতে পৌঁছাতে প্রায় বারোটা। বাড়িতে সবাই এর আগে চলে এসেছে। শেহজাকে পেয়ে শিফা খুশিতে নাচতে নাচতে নিয়ে গেলো। দিয়া শাশুড়ীকে সাহায্য করতে রান্নাঘরে যেতেই শাহীন বললো,

– ভাবীমা একটা গুরুদায়িত্ব দিব পারবেন।

দিয়া চমকে উঠে ভাবুক চোখ শুধায়,

– কি দায়িত্ব ভাইয়া?

– ঘাবড়াবেন না প্লিজ। আগে বলেন ভাইজানের মুড কেমন?

– আমার সাথে তো সকাল থেকে দুটো কথাই হয়েছে,রেডি হও আর গাড়ি থেকে নামো। বুঝতে পারছিনা। হয়তো ভালো হবে।

– আজ বাড়িতে একটা বোম ফুটতে পারে আমার বিয়ে নিয়ে।সামলে নেবেন প্লিজ। আমি যাকে পছন্দ করতাম ভাইজান জেনে গিয়েছে। আমি শিউর আব্বু মুখের উপর না করে দিবে। ভাইজান আব্বুর মুখে তর্ক করেনা।

দিয়া মুচকি হেসে বলে,

– আচ্ছা এই ব্যাপার।ঠিক আছে আমি দেখছি। একটা বুদ্ধি দি?

– কী?

– বাসায় আজ সব কাজিনদের ফোন দিন। সবাই থাকলে ঝাড়ি কম খাবেন।

– সেরা তো।

– বাকিটা দেখি কি করা যায়।তবে মেয়ে ভালো??

– পাক্কা।আপনার সাথে পারা দিয়ে ঝগড়া করতে আসবেনা। উলটা দেখবেন পা ছুঁয়ে সালাম করতে ছুটে আসবে।

– ইয়া আল্লাহ না না তার প্রয়োজন নেই।

সেই মুহুর্তে শেফালী লুলা পা নিয়ে এগিয়ে এসে বলে,

– ছোট ভাইজান,এই মেয়ের সাথে কেনো কথা বলছো? আমার বড় ভাইকে অশান্তিতে রেখে শান্তি হয়নি তো এখন আসছিস আমার ছোট ভাইয়ের সাথে ন-ষ্টামি করতে। বে**শ্যা।

প্রচন্ড জোরে আওয়াজ হলো। ছিটকে গেলো শেফালী। তব্দা খেলো শাহীন, দিয়ার মুখে হাত। রান্নাঘর থেকে ছুটে এসেছে সুলতানা কবির। রায়হান সাহেব ডায়নিং এ বসে পত্রিকা পড়ছিলেন। শিফা শেহজাকে নিয়ে হাজির। এখনো শেফালী আগের জায়গায় দাঁড়িয়ে। ছলছল চোখে চেয়ে আছে। মুখ দিয়ে একটি শব্দ উচ্চারণ করলো,

– বড় ভাইইজান…

শাহাদ রক্তচক্ষু নিয়ে তাকিয়ে। ঘুরে তাকালো শাহীনের দিকে। শাহীন বার কয়েক ঢোক গিয়ে আমতা আমতা করে বলে,

– ভাইইজান আমি… কিছু… করিইইনি।জানিনা।

শাহীনের দিকে ভস্মীভূত দৃষ্টি নিয়ে বলে,

– যখন কেউ অর্ধাঙ্গীর চরিত্র নিয়ে আঙ্গুল তুলে এভাবে তাকে শায়েস্তা করতে হয় মনে রাখবি।

আজকে ভাইয়ের চোখে অনল দেখে কলিজা কাঁপছে। শেফালী কি করে এই কথা বললো! ভাবীমার চরিত্রে দাগ লাগালো।জড়িয়ে দিলো তার সাথে।তাহলে কি সে বাড়ির ভেতরে ভাবীমার সাথে কথা বলতে নিরাপদ নয়।সামান্য একটু কথা নিয়ে এত বড় ইস্যু। শেফালীর দিকে আঙ্গুল তুলে শাহাদ শাসিয়ে বলে,

– আজকের দিনের জন্য এত বছর অপেক্ষা করেছি। যদি আমি ভুল হই নিজের হাতে সমস্ত সত্ত্বা ভুলে গিয়ে আমার ভালোবাসাকে মাটিচাপা দিয়ে ফারাহকে জ্যান্ত পুঁতে দিব। আর যদি কোনোভাবে আমি সঠিক হই তাহলে দিন গুণতে থাক শেফালী।ভাই হিসেবে যেমন আগলে রেখেছি ঠিক তেমনি শূলে চড়াবো তোকে আমি। আম্মুর জন্য প্রতিবার বেঁচে গিয়েছিস। আজ এতটাই নিচে নেমেছিস যে এক ভাইয়ের বউকে ছোট করতে অন্য ভাইয়ের চরিত্রে দাগ লাগাচ্ছিস!

সুলতানা কবির ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে প্রশ্ন করলেন,

– বাবু কি করেছে এই মেয়ে?

– জিজ্ঞেস করুন।

শাহীন মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে,

– আম্মু, থাক না ওসব।

– না বল।

– আমি ভাবীমার সাথে দাঁড়িয়ে কথা বলছিলাম,শেফালী তখন আমাকে আর ভাবীমাকে মিশিয়ে বাজে কথা বলছিলো।

গলার স্বর ক্ষীণ হয়ে গেলো শাহীনের লজ্জ্বায়। রায়হান সাহেব,সুলতানা কবির আর শিফা হতবাক। শাহাদ যেভাবে তাকিয়ে আছে শেফালীর দিকে আজই সব অনলে পুড়িয়ে ছাই করবে। মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে,

– বের হচ্ছি আমি। দেখে রাখবেন আমার আমানত আম্মু। বহাল তবিয়তে থাকে যেন।

বেরিয়ে গেলো। রুমে চশমা আর গুরুত্বপূর্ণ একটা দলিল ফেলে যাওয়াতে ফিরে এসেছিলো নিতে।শুনে ফেলেছে শেফালীর মুখ নির্গত বাচ্য।নিজেকে আজ দমায়নি। নোমানকে ঢাকা আনা হয়েছে।আগে ঘরের সমস্যা সমাধান হবে।

সেই রাতের কথা আজো মনে পড়ে যায়। দুপুরে দিয়ার মিষ্টি মিষ্টি কথা শুনে হাসে শাহাদ। শাহাদের দিনগুলো কা*টে দিয়ার খুনশুটিতে। মধ্যাহ্ন ভোজ শেষে দুজনই বিশ্রামের জন্য যায়। দিয়া একটা লাল শাড়ি পরে ঘুরে ঘুরে বিভিন্ন ভঙ্গি করে দেখাচ্ছে। দাদীজান বলতেন,

– মেহতাব বিবি, আপনাকে তো মহলের সেরা সুন্দরী লাগছে। আমাকে আজকে পানে একটু বেশি করে জর্দা দিবেন। আপনার মত লাল ঠোঁট বানায়ে মজুমদার মশাইকে আকৃষ্ট করবো।

– ইশ বুড়ির কত ঢং।

শাহাদ হাসছে দিয়ার ঢং দেখে। দিয়া মুখ ভেঙচি দিয়ে বলে,

– হাসবেন না নেভিয়ান মশাই। আরো দেখবেন দাদা সাহেব কিভাবে রোমান্স করে?

– কিভাবে কিভাবে??

শাহাদ উৎসুক দৃষ্টিতে শোয়া থেকে উঠে বসলো। দিয়া ঢং করে শাহাদের হাত ধরে বলে,

– আপনি এখানে দাঁড়ান। আমার কোমরে হাত দিয়ে আমার দিকে ঝুঁকে বলেন, ও আমার দিলরুবা, তুমি তো অপরূপা। তুমি আমার জানেরই জানের জান পরানের পরান।

শাহাদ অনুকরণ করে বললো,

– ও আমার ফারাহ, তুমি অপরূপা,তুমি আমার জানেরই জান পরানের পরান।

দিয়া বলে উঠলো,

– আহ হা, মুরাদের বাপ আপনার কি ভীমরতি ধরছে। মেহতাব বিবি এসে পড়বে তো। ছিঃ ছিঃ লজ্জ্বা।

শাহাদ তাল মিলিয়ে বলে,

– ইশ কি লজ্জ্বা! কিছু হবেনা আসুক কেউ। আমি আমার বউকে আদর করবো এখন।

দিয়া ভ্রু কুচকে বলে,

– সীন থেকে বেরিয়েন আসেন মশাই।

– কিসের কি? আমি এখন ব্যস্ত সীনে। বিরক্ত করবেনা। মুড চলে এসেছে।

দিয়া নিজেকে ছাড়াতে চেয়েও পারলোনা। শক্ত পোক্ত পুরুষালি হস্ত আকড়ে ধরলো। লজ্জালু দিয়া নিজেকে আড়াল করলো মানুষটার মাঝে। প্রতিদিনের এই ভালোবাসাময় স্পর্শ দিয়াকে ভুলিয়ে দিয়েছে আপন মানুষ না থাকার কষ্ট। মৃদুমন্দ বাতাস ভেসে আসছে বারান্দা দিয়ে। বিয়ের পর থেকে গত এক মাস শাহাদ প্রতিটি মুহুর্তে মাতিয়ে রেখেছে অবিরাম সুখে।শাহাদের আকাঙ্ক্ষিত নারী এই ফারহানা মেহতাব দিয়া। ভালোবেসে স্ত্রীর নাম দিয়েছে ফারাহ। যার নামের অর্থ “সুখ”। রাশেদ চলে যাবার পর ভুলেই গিয়েছিলো ভালো থাকা।দিয়া এসে শাহাদের জীবনটাকে সুখে রাঙিয়ে দিয়েছে। তবে সেই সুখের মেয়াদ ছিলো মাত্র একমাস। সেদিন রাতেই ঘটে যায় ভয়াতুর, হৃদয় কাঁপানো ঘটনা। সেই সত্যতা বের করতেই আজ মুখোমুখি হবে নোমানের। শাহাদের আত্না কেঁপে উঠেছিলো সেদিন প্রনয়ীনিকে নোমানের বুকে দেখে। আজ ও বিশ্বাস হয়না, ইশ যদি ভুল হত সেই চিত্র,যদি মিটে যেত সেইদিন।যদি এমন হত এমন কোনো দিন জীবনে আসেনি। কিন্তু সম্পূর্ণভাবে সব রকমের ভ্রমকে ছাপিয়ে ঘটে যাওয়া ঘটনা সত্যি প্রমানিত হয়েছিলো নোমানের কথায়,

– হ্যাঁ ভাইজান আমার আর দিয়ার সম্পর্ক চলছে।

শেফালী চেঁচিয়ে বলেছিলো,

– আমি ভাবীকে আরো অনেকবার দেখেছি নোমানের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে। আমার জীবনের সুখ কেড়ে নিয়েছে এই মেয়ে ভাইজান। এক্ষুনি বের করে দিন।

দিয়ার চুল ধরে সেদিন শেফালী কষে থা/প্পড় মেরেছিলো। লা/থি দিয়েছিলো পেট বরাবর। তবে মহান রবে ইচ্ছে হয়তো আরো মহান। অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার খবর সেদিনই পেয়েছিলো। জটিলতার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে ন’মাস। শর্ত মতে শেহজার এক বছর হলে শাহাদের সাথে বিচ্ছেদ হবে দিয়ার। মাত্র দু মাস সময় আছে। আজ শেহজার দশ মাস। সকল সম্পর্কে আজ ছেড়ে যাবে। শাস্তি পেতে হবে অপরাধীকে। হোক সে দিয়া! অথবা শেফালী! অথবা নোমান!!

চলবে…

(নোট : খুলছে জট! কেমন লাগছে)