#সায়রে_গর্জন
#নীতি_জাহিদ
২০.
( অনুমতি ব্যতীত কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ)
পিনপতন নিরবতা ডাইনিং টেবিলে। সকলে একসাথে সকালের নাস্তা করতে বসেছে। তাহি শেফালীকে ড্রেসিং করে দিয়েছে। বাসার সবাই জেনেছে শেফালীর আচার ব্যবহারের জন্যই শাহাদ শাসন করেছে। লিমনের মা রত্না বেশ কিছুবছর যাবৎ অসুস্থ। ওর নানুর সাথেই থাকে। শাহাদ কিছুক্ষন উনার খোঁজ নিয়ে ভালো ডাক্তার দেখানোর জন্য বললো। আফিয়া খালা নাস্তা সাজিয়ে শাহাদকে উদ্দেশ্য করে বললো,
– শাহাদ বাবা, রুমের চাবিটা দিতেন, আমি নাস্তা দিয়ে আসি।
শাহাদ টিস্যু দিয়ে মুখ মুছে আফিয়ার দিকে চোখ গরম করে তাকিয়ে জোর আওয়াজে বললো,
– খাবারের কভার সরাও, কি খাবার দিয়েছো দেখি?
আফিয়া শুকনো ঢোক গিলে সুলতানা কবির আর দিয়ার দিকে তাকালো।
– এদিকে তাকাও।
পুনরায় ধমক খেয়ে কভার উঠাতেই দেখতে পেলো খিচুড়ি আর বেগুন ভাজা সাথে জুস। শেফালী রুটি, আলু ভাজি পছন্দ করে না। শাহাদ খাবার ডিশ থেকে খিচুড়ি নামিয়ে সেখানে রুটি আর আলুভাজি দিলো,সাথে জুসের গ্লাস নামিয়ে এক গ্লাস পানি দিয়ে বললো,
– জেলের কয়েদী যা খায়, ও তার চেয়ে কিছুটা স্বাস্থ্যসম্মত খাবার পাবে। আমার কথার এদিক সেদিক হলে ওর খাবার বন্ধ করে দিব। খাবার দিয়ে চাবি ফিরিয়ে দাও আমাকে। যাও।
তাহি,লিমন তাকিয়ে আছে একে অন্যের দিকে। শাহীনের কোলে ছিলো শেহজা। রুম থেকে ভাইঝিকে নিয়ে দুষ্টুমি করতে করতে বের হয়েছে। বাবাকে দেখে খুশিতে চিৎকার দিয়ে উঠলো। ধ্যান ভাঙলো সকলের।শাহাদকে দেখেই হাত বাড়িয়ে দিলো কোলে নেয়ার জন্য। মুখে উচ্চারণ করলো,
– বাবা…
শাহাদ দু হাত মেলে দিতেই ঝাঁপিয়ে আসে। শাহাদ মৃদু হেসে বলে উঠলো,
– এই মেয়ে বুঝে কিভাবে আমার উপস্থিতি?
গুটিসুটি মেরে বাবার বুকের সাথে লেপ্টে আছে। মায়ের কার্বন কপি। মেয়ের দিকে তাকিয়ে মন কেমন করে উঠলো। আনমনেই সকলের সামনে বলে উঠলো,
– আমি না থাকলে কি বাবাকে ভুলে যাবে আম্মা!
দিয়া দাঁড়িয়ে গেলো সকলের সামনে। বিনা বাক্য ব্যয়ে রুমে চলে গেলো। সকলের সামনে এমন কথা বলা ঠিক হয়নি বুঝতে পেরে শাহাদ উঠে দাঁড়ায়। সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলে,
– তোমরা খাও আমি আসছি। আফিয়া খালা তোমার ছোট আম্মার নাস্তাটা রুমে নিয়ে এসো।আমার জন্য কড়া এক কাপ চা দিও সুগ্যার ফ্রি।
মেয়েকে কোলে নিয়ে রুমে চলে এলো শাহাদ। সুলতানা কবির,রায়হান সাহেবের বিষন্নতা, শাহাদের এমন কথা বাকি সকলকে ভাবিয়ে তুলে। লিমন, তাহিকে ফিসফিস করে বলে,
– ডাক্তার তাহি,কেসটা কি? ভাবীমার আচরণে বড় ভাইজান সেন্টি খেলো কেনো? আমি জীবনে প্রথম এই লোককে সেন্টি খেতে দেখলাম।
তাহি কটমট করে তাকিয়ে বললো,
– বেয়াদপ,ভাইজানকে নিয়ে এসব কথা বলো কি করে? ছোট ছোটর মত থাকতে পারো না।
– ঠিক বয়সে বিয়ে করলে এক বাচ্চার বাপ হতাম। হুহ।
– কিহ!!
– কিছুনা।
ঠোঁট বাকিয়ে বিরবির করতে করতে খেতে লাগলো। বড্ড বিরক্ত এই সিনিয়র মেয়েটার উপর।সারাক্ষন তাচ্ছিল্য করতে ব্যস্ত থাকে। এমন শাস্তি দিব ভবিষ্যতে দেইখো মেয়ে। আপন মনেই এসব বলতে থাকলো লিমন।
___
‘ খাঁড়ার ওপর মরার ঘাঁ’ এমনিতেই জীবন তেজপাতা এর মাঝে নতুন বিপদ হানা দিয়েছে। গতরাত থেকে ঘুম আসছেনা। সকালে নাস্তা না খেয়ে পার্টি অফিসে এসে চুপচাপ বসে আছে। হামজা,তুহিন দুবার জিজ্ঞেস করে গিয়েছে কি সমস্যা। ঘড়িতে বাজে সকাল সাড়ে আটটা। এত তাড়াতাড়ি কেউ অফিস আসে? নিজেও এসেছে সাথে ওদেরও ফোন দিয়ে বসের কথা বলে আনিয়েছে। রুমের মধ্যে ছটফট করছে। তুহিন কাঠের বেঞ্চিতে বসেই ঘুম। হামজা বিরক্ত হয়ে বলে উঠলো,
– পাভেল ভাই,হইছে টা কি আপনার। বেতরঙ্গি মাছের মতন এমন ছটফট করতাছেন ক্যান? চুপচাপ বসেন একজায়গায়। মনটারে স্থির বানান।
এবার পাভেল বেঞ্চিতে বসে বিড় বিড় করতে করতে জোরেই বলে উঠলো,
– শা/লা*র জীবনটা! প্রেম করলেও ঝামেলা,না করলেও ঝামেলা। ভালোই তো ছিলাম, প্রেম পিরিতি আসে নাই জীবনে। আমি প্রেমের সাথে না জড়ালেও প্রেম কুতকুত খেলতাছে আমার সাথে জড়ানোর লাইগা।
প্রেমের কথা শুনে তুহিন চিৎকার দিয়ে বলে,
– আব্বে কোন হা/লায় রে প্রেম করতাচে, সামনে আইনা দে। ওরে কুটি কুটি কইরা হালামু। হা*লার কাম টা দেখছুস নি! প্রেম কইরলে যে পস্তাইবে এই কতা কি হা’লায় জানে না।
পাভেল পা থেকে স্পঞ্জের স্যান্ডেল জোড়া খুলেনি। মাঝে মাঝে ফ্লোরে হাঁটার জন্য অফিসের সকলের আলাদা স্যান্ডেল আছে।এক পায়ের স্যান্ডেল খুলে ছুঁড়ে মারলো তুহিনের গায়ে। আধ ঘুমন্ত তুহিন আবার চেঁচিয়ে বললো,
– আব্বে পাথ্থর মারচ ক্যান হা*লা! ভাইজান আইয়া লক কইয়া দিমু সব।
পাভেল হামজাকে বললো,
– এই মালটা বেশি গিলছে কাল। বস জানলে পার্টি অফিসের তিলতলা থেইকা লা*ত্থি মাইরা বুড়িগঙ্গার যে লেনে কমোড আছে ওই ট্যাংকিতে চুবাবে। ব্যাটা খা/ই/স্টা কোন হানকার। সরা এটারে।
– এমন করেন ক্যান ভাই, জানেন তো তুহিন ভাই ছ্যাঁকা খাইয়া ব্যাকা হইয়া গেছে। প্রেমের কথা শুনলেই হ্যে ছ্যাঁত ছ্যাঁত করে।
– চুপ থাক চামচিকা। আমার জন্য এক কাপ চা আনা।
পকেটে কম্পনের আওয়াজ অনুভব হওয়াতে সেল ফোন বের করে দেখে সেই রাতের নাম্বার থেকে মেসেজ। পাভেল ভ্রু কুঞ্চিত করে ঠোঁটে বিরক্তিকর শব্দ করলো। মেসেজ দেখেই পুনরায় রা*গ উঠলো। এত বুঝানোর পরও সেই ভুল। পাভেল ফিরতি ফোন দিলো।রিসিভ হতেই প্রথমে ধমক,
– একটু বাড়াবাড়ি হচ্ছেনা, কয়টা বাজে ঘড়িতে দেখেছো? আমার জানটা কবজ করার ব্যবস্থা না করলে হয়না!
অপর পাশ শব্দহীন। শব্দেরা আজ হরতাল করছে। পাভেল উঠে দাঁড়ায়। শাহাদ এখনো আসেনি। ওর অফিস চেম্বারে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দেয়। পার্টির অন্য লোকজন আসা শুরু করেছে। পুনরায় কানের সাথে ফোন লাগিয়ে বলে উঠলো,
– কেনো করছো এসব বলোতো? প্রথম যেদিন বললে সেদিন আমি কিছু বলিনি। এখন প্রায় এসব বলো। আমি অনেক বিরক্ত প্লিজ এসব বলোনা। কেনো বুঝতে পারছোনা, আমি তোমার এসব পছন্দ করছিনা।আমার অন্য কাউকে পছন্দ আছে। দয়া করে ফোন দিবেনা।
অপর পাশ থেকে প্রতিউত্তর এলো,
– একবারো কি বলেছি আমায় পছন্দ করুন। তবে কেনো এমন আচরণ। করতে হবে না পছন্দ। মনোযোগ দিয়ে শুধু শুনবেন আমি যখন ফোন দিব। আপনার কথা শোনার জন্যই ফোন দিই।
পাভেল শব্দহীন। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে ন’টা বাজার মাত্র পাঁচ মিনিট। এক্ষুনি শাহাদ ঢুকবে। রুমের দরজা লাগানোর অপরাধে হাজারটা প্রশ্নের সম্মুখীন ও হতে হবে। কিন্তু এই কেসটার ও একটা সমাধান চাই। কাটকাট গলায় ধমক দিয়ে বললো,
– না আর ফোন দেবে না। আমি কিন্তু অন্য ব্যবস্থা নেব ফোন দিলে। আমার জানের মায়া থাকলে এসব বাদ দিয়ে পড়াশোনা করো।নতুবা আমি নিরুদ্দেশ হয়ে যাব।
কলের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে রুম থেকে বেরিয়ে গেল।
___
শাহাদ শেহজাকে একটু করে নাস্তা খাইয়ে দিচ্ছে আর মিটমিটিয়ে হাসছে। দিয়া গাল ফুলিয়ে বসে আছে অন্য পাশে। শেহজা বাধ্য সন্তানের ন্যায় খেয়ে নিচ্ছে। মাঝে মাঝে মাথা নাড়ালে শেহজার হাতের ডক্টর’স টয় দিয়ে বিভিন্ন এক্ট করে দেখাচ্ছে। মেয়েকে খাওয়ানো শেষ করে খাটের মাঝে খেলনা দিয়ে বসিয়ে দিলো। এরপর পকেট থেকে ফোন বের করে নাম্বার ডায়াল করে কল করলো ওপাশ থেকে স্বর এলো,
– আসসালামু আলাইকুম বস।
– হুম ওয়ালাইকুমুস সালাম। আমার আসতে কিছুক্ষন লেট হবে। সামলে নাও।
– ওকে বস।
ফোন টেবিলের উপর রেখে দিয়ার কাছ ঘেঁষে বসলো। খিচুড়িতে ভালো করে বেগুন আর ডিম মাখিয়ে মুখের সামনে তুলে ধরে বলে,
– খেয়ে নিন শাহাদ গিন্নী , কথা দিলাম নেক্সট মান্থ যাবো সিঙ্গাপুর। শেহজার আর আপনার ভিসা অলরেডি প্রসেসিংয়ে আছে।
দিয়া কথা না বলে পিঠ দিয়ে বসলো। শাহাদ ভ্রু কুঁচকে বলে,
– এখন আবার কি করলাম! ওহ আচ্ছা, ঠিক আছে আর এসব বলবোনা। শেহজা আম্মা শুনো আব্বা আরো কয়েক যুগ বাঁচবো ইনশাআল্লাহ। পরে একদিন ঘুম থেকে উঠে দেখবো হায়! হায়! দুনিয়াতে আবার ডায়নোসর যুগ ফিরে এসেছে,সাথে যুক্ত হয়েছে এলিয়েন। কিন্তু শাহাদ ইমরোজ ও তার পরিবার বেঁচে আছে। এরপর আমরা ডায়নোসরের হাড়গোড় দেখতে আর চিড়িয়াখানায় যাবোনা তখন তো রাস্তায় কত ডায়নোসর হাঁটাচলা করবে, এলিয়েন ও আসতে পারে। আচ্ছা কেমন হবে বলোতো যদি আমরা পিকনিকে যাই ওদের সাথে, কারণ তখন তো আমরা ছাড়া পৃথিবীতে আর কোনো মানব পরিবার থাকবেনা। আচ্ছা ফারাহ আমাদের বাসায় ডায়নোসরদের দাওয়াত দিলে তুমি সব রান্না একসাথে করতে পারবে। ওরা তো অনেক খায়।ততদিনে তো আমি আরো বুড়ো হবে,তুমিও হবে বুড়ি তাইনা! আর ডায়নোসর, এলিয়েন হবে আমাদের বন্ধু,প্রতিবেশী।
– হ্যাঁ অবশ্যই পারবো সব রান্না করতে,ইনফ্যাক্ট রান্নারই কি দরকার।ওই ডায়নোসর আর এলিয়েন আমাকে,আপনাকে তরকারি বানিয়ে খেয়ে নিবে।
– দূর্দান্ত আইডিয়া!!!
দিয়া চক্ষু ছানাবড়া। কি বলে এসব উদ্ভ্রান্ত কথাবার্তা। মাথা ঠিক আছে। দিয়ার এমন ভাবে তাকিয়ে থাকা দেখে শাহাদ হো হো করে হেসে উঠলো। বাবার হাসি দেখে হামাগুড়ি দিয়ে শেহজা এগিয়ে এসে বাবার কাঁধ ধরে উঠে দাঁড়ায়। মুখে হাত দিয়ে বাবাকে নকল করে খিলখিল করে হাসছে। শাহাদ মেয়েকে আগলে নিয়ে মেয়ের সাথে পাল্লা দিয়ে হাসছে।ওদের হাসি দেখে দিয়াও হেসে দিলো।না হেসে এমন পরিস্থিতিতে থাকা যায় নাকি! শাহাদ খিচুড়ির লোকমা বাড়িয়ে দিতেই খেয়ে নিলো দিয়া। শাহাদের হাতে কখনো কিছু খাওয়া হয়নি। এই প্রথম এত যত্ন করে রাগ ভাঙাতে এসেছে মানুষটা। দিয়া ভাবছে যদি কোনো দূর্ঘটনা ঘটে দিয়া তো কিছুতেই এই শোক আর কা/টাতে পারবেনা।এই সাহস এবার নেই। বাবাজান,আম্মিজান চলে যাবার পর দাদাসাহেব ছিলেন, দাদাসাহেবের পর এমপি সাহেব। এখানেই কেনো দিয়ার কষ্টের অন্ত হলো না! অন্য ধ্যানে মশগুল থাকা সহধর্মিণীকে বললেন,
– ওগো আমার বেগম শাহাদ, ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখেছেন? আপনার সোয়ামী সরকারের বেতনভুক্ত কর্মচারী। আপনার ফরমায়েশ রাতে এসে খাটবো।আপাতত খেয়ে ছুটি দিন। এই বান্দা অফিসে দেরী না করে যাওয়ার রেকর্ড ভেঙে ফেলেছে আজ।
মুখটা কেমন বাচ্চাদের মত ফুলিয়ে কথাটা বললো শাহাদ। শাহাদের আজকের আচরণে পরিবর্তন দেখে দিয়ার প্রচন্ড হাসি পাচ্ছে সেই সাথে ভালো লাগা কাজ করছে অফুরন্ত। হেসে শাহাদকে বলে উঠলো,
– ওগো সোয়ামি আপনি তো বউকে খাইয়ে দেয়ার মতো ঘটনা ঘটিয়ে বউ পাগলের তকমা লাগিয়েছেন।তার বেলায়।
সবটুকু খিচুড়ি দিয়াকে খাইয়ে দিয়ে শেষ লোকমা নিজের মুখে নিলো। খেয়ে হাসি মুখে বললো,
– এই কাজ বহু আগেই করতাম যদি জীবনে কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার মুখোমুখি না হতাম।
সরাসরি ওয়াশরুমে গিয়ে হাত ধুয়ে নিলো শাহাদ। শাহাদ শেষ লোকমা মুখে নেয়ার কারণ বুঝলো না দিয়া। শেহজার দিকে তাকিয়ে দেখে আপন মনে খেলছে। দিয়া দাঁড়িয়ে পড়ে। শাহাদ রুমে ঢুকে টিস্যুতে হাত মুছে বললো,
– ওকে সোনা বের হচ্ছি নিজের প্রতি, মেয়ের প্রতি খেয়াল রেখো। আর খবরদার সকালে যে ভুলটা
বউ- শাশুড়ী মিলে করেছো সেটা আর করবেনা।
শেফালীর নাস্তার আয়োজন শাহাদের অনুমতি ব্যতীত করাতে শাহাদের রাগের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। মাথা নাড়িয়ে দিয়া সম্মতি জানালো।মনের মাঝে উঁকি দেয়া সেই প্রশ্ন করলো,
– শেষ লোকমা আপনি খেলেন কেনো?
কাঙ্ক্ষিত জিনিস পেয়ে যেভাবে লোকে উচ্ছ্বাসিত হয়,শাহাদ এমন প্রশ্নে একপেশে হাসি দিয়ে বললো,
– তোমার প্লেটের খাবার না খাওয়ার লোভ ছাড়তে পারিনি।
দিয়ার দু অধর আলগা হয়ে গেলো। হেসে উত্তর দিলো,
– ওরে আমার এমপি সাহেব…
শাহাদ লজ্জা পেয়ে মাথা চুলকে দিয়ার কাছে এসে কপালে অধর ছুঁয়ে দিলো। এরপর মেয়ের কপালে অধর ছুঁয়ে দুজনকে সাবধান বার্তা শোনাতে শোনাতে শেহজাকে কোলে নিয়ে লিভিং রুমে আসলো সকলের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে গেলো তখন ঘড়িতে ন’টা চল্লিশ। পাক্কা চল্লিশ মিনিট লেট হয়েছে কাটখোট্টা ডিসিপ্লিনড শাহাদের।
____
গাড়িতেই বসেই আজ ড্রাইভারকে বললো,
– একটা ভালো গান দাও রিফ্রেশিং।
”এক হারিয়ে যাওয়া বন্ধুর সাথে
সকাল-বিকেল বেলা
কত পুরোনো-নতুন পরিচিত গান
গাইতাম খুলে গলা
কত এলোমলো পথ হেটেছি দু’জন
হাত ছিলো না তো হাতে
ছিল যে যার জীবনে দু’টো মন
ছিল জড়াজড়ি একসাথে
কত ঝগড়া-বিবাদ, সুখের স্মৃতিতে
ভরে আছে শৈশব
তোকে স্মৃতিতে স্মৃতিতে এখনও তো
ভালোবাসছি অসম্ভব
কেন বাড়লে বয়স ছোট্ট বেলার
বন্ধু হারিয়ে যায়
কেন বাড়লে বয়স ছোট্ট বেলার
বন্ধু হারিয়ে যায়
কেন হারাচ্ছে সব, বাড়াচ্ছে ভীড়
হারানোর তালিকায়”
মনে পড়ে রাশেদের কথা। শায়ানের এই গান অসম্ভব পছন্দের ছিলো।প্রায় শাহাদের পিছু নিয়ে বলতো,
– বন্ধু তুই এমন কাটখোট্টা ক্যান! এত কম হাসিস ক্যান! তুই জানোস দুনিয়া কত্ত সুন্দর। হাসবি,মজা করবি কাছের মানুষ গুলারে বুকে টাইনা নিবি দেখবি কলিজাটা কেমন স্বস্তি পায়।
– আমার কলিজায় এত মানুষের জায়গা নাই। তুই নে তোর মন চাইলে।
রাশেদ মুখ ভেঙচি দিয়ে বলে,
– বুঝবি একসময়,হয়তো আমি থাকবোনা। তখন ঠিকই বলবি রাশেদ তুই ঠিক ছিলি।
শাহাদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিরবে চোখ বুজে হেলান দেয় গাড়ির সিটে। বিড়বিড়িয়ে বলে,
– রাশেদ তুই ঠিক ছিলি। বন্ধু, একসময় খুব চাইতাম একবার স্বপ্নে এসে বলে যা কে ছিলো তোর এভাবে অকালে হারিয়ে যাওয়ার পেছনে। আজ বলবো আসিস না তুই স্বপ্নে। আমি নিজেই অপরাধীকে খুঁজে সেরা শাস্তিটাই দিব। তুই এলে আমার মনে ভয় ঢুকে যাবে,মানুষ নাকি মৃত মানুষ স্বপ্নে দেখে নিজের মৃত্যুর আগে। বাঁচার তৃষ্ণা বেড়েছে বিশ্বাস কর। ছোট্ট শেহজা আমার জান। ওকে ছাড়া আমি ভাবতে পারিনা আমার অস্তিত্ব। আর তার মা আমার কাছে দ্বিতীয় সেরা নারী। যার কন্ঠে থাকে স্বামীর সম্মানে রচিত বাক্য, সংসার বাঁচানোর অদম্য সাহস।
গাড়ির হর্নে ধ্যান ভেঙে যায়। ড্রাইভারের দিকে তাকিয়ে দেখে সে বার বার হর্ন দিচ্ছে। ধমক দিয়ে বললো,
– কি সমস্যা আকবর?
– স্যার সামনে একটা এক্সিডেন্ট হয়েছে।
শাহাদ ভাবছে এখন নামলে যদি বিপদ বাড়ে। আজ নেই কোনো নিরাপত্তা। যদিও সে ভয় পাচ্ছেনা তবুও যেকোনো সময় যেকোনো কিছু ঘটতে পারে। এদেশের ক্ষেপাটে, পাগলাটে হুজুগে বাঙালি গুজবে বিশ্বাসী। কিছু ভেবে বলে,
– আমার অফিসে দেরি হচ্ছে। তুমি ঘটনা কি দেখে গাড়ি নিয়ে চলে আসো। আমি রিকশা করে যাচ্ছি।
– স্যার, আপনাকে কেউ দেখলে!
– মাস্ক থাকবে। সমস্যা নেই সাবধানে এসো। প্রয়োজন হলে জানিয়ে দিও।
শাহাদ বেরিয়ে গেলো গাড়ির দরজা খুলে। মুখে মাস্ক,চোখে সানগ্লাস। পরনে সাদা পাঞ্জাবির হাতা গুটানো। যে কেউ দেখলে ভাববে রাস্তার সাধারণ পথচারী। একটা রিকশা ডেকে উঠে পড়লো। এই রাস্তা থেকে অফিস বিশ মিনিট। আপন গতিতে চলছে রিকশা। রিকশাওয়ালা রাজ্যের আলোচনা করছে। সরকার, দেশ তুলে এবং নিজের ঘরের মহিলা মানুষ তুলে ও গালা-গালি দিচ্ছে। শাহাদ বিরক্তিতে পাশ ফিরে ঘাড় ঘোরাতেই ভ্রু কুঁচকে এলো। ঘটনা আঁচ করতে পেরে ললাটে চিন্তার রেখা প্রকাশ পেলো। অফিসের সামনে আসতেই রিকশাওয়ালা বললো,
– ছার, আপনে কইলেই হইতো পার্টি অফিস আইবেন। তাহলে কি আমি সরকার তুইলা গাইল পাড়তাম। খালি কইলেন ডাইনে যান,বামে যান। আপনে তো নেতা মানুষ কিছু মনে কইরেন না।
শাহাদ মুখের মাস্ক খুলে বলে,
– আপনার সরকার কেনো পুরো বাংলাদেশ নিয়ে মত প্রকাশের অধিকার আছে। কিন্তু ঘরের বউয়ের বদনাম রাস্তায় লোকের কাছে করার জন্য আপনাকে তুলে আঁছাড় মারতে মন চেয়েছে। আমার হাতে সময় কম বলে বেঁচে গিয়েছেন।
রিকশাওয়ালা আমতা আমতা করে বলে,
– এমপি সাব, মাফ কইরা দেন। এ আমার কি ভাগ্য।
শাহাদের পা জড়িয়ে ধরবে এর মধ্যে শাহাদ পিছিয়ে কেয়ারটেকার কে বলে,
– এটাকে দূরে সরাও। বেহুদা পুরুষ।
হনহন করে হেঁটে গেলো। শাহীন, পাভেল,হামজা বসে আছে। শাহাদকে দেখে উঠে দাঁড়ায়। অন্যরা মুখ খোলার আগেই শাহাদ বলে উঠলো,
– শাহীন ধন্যবাদ আমার আগে এসেছো। চেয়েছিলাম অন্য কাজ দিতে কিন্তু পথিমধ্যে এক অদ্ভুত জিনিস দেখলাম।
– কি ভাইজান?
– ক্যাপ্টেন আলতাফের সাথে মনি কি করে?
– ক্যাপ্টেন আলতাফ বলতে আপনি কি অহনার ভাইকে বুঝাচ্ছেন?
– হ্যাঁ।
সকলে একে অন্যের চোখে তাকিয়ে দেখে প্রশ্নসূচক দৃষ্টি। শাহাদ ভাবুক চোখে তড়াক করে তাকিয়ে বলে,
– ইয়া আল্লাহ।রহম করো। মনির কাছে রাশেদের পোস্ট মর্টেম রিপোর্টের কপি আছে। পাভেলের বাচ্চা তোকে আমি বলেছিলাম আলতাফকে খুঁজে বের কর। ও এক নাম্বার কালপ্রিট। এই রিপোর্ট হাতে পেলে রাশেদকে ও রেপিস্ট বানিয়েই ছাড়বে। অমীমাংশিত কেইস সলভ করে ফেলবে। আমার এতদিনের পরিশ্রম পন্ড হবে। আমি তোদের খু/ন করে ফে*লবো।
পুরো অফিস রুম কেঁপে উঠে শাহাদের হুংকারে। নতুন জাল বিছাবে মনি। এই রিপোর্টের প্রকৃত কপি শাহাদের কাছে ছিলো।কিছুদিন আগে মনি চেয়ে নিয়েছে। শাহাদ মনির চালটা ধরতেই পারলোনা। হায়রে দুনিয়া কাছের মানুষগুলা এতোটা ঠ/কবাজ! বেঈমান! কি করে হয়ে গেলো। নিজের বোনটাই যেখানে ভাইকে ফাসায় সেখানে মনি তো পরের মেয়ে। নিরবতা পছন্দ হয়নি কারো। পুনরায় গর্জন উঠবে।এবার সকলে দেখতে পাবে শাহাদের অবিনাশী রূপ। সতর্ক সংকেত কাউকে সতর্ক করেনি,কেউ অবলম্বন করেনি ঝড়ের আগের পূর্ব সাবধান বাণী। র*ক্ত জলোচ্ছ্বাস বইয়ে আনবে। প্রলয়ঙ্কারী তুফান এর ঘনগর্জন জানিয়ে দিচ্ছে আভাস বার্তা।
চলবে…
#সায়রে_গর্জন
#নীতি_জাহিদ
২১.
( অনুমতি ব্যতীত কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ)
ওহে, কি করিলে বলো পাইব তোমারে, রাখিব আঁখিতে আঁখিতে
ওহে, কি করিলে বল পাইব তোমারে, রাখিব আঁখিতে আঁখিতে
ওহে এত প্রেম আমি কোথা পাব, নাথ
এত প্রেম আমি কোথা পাব, নাথ তোমারে হৃদয়ে রাখিতে
মাঝে মাঝে তব দেখা পাই, চিরদিন কেন পাই না
মাঝে মাঝে তব দেখা পাই, চিরদিন কেন পাই না।
গান শুনে রেস্টুরেন্টে উপস্তিত সকলে মুগ্ধ। যেন কোনো প্রফেশনাল গায়কের কণ্ঠ থেকে বেরিয়ে আসা গান। তাহি মুগ্ধ হয়ে বললো,
– থামলেন কেনো?
রাশেদ মৃদু হেসে বলে,
– থামতে হবে,নতুবা স্টেশন মিস করে ফেলব ডক্টর।
– মানে?
– এখন যদি না থামি ট্রেন ধরবো কি করে! আগে তো ট্রেন ধরি এরপর নাহয় পরের স্টেশনে দুজন মিলে মেঘালয়ের উদ্দেশ্য নেমে পড়বো। পথিমধ্যে এই বেসুরে গাওয়া আমজনতার গান মহামানবী, সেবিকা ডক্টর তাহিরা জান্নাতকে শোনাবো। কি বলেন! শুনবেন না?
– এত ভালো ফ্লার্ট করেও প্রেমিকা জুটাতে পারলেন না?
– কি করে পারবো? আপনার খাড়ুশ ভাইটা আমার জান কবজ করার জন্য আশপাশে ঘুর ঘুর করে। জানেন এক জেনারেলের মেয়ের প্রেমে পড়েছিলাম।আমাদের মাঝে ইটিশ পিটিশ ও হয়েছিলো কিন্তু মাঝে আপনার ভাই গিয়ে সব এলোমেলো করে দিলো। ওই বেয়াদ্দপ মেয়ে আপনার ভাইয়ের প্রেমে হাবুডুবু খেয়ে আমাকে ন্যাকামি করে বলে, রাশেদ ভাইয়া একটা হেল্প করবেএএএন। আমি না আপনার বন্ধুর প্রেমে পড়ে গিয়েছি উনাকে বলবেন। আমি তো ভ্যাবলা কান্ত। জানি বন্ধু নাকোচ করবেন। নাকোচ করলে আমার রাস্তা ক্লিয়ার।ওই শা’লা তো অন্যজনরে মন দিয়েছে। গিয়ে বন্ধুকে বলতেই বন্ধু গিয়ে মেয়ের বাপকে ফোন দিয়ে বলে,আপনার মেয়ে সামলান। এবার ভেবে দেখেন, কেমন বে’য়া’দ্দপ। নিজেও করলিনা,আমারেও দিলি না।
তাহি হো হো করতে হাসতে দাঁড়িয়ে পড়ে। পেটে খিল ধরেছে। ও জানতো বড় ভাইজান এমন কিন্তু এতটা তা জানতোনা।
ঘুমের ঘোর লেগে এসেছিলো। নার্স ফরিদার ডাকে অকস্মাৎ ঘুম ভেঙে গিয়েছে। একমাত্র তাহি যে প্রায় রাশেদকে স্বপ্নে দেখে। অবচেতন মন ঘিরেই রাশেদের বাস। ভাবনা থেকে বেরিয়ে মুখ ধুয়ে নিলো। কিছুটা ফ্রেশ লাগার পর রওয়ানা দিলো আউটডোরে।
___
গুলশানের নামকরা ক্লাব। উপস্থিত নামজাদা নেতাকর্মী, উচ্চ পদস্থ অফিসার, মাঝে তিনজন নারী। সকলের একটাই উদ্দেশ্য মনির কাছ থেকে রাশেদের পোস্ট মর্টেম রিপোর্ট হাতিয়ে নেয়া। মেয়েটা বড্ড চালাক। ভাগে আনতে পারছেনা। ক্যাপ্টেন আলতাফ বললো,
– ডাক্তার মনিকা, এটা তো আমাদের চুক্তির মাঝে ছিলোনা। আপনি শর্ত মোতাবেক দুটো জিনিস চেয়েছেন। একটি তো দিতে সক্ষম হয়েছি আমরা।
– তাহলে অপরটি?
খালেদ পারভেজ বিরক্ত হয়ে বললো,
– এজন্যই আমি দু পয়সার মেয়ে মানুষের ফান্দে পড়তে চাইনা। তোমার কথা মত মেমোরি কার্ড দিলাম।আমি কি জানতাম ওটা তোমার পাঠানো লোক নয়, ওই এমপি শাহাদের লোক। না তুমি চাইতা আর না আমি হারাতাম এত স্ট্রং একটা প্রমান। এমপির মান সম্মান ও ধূলায় মিশতো বোনের চরিত্র টান দিলে।
ক্যাপ্টেন আলতাফ বললো,
– আপনি বহুত শেয়ানা খালেদ সাহেব। মেয়েটারে স্পষ্ট বুঝা যাইতেছিলো ভিডিওতে অথচ আপনারে চেনাই যায়না।
প্রত্যেকে হাসছে।এর মাঝেই মনি তেড়ে জবাব দেয়,
– আমার ডিল লাগবেনা। আমি রিপোর্ট দিব না। এভাবে তো কাজ করা সম্ভব নয় ক্যাপ্টেন। আমাকে অপমান করা হচ্ছে রীতিমতো।
– আহ হা ডাক্তার মনিকা,এটা মাথা গরম করার সময় নয়। খালেদ সাহেব আপনি একটু সংযত হোন। বলুন ওটা বাদে আপনার আর কি লাগবে?
– এমপি শাহাদকে। বিনিময়ে তার বর্তমান স্ত্রীকে যা খুশি করতে পারেন। আমি জাস্ট শাহাদের লাইফে এন্ট্রি করতে চাই। ওই দিয়ার অস্তিত্ব যেন আমার জীবনে না পড়ে।
উপস্থিত প্রতিটা মানব প্রাণী হতভম্ব। নারী কত বড় ধ্বংস তারা সচক্ষে দেখতে পারছে। এক নারীর ঘর ভেঙে নিজের ঘর গড়বে ভাবছে।সবচেয়ে বড় গেমার তো এই নারী জাতি। এরা মাতৃ,স্ত্রী,ভগ্নী সর্বরূপে ধরা দেয়, ঠিক তেমনি সর্বনাশী হয়েও জীবনে আসে।এই মুহুর্তে মনিকে সকলে শাহাদের সাক্ষাৎ সর্বনাশ ভাবছে। কিসের শঠতা, বেঈমানী, প্রতারণা। এসব রিপুর সবচেয়ে বড় উদাহরণ তো এই মনি।কোলে পিঠে মানুষ করা শাহাদের ক্ষতি করতে এর বিবেকে কি বাঁধবে না! এই নারী, নারী জাতির কলঙ্কের ইতিহাস গড়বে।
___
অফিস থেকে হন্তদন্ত হয়ে বের হয়ে গেলো শাহাদ। পেছনে ছুটছে পাভেল,হামজা আর তুহিন। কিসের মিটিং কিসের আলোচনা। সব কিছু আজ পোস্টপনড। নিজের মেরুন রং গাড়িতে উঠে ড্রাইভিং সিটে বসে পড়লো।বাকি তিনজন জানে আজ গাড়ি না মিসাইল ছুটাবে। ঘটনা তাই ঘটলো। দশটা বাজে ঘড়িতে। আশপাশ তোয়াক্কা না করে গাড়ি ছুটছে নৌবাহিনীর সদর দপ্তরের উদ্দেশ্যে যা বনানীতে অবস্থিত। পাশে,পেছনে বসে বাকি তিনজন আল্লাহর নাম জপছে। যেভাবে ওভারটেক করছে গাড়ি না উলটে যায় গেটে এসে থামতেই তিনজন দম ছাঁড়লো। সামনে আসতেই একজন অফিসার আটকালো। প্রথমত মুখে সবার মাস্ক। রাস্তায় কেউ দেখলে মারাত্মক বিপদ ঘটতে পারে। প্রচন্ড ক্রোধে অফিসারের গায়ে হাত তুলতে যেয়েও নিজেকে সংযত করে কমান্ডার নওয়াজকে ফোন দিলো।
– আসসালামু আলাইকুম স্যার শাহাদ ইমরোজ স্পিকিং।
– ওয়ালাইকুমুস সালাম, কেমন আছো কিং অফ ওয়েভ?
– স্যার, আমি গেটে।
– ওয়েট ওয়েট আমি আসছি।
কমান্ডার নওয়াজ মোর্শেদ ছুটে এলো আরো কয়েকজন অফিসার নিয়ে। কেয়ারটেকার আঁৎকে উঠলো এভাবে কমান্ডারকে ছুটে আসতে দেখে। শাহাদকে স্যালুট করে বাকি অফিসারসহ ভেতরে নিয়ে আসলেন নওয়াজ। ওখানে শাহাদের জন্য অপেক্ষারত ছিলেন ভাইস এডমিরাল মানিক মোজাম্মেল। যা ইনফরমেশন দরকার সব নিয়ে বের হওয়ার সময় এডমিরাল মানিক বললেন,
– রাশেদকে করা প্রতিটি অপমানের জবাব চায় নেভি। যার দায়িত্ব রাশেদের প্রিয় মানুষ শাহাদের উপর বর্তেছে। আশা করি মঙ্গলের মুখ দেখতে পাব।
– আই আই স্যার।
স্যালুট করেই শাহাদ বেরিয়ে এলো গেট দিয়ে। গাড়িতে অপেক্ষা করছে বাকি তিনজন। শাহাদ গাড়ির স্টিয়ারিং এ হাত দিবে এমন সময় হামজার দিকে ফিরে বলে,
– হামজা আসার সময় সিজারকে দেখেছিলাম ডেস্কে কাজ করছিলো।ও এখানে কি করছে?
গাড়ির থাই গ্লাস না খুলেই সেদিকে সবাই তাকিয়ে দেখে সিজার রাস্তার অপর পাশে বাইক নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। হুট করে কেউ দেখলে চিনতেই পারবেনা তাকে। তার মানে কি ফলো করছিলো! পাভেল হেসে বলে,
– ওরে বাটপার,আমাদের খেয়ে আমাদের বাঁশ মারার জন্য কায়দা করো। বস আপনি সেদিন কন্ট্রাক্ট পেপার কেড়ে নেয়ার পর থেকে ওর হাবভাব বদলে গিয়েছে।
শাহাদ হেসে বলে,
– ও চোরের উপরে বাটপারি করতে আসছে। আমাকে এখনো চিনে নাই। মাছ ধরবি তোরা? রাঘব বোয়াল!
তিনজনই কেবলাকান্তের মতো মুখ করে তাকিয়ে আছে।শাহাদ সেসবের তোয়াক্কা না করে গাড়ি ছুটালো।তুহিন ফিসফিস করে হামজাকে বলে,
– বসের মাথা গেছে, আইলো নেভি অফিছে, যাইবো অপরাধীরে ধরতে অহন কইতাছে মাছ ধরবো। পাগল টাগল হই গেছে নি বস!
হামজা মাথায় জোরে গাট্টা মেরে বললো,
– চুপ থাক,গাল সেলাই করে দিবে শুনলে।
গাড়ি থামলো ৩০০ ফিট নীলা মার্কেট এসে। আজব এখন কেউ হাঁসের গোস্ত খাবে নাকি। গাড়ি থেকে নেমে সখিনা খালাকে ডাক দিলো। এগিয়ে এসে সালাম দিয়ে বললো,
– বাপজান বহুত বছর পর আইছেন। ভালা আছেন?
– জ্বি খালা ভালো। আপনার স্পেশাল হাসের মাংস আর চাপড়ি দেন।
আশপাশে মানুষ কম। কয়েকজন দেখে এগিয়ে আসলো। শাহাদ মিষ্টি হেসে সালাম বিনিময় করলো,অনেকে সেলফি তুলতে চাইলো। অবুঝের মত ওরা তিনজন খাবার আসার পর খাচ্ছে। যেন কেউ জোর করে বসিয়ে দিয়েছে খেতে। শাহাদ খুশি মনে খাচ্ছে। এভাবে খেতে আজ অবধি ওকে কেউ দেখেনি। খাবারের ব্যাপারে সন্দিহান নয়,বরং এমন খোলামেলা জায়গায় ভবঘুরের মত আচরণ ওদের বেশ ভাবাচ্ছে। খেয়ে হাত ধুয়ে সখিনা খালার দিকে টাকা বাড়িয়ে দিতেই খালা প্রশ্ন করলো,
– বাপজান আপনের লগে আরেকটা বাপজান আইতোনা উনি কই?
শাহাদ সখিনা খালার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললো,
– আপনার ওই বাপজান তিনবছর আগে মা*রা গেছে।
এতক্ষনে বাকিরা বুঝলো শাহাদ রাশেদকে নিয়ে এই জায়গায় আসতো। সখিনা খালা আঁৎকে উঠলেন। উনার দুচোখ বেয়ে পানি পড়ছে। শেষ বার সখিনা খালাকে বলেছিলো কক্সবাজার নিয়ে যাবে দুইবন্ধু সাগর দেখাতে।সেই যে গেলো কেউ আর এলো না। পুরোনো নেতিয়ে যাওয়া আঁচলে চোখ মুছে কাঁপা গলায় সখিনা খালা বলে উঠলো,
– এমন খবরডা না হুনলেই ভালা হইতো।কলিজাটা হু হু করতাছে। আমি ওই বাপজানরে কোনো দিন ও ভুলুম না। কি সুন্দর আইয়াই কইতো, ও খালা আপনার গরম গরম চাপড়ি দেন। আজ আর বাসায় ভাত খামুনা,আপনি ভাত রানলে দুইটা দিয়েন একেবারে খাইয়া যামু।এক্কেরে মাটির মানুষ আছিলো।
শাহাদ নিজেকে সামলে বলে উঠলো,
– মন খারাপ কইরেন না। যার হায়াত যতটুকু সে ততদিন বাঁচবে। আমি তো আছি,আমি আসবো….
থমকে গেলো শাহাদ। আচ্ছা জোর গলায় তো বললো প্রকৃতপক্ষে ও কয়দিন বাঁচবে? অন্তরাত্মা কেঁপে উঠলো। নিজেরই তো সময় ঘনিয়ে এসেছে। সখিনা খালা থেকে বিদায় নিয়ে পাশে সামুদ্রিক মাছের ফ্রাই হচ্ছে সেই দোকানে গিয়ে বসলো। ঘাড় কাঁত করে মুচকি হেসে পাশের টেবিলে গিয়ে চেয়ারে বসা আগন্তুকের কাঁধে হাত দিয়ে বললো,
– আমার সাথে এলেই তো পারতি। আর এসব কি ছাঁই পাশ খাচ্ছিস! এ্যাই কুদ্দুস এই টেবিলে একটা রাঘব বোয়াল বারবি কিউ দে।
সিজার থতমত খেয়ে মুখ থেকে মাস্ক খুলে শাহাদের দিকে তাকিয়ে শুকনো ঢোক গিলে। হামজা,পাভেল আর তুহিন টেবিলের চারপাশে চেয়ার নিয়ে সিজারকে ঘিরে বসে। কি সুকৌশলে ধরে ফেললো সিজারকে। নীলা মার্কেট আসার প্ল্যান তাহলে সিজারকে ধরার জন্যই করা। কুদ্দুস টেবিলে এক বিশাল বোয়ালের বারবিকিউ এনে দিলো। শাহাদ রুমালী রুটি ছিড়ে বোয়াল মাছ দিয়ে সিজারের মুখের সামনে ধরে বললো,
– হা কর, বেশি করে খা। সামনে মোটেও তোর বস শাহাদ ইমরোজ বসা নেই। গুন্ডা শাহাদ বসে আছে। আর যদি খেতে না পারিস, বলতে পারিস। সেই ব্যবস্থাও আছে। হা কর।
সিজার শাহাদের রক্তিম চোখের দিকে তাকিয়ে ভয়ে দু অধর আলগা করে হা করলো।শাহাদ মুখের মধ্যে রুটি পুরে দিয়ে বললো,
– আশপাশে তোর চামচা যদি থাকে সবাইকে আমার দেয়া এড্রেসে যেতে বল। নাহলে তোর রেহাই নেই।
আরেক টুকরো রুটি মুখে পুরিয়ে দিয়ে বলে,
– গত মাসে জনি, রিপন আর প্রতাপরে তো খুঁজে ও পেলাম না আমরা তাই না সিজার?
সিজার মাথা নাড়ে ভয়ে। বুঝায় হ্যাঁ পাইনি। শাহাদ কুটিল হেসে বলে,
– পাবি কি করে,আমার মতো গুন্ডার পিছু ধরতে ওদের মজুমদার বাড়ি পাঠালি অথচ এই খবর রাখলি না যে মজুমদারদের রাবার বাগানে এমপি শাহাদ ইমরোজ তার দুহাত র*ক্তে রাঙিয়ে সেখানেই পুঁতে দিয়েছে তিনটাকে। ভেবেছিস শাহাদ বোকা তাই না! যুদ্ধ করা হাত। দেশ বাঁচাতে কত যে শেয়াল-কুকুর মে/রে/ছি। আর তোদের মত দু একটা তো আমার কাছে মশা-মাছি।
সিজারের দম যায়। গলায় খাবার আটকেছে। বিষম খেলো চরম ভাবে। হামজা পানি এগিয়ে দিয়ে শয়তানি হাসি দিয়ে বলে,
– জানিস ওরা মরতে মরতে বলেছে সিজারের কাছে দৌলতদিয়া প/তি/তা/ল/য়ের ভি আই পি কাস্টমার খালেদ পারভেজের ব্যবসার পার্টনার মেহেরজান আম্মার হদিস আছে। ফটাফট দিয়ে দেয়।
শাহাদ সোজা দাঁড়িয়ে বলে,
– কুদ্দুস পার্সেল কর। পাভেল আমি সিজারের বাইক নিয়ে ঢাকা যাচ্ছি। বাকি কাজ সেরে নে।
– ওকে বস।
মাথাটা ঝুঁকিয়ে সিজারের কানের কাছে এসে বললো,
– আমার ঘাড়ের একটা রগ ত্যাড়া। তুই যে আমার মা*ল লুটতেছিস এই খবর আমি মাস তিনেক আগেই পেয়েছি। ছাড় দিয়েছিলাম,ছেড়ে দি নি। যদি আবার দেখা হয় বুঝবি বেঁচে গিয়েছিস,নতুবা আজই শেষ দেখা।
মুখে মাস্ক লাগিয়ে সিজারের বাইকে চেপে রওয়ানা দিলো ঢাকার উদ্দেশ্যে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে একটা দশ। দুটোর মধ্যে পৌঁছানো জরুরি। কথা দিয়েছে শাহীনকে। একটা পঞ্চান্নতে বাসার গেটে এসে পৌঁছায়। গেটকিপার হকচকিয়ে যায় এই প্রথম স্যারকে বাইকে দেখে। বাইক নিয়ে সোজা গ্যারেজে পার্ক করে হামজাকে সময় মত বাইক নিয়ে যাবার নির্দেশ দিতে দিতে বাসার দরজায় ঢুকে দেখলো সকলে বসে আছে। বাবার দিকে তাকিয়ে বললো,
– আব্বু,আই উইল টেক অনলি টেন মিনিটস।
কামরা খালি। শেহজা হয়তো বাইরে চাচ্চুদের কাছে। তার গিন্নি কাজে ব্যস্ত বাসায় নতুন অতিথি এসেছে সেজন্য। একদম ক্লিন সেভ করা মুখ, কালো একটা শার্ট হাতা গুটিয়ে রেখেছে, পরনে ডেনিম প্যান্ট লিভিং রুমে আসতেই নওরিন সালাম দিয়ে দাঁড়িয়ে গেলো, শাহীন ও সালাম দিলো। হাতের ইশারায় বসতে বললো। নওরীন এই প্রথম সরাসরি এভাবে দেখছে হবু ভাসুরকে। অদ্ভুত চোখতো।সারাক্ষন চোখে পাওয়ার চশমা অথবা রোদচশমা দেখে অভ্যস্ত।আজ দেখে ভারী চমকালো।এমন ছাই রঙা চোখ এদের বংশে আছে নাকি। মনে হয় যেন লেন্স লাগিয়েছে।ইংরেজিতে এই চোখকে হ্যাজেল আই বলে। খুব কম শতাংশ মানুষের এমন হয়। বডি স্ট্রাকচারে শাহীনকে মাঝে মাঝে তার দা’নব মনে হত। শাহাদকে দেখে তো আরো ভয় লাগছে। এরা কোনো ভাই ই একেবারে ছ ফিট লম্বা এমন নয়।শাহীন বলেছিলো ও উচ্চতায় পাঁচ নয় আর ভাইজান পাঁচ এগারো। ভাইজানকে দেখে রীতিমতো ভয় পেয়ে গিয়েছে নওরীন। ভাবীমাকে এখনো দেখেনি। নওরীন আসার পর শিফা আর সুলতানা কবির গল্প করে যাচ্ছে। শেহজা নওরীনের কোলে। মেয়েটা পুরোই বাবার আদল,বিশেষ ভাবে ওর চোখ জোড়া তো বাবার কপি। শাহীন নওরীনের চোখে মুখে আতঙ্ক দেখে পাশ ঘেঁষে বসলো।ফিসফিস করে বললো,
– কি হয়েছে?
– আমার ভাইজানকে ভয় লাগছে।
শাহীন চমকে গেলো।ওমা ভয় লাগার কি আছে। একটুখানি আশ্বাস দিয়ে বললো,
– ভয় কেনো লাগছে?
– টিভিতে যেমন, ভাইজান বাস্তবে তার চেয়ে ও ভয়ানক দেখতে।
– কিহ?
– আমার কাছে ভাইজানকে কেমন যেন ম্যাজিশিয়ান বা অদ্ভুত কিছু লাগছে। শ্যাম বর্নের মানুষের হ্যাজেল আই আমি এর আগে কখনো দেখিনি শাহীন।ভাইজান কি আমাকে ধমকাবে সবার সামনে।
শাহীন তাজ্জব বনে গেলো। ভালো করে শাহাদের দিকে তাকিয়ে ওর হাসি পেলো। ভাই সত্যি সুঠাম দেহের অধিকারী। শাহাদের শ্যামবর্ণ শরীরে চোখ গুলো সবচেয়ে বেশি আকর্ষণীয় যার কারণে ওকে দেখতেই অন্য কিছু ভেবে ভয় পাবে অনেকেই। শাহীনের মনে হলো ভাইজানকে আজকে জ্বিন জ্বিন লাগছে এরমধ্যে পরেছে কালো। চশমাটা পরলে নাহয় কম বুঝা যেত। বলতেও পারছেনা ভাইজান চশমাটা পরেন। হাসি আটকে শাহীন কানের কাছে এসে বলে,
– ভাবীমাকে দেখলে ঠিক হয়ে যাবে। কারণ আমার ভাই যদি অদ্ভুত সুদর্শন হয়, উনি অদ্ভুত সুদর্শনা। এরা মানিকজোড়।
বাবার সাথে কথা শেষ করে,আচমকা ভারিক্কি গলায় শাহাদ বললো,
– নওরীন কি করছো এখন?
নওরিন ঘাবড়ে গিয়ে আমতা আমতা করে বলে,
– বাবুকে নিয়ে… বসে আছি।
শাহাদ ভ্রু কুঁচকে বলে,
– আচ্ছা,গুড। আমি জিজ্ঞেস করেছি পড়াশোনা তো শেষ, শুনেছি জব করো। কোথায় করছো?
– এহ.. না মানে অফিসে।
শাহীন নিজেই এবার বিব্রত হয়ে গেলো। নওরীনের হয়ে উত্তর দিলো,
– ভাইজান একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে আছে।
– উত্তরটা তুমি দিচ্ছো কেনো? ওর কি সমস্যা?
নওরীন শাহীনের দিকে তাকিয়ে শুকনো ঢোক গিললো। শাহাদ চোখে চশমা দিলো। শাহাদের মাথায় ধরছেনা এই মেয়ে কি বলছে এসব। যতদূর খবর নিয়েছে মেয়ে ভালো।এমন আবোলতাবোল বকছে কেনো? শাহাদের কুঞ্চিত ভ্রু দেখে নওরীনের মনে হলো এই মুহুর্তে ওকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিবে। চোখে চশমা দেখে মনে হলো যাক এখন মনে হয় স্বাভাবিক লাগছে কিছুটা। তাই সাহস নিয়ে বললো,
– ভাইজান আমি আপনাকে দেখে ঘাবড়ে গিয়েছি।
শাহাদ চমকে গেলো।এটা কেমন উত্তর।ওকে দেখে ঘাবড়ানোর কি আছে। ভাঁজ পড়া কপাল নিয়ে প্রশ্ন করলো,
– ঘাবড়ানোর কি আছে? ক্যাজুয়াল প্রশ্ন করেছি তোমাকে। ইন্টারভিউয়ের ভাইভা নিতে তো বসিনি। আত্নবিশ্বাসহীন আমার পছন্দ নয়।
– না মানে আপনি দেখতে তো শাহীনের মতো না।
শাহাদের অবাক হওয়া চাহনিতে মনে হলো নওরীন আজই শেষ। শাহীনের মত না মানে। শাহাদ রাগত চোখে শাহীনের দিকে তাকালো। বাকিরাও বিস্মিত। শাহাদ কিছু বলার আগেই দিয়া সরবতের ট্রে নিয়ে ঢুকতে ঢুকতে সালাম দিলো।
নওরীনের কানের কাছে ফিসফিস করে বললো,
– ছোট ভাইয়ার মতো না একদম ঠিক, তবে উনি উনার মতো।আপু আপনি যেমন প্রথম দেখাতে ভয় পেয়েছেন,আমিও তেমনি ভয় পেয়েছিলাম। মানুষটা মাত্রাতিরিক্ত সুদর্শন। এজন্যই অনেকে ঘাবড়ে যায়। ভয় পাবেন না। উনি মানুষই, জ্বিন বা ভূত নয়।
দিয়া হাসি দিলো। নওরীনের এই ব্যাপারটা বড্ড ভালো লাগলো।কি সুন্দর বুঝিয়ে দিলো।দিয়ার দিকে তাকাতে দেখে এই মেয়ে তো পুরা ইরানী। সুতি আকাশী রঙা জামিদানীতে পুরো অপ্সরী লাগছে।শাহাদ ইমরোজের যোগ্য সহধর্মিণী। এই বাড়ির প্রতিটি মানুষ খুব সুন্দর। শাহাদকে যদি জ্বিন বলে এই মেয়ে সাক্ষাৎ পরী। খাবারের ডিশ টেবিলে রেখে দিয়া শেহজাকে কোলো নিলো। শাহাদ তখনো শাহীনকে গিলছে চোখ দিয়ে। শাহীন অসহায়ের মত বসে আছে। নওরীন সাহস করে এবার মুখ খুললো,
– ভাইজান আমি একটা কর্পোরেট কোম্পানিতে আছি। আর পড়াশোনা শেষ করেছি তবে এখন থিসিস করছি পাশাপাশি।
এতক্ষণে ঠিকঠাক উত্তর দিলো। এরপর বেশ কিছুক্ষন আলোচনার পর শাহাদ জানালো খুব শীঘ্রই নওরীনকে বাড়ির বউ করতে চায়।নওরীনকে প্রথম প্রশ্ন করলো বিয়ে নিয়ে,
– নওরীন তোমার বড় ভাইয়ের দায়িত্বটা যদি আমি পালন করি আপত্তি থাকবে?
নওরীন এক রাশ চমকানো অভিব্যক্তি নিয়ে তাকালো। চোখে মুখে খুশি নিয়ে বললো,
– না ভাইজান।
– তুমি খুশি?
– জ্বি ভাইজান।
শাহাদ মাথা নেড়ে বললো,
– গুড। তবে দেরি কেন আর। ছুটি নাও দশদিনের জন্য অফিস থেকে। তিনদিন বিয়ে। বাকি সাতদিন ট্যুর। আমার পক্ষে থেকে গিফট থাকবে বোনের জন্য।
শাহীন হাসি দিয়ে কানের কাছে বলে,
– নিরা বলেছিলাম, এটাই আমার ভাইজান।
বড়রা সব নিয়ে আলোচনা করছে। এর মাঝে শাহীনকে বললো,
– আগামী শুক্রবার বিয়ের ডেট রাখো।ডেস্টিনেশন ম্যারেজের ব্যবস্থা করবো গাজীপুর রিসোর্টে। শপিং শুরু করে দাও। কি লাগবে জানিও। বিয়ে তো একবারই জীবনে। ওর পছন্দে সব নাও। আব্বু আপনি বাকি ফরমালিটিস করে নেন।
সকলেই সম্মতি জানালো। আরো একটা উৎসব হতে যাচ্ছে রায়হান সাহেবের পরিবারে।হৈ হৈ রব।
…
সুলতানা কবির সকলকে টেবিলে খেতে ডাকলো।শাহাদ মাথা নেড়ে বললো,
– খেতে চলো সবাই।
খাবার টেবিলে বসেই মেয়েকে কোলে নিলো। শেহজাকে একটু করে খাওয়াচ্ছে নিজেও খাচ্ছে। আফিয়া খালাকে ডেকে বললো,
– খাবার দিয়েছো অপরাধীকে?
সেদিনের পর থেকে শাহাদ আর নাম ধরে ডাকেনা শেফালীর। যেন মন থেকে মুছে ফেলতে চাইছে বোনটাকে। আফিয়া খালা মাথা নেড়ে বুঝালো দিয়েছে। গরুর কলিজা ভুনা করেছে সুলতানা কবির। শাহাদ কোলেস্টেরলের জন্য এড়িয়ে চলে। হঠাৎ লক্ষ্য করলো দিয়া কলিজা ভুনা দিয়েই খাচ্ছে। তার প্লেটে বেশি খাবার নেই। কলিজা ভুনা,টমেটো চাটনি, আর একটা শামি কাবাব। নিজের প্লেটের দিকে তাকিয়ে দেখে ক্যাশিউ নাট সালাদ, তিতা করলা এবং চিকেন।
দিয়াকে সকলের সামনে প্রশ্ন করলো,
– তুমি কলিজা ভুনা পছন্দ করো?
দিয়া এহেন প্রশ্নে খাওয়া থামিয়ে মাথা নেড়ে উত্তর দেয়,
– অনেক। আম্মিজানের পরে দাদীজানের হাতের রান্না টা করতাম এখন আম্মুর হাতেরটা।
শাহাদ মৃদু হেসে বলে,
– চিংড়ি ও পছন্দ করো?
দিয়া হতবাক হয়ে বলে,
– হ্যাঁ অনেক। কিন্তু কেনো?
– কিছুনা, শেহজাকে চিকেন খাওয়াতে চাইলাম সে বার বার নাকোচ করছে। আঙুল দিয়ে তোমার প্লেটের টা দেখাচ্ছে। চিংড়ি এবং কলিজা মুখেই দিতেই খাওয়া শুরু করলো। পুরো তোমার কপি।
দিয়া মাথা নেড়ে বলে,
– আমার কপি না তো।আমি শিখিয়েছি খাওয়া তবে আপনার কপি প্রমান দেখবেন?
শাহীন, শিফা উৎসাহ নিয়ে বললো,
– দেখবো দেখবো।
দিয়া বলে উঠলো,
– এখন যা দেখাবো তা ও জেনেটিকেলি ওর বাবা থেকে পেয়েছে।
টেবিলের সবচেয়ে অদ্ভুত খাবার টা শাহাদের প্লেট থেকে তুলে শেহজার মুখে দিলো। যা শাহাদের জন্য করা। তিতা করলা ভাজি। শাহাদের পছন্দের একটা আইটেম। এই মানুষটা বড্ড অদ্ভুত ফ্রাইড রাইস দিয়ে তিতা করলা ভাজি খায়। শেহজার মুখে দিলো শেহজা অত্যন্ত স্বাভাবিক ভাবে খেলো। এরপর দিয়া মুখের সামনে থেকে তিতা করলা সরিয়ে চিংড়ি ধরলো।মেয়েটা রেগে গিয়ে থাবা মারলো মায়ের দিকে।চিৎকার দিয়ে উঠলো। দিয়া পুনরায় তিতা করলা মুখে দিতেই আবার খাচ্ছে। দিয়া হেসে বলে,
– এখন এই করলাই খাবে।আর কিচ্ছু ধরবেনা,না কলিজা না চিংড়ি।
শাহাদ সহ পুরো পরিবার বিস্মিত। সুলতানা কবির বিস্মিত হয়ে বলে,
– বৌমা এই জিনিস আগে দেখিনি কেনো।
দিয়া হাসিমুখে বলে,
– আম্মু ও আটমাস থেকেই পছন্দ করে তিতা করলা। একদিন টেবিলে ছিলো এই ভাজি আইটেম।না বুঝে বার বার খেতে চাইছিলো দেখে ভাবলাম জিহবায় লাগিয়ে দি হয়তো তিতা বুঝে আর খাবেনা।কিন্তু এই মেয়ে ওই জিনিসই খেলো।পরে ভাত দিয়ে মাখিয়ে খাওয়ালাম।এরপর থেকে খাওয়াতে আসলেই এই খাবার খুঁজে।এভাবে কয়েকদিন খাওয়ানোর পর বুঝলাম র*ক্তের টান।
মেয়েকে বুকের সাথে চেপে ধরলো। শাহাদ নির্বাক হয়ে বাবার দিকে তাকালো। এ যেনো বাবাদের নিরব অপ্রকাশিত কষ্ট। দুই বাবাই আতঙ্কে আছে। এক বাবা সন্তানে অভ্যস্ত,অন্য সন্তান বাবাতে অভ্যস্ত। রায়হান সাহেব চোখের পানি মুছছেন সকলের আঁড়ালে। গমগমে গলায় শাহাদ বললো,
– ঠিক করোনি ফারাহ।এতটা অভ্যস্ত করোনা মেয়েকে তার বাবার অভ্যাসে। সামলাতে পারবেনা পরে। অলরেডি শেহজা বুঝে গিয়েছে ওর বাবাই ওর সব।ইদানীং আমি লক্ষ্য করছি ও তোমার কাছে কম থাকছে। ওকে তোমাতে অভস্ত্য করো। যদি তাতে এমনো করতে হয় মেয়ের ভালোর জন্য, তবে দূরে রাখো আমার থেকে।
চলবে…