#সায়রে_গর্জন
#নীতি_জাহিদ
২২.
( অনুমতি ব্যতীত কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ)
– এতদিন কথাটি কিভাবে লুকিয়ে রেখেছিলেন? আমাদের প্রথম দেখা মজুমদার বাড়ি নয় সেদিন না বললে জানতেই পারতাম না।
দিয়ার অনুরোধে বারান্দায় বসেছে দুজন। মেয়েটা সন্ধ্যায় অনেক করে বললো আজ নাকি অনেক কথা বলতে ইচ্ছে করছে। প্রয়োজনীয় কাজ সেরে দু কাপ কফি হাতে ভরা চন্দ্রবিলাসে বসেছে কপোত-কপোতী। সহসা এমন প্রশ্নে শাহাদ বিচলিত না হয়ে বরং খানিকটা হাসলো। ঘাড় কাত করেই বললো,
– মজুমদার বাড়িতে তৃতীয়বার দেখা আমাদের। প্রথম দেখেছিলাম ” সান ডান্সার” রেস্টুরেন্টে। সেদিনই প্রথমবার সামরার সাথে দেখা করিয়ে দিয়েছিলো রাশেদ। সামরা সেজে এসেছিলো। একটা কড়া পারফিউম লাগিয়েছিলো।অথচ আমাকে সেই পারফিউম আকৃষ্ট করতে পারেনি।আকৃষ্ট করেছিলো তোমার রজনীগন্ধা।কেমন মুগ্ধের মত তোমার দিকে চেয়েছিলাম।একটা কালচে লাল রঙা আনারকলি পরেছিলে,গলায় ঝুলিয়েছিলে সাদা ওড়না। কালচে বাদামী চুল গুলো ঘাড় বেয়ে পিঠ ছুঁয়ে ছিলো। তখন তুমি সপ্তদশী। এক দেখাতেই এভাবে কোনো মেয়ের দিকে চোখ যাবে ভাবিনি। রাশেদ ভেবেছিলো এটা কোনো আশ্চর্য। আমি কোনো মেয়ের দিকে এভাবে তাকাতে পারি কল্পনাতীত ছিলো রাশেদের কাছে। পরে রাশেদকে বুঝালাম সামরাকে পছন্দ হয়েছে।কিন্তু বিধি বাম।সামরার সাথে ফোনে কথা হয়েছিলো দুদিন।মেয়েটা ভদ্র,ভালো, আমার মন মত কিন্তু তবুও যেন আমি ওর মাঝে তোমাকে খুঁজে বেড়িয়েছি। ভুলার চেষ্টা করলাম তোমাকে। তাতেও স্রষ্টার পরিকল্পনা।দুদিন পর এক বিকেলে কাজ শেষ করে সৈকতে বসতে মন চাইলো।যেহেতু নেভির লে.কমান্ডার সেই সুবাদে আমার সাথে সর্বদা ফোর্স থাকবে স্বাভাবিক। কিন্তু বীচে তুমি আমাকে এত দেহরক্ষী সমেত দেখে যে মন্তব্য করলে, ঘাড় ঘুরিয়ে দেখেছিলাম কার এত বড় স্পর্ধা! দেখতে পেলাম তেজস্বিনীকে। কি অদ্ভুত মন্তব্য ছুঁড়লে,
– ” কোথাকার কোন লাট সাহেব এসেছে দাদাসাহেব দেখেছেন, এই লোকের জন্য এতজন বডিগার্ড লাগে। এভাবে আমাদের সুন্দর সময়টা নষ্ট করছে।অর্ধেক সৈকত তো এরাই দখল করেছে।”
রাশেদ তোমাকে দেখে হেসে বলেছিলো,
– ইয়া আল্লাহ এট্টুক মেয়ের মুখে কি বুলি।
তোমার মনে পড়ে রাশেদের কথা। দিয়ার মুখে হাত। মনে পড়ে গেলো বছর পাঁচেক আগের কথা। কক্সবাজার ঘুরতে এসেছে দাদাসাহেব আর দাদীজানের সাথে।দাদা সাহেবের অনেক শখ ছিলো হজ্জ্ব করার আগে দাদীজান আর মেহতাব বিবিকে নিয়ে কক্সবাজার ঘুরবে।যেই ভাবা সেই কাজ। উড়াল দিলো কক্সবাজারের উদ্দেশ্যে। নিজের যৌবন কালে বহুবার এসেছে এই কক্সবাজার। সংসারের চাপে দাদীজানকে আনা হয়নি কখনো। দিয়ার প্রায় মন খারাপ থাকে। বাবা মা যাওয়ার পর নিঃসঙ্গ মেয়েটাকে দাদা-দাদী সবসময় সঙ্গ দিয়েছেন। কক্স-বাজার যাবে শুনে মন ভালো হয়েছে। হামিদ মজুমদার নাতনী এবং সহধর্মিণীকে নিয়ে রওয়ানা হয়ে গ্রীন লাইন বাসে। ইরান থেকে আসার পর কখনো এমন লং জার্নি করা হয়নি। নাম শুনেছে, বই খাতায় পড়েছে কিন্তু কক্সবাজার যাওয়া হয়নি কখনো৷ কক্সবাজার পৌঁছে হোটেল নিসর্গতে উঠে। মেরিন ড্রাইভ রোডের বিখ্যাত হোটেল। চারদিকে নিরিবিলি পরিবেশ।সামনে বিশাল উত্তাল ঢেউয়ের সমুদ্র।রুফটফে সুইমিং পুল। রুমের বারান্দায় দাঁড়ালে মনে হয় এই তো প্রকৃতি ছোঁয়া যাবে। ডাবল বেড রুমের একটা স্যুট বুক করেছিলো হামিদ মজুমদার। কিছুক্ষন রেস্ট নিয়ে দুপুরের খাবার খেতে গেলেন পাশের রেস্টুরেন্টে। ভেতরে কোনো ভি আই পি সেনা কর্মকর্তা আছেন দাদা সাহেব আন্দাজ করেছিলেন।বাইরে ফোর্সের গাড়ি,অফিসাররা দাঁড়িয়ে আছে। এসব দেখে বলেছিলেন,
– আশে পাশে তো আর খাবার হোটেল নাই,এখানেও তো দেখি নেভির গাড়ি। ভেতরে কেউ আছে মনে হয়।
দিয়া ভ্রু কুঁচকে বললো,
– আমরা কি উনাদের পাতের খাবার খাব দাদাসাহেব। আপনি তো টাকা দিবেন তাই না?
হামিদ মজুমদার নাতনীর কথায় হেসে দিলেন। দিয়ার পরিবেশ পছন্দ হয়েছে তাই হামিদ মজুমদার আর না করেন নি। ভেতরে ঢুকেই এক পাশে একটা টেবিলে বসলো। দেখতে পেলো আরো কয়েক টেবিল সামনে তিনজন বসে আছে। একজন নারী,দুজন পুরুষ। চুলের কাট,বেশভূষা দেখে মনে হচ্ছে এরাই সেই ভি আই পি। ভেতরে রোদ নেই তবুও চোখে রোদ চশমা। তাদের আবার ঘিরে ধরেছে রেস্টুরেন্টের ম্যানেজার থেকে শুরু করে স্টাফ প্রত্যেকে। দিয়া হামিদ মজুমদারকে বলে খাবার অর্ডার করতে গেলো।বুঝতে পারলো এত ভিড়ে কেউ এদিকে আসবেনা বা আসলেও দেরি হবে। অর্ডার দিয়ে আসার সময় ভাবলো এই জাদরেল লোকগুলোকে দেখবে।বিধিবাম দেখার সুযোগই হলো না। চেহারা বুঝা যাচ্ছেনা। পিঠ বুঝা যাচ্ছে।সামনে শাড়ি পরিহিত টিপটপ সুন্দরী রমনীকেই শুধু দেখা যাচ্ছে। খুবই সুন্দর, সুশীলা দেখতে।বয়স হয়তো তিরিশের আশপাশ। বুঝতে পারলো হয়তো গুরুত্বপূর্ণ কেউ।
খাবার খেয়ে মজুমদার পরিবার আশপাশটা ঘুরে দেখলো। এভাবে সুন্দর দিনগুলো কা/টা/তেই তৃতীয় বিরক্তিকর একটি দিনের সাক্ষাৎ হলো। এখানে যেদিকে যায় সেদিকেই কি এই অফিসার গুলো ঘুরঘুর করে। এদের জন্য সমুদ্রের একপাশ বুকিং দেয়া থাকে নাকি! ঘাড় কাঁত করে দেখে আজকেও একদল।অনেকটা বিরক্ত হয়ে দাদাসাহেবকে ওই মন্তব্য ছুঁড়লেন। ব্যাপারটা এত উচ্চ স্বরে হবে বুঝতে পারেনি।তাদের মধ্যে একজন এগিয়ে আসলো দিয়াদের দিকে। হামিদ মজুমদারকে সালাম দিয়ে পাশে বসার অনুমতি চাইলেন।
– আংকেল আমি রাশেদ। বাংলাদেশ নেভিতে আছি লে. কমান্ডার হিসেবে। সময় আর সুযোগ হয়না তাই এদিকে আসতে পারিনা। আজ এলাম। ম্যাডাম কি প্রথম বাংলাদেশে এসেছেন ঘুরতে? আপনি মনে হয় বিরক্ত। আমরা ফরেনারদের জন্য বেস্ট সার্ভিস দিয়ে থাকি। কোনো সমস্যা হলে বলতে পারেন।
দিয়া ভ্রু কুঁচকে ভাবছে, এত দামড়া ব্যাটা ওকে ম্যাডাম সম্বোধন করছে। শুনতে কেমন দেখায়। আর ফরেনার কে! বিরক্ত নিয়ে বললো,
– এ্যাই যে মিস্টার কে ফরেনার? আমি বাঙালী।
রাশেদ হম্বিতম্বি খেলো।প্রচন্ড অবাক হয়ে হা সদৃশ মুখ করলো। মুখ দিয়ে কথা বের করলো। দিয়া পুনরায় বললো,
– আমি ইরানীদের মত দেখতে অথচ কিভাবে বাংলা বলি, আরো কত প্রশ্ন মনে জাগছে তাই না?
রাশেদ মাথা নাঁড়ায়। দিয়া বিরক্তিতে বলে,
– আমার মা ইরানী বাবা বাংলাদেশী। জন্ম ইরানে। সেই সুবাধে আমি বোথ সিটিজেন কিন্তু ফরেনার নই। ক্লিয়ার?
– জ্বি ম্যাডাম বুঝতে পেরেছি। ধন্যবাদ এত সুন্দর করে বলার জন্য।
ঠোঁট ভেঙচি কেটে দিয়া অন্যদিকে ফিরলো।রাশেদ মুচকি হেসে বললো,
– ম্যাডাম স্যরি আসলে হয়েছে কি আজ আমার বন্ধুর মন খারাপ তাই আমরা একটু ঘুরতে এলাম।আপনার সমস্যা হলে চলে যাব।
দিয়া তেঁ তেঁ উঠে বললো,
– ম্যাডাম ম্যাডাম করছেন কেনো? সমুদ্র কি আমার বাবার! আপনার ইচ্ছে হলে থাকবেন নতুবা চলে যাবেন। আমাকে কেনো জিজ্ঞেস করছেন।আমি কি এত বডিগার্ড নিয়ে দখল করে বসেছি?
রাশেদ হামিদ মজুমদারের দিকে তাকাতেই উনি লজ্জ্বা পেলেন। ঠান্ডা ধমক দিলেন দিয়াকে,
– মেহতাব বিবি এমন করেনা। উনাদের তো নিরাপত্তার ব্যাপার আছে তাই ফোর্স আছে।
রাশেদের দিকে ফিরে বললেন,
– অফিসার আসলে ও ওদিকটাতে যেতে চেয়েছিলো।আপনাদের পাহারার জন্য পারেনি তাই রেগে আছে।
– সমস্যা নেই আমরা এখনি উঠে যাচ্ছি।সময় হয়েছে আমাদের ও। ভালো থাকবেন।
দিয়ার দিকে ফিরে হেসে চলে গেলো।
কিছুক্ষন পর ফিরে এসে দিয়াকে বললো,
– ম্যাডাম একটু কথা ছিলো এদিকে আসবেন।
হামিদ মজুমদারকে বলে দিয়া একপাশে এলো। রাশেদ কেমন আনবান করছে।কিছু একটা বলতে চাইছে কিন্তু পারছেনা। অবশেষে বললো,
– আপনি কি আমার বন্ধুর সাথে কথা বলবেন? ও কথা বলতে চেয়েছে।
– কে বন্ধু?
– ওই যে।
রাশেদ আঙ্গুল দিয়ে দেখালো। দিয়া দূর থেকে দেখতে পাচ্ছে কেউ একজন বসে আছে জাদরেলি ভাব নিয়ে। কেনো কথা বলতে চাইছে! বকা দিবে কি! এত কথা শুনালো ওই সময় তার জন্য। দিয়ার মাঝে ভয়ের উদ্রেক হলো। দিয়া দু পাশে মাথা নেড়ে বললো,
– না, আমি দাদা সাহেবের কাছে যাব।
হনহন করে সামনে দিয়ে হেঁটে চলে গেলো। রাশেদের মুখ লটকে গেলো। দেখতে পাচ্ছে দিয়া পরিবার সমেত সৈকত ত্যাগ করছে। দূর থেকে শাহাদ চেয়ে আছে।
– ফারাহ…
ধ্যান ভাঙলো দিয়ার। শাহাদের চমকে যাওয়া চাহনি দেখে বললো,
– সেদিন আপনারা ছিলেন? আমি রাশেদ ভাইয়াকে চিনতে পারিনি। আপনাকে তো দেখিইনি সামনে থেকে।
শাহাদ অন্তরীক্ষে তাকিয়ে বললো,
– আমার ডাকে সেদিন কাছে আসলে বুঝতে ঘটনা কি?
– কেনো ডেকেছিলেন?
শাহাদ মুচকি হেসে উঠে দাঁড়ায়।
– মাথা ধরছে ফারাহ। ঘুমাবো একটু।সকালে মিটিং আছে।
– আমি উত্তর পেলাম না।
– সরাসরি প্রপোজ করতে। বৃহৎ বঙ্গোপসাগরকে সাক্ষী রেখে নেভির এই কমান্ডার শাহাদ ইমরোজ সেদিন রেকর্ড ভাঙা প্রপোজাল দেয়ার প্রস্তুতি নিয়েছিলো সপ্তদশীকে। সে নাকোচ করে দিয়ে প্ল্যানে পানি ঢেলে চলে গেলো।
হতবাক দিয়া।এও কি সম্ভব!!
– এখন করুন।
– টাইম এক্সপায়ার্ড।
দিয়া ছলছল চোখে তাকিয়ে আছে। শাহাদ রুমে চলে গেলো। এই নিরস মানুষটা এত বছর ধরে পছন্দ করে ব্যাপারটা ভাবতেই কেমন যেনো লাগছে। আসলেই পছন্দ করে তো?
___
নতুন প্রোফাইল পিকচার দেখে রিয়েক্ট দিতে হাত নিশপিশ করে উঠলো। মনটাকে শত বারনেও সামলাতে না পেরে একটা লাভ রিয়েক্ট দিয়েই দিলো। অনলাইনের সবুজ রঙ টা জ্বলছে। মেসেঞ্জারে ঢুকে ঠুস করে একটা মেসেজ দিলো। বেশ কিছুক্ষন হলো রিপ্লাই না আসাতে পুনরায় মেসেঞ্জারে ক্লিক করতেই দেখলো ব্লক। লিমন হতবাক।পুরোপুরি ব্লক করে দিলো। কি ভয়ংকর মেয়ে। সালাম দিলে যে ব্লক করে দেয় তা তো জানা ছিলো না। ফোনটা হাতে নিয়ে কয়টা বাজে সেসব পরোয়া না করে নাম্বার ডায়াল করলো।
ফোন রিসিভ হতেই ও পাশ থেকে রিনরিনে আওয়াজে সালাম ভেসে এলো। ইশ কি সুন্দর কণ্ঠ। উত্তর দেয়ার আগে রিমনের মনে হলো- আচ্ছা তাহলে জানেনা আমার নাম্বার, জানলে সালাম তো দূর কয়েকটা শুদ্ধ বাংলায় গালি ভেসে আসতো। মনে সাহস করে লিমন সালামের উত্তর নিয়ে বললো,
– কোন ধরনের অসভ্যতামি।সালাম দিলাম আর ব্লক করে দিলেন।
তাহির রাগ সপ্তম আসমানে। যদি ঘুনাক্ষরে ও টের পেত এই বেয়াদপ কখনোই ফোন রিসিভ করতোনা। মাথা ঠান্ডা করে বললো,
– কি ব্যাপার ছোট ভাইয়া এত রাতে?
– এ্যাই খবরদার ভাইয়া বলবেন না,আমি ছাইয়া বানাতে চাচ্ছি আর উনি ভাইয়া ভাইয়া করছে।ব্লক করেছেন কেনো?
তাহির মেজাজ নিয়ন্ত্রণে আনতে অক্ষম হয়ে বলে,
– অনেক সহ্য করেছি আমি কালই ভাইজানকে বলে তোমার ব্যবস্থা করছি।এতটা অসভ্য তো ছিলেনা বাচ্চা কালে। আমার এখনো মনে পড়ে তিন বছর বয়সে নিজে হিসু করে নিজের হিসুতেই আঁছাড় খেয়েছো। পরে বড় খালামনি একটা ন্যাপি পরিয়ে দিয়ে আমাকে বললো ওকে একটু দেখে রাখো তো আম্মু। খালামনি ওর হিসু পরিষ্কার করি। আর এখন আসছে সিনিয়র বোনের সাথে প্রেম করতে…
লিমন প্রচন্ড লজ্জা পেয়ে নির্বাক হয়ে গেলো।এত উপমা,এত উদাহরণ, এত দোষ থাকতে এই একটা কথাই মাথায় এলো এই মেয়ের। ছিঃ ছিঃ শেষ মেষ কিনা হিসু। ইয়াক। প্রেমের বারোটা বাজিয়েছে ছোটবেলার এই তিক্ত স্মৃতি। ইয়াহ আল্লাহ কথা বের হচ্ছেনা কেনো মুখ দিয়ে।
তাহি পুনরায় বললো,
– লজ্জা পেয়েছো ছোট ভাই, লজ্জা পেয়োনা ওটা তো ছোট বেলার ঘটনা। এখন তো আর নিজের হিসুতে আঁছাড় খাও না তাই না। অবশ্য খেলে তো নিজেরই বিপদ। নিজের টা নিজেরই পরিষ্কার করতে হবে। নাহয় ভাইজান এসব শুনলে এসে ওই হিসুতেই আঁছাড় মা/রবে।
লিমন চেঁচিয়ে উঠলো,
– আপনি কি থামবেন মিস তাহি, কি শুরু করলেন বলুন তো।আর কোনো কথা পেলেন না।
– আরেহ দাড়াও আরো আছে তো। তোমার যখন সুন্নতে খৎনা হলো, তুমি তো তখন মাত্র নয় বছরের ছোট্ট শিশু।আমি তখন বারো কি তেরো। এসে অবুঝের মত বলছিলে শেফালীকে, আপু জ্বলছে। ফুঁ দিয়ে দাও। তাহলে ভাবো আমি তোমার সুন্নতে খৎনা ও দেখেছি। ভাগ্যিস ফুঁ টা আমাকে দিতে বলোনি। যদি বলতে মান সম্মান কোথায় যেত জানো?
লিমন ক্ষোভে হিস হিস করে বললো,
– আমি বেক্কল ছিলাম, আপনাকে বললেই পারতাম। আমার যতদূর মনে পড়ে শেফালী আপা কান মলে আম্মুর কাছে নিয়ে গিয়েছিলো। আপনি মানবতা দেখিয়ে ফুঁ দিলেই পারতেন।অন্তত ছোট থেকে দেখে অভ্যস্ত হতেন।
এই ছেলে এত বেয়াদপ। তাহি চরম ক্রোধান্বিত হয়ে ফোন কে*টে দিলো। ব্লক ও করে দিলো। অপর পাশ থেকে লিমন ফোনটা এক পাশে রেখে কপালে হাত দিয়ে নিশ্চুপ। জিহবায় কামড় দিয়ে চোখ ঢেকে বিড়বিড় করে বললো,
– ইয়া আল্লাহ কত কষ্টে সাহস করে ফোন দিয়েছিলাম। এমন সব কথা শোনালো,সামনেই তো যেতে পারবোনা আর। এই মুখ লুকাবো কোথায়।
____
ঘড়িতে রাত দেড়টা। টিক টিক করে বাড়ছে সময়ের ঘন্টা। এবার যেন এই আওয়াজটা মাথায় বাড়ি দিচ্ছে।অসহনীয় ব্যাথায় উঠে পড়ে বিছানা ছেড়ে। মাঝখানে শেহজা ঘুমায়। পাশের কাউচে দিয়া। মেয়েটাকে কয়েকবার বলা হয়েছে বিছানায় শুতে। কি প্রবল জেদ। মুখে প্রকাশ করেনি তবে এই কামরায় আসার পর থেকে এক বিছানায় শোয়া হয়নি দুজনের। পরিস্থিতি স্বাভাবিক এরপরো কোথাও একটা অস্বাভাবিতার তীব্র ছায়া। যা প্রকাশ করে আসন্ন বিচ্ছেদ। কয়েকবার বলার পর ও কথা না শোনাতে শাহাদ আর জোর করেনি। যার যার ব্যক্তিগত ব্যাপার।এখানে হস্তক্ষেপ করার অধিকার শাহাদের নেই। শাহাদের পক্ষে সম্ভব নয় কাউচে ঘুমানো। কাউচের দৈর্ঘ্যের সাথে তার দেহ বড্ড বেমানান। বিছানা ছেড়ে উঠে এক গ্লাস পানি পান করে রুম থেকে বেরোলো। সোজা ছাদের উদ্দেশ্যে পা ফেললো।
চারপাশটা ঘুটঘুটে অন্ধকার। পোর্চের নিচে টিমটিমে হলুদ আলো।
চোখের সামনে ভেসে উঠেছে পরিচিত রমনীর নাচ। মঈন মজুমদার, দিয়ার চাচা যার সাথে কথা বলে বাবা মা বিয়ের দিন ঠিক করেছিলেন। মজুমদার বাড়িতে যেতেই রাস্তায় বজ্রপাত, বৃষ্টি। গাড়ির চাকা আটকে গেলো কাদাতে। পাভেল,হামজা,নোমান,তুহিন ঠেলেও যখন উঠাতে পারেনি,শাহাদ বিরক্ত হয়ে ভরা বৃষ্টিতে বেরিয়ে গেলো মুখে অস্বাভাবিক গালি দিয়ে। নেভি কর্মকর্তা মুখের ভাষা স্বাভাবিক হবে না এটাই যেন স্বাভাবিক। শাহাদের মুখে বিচ্ছিরি গালি শুনে হামজা আর তুহিন ঢোক গিললো। শাহাদ চেয়েছিলো না এই রাস্তায় ঢুকতে। তুহিন ভুল করে কাদা মাটির রাস্তায় ঢুকে পড়েছে।বারণ করার সত্ত্বেও যখন শুনেনি, এখন গালি শোনাই শ্রেয়। গায়ের শার্ট ভিজে ছুপছুপা। ফোন বের করার সাধ্য নেই। যা পানি ঢোকার সব অলরেডি ঢুকেছে এখন বের করলে আরো বরবাদ হবে। হামজা এর মধ্যে বলে উঠলো,
– বস গুগল ম্যাপে কি রাস্তা দেখাবে?
এবার আর নিজেকে পুনরায় সংযত করতে ব্যর্থ হয়ে শাহাদ ক্ষেপে উঠলো,
– হারা****** কাছে আয় তুই, এই কাদা রাস্তায় তোরে মাটি পানির ভিত্রে চুবায় গুগল ম্যাপের নতুন রাস্তা বানাবো বদ**শ।
পাভেল,নোমান হামজাকে চেপে ধরে চুপ করতে বলে। যখন মজুমদার বাড়িতে পৌঁছালো, তখন দুপুর গড়িয়ে বেলা তিনটা। বাড়িতে সকলে অপেক্ষা করছে। মজুমদার বাড়ির মেহমান খানায় মেহমানদের জন্য বিশাল আয়োজন। মঈন মজুমদার এগিয়ে এসে স্বাগত জানালেন। সনাতনী সেগুন কাঠের নকশাদার
সোফায় বসে আছেন রায়হান সাহেব এবং সুলতানা কবির। শাহাদকে দেখে সুলতানা কবির হাতে একটা ব্যাগ ধরিয়ে মঈনকে অনুরোধ করলো গোসলখানা দেখিয়ে দিতে। শাহাদ ব্যাগ হাতে চলে গেলো। একটা সাদা শেরওয়ানি।পরার পর মনে হলো বড়ই সুন্দর, শাহী ভাব। এর মাঝে খাবারের আয়োজন চলছিলো। কিছুক্ষন পর শাহাদ আসতেই খাবার টেবিলে মঈন মজুমদার বলে উঠলেন,
– জামাই , আমার ভাস্তির সাথে তো দেখা হয়নি। একবার কি দেখা করবেন?
শাহাদের ব্যক্তিত্ব মঈনের খুবই পছন্দ হয়েছে। কেমন গাম্ভীর্য। শাহাদ মঈনের দিকে তাকিয়ে বললো,
– দেখা করা তো উচিত। আপনাদের যদি তেমন রীতি থাকে তাহলে ভালো হয়। যতটুকু আন্দাজ করেছি আপনারা অনেক আচার,রীতি মেনে চলেন।
– তা চলি। আমাদের এখানে মেয়েরা না মেহরামের সাথে দেখা করে না।
শাহাদ কিঞ্চিত হেসে বললো,
– ভালো লাগলো শুনে।
খাবার শেষে বিশ্রামের পর পাঠানো হলো অন্দরে। শাহাদ জানতোনা এই বাড়িতে আবার অন্দরমহল ও আছে। মঈনের স্ত্রী তমা শাহাদকে বার বার আড়চোখে দেখছে। নিজের মেয়েকে বললো শাহাদের সাথে আগ বাড়িয়ে কথা বলতে। কল্পনা শাহাদের সাথে কথা বলছে দিয়ার রুমে নিয়ে যেতে যেতে। শাহাদ নিরবতা পালন করতে। দরজার কাছে এসে ঘুঙুরের আওয়াজ শুনেই থমকে গেলো হৃদয়। কল্পনাকে প্রশ্ন করলো,
– ভেতরে কে?
– আমাদের দিয়া রানী। আপনি ভেতরে যান দুলাভাই।আম্মা জানলে আমার ছাল তুলবে। আপনাকে অন্দরের মেহমানখানায় বসাতে বলেছিলো। সেখান থেকে আম্মা সব দেখতে পেত।আমার কাছে মনে হলো আপনি এখানেই আলাপ সারুন কেউ দেখতে পাবেনা।আর দিয়ারানী জানেনা আজ তার বিয়ে।একটু খোলাশা করে বলবেন।মেয়েটা একটু অন্যধাঁচের কিন্তু আমার বড্ড স্নেহের। আম্মার আপনাকে আমার জন্য পছন্দ হয়েছে,তাই আপনার সাথে বক বক করতে বলেছে। তবে আমার মনে হলো আপনি আমাদের দিয়ারানীর রাজযোটক। তাই বাঁধা হলাম না। গেলাম। কথা বলুন।
এতক্ষনে মনে হলো মেয়েটা বড্ড সরল,অথচ মা টা কতটা কুচক্রি।শাহাদ মুচকি হেসে বলে,
– বোকা মেয়ে।
– এজন্যই আম্মা ভেবলি ডাকে। হি হি হি।
কল্পনা চলে যেতেই শাহাদ কামরার আলিশান দরজায় হালকা জোর দিয়ে ধাক্কা দিলো। ঘুঙুরের আওয়াজ স্পষ্ট হলো। গান বাজছে নজরুল গীতি। এই কামরা বাড়ির অন্য সব কামরা থেকে বৃহৎ।সাধারণত রাজা বাদশাদের কন্যা, স্ত্রীরা এসব কামরার উত্তরাধিকারীনি হয়।সামনে সাদা আনারকলি পরিহিত প্রেয়সী।কোমড়ে লাল জরি সুতার ওড়না প্যাঁচানো। মনে হলো কোনো জমিদার কন্যা নাচের অনুশীলন করছে। সেই রজনীগন্ধার মিষ্টি সুবাস। বুকের ভেতরটা ধক করে উঠলো। শিউরে উঠলো শরীরের প্রতিটি লোমকূপ। পঁয়ত্রিশ বছরের জীবনে এমন নাচ সরাসরি কখনো দেখেনি। যেন সত্যিকার অর্থে সম্রাজ্ঞী নূরজাহান সামনে চলে এসেছে। গলাটা শুকিয়ে কাঠ। কামরা জুড়ে টিমটিম আলো। গানের প্রতিটি স্তবক মন থেকে অনুভব করার চেষ্টা করলো,
প্রিয় যাই যাই বলো না ,
না না না ।
আর ক’রো না ছলনা ,
না না না ।
আজো মুকুলিকা হিয়া মাঝে
না বলা কত কথা বাজে ,
অভিমানে লাজে বলা যে হ’ল না ।।
কেন শরমে বাধিল কে জানে ,
আঁখি তুলিতে নারিনু আঁখি পানে ।
প্রথম প্রণয় – ভীরু কিশোরী
যত অনুরাগ তত লাজে মরি ,
এত আশা সাধ চরণে দ’ লো না ।।
হঠাৎ নাচ থেমে গেলো।ঘোমটা তুললো মাথায়। আর চেহারা দেখা গেলোনা।মেয়েটাও শাহাদকে দেখেনি। হকচকিয়ে গেলো শাহাদ। সজ্ঞানে ফিরে বলে উঠলো,
– আমি ভীষণ দুঃখিত।
– কে আপনি? আমার নাচ ঘরে কি করছেন? অন্দরে কিভাবে ঢুকেছেন? চাচা জান, মতিয়া বানু,কল্পনা আপা কোথায় তোমরা?
হাঁক ছাড়লো দিয়া। ঘোমটা সমেত মুখ চেপে ধরলো শাহাদ দিয়ার।
– আস্তে কি করছেন। আপনার চাচাজান ই পাঠিয়েছেন আমাকে। আপনার সাথে কথা বলতে।
– কি কথা?
– বিয়ের?
– কার সাথে?
– আমার।
– কিহ?
দিয়া থমকে গিয়ে বললো,
– ওহ।
শাহাদ হতবাক হলো।এই না রেগে যাচ্ছিলো এখন আবার চুপসে গেলো। অদ্ভুত রহস্য মানবী তো।
– চলুন ছাদে যাই।
পিছু হাঁটলো শাহাদ। ছাদে থেমে কবুতরের খাঁচায় খাবার দিতে দিতে বললো,
– আমার সম্বন্ধে সব জেনে এসেছেন?
– হুম
– আমার এই দুনিয়াতে কেউ নেই।যারা আছেন তারা কদিন জানিনা। বিয়ে কবে আমাদের?
– আজই
দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
– অথচ আমি জানিই না। নিয়ে যাবেন আমায় আজ?
– আপনি কি চান?
– নেই কোনো চাওয়া পাওয়া।
তৃপ্তির হাসি মুখে।এ যেন সব পাওয়া। কথা শেষ করে দিয়া চলে গেলো একা ছাদে শাহাদকে রেখে। সন্ধ্যার মধ্যে বিয়ের সব আয়োজন শেষ। কাজী শাহাদের মুখ থেকে কবুল শুনে ভেতরে পাঠালেন শাহাদের মাকে। ভেতর থেকে মঈন, শাহাদের মা এবং বাবা দিয়ার সম্মতি জেনে স্বাক্ষর করিয়ে নিয়ে আসলেন। সম্পন্ন হলো শাহাদ দিয়ার বিয়ে। দিয়া এক নজর ও দেখেনি স্বামীকে।জানেনা স্বামী দেখতে কেমন! বাড়ির মেহমানখানায় আনা হলো দিয়াকে। ঘোমটা তোলে শাহাদকে দেখালো। ওই মুহুর্তে মনে হলো পৃথিবী থমকে গিয়েছে।রূপ কি করে ঠিকরে পড়ছে। মুখ ফিরিয়ে নিলো শাহাদ আর একটি কথাও বলেনি। এই রূপ চোখ ঝলসে দিবে। দিয়ার পরনে শাহী জোড়া। এই জোড়া তার দাদীজানের। উনার শেষ ইচ্ছে ছিলো বিয়েতে তার শাহী মসলিনের লাল আনারকলি পরবে দিয়া। এমন পোশাকে এই মেয়েকে অনবদ্য লাগছে আজ। রওয়ানা হলো সদ্য শ্বশুর বাড়ির পথে।শাহাদের তখনো জানা হলো না কেনো দিয়া এই বিয়ে মেনে নিলো? কেনো কোনো প্রতিবাদ করলো না! কেনো শাহাদকে এক নজর চেয়ে দেখলো না! সদর দরজায় শিফা এসে এগিয়ে নিয়ে গেলো নতুন ভাবীজানকে। মায়ের আদেশে কোলে তুলে নিলো প্রেয়সীকে। সেই মুহুর্তে দু জোড়া চোখের মিলন ঘটলো। শ্যামবর্ণ এই সুদর্শন মধ্য বয়সীপুরুষ দিয়ার। সে তো ভেবেছিলো বুড়ো,চুল নেই এমন পুরুষ। তাহলে যে চাচী বলেছিলো, তোর বর হবে বুড়ো, দাঁত পড়েনি তবে চাচীর চেয়ে চাচার কথা শুনেছিলো। বলেছিলো বয়স বেশিবতবে মানানসই। চাচী বার বার বলেছিলো, মানা করে দেয় এই সম্বন্ধ। তবে কি দিয়ার সুখ চাচীর সইলো না! বিয়ে ভাঙলেই বোধ হয় খুশি হতেন।
কাঁধে হাত পড়াতে শাহাদ পেছন ফিরে দেখে দিয়ে। শান্ত স্বরে শুধালো,
– ঘুমাও নি! কিছু বলবে?
– যে স্মৃতিতে আমার বিচরণ, আমার অনুপস্থিতি কি কাম্য?
ইষৎ হেসে শাহাদ বললো,
– এখন আমাদের মধ্যে দূরত্বই শ্রেয়। অনুপস্থিতিতে অভ্যস্ত হয়ে যাওয়া উচিত নয় কি দুজনের?হয়তো তুমি ধরণীতে,আমি সাড়ে তিন হাতে ঘরে। জোর করে নিজের করেছি মানবীকে । উপর ওয়ালা অসন্তোষ। তোমার আমার মিলন কোথায়!
– দিয়া হেরে গেলেও, ফারাহ হারবেনা। যার নামেই সুখ, স্রষ্টা কি করে তাকে অসুখী রাখবেন। ঠিক চেয়ে নেব স্রষ্টা থেকে আমার সুখ।
অধরে ফুটে উঠেছে একপেশী মন মাতানো হাসি। টোল পড়েছে তামাক বর্ন পুরুষের গালে। স্রষ্টা কখনো নিরাশ করেনা তার প্রিয় বান্দাকে। দিয়াকে পিতা- মাতাহীন করেছে,তার সন্তানকে কি কষ্টে রাখবেন! প্রতিটি মোনাজাতে থাকে এই মানুষের জন্য স্বার্থহীন দোয়া। কে বলেছে দিয়া ভালো নেই। মানুষটা সর্বস্ব দিয়ে আগলে রেখেছে সেই খবর দিয়া পায়। আড়ালে আবড়ালে গত দুবছর দিয়ার প্রতিটি নিশ্বাসের খবর রেখেছে এই গম্ভীরমুখো কাষ্ট মানব।দিয়ার ভালোবাসা তুচ্ছ এই মানবের যত্নের কাছে। মুখে তিনশব্দ উচ্চারন তো কুঠিবাড়ির মেয়েরাও করে,মন থেকে আগলে রাখে কয়জন!!!
চলবে…
#সায়রে_গর্জন
#নীতি_জাহিদ
২৩.
( অনুমতি ব্যতীত কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ)
এক সপ্তাহ কামরা বন্দি। ছেলেটাকে এতদিন দুচ্ছাই করেছিলো আজ কেমন বুকের ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে। এক লাইট,এক ফ্যান,একটা খাট আর একটা বুকশেলফ ছাড়া বাকিসব এখান থেকে সরিয়ে নেয়া হয়েছে। হাহুতাশ, চিৎকার চেঁচামেচি কোনো কিছুই কাজে আসেনা। তিনবেলা খাবার দিয়ে যায় কয়েদীর মত। প্রিয় খাবার গুলো খাওয়া হয়না গত সাতদিন। একবার বের হই এখান থেকে কাউকে ছাড়বোনা। তৎক্ষনাৎ দরজা খোলার আওয়াজ কানে এলো। ডান পাশে ঘুরে দেখলো ভাইজান। মাথায় ঘোমটা টেনে গুটিশুটি হয়ে বসলো। হাতে একটা ছোট কার্টন। দরজা ভেজিয়ে চেয়ার টেনে বসলো। কার্টনের টেপ খুলে আট দশটা বই বের করলো। বুক শেলফে সাজিয়ে রাখলো প্রতিটি বই। হাতে একটা বই নিয়ে এগিয়ে এসে বললো,
– সময় কাটেনা বুঝতে পারছি, কিছু বই রেখে গেলাম পড়বে। প্রথমে রবার্ট টি কিয়োসাকির “Rich Dad,Poor Dad” দিয়ে শুরু করে। উঁহু বই ছেড়ার মতো বোকামি একদম করবেনা। এই বই গুলো আমার বড্ড পছন্দের। এর চেয়ে বড় কথা কিনতে অর্থ ব্যয় করেছি।তোমার হারাম টাকায় কামানো অর্থের মত নয়। আমার কষ্টে কামানো প্রতিটি কানা কড়ি। মানুষ হও। আদিম যুগের মত অসভ্য যুগেও সভ্য, লজ্জ্বা নামক অনুভূতি ছিলো যা তুমি এই একবিংশ শতাব্দীর সভ্য যুগে এসেও খুঁইয়েছো। তোমার ছেলে সুস্থ আছে,ভালো আছে। তুমিও ভালো থেকে আমাকে শান্তিতে বাঁচতে দাও কটা দিন।
শেফালী ভাইয়ের মুখের দিকে তড়াক করে তাকালো। সব কথা বুঝলেও শেষের কথাটা ঠিক বুঝে উঠতে পারলোনা। ভাইয়ের চলে যাওয়া দেখতে থাকলো। মন চাইলো সব গুলো বই ছিড়ে ফেলতে কিন্তু ভয়ে হাত লাগালো না।
___
শাহাদ রুমের দিকে যেতেই আজ হঠাৎ আবির ছুটে এসে মামাকে জড়িয়ে ধরলো।এই ছেলেটা কখনো ভয় পেয়ে শাহাদের কাছে আসে না। শাহাদ ও কথা কম বলতো আবিরের সাথে। সখ্যতা গড়ে উঠেনি শাহাদের সাথে। আবির হওয়ার পর থেকেই তো বাইরে বাইরে ছিলো শাহাদ। শেফালী নিজেই কারো কোলে দিতে চাইতোনা আবিরকে। ছয় বছরের আবির হঠাৎ ছুটে মামার কাছে আসাতে পেছনে দাঁড়ানো আফিয়া বেগম,দিয়া এবং সুলতানা কবির ঘাবড়ে গেলেন। শাহাদ ভাগ্নেকে কোলে তুলে নিয়ে সোফায় বসলো। আবির গাল ফুলিয়ে বললো,
– বড় মামা…
– জ্বি মামা।
– আমি আজকে কার সাথে ঘুমাবো? ছোট মামাতো আজকে বাসায় আসবেনা।
মায়ের দিকে তাকালো শাহাদ।সুলতানা কবির জানালো শাহীন কাজে আজ বাইরে থাকবে। শেফালীর বন্দি দশার পর থেকে শাহীনের সাথেই ঘুমায় আবির। আবির ছোট থেকেই শাহীনের ন্যাওটা। শাহাদ আবিরের দিকে তাকিয়ে বললো,
– মামা, তোমাকে এই বাসায় সবচেয়ে বেশি কে ভালোবাসা দেয়?
আবির কিছুক্ষন ভাবলো। এরপর বললো,
– নানা ভাইয়া, নান, খাম্মা, ছোট মামা আর দিয়ামা।
– তুমি কার কাছে থাকতে চাও?
– খাম্মার অসুস্থ, ঘুমায়। নানা ভাইয়া আর নানের সাথে থাকবোনা। নান রাতে নাক ডাকে।
সুলতানা কবির লজ্জ্বা পেলো সবার সামনে। শাহাদ মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো,
– আম্মু, বার বার বলেছি একবার ডাক্তার দেখান। এটা তো ক্ষতিকর। নিজের প্রতি একটু খেয়াল রাখুন।
– আচ্ছা যাব বাবু। এবার আর হেয়ালি করবোনা।
পুনরায় আবিরের দিকে ফিরলো।আবির শাহাদের গলা জড়িয়ে ধরলো। শাহাদ এই প্রথম এই বাচ্চাটাকে এত আহ্লাদে কোলে নিলো। ছেলেটা শাহাদের আদর পেয়ে আরো আহ্লাদ নিয়ে বলে,
– দিয়ামা তো শেজামনিকে নিয়ে ঘুমায়। তুমি আজ আমায় রাখবে বড় মামা? আমি রাতে জ্বালাতন করিনা। গায়ে হাত- পা তুলি না। মাম্মা বকা দিত তাই অভ্যাস হয়ে গিয়েছে।
শাহাদ বুকে জড়িয়ে ধরে বলে,
– রাখবো বাবা।তুমি আজ থেকে মামার কাছেই থেকো তোমার ইচ্ছে হলে কেমন।
খুশিতে আবির টুপ করে শাহাদের গালে চুমু খেলো। সুলতানা কবির বিস্মিত। ভাবেনি শাহাদ রাজি হবে। শাহাদ আবিরকে কোলে নিয়ে দাঁড়াতেই আফিয়া খালা রুম থেকে শেহজাকে নিয়ে এলো। মেয়েটা মাত্র উঠেছে। শাহাদের কোলে আবিরকে দেখে আচমকা কান্না জুড়ে দিলো। সে কি কান্না। দিয়া ভয় পেয়ে শেহজাকে নিয়ে রুমের দিকে পা বাড়াবে তখনই শাহাদ বলে উঠলো,
– ফারাহ… দাঁড়াও…
– শেহজা কাঁদছে তো। খাইয়ে দিই।
– ও খাওয়ার জন্য কাঁদছেনা, তোমার ধাঁচ পেয়েছে। কোলে দাও।
দিয়া ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছে।শাহাদ এগিয়ে এসে শেহজাকেও কোলে তুলে নিলো। বাবার কোলে আসতেই খুশিতে গদগদ হয়ে গেলো। বাবার কাঁধে মাথা রেখে গলার দুপাশ থেকে দুহাতে আঁকড়ে ধরে। শাহাদ মুচকি হেসে বলে,
– আম্মা, বাবা অফিস যাবো তো ছাড়বেন না?
মেয়েটা আরো শক্ত করে আঁকড়ে ধরে। আবির খিলখিল করে হেসে বলে,
– মামা শেহজা জেলাস!!
সুলতানা কবির হেসে বলে,
– বাবু নিজ চোখে না দেখলে বিশ্বাসই করতাম না। ও আসলে কি বুঝলো ? এই ব্যাপারটা মাথায় ঢুকলো কি করে?
– আম্মু, আপনারা ওকে ঠিক যতটা ছোট, অবুঝ ভাবেন ও কিন্তু একদম তা নয়। সব বুঝে। আবিরকে দেখে ভেবেছে আবির বুঝি বাবাকে এবার নিয়ে যাবে। বাবা যদি আবিরের হয়ে যায়! আতঙ্কে ঢুকে গিয়েছে তৎক্ষনাৎ। তাই এত জোরে চিৎকার দিলো। শাহাদ মেয়ের মাথায় চুমু খেয়ে দিয়ার দিকে তাকাতেই লক্ষ্য করলো কেমন ভাবে যেন তাকিয়ে আছে। দিয়া বিলম্ব না করে প্রশ্ন করলো,
– আপনি আমার ধাঁচ পেয়েছে বলতে কি বুঝালেন?
ঠোঁট টিপে হাসি আটকে শাহাদ বলে উঠলো,
– শাহাদকে ভাগ করার কথা আসলেই মা মেয়ে রণমুর্তি হয়ে উঠো তাই বুঝালাম।
দিয়ার মুখ হা সদৃশ হয়ে গেলো। আবিরকে নামিয়ে,শেহজাকে সুলতানা কবিরের কোলে দিয়ে শাহাদ বেরিয়ে গেলো। আফিয়া বেগম আর সুলতানা কবির হেসেই যাচ্ছে এটা সেটা বলে। দিয়া প্রচন্ড লজ্জ্বা পেয়ে রুমে চলে আসলো। লোকটা এভাবে লজ্জ্বা না দিলেও তো পারতো।
___
কাজ শেষ করে আজ রাতটা হোটেলে কাটাতে হবে। শাহীন ফ্রেশ হয়ে নওরীনকে কল করলো। ওয়েটার রাতের খাবার দিয়ে গেলো। শাহীন রিফ্রেশিং জুসে চুমুক দিয়েছে। কিছুক্ষন আগে শাহাদ ফোন দিয়ে জোরে শোরে ধমক দিয়েছে আজ মঙ্গলবার বার এখন অবধি শপিং শেষ হলোনা। নওরীনকে ফোন দিতেই ও পাশ থেকে বলে উঠলো,
– জানো কি হয়েছে?
– কী..
– বড় ভাইজান ফোন দিয়েছে।
শাহীন বিষম খেলো জুস খেতে গিয়ে। নাকে মুখে উঠেছে।শাহাদ নাকি নওরীনকে কল দিয়েছে! এটা কি সম্ভব। শাহীন কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে বললো,
– কি বলেছে ভাইজান?
– আমার থেকে ব্যাংক একাউন্ট নিলো। আমি তো বুঝিনি ভাবলাম কোনো কাজে লাগবে। ওমা একটু পর দেখি আমার একাউন্টে দেড় লাখ টাকা পাঠিয়েছে শপিং করার জন্য। আর তোমাকে চাইলে কিছু গিফট করার জন্য। আমি না বুঝেই বললাম,ভাইজান আপনি কেনো দিয়েছেন? উনি ধমকে উত্তর দিলো, তোমার ভাই আমি। আমি দিব না কে দিবে? বিশ্বাস করো আমি কেঁদে দিয়েছি ফোনে।এতটা আপন করে কেউ কখনো বলেনি। কাল নাকি আমাকে নিয়ে বেরুতে বলেছে ভাইজান তোমাকে?
– হ্যাঁ তা তো বলেছে।কিন্তু আমার কিছুই বিশ্বাস হচ্ছেনা।
– সত্যি। তোমার মেসেঞ্জারে ছবি দিয়েছি ব্যাংক থেকে পাঠানো মেসেজের।দেখে নাও।
শাহীন ভাইয়ের কান্ডে অবাক না হয়ে পারলোনা। এতদিকে এত খেয়াল সবার রাখছে।অথচ নিজের খেয়াল রাখছেনা। আগামী মাসের মধ্যে কিছু একটা করতে হবে। ট্রিটমেন্ট নিতে হবে অথবা অপারেশন। ডাক্তার পই পই করে বলেছে। কে শুনে কার কথা। একটা কথা বলে যাচ্ছে,তোমার বিয়েটা হোক এরপর। নওরীনের ডাকে সম্বিত ফিরে এলো শাহীনের।
– কালকে কি সত্যি বের হবো?
– জ্বি ম্যাডাম তৈরি থাকবেন। আচ্ছা সবাইকে দাওয়াত দিয়েছো?
– আমার আর সবাই! বান্ধবীরা আছে আর মামা চাচা।এই। বলেছি কেউ তেমন গায়ে মাখলো না ব্যাপারটা।
শাহীন দীর্ঘ শ্বাস ফেললো। বুঝলো মন খারাপ নওরীনের। হঠাৎ গেয়ে উঠলো পছন্দের একটা গান। তাও আবার বেসুরে গলায়,
তুই হেসে উড়িয়ে দে আমার যুক্তি
তোর সাথেই হবে শান্তির চুক্তি
কারণে অকারণে রেষারেষি
আর জিলাপির পেঁচ পাবে মুক্তি
আমার কথা কবিতায় নাক গলাতে
থাক সহ্য ক্ষমতার যফলাতে
বোঝা যায় না তোর সভাব
কিজে করি আমি
শুধুই পারিস তুই গাল ফোলাতে
আমার নাওয়া খাওয়া ঘুম হারাম করে
তুই আমার জীবনে থাক আরাম করে
– তুমি গান ও গাইতে পারো?
– ওমা গান কে পারেনা?
– মশাই আমার সামনে গেয়েছো,গাইবে এই যেন শেষ হয়। যা সুর লাগিয়েছো শেষে মান ইজ্জত যাবে।
– ইশ এভাবে বলোনা তো। আমার সব গান তো তোমার জন্যই। আরো বেশি গাইবো।
– ভাগ্যিস ভাইজান নেই। থাকলে গান বের করতো তোমার।
– রোমান্টিকতা বুঝোনা মেয়ে,ভাইজানকে কেনো টানতে হবে? তুমি দেখি ভাইজানের মত নিরামিষ। আজ পর্যন্ত শুনলাম না ভাবীমায়ের সাথে দুটো মিষ্টি কথা বলতে।
ফোনের অপর পাশ থেকে খিলখিল হাসির শব্দে শাহীনের মন ভালো হয়ে গেলো। নওরীন থেমে বলে,
– একটা কথা বলি রাগ না করলে?
– হুম
– আমার কেনো জানি না মনে হিয়, ভাইজান মারাত্মক রোমান্টিক কিন্তু চেপে যায়। ইভেন ভাবী মা ও জানে না ভাইজানের এই গুণের কথা।
শাহীন কিছুটা অবাক হয়ে উৎসাহ নিয়ে প্রশ্ন করলো,
– কি রকম,তুমি কি করে বুঝলে?
– আমি একটা মেয়ে, ছেলেদের ইন্টেনশন সহজে বুঝি। সেদিন ভাবীমা আমাদের একসাথে খাওয়া বেড়ে খাওয়াচ্ছিলো না,তখন ভাইজানের পূর্ণ দৃষ্টি ছিলো ভাবীমায়ের দিকে। তার চোখে মুখে খেলছিলো মুগ্ধ চাহনী। ভাবীমাকে লাগছিলোও সেদিন মাশাল্লাহ ওই আকাশ রঙা শাড়িটাতে। ভাইজান ভাবীমাকে একা পেলে সেদিন শিউর তোমাদের নতুন মেহমান চলে আসতো।
– থামো। আসছে অ্যাস্ট্রোলজার। এমন ভাবে বলছো যেন সে ভাবীমাকে একা পায় না। শুনো আমার দেখা সবচেয়ে রসকষহীন বান্দা আমার ভাই। সে অনুভূতি লুকাতে জানে। দুজনের মাঝে অসীম দূরত্ব নিরা। সেদিন শুনেছি আফিয়া খালা আম্মুকে বলছিলো, ভাবীমায়ের বালিশ পেয়েছে কাউচে। বাদ দাও সেসব।আমাদের আলোচনা করাও হারাম তাদের নিয়ে। তবে আমার ভাইজান নিজেও কষ্ট পাচ্ছে, ভাবীমাকে কষ্ট দিচ্ছে।মাঝখানে আমাদের মেয়েটা ভুক্তভোগী। ভাইজানের সুস্থতা ছাড়া আর কিছু চাইনা। সময় নেই হাতে। বিয়েটা শেষ হলে আমি জোর করে হলেও তাকে বাইরে পাঠাবো।
– তাই হোক।আল্লাহ সকলের নেক আশা পূর্ণ করুন।আমিন।
– আমিন।
____
রাত আটটা। শাহাদ বাসায় ফিরেই দিয়াকে তৈরি হয়ে নিতে তাড়া দিচ্ছে। দ্রুত রেডি হয়ে নিলো। শিফা আর দিয়া দুজনকে নিয়ে রওয়ানা হলো বসুন্ধরা শপিং মলের দিকে। গাড়িতে ইংলিশ গান চলছে। শেহজা বাবার বুকে শুয়ে উ আ করছে। শাহাদ ঢংয়ে রঙে মেয়ের সাথে কথা বলছে। শিফা বলে উঠলো,
– শেরি শেরি লেডি গানটা সুন্দর না ভাবীজান?
শাহাদের কথাটি কানে বাজলো। ফ্রন্ট সিটে বসেছে। পাশে পাভেল গাড়ি চালাচ্ছে। বোনের দিকে তাকিয়ে বললো,
– তুমি কি গানটার অর্থ জানো?
শিফা ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে স্বাভাবিক ভাবেই বললো,
– জ্বি ভাইজান জানি।
– আমি যতদুর জানি তুমি নজরুল সঙ্গীতের ভক্ত। পপ সং কবে থেকে শুনছো?
এবার শিফা ঘাবড়ে গেলো। আমতা আমতা করে বললো,
– না মানে ভাই জান হয়েছে কি.. আমার এক ফ্রেন্ড শুনছিলো তখন সেটার অর্থ বের করেছিলাম তাই…
– সাবধান…
– জ্বি ভাইজান।
এভাবে বেশ কিছুক্ষন কে*টে গেলো।অকস্মাৎ শাহাদ বলে উঠলো,
– পছন্দ থাকতেই পারে শিফা তবে সেটা যেন স্বাভাবিক হয়। অস্বাভাবিক সম্পর্কে জড়ালে আগে আমার মুখোমুখি হবে এরপর বাকি সব।
বুকের ধুকধুক বেড়ে গিয়েছে গাড়িতে অবস্থানরত দুজনের। হাত কাঁপছে। হঠাৎ ব্রেক কষলো। শাহাদ সামনে ঝুকে ঘাড় ঘুরিয়ে পাভেলের দিকে তাকাতেই দেখলো পাভেল ভয়ে আঁৎকে উঠেছে। অনুনয় করে বললো,
– স্যরি বস। বুঝিনি হঠাৎই হাত স্লিপ করলো।
শাহাদ পূঙ্খানুপুঙ্খ রূপে পর্যবেক্ষন করে বললো,
– কোনো সমস্যা?
– না বস,ঠিক আছে। স্টার্ট করবো?
– না দরকার নেই। গাড়ির লাইট টা জ্বালিয়ে আমার চাঁদ মুখটা দেখো। এতে তোমার বড়ই উপকার হবে। বুদ্ধিশুদ্ধি কিছু বাড়লেও বাড়তে পারে। আর এটাও যদি কঠিন মনে হয় বলো, আমি তোমাকে ড্রাইভ করে মানসিক হাসপাতালে রেখে আসবো, যদি ঘটের বুদ্ধি ঠিকানায় আসে…
আতঙ্কে ঢোক গিলে পাভেল গাড়ি স্টার্ট দিলো। দিয়া এতক্ষন শিফাকে পর্যবেক্ষন করলো। খুব জোরে দম ফেললো মেয়েটা। এই এসির মধ্যেও ঘেমে গিয়েছে। পুনরায় শাহাদের গলা শোনা গেলো,
– পাভেল ভূতে পেয়েছে তোমাকে, এসির মধ্যে এমন ঘামছো কেনো? কিছু কি হয়েছে,শরীর খারাপ?
– না বস। ঠিক আছি। আমি প্রায় এভাবে ঘামাই।গরম বেশি লাগে ইদানীং।
বিরক্ত হয়ে ভ্রু কুচকে শাহাদ বললো,
– অদ্ভুত রোগ। ঠিক আছে গাড়ি চালাও মনোযোগ দিয়ে।
গাড়ি থামলো বসুন্ধরার সামনে। ঘুরে ঘুরে অনেক শপিং করলো পরিবারের প্রতিটি মানুষের জন্য। বাকি আছে শাহাদ দিয়ার শপিং। দিয়া লাগবেনা বলে শপিং করতে চাইলো না। সতর্ক চোখে আশপাশটা দেখে নিলো। নিরাপত্তা নিয়ে আসেনি। সবসময় আশপাশে এসব নিরাপত্তা ভালো লাগেনা। আজ মাস্ক ও পরেনি। মানুষের কিছুটা ভিড় লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এসে কথা বলছে অনেকে। দিয়ার মুখে মাস্ক,হিজাব যার কারণে কয়েকজন ছবি তুলতে চেয়ে শাহাদকে অনুরোধ করলো,
– স্যার আপনার সাথে ছবি তুলতে চাচ্ছিলাম।
শাজাদ নিষেধ করেনি।আচমকা ওই ছেলে দিয়াকে বললো,
– ম্যাডাম আসুন,আপনার সাথেও তুলি।
শাহাদ গম্ভীর গলায় বললো,
– ম্যাডাম ছবি তোলে না।
দিয়ার হাত ধরে টেনে নিয়ে বেরিয়ে গেলো।
শপিং মল থেকে সবার কেনাকাটা শেষ করে বের হয়ে গাড়িতে বসলো।গাড়ি যখন বিজয় সরণীতে শিফা জোরে বলে উঠলো,
– ভাইজান আপনারা দুজন শপিং করেন নি?
দুজনই একসাথে বলে উঠলো,
– দরকার নেই,অনেক আছে।
বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত এগারোটা। রাতের খাবার শেষ করে শাহাদের কামরায় শপিং দেখতে বসেছে সবাই। পরিবারের প্রতিটি মানুষের জন্য শপিং হয়েছে। কাল থেকে সবাই আশা শুরু করবে বাড়িতে। এখান থেকে রিসোর্টে যাবে। শুধুমাত্র পারিবারিক লোকজনই থাকবে। শাহাদ একপাশে বসে আছে আবির আর শেহজাকে নিয়ে। শেহজার জন্য একটা প্রিন্সেস গাউন নিয়েছে স্কাই ব্লু কালার। সাথে চুড়ি,হেয়ার ব্যান্ড।সব শিফা পছন্দ করেছে। সুলতানা কবির বলে উঠলেন,
– বৌমা কিছু কিনো নি?
– না আম্মু আমার আছে,তাই এবার কিনি নি।
– শিফা, ব্লু ব্যাগটা বের করে দেখোতো শাড়িটা তোমার ভাবীজানকে কেমন লাগবে। – শাহাদের এমন কথায় দিয়া চমকে উঠলো।
শিফা খুশি মনে লাফিয়ে লাফিয়ে ব্যাগ খুলে দেখে নেটের একটা আকাশী রঙ্গা শাড়ি।যা শেহজার গাউনের সাথে ম্যাচ করা।
– ওয়াও ভাইজান খুবই সুন্দর। ভাবীজানের জন্যই বানানো হয়েছে এই শাড়ি এমন মনে হচ্ছে। পরী লাগবে।
শাহাদ মুচকি হাসলো। দিয়া উঠে একটা শপিং ব্যাগ নিয়ে শাহাদের সামনে দিয়ে বললো আপনার জন্য। শাহাদ অবাক না হয়ে মায়ের দিকে তাকালো।সুলতানা কবির হাসছে। একপেশে হাসি দিয়ে ঠোঁট কামড়ে হাসি সংবরণ করে শাহাদ বলে উঠলো,
– ধন্যবাদ।
– দেখবেন না?
– একেবারে বিয়ের দিন পরে দেখাবো। বসুন্ধরা বেছে বেস্ট জিনিসটাই নেয়া হবে জানি। সেটাকে এখন দেখে পরোখ করে অবমাননা করতে চাইছিনা। পরার পর প্রথমে আপনাকেই দেখাবো।
– অফ হোয়াইট স্যুট নিয়েছি।
– অফ হোয়াইট আমার পছন্দের রঙ,তবে অফ হোয়াইট স্যুট পছন্দ করা মানুষটা তার চেয়ে ঢের পছন্দের। আবারো শুকরিয়া।
দিয়া সকলের সামনে লাজুক লাজুক গাল নিয়ে মিষ্টি নিরব হাসি দিলো। সুলতানা উঠে গেলেন, এদের মাঝে থেকে আর লজ্জ্বা দিতে চাইলেন না। শিফা ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলে,
– ভাইজান সুন্দর…
– কী?
– প্রেম নিবেদন…
– শিফা…
শাহাদ চোখ রাঙাতেই শিফা কামরা ছাড়লো। দিয়া দেখলো আবির শেহজা দুজনই ঘুমিয়ে পড়েছে শাহাদের কোলে। আবিরকে কোলে নিয়ে শোয়ালো। শেহজাকে নিতে আসলে শাহাদ দাঁড়িয়ে পড়ে মেয়েকে কোলে নিয়ে। বাম হাতে হেঁচকা টান মেরে নিজের সাথে মিশিয়ে নিলো। বৃদ্ধাঙ্গুলের সাহায্যে দিয়ার পাতলা ঠোঁট স্পর্শ করতেই তিরতির করা কম্পন অনুভব করলো। পূর্ণ অনুভূতি নিয়ে বলে উঠলো,
– এই ঠোঁটে লেগে থাকা হাসি আপনার এমপি সাহেবের চোখে দেখা সেরা কয়েকটি নিদর্শনের একটি।
আঙুলের অবাদ বিচরণ ওষ্ঠ ঘিরে।বাক হারিয়ে নির্বাক, গলা শুকিয়ে কাঠ দিয়ার। মিনিট খানেকের মাঝেই স্বীয় নারীর ঠোঁট থেকে সেই বৃদ্ধাঙ্গুল সরিয়ে নিজের ঠোঁটে ছুঁইয়ে শব্দ করে চুমু খেয়ে বলে উঠলো,
– Sleep Tight Strawberry.
চলবে…