সায়রে গর্জন পর্ব-৫৬+৫৭

0
3

#সায়রে_গর্জন
#নীতি_জাহিদ
#গ্যালাপাগোস_ভ্রমণ
৫৬.
(অনুমতি ব্যতীত কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ)

দুপুরে লাঞ্চের পর কিছুক্ষন বিশ্রাম নিচ্ছে সকলে যে যার যার কামরায়। ছেলেরা সবাই ক্রুজের ছাদে। প্ল্যান করছে কোথায় স্কুবা করবে? গ্যালাপাগোসের অন্যতম বড় দ্বীপ ইসাবেলা। কাছাকাছি এসেই স্কুবা করার প্ল্যান। সন্ধ্যার আগেই কাছাকাছি চলে এসেছে ক্রুজ। শাহাদ নিচে নেমে তৈরি হয়ে নিলো। সাথে তৈরি হলো রকিব এবং রাহিল। রোকসানা শাহাদের কথায় রাজি হয়েছে। ক্রুজের ব্যালকনিতে এসে দাঁড়িয়েছে সবাই। স্কুবা গেট আপ নিয়ে তিনজনই লাফিয়ে পড়লো পানিতে। অন্যদিকে ক্রুজের কুক,ক্যাপ্টেন সহ প্রত্যেকে চিয়ার আপ করছে। শাহাদদের সাথে ক্রুজের স্টাফ ও গিয়েছে। শেহজা হাত তালি দিচ্ছে। প্রতীক্ষা এখন পাতালপুরীর গল্প শোনার।

গ্যালাপাগোসের ম্যারিন জগৎ নিয়ে যারা স্কুবা ডাইভারদের জানার আকাঙ্ক্ষা সীমাহীন। পছন্দের তালিকার শীর্ষে থাকে। গ্যালাপাগোস মেরিন রিজার্ভ বিশ্বের বৃহত্তম, শত শত বিভিন্ন প্রজাতির জন্য একটি অভয়ারণ্য, যার মধ্যে অনেকগুলি অত্যন্ত বিপন্ন। যদিও স্থলভাগের তুলনায় পানির নিচে কম এন্ডেমিজম রয়েছে, সেখানে গ্রীষ্মমন্ডলীয় এবং নাতিশীতোষ্ণ উভয় পরিবারের প্রজাতির একটি বিশাল বৈচিত্র্য রয়েছে, যা এই দ্বীপগুলিকে স্কুবা-ডাইভ করার জন্য বিশ্বের সেরা জায়গাগুলির মধ্যে একটি করে তুলেছে , সেই সাথে একটি চমৎকার বছরব্যাপী ডাইভিং করার উপযোগী করেছে।

রাহিল কিছুটা আতঙ্কিত হয়ে শাহাদকে অনুসরণ করছে। এখনো চারদিকে পানি। পেছন দিকে ঘুরতেই দেখতে পেলো উপরের সূর্যের আলো পড়ে চিক চিক করছে পানি। শাহাদ পানিতেই রাহিলের হাত ধরে এগুতে থাকলো। ফ্লিপার এর মতো পা চালাচ্ছে। স্কুবা কস্টিউম এর পদদ্বয় মাছের পাখনার মতো। খানিকটা নিচে নামতেই দেখতে পেল পাশ দিয়ে কিছু রঙ্গিন মাছ যাচ্ছে। পানিতে চিৎকার দেয়ার সুযোগ থাকলে রাহিল হয়তো আজ সজোরে চিৎকার দিয়ে বলতো এই মজার অভিজ্ঞতার কথা। এরপর আবার খানিকটা এগিয়ে গেলো। হঠাৎ রকিব কাছাকাছি এসে ডাকলো দুজনকে। বিশাল এক অক্টোপাস। রাহিল ভয় পেয়েছে। শাহাদ কাছে আগাতেই রাহিল এবং রকিব দুজনই আটকে দেয়। দুজনের কাউকে তোয়াক্কা না করে শাহাদ এগিয়ে যায়। এই দশ ফিটের অক্টোপাস যে কেউ দেখলো ঘাবড়ে যাবে। শাহাদ কি বুঝে এগিয়ে গেলো! অক্টোপাসটি বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে আছে। যেই মাছই কাছে যাচ্ছে তার আটপা দিয়ে মুড়িয়ে বিষ ছেড়ে দিচ্ছে। শাহাদ কাছাকাছি যেতেই এক পা দিয়ে শাহাদকে আক্রমণ করবে এর পূর্বেই শাহাদ ছিটকে গেলো। রাহিল আর রকিব ভীত হয়ে একপাশে সরে আছে। সেই স্ক্রুজের স্টাফ এন্ড্রু ও হাত নাড়িয়ে নিষেধ করছে। খানিকবাদে বুঝতে পারলো শাহাদের আগানোর কারণ। অক্টোপাসের পা মুড়িয়ে গিয়েছে একটা প্রবালে। সে কিছুতেই বের হতে পারছেনা। তাই সামনে যে আসছে ভাবছে তাকে আক্রমণ করবে, তার দিকেই বিষ ছুড়ছে। শাহাদ এগিয়ে পা খুলে দিতেই সরে গেলো প্রকান্ড দেহ নিয়ে। এটাই হয়তো একজন স্কুবা ট্রেইনারের বিশেষত্ব। অন্যদিকে মানব অক্টোপাস শাহাদ ইমরোজ হয়তো বুঝতে পেরেছিলো অক্টোপাসের দুঃখ। সমুদ্রের প্রাণিদের দুঃখ বুঝে প্রতিটি স্কুবা ডাইভার।

পুনরায় এগিয়ে গেলো, অনেক রকমের রঙ্গিন রুপচাঁদা মাছ দেখতে পাচ্ছে। এর পরই ঘটলো জীবনের সবচেয়ে আশ্চর্যজনক ঘটনা গ্যালাপাগোস হাঙর সামনে দিয়ে যাচ্ছে। শাহাদ,রকিব, এন্ড্রু মাঝখানে রাহিল একপাশে। ছেলেটা হাঙর দেখে বুদ্ধি হারিয়েছে মাস্ক সরিয়ে ফেলতে চেয়েছিলো। শাহাদ দ্রুত গিয়ে রাহিলকে কাছে টেনে স্থির করে ফেললো। একটি নয়,দুটি নয় মিনিমাম অর্ধশত হাঙর ঘুরে বেড়াচ্ছে চারপাশে। একটু পিছিয়ে শাহাদ খুব কাছ থেকে একটা হাঙরকে ছুঁলো। এত শান্ত, নমনীয় প্রাণি হয়তো দুটি নেই এই হাঙরকে দেখলে মনে হবে। অথচ এরা ততটাই হিংস্র রূপ ধারন করে প্রয়োজনে, যতটা কোনো প্রাণির প্রাননাশ হয়।

মাঝখানে ওরা তিনজন, আচানক সামনে এলো সী লায়ন। হাঙর গুলো সরে যেতেই যেই ঘটনা ঘটলো সী লায়ন পিছু ধরেছে ওদের। যদিও সী লায়ন কোনোভাবেই ক্ষতিকর নয় তবে ভয় পাইয়ে দিয়েছে রকিব এবং রাহিলকে। শাহাদকে কিছুতেই ছাড়ছেনা। এন্ড্রুসহ দ্রুত সেই জায়গা ত্যাগ করে এগুতেই সামনে দেখলো বড় বড় তারা মাছ যাকে ইংরেজি বলে স্টার ফিস। এক একটি তারা মাছ বেশ বড় এরপর কিছু বাঁদুড়ের মত ডানা মেলে যাচ্ছে। পানিতেও বাঁদুড়। আসলে তো এগুলো স্টিংগ্রে ফিস যাদের আমরা শাপলা পাতা মাছ হিসেবে চিনি। শাহাদ পানির মাঝেই উলটো ঘুরে গেলো। মাছ গুলোকে ফলো করেই আগাতেই দেখতো বেশ চমৎকার কিছু সামুদ্রিক প্রাণি। সব শেষে সেই কাঙ্ক্ষিত মুহুর্ত এলো। শাহাদ স্বচক্ষে দেখতে পেলো গ্যালাপাগোস বিখ্যাত হ্যামারহেড শার্ক বা হাতুড়ে হাঙর। যার মাথা দেখতে হাতুড়ির মত। এই হাঙর নিয়ে জানা অজানা রহস্যের শেষ নেই। অন্য হাঙরের চেয়ে এই হাঙর তুলনামূলক কম ক্ষতিকর। এরা ছোট মাছ শিকার করতে পছন্দ করে। পানির নিচে মানুষটার হাসি পর্যবেক্ষন করা সম্ভব হয়নি। তবে তার মনোবাসনা আজ কিছুটা পূর্ণ হলো।

ফিরে আসার পর পথ আটকালো সেই বিশালাকৃতির অক্টোপাস যার পা সুরক্ষিত করেছিলো শাহাদ। চারজনকে ঘিরে ঘুরছে সেই অক্টোপাস। সাথে আরো আছে তার পুরো দল। কিছুটা ভীত হলো রকিব রাহিল এবং এন্ড্রু। তবে শাহাদ এগিয়ে গিয়ে অক্টোপাসকে ছুঁয়ে দিতেই শাহাদকে আট পায়ে মুড়িয়ে ধরলো। বাকিরা ভয়ে পিছিয়ে গেলো। এমন পরিস্থিতির শিকার শাহাদ নিজেও কখনো হয়নি। ভয় না পেলেও হাত দিয়ে তিনজনকে চলে যেতে বললো। বাকি অক্টোপাস ওদের আক্রমণ করার আগেই চলে যাওয়া উচিত। সমুদ্র কতটা রহস্যময় আজকের ঘটনা না ঘটলে হয়তো অজানাই থেকে যেতো। শাহাদকে অক্টোপাস ছেড়ে দিলো। একই ভাবে আরো একটা অক্টোপাস এসে আটপায়ে ধরলো। শাহাদের তখন মনে হলো এরা তো আমাকে আক্রমণ করছে না। মানুষের মতো আলিঙ্গন করছে। চারজনকে ঘিরে হাজারো মাছ,অক্টোপাস খেলছে। মনে হচ্ছে সমুদ্রে তাদের জন্য কোনো উৎসব রেখেছে অক্টোপাসের পরিবার। তবে কি তখন বিপদ থেকে পরিবারের লোককে উদ্ধার করাতে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে এসেছে! এটা কি সম্ভব! সম্ভব। তখনই মনে হলো আরে আমি তো অন্য কোথাও নেই। আছি তো গ্যালাপাগোস যা ভ্রমণপিয়াসীদের জন্য স্বর্গ। এখানে তো কোনো প্রানী কারো ক্ষতি করেনা। এই অভিজ্ঞতা নিয়ে উপরে উঠে আসলো সকলে। প্রায় এক থেকে দেড় ঘন্টা পানির নিচে কাটিয়ে যখন উপরে উঠে এলো ক্রুজে মানুষ গুলো অপেক্ষা নিয়ে তাকিয়ে আছে। ক্রুজে উঠে চারজনই স্তব্ধ। স্কুবা কস্টিউম ছেড়ে লন এ বসেছে। রাহিল শাহাদকে সবার সামনে বললো,

– আংকেল এ আমি কি দেখলাম?

রকিব ও স্তব্ধ। বাক হারিয়ে নিস্তেজ হয়ে আছে। আদিত্য প্রশ্ন করলো,

– খারাপ কিছু দেখেছো?

রকিব মুখ খুললো,

– আদিত্যদা বিশ্বাস করেন, আমার জীবনে ঘটে যাওয়া সবচেয়ে আশ্চর্যজনক ঘটনা আজ ঘটেছে। আমি লাইভ না দেখালে আপনারা হয়তো বিশ্বাস ও করবেন না। আমি নিজেও না দেখলে বলতাম কেউ গাজাখুরী গল্প ছাড়ছে।

মল্লিকা, মনিরুজ্জামান প্রশ্ন করলো,

– কি ঘটেছে?

রাহিল বললো,

– অক্টোপাসকে শাহাদ আংকেল বিপদ থেকে উদ্ধার করেছে, ওটার পা আটকে গিয়েছিলো। যেন তেন অক্টোপাস নয়। বিশাল। আট/দশ ফিট। সেই অক্টোপাস আমরা আসার সময় পথ আটকে আংকেলকে পেঁচিয়ে ফেলেছে…

কথা শেষ হওয়ার আগেই রোকসানা চিৎকার দিয়ে বলে উঠলো,

– ইন্না-লিল্লাহ।

রকিব ধমকে বললো,

– থাম কিসের ইন্না-লিল্লাহ। অক্টোপাস শাহাদকে পেঁচায় নি। জড়িয়ে ধরে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে এসেছে। ইভেন তার পরিবার নিয়ে। আরো মাছ নিয়ে আমাদের ঘুরে খেলছিলো। ভাবতে পারছিস এমন ঘটনা? কল্পনা করতে পারছিস? আমি এক মুহুর্তের জন্য ভেবেছিলাম আজকে ম/রেই গেলাম বুঝি।যেভাবে শাহাদকে আট পায়ে পেঁচিয়েছে। ভয়ে আমি আর রাহিল ওখানেও শেষ।

দিয়ার শ্বাস আটকে আসছে। এদিকে শাহাদ মেয়েকে বুকে নিয়ে বউকে আগলে বসে আছে। কেমন যেন নিশ্চল। রকিব শাহাদের দিকে তাকিয়ে বললো,

– ভাই আজ যা যা দেখলাম পানির নিচে আমার মনে হলো আমি পৃথিবীর কোথাও এই সুখ পাবোনা। তোকে ধন্যবাদ দিলে কম হবে। তুই কিছু বল?

শাহাদ মুখ খুলে বলে,

– আমার জন্য প্রতিটি ঘটনাই উত্তেজনার ছিলো। তবে অক্টোপাসটা যা করলো আমি সারাজীবন মনে রাখবো। সম্ভবত পুরুষ অক্টোপাস হবে। পরের বার আমাকে যে ধরেছে তা নারী অক্টোপাস। স্বামী, বাবা ছাড়া কতটা অসহায় একটা পরিবার? অক্টোপাস হোক আর মানুষ, সকলের জীবনের ভিত্তি যে পুরুষ মানুষ আমি আজ টের পেলাম। একজন পুরুষ কতটা সৌভাগ্যবান জানিস? এরা বাবা মায়ের আদর পায়, সন্তানের,ভাই বোনের সম্মান পায়, স্ত্রীর ভালোবাসা পায়৷ কোথায় পাবো এমন বিরল চিত্র!! অক্টোপাসের কৃতজ্ঞতা কতটা মায়াময়, ভালোবাসাময় ছিলো বলতো!

দিয়া হেসে বলে,

– তাহলে তো আমার পানির নিচে যাওয়া উচিত ছিলো। অক্টোপাসের চেয়ে যন্ত্রনা বেশি তো আমি ভোগ করেছি অনেক মাস। যখন কেউ ছিলোনা পাশে। বাবা নেই, ভাই নেই, স্বামী অসুস্থ সিঙ্গাপুর। ভাবুন তো কতটা অসহায় কেটেছে একেকটা দিন?

___

ঘড়িতে সন্ধ্যা সাতটা। অফিস থেকে বেরিয়েই হাসপাতালের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। বিয়ে হয়েছে আজ দশদিনের ও বেশি সময় পেরিয়েছে। স্বাভাবিক সবকিছুর মাঝেও অস্বাভাবিকতা পরশ রয়েই গেলো। হাসপাতালের নিচে শিউলী গাছটাতে ফুলে ফুলে ভরা। শ্বাস টানতেই মনে হয় কত মায়া। কল দেয়া হয়েছে ডাক্তার তাহিকে। উঠায় নি হয়তো ব্যস্ত। একটা মেসেজ দিয়ে বাইকের নিচে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আজই বাইক নিয়ে বেরিয়ে প্রায় অনেক মাস পর। এক্সিডেন্টের পর কেউ বাইক ছুঁতে দেয়নি। ভাইজান দেশের বাইরে সেই সুযোগে গ্যারেজে সকালে বলেছে বাইক ঠিক করে অফিসে দিয়ে আসতে। ফোন হাতে নিতেই অপরিচিত আইডি থেকে বন্ধু রিকুয়েস্ট পাঠানো হয়েছে ফেসবুকে। হালকা হাসলো লিমন। বেশি না বছর খানেক আগেও এসব রিকুয়েষ্ট দেখলে মজা নেয়ার সুযোগটা এক বিন্দু ছাঁড় দিতো না। অথচ আজ সেদিকে মনই টানে না। ভাবতে ভাবতে চা নিয়ে যাচ্ছে একজন। তাকে থামিয়ে এক কাপ লেবু চা করে দিতে বললো। অফিস থেকে বের হতেই শরীরটা ভালো ঠেকছেনা।

চা মুখে দিতেই ফোন বেজে উঠলো। তাহি ফোন দিয়েছে। রিসিভ করতেই বললো,

– উপরে এসে বসুন। আমার আরো কিছুক্ষণ সময় লাগবে।

– আচ্ছা, আমি আছি। আপনার হলে জানাবেন।

– হুম।

সংযোগ বিচ্ছিন্ন হলো। চা খেয়ে চা ওয়ালার মামার সাথে গল্প জুড়ে দিলো। হাসপাতালের কেয়ারটেকার ও যোগ দিলো। লিমনকে চেনে। প্রায় দেখে তাহি ম্যাডামকে নিতে আসে। প্রশ্ন করেনি কখনো। আজ সাহস করে বললো,

– স্যার একটা কথা জিজ্ঞেস করি যদি আপনে অনুমতি দেন আর কি?

– জ্বি চাচা বলুন।

– তাহি ম্যাডাম আপনের কি লাগে?

লিমন হেসে দিলো। জবাবে বললো,

– চাচীর নাম কি চাচা?

– জ্বে আমার বউয়ের নাম?

– জ্বি।

– লতা।

– আচ্ছা। লতা চাচী আপনার যা হয় তাহি ম্যাডাম ও আমার তা হয়।

– ইয়া আল্লাহ! কি কন তাহি ম্যাডাম বিয়া করছে?

– হ্যাঁ কিছুদিন হলো। দোয়া করবেন আমাদের জন্য।

– অবশ্যই দোয়া স্যার। কি যে মন খুশি লাগতাছে। তাহি ম্যাডাম অনেক ভালা। আপনারা সুখী হন। বহুত কষ্ট করছে ম্যাডাম এত বছর। আমার মন থেইকা দোয়া ম্যাডামের লাইগা।

লিমন দেখলো তাহির বেশ সময় লাগছে। বাইক পার্ক করে উপরে চলে এলো। ওয়েটিং চেয়ারে বসে অপেক্ষা করতেই পাশ দিয়ে দুজন নার্স ফিসফিস করে বললো,

– ডাক্তার তাহির হাসবেন্ড। উনার থেকে বয়সে ছোট। শেষমেষ ছোট টা ধরছে।

লিমনের মনোযোগ ফোনে ছিলো। কর্ণকুহরে কটু কথা আসতেই চোখ পাকিয়ে তাকালো নার্সের দিকে। নার্সের সামনে গিয়ে শীতল কন্ঠে বললো,

– নার্স আমাকে কি আপনার অসুন্দর মনে হয়?

থতমত খেয়ে গেলো নার্স দুজন। পাশে ছিলো রিসিপশনিস্ট। নার্স তোতলে বললো,

– আমি তো ওভাবে মানে আপনি যা বলতে চাইছেন তা বলিনি।

– কি বলতে চাইছি আমি আপনিই বলুন?

– স্যরি স্যার।

– আমি দেখতে খুব সুন্দর আমি জানি। ইভেন খুব ভালো মেয়ে পটাতে পারি। আমার হাসি সুন্দর। আপনিও কাত আমার হাসিতে আমি এটাও জানি। তাহলে বুঝে নিন ডাক্তার তাহি ঠিক কতটা মনোমুগ্ধকর সৌন্দর্য্যের অধিকারী হলে আমি পাগল হয়ে যাই। আমার স্ত্রীর নামে কিছু বলার আগে ভেবে বলবেন। আমার পছন্দ নয়।

– জ্বি স্যার।

– গুড।

– মিস্টার লিমন?

রিনরিনে আওয়াজ পেয়ে ঘাড় ঘুরালো লিমন। ক্লান্ত,পরিশ্রান্ত স্ত্রীকে দেখে কষ্ট লাগলেও সারাদিনের পরিশ্রম সব যেন উবে গেলো। হেসে সামনে এগিয়ে বললো,

– কাজ শেষ?

– ওটি করেই বের হলাম। চলুন। কি করছিলেন ওখানে?

– ভাবছিলাম ডাক্তার দেখাবো তাই নার্সদের সাথে আলোচনা করছিলাম।

উপস্থিত সকলে চেহারায় এমন চোর চোর ভাব আনলো দেখেই বুঝা যায় সুযোগ পেলেই এরা চোগলখোরিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।

তাহি হেসে বললো,

– কিসের ডাক্তার? এখনো আছে কিছু ডাক্তার। চলুন দেখিয়ে নিবেন।

– অসুখ তো সেরে গিয়েছে।

তাহি ভ্রু কুচকে বললো,

– কি বলছেন?

– আপনাকে দেখলাম, দু চোখ জুড়ালো, বুকের ভেতর খরস্রোতা নদী শান্ত হলো। হৃদয় গেয়ে উঠলো,

সেদিনও বুঝিনি আমি যে চোখে পড়েছি ধরা
এভাবে আমার হয়ে যাবে
আলগোছে পায়ে পায়ে যে কবিতা হলো শুরু
এভাবে মলাট খুঁজে পাবে।

তাহি লজ্জা পেয়ে গেলো সকলের সামনে। লিমনকে ছেড়ে সামনে এগিয়ে এলো। তাহি এগুতেই লিমন ওদের দিকে তাকিয়ে বললো,

– গানটা সুন্দর না? বাকিটুকু ভুলে গিয়েছি নতুবা পুরোটাই গেয়ে শোনাতাম আপনাদের।

হেঁটে চলে গেলো সামনে। পেছনে রাখা মানব মানবীদের মুখ ছিলো দেখার মতো। পুরুষ নার্স হালকা হেসে বলে,

– তোদের দুটোর উচিত শিক্ষা হয়েছে। যখনই দেখি ওর নামে এর নামে বলতে ব্যস্ত। দাড়া স্যারকে বলব তোদের নামে।

নিচে নামতেই লিমন বাইক বের করলো। বাইক দেখে তাহি চটে গেলো। যাবেনা গো ধরে বসে আছে। লিমন অনেক বুঝিয়ে বললো,

– শুধু আজকের জন্য। যদি সঠিক ভাবে না চালাতে পারি, ওয়াদা করছি আপনি যেভাবে বলবেন ওভাবে হবে।

তাহি লিমনের দিকে তাকিয়ে বললো,

– আমি বাইকে বসতে পারিনা।

লিমন হেসে বললো,

– বসে শক্ত করে আমাকে ধরুন। বাকিটুকু আমি সামলে নিবো।

লিমন ব্যাগ থেকে তাহির জন্য হেলমেট বের করে পরিয়ে দিলো। জীবনে প্রথমবারের মতো তাহি বাইকে চেপে বসলো। প্রথমে লিমনকে না ধরলেও ভয়ে চেপে ধরলো। বাইক স্টার্ট দিলো। আরো জোরে চেপে ধরলো। বেশ রাত হয়েছে। গলির রাস্তা ধরলো। পুনরায় গলা ছাড়লো,

সেদিনও বুঝিনি আমি যে চোখে পড়েছি ধরা
এভাবে আমার হয়ে যাবে
আলগোছে পায়ে পায়ে যে কবিতা হলো শুরু
এভাবে মলাট খুঁজে পাবে।

তাহির খুব পছন্দের একটি গান। শিরশিরে হাওয়া লাগছে। শীত শীত প্রকৃতি। চোখ বুজে তাল মিলিয়ে গেয়ে উঠলো,

– হাওয়া কেন চেনা আঙুলে?
হাওয়া কেন আমাকে ছুঁলে?
আমিও কি পড়েছি প্রেমে অকারণ?
হাওয়া কেন চেনা আঙুলে?
হাওয়া কেন আমাকে ছুঁলে?
আমিও কি পড়েছি প্রেমে অকারণ?

চলবে…

#সায়রে_গর্জন
#নীতি_জাহিদ
#গ্যালাপাগোস_ভ্রমণ
৫৭.
(অনুমতি ব্যতীত কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ)

ক্রুজ এখন ইসাবেলা দ্বীপে। রোদ – বৃষ্টি আবহাওয়া। সব মিলিয়ে পরিবেশে স্বচ্ছতা। কোথাও রোদ, কোথাও শীতল। তুলনা মূলক উত্তাপ বেশী। পুরোনো প্রবালে ঘেরা ইসাবেলা দ্বীপ। একেকটি দ্বীপের বয়স কম হলেও প্রায় পঞ্চাশ লক্ষ বছর। সবচেয়ে নব্য দ্বীপের বয়স সাত থেকে আট লক্ষ বছর। নতুন দ্বীপ গুলো নাব্যতা পেয়ে বেড়ে উঠছে পুরোনো দ্বীপ গুলো তলিয়ে যাচ্ছে। পৃথিবীর প্রথম ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইড এই গ্যালাপাগোস দ্বীপ পুঞ্জ। গ্যালাপাগোস দ্বীপপুঞ্জের উপর দু ধরনের কারেন্ট বা স্রোত আছড়ে পড়ে। দুটোই এর জীববৈচিত্রে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলে। একটি হলো পানামা কারেন্ট যা উষ্ণ স্রোত এবং অন্যটি হাম্বল্ট কারেন্ট, শীতল স্রোত বিশিষ্ট। গ্যালাপাগোসে দ্বীপের সংখ্যা সুনির্দিষ্ট নয়। ধারণা মতে গ্যালাপাগোসে প্রায় একশ সাতাশটি দ্বীপের হদিস পাওয়া গেলে বসতি রয়েছে তিন বা চারটি দ্বীপে। বাকি দ্বীপ গুলোকে ইকুয়েডরের জাতীয় উদ্যান হিসবে ঘোষনা করা হয়েছে।

গ্যালাপাগোস এরিয়া ইকুয়েডর সরকার কতৃক কঠোরভাবে সংরক্ষিত। পর্যটকটদের জাহাজে বা ক্রজেই অবস্থান করতে হয়। সেই ব্যাপারে ও কঠোর নিয়ম মেনে চলতে হয়। গ্যালাপাগোস সারা বছর ভ্রমণের জন্য উপযোগী। বিষুবরেখা উপর দিয়ে যাওয়ার কারণে এই অঞ্চলে দিন ও রাত সমান। বারো ঘন্টা দিন এবং বারো ঘন্টা রাত হয়ে থাকে। তাপমাত্রা ও থাকে স্বাভাবিক। স্থলভাগে তাপমাত্রা প্রায় ২৫/২৬° সেলসিয়াস এবং জলভাগে ২১/২২° সেলসিয়াস। ক্রুজ থেকে নেমে শাহাদ ইসাবেলার মাটিতে পা রাখতেই চোখ বুজে শ্বাস নিলো। কি স্নিগ্ধ মনোমুগ্ধকর সৌন্দর্য্যের পরিবেশ। মেয়েকে কোলে নিয়েই সামনে আগালো। পেছনে তার দল। মাথার উপর সাই সাই করে উড়ে বেড়াচ্ছে পাখি। গ্যালাপাগোসের পাখি। দূরে কিছু পাহাড়। রাহিল এগিয়ে এসে বললো,

– দেখো এখানে পাহাড় ও আছে। কিন্তু সবুজ না।

শাহাদ হেসে বলে,

– এগুলা পাহাড় না বেটা, আগ্নেয়গিরি।

– এটা কি?

শাহাদ হতবাক। রোকসানাকে ধমকে বললো,

– বুঝলাম ইংলিশ মিডিয়ামে দিয়েছিস? বাংলাটা শেখাতে পারিস নি এত বয়সেও। কয়েক বছর পর তো বিয়ে দিবি। কি ধরনের কথা এগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে আগ্নেয়গিরি কি জানেনা?

রোকসানা ছেলের দিকে কটমট করে তাকিয়ে আছে। শাহাদ রাহিলের দিকে তাকিয়ে বললো,

– It’s Volcano. Which is an opening of earth surface. It’s actually a rapture in the crust and finally the magma comes out with a huge eruption. Do you know what is magma?

– জ্বি জ্বি জানি। আসলে স্যরি আংকেল আমি আগ্নেয়গিরি কি শুনেছি কিন্তু ভুলে গিয়েছি ভলক্যানোকেই আগ্নেয়গিরি বলে।

মাকে বকা দেওয়াতে ব্রেইনকে ভালো করে স্ট্রর্ম করে রাহিল বুঝতে পেরেছে এই শব্দ তার পরিচিত। মাঝে মাঝে বাংলা পড়া উচিত বলে আজ আবশ্যিক মনে হচ্ছে। নতুবা শাহাদ আংকেলের মতো মানুষের খপ্পরে পড়লে জান শেষ। ভাগ্যিস এখানে ইনায়া ছিলো না। ছিঃ ছিঃ সদ্য সদ্য প্রেম হয়েছে। হিরো হিরো ভাব ধরা ছেলেটার এই হাল দেখলে আজই ব্রেক আপ হত।

পায়ের কদম অগ্রসর হলো। হাঁটতে হাঁটতে শাহাদ বললো,

– রাহিল, তোমাকে প্রশ্ন করতে আমি বাঁধা দি নি। চুপ হয়ে থাকবে না। যা জানতে চাও জিজ্ঞেস করবে। কিন্তু বাবা মাঝে মাঝে বাংলা চর্চা ও ভালো। আমাদের ভাষা খুবই চমৎকার। তুমি কি জানো পৃথিবীর আরো একটি দেশের মানুষের ভাষা বাংলা? যারা সম্মান করে আমাদের ভাষাকে। ২০০২ সালে বাংলাকে তাদের সরকারি ভাষার তালিকা ভুক্ত করা হয়।

– না তো আংকেল। কোন দেশ?

– সিয়েরা লিওন।

রাহিলের মুখে হাসি। নতুন একটা তথ্য পেয়েছে। একাডেমিয়াতে পড়ার সুবাধে অনেক ইনফোরমেশন জানা ছিলো না বাংলা সম্পর্কে। নিজ থেকে তথ্য ভান্ডার সমৃদ্ধ করার জন্য তেমন কোনো বইয়ের সাথে লেনদেন ছিলো না ফলশ্রুতিতে আজ অনেক সাধারণ প্রশ্নই তার অজানা। হঠাৎ প্রশ্ন করলো,

– আংকেল এখনো কি ম্যাগমা বের হয়?

– ম্যাগমা শেষ বার ইসাবেলা দ্বীপে বের হয়েছিলো ২০১৮ তে। তবে বেশ সক্রিয় এই আগ্নেয়গিরি গুলো।

বাকিরা অনেকেই জানে,আবার বাকিরা জানে না। বেশ মনোযোগ দিয়ে শুনছে। আদিত্য বলে উঠলো,

– শাহাদ ভাই এমন ভাবে বলছেন প্রতিটি কথা মনে হচ্ছে আপনি বেশ কয়েক বার এসেছেন।

শাহাদ হেসে বলে উঠলো,

– বেশ কয়েকবার আসিনি তবে কিছু জানি। যা জানি খুবই সামান্য জানি।

কিছুদূর এগিয়ে যেতেই রকিব শাহাদের কাছে এলো। কানের কাছে ফিসফিস করে কি যেন বললো। শাহাদ খানিকটা হেসে সায় দিলো। সামনে কদম বাড়াতেই একটার পর একটা প্রানী দৃশ্যমান হতে শুরু হলো। প্রথমে যা দেখতে পেলো তা হলো,

গ্যালাপাগোস বিখ্যাত জায়ান্ট টরটয়েজ। এত বড় কচ্ছপ জীবনে প্রথমবার দেখেছে সকলে। মিনিমাম দূরত্ব ছ ফিট। দৈর্ঘ্যে প্রায় পাঁচফিট। দিয়া দেখে ভয় পেয়ে শাহাদের পেছনে লুকালো। শাহাদ ঠোঁট টিপে হাসছে। এখানে আসার আগে যেন কি বলেছিলো? ভয় পাওয়ার কি আছে। কচ্ছপ টা ওদের দিকে এগিয়ে আসছে। রোকসানা এবং মল্লিকা রীতিমতো চিৎকার দিয়ে লাফিয়ে উঠলো। এদের এভাবে ভয় পেতে দেখে রাহিল আঁৎকে উঠলো। ভয়ের তোড়ে উলটা পালটা ভুল ভাল ইংলিশ বকতে শুরু করলো,

– ইট ইজ সো বিগ, আংকেল প্লিট লস্ট ইট, আরেহ না আংকেল সরান। হোয়াই ইট ইজ সো বিগ। মাম্মা বাঁচাও। এটা এভাবে হাঁটছে কেনো?

আদিত্য, রকিব এবং মনিরুজ্জামান হাসতে হাসতে মাটিতে বসে পড়েছে। অদ্ভুত ভাবে কচ্ছপের কোনো হেলদোল নেই। শাহাদ অনেকটা সেদিকে এগুতেই দিয়া চেঁচিয়ে বললো,

– এমপি সাহেব, প্লিজ সামনে যাবেন না। আমার মেয়েটা ভয় পাবে। আমার হার্টবিট বেড়ে যাচ্ছে। শেহজার বাবা প্লিজ আগাবেন না।

দিয়ার চেঁচামেচিতে শাহাদ থেকে ওর দিকে তাকিয়ে হেসে বললো,

– ভয় পাচ্ছো কেনো? কিছুই করবে না। ওরা মানুষ ভয় পায় না বোকা মেয়ে। তুমি আছো না, কি আছে তা ওদের ধ্যানেই নেই। পৃথিবীতে একমাত্র গ্যালাপাগোসের প্রাণীরাই এমন ভীতিহিন হয়৷ মানুষ ছাড়া পৃথিবী লক্ষ্য বছর আগে কেমন ছিলো তা আজ দেখাবো তোমাদের। আমাদের এরা কোনো ক্ষতিই করবে না।

কচ্ছপটা পথ বদলে চলে গেলো আপন পথে। আর কিছুটা পথ হাঁটতেই দেখতে পেলো সাদা সাদা এক ঝাঁক পাখি উড়ে যাচ্ছে। ঠিক তখনই রাকিব চিৎকার দিয়ে বললো আলবাট্রস। রাহিল এবং রকিব ছবি তুলতে ব্যস্ত। শাহাদ তাকিয়ে আছে সেই পাখিটির দিকে যে ইতিহাস স্বাক্ষী। রাইম অফ দ্য এনশিয়েন্ট মেরিনার বইয়ে মেরিনারদের জীবনে সকল দুঃখ দূর্দশার কারণ। উড়ে গেলো পাখি গুলো। প্রায় ৫৬ প্রজাতির পাখি আছে যার মাঝে ৪৫ প্রজাতি বিশ্বের আর কোথাও নেই। এদের দেখতে হলে আসতে হবে গ্যালাপাগোস। এরপর এলো রঙ বেরঙের কাকড়া। বিশাল বিশাল সাইজের এই কাকড়া দেখতে ভয়ানক। মনে হয় যেন সামনে গেলেই ধারালো খুরের মতো পা দিয়ে কেটে দিবে। একটু সাবধানে এড়িয়ে চললো সকলে।

হঠাৎ শাহাদের মনে হলো পাশ দিয়ে কিছু একটা ছুটে গেলো। ছুটে যাওয়ার চেয়ে ও বড় কথা আশেপাশের মানুষ গুলো আতঙ্কে চিৎকার দিয়ে উঠলো। কিছুক্ষন পর শাহাদের উপলব্ধি হলো এটা তো মারাত্মক জিনিস? শাহাদ উত্তেজনায় বললো,

– ওহ মাই গুডনেস। ইট’স গ্যালাপাগোস পেঙ্গুইন।

দিয়া ভীত গলায় বললো,

– ইয়া আল্লাহ পেঙ্গুইন যে গরমের দেশেও থাকে এখানে না আসলে জানতাম না।

শাহাদ হেসে বললো,

– এটাই একমাত্র পেঙ্গুইন যা এখানে পাওয়া যায়। ধারণা করা যায় হাম্বল কারেন্টের সাথে এসব পেঙ্গুইন এন্টার্কটিকা থেকে এসে পড়েছে। আরো অনেক প্রাণী এখানে পাওয়া যায় যা পৃথিবীর অন্য জায়গায় বিলুপ্ত প্রায়।

কথা বলতে বলতে বসে পড়লো প্রবালের উপর। সময় গড়িয়ে গিয়েছে। ক্লান্ত হয়ে ক্রুজের কুককে জানালো এখানে কিছু ড্রিংক্স দিয়ে যেতে। সেই হিসেবে কুক সকলের জন্য কোকোনাট লাইম ড্রিংক্স এর আয়োজন করেছে। খেতে খেতে ছোট খাট প্রাণী কচ্ছপদের দৌঁড়ঝাপ দেখছে। সারাদিনের ক্লান্ত শ্রান্ত শরীরে রাজ্যের ঘুম আসছে দিয়ার। মাটিতে বসতেই সকল দ্বিধা ভুলে শাহাদের কাঁধে মাথা এলিয়ে দিলো। কিছুটা হতচকিত হলো শাহাদ। সকলের সামনে তো মেয়েটা এমন আচরণ করে না। প্রথমে কিছু না বললেও দিয়ার নিরবতা টের পেয়েই দেখলো মেয়েটা ঘুমিয়ে পড়েছে৷ রোদের উত্তাপ ও আছে ভালোই। শেহজাকে ক্রুজে নিয়ে খাওয়াতে হবে। মেয়েটা ইচ্ছেমতো দৌঁড়েছে, খেলেছে। শাহাদ মেয়ের অনেক ভিডিও চিত্র বানিয়েছে। রাহিলের সাথে অনেক ভাব হয়েছে শেহজার। তবে শেষের দিকে রাহিল মজা করে শেহজার চকলেট খেয়েছে। মেয়েটা চিৎকার দিয়ে রাহিলের চুল ছিড়ে দিয়েছে। দিয়া বকেছে। বাবার কাছে নালিশ দিয়ে বলেছে,

– বাবা মা পতা, মাকে ভাউ লাগাও।

দিয়া পেঙ্গুইন দেখে ভয় পেয়েছে এখন মেয়েও তা নিয়ে মজা নিচ্ছে। পেঙ্গুইন এর নাম দিয়েছে ভাউ। শাহাদ মেয়ের সাথে খেলতে খেলতে বাস্তবে দিয়াকে পেঙ্গুইনের ভয় লাগিয়েছে। দিয়া গাল ফুলিয়ে গত আধঘন্টা কথাই বলে নি শাহাদের সাথে। সেই খুনশুটি দেখে মনিরুজ্জামান বার বার বলছে,

– এবার দেশে ফিরে একটা বিয়ে করবোই। এরকম একটা শেহজা আমার লাগবেই যাতে তার মাকে ভাউ লাগাতে পারি।

সকলে হো হো করে হাসছে। শাহাদের পিঠে হেলান দিয়ে পুরোপুরি ঘুমে আচ্ছন্ন হলো শাহাদপ্রিয়া। রোকসানার কোলে মেয়েকে দিয়ে দিয়াকে কোলে তুলে নিলো শাহাদ। পুনরায় সকলে ক্রুজে ফিরে গেলো।

___

নওরীনের দুচোখে খুশির পানি। সকাল থেকে নিজে নিজে বহুবার কেঁদেছে। শাহীন এখনো বাসায় ফিরেনি। ফোনে এমন ঘটনা বলার আনন্দ কোথায়? কারো সাথে এই ঘটনা প্রথম শেয়ার করতে চাচ্ছেনা। অশ্রু মুছে কলিংবেল বাজায় দরজার দিকে গেলো৷ দরজা খুলতেই শাহীনকে দেখে সোজা নিজের কামরায় ফিরে এলো।

বেশ কিছুক্ষন পর সবার সাথে দেখা করে শাহীন কামরায় এলো। হাতে রিপোর্ট টা ধরিয়ে দিলো। পকেট থেকে ওয়ালেট বের করে ড্রেসিং টেবিলে রাখলো। টুল টেনে বসে রিপোর্ট টা খুটিয়ে খুটিয়ে দেখছে। অকস্মাৎ কিছু একটা দেখে থমকে গেলো। চোখ কচলে পুনরায় দেখলো। এমন ভাবে চিৎকার করে উঠলো মনে হলো ভুত দেখেছে। বাড়ির বাকিরা ছুটে এসেছে রুমে। এদিকে নওরীন তাজ্জব বনে গেলো। কানে তালা লাগিয়ে দিলো চিৎকারে। রায়হান সাহেব, সুলতানা কবির ছেলের সামনে এসে বুকে হাত দিয়ে ভয় পাওয়ার ভঙ্গিতে বললো,

– কি হলো শাহীন, চিৎকার দিলে কেনো?

শাহীন ভাষা হারিয়ে ধপ করে বসলো। বাবার হাতে রিপোর্ট ধরিয়ে দিলো। রায়হান সাহেব রিপোর্ট পড়ে হাসছে। সুলতানা কবির কেড়ে নিলো রিপোর্ট। উনি পড়ে রিপোর্ট শেফালীর হাতে ধরিয়ে নওরীনের কাছে গিয়ে নওরীনকে জড়িয়ে ধরলেন। নওরীন শাহীনের চিৎকার শুনে ভুলে গিয়েছে উচ্ছ্বাস প্রকাশের ভাষা। সুলতানা কবির ছেলের বউয়ের কপালে চুমু দিয়ে বললেন,

– আলহামদুলিল্লাহ। আল্লাহ সকল বদ নজর থেকে রক্ষা করুন আমার ঘরের সম্পদদের।

গলা থেকে চেইন খুলে সরাসরি ছেলের বউয়ের গলায় পরিয়ে দিলেন। রায়হান সাহেবের দিকে তাকিয়ে বললেন,

– বাবুর বাবা, বাবুকে লাইনে পেলে বলবে যেন ফেরার পথে বড় বাবা হওয়ার খুশিতে কিছু নিয়ে আসে নতুন অতিথির জন্য।

রায়হান সাহেব সম্মতি দিয়ে মাথা ঝাকালেন। সকলে একা রেখে গেলো দম্পতিকে। শাহীন বউকে জড়িয়ে ধরে বললো,

– নিরা আমি অনেক খুশি। কিভাবে তুমি সারাদিন না জানিয়ে থাকতে পারলে?

– এভাবে চিৎকার দিয়ে লজ্জায় ফেললে কেনো?

– জানিনা, আমি ভেতর থেকে এত খুশি হয়েছি, সামলাতেই পারলাম না। স্যরি কষ্ট দিলে। আচ্ছা শুনো না আমাদের কি হবে? প্রিন্স না প্রিন্সেস?

নওরীন হেসে লাজুক স্বরে বললো,

– জানিনা। আল্লাহ যা দিবেন তাতেই সন্তুষ্ট আমি।

– ইনশাআল্লাহ।

শাহীন নওরীনকে কোলে তুলে আনন্দে মেতে উঠেছে। মম আনচান করছে ভাইজানকে তাক লাগিয়ে দেয়ার জন্য। শেহজার ভাই বোন আনতে বলেছিলো। সে নিয়ে আসছে। এবার শাহীন জিতে গিয়েছে।
___

আজ মন্ত্রী পরিষদ আলোচনায় বসেছে, উপস্থিত স্পিকার সহ বিশিষ্ট গণ্যমান্য সকল নেতা ও ব্যক্তিবর্গ। কিছুক্ষন আগেই অস্বাভাবিক এক ঘটনা ঘটেছে। আলোচনায় বানিজ্য মন্ত্রী, নব নিযুক্ত স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী সহ অন্যান্য মন্ত্রী ও এমপিদের ক্ষোভ প্রকাশ। এমন একটা ঘটনার শিকার হবে কেউ বুঝতেই পারেনি৷ স্পিকার চিঠি যোগে পাঠানো পদত্যাগ পত্র হাতে নিয়ে বসে আছে। সকলের মনে আশঙ্কা। কেবল প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় আজ নিরব ভূমিকা পালন করছে। তিন বাহিনী প্রধানের সাথে জরুরি সাক্ষাৎকারে বসতে চান প্রধানমন্ত্রী। প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব সকলের থেকে নিজেকে আড়াল করে রেখেছেন। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নিজে দায়িত্ব পালন করছেন এই মন্ত্রণালয়ের। পূর্ববর্তী প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করে পুরো দলকে বিপদে ফেলে পলাতক । তখনই আশার আলো জাগিয়ে দলের বুদ্ধিমান চৌকশ মন্ত্রী আসন গ্রহন করেন।প্রতিটি পদক্ষেপ নতুন সরকারকে সাবধানে ফেলতে হচ্ছে। আলোচনা শেষে প্রধানমন্ত্রী জানালেন,

– চিন্তা এখন আমার। আপনাদের চিন্তা করার কারণ নেই। নিজ নিজ মন্ত্রনালয় সুরক্ষিত রাখুন। কখন কোন দানব জেগে উঠে আপনাদের পাকা ধানে মই দিবে বলা যায় না।

চলবে…

[নোট: বানান ভুল থাকলে অবশ্যই জানাবেন ইনবক্সে]