সায়রে গর্জন পর্ব-৬+৭

0
9

#সায়রে_গর্জন
#নীতি_জাহিদ
৬.
( অনুমতি ব্যতীত কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ)

একবছরের একটা মেয়েকে মা চেয়ারে বসিয়ে অন্যদের সাথে গল্প করছে। ফুটফুটে মেয়ে, গোল গোল চোখ।হাসলেই মনে হয় হাতছানি দিয়ে ডাকছে। মা আর মেয়ের দূরত্ব প্রায় দু হাত।মেয়েটির হাতের খেলনাটি নিচে পড়ে গিয়েছে।মায়ের সেদিকে খেয়াল নেই। মেয়ে খেলনা নেয়ার জন্য নিচে নামার চেষ্টা করছে।আরেকটু পেছনে গেলেই পড়ে মাথা ফেটে যাবে। চেয়ারের সামনে ক্যামেরার প্লাগ এবং বিদ্যুৎ সংযোগের সকল তার। এমন দুঃসহ মুহুর্তে কি করে মা অমনোযোগী হতে পারে। বিবেক কি করে দিলো এই জায়গায় চেয়ারে মেয়েটাকে বসানোর জন্য! এতটাই কেয়ারলেস!

প্রায় অনেকেই থমকে গিয়েছে অথচ মেয়ের মায়ের হুঁশই নেই, গল্প করেই যাচ্ছে। মেয়েটা পড়েই যাচ্ছে প্রায়। শাহাদ পায়ের স্পিড বাড়িয়ে দিলো। এতটা তীব্র গতিতে রেস ও লাগায় নি কখনো। বাঘের গতির মত ক্ষীপ্র দৌঁড়। ওয়েটাররা ভয় পেয়ে ছিটকে গিয়েছে। বরের জিনিস পত্র রাখার জন্য ডেকোরেশন টেবিল ছিলো সামনে,ওটার উপর উঠে লাফ দিয়ে একটা চেয়ারে পা দিলো ,আরো দুটো চেয়ার অতিক্রম করলো দুই লাফে। সোজা রাস্তায় হাঁটার উপায় নেই এত মানুষ। কৌতুহলী মানুষ না সরে ভিড় করছে। অনেকের চক্ষু ছানাবড়া। একেবারে সন্নিকটে এসে মেয়েটাকে ধরে ফেললো, হাতের বাহুতে ধরে এক টানে কোলে তুলে নিলো। এমন ভাবে ধরলো বাচ্চাটাকে, বাচ্চা থেকে ইলেকট্রিক প্লাগের দূরত্ব চার কি পাঁচ ইঞ্চি। বুকে জড়িয়ে ধরলো ছোট্ট পুতুলটাকে। সাথে সাথে ভয় পেয়ে চিৎকার দিয়ে কেঁদে উঠলো বাচ্চামেয়েটা । শাহাদের দম আটকে গিয়েছে। এই বাচ্চা মেয়েটার জায়গা অল্প কিছুক্ষনের জন্য হলেও শেহজাকে কল্পনা করে ফেলেছে। আজ বুঝতে পারছে মেয়েটা ওর জন্য কি? বুকের ধুকপুকানি এখনো কমে নি। উপস্থিত প্রত্যেকে মুগ্ধ হয়ে দেখছে শাহাদকে। মেয়ের মায়ের চোখে পানি। মা এগিয়ে আসতেই শাহাদের কাছে মেয়েকে চাইলো। বুক থেকে সরিয়ে মেয়েকে মায়ের কাছ দিতেই বলে দিলো,

– সাবধানে।

অন্য সময় হলে এই মহিলার মেয়েলী গালে হয়তো নিজের পাঁচ আঙুল বসাতো। এই অবস্থায় নিজেই স্থির নেই।সেখানে অন্য কিছু মাথাতেই আসছেনা।শাহাদ জায়গায় দাঁড়িয়ে স্তব্ধ।কি ঘটে যেত! সকলে শাহাদের কাছে এগিয়ে এলো। চারদিকে গুঞ্জন। শাহাদকে বাহবা দিচ্ছে। প্রবল বিরক্ত শাহাদ। মানুষের দু মুখো রূপ।খেয়াল অনেকেই করেছে। দায়িত্ব নিয়ে এগিয়ে যায়নি বাচ্চাটাকে ধরতে। এলিন,রোকেয়া আক্তার ও এলো। শাহাদ পকেট থেকে ফোন বের করে বাসায় ফোন দিচ্ছে। কেউ ফোন ধরছে না। ল্যান্ডলাইনে ফোন দিলো তবুও ফোন ধরছেনা। উপায় না পেয়ে ফোন দিতে গেলো দিয়াকে। কিন্তু দিয়ার ফোন নাম্বার যে ফোনে নেই। অকস্মাৎ পাভেলকে ফোন দিয়ে ভেতরে আসতে বললো।দেলোয়ার হোসেন চিন্তিত গলায় বললো,

– কি হয়েছে শাহাদ তোমাকে এমন দেখাচ্ছে কেনো?

শাহাদ যেন এই দুনিয়াতে নেই। কেমন বোকা সোকা চেহারা করে তাকাচ্ছে। চিন্তিত অবস্থা দেখে দেলোয়ার সাহেব এক গ্লাস পানি এগিয়ে দিলেন। অন্য মন্ত্রীরা এগিয়ে এলেন। এমন সময় পাভেল ভেতরে আসলো। শাহাদ পাভেলকে বললো,

– পাভেল তোমার ম্যাডামকে কল দাও।

পাভেল হতবিহ্বল হয়ে তাকিয়ে আছে। ম্যাডামকে কি করে কল দিবে! এ যাবৎকালে এমন কথা বলেনি শাহাদ। বউকে যেখানে কাউকে দেখায়নি সেখানে বউয়ের ব্যক্তিগত নাম্বার পি এসের কাছে কিভাবে থাকবে! এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে শাহাদ পুনরায় ধমকে বললো,

– কি হলো চুপ করে দাঁড়িয়ে আছো কেনো?

– স্যার আমি ম্যাডামের নাম্বার কিভাবে পাবো?

– আমি এত কথা জানিনা বাসায় ফোন দাও।কেউ ফোন ধরছে না কেনো?

এমন সিচুয়েশনে এর আগে কখনো পড়েনি পাভেল।কেউ ফোন না ধরলে ওর ফোন কিভাবে ধরবে। এমন সময় হঠাৎ মাথায় এলো নিশাদের কথা। এয়ারপোর্টে নিশাদের নতুন সিম কিনে দিয়ে সব সেট করে দিয়ে ওর কাছ থেকে নাম্বার নিয়েছিলো। নিশাদকে ফোন দিতেই নিশাদ ফোন ধরে।

– হ্যালো নিশাদ, ম্যাডাম আছে বাসায়?

-হ্যা বলো, কোন ম্যাডাম?

– দিয়া ম্যাডাম।

-আছে তো।

-ম্যাডামকে দাও।

পাভেল বাসায় ফোন দিতেই শাহাদ অপেক্ষা করছে। মনে মনে চাইছে যেন কেউ একজন ফোন ধরে। পাভেল ফোন এগিয়ে দিলো শাহাদের দিকে।এমন সময় দিয়া ফোন ধরে বললো,

– আসসালামু আলাইকুম ভাইয়া।

শাহাদ প্রশ্ন করে বসলো,

– ফারাহ, আমার শেহজা কেমন আছে?

প্রায় দু বছর! হ্যাঁ ঠিকই তো দু বছর পর মানুষটা নাম সেই নামে ডাকলো। পুরোপুরি চমকিত, ধমনী,শিরা বেয়ে প্রবাহিত হচ্ছে শীতল রক্ত।স্পষ্ট টের পাচ্ছে শারীরিক কম্পন।উত্তর দিতে চাচ্ছে তবুও গলা দিয়ে শব্দ বের হতে নারাজ।হারিয়ে গিয়েছে বর্ণমালা।এলোমেলো অক্ষরগুলো শব্দজোট করতে ব্যর্থ। শীতল ছোঁয়া কায়া জুড়ে। বড্ড ভালোবেসে দিয়াকে ফারাহ নামে ডেকেছিলো শাহাদ। পুনরায় প্রশ্নে সম্বিত ফিরে পেয়ে বলে,

– আগের চেয়ে আলহামদুলিল্লাহ ভালো,কিন্তু গায়ে জ্বর।

– ওকে রেডি করো।আসছি আমি। হাসপাতালে নিয়ে যাব।

ফোন কেটে পাভেলের হাতে ধরিয়ে দিয়ে দেলোয়ার হোসেনকে বলে,

– স্যার আমার মেয়েটার অবস্থা ভালো না। আমি আজ যাই। আরেকদিন আসবো।হাসপাতালে যেতে হবে।

দেলোয়ার সাহেব চিন্তিত হয়ে বললো,

– তোমাকে আটকাই কি করে বলোতো।এমন একটা দিন আমি যেতে পারছিনা।

-স্যার সমস্যা নেই।আমি জানাবো আপনাকে।ম্যাডাম আসি।আমার মেয়েটার জন্য দোয়া করবেন।

শাহাদ কোনোরকম বেরিয়ে এলো। সচেষ্ট ব্রেন এত দ্রুত কি করে তেজহীনভাবে জমাট বেঁধে গেলো বুঝতে পারছেনা। মেয়েটা তার এতটা জুড়ে আছে। প্রতিটি কদম যেন কয়েকটা দিন। গাড়ির কাছে পৌঁছেছে মিনিট গতিতে। পাভেল তাল মিলিয়ে পারছিলোনা। এলিন বাবার দিকে তাকিয়ে বলে,

– পাপা উনি কি ম্যারিড!

– হ্যাঁ মেয়েও আছে ছোট এক বছর মনে হয়।

দেলোয়ার সাহেব মেয়ের দিকে তাকিয়ে বুঝলো মেয়ে কি যেন বিড়বিড় করছে। এলিন অবাক হলোনা। একজন সুদর্শন, সুপুরুষের বিয়ে হতেই পারে।স্ত্রী থাকতেই পারে কিন্তু মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে। খানিকের জন্য হলেও এই লোকটার মোহে নিজেকে বেঁধে ফেলেছিলো। কারো মায়ায় পড়া যতটা সহজ,মায়া কাটানো ঠিক ততটাই কঠিন। অথচ প্ল্যান ও করে নিয়েছিলো বাবাকে জানাবে উনাকে পছন্দ হয়েছে।ব্যাক্তিত্বের প্রেমে পড়ে গিয়েছে তার। এভাবে কেউ হল মাতিয়ে অন্যের বাচ্চার জন্য ছুটতে পারে ভাবতেই মন থেকে শ্রদ্ধাবোধ জেগে উঠলো।

___

পাভেলকে সরিয়ে আজ নিজেই ড্রাইভ করছে শাহাদ। এলোমেলো ড্রাইভ করছে। স্পিড ১২০। পাভেলের বুকে ধুকপুক বেড়ে গিয়েছে। ১২০ মানে রাস্তার সব গাড়ি ওভারটেক করছে।উদ্ভ্রান্তের মতো চালাচ্ছে গাড়ি। পাভেল মনে মনে দোয়া পড়ছে,

– লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মোহাম্মদূর রাসুলুল্লাহ।

হার্ড ব্রেক কষেছে এর মধ্যে দুবার। আজ বুঝু প্রাণ পাখি গেলো! স্যারের এমন উদ্ভ্রান্ত আচরণ দেখে গাড়ির সামনে রাখা পুরো পানির বোতল শেষ। পাক্কা এক ঘন্টা পঁয়তাল্লিশ মিনিট ড্রাইভ করে বাড়ির সামনে থেমেছে গাড়ি।ফ্রন্ট ডোর খুলে গাড়ি থেকে নেমে দৌঁড় দিলো। কিভাবে দৌঁড়াচ্ছে নিজেও জানেনা। লম্বা পা ফেলে সিড়ি বেয়ে উঠে দরজায় বেল চাপলো। শিফা দরজা খুলে দিলো। ড্রইং রুমে সবাই বসে আছে। শেফালীর কোলে শেহজাকে দেখে কথা না বলে হাত বাড়িয়ে মেয়েকে কোলে নিলো।বুকের সাথে ধরে মেয়েটার পুরো মুখ আদর দিচ্ছে। মেয়েও বাবাকে ধরে চুপ করে আছে।শরীর হালকা গরম। মেয়েকে বলছে,

-আম্মা চলেন আমরা হসপিটালে যাব।

বাবা মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো,

– আব্বু আমি ওকে নিয়ে একটু ডাক্তার দেখিয়ে আসি।

রায়হান সাহেব বিচলিত হয়ে বলে,

– কি হয়েছে এভাবে হাঁপাচ্ছো কেনো? এত রাতে নিবে? তাহি এসেছিলো দেখে গিয়েছে ওকে।

শাহাদ মেয়েকে বুকে চেপে ধরে চুপচাপ বসলো সোফায়। এখনো বুকের পাশটা ব্যাথা করছে মনে হচ্ছে। আজ যদি ওই বাচ্চাটা পড়ে যেত। শেহজা বাসায় থাকে। বাসার মানুষ জন কত কাজে এদিক সেদিক যায়। হয়তো মেয়েটাকে খেলতে দিয়ে যে যার যার কাজ করে, কে নিবে শেহজার নিরাপত্তার দায়িত্ব। আজ হঠাৎ এমন গোলমেলে লাগছে কেনো। শেহজাকে বুকে নিয়ে উঠে দাঁড়ায়। সবার উদ্দেশ্যে বলে,

– শেহজা আজ থেকে আমার কাছে থাকবে।

সুলতানা কবির বলে উঠলো,

– শেহজার মা কোথায় থাকবে?

শাহাদ আশপাশ তাকিয়ে দেখলো ফুফুদের কেউ নেই।সবাই হয়তো ক্লান্ত। যে যার যার মত রেস্ট নিচ্ছে। শাহাদ নিজেকে শান্ত করে বললো,

– সে তার নিজের রুমে থাকবে।

– ফিডিং কে করাবে শেহজাকে?

– জানিনা ব্যবস্থা করুন। শেহজাকে আমি আমার কাছে রাখবো এটাই শেষ কথা।

– তাহলে ওর মাকে ও রাখো।

– নাহ। আমার রুমে আমি এমন কোনো নারীর স্থান দিব না যে আমার নয়।

দিয়া হাসছে মনে মনে। অদ্ভুত ভাবে তার মনে এক অবাস্তব ভাবনা এসেছিলো। শাহাদের ওই সময়ের সম্বোধনে ভেবেছিলো এবার বুঝি শাহাদ ফিরে তাকালো। বিশ্বাস কখনো ফেরে না যদি শক্তিশালী প্রমাণ না থাকে। দিয়ার কথা বাড়াতে মন চাইছেনা। সে নিজেই চাইছে শেহজার দায়িত্ব কেউ যেন শক্ত পোক্তভাবে নেয়। ওর বাবাই চাইছে।৷ দিয়া শাশুড়িকে বললেন,

– আম্মু চিন্তা করবেন না আমি ব্যবস্থা করে রাখবো।

যে যার মত রুমে চলে গেলো। দিয়া নিজের রুমে এসে থ মেরে বসে আছে। নিজেকে আজ এই পরিবারের সবচেয়ে উচ্ছিষ্ট্য বস্তু লাগছে। মন চায় চিৎকার করে বাবার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়তে, কারো বুকে ভরসায় মাথা রাখতে।

রাত দুটো। মেয়েটা একটু পর উঠবে। পাম্প দিয়ে ব্রেস্ট মিল্ক বেবি ফিডারে দিয়ে দিল। শাহাদের দরজা নক করতেই রুমে প্রকান্ড দরজা খুলে উদাম গায়ে,ছাই রঙা ট্রাউজারে শাহাদ বেরিয়ে এলো৷ দিয়া চোখ নামিয়ে শেহজার পিডার বাড়িয়ে দিল। শাহাদ ফিডার নিয়ে দিয়ার দিকে তাকালো। একেবারে চোখের মনিতে দৃষ্টি। একটু ও দৃষ্টি লুকালোনা। আচমকা মুখের উপর ঠাস করে দরজা আটকে গেলো।

___

গত দুদিন ধরে এভাবেই দিয়া রাতে খাবার দিয়ে আসে। মেয়েটা রাতে মাকে খুঁজে বেড়ায়। আজ রাতেও পিডার দিতে এসেছে। আজ মেয়েটার জন্য খুব খারাপ লাগছে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে ঘড়িতে একটা ত্রিশ। শাহাদের দরজা নক করতেই দরজা খুলে ওর কাছ থেকে পিডার নিয়ে দরজা আটকে দিলো। পুনরায় নক করলো। দিয়া ভয়ে ভয়ে বললো,

– আজকে রাতটা শেহজাকে দিবেন? আমার ওর জন্য কষ্ট হচ্ছে।

পেছন থেকে তেতে উঠা গলায় কেউ একজন বলে উঠলো,

– এখানে কি করো তুমি, আমার ভাইয়ের ঘুম হারাম করছো কেনো?

তাকিয়ে দেখে শেফালী। দিয়ার এত খারাপ লাগলো চোখের পানি ফেলে দিলো। শাহাদ বোনের দিকে তাকিয়ে বলে,

– কি সমস্যা, এখানে কি করছো?

– ভাইজান,আবিরের জন্য পানি নিতে আসছিলাম।

– ঠিক আছে।

শেফালী চেঁচিয়ে বলে উঠলো দিয়াকে,

– এই তুমি যাও। এখানে কি?

শাহাদ প্রচন্ড বিরক্ত হয়ে বোনকে ধমকে বললো,

– শেফালী তোমার কি মনে হচ্ছে না তোমার স্পর্ধা বেড়ে গিয়েছে। গলা নামাও। সম্পর্কে তোমার ভাবীজান। আমি নিশ্চয়ই তোমাকে এখন কার্টেসি শেখাতে হবেনা?

দিয়াকে ধমকে বললো,

– রুমে যাও। প্রয়োজন হলে ডাকবো।

মুখের উপর দরজা টা লাগিয়ে দিলো। দিয়া আর এক মুহুর্ত না দাঁড়িয়ে নিজের রুমে চলে গেলো। শেফালী একটা তীক্ষ্ণ হাসি দিলো। কত বড় বেহায়া হলে এত বড় অপমানেও হাসে। হাসবে নাই বা কেনো! যতই অপমান করুক ওই মেয়েকে রুমে জায়গা তো দেয় নি। সফল হওয়ার আরেকটি ধাপ। যা চেয়েছিলো মনে মনে তাই হচ্ছে। রুমে এসে দেখে ছেলে ঘুমাচ্ছে। ফোনটা হাতে নিলো। নাম্বার ডায়াল করে বারান্দায় চলে গেলো। বারান্দায় একটা চেয়ারে বসে সব রকমের কুটিল চিন্তার একটা নীল নকশা তৈরি করলো। কল রিসিভ হলো,

– এত রাতে?

– যতই ভাইজান থেকে গেঁয়ো মেয়েটাকে দূরে রাখতে চাচ্চি ততই গা ঘেঁষে যাচ্ছে। ও আমার সুখ নষ্ট করেছে,আমি ওর নষ্ট করবো।

– দু বছরে তো কিছুই পারো নি। বললাম বিচ্ছেদ ঘটাও। ও না গেলে আমি আসবো কি করে?

– ঝামেলা তো করছে মেয়েটা। ওটা না হলে তো এতদিনে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিতাম। দুধ খায় তাই পারছিনা কিছু করতে৷

– কত অনাথ বাচ্চা রাস্তা ঘাটে আছে, ওরা কি মা ছাড়া বড় হচ্ছেনা। তুমি আসলে একটা গণ্ডমূর্খ। কোনো কাজ হবে না।

– আরেকটু সময় দাও। এই বছরের মধ্যে একটা ব্যবস্থা করছি।

ফোন কেটে গেলো। শেফালী এবার শক্ত পোক্তভাবে নেমে পড়বে। এভাবে হলে তো সব ওর হাতছাড়া হয়ে যাবে। বাবা – ভাইয়ের সম্পত্তির অভাব নেই। ওর শ্বশুরবাড়ির লোকজন ছিলো অল্প আয়ের মানুষ। তাও স্বামীটা যদি থাকতো সংসার করার কথা ভাবতো।স্বামী যেখানে নিখোঁজ সেখানে কিসের সংসার। তবে এই সংসারে শুধু ওর রাজত্ব চালাবে। এখানে থেকে আর কোথাও যাওয়া যাবেনা। আবিরের নামে সব করতে হবে। প্রথমে ওই দিয়াকে,পরে ওর মেয়েকে চিরতরে এই বাড়ি থেকে সরাবে।

চলবে…

#সায়রে_গর্জন
#নীতি_জাহিদ
৭.
(অনুমতি ব্যতীত কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ)

হাসপাতালের চারদিকে কড়া নিরাপত্তা। ডাক্তারের চেম্বারে বসে আছে। খুব ভোরে পাভেলের ফোন পেয়ে ছুটে আসে। ডাক্তার মনিকা ফেরদৌস হামজার রিপোর্ট চেক করছে। ছেলেটাকে এমন ভাবে কো/পা/নো হয়েছে ডাক্তাররা আতঙ্কিত। শাহাদের মাথার ভেতর আগুন জ্বলছে। মনিকা শাহাদের দিকে তাকিয়ে বলে,

– শাহাদ ভাই, ছেলেটার প্রচুর ব্লি*ডিং হচ্ছে। ওর পরিবারের লোকজনকে খবর দিয়েছেন?

– পাভেল দিয়েছে,ওরা আসছে রাস্তায়। যত ব্লা*ড দরকার নে আমার কাছ থেকে। হামজাকে সুস্থ চাই আমার।

– অলরেডি দু ব্যাগ নিয়েছি আমি আপনার কাছ থেকে। এখন আর সম্ভব না।

– শুন মনি আমার এত কথা বুঝার ও দরকার নাই,জানার ও দরকার নাই। তোকে ডাক্তারি আমি এজন্য পড়াই নাই যে তুই প্রয়োজনে আমার কাজে লাগবি না। যেখান থেকে পারিস ভালো ডাক্তার নিয়ে আয়,নিজেও হেল্প কর। হামজাকে প্রয়োজন আমার।

জোরে চেয়ার সরিয়ে উঠে দাঁড়ায় শাহাদ। মনির মুখটা থমথমে হয়ে যায়। লোকটা সব সময় এমন ঔদ্ধর্ত্য নিয়ে থাকে। পড়িয়েছে তো কি হয়েছে এভাবে বলতে হবে! মনিকে একা তো পড়ায় নি সব সময় খোটা টা মনিকেই দিতে হবে কেনো? তাহিকে ও তো পড়িয়েছে। তাহিকে তো কখনো একটু কথাও শোনায় না। এজন্যই তাহিকে সহ্য হয়না। মনি দীর্ঘশ্বাস ফেলে থমথমে মুখ নিয়ে বের হয়।

শাহাদ ওটির বাইরে অপেক্ষা করছে। হামজার সদ্য বিয়ে করা বউ আর মা বসে আছে পাশে। শাহাদ একবার তাকিয়ে পুনরায় পাভেল, লাবিবের দিকে তাকায়। দলের আরো ছেলেরা হাসপাতালের বিভিন্ন ফ্লোরে আছে। শাহাদের কাছে হামজার মা দু হাত জোর করে বলছে,

– স্যার আমার ছেলেটাকে বাঁচায় দেন। ও তো ভালো মানুষ সকালে বাইর হইলো বললো, আমি দুপুরে তোমাকে নিয়া ডাক্তার কাছে যাব আম্মা। আর তো আসলোনা আমার ছেলে। বিয়া হইছে আজকে সাতদিন। মেয়েটার কি হবে স্যার!

শাহাদ নিস্তব্ধ। এমন কেনো রাজনীতি। মারামারি, দাঙ্গা,লুটপাট। অথচ সে চেয়েছিলো সুস্থ রাজনীতি। এক দূর্নীতির জন্য ছেড়েছে আগের প্রফেশন। রাশেদকে চোখের সামনে বিনা অপরাধে তড়ফাতে দেখে সেদিনই প্রতিজ্ঞা করেছিলো এই প্রতিশোধ সে নিবে। তা জন্য দরকার ক্ষমতা।বৈধ ক্ষমতা।

____

বাড়িতে আজ অনুষ্ঠান। নিশাদের গায়ে হলুদ। সারা বাড়ি আলোতে সাজানো। ফুফু মঞ্জিলা পুরো অনুষ্ঠানের দায়িত্ব সঁপে দিয়েছে দিয়ার কাঁধে। আজ থেকে অতিথিদের আসা শুরু। দিয়া শাড়ি কোমড়ে বেঁধে কাজ করছে। কাজ করতে গিয়ে মাঝে মাঝে হাঁপিয়ে উঠছে। সুলতানার ভাই বোনেরা এসেছে, রায়হান সাহেবের ভাইবোন এসেছে। বাড়ির ছাদে হলুদের অনুষ্ঠান হবে। মেয়েরা সাজগোজ করতে ব্যস্ত। শেহজা কখনো চাচ্চুদের কোলে তো কখনো ফুফিদের কোলে। দিয়া রান্নাঘরে মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে। ফুফু মঞ্জিলা,চাচী শাশুড়ি ইফাত, খালা শাশুড়ি সাবিনা মুখ টিপে হাসছে। এই মেয়ে হোয়াইট সস পাস্তা বানাতে গিয়ে ফ্লোরে ময়দার ছড়াছড়ি করেছে। নিজের কপাল নিজে চাপড়াচ্ছে। এবার খালা শাশুড়ি সাবিনা নিজের থ্রিপিছের ওড়না কোমড়ে চেপে বলে,

– মা উঠ,অনেক করছিস। এতখানি একটা পুতুল মেয়ে। এত চাপ নিস না তো।

ফুফু শাশুড়ি, মামী শাশুড়ী, চাচী শাশুড়ি কাজে লেগে পড়ে। দিয়াকে পাঠিয়ে দেয় সাজগোজের জন্য। এরমধ্যে মেয়েরা ডাইনিং রুমে এসে হলুদের ডেকোরেশনের জন্য বিভিন্ন নাস্তা সাজাতে ব্যস্ত। দিয়ার হাতে গাঁদা ফুল সমেত একটা বেতের প্লেট। ফুল দিয়ার বেশ পছন্দ। খুব ইচ্ছে গাঁদা ফুলের মালা পরবে চুলে,হাতে। আজ অনেক গাঁদা আছে বাসায়।হলুদ শাড়িতে সাজবে নিজের জন্য। ফুলের প্লেট
উপরে নিয়ে যাবে কনেপক্ষ আসলে শুভেচ্ছা জানাতে। নিচের দিকে তাকিয়ে ডিশে গোলাপ গুলো ছড়াতে ব্যস্ত সাথে বিমোহিত সুরে আনমনে গান গেয়ে উঠলো,

অন্তর দিলাম বিছাইয়া,বইসা লোওনা জিরাইয়া
যদি তোমার চাই মনে,পরাণ রাইখা পরানে
নয়ন রাইখা নয়নে,পরাণ রাইখা পরানে
নয়ন রাইখা নয়নে

অন্তর দিলাম বিচাইয়া,বইসা লোওনা জিরাইয়া
যদি তোমার চাই মনে,প্ররাণ রাইখা প্ররানে
নয়ন রাইখা নয়নে,প্ররাণ রাইখা প্ররানে
নয়ন রাইখা নয়নে…

অকস্মাৎ সামনে আসা মানুষটা থমকে গিয়েছে। গানের সুরে পুরো বাসা নিস্তব্ধ। এত বছরেও গান গাইতে দেখেনি কেউ এই মেয়েকে। আজ কি তবে মন খুশি আছে! শাশুড়ীরা সব ভিড় করেছে। ননদ, দেবররা সব স্তব্ধ। সকলে চমকে গিয়ে ডাইনিং রুমে মানুষটার উপস্থিতি দেখে। মনোমুগ্ধকর নয়নে তাকিয়ে আছে। অপলক সেই দৃষ্টি। দিয়া প্লেট হাতে নিয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে হাঁটা ধরলো ড্রইং রুমের উদ্দেশ্যে। সেখানে সব তত্ত্ব রাখা। তৎক্ষনাৎ সামনে প্রবলভাবে বাঁধা গ্রস্থ হয়ে হাত ছিটকে উপরের দিকে ছড়িয়ে পড়ে সব ফুল। নিশব্দ রুমটাতে এতক্ষন কেউ ধ্যানে ছিলো না। বেতের প্লেট নিচে সেন্টার টেবিলের উপর পড়ে ঝনঝন করে উঠলো। তাল সামলাতে না পারলে পড়ে যেতে নিলে একটা প্রশস্ত,শক্ত,অমসৃণ, খসখসে হাত উন্মুক্ত কোমড় আঁকড়ে ধরেছে। তখন শাড়ির আঁচল কোমড়ে গুঁজা, দুগালে ময়দা, চুল গুলো পাঞ্চ ক্লিপ দিয়ে মুড়িয়ে মাঝখানে বাঁধা। দিয়া ধরা গলায় চোখ বুঁজে বলে,

– ফুফুআম্মা , মামীমা আমি কি নিচে পড়ে গেলাম! কোমড় কি ভেঙেই গেলো।আল্লাহ গো। শক্ত কিছু কি কোমড়ে বিঁধে গিয়েছে!

শিফা,নিশি ডাইনিং এর পরিবেশ দেখে থ। পেছন দিক থেকে কাজিনরা সব এসে দাঁড়িয়েছে। সুলতানা কবির নাতনীকে নিয়ে সামনে আসতেই এমন দৃশ্য দেখে ভ্যাবাচেকা খেয়ে গিয়েছে। মঞ্জিলা লজ্জা পেয়ে উলটো দিকে ঘুরে গিয়েছে জিহবায় কামড় বসালো। শাহাদের মাথায়, চুলে,কাঁধে হলুদ গাঁদা আর লাল গোলাপ। দিয়ার শাড়ি,চুলের ও একই অবস্থা। শাহাদ ধ্যানে ফিরে আসলো। তাকিয়ে দেখে সবাই হাসছে মুখ লুকিয়ে। নিজেকে সামলে ধমকে বললো,

– মুভির সিন চলছে এখানে, ষ্টুপিড। আমি কতক্ষন এভাবে দাঁড়িয়ে থাকবো।

ছোট ভাই বোন, মা চাচীদের সামনে এমন বিব্রতকর অবস্থায় পড়বে ভাবেনি। দিয়া তড়াক করে চোখ খুলে বলে,

– আউজুবিল্লাহি মিনাশ শায়তনির রাজীম।

হাত পা একদম জমে বরফ। সামনে তো সাক্ষাৎ একটা ভয়ের রাজা। মনে মনে এই একটা লাইন জঁপেই যাচ্ছে। এই আয়াতের মানে শয়তান থেকে রক্ষা পাওয়া,এই মেয়ে শয়তান কাকে বললো!! শাহাদ ক্ষেপে উঠে কোমড় থেকে হাত সরিয়ে বলে উঠলো,

– বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম।

সাথে সাথে দিয়া নিচে পড়ে গেলো। ওর কাজে পুরা ডাইনিং রুম হতভম্ব। এমনটা করবে কেউ ভাবতেও পারেনি। দিয়া পড়ে গিয়ে কোমড়ে ব্যাথা পেয়েছে। ছলছল চোখে শাহাদের চলে যাওয়া দেখলো। সকলে দৌঁড়ে এসে ধরলো। ভাগ্যিস কার্পেট ছিলো। নতুবা আজকে কোমড়ের অবস্থা যেরূপ হত আগামী এক মাস বিছানা ছেড়ে উঠার নাম ও নেয়া মহাপাপ হয়ে যেত৷ সাবিনা, সুলতানার দিকে তাকিয়ে বললো,

– বাবুর কাজটা একদম ঠিক হয়নি।মেয়েটার কোমড়ে লেগেছে।

সুলতানা ছেলের উপর চটেছে ভীষণ কিন্তু কিছু বলার ছিলোনা।বাড়িভর্তি মানুষের সামনে কিছু বলতে মন চায়নি। দিয়াকে ধরে নিয়ে শিফার রুমে বসালো। আজ থেকে দিয়া কোথায় থাকবে এটা নিয়ে শিফা,রায়হান সাহেব এবং সুলতানার মাঝে কয়েক দফা আলোচনা হয়েছে। এই কয়েকদিন দিয়া শিফার সাথে ছিলো। মঞ্জিলা বুঝতে পারেনি।এদিক সেদিক দাওয়াত দিতে ব্যস্ত ছিলো। আজ বাড়িভর্তি মেহমান এর মধ্যে শাহাদের এমন একটা কাজ লজ্জাজনক। দিয়াকে রুমে বসিয়ে শিফা আইসব্যাগ নিয়ে আসতে ছুটলো। নিশি পাশে বসে বলছে,

– ভাবীমা, তোমার খুব লেগেছে।

দিয়ার খুব হাসি পাচ্ছে। কিভাবে বলবে ঠিক কতটা লেগেছে। সি সেকশন করা পেট। ভারী কাজ করতে পারেনা। অপারেশনের পর থেকে পেছনের মেরুদন্ড অনেক ব্যাথা করে সেখানে মানুষটা এতটা নির্দয় না হলেও তো পারতো।সন্তানের মা হিসেবে একটু দয়া দেখাতো। বুকে এক আকাশ সব কষ্ট নিয়ে নিশিকে বললো,

– নিশি, ভাবী ঠিক আছি। চিন্তা করোনা। একটু ব্যাথা লেগেছে।

শিফা দৌঁড়ে এসে দিয়ার কোমড়ের ডান পাশে আইসব্যাগ ধরলো। কিছুক্ষন পর দিয়া তাড়া দিলো সকলকে রেডি হয়ে উপরে যাওয়ার জন্য। দিয়া যাবেনা। কেউ জোর করতে পারছেনা। সুলতানা,সাবিনা যাবেনা বলাতে দিয়া বকা দিয়ে পাঠালো উপরে। সকলে উপরে যাওয়ার সময় দিয়াকে বাসার একটা এক্সট্রা চাবি দিয়ে দিলো।কিছুক্ষন পর আফিয়া খালা আসবে। বাসার দরজায় তালা দিয়ে গেলো। বিয়ের আমেজে ভরা বাড়িটা এক নিমেষে অন্ধকার,শূন্য বাড়িতে পরিণত হলো। আশে পাশে,দৃশ্যমান উপরে নিচে কেউ নেই। শুধু সাত আসমানের উপর রক্ষাকারী রব্বুল আলামিন বসে আছে। দিয়ার দুচোখে আজ অশ্রধারা। মনে পড়ে গেলো সেই রাতের কথা, যে রাতে প্রথম এই বাড়িতে পা দিয়েছিলো। বিয়ের আগে একবার ও ছবি দেখেনি শাহাদের। চাচা দেখাতে চেয়েছিলো। বিয়ের দিন গাড়ি থেকে নামার সময় সাহায্য করেছিলো ননদ শিফা। হেঁটে ফ্ল্যাটের দরজা পর্যন্ত এলো। শাহাদ একপাশে দাঁড়িয়ে ছিলো। মা সুলতানার অনুরোধে সদ্য সঙ্গী হওয়া স্ত্রীকে পরম মমতায় কোলে তুলে নিলো। তখনই দিয়া সরাসরি দেখতে পেলো স্বামীর মুখ। দিয়া প্রথমবারের মতো শাহাদ ইমরোজের হ্যাজেল আইয়ের প্রেমে পড়ে গেলো। এমন ধূসর রঙা চোখের মানুষ খুব কম দেখা যায়।ইংরেজদের চোখ এমন থাকে। দিয়ার চোখ তো কুচকুচে কালো তবে উনার চোখ এত আকর্ষণীয় কেন! দিয়াকে নিয়ে নিজের বেডরুমে প্রবেশ করলো। এত বড় গুছানো বেডরুম দিয়া আগে দেখেনি। শাহাদ সরাসরি বিছানায় বসিয়ে দিয়েছে। দাদা বাড়িতে শয়ন কামরা ছিলো পুরনো আসবাবে ঘেরা। সেখানে ছিলো ঐতিহ্যের ছোঁয়া, আর এখানে আভিজাত্যের। এরপর বাড়ির সবাই এসে বাকি নিয়ম কানুন সব পালন করেছে।

রাত বারোটার দিকে শাহাদ ঢুকেছে। দিয়ার গায়ে বিয়ের পোশাক জড়ানো দেখে পরিবর্তন করতে বললো। দিয়া উঠে শাহাদকে সালাম করতে চাইলে শাহাদ বাঁধা দিয়ে মমতায় মাথায় রাখে। ঘোমটা সরিয়ে কপালের মাঝখানটাতে অধর মিলিত উষ্ণ পরশ দিয়ে বললো,

– ভালো থাকো, বয়সটা খুব কম তোমার। ভেবেছিলাম বিয়েটা করবোনা এত ছোট মেয়েকে কিন্তু যখন শুনলাম তোমার মাথার উপর কারো শক্ত ছায়া নেই তখন আর ইচ্ছে করেনি তোমাকে একা এই কঠিন পৃথিবীতে লড়াই করতে নামিয়ে দিতে। পারবেনা এই মানুষটাকে স্বামী হিসেবে মন থেকে মেনে নিতে!

দিয়া উপর নিচ মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো।

– যাও পোশাক ছেড়ে আরামের কিছু পরো।

এরপর লাগেজ থেকে একটা ড্রেস বের করে চলে গেলো ওয়াশরুমে। শাহাদ ও পরিবর্তন করে পাশে এসে বসেছে। দিয়ার দিকে তাকিয়ে অন্য রকম একটা মায়া কাজ করছে। কিন্তু নিজের কাছে ব্যাপারটা বড্ড বেমানান লাগছে। হাঁসফাঁস করছে। দিয়ার দিকে তাকিয়ে বললো,

– তোমার পুরো নাম কি?

– ফারাহানা মেহতাব দিয়া।

– আমার নাম জানো?

দিয়া দু পাশে নাড়ালো। শাহাদ হেসে বলে,

– আমাকে বিয়ের আগে দেখেছো?

দিয়া পুনরায় দু পাশে মাথা নাড়ালো। শাহাদ ভ্রু কুঞ্চিত করে বললো,

– তবে? বিয়েতে মত দিলে কিভাবে?

– মত না দিলে চাচা যদি আরো বয়স্ক কারো সাথে বিয়ে দিত এরচেয়ে আপনি বেটার অপশন ছিলেন।

শাহাদ হো হো করে হেসে উঠলো। মজা করে বললো,

– এই প্রথম আমাকে কেউ অপশন হিসেবে বেছে নিয়েছে।

দিয়া উজ্জ্বল নেত্রে তাকিয়ে আছে। শাহাদ মুচকি হেসে বলে,

– আমার নাম শাহাদ ইমরোজ। আপাতত বেকার। বাবার টাকায় খাচ্ছি। নেতা হওয়ার চেষ্টায় আছি এক বছর ধরে।এই বছর ইলেকশনে দাঁড়াবো। প্রাপ্ত বয়স্ক তো হয়েছো তাই না! আমাকে দিও ভোট টা কেমন।

এত সাবলীলভাবে গুছিয়ে বাবার পর কেউ কথা বলেছে কিনা ওর সাথে মনে পড়ছেনা। দিয়া মুখ ফসকে বলে ফেলে,

– আপনি অনেক সুন্দর।

শাহাদ চোখ বড় করে পুনরায় হেসে উঠে বলে,

– তুমিও অনেক সুন্দরী। ওহ হ্যাঁ ভালো কথা, তুমি চাইলে আমাকে তুমি করে বলতে পারো।

– না না ছিঃ। কি বলছেন এসব। আপনি এত বয়সের একজন কিভাবে আপনাকে তুমি বলি।

– বয়স্ক বললে?

– না, আপনাকে আমার খুব পছন্দ হয়েছে। আমার বান্ধবীরা আপনাকে দেখলে হিংসা করবে।

– তাই নাকি, তাহলে একদিন বান্ধবীদের দাওয়াত দাও।
– কেনো?

দিয়ার ড্যাব ড্যাব করা চাহনীতে শাহাদ হেসে উঠে। চোখ ঝাপটে বলে,

– তোমার এমন মধ্যবয়সী স্বামী দেখে যদি কেউ হিংসে করে তাহলে আমার একটু শান্তি লাগবে কারণ সবাই তো আমাকে বলে আমার নাকি বাবা হওয়ার বয়স পেরিয়ে দাদার বয়স হয়ে গিয়েছি। বাবা তো মাঝে মাঝে রেগেই যায় আমার একরোখা স্বভাবের জন্য।

– বাবাকে না রাগালেই পারেন।

শাহাদের একটা দীর্ঘশ্বাস। বাবাকে রাগিয়ে সবচেয়ে কঠিনতর কাজটা ছ’ মাস আগেই করে ফেলেছে।

কোমড়ের ব্যাথাটা চিনচিন করে উঠলে পুরনো কথা ভুলে নড়ে বসে দিয়া। বামপাশটাতে হালকা কেটে গিয়েছে বেতের প্লেটটা লেগে। ওটা বোধ হয় শিফা,নিশি খেয়াল করেনি। দিয়া পরে উঠে অয়েন্টমেন্ট লাগাবে ভেবে পুনরায় শুয়ে পড়লো। একা বাড়িতে কিছুটা ভয় করছে। একটু পর ঘুমের রাজ্যে তলিয়ে গেলো।
____

বন্ধ নেত্রে বিছানায় শুয়ে আছে, রাজ্যের চিন্তা মাথায় হানা দিয়েছে। একটু ঘুমানো দরকার। কিন্তু ঘুমাবে কি করে! পুরোনো ব্যাথা শরীরে কাঁটা দিচ্ছে।দেখেছিলো দুঃসাহসী স্বপ্ন,ধরা দিলো দুঃস্বপ্ন হয়ে।সেই স্বপ্ন আজ ধূলিসাৎ করে নিজের সবচেয়ে অপছন্দের পেশায় নিজেকে নিয়োজিত করেছে। অপছন্দের অনেক কিছুই প্রিয় হয়ে উঠে আকস্মিকভাবে। এখন রাজনীতি অপছন্দের নয়। ঘুম না আসাতে উঠে বসে। ড্রয়ার থেকে মেডিকেল কিট বের করে রুম থেকে বের হয়৷ পুরো বাড়ি এখন নিঃসঙ্গ। শাহাদ তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে ভাবলো, ‘ আম্মু সত্যি বলে প্রতিটি স্ত্রীর বটবৃক্ষ দরকার। অসুস্থ অবস্থায় এতক্ষন হলো মেয়েটা রুমে অথচ কেউ আসলোনা। আমি কেনো পারলাম না একা রেখে যেতে! নিজেকে ধিক্কার জানাতে চেয়েও পারেনি। তস্ত্রপায়ে হেঁটে আবজানো দরজা খুলে দেখে বিভোর ঘুমে আচ্ছন্ন রমনী। কোমড়ের পাশের আঁচলটা সরিয়ে সেলফোনের আলোতে তাকিয়ে দেখে অনেকটা কেটেছে৷ জায়গাটা ফুলে আছে। তৎক্ষনাৎ আপনা আপনি বন্ধ হয়ে গেলো নেত্রযুগল। বুকের ঠিক মাঝখানটায় চিনচিনে ব্যাথা।একটি দীর্ঘশ্বাস। বিকেল থেকে এখন অবধি প্রায় সাত ঘন্টা অতিবাহিত হলো। অথচ কোনো অয়েন্টমেন্ট এখনো লাগানো হয়নি, না কোনো ব্যান্ডেজ।জায়গাটা রক্তে লালচে হয়ে আছে। এন্টিসেপটিক বের করে ক্ষ*ত স্থান মুছে দিলো। ব্যান্ডেজ করতেই কেঁপে উঠলো দিয়া। শাহাদ ধীরহস্তে ব্যান্ডেজ শেষ করে ওষ্ঠ ছুঁয়ে দিলো ব্যান্ডেজের উপর। বিকেলেই দেখেছে কেটে যাওয়ার সময়। আলতো হাতে চুলে বিলি কেটে দিতে দিতে বললো,

– এমন ভুল করলে বউ যার কলঙ্ক মেটাতে অগ্নি পরীক্ষা তোমার স্বামীকে দিতে হচ্ছে। না পারছি কাছে টানতে,না পারছি দূরে ঠেলতে। একবার, শুধু একবার হাতের নাগালে পাই ওকে। কথা দিলাম তোমাকে করা প্রতিটি আঘাত নিজেকে করবো আর দ্বিগুনের বেশি ফিরিয়ে দিব ওদের। সম্পর্ক ভুলে যাব।

চলবে…

(নোট: অনুভূতি ব্যক্ত করতে ভুলবেন না)