সায়র পর্ব-১৯

0
449

#সায়র
#পর্ব_১৯
#আসরিফা_মেহনাজ_চিত্রা

(অনুমতি ছাড়া কপি করা নিষেধ)
———————–

কংকর বিছানো সরু রাস্তায় কিরণ হাত পা ছড়িয়ে কাঁদছে। আয়াত এসে দৌড়ে কিরণকে ঝাপটে ধরল। তার মাথায় বুলিয়ে কান্না থামাতে লাগল। কিরণের মা মমতাজ সদর দরজার সামনে পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। তার চোখের পানি শুকিয়ে দাগ হয়ে আছে। তিনি মা হিসেবে আসলেই ব্যর্থ। আহযান আর উজান দাঁড়িয়ে ছিল কিরণের পেছনে। আহযানের মুখে রা নেই। উজান নিষ্প্রাণ।

জাওভানের চোখে জল। এটা কী কিরণের দুঃখে নাকি অন্য কারণে সেটা বোঝা গেল না। সে কয়েকমুহুর্ত কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে রয়। কিরণ তাকে কেন এই ব্যাপারে জানায়নি এই একটা বছর? কিরণের কাছে কোনো ছেলে ঘেঁষতে দেয় না কারণ তার কিরণ অপবিত্র হয়ে যাবে বলে। সে কিরণকে পিওর অবস্থায় চাইতো। তার কিরণ হবে তার পবিত্র সঙ্গিনী। অথচ এতটাকাল যাকে পবিত্র মনে করে এসেছে, তার গায়ে যে আগেই পুরুষের ছোঁয়া লেগেছে এই সত্যিটা কিরণ তার কাছ থেকে কীভাবে লুকালো? তার কিরণ তো অপবিত্র হয়ে গেছে অনেক আগেই। নষ্ট হয়ে গেছে কিরণ। যেখানে সে ভেবেছিল সে কিরণকে প্রথম ছুঁয়ে দিবে সেখানে কিরণকে দুটো লোক আগেই ছুঁয়েছে! এই অপবিত্র নষ্টা মেয়ের পিছনে সে তার জীবনের মূল্যবান একটা বছর ওয়েস্ট করল? এতটা গাধা কেন হলো সে?

কিরণের কান্না বন্ধ হচ্ছে না। জাওভান কিরণের দিকে তাকাতেই কপালের রগ দপদপ করে জ্বলে উঠে। এখন আর কিরণের কান্না তার মন গলাতে পারছে না। একে দেখলেই মনে হয় একটা ধোঁকাবাজ নষ্টা মেয়ে। সে এসে আয়াতের হাত থেকে কিরণকে ছাড়িয়ে কিরণের চুল ধরে টেনে তুলে। আহযান ছুটে আসতে নেয়। উজান তার হাত ধরে বাঁধা দেয়। আয়াতকে চোখের ইশারায় পিছু হটতে বলে।

জাওভান ক্রোধান্বিত স্বরে বলে উঠে,

‘তুই এত বড় একটা সত্যি আমার থেকে লুকালি? আমাকে আগে বলিসনি কেন?’

কিরণ জাওভানের হাত থেকে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করল না। ম্লান মুখে চেয়ে রইল তার দিকে।

‘আগে জানলে তো তোর মতো নষ্টা মেয়ের সাথে রিলেশনই করতাম না বিয়েতে দূরের কথা। গায়ে কলঙ্ক লাগিয়ে আমার জীবনটা নষ্ট করতে এসেছিস তুই? চরিত্রহীনা, কলঙ্কিনী, নষ্টা তুই!’

কিরণের মাথার উপর বাজ পড়ল যেন। এমনকি আহযান, আয়াত, মমতাজও অবাকের চূড়ান্ত পর্যায়ে। জাওভান এসব কী বলছে? এই ঘটনায় তো জাওভানের উচিত ছিল কিরণের জন্য কষ্ট পাওয়া। কিন্তু তা না করে সে কিরণকে কথা শোনাচ্ছে!

কিরণ নির্বাক হয়ে তাকিয়ে রইল জাওভানের মুখের দিকে। প্রথমে ভেবেছিল জাওভান রেগে আছে তার কিরণকে ধর্ষ’ণ করা হয়েছে এই ভেবে। কিন্তু আসলে জাওভান রেগে আছে কেন সে কিরণের মতো নষ্টা মেয়ের পেছনে ছুটল এই কারণে? কিরণ স্তব্ধ। এই জাওভানের ভালোবাসা? জাওভান আসলে কিরণের মনটাকে নয়, কিরণের শরীর পাওয়ার জন্য ভালোবেসেছে? এখন কিরণ ধর্ষি’ত হয়েছে বলে সে আর কিরণকে চায় না? কিরণকে সে আসলে ভার্জিন হিসেবে চেয়েছিল? এ কেমন দুনিয়া? জাওভান একবারও কিরণের মনের অবস্থা বোঝার চেষ্টা করেনি। কিরণ যে ছোটো থেকে এত ধকল, এত কষ্ট, নিদারুণ যন্ত্রণা বয়ে বেড়াচ্ছে তা জুভের চোখে পড়েনি? কিরণের জীবনটা যে যাতাকলে পিষে গেছে সেই কথাটা মাথায় উদয় হয়নি? তার মাথায় এসেছে কিরণ ননভার্জিন। নষ্টা! অপবিত্র! কলঙ্কিনী! চরিত্রহীনা!

কিরণের কান্না বন্ধ হয়ে গেল। জাওভানের কথাগুলো তার কানে বাজছে। এই চারটি শব্দ কিরণের মাথায় ঘুরতে লাগল অনবরত। এতে কি কিরণের হাত আছে? তার দোষ কোথায়? সে তো আর তখন জানত না যে তাকে ধর্ষ’ণ করা হবে। সে ধর্ষি’ত হয়েছে বলে সে অপবিত্র? সে কিছু জানোয়ারের থাবায় তার সম্ভ্রম হারিয়েছে বলে নষ্টা? কলঙ্কিনী? কিরণ নিজে যেচে গিয়েছিল নিজের সম্ভ্রম হারাতে যে জাওভান তার গায়ে এত বড় কালো দাগ লাগিয়ে দিচ্ছে?

সে অস্ফুট স্বরে শুধু বলল, ‘আমি কী দোষ করেছিলাম… ‘

জাওভান এতে আরো রেগে গেল। দোষ করে বলে আমি কী দোষ করেছি? এত নিষ্পাপ সাজে কেন কিরণ? সে অগ্নিদৃষ্টিতে চেয়ে কিরণের চুল আরো শক্ত করে ধরে বলে,

‘তোর দোষ হচ্ছে তুই কেন আমাকে জানাসনি। আমার জীবনটা কেন নষ্ট করলি? আমাকে আগে বললে তো তোকে ভালোবাসতে যেতাম না। তোর তো উচিত ছিল আরো আগে গলায় ফাঁসি দিয়ে ম’রে যাওয়া। গায়ে এত কলঙ্ক লাগিয়ে ঘুরিস কীভাবে? লজ্জা লাগে না? স্লাট একটা…’

কথাটা বলতে দেরী কিন্তু একটা শক্ত পুরুষালী হাতের চড় জাওভানের গালে পড়তে দেরী হলো না। শক্ত চড়ের আঘাতে জাওভান কয়েক পা পিছিয়ে যায়। কিরণের চুল ছেড়ে দেয় সে।

কিরণের অসাড় শরীর মাটিতে পড়ার আগেই উজানের একহাত কিরণকে জড়িয়ে ধরে আগলে নেয় নিজের বুকে।

জাওভান ক্ষুব্ধ চোখে চায় উজানের দিকে। সাপের ন্যায় ফোঁস ফোঁস করে উঠে। উজানের এত বড় সাহস তাকে চড় মারা? এই জাওভানকে? সে উজানের দিকে তেড়ে এসে উজানের কলার চেপে ধরে। আগুন ঝরা কণ্ঠে বলে,

‘তোর কত বড় সাহস তুই আমার গায়ে হাত তুলিস! কিরণকে কথা শুনিয়েছি দেখে তোর খুব গায়ে লাগছে তাই না? কেন? শুনলাম কিরণ নাকি এখানেই, তোর বাড়িতেই থেকেছে এতদিন, আর আমাকে মিথ্যা বলতো সে নাকি দেশের বাড়ি! কিরণকে সাপোর্ট করছিস কেন?কিরণ তোকে সার্ভিস দেয় নাকি?’

এই কথাটা বলার সঙ্গে সঙ্গে আরেকটা চড় এসে জাওভানের গালে পড়ল। উজান আঙুল তুলে শাসাল জাওভানকে,

‘অনেক বাজে কথা বলেছিস, আর না। কিরণকে নিয়ে আর একটা বাজে কথা বলবি তো তোর মুখ আমি সেলাই করে দেব।’

জাওভান গালে হাত রেখে চোখ লাল করে তাকাল উজানের দিকে। রাগে তার সারা শরীর কাঁপছে। উজান আঙুলে তুড়ি মেরে বলল,

‘এক্ষুনি এখান থেকে বের হয়ে যাবি। আমার বাড়ির আশেপাশে তোকে আর দেখতে চাই না। গেট লস্ট! আর কিরণকে বিয়ের কথাও ভুলে যা।’

শেষ কথাটা শুনে জাওভান যেন খুব মজা পেল, এমনভাবে সে হাসতে লাগল, বলল, ‘ওর মতো সেকেন্ড হ্যান্ড মালকে কে বিয়ে করবে?’

তারপর কিরণকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘তোকে কে বিয়ে করে আমিও দেখব। আমার জীবনটা নষ্ট করেছিস না? তোর মতো ইউজ করা মাল কার ভাগ্যে জুটে সেটা দেখার অপেক্ষায় আছি। তুই তো পঁচা-বাসি হয়ে গেছিস। কার কপাল যে পুড়বে তোকে বিয়ে করলে! কোনো সুখ পাবে না তোর হাজব্যান্ড।’

কিরণ ফোঁপাচ্ছে। জাওভানের কথাগুলো তীরের মতো তার বুকে এসে বিঁধছে। সে এতটাই ফেলনা! কিরণের কণ্ঠরুদ্ধ। জাওভানকে প্রত্যুত্তরে যে কিছু বলবে সেই শক্তি যেন ধীরে ধীরে নিঃশেষ হয়ে গেছে।

জাওভান আরো কিছু বলবে ঠিক সেই মুহুর্তে তার কপালে একটি পাথরের টুকরা ছুঁড়ে দেন মমতাজ। সবাই পেছনে ফিরে তাকাল। মমতাজের হাতে কতগুলো পাথর। সে জাওভানের দিকে ছুঁড়তে ছুঁড়তে বলেন,

‘আমার মেয়েকে নিয়ে তোর ভাবতে হবে না জানোয়ার। আমি তো ভেবেছিলাম আমার মেয়ে সুখে আছে এখানে। কিন্তু তুই জানোয়ার যে আমার কিরণের জীবনটাকে অন্ধকারে ঠেলে দিবি সেটা জানলে আমি কখনোই কিরণকে এই সম্পর্কে যেতে বলতাম না, আর না বিয়েতে মত দিতাম। ভালোই হয়েছে তোর মুখোশ খুলেছে। নইলে তো আমার মেয়েটাকে বিয়ের পর বিষ খেয়ে মরতে হতো তোর জ্বালায়। যা জানোয়ার যা তুই, চোখের সামনে থেকে যা, আজ তোকে মেরেই ফেলব।’

কেউই আটকালো না মমতাজকে। এবার আয়াতও যুক্ত হলো, সেও কতগুলো পাথর কুড়িয়ে মারতে লাগল। মমতাজ তার ঝাঁঝ মেটাচ্ছেন। তার কিরণকে ছোটো বেলায় নির্যাতন করা মানুষগুলোকে কিছু করতে না পারলেও এখন জাওভানকে হাতের কাছে পেয়ে কিছুতেই ছাড়বেন না। এই ছেলের বুকের পাটা কতটুকু যে মায়ের সামনে মেয়েকে বাজে কথা শোনায়, গালিগালাজ করে!

জাওভান শেষমেষ পাথরের আঘাত থেকে নিজেকে বাঁচাতে দ্রুত গাড়িতে উঠে চলে যায়। পেছন থেকে আরো কয়েকটা পাথর এসে তার গাড়ির কাঁচ ভেঙে দেয়।

উজান কিরণকে কোলে তুলে নিয়ে ঘরে আসলো। কিরণের খাটে তাকে নামিয়ে সে চলে গেল নিজের রুমে। যাওয়ার আগে আয়াতকে বলে দিলো কিরণকে আপাতত একা থাকতে দেয়ার জন্য। আর মমতাজকে নিয়ে অন্য রুমে যেতে।

কিরণ পায়ে মাথা গুঁজে বসে আছে। একটু পরপর তার শরীর কেঁপে কেঁপে উঠছে কান্নার দমকে। পুরোনো ক্ষতগুলো এখনো তরতাজা হয়ে আছে মানসপটে।

ঢাকায় যখন সে প্রথম পা রেখেছিল তখন সে ইন্টারমিডিয়েটে। তার মা পাঠিয়েছে তার একটা সুন্দর জীবনযাপনের জন্য। প্রথমে সে এখানে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারেনি। এখানে আসার পর ভালো খারাপ সবরকম বন্ধুবান্ধবের সাথে পরিচয় হয়েছে তার। যার ফলে কিছু খারাপ অভ্যাসের সাথেও পরিচয় ঘটে। তার বন্ধুদলের সাথে নিজেকে মানিয়ে নেয়ার পর ধীরে ধীরে কিছুটা স্বাভাবিক হয় সে। নিজেকে শক্ত করে। নিজেকে ভালোবাসার চেষ্টা করে। কী দরকার পুরোনো স্মৃতি মনে করে বর্তমান নষ্ট করার? তারচেয়ে বরং অতীতটাকে একটা দুর্ঘটনা ভেবে বর্তমানকে আপন করে নেয়াই শ্রেয়।

অনার্স পড়ার পর থেকেই সে কয়েকটা টিউশনি করিয়ে নিজের পড়ালেখার খরচ চালাতো। সে বাড়ির খবর কিছুই জানে না। শুধু মাঝে মাঝে তার মা লুকিয়ে কিরণকে ফোন করত, কিংবা দুই তিন মাসে একবার কিয়াদকে নিয়ে তাকে দেখতে আসত।

হোস্টেলের ভাড়া কিরণ চালাতে না পারায় তাকে বারবার ওয়ার্নিং দেয়া হয়েছিল হয় টাকা দিতে নয়তো চলে যেতে। হোস্টেলের খালা ছিল জল্লাদ মহিলা। তিনি হলের সবার সামনে কিরণকে যা তা বলে অপমান করে। কিরণ অপমান সইতে না পেরে কানের ছোট্ট স্বর্ণের দুল জোড়া দিয়ে চলে আসে সেদিনই। রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে এই ভেবে যে সে কোথায় থাকবে। মা এখন আর টাকা দিতে পারে না কারণ তার সৎ বাবা একটা টাকাও দিত না তার মায়ের হাতে।

উপায় না পেয়ে সে একটা হসপিটালের চেয়ারে একরাত কাটায়। তারপর আবার রাস্তায় উদ্দেশ্যহীন ঘুরে বেড়ায়। তার মেয়ে ফ্রেন্ডরাও হোস্টেলে থাকত যার কারণে তারা কিছুই করতে পারত না। আর ছেলেদের সে ইচ্ছে করেই কিছু জানায়নি। রাস্তায় হুট করেই তখন দেখা হয়ে যায় ইয়ানার সাথে। সেই সময় ইয়ানা আর কিরণের মাঝে সম্পর্ক ছিল শুধুই ক্লাসমেটের। ক্লাসমেট হিসেবে সে কিরণকে নিজের বাড়িতে নিয়ে আসে।

দুদিন ইয়ানার বাড়িতে কাটার পর আর টিকতে পারে না কিরণ সেখানে। ইয়ানা প্রত্যেকটা মুহুর্ত তার বাবা মায়ের সাথে টাকা নিয়ে ঝগড়া করত। আর ঝগড়া করে এসে তার রাগ ঝাড়তো বেচারি কিরণের উপর। ইয়ানা ছিল উচ্ছৃঙ্খল। কিরণের উপর হাত তোলাটাই সে বাকি রেখেছিল। কিরণের এত লজ্জা লাগছিল যে মাঝরাতেই লাগেজ নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। তারপর সে আয়াতের সামনে পড়ে। আয়াত কিরণের সিনিয়র। কিরণের মায়া মায়া মুখ দেখে সে তাকে নিজের বাসায় নিয়ে যায়। সেখানে মীরা আর আরেকটা মেয়ে ভাগাভাগি করে একটা ফ্ল্যাটে থাকত। কিরণকে সেখানেই রাখে আয়াত। মীরাও ছিল কিরণের আরেক ক্লাসমেট।

কিরণ চাকরির জন্য অনেক জায়গায় আবেদন করে কিন্তু যোগ্যতা অনুযায়ী কোনো চাকরি পায় না। তবে সে অনেক কুপ্রস্তাব পেয়েছিল একা থাকার দরুন। প্রথম প্রথম সে খুব ভয় পেত, কান্না করত। কিন্তু ধীরে ধীরে এগুলো গায়ে সয়ে গেছে। সে বুঝে গেছে এরকম হবেই। সে আর পাত্তা না দিয়ে নিজের চড়কায় তেল দিতে থাকে।

এদিকে তার হতাশা চাকরি না পাওয়ায়। তিনটা টিউশনি করত সে। মাসে পেত মোট তের হাজার। কিছু মায়ের হাতে দিত আর কিছু নিজের কাছে রাখত। কিন্তু এতে তার চলত না। টিউশনিও পেত না তেমন। স্টুডেন্টের মায়েরা এমন ভাবে জেরা করত যেন তারা অনেক বড় পদের জন্য মানুষ খুঁজেন।

একদিন দিকবিদিকশূন্য হয়ে এদিক সেদিক ঘুরে বেড়ায় সে। মাঝপথে আবারও দেখা হয় ইয়ানার সাথে। সে নাকি তার কোন কাজিনদের এয়ারপোর্ট থেকে পিক করতে যাচ্ছে। কিরণ সেই পথেই যেত। ইয়ানা সেদিন মুড খারাপ করতে চাইছিল না বলে কিরণকে সাথে নেয়। তার কাছে কতগুলো মদের বোতল ছিল। সেগুলো কিরণের হাতে ধরিয়ে দেয় সে।

সেইদিন কিরণের দুইটি অদ্ভুত মানুষের সাথে দেখা হয়। তাদের মধ্যে একজন ছিল জাওভান। বৃষ্টির মাঝেই জাওভানের সাথে দেখা হয়েছিল তার। এইজন্যেই বর্ষাকালটাকে এত ঘৃণা করে কিরণ। এই বর্ষাকালেই তার জীবনে বড় বড় দুর্ঘটনা ঘটে। যেমন, সে বর্ষাকালে জাওভান নামক দুর্ঘটনা তার জীবনে প্রবেশ করে।

পরদিন সকালে ইয়ানা তাকে ফোন দিয়ে বলে জাওভান মানে গতরাতে যেই ছেলেটা কিরণকে দেখে থমকে গিয়েছিল সে নাকি হন্যিহয়ে কিরণকে খুঁজছে। ইয়ানার কাছে কিরণের নাম্বার ছিল, কিন্তু সে দেয়নি, তার কাছে ফেয়ারওয়েলের একটা পুরোনো ছবি ছিল সেটা দিয়ে দিয়েছে জাওভানকে। ইয়ানা জাওভান সম্পর্কে আরো বলল যে জাওভান নাকি খারাপ, তার নজর এখন কিরণের উপর, এখন কিরণকে নাকি সে বন্দী করবে। এসব শুনে কিরণ ভয় পেয়ে গিয়েছিল অনেক। তার মাথায় বারবার বাজছিল একটা কথা, তার জীবনে আরো একটা সর্বনাশ হতে চলেছে। সে ভয় পেয়েছিল এই ভেবে জাওভান নামক ছেলেটা যদি তার সৎ বাবার মতোই কিছু করে বসে!

তারপর সে দ্রুত লাগেজ গুছিয়ে চলে যায় ময়মনসিংহ, ফুলবাড়িয়ায়। যেখানে তার নিজের বাড়ি। সে যখন পৌঁছায় তখন মধ্যরাত। বৃষ্টিতে তাদের বাড়ির রাস্তা কাঁদা মাটিতে ভরে গিয়েছিল। ফোনে চার্জ নেই যে মাকে কল করবে। টিনশেডের সেই পুরোনো বাড়িটি দেখে কিরণের আতঙ্কে গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। কিন্তু এছাড়া তো আর কোনো উপায়ও নেই। সে পা টিপেটিপে ঘরে যায়। দরজা খোলাই ছিল। কিরণের বুক ঢিপঢিপ করছিল ভয়ে। অন্ধকারে সে কিছুই ভালো করে দেখছিল না। বিজলি চমকানোর আলোতে পা ফেলে ফেলে এগিয়ে যাচ্ছিল। সে তার মাকে অনেক ডাকল, কিয়াদকে ডাকল, কেউই সাড়া দিলো না।

‘কে?’

কর্কশ শব্দের একজন পুরুষের কণ্ঠ শুনে কিরণের সারা শরীর ঠাণ্ডা হয়ে যায়। এই কণ্ঠটা সে চিনে। কিরণ বড় বড় শ্বাস নিয়ে হাত মুষ্টিবদ্ধ করে পেছনে ফিরে। আবারো বিদ্যুৎ চমকায়। দেখে বিশ্রী হাসি হেসে লোকটি তার দিকে চেয়ে আছে।

‘আমার কিরণ মা যে। এতদিন পর আব্বার কাছে আসলি মা?’

লোকটি এগিয়ে আসছিল কিরণের দিকে। কিরণের হাত পা কাঁপতে থাকে। এই লোকটা এখনো তাকে মনে রেখেছে?

‘আব্বা তোমাকে কত মিস করেছি আম্মুটা আমার।’ করুণ মুখ করে বলল ফারুক।

‘মা কোথায়?’ কম্পিত গলায় বলল কিরণ।

‘তোমার মা তো আর আমার সাথে থাকে না। তোমার মা’ও অনেক খারাপ। আমার থেকে তোমাকে আলাদা করেছে। এখন আমার ছেলেটাকেও আলাদা করেছে।’

কিরণ জানত না তার মা যে এখানে নেই। তার মা ফোনে কথা বললে নিজে কী পরিস্থিতিতে আছে সেটা কখনোই কিরণকে জানতে দিতো না।

ফারুক নিজে নিজেই বলতে থাকেন,

‘এক মাস হলো তোমার মা আমাকে ছেড়ে ত্রিশাল চলে গেছে। আমার সাথে নাকি সংসার করবে না। বলো তো, বউ ছাড়া এই বৃষ্টির রাতে একা থাকা যায়?’

ফারুক অসংলগ্ন কথা বলতে থাকেন যে কিরণের গা ঘিনঘিন করা শুরু করে। ফারুক তারপর কিরণের দিকে চেয়ে কুৎসিত হেসে বলে,

‘তোমার মা চলে গিয়েছে তো কী হয়েছে? আমার কিরণ আছে না। তাই না মা? তুমি আছো না বাবার সাথে?’

এই বলে ফারুক কিরণের হাত ধরতে যায়। কিরণ সর্বশক্তি প্রয়োগ করে ফারুকের মুখ বরাবর ঘুষি মারে। উল্টে পড়ে ফারুক। কিরণ দ্রুত লাগেজটা হাতে নিয়ে চলে যেতে নেয়। অন্ধকারে এলোমেলো পা ফেলে হঠাৎ দরজার নিচের কাঠের সাথে পা বেজে উল্টে পড়ে। ফারুক কিরণের পা ধরে টান দেয়। শক্ত করে চেপে ধরে কিরণের টুটি। কিরণ ছটফট করছিল। সে আজ সারাদিনে কিছুই খায়নি তেমন, তার উপর এতটা পথ ক্লান্ত থাকার দরুণ সে ফারুকের সাথে পেরে উঠে না। কেঁদে উঠে সে। ফারুক হাঁটু দিয়ে কিরণকে চেপে ধরে, একহাতে কিরণের গলা চেপে ধরে আরেকহাতে কিরণের জামা টানতে থাকে। কিরণ প্রাণপণে চিৎকার করছিল। কিন্তু ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস! তার চিৎকার গলা অবধিই আটকে ছিল। আর চিৎকার করলেও এই ঝড়ো বৃষ্টিতে কেউ শুনতো কিনা সন্দেহ!

‘আব্বা তোকে আজ অনেক আদর করব কিরণ। সেইদিনের মতো।’
ফারুকের চোখে চকচক করছিল। ফারুক যখন কিরণের টপ ছিঁড়ে তার বুকে হাত দিতে নেয় তখনই কিছু একটা ফারুকের মাথায় জোরে আঘাত করে। যার ফলে ফারুক কিরণকে ছেড়ে মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ে। কিরণকে কেউ ধরে উঠায়। সেই সময় আরেকটা বাজ পড়ে। সেই আলোতে কিরণ দেখে একটা সুদর্শন চেহারার যুবক তার চোখের সামনে। চোখে চশমা পরা। এই ছেলেটিকে সে যেন কোথায় দেখেছিল! মনে পড়ছে না ঠিক মতো। কোথায় যেন?

ছেলেটি কিরণের একহাত চেপে ধরে উঠায়। তারপর সে ফারুকের দিকে তাকিয়ে তার বুকে খুব জোরে লাথি মারে। ছেলেটি কিরণের দিকে চায়। কেন যেন কিরণ ছেলেটির চোখের ইশারা বুঝে ফেলল। সে নিজেও দুর্বল পায়ে ফারুকের গলায় পাড়া দিয়ে অন্ডকোষ বরাবর লাথি মারে। ব্যথায় কুঁকড়ে যায় ফারুক। ছেলেটি কিরণের লাগেজ নিয়ে কিরণের হাত ধরে বেরিয়ে যায়। বাইরেই তার গাড়ি রাখা ছিল।

গাড়িতে উঠার পর কিরণের মনে পড়ে এই ছেলেটাকে সে রেস্টুরেন্টে দেখেছিল। ইয়ানা বলেছিল কী যেন নাম? জাভান না যেন কী? জাওভান! হ্যাঁ জাওভান! এই ছেলেটাকে সে জাওভানের সাথেই দেখেছিল। ইনি কি জাওভানের কিছু হয়?

কিরণকে আবার ভয় ঘিরে ধরল। বুক ধড়ফড় করতে লাগল। এইমাত্র এক জানোয়ারের থেকে বাঁচিয়ে এখন আবার তাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে! সে গাড়িতে কান্নারত গলায় চেঁচিয়ে উঠল,

‘কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন আমাকে? নামান আমি নেমে যাবো!’

ড্রাইভিং করার মাঝেই কিরণের চিৎকার শুনে ছেলেটি এমনভাবে কিরণের দিকে তাকাল যে কিরণের প্রাণপাখি উড়ে যাওয়ার জোগাড়। মনে হয় ঐ চোখ দিয়ে কিরণকে গিলে খাবে। কিরণ জানলোই না ছেলেটি কেন তার দিকে এভাবে তাকাচ্ছে। সে ভয়ে চুপ করে থাকে। ঐ চোখে চোখ রেখে কথা বলার সাহস আর হলো না।

কিরণকে ঢাকায় নিয়ে আসে ছেলেটি। কিরণ জানতে পারে তার নাম উজান। কিরণকে ছেলেটি প্রথমেই একটা রেস্টুরেন্টে নিয়ে যায়। সেখানেই তার কিরণের সাথে করা প্রথম ডিল হয়।

কিরণকে প্রথমে উজান চেপে ধরে তার জীবনটা সংক্ষেপে বলতে। কিরণ ইতস্ততবোধ করছিল অনেক। এমন অচেনা অজানা ছেলেকে কীভাবে সে বলবে এসব? কিন্তু উজান তাকে বলেছিল সাহায্য করবে। তার মাকে আর ভাইকেও। কিরণ অবাক হয়েছিল এই ভেবে উজান কীভাবে জানল তার মা আর ভাই সম্পর্কে? তাও কিরণের কেন যেন ছেলেটির উপর ভরসা করতে মন চাইলো। একদম অজান্তেই। যতই হোক, ছেলেটি তাকে আবার ধর্ষণ হওয়া থেকে বাঁচিয়েছে। তারপর তার সাথে হওয়া প্রত্যেকটা কাহিনী বর্ণনা করে উজানের নিকট। বলতে বলতে সে কেঁদে ফেলে। রেস্টুরেন্টে তেমন মানুষ ছিল না তবে ওয়েটার সহ বাকিরা কেমন ঘুরে ঘুরে চাইছিল তাদের দিকে। উজান বিরক্ত হয়ে একটা কেবিনে ঢুকে পড়ে কিরণকে নিয়ে। তারপর সে বলতে শুরু করে,

‘আমার কথা মন দিয়ে শুনো। আমি তোমাকে সাহায্য করব। তবে তার বিনিময়ে আমাকেও তোমার সাহায্য করা লাগবে।’

কিরণের কান্না থেমে গেল। সে অবাক হলো। সাহায্যের আবার বিনিময় আছে নাকি? আর সে কিইবা সাহায্য করবে? তার কাছে তো টাকা পয়সা কিছুই নেই। আর সামনে বসা লোকটিকে দেখে মনে হয় সে যথেষ্ট সম্পদশালী। অন্তত তার আভিজাত্য পোশাক আর চেহারায় তাই মনে হচ্ছে। সে বিস্মিত গলায় বলল,

‘সাহায্য? আমি কী সাহায্য করব আপনাকে?’

উজান কিরণের দিকে চেয়ে শীতল গলায় বলল,

‘তোমার সাথে আমার একমাসের ডিল হবে।’

‘ডিল! কীসের ডিল?’

উজান ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলল। পরমুহুর্তেই তার মুখ আবার কঠিন হয়ে গেল। সে টেবিলের উপর দুহাত এক করে এগিয়ে বসল। কিরণের চোখে চোখ রেখে গম্ভীর স্বরে বলল,

‘তোমাকে আমার ভাইয়ের গার্লফ্রেন্ড হতে হবে একমাসের জন্য?’

‘মানে?’ কিরণ বিভ্রান্ত।

‘আমি নিশ্চয়ই অন্য ভাষায় কথা বলছি না যে তোমার বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে! যা বলছি সহজ ভাষাতেই বলছি।’

‘কিন্তু আপনার ভাইয়ের গার্লফ্রেন্ড! তাও আবার একমাসের জন্য! বুঝলাম না ব্যাপারটা।’

‘আমার ছোটো ভাই জাওভান। জাওভান তোমাকে পছন্দ করেছে। আমি কখনোই আমার ভাইকে কোনো মেয়ের জন্য এতটা উন্মাদ হতে দেখিনি। সে জীবনে প্রথম কাউকে নিজের করে চাইছে। সে চায় তুমি তার গার্লফ্রেন্ড হও।’

‘সে চাইলেই হবে? সব কি তার ইচ্ছায় চলবে? আমি কি পুতুল নাকি রোবট যে আপনার কথা মেনে আপনার ভাইয়ের গফ হতে যাব। আমার কোনো ইচ্ছা নেই নাকি?’ কিরণ কিছুটা রেগে গেল। এসব কী হচ্ছে তার সাথে?

উজান ধীর স্বরে থেমে থেমে বলল, ‘আপাতত তোমার ইচ্ছা কিংবা মন বলতে কিছুই নেই।’

কিরণের ভেতরে ধেয়ে উঠা রাগ ধপ করে নিভে যায়, সে আস্তে আস্তে বলে, ‘আপনি এভাবে বলতে পারেন না।’

‘তিক্ত হলেও সত্য। ব্যাপারটা তুমি অস্বীকার করতে পারবে না। তোমায় বায়োডাটা আমি জানি। তুমি চাকরি খুঁজছ কিন্তু পাচ্ছো না। তোমার মা আর ভাই ত্রিশালে থাকে। কোনোরকমে টেনেটুনে সংসার চলে। তুমি টিউশনি করাও তিনটে। সেখান থেকে কিছু দাও মাকে। তাও চলতে পারছ না। হিমশিম খাচ্ছো জীবনের প্রতিটা পদে।’

‘আপনি কীভাবে জানলেন?’

‘সেটা জানা জরুরী না তোমার। তোমাকে আমি চাকরি ম্যানেজ করে দিতে পারব। এমনকি তোমাকে ব্লাংক চেক লিখে দেবো। তুমি জাস্ট এমাউন্টটা বসিয়ে দিবে। ভেবে দেখো। শুধুমাত্র একটাই তো মাস। আমার ভাইয়ের আকর্ষণ বেশিদিন থাকবে না। একটা মাস শুধু তোমাকে অ্যাক্টিং করতে হবে যে তুমি জাওভানকে ভালোবাসো, কেয়ার করো। জাস্ট ওয়ান মান্থ। এক মাসের বিনিময়ে তুমি কিন্তু একটা বেটার লাইফ পাচ্ছো।’

এই বলে উজান কফিতে সিপ দিলো। কিরণ ভেবে দেখল, আসলেই তার আর কোনো পথ নেই উজানের কথা মেনে নেওয়া ছাড়া। তার হাতে টাকা পয়সা কিচ্ছু নেই। তার উপর মা আর ভাই নাকি এখন ত্রিশাল অর্থাৎ তার নানবাড়িতে থাকে। তার নানা নানিরা কেউই নেই। বাড়িটা পরিত্যক্ত। সেখানে কীভাবে দিন কাটায় তার মা আর ভাইটা? কিরণ যে ব্যবসা করবে সেই পুঁজিটুকুও নেই। বাসা ভাড়া, খাওয়া দাওয়া, সবমিলিয়ে কিরণের হাতটান লেগেই থাকে। এখন যদি একমাসের বিনিময়ে তার পরিবার একটু সুখের দেখা পায় তাহলে সেটাই হোক। মাত্র একটা মাসই তো। তারপর টাকা পয়সা হলে নাহয় ব্যবসা করা যাবে। সে তৎক্ষণাৎ হ্যাঁ বলে দেয় উজানকে।

কিন্তু কিরণ ভাবতেও পারেনি তার জীবনটা যে অন্যদিকে মোড় নেবে। উজানের ভাই জাওভান তাকে বন্দী করে রাখতে চাইতো। একমাসের ডিল শেষ হলেও জাওভান কিছুতেই কিরণকে ছাড়তে চাইতো না, যদিও জাওভান এসব ডিলের ব্যাপারে অজ্ঞাত ছিল।

কিরণের দমবন্ধ হয়ে আসছিল জাওভানের সাথে থাকতে থাকতে। এই নিয়ে উজানের সাথে অনেকবার কথা কাটাকাটি হয়েছিল। কিন্তু উজান এমনভাবে দোষটা কিরণের উপর চাপাল যে কিরণ আসলেই ভাবতে লাগল যে সে আসলেই দোষী। তারপর থেকে সে উজানকে দুচোখেও সহ্য করতে পারত না। দুই ভাই তার জীবনটা অতিষ্ঠ করে তুলত।

.

.

অতীতের কথা ভেবে কিরণ দীর্ঘশ্বাস ফেলে। এতক্ষণ ধরে একটু অতীতের স্মৃতিচারণ করছিল সে। কিরণ আসলেই কত বোকা তাই না? দুনিয়ার সবাই তাকে ইউজ করে। দুনিয়াতে এসেছেই সে অন্যের ব্যবহারের বস্তু হতে!

আজ জাওভান তাকে কত কথা শোনালো! কিরণ নাকি চরিত্রহীনা! তাকে নাকি কেউ বিয়ে করবে না? তা মনে করে কিরণ তাচ্ছিল্যের হাসি হাসে। না করুক। সে তো বিয়ের জন্য পাগল হয়ে যাচ্ছে না। আচ্ছা! জাওভান কী ভেবে কিরণকে এত কথা শোনালো? চিরুনি তল্লাশি চালালেও তো কিরণের দোষ খুঁজে পাওয়া যাবে না। সে ধর্ষিতা এটাই কি তার দোষ?

কিরণ হাঁটুতে মুখ গুঁজে আবারও কেঁদে উঠে। সে একটু শান্তি চায় শুধু। মরে গেলেই শান্তি হতো তার।

ঠকঠক শব্দ হয়। কিরণ মাথা তুলে তাকায়। চোখ ফিরিয়ে নেয় দরজার দিকে। দেখে উজান দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কিরণ চোখ মুছে নেয় দুই হাতে। ঘড়িতে দেখে এখন রাত সাড়ে এগারোটা। এত তাড়াতাড়ি রাত হয়ে গেল!

উজান কিরণের লাল হওয়া ফুলো ফুলো চোখের দিকে চেয়ে বলল,

‘চলো?’

‘হুম?’ প্রশ্নবোধক চাহনিতে চায় কিরণ।

উজান কিরণের প্রশ্ন উপেক্ষা করে কিরণের খাটের কাছে আসে। কিরণের হাত ধরে খাট থেকে নামায়। কিরণ চমক লাগানো দৃষ্টিতে তাকায় উজানের দিকে। উজান কিরণের হাত ধরে নিয়ে যেতে যেতে বলল,

‘একজন তোমাকে দেখতে চাইছে?’

‘কে?’

‘গেলেই দেখতে পাবে।’

কিরণ দেখে সারা বাড়ি অন্ধকার।

‘আয়াত আর আহযান চলে গেছে?’

‘হুম।’

‘মা কোথায়?’

‘ঘুমোচ্ছে।’

তারপর আর কেউ কথা বলে না। কিরণ উজানকে অনুসরণ করতে থাকে। উজান এখনো তার হাত ধরে আছে। কিরণের অস্বস্তি লাগছিল। হাত ছাড়াতে চাইছিল কিন্তু পারল না।

উজান তাকে নিয়ে বাড়ির পেছনের দিকে যাচ্ছে। জঙ্গলের পথ। লতাপাতা, গাছের ডাল এদিক সেদিক পড়ে পথ বন্ধ করে রেখেছে। উজান খুব সাবধানে কিরণকে নিয়ে পথ পার করল।

তারপর চলে আসল নদীর ধারে। হিম শীতল হাওয়া এসে গা ছুঁয়ে দিল কিরণের। শীতে কুঁচকে গেল সে। উজান তা লক্ষ্য করে হাতে থাকা এক্সট্রা চাদরটা কিরণের গায়ে জড়িয়ে দিলো। সে জেনেই আলাদা একটা চাদর এনেছে।

কিরণ মুখ হা করে ধোঁয়া ছাড়ছে। ছোটকালে ভাবত তার পেটে বুঝি আগুন ধরেছিল! আবার এভাবে দুই আঙুল মুখের কাছে নিয়ে সিগারেটের ভঙ্গিতে ফু দিয়ে ধোঁয়া ছাড়ত।

আকাশে জ্যোৎস্না। থালার মতো চাঁদ উঠেছে। নদীটায় রুপালী রঙা আলোয় ঝিলমিল করছে। আকাশ স্বচ্ছ। কতগুলো তারা এসে চাঁদকে সঙ্গ দিয়েছে। কিরণ মুগ্ধনয়নে তাকিয়ে রইল। আকাশ দেখলেই তার মন ভালো হয়ে যায়। হঠাৎ কিছু একটা মনে পড়তে সে উজানের দিকে তাকাল। দেখল উজান তার দিকেই তাকিয়ে আছে। বিব্রত কণ্ঠে সে বলল, ‘কার কথা বলছিলে তখন? কে দেখতে চেয়েছিল?’

উজান আকাশের চাঁদটার দিকে ইশারা দেয়। কিরণ লজ্জা পাওয়ার সাথে বিস্মিত হয়। উজানের থেকে এই ধরনের আচরণ আশা করেনি। উজান কেমন যেন বদলে যাচ্ছে।

কিরণ উজানের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে গাছের গুড়িতে বসল। উজানও এসে তার পাশে বসল। গাছের গুড়িটা বড়ই ছিল। কিন্তু তাও কিরণের কেমন যেন লাগছিল। সে চেপে বসল আরো। উজানের কথা মাথা থেকে ঝেড়ে নজর দিল চাঁদের দিকে। কী সুন্দর মোহনীয়, কোমল! চারিদিকের অন্ধকারকে বিদায় করে স্বর্গ থেকে একটুকরো আলো যেন ধরণীতে ছড়িয়ে পড়ছে। জ্যোৎস্নারা গলে গলে পড়ছে। চাঁদের যাদুকরী আলোয় কিরণের মনখারাপ নিমিষেই কর্পূরের মতো উড়ে গেল। বাতাসে নাম না জানা এক ফুলের ঘ্রাণ ভেসে বেরাচ্ছে। সৌরভে মুখরিত চারপাশ। কিরণ বড় করে শ্বাস টেনে মিষ্টি সুবাসটা নিজের বুকের ভেতরে নেয়ার চেষ্টা করল।

এমন শান্ত, নিরব, নিস্তব্ধ পরিবেশে হঠাৎ উজানের পুরুষালী কন্ঠ ঝংকার তুলে বলে উঠে,

‘দ্য মুন ইজ বিউটিফুল, ইজন্ট ইট?’

উজানের করা প্রশ্নে কিরণ চাঁদের দিকে তাকিয়ে মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় বলে উঠে,

‘আসলেই, ইচ্ছে করে উড়ে চাঁদের দেশে চলে যেতে। ইশ! যদি চাঁদের মতো জীবনটাও স্নিগ্ধ হতো!’

.
.
চলবে…