#সুখের_নেশায়
#লেখিকাঃ আসরিফা সুলতানা জেবা
#পর্ব___৩২
বর্ষার মৌসুমে এবার ঝড়,বৃষ্টি, রোদ সবই ঠিক পরিমাণে প্রকৃতিতে নিজের আগমন ঘটিয়েছিল। আজ প্রকৃতিকে স্নিগ্ধ, সতেজ রাখা মাস টার শেষ দিন। যদিও উল্টো নিয়মে তপ্ততার দেখা মিলেছিল প্রচন্ড পরিমাণে তবে বর্ষণের কমতি হয় নি। বরণ রৌদ্দুর তো মাঝে মাঝে ধরণীতে বেড়াতে এসেছিল। পুরো মাস জুড়ে কেবল রাজত্ব করে বেড়িয়েছে বৃষ্টি। চৈত্রিকা ফজরের নামাজ পড়ে জানালার ধারে এলো৷ সাফারাত এর কাছ থেকে ফিরে এসে বাকি রাত টুকু পাড় হয়েছে এই জানালার কাছে বসে। কেন যেন তন্দ্রা আর ধরা দেয় নি তার চক্ষে। অকারণেই আজ বাবার কথা মনে পড়ছে বড্ড,ভীষণ। মন চাইছে সিলেট ছুটে যেতে। বাবা কে না দেখুক, মনের শান্তির জন্য হলেও একটা বার কবরটা দেখে আসতে।
‘ আমি এতো অভাগিনী কেন হলাম বাবা?কেন শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার আগেই আমার মাথায় আদর করে হাত বুলালে?তোমার অভিমান, জেদ,রাগের পাহাড় টা কি আগে ধ্বসে পড়তে পারে নি বাবা?’
মিনমিন স্বরে অভিযোগ মিশ্রিত বাক্যগুলো উচ্চারণ করতে গিয়ে চৈত্রিকার গলা ধরে এলো। নেত্রদ্বয় জলে পরিপূর্ণ হয়ে উঠল। চৈত্রিকা আখিঁপল্লব বুঁজল। অশ্রু কণাদের গড়িয়ে যেতে দিল বিনা বাঁধায়,অতি সন্তর্পণে। আগামীকাল এই বাসা ছেড়ে চলে যেতে হবে। মা ও বোন কে বিভিন্ন ভেজালের মাঝে রেখে যেতে পারবে না সে। জানালার পাশ থেকে সরে এসে আলমিরা খুলে কিছু জমানো টাকা ছিল প্রায় পাঁচ হাজারের মতোন। সেগুলো বের করে হাতে নেয়। মায়ের ঘরে উঁকি দিতেই দেখে ফাহমিদা নামাজ পড়ছেন। চৈত্রিকা দরজার কাছ থেকে দাঁড়িয়ে রুমের চারদিকে চোখ বুলায়। বাবা বেঁচে থাকতে ভয়ে এই রুমে আসার সাহস অব্দি হতো না ওর। অথচ আজ রুমে বাবা নেই। কতটা অগোছালো সবকিছু। চৈত্রিকা মনে মনে ঠিক করে নেয় রুমটা গুছিয়ে দিবে,তার আগে বাড়িওয়ালার সাথে দেখা করা জরুরি। এক মাসের ভাড়া চুকিয়ে দিবে। নাহলে যাওয়ার পর যদি মিম ও ফাহমিদাকে বাড়িওয়ালা হেনস্তা করে তা কোনো ক্রমে সইতে পারবে না চৈত্রিকা।
সিড়ি ডিঙ্গিয়ে উপরের তালায় এলো। গত কয়েক দিন পূর্বে বাড়িওয়ালারা এই ফ্ল্যাটে শিফট হয়েছেন। হয়ত এখন থেকে সবসময় এখানেই থাকবেন। চৈত্রিকা বার দুয়েক কলিং বেল বাজালো। পরমুহূর্তে মনে হলো এতো সকালে হয়ত সকলে নিদ্রায় বিভোর। ঠিক হয় নি এখন আসা টা। চলে যেতে নিলেই দরজা মেলার আওয়াজ কর্ণপাত হওয়া মাত্র ঘুরে দাঁড়াল। সামনে তজবি হাতে উপস্থিত মহিলাটার দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করল,
‘ আংকেল আছেন বাসায়?আসলে আমি অবুঝের মতো এতো সকালে চলে এলাম। তার জন্য দুঃখিত আন্টি। ‘
মহিলা একগাল হেসে বললেন,
‘ সমস্যা নেই। এসো। ‘
চৈত্রিকা পায়ের সেন্ডেল জোড়া খুলে রাখে একপাশে। উন্মুক্ত পায়ে সুস্থির ভাবে হেঁটে ভিতরে আসে। মহিলা টা আবারও একগাল হেসে বললেন,
‘ শুনলাম কাল নাকি তোমার বিয়ে?’
চৈত্রিকার কেন যেন লজ্জা অনুভব হলো। চোখের পলক ঝুঁকিয়ে বললো,
‘ বিয়ে হয়ে গিয়েছে আন্টি। কাল ছোটখাটো একটা অনুষ্ঠান। ‘
‘ হুম। শুনেছি তোমার মায়ের কাছে। তুমি বসো। আমি তোমার আংকেল কে ডেকে আনছি। ‘
পাশের একটা বেতের চেয়ারে বসতেই বাড়িওয়ালা চোখে বড় একটা চশমা ঝুলিয়ে রুম হতে বেরিয়ে এলেন। চৈত্রিকার কাছে এই লোক কে ভালো লাগে না। উনার ওয়াইফের ব্যাবহার যতটা মিষ্টি উনার ব্যবহার ঠিক তার উল্টো। উগ্র মেজাজের ও কর্কশ।
‘ আসসালামু আলাইকুম আংকেল। ‘
বাড়িওয়ালা সালামের জবাব দিয়ে বলে উঠলেন,
‘ বসো। ‘
‘ বসবো না। একটা অনুরোধ ছিল আংকেল। প্লিজ ফিরিয়ে দিবেন না। আমাদের তো তিন মাসের ভাড়া জমে আছে। আপাতত এক মাসের রাখুন। বাকি দু মাসের আমি খুব জলদি দিয়ে দিব। আমার খুব ভালো একটা জব হয়েছে। তাড়াতাড়ি দিয়ে দিব। ‘
‘ টাকা টা তুমি রাখো। আমি তিন মাসের ভাড়া নিব না। ‘
হতবিহ্বল হয়ে পড়ে চৈত্রিকা। ওর মনে হলো ভুল শুনেছে। হকচকানো স্বরে প্রশ্ন করলো,
‘ কি বলছেন আংকেল?’
‘ তিন মাস তোমাদের উপর দিয়ে অনেক ঝড় ঝাপটা গিয়েছে মা। আমাকে ভাড়া দিতে হবে না। বসো। চা খেয়ে যেও৷ ‘
কথাটা বলেই উনি চলে গেলেন ড্রইং রুম ছেড়ে। চৈত্রিকার মনে হচ্ছে এটা কোনো ভ্রম, যা হতে বেড়িয়ে আসা অত্যন্ত জরুরি। যেই লোক ওর বাবা অসুস্থ থাকা কালীন ভাড়ার জন্য খুব কড়া কথা শুনিয়েছেন তিনিই গত কয়েকদিন ধরে ভাড়া নিতে অস্বীকার করছেন। সবকিছু কেমন অদ্ভুত ঠেকছে। এক লহমা,এক মুহূর্তও দেরি না করে চৈত্রিকা বাসায় চলে এলো। ঘরে ঢুকতেই শুনতে পায় ফাহমিদার চিন্তিত স্বর।
‘ কোথায় গিয়েছিলি?’
‘ ছাদে গিয়েছিলাম মা। তুমি গিয়ে রেস্ট নাও। আজ নাস্তা আমি বানাব। ‘
ইচ্ছে করেই ভাড়া দিতে যাওয়ার বিষয়টা চেপে গেল ও। পরে দেখা যাবে বাড়িওয়ালার হুটহাট পরিবর্তনে ওর মা ডিপ্রেশনে পড়ে গিয়েছে।
.
.
কোমরে ওড়না বেঁধে চৈত্রিকা আহমেদ সাহেবের রুমটা গোছাতে শুরু করে। তার কতকালের ইচ্ছে ছিল বাবার সবকিছু নিজ হাতে গুছিয়ে দিবে তা আর হলো না। এখনও মনে পড়ে বছর খানেক আগে টিউশনের টাকা জমিয়ে বাবার জন্য একটা পাঞ্জাবি কিনেছিল। কিন্তু আহমেদ সাহেব নেন নি তা। উল্টো শপিং ব্যাগ টা ছুঁড়ে ফেলেছিলেন ফ্লোরে। চৈত্রিকা কাঁদতে ভুলে গিয়েছিল। ভিতরে ভিতরে বুক টা ফেটে যাচ্ছিল ওর। ফাহমিদা ওকে বুকে জড়িয়ে বলেছিল একদিন তোর বাবা অনেক ভালেবাসবে চৈত্র। মিলিয়ে নিস তুই। কই মিলল না তো মায়ের কথাটা!একদমই মিলে নি। মা হয়ত সান্ত্বনা দেবার জন্য বলেছিল।
চৈত্রিকার বক্ষজুড়ে বিষের ন্যায় বিষাক্ত যন্ত্রণা ছড়িয়ে পড়ল। কন্ঠনালি টাও কেমন কাটা কাটা দিয়ে উঠছে। ব্যাথা করছে বেশ। চক্ষু বুঁজে দীর্ঘ একটা নিঃশ্বাস ফেলে লেগে পড়ে আবারও কাজে। বিছানা ঝেড়ে বাবার টেবিলের সামনে আসে। আহমেদ সাহেব প্রচুর বই পড়ুয়া লোক ছিলেন। জীবনের অবসর সময়গুলো তিনি ব্যয় করেছেন বই ও পেপার পড়ে। এখনও একটা বই খুলে উল্টে রাখা হয়েছে। হয়ত শেষ বেলায় এই বই টা-ই পড়ছিলেন উনি। তিনি মারা যাবার পর এই রুমের একটা আসবাবপত্রও নাড়েন নি কেউ। ফাহমিদা রাতে মিমের সাথেই থাকে ওর রুমে। চৈত্রিকা বই টা ঠিক করে রাখতে যাবে তখনই একটা কাগজ বই থেকে ছিটকে পড়ে টেবিলে। অতিশয় বিস্ময়ে থমকে যায় চৈত্রিকা। বই টা রেখে টেবিল হতে ভাজ করা কাগজ টা হাতে তুলে নেয়। ভাজ খুলবে কি খুলবে না দ্বিধাদ্বন্দে ভোগে কিয়ৎপরিমাণ সময়,সেকেন্ড। অতঃপর মেলে ধরেই কাগজটা। বরাবরই সুন্দর ছিল আহমেদ সাহেবের লিখা।
কাগজটা মেলে ধরতেই বড়সড় ঝটকা খায়। কয়েক পা পিছিয়ে বিছানায় বসে পড়ে।
” আমি কি আদৌ বাবা হওয়ার যোগ্য?আমি তোর সকল কষ্টের,দুঃখের কারণ চৈত্রিকা। তুই যখন জন্ম নিয়েছিলি পরিবারের সবচেয়ে খুশি ব্যক্তি টা আমি ছিলাম। আমার সেদিন মনে হয়েছিল আমি এমন এক জিনিস পেয়েছি যা পৃথিবীর সকল দামী দামী উপহারকে হার মানায়। পুতুলের মতো গড়ন ছিল তোর। সাদা ধবধবে ছোট ছোট হাত, পা। তোর মা যখন তোকে আমার কোলে দিতে চেয়েছিল ভয় পেতাম বাবার শক্তপোক্ত হাতে তোর নরম,কোমল দেহ টা আঘাত পাবে না তো?সেই আমি তোর জীবনটা দুর্বিষহ করে ফেলেছি পুত্র মোহে আচ্ছন্ন হয়ে। ছেলে হবার পর সবাই বলতো মেহুল আমার বুড়ো বয়সের লাঠি, শক্তি। মেয়েরা তো বিয়ে দিলে অন্যের ঘর সাজাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। একটা সময় পাড়া প্রতিবেশীর এসকল কথায় আমি পাল্টে যাই। তোর চেয়েও বেশি ভালোবাসতে শুরু করি মেহুলকে। তুই যখন চিল্লাচিল্লি করতি ছোট বেলায় অবুঝ মনে আমি মেহুলকে কেন বেশি আদর করি তখন আমি হাসতাম। মাঝে মাঝে দেখতাম তুই মেহুল কে কাঁদাস। মেহুলের মৃত্যুর পর আমার মনে হতো তুই হিংসার চোটে মেহুলকে সেদিন ছাদ থেকে ফেলে দিয়েছিস। হতে পারে অবুঝ মনে হিংসা পুষে রেখে ওকে ইচ্ছে করেই ছাদে নিয়ে গিয়েছিলি যেন ওর ক্ষতি হয়ে যায় এটাই এতো বছর যাবত ধারণা করে রেখেছিলাম আমি। তোকে দেখলে মেহুলের মৃত্যুর কথা মনে পড়ে যেত। আমার রাগ হতো। আমি জানি আমার এমন ভাবনা টাই ছিল ভুল। তুই ছোট বয়সেও অবুঝ ছিলি না কিন্তু তোর বাবা তোকে ভুল বুঝে সারাজীবন কষ্ট দিয়ে গিয়েছে। জানি আমি ক্ষমার যোগ্য না। আমার এই অসুস্থ সময়ে তুই রাতের আঁধারে ভয়ে চুপিচুপি ওষুধের প্যাকেট রেখে যাস অথচ হাত বাড়িয়ে আমি তোকে কাছে ডাকতে পারি না। কারণ আমি প্রকৃত দোষী। আমি বাবা হয়ে উঠতে পারি নি। বাবা রা কি সন্তানদের মধ্যে পার্থক্য করে?কিন্তু আমি করেছি। ছেলেকে বুড়ো বয়সের লাঠি ভেবে মেয়েকে অবহেলা করার কারণেই হয়ত আল্লাহ আমায় চিরতরে পঙ্গু বানিয়ে দিয়েছেন। আমার এই সময়গুলোতে মন গলে গেলেও, নিজের ভুল বুঝতে পারলেও আমার যে তোকে কাছে ডাকার আর মুখ নেই। আজ বাকহারা আমি মা। তোর চোখে আমি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বাবা নয় বরং সবথেকে খারাপ,জঘন্য পিতা। এই কাগজের লিখাগুলোও তোকে দেখানোর সাহস আমার নেই। এটা কখনও তুই পাবি কিনা তাও জানিনা। তোর ক্ষমার অযোগ্য বাবা টাকে পারলে ক্ষমা করে দিস। ”
যার প্রতি কোনোদিন রাগ,ক্ষোভ রাখে নি তাকে কি ক্ষমা করবে?চৈত্রিকার তো বাবার প্রতি কোনো কষ্ট নেই। শুধু আক্ষেপ রয়ে গেছে ভালোবাসা পাবার। বাবা ভুল বুঝতে পেরেছে এটাই ওর জন্য অনেক বেশি পাওয়া। তবুও চৈত্রিকার ভিতরটা দুমড়েমুচড়ে যাচ্ছে। কি করে পারলেন আহমেদ সাহেব এমন ভেদাভেদ করতে?সত্যিই কি ছেলেরা বাবা মায়ের বুড়ো বয়সের লাঠি হয়? মেরুদন্ড হয়?মেয়েরা হয় না?চিঠি টা দেখলে মা ও মিম কষ্ট পাবে তাই ওড়নার আড়ালে লুকিয়ে নিজের রুমে চলে আসে চৈত্রিকা। বাবা নিজের ভুল স্বীকার করে ক্ষণিকের নিমিত্তে হলেও তো ওর জন্য মায়া দেখিয়েছে। এটাই বা কম কিসের? চৈত্রিকা বিড়বিড় করে বলে উঠল– ‘ তোমার প্রতি কোনো অভিমান নেই বাবা। খুব ভালোবাসি তোমায়। বড্ড বেশি। ‘
____________________
মোবাইল হাতে নিয়ে বসে আছে চৈত্রিকা প্রায় এক ঘন্টার উপর হবে। সাফারাতের সাথে কথা হয়েছিল একবার দুপুর বেলায়। জ্বর কমেছে কিনা জিজ্ঞেস করাতে জানালো নিজে চেক করে নিতে। ভারী অবাকতায় জড়িয়ে গেল চৈত্রিকা। ও কি করে চেক করবে?দেখা তো কাল হবে। এখন ফোন দেওয়াতে প্রিয়ন্তী রিসিভ করে এবং জানায় সাফারাত রুমে নেই৷ তাই চৈত্রিকা মেবাইল হাতে নিয়েই বসে আছে কখন আবার কল আসে সেই আশায়। সাফারাত এর অনুপস্থিতিতে আজকাল হৃদয় ভীষণ শূন্য শূন্য অনুভব করে। মন ছুটে যেতে চায় মোহগ্রস্ত হয়ে বারংবার। এটাই কি প্রণয়ের, প্রেমের শক্তি?
অকস্মাৎ রুমে কারো পায়ের শব্দে চৈত্রিকা নড়েচড়ে উঠল। ঘাড় একটুখানি বাক ফিরাতেই দেখে মিমের পড়নে একটা হলুদ লেহেঙ্গা। মুখশ্রীতে হালকা পাতলা মেকআপ এর আস্তরণ। হতভম্ব, বিস্মিত হয় চৈত্রিকা। উত্তেজিত সুরে প্রশ্ন করে,
‘ এভাবে সেজেছিস কেন?কোথাও যাচ্ছিস?’
‘ কোথায় যাবো?নিজের বোনের বিয়ে কাল আর আমি আজকে অন্য কোথাও যাবো?তোমার মেহেদি অনুষ্ঠান ও হলুদ উপলক্ষে সাজলাম। একটা মাত্র বোন বলে কথা। ‘
‘ হলুদ?এসব কিছুই হবে না। আর এতো দামী ড্রেস কে কিনে দিল?আবার বিকাল হতে খেয়াল করছি তুই বারবার ছাদে আসা যাওয়া করছিস। ব্যাপার কি?
চৈত্রিকা ভ্রুঁ যুগল কুঁচকালো। সন্দেহের দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো মিমের দিক। মিম কথা চেপে গিয়ে বললো,
‘ ভাইয়া দিয়েছে। এবার উঠো। তোমাকে রেডি করাতে হবে। ‘
‘ কোন ভাইয়া?সাফারাত? ‘
‘ হু। ‘
সংক্ষিপ্ত উত্তর দিয়ে মিম সবুজ রঙের একটা লেহেঙ্গা শপিং ব্যাগ থেকে বের করে চৈত্রিকাকে পড়ার জন্য তাড়া দেয়। চৈত্রিকা একের অপর এক প্রশ্ন করেও উত্তর না পেয়ে মিমের জোরাজোরি তে লেহেঙ্গা টা পড়তে বাধ্য হয়। হাত টেনে বিছানায় বসিয়ে দেয় মিম। লাল কালার জারবেরা ফুলের টিকলি,দুল,হার পড়িয়ে দিল চৈত্রিকাকে। এখানেও জারবেরা ফুল?বুক টা ধ্বক করে উঠে চৈত্রিকার। কিছুই বুঝতে পারছে না। হালকা করে সাজিয়ে মিম হাসি মুখে বললো,
‘ এখন অনুষ্ঠানের জন্য রেডি তুমি। চলো আপু। আর এসব তোমার হাসবেন্ড পাঠিয়েছে। ‘
চৈত্রিকার মুখ থেকে অস্ফুটস্বরে বেরিয়ে আসে,
‘ এই জারবেরা ফুল গুলোও?’
সিঁড়ি বেয়ে ছাদের দরজা অব্দি আসে দু বোন। চৈত্রিকার মিহি স্বরের প্রশ্নটা হয়ত মিমের কর্ণগোচর হয় নি। পিছন থেকে দু চোখে হাত রেখে বললো,
‘ পা বাড়াও আপু। ‘
‘ কি করছিস?’
‘ উফ!হাঁটো তো। ‘
চৈত্রিকা হাঁটে ধীর গতিতে। একটা সময় থেমে যায় মিমের কথায়। মিম চক্ষুদ্বয় হতে হাত সরাতেই চৈত্রিকা ঝাপসা দৃষ্টিতে চারপাশে অবিন্যস্ত দৃষ্টিতে তাকায়। নিমিষেই স্তব্ধ হয়ে পড়ে। নিজেকে আবিষ্কার করে ছাঁদের টিমটিমে আলোয় একদম মাঝের স্থানে পাশে দেখতে পায় সিনথিয়া,মিহিতা,মিম,দিহান,আয়ান,প্রিয়ন্তীর হাসি মাখা মুখ গুলো। জেরিনও দাঁড়িয়ে আছে এক পাশে। তবে মুখে হাসির অভাব। সবাই একটুখানি দূর হতে গোলাপের পাপড়ি ছিটাতে শুরু করে চৈত্রিকার উপর। খুশিতে কেঁদে দেওয়ার উপক্রম ওর। পুরো ছাদ ফেয়ারি লাইট দিয়ে সাজানো। একপাশে ফুল দিয়ে ভরপুর ছোট খাটো একটা স্টেজ। এক মুহুর্তের জন্যও কল্পনা করে নি আজ এমনভাবে সারপ্রাইজ পাবে ও। সিনথিয়া দু’ হাত ধরে বলে উঠল,
‘ অবাক হওয়ার আরো কারণ আছে?এখনই সব অবাকতা দেখিয়ে ফেলবি?মেহেদি আর্টিস্ট চলে এসেছে। চল। ‘
চৈত্রিকাকে স্টেজে বসাতেই দু’টো মেয়ে দুই দিকে বসে মেহেদী দেওয়ার জন্য। চিকন হাত দুটো মেলে ধরে ও। এতো আয়োজন কার করা চৈত্রিকার বুঝতে বাকি নেই। কিন্তু সবাই এলো সাফারাত কি আসে নি?লজ্জায় কাউকে জিজ্ঞেসও করতে পারছে না চৈত্রিকা। একজন মেহেদী আর্টিস্ট জিজ্ঞেস করে ,
‘ ম্যাম আপনার বরের নাম?’
চৈত্রিকা বলতে নিলে সম্মুখ হতে ভেসে আসে,
‘ সাফারাত। ‘
#চলবে,,,!
#সুখের_নেশায়
#লেখিকাঃআসরিফা_সুলতানা_জেবা
#পর্ব___৩৩
চৈত্রিকার চোখ ধাঁধিয়ে আসছে। পল্লব ঝাঁকিয়ে অভিভূত দৃষ্টি মেলে ধরে সামনের দিক। সুন্দর মানুষ শুভ্র রং পরিধান করলে ঠিক কেমন লাগে তার ব্যাখা দেওয়ার ক্ষমতা নেই চৈত্রিকার। মানস্পটে বিশ্লেষণ করার ক্ষেত্রে উপযুক্ত শব্দের অভাব। বড্ড অভাব। সাফারাতের গায়ে জড়ানো শুভ্র রঙের পাঞ্জাবি দেখে ওর হিচকি উঠছে রীতিমতো। সিনথিয়া পানির গ্লাস নিয়ে ওর মুখের সামনে ধরল। একটুখানি পান করে পুনরায় সাফারাত এর দিক দৃষ্টি জ্ঞাপন করল চৈত্রিকা। সঙ্গে সঙ্গে শুনতে পায় পুরুষালি গম্ভীর, ব্যগ্র স্বর।
‘ আপনি ঠিক আছেন চৈত্র? ‘
অভ্যন্তরের রণঢাকের আওয়াজে চৈত্রিকা নিজেই অতিষ্ট,বিরক্ত। সমস্ত বক্ষস্থল জুড়ে নিদারুণ কম্পন। শরীরের প্রত্যেক ভাঁজে শিহরণ। চোখ দুটো বেহায়ার ন্যায় কেবল সাফারাতের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। কন্ঠনালি জড়িয়ে আসছে। উফ!এই পরিপক্ব বয়সে এসে কোনো পুরুষের ধারালো রূপে কপোকাত হওয়ার ব্যাপারটা চৈত্রিকার দম বন্ধ করে দিচ্ছে। নিজেকে কিশোরী বয়সের, আবেগি সেই চৈত্রিকার সাথে মিলিয়ে, গুলিয়ে ফেলছে ও। ব্লাশ দেওয়া কপোল দু’টো লজ্জায় দ্বিগুণ লাল বর্ণে ছেয়ে গেল। মাথা নাড়িয়ে জানালো ঠিক আছে। তবে সাফারাত ভ্রুঁ উঁচিয়ে এক দৃষ্টিতে অপলক চেয়ে আছে। যা দেখে থতমত খেয়ে যাওয়ার অবস্থা চৈত্রিকার। দ্রুতপদে চক্ষুদ্বয় নামিয়ে মেঝেতে নিবদ্ধ করে ও।
সাফারাত একটা প্লাস্টিকের চেয়ার টেনে একদম সমুখ বরাবর এবং নিকটে বসে। নত মস্তকে ঝুঁকে থাকা চৈত্রিকার দিকে চাইতেই অধর কার্নিশ ক্ষীণ বাঁকা হয় তার। সিনথিয়া হাত নেড়ে বলে,
‘ কি জামাই সাহেব? আমার ছেলে কোথায়?’
সাফারাত চৈত্রিকার দিকে নজর রেখেই রাশি ভারী কন্ঠে প্রতুত্তরে জানায়,
‘ এক নম্বর পেয়েছে তোমার ছেলের আসার সাথে সাথেই। আয়ান নিচে নিয়ে গেল। আসছে বোধ হয়। ‘
‘ তুমি মামা হয়ে আমার ছেলেটা কে এক নাম্বার করিয়ে আনতে পারলে না?কষ্ট করে আবার আমার জামাই টাকে পাঠালে। বউ দেখার এতো তাড়া? আমরা কি তোমার বউ গিলে খেয়ে ফেলব?’
‘ উনাকে গিলে তোমরা হজম করতে পারবে না। কারণ উনাকে হজম করার ক্ষমতা শুধু আমার। অযথা শক্তি ব্যয় করবে না আমি জানি। ‘
সাফারাতের কথা শুনে হাসির রোল ছড়িয়ে পড়ে পুরো ছাঁদে। চৈত্রিকা ভীষণ অবাক হয়। সময়ের সাথে সিনথিয়া ও সাফারাত এর সম্পর্ক কি সুন্দর একটা রূপ নিয়েছে!দু’জন যেন ভাই-বোন। এত সুন্দর খুনসুটি দু’জনের মাঝে। তন্মধ্যে বিল্ডিংয়ের প্রায় সকল ভাড়াটিয়া হাজির হয়েছে অনুষ্ঠানে। মিম কে দিয়ে সবাইকে আমন্ত্রণ জানিয়েছে সাফারাত। সে চায় না চৈত্রিকার এই রাত টা পানসে কাটুক। উপস্থিত সকলেই সাফারাত এর প্রশংসায় পঞ্চমুখ। কিছু কিছু মেয়ে তো ফিসফিস করছে সাফারাতের লুক নিয়ে। তার মধ্যে পাশ থেকে একটা মেয়েলি মিষ্ট স্বর কর্ণপাত হয় চৈত্রিকার।
‘ চৈত্র আপুর ভাগ্য টা অনেক ভালো। নয়ত আমরা কেন এতো সুন্দর বড়লোক ছেলে পাই না?ইশ!আমাদের হাসবেন্ড যেন এমন সুদর্শন হয়। চোখ সরানো দায় হয়ে পড়ছে। ‘
চৈত্রিকার স্পৃহা,অভিলাষ জাগে মেয়েটার মুখে মেহেদী লেপে দিতে। কাউকে নিজের সুখের ভাটা হতে দিবে না ও। সারাজীবন দুঃখে জর্জরিত হয়ে যাওয়া মানুষ যদি একটুখানি সুখের নাগাল পায় তবে চেষ্টা করে নিজের প্রাণপণ দিয়ে সেই সুখ টুকু আগলে রাখার। চৈত্রিকাও তার ঊর্ধ্বে বা নিম্নে নয়। একদমই তেমন।
মিম হলুদের ঢালা নিয়ে মাঝ সিঁড়িতেই পা রাখতেই হুট করে সামনে দিহান এসে হাজির হয়৷ অকস্মাৎ এহেন কান্ডে মিম ভড়কে যায়। দেহের তাল সামলাতে ব্যর্থ হয়ে পশ্চাতে পড়ে যেতে উদ্যত হওয়া মাত্র হাত টা শক্ত করে আঁকড়ে ধরে দিহান। নিজের বুকে টেনে এনে শক্ত করে চেপে ধরল। ও নিজেই প্রচন্ড ভয় পেয়েছে। মিম বুকে মাথা রেখে জোরে জোরে শ্বাস ফেলতে থাকে অনবরত। পাঞ্জাবি খামচে ধরে তিরিক্ষি মেজাজে বলে উঠল,
‘ কি করছিলেন আপনি?এখনই পড়ে ম’রে যেতাম আমি। ‘
দিহান মিমের রোষপূর্ণ কন্ঠ শুনে ফুৃস করে একটা নিঃশ্বাস ছাড়ল।
‘ ভুল হয়ে গেল মিম-ডিম। তবে ভুল করেও লাভ হলো। আহ কি শান্তি! ‘
দিহানের কথার মানে বুঝতে পেরে চট করে বুক থেকে সরে এলো মিম। কিন্তু সরে আসার পূর্বে ও এক কান্ড করে বসলো। শক্তি প্রয়োগ করে দুম করে কিল বসিয়ে দিল দিহানের বুক বরাবর। ব্যাথায় ককিয়ে উঠল দিহান। চোখ কটমট করে তাকালো ওর দিকে। কিন্তু পাত্তা পেল না। উল্টো মিমের ক্রোধান্বিত দৃষ্টি সিঁড়ি তে ছিটকে পড়ে থাকা হলুদের ঢালার পানে। দিহান সেদিকে নয়ন জোড়া রেখে বলে,
‘ আমি আবার আনিয়ে দিব। রেগে যেও না প্লিজ। ‘
‘ আপনি আমাকে ভীষণ জ্বালান। সবসময় জ্বালান। যেদিন থেকে জীবনে এসেছেন জ্বালিয়ে ছাড়খাড় করে ফেলছেন জীবনটা। ‘
রাগে ফোঁস ফোঁস করতে করতে কঠিন বাক্যগুলো আওড়ালো মিম। দিহান তা আমলে না নিয়ে এক হাত চেপে ধরে সাইডে নিয়ে এলো। নিচে হাঁটু গেড়ে বসে বলে উঠল,
‘ পা টা দাও তো। ‘
মিম ভ্রুঁ কুটি করে তাকালো। কপালে ভাজ পড়ল ওর। শঙ্কিত কন্ঠে প্রশ্ন করলো,
‘ কেন?’
‘ ভেঙ্গে দিব তাই। ‘
‘ কি আপনি আমার পা ভেঙে দিবেন?’–কিছুটা উচ্চস্বরে চেঁচিয়ে উঠে মিম। দিহান পা ধরে নিজের উরুতে রেখে বললো,
‘ হুম। তারপর সারাদিন রাত শুধু আমার কোলেই থাকবে। ‘
মিমের শ্বাস ভারী হয়ে আসতে শুরু করলো হঠাৎ, আকস্মিক। আমতা আমতা করে বলে উঠল,
‘ কি করছেন?’
দিহান তৎক্ষনাৎ জবাব দিল না। মুখ তুলেও চাইল না। পকেট থেকে একটা পায়েল বের করে হাতে নিল। অতঃপর লেহেঙ্গা টা একটুখানি উপরে উঠিয়ে পড়িয়ে দেয় পায়ে। তারপর মৃদু হেসে বলে উঠল,
‘ তোমাকে সারাক্ষণ জ্বালাতন করার জন্য হৃদয়ে পৌঁছার রাস্তা ক্লিয়ার করছি। ‘
মিম ঝটপট পা সরিয়ে আনল। বয়সে মোটামুটি ছোট হলেও অবুঝ নয় ও। দিহানের কথার ধাঁচ এবং মানে বুঝতে সময় লাগল না। বরং হৃদয় স্পর্শ করলো তা। এক পশলা বৃষ্টি হয়ে বক্ষে বিঁধে বাক্যটা তীব্রভাবে। শিরশির করে উঠে দেহখানি। পালানোর তাগিদে বড় বড় পা ফেলে দ্রুত বেগে প্রস্থান করে দিহান কে ফেলে রেখে। দিহান প্রথমত বিস্ময়াহত হয়। পরক্ষণেই নিজেও ছুটে চলে মিমের পিছু পিছু।
চৈত্রিকার মেহেদী দেওয়া প্রায় শেষের পথে। প্রিয়ন্তী, দিহান আজকের ফটোগ্রাফার। ইচ্ছেমতো পিক তুলছে দু’জন। মেহেদী দেওয়া শেষ হলে সাফারাত চৈত্রিকার পাশে এসে দাঁড়ায়। মেয়ে দু’টো নিজের জায়গা ছেড়ে দেয়। চৈত্রিকাকে উঠতে সাহায্য করে মিম। সাফারাতের পাশে দাঁড়ায় ও। আলতো করে কোমর জরিয়ে কাছে টেনে নেয় সাফারাত। দিহান সঙ্গে সঙ্গে একটা পিক ক্লিক করে। চৈত্রিকা কেবল থ হয়ে রইল সাফারাতের মুখের দিকে তাকিয়ে। পাঞ্জাবি আঁকড়ে ধরতে নিলে সাফারাত কড়া সুরে বলে উঠল,
‘ আপনার মেহেদী লেপ্টে যাবে চৈত্র। বি কেয়ার ফুল। ‘
চৈত্রিকা লাজুক হাসে। সাফারাতের দিকে চেয়ে থাকে অনিমেষ নেত্রে। দৃষ্টি অপলক,নির্নিমেষ। হঠাৎ একটা বাচ্চা ছেলে দৌড়ে এসে কোমর ঝাপটে ধরে ওর। আকস্মিকতায় পড়ে যেতে নিলে সাফারাত সামলে নেয়। তবে চৈত্রিকার মনে হলো ওর পায়ের নিচের ভূতল কেঁপে উঠেছে। মাথা টা ঝিমঝিম করছে। বিদেশি বাচ্চাদের মতো অত্যাধিক ফর্সা, কিউট একটা ছেলে। চুলগুলো একদম আয়ানের মতোন ব্রাউন কালার। বাচ্চা টার মায়াবী চেহারা দেখে হতভম্ব নয় চৈত্রিকা। বরং নিজের সাথে ঘটে যাওয়া এতোদিনের ঘটনার সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত এই বাচ্চা ছেলে টা। চৈত্রিকার এতোকালের গোলকধাঁধা যেন হুট করেই সলভ হয়ে গেল। চক্ষু বড় বড় করে তাকালো ও সাফারাতের দিক। সাফারাত ওর সেই দৃষ্টি এড়িয়ে সিনথিয়ার ছেলে আয়মান কে কাছে টেনে আনে। ছেলেটা দাঁত দেখিয়ে মিষ্টি হাসে। চৈত্রিকার বিস্ময়ে ভরা চেহারায় নজর রেখে বললো,
‘ মামি মণি ইউ লুকস সো প্রিটি। ‘
সিনথিয়া পাশ থেকে বললো–‘ আমার ছেলে চৈত্র। জানি এটা তোদের দ্বিতীয় সাক্ষাৎ। ‘
চৈত্রিকা স্মিত হাসল। সত্যিই আয়মানের সাথে ওর দ্বিতীয় সাক্ষাৎ। গায়ে জড়ানো জারবেরা,প্রতিদিন কারো জারবেরা দেওয়া, টিউশন হতে ফেরার সময় একটা বাচ্চা ছেলের অর্থাৎ আয়মানের মামী মণি ডেকে জারবেরা দেওয়া, বাবার অপারেশন এর টাকা,রাস্তায় পানি ও ভর্তা দেওয়া সবকিছু একটা মানুষ এর কাজ। এই মানুষ নাকি আবার প্রতি/শোধ নিতে এসেছিল। অথচ আড়ালে উজার করে ভালোবাসতে নিজেকে আটকাতে পারে নি। চৈত্রিকার ইচ্ছে করছে মানুষটার বুকে মাথা ঠেকিয়ে বলতে এতো ভালো না বাসলেও পারতেন সাফারাত। এতো সুখের নেশায় আমায় উম্মাদ করার প্রয়োজন কি খুব বেশি ছিল?আমি আপনার নেশায় মত্ত হয়ে পড়েছি আজ নতুন করে। নতুন করে আপনার কাছে ছুটে যাওয়ার উদ্দীপনা খুঁজে পাচ্ছি ভালোবাসার টানে,সুখের নেশায়।
____________________
এসির ঠান্ডায় সাদা ধবধবে নরম ও তুলতুলে বিছানায় জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে চৈত্রিকা। খানিক সময় আগেই প্রিয়ন্তী,সিনথিয়া রুমে দিয়ে গেল ওকে। ফুলের গন্ধে মৌ মৌ করছে পুরো কক্ষ। আবার বারান্দা হতে ধেয়ে আসা দখিনা অনিলে রুমের পর্দাগুলো উড়ছে এলোমেলো, অবিন্যস্তভাবে। গায়ে লাল খয়েরী বেনারসি জড়িয়ে চুপচাপ অপেক্ষার প্রহর গুণছে চৈত্রিকা সাফারাত এর। অন্য বেলায় তো এই লোকের অনেক তাড়া থাকে কাছাকাছি আসার অথচ আজ এক ঘন্টা ধরে অপেক্ষা করাচ্ছে ওকে। বসে থাকার দরুন পা দুটো ব্যাথা করছে ক্ষীণ। শাড়ি সামলে চৈত্রিকা বিছানা ছাড়ে। একটু হাঁটলে ভালো লাগবে তা ভেবে। কিন্তু যার জন্য এতক্ষণ বসে বসে প্রতীক্ষা করলো সেই লোক চৈত্রিকা দাঁড়ানো মাত্র দরজা খুলে হাজির। চৈত্রিকার অন্তস্থল ধ্বক করে উঠল। শরীরের রক্ত হিম হয়ে এলো।
সাফারাত এক নজর চেয়ে দরজা লাগিয়ে দেয়। গাঢ় সেই দৃষ্টিতে দ্বিধাদ্বন্দে পড়ে গেল চৈত্রিকা। ওর কি করা উচিত?দাঁড়িয়ে থাকা নাকি বসে পড়া?বউরা তো বাসর ঘরে বসেই থাকে তাই না?নাকি দাঁড়িয়েও থাকে?ওর মতো এমন করে কি এই সময়টা তে সকল বউ মানুষ কনফিউজড হয়?সাফারাত যত এগিয়ে আসছে চৈত্রিকার বুকের অশনী,দুরুদুরু ততই বেড়ে চলেছে। ছাব্বিশ বছরের জীবনে এমন ফিলিংসটা খুবই ভয়ংকর মনে হচ্ছে চৈত্রিকার। শক্ত, কঠোর,পরিবার সামলানো মেয়েটা আজ একজন পুরুষের উপস্থিতিতে কেমন নেতিয়ে পড়ছে। লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে পড়ছে।
সাফারাত মাঝে দূরত্ব রেখে থেমে গেল। চৈত্রিকার পা হতে মাথা অব্দি নিজের ঈগল চোখের সূক্ষ্মতা নিয়ে সম্পূর্ণ পর্যবেক্ষণ করলো সে। চেহারার গম্ভীরতা সরে গিয়ে ঠোঁটে দুর্বোধ্য হাসি ফুটে উঠে তার। নরম গলায় প্রশ্ন করে,
‘ পানি খাবেন?’
চৈত্রিকা স্তম্ভিত হয়ে যায়। মাথা নেড়ে সায় জানায়। ওর ভীষণ পিপাসা পেয়েছে। সাফারাত এক গ্লাস পানি দিতেই ও বিছানায় বসে রুদ্ধশ্বাসে পান করে পুরো গ্লাসের জল। সাফারাত আলতো করে একহাতে নিজের শক্তপোক্ত হাত ডুবিয়ে দিল। কাছে এগিয়ে গিয়ে দীর্ঘ এক চুম্বন আঁকে চৈত্রিকার কপালে। চক্ষুদ্বয় বুঁজে আসে চৈত্রিকার। গাল ছুঁয়ে গড়িয়ে যায় অশ্রুকণা। এই কান্নার মানে টা ভিন্ন। খুবই ভিন্ন। সাফারাত নাকের ডগায়ও ঠোঁট ছুঁয়ে দেয়। চৈত্রিকার গায়ের ভারী গহনাগুলো অতি সন্তর্পণে খুলে একপাশে রাখে সে। চৈত্রিকা নিজেকে ধাতস্থ করার আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে। তবুও বারংবার লজ্জায় মিইয়ে যাচ্ছে সে।
‘ বলেছিলাম চৈত্র আপনি আমার কাছাকাছি এলে একদম তুলে নিয়ে আসব আপনাকে। আজ সত্যি সত্যি নিয়ে এলাম। ‘
চৈত্রিকা বুঝতে পারল সাফারাত সেই রাতের কথা বলছে। বর্ষণমুখর সেই রাতে আবেগের বশে সাফারাত এর কপালে ভালোবাসার পরশ এঁকেছিল ও। চৈত্রিকার তরফ হতে সেটাই ছিল সাফারাতের কাছাকাছি যাওয়া প্রথমবার। সাফারাত এর তেজী স্বরে চৈত্রিকা অল্পসল্প নড়েচড়ে উঠে। সাফারাত হাত টা শক্ত করে মুষ্টিমেয় করে কাছে টেনে নিল ওকে। চৈত্রিকার এক হাত গিয়ে ঠেকে তার বুকে। প্রগাঢ় দৃষ্টি দু’জনের। একে অপরের তপ্ত নিঃশ্বাস আছড়ে পড়ছে মুখশ্রীতে। অভ্যন্তরে ঝড় বয়ে যাচ্ছে। উত্তাল পাতাল গর্জে উঠছে অনুভূতিরা।
সাফারাত কোলে তুলে নিলো চৈত্রিকাকে। বিছানার মাঝখানে বসিয়ে দিয়ে ড্রয়ার থেকে একটা কাগজ এবং হাতে একটা চেক নিয়ে এলো। চৈত্রিকার দিকে বাড়িয়ে দিতেই জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো ও।
‘ চেকের মাধ্যমে আপনার কাবিন নামার টাকা পরিশোধ করে দিলাম। এবং এটা এই বাড়ির দলিল। এখন থেকে আমার মায়ের বাড়িটা আপনার চৈত্র। ‘
ক্ষণিকের জন্য স্তব্ধতা চৈত্রিকা কে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে নিল। পরমুহূর্তেই দ্রুতবেগে বলে উঠল,
‘ কি বলছেন আপনি?’
‘ আমার জীবনে থাকা টা আপনার জন্য মোটেও সহজ নয়। চাঁদ যেমন সুন্দর তেমনি তার গায়ে কলঙ্ক আছে। এই বাড়ির সৌন্দর্যের মাঝেও বিষাক্ত কিছু মানুষ ছড়িয়ে আছে। যারা আপনার ক্ষতির কারণ হতে পারে চৈত্র। আপনি বাড়ির ওনার মানে আপনি সেফ। আপনাকে আমি আমার জীবনে জড়াতে চাই নি। আবার না জড়িয়েও থাকতে পারি নি। আমি জানি আপনি অবাক হচ্ছেন তবে আমি চাই আমার থেকে উপহার হিসেবে আপনি এটা গ্রহণ করুন। ‘
কাঁপা কাঁপা হাতে দলিল টা হাতে নেয় চৈত্রিকা। সাফারাত লহু স্বরে বলে উঠল,
‘ ভয় পাচ্ছেন?’
‘ আপনার কথায়। ‘
‘ রিলেক্স। শেষ নিঃশ্বাস অব্দি আপনার ঢালস্বরূপ আমায় পাবেন। ‘
বিনিময়ে চৈত্রিকা মৃদু হাসলো। মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকায় সাফারাত চৈত্রিকার হাসি মাখা চেহারায়। হাত বাড়িয়ে বেড সাইডের পাশে অবস্থিত ল্যাম্পশেড অফ করে দিল। চৈত্রিকা চমকে গিয়ে বিছানার চাদর খামচে ধরে। রুমের ড্রিম লাইটের আলোয় ওর কম্পনরত ঠোঁট দেখে বেসামাল হয়ে পড়ে সাফারাত। নিজেকে আটকাতে ব্যর্থ হয় সে। নিজের শুষ্ক ওষ্ঠজোড়া দিয়ে নরম অধর দু’টো গভীরভাবে আঁকড়ে ধরে সাফারাত। ঘাড়ের নিচে হাত গলিয়ে নিজের সাথে মিশিয়ে নিল চৈত্রিকাকে। চৈত্রিকা অনুভব করতে থাকে গাঢ় এই অনুভূতি। সাফারাতের নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়া ওর হৃদয়ের গতি নিয়ন্ত্রণ হারা করে চলেছে। বড় বড় শ্বাস ফেলতেই গলায় ছোট ছোট উষ্ম পরশ অনুভব হয়। মুহুর্তেই ঠোঁটের স্পর্শ অধিকতর প্রবল ও গাঢ় হতে শুরু করে। চৈত্রিকা সাফারাত কে ঝাপটে ধরলো। শক্ত করে আলিঙ্গনে বাঁধার প্রয়াস চালালো। বাঁকা হাসল সাফারাত। চৈত্রিকাকে শুয়ে দিয়ে কানের কাছে মুখ নিয়ে অধর ছুঁয়ে দিল। ফিচেল স্বরে বললো,
‘ চৈত্র মাসের রুক্ষ শুষ্ক জীবনে আজ হতে অহর্নিশি বর্ষণ হয়ে ঝড়ব আমি। বর্ষণের তান্ডব সামলাতে রাজি তো আপনি চৈত্র মাস? ‘
#চলবে,,,!