সুখ অমৃত পর্ব-০৮

0
100

#সুখ_অমৃত
#পর্বঃ৮
#লেখিকাঃদিশা_মনি

মানতাশা রেগেমেগে হেঁটে হেঁটে যাচ্ছিল। হঠাৎ করেই জাদের মুখোমুখি হয় সে। জাদকে দেখামাত্রই তার মাথায় রাগ চেপে বসে। জায়িন নামক লোকটা তো এই লোকটারই ভাই। সে একাধিক বিয়ে করেছে তার মানে ভাইও একইরকম হবে। এমনটা ভেবেই ক্রোধে মানতাশার গাল লাল হয়ে উঠল। সে জাদের দিকে তাকিয়ে বলতে লাগল,
“নারীলোভী, শয়তান, খাটাশ লোক।”

কথা গুলো বাংলায় বলায় জাদ কিছুই বুঝতে পারল না। বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল মানতাশার দিকে। মানতাশার মুখ দেখে খানিক অনুভব করল যে মেয়েটা হয়তো রেগে আছে এবং তার উপর রাগ দেখাচ্ছে। ব্যাপারটা টের পেতেই জাদের চোয়াল শক্ত হলো। একেই তো এই মেয়েটা আজ তার প্রিয় ঘোড়ার সাথে একটা দূর্ঘটনা ঘটাতে যাচ্ছিল এখন আবার তাকেই রাগ দেখায়। তখন নিজের চাচির সামনে ঝামেলা করতে চায়নি জন্য চুপ ছিল৷ কিন্তু এখন পরিস্থিতি ভিন্ন। তাই জাদ বলে উঠল,
“এই মেয়ে কি বলছ আরবিতে বলো।”

মানতাশা নিজের ক্রোধ সম্বরণ করে আরবিতে বলে,
“বলেছি যে আপনি খুব নম্র, ভদ্র, পরোপকারী একজন মানুষ।”

বলেই রাগে গজগজ করতে করতে চলে যায়। জাদ মানতাশার যাওয়ার পানে তাকিয়ে বলে,
“পাগল নাকি!”


হুসনেয়ারা বেগমের রুমে এসে চুপ করে বসে আছে মানতাশা। মানতাশার হঠাৎ এমন গাম্ভীর্যের কারণ প্রথমে বুঝতে পারেন নি হুসনেয়ারা বেগম। একটু পর উমায়রা কক্ষে এসে তার দিকে অসহায় চোখে তাকিয়ে থাকে তখন ব্যাপারটা উপলব্ধি করতে পারেন তিনি। মানতাশার কাঁধে হাত রেখে বলেন,
“তুই কি উমায়রাকে নিয়ে চিন্তিত?”

মানতাশা কাঁদো কাঁদো গলায় বলল,
“তোমরা উমায়রা আপুকে এভাবে একজন পূর্ব বিবাহিত ব্যক্তির সাথে কেন বিয়ে দিলে ফুফু?”

হুসনেয়ারা বেগম হতাশার দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলেন,
“আমি বুঝতে পারছি ব্যাপারটা মেনে নিতে তোর কষ্ট হচ্ছে কিন্তু কিছু করার নেই। বাংলাদেশে হয়তো বহুবিবাহ তেমন প্রচলিত না৷ কিন্তু এখানে আরবে সিংহভাগ পুরুষই একাধিক বিয়ে করে এবং এটা এখানে খুব স্বাভাবিক। তাছাড়া এটা ইসলামে একটা বৈধ বিষয়। এটা নিয়ে এত মন খারাপ করছিস কেন?”

মানতাশা উমায়রার দিকে তাকিয়ে বলে,
“কিন্তু এই বিয়েতে উমায়রা আপু খুশি নেই। আমি নিজের চোখে দেখেছি হাফসা বেগম ওনার সাথে কত খারাপ ব্যবহার করেছেন। এটা তো উমায়রা আপুর নিজের বাড়ি, তাহলে এখানে এসে ঐ মেয়ে উমায়রা আপুর সাথে এমন ব্যবহার করার সাহস পায় কোথায়?”

হুসনেয়ারা বেগম দরজার দিকে তাকিয়ে বলেন,
“আস্তে কথা বল মানতাশা। এই বাড়িতে দেয়ালেরও কান আছে। হাফসা দুবাই রাজ পরিবারের সদস্য!”

মানতাশা হতবাক স্বরে বলে,
“কি!”

হুসনেয়ারা বেগম বলেন,
“হুম। দুবাইয়ের বর্তমান আমিরের চাচাতো ভাইয়ের মেয়ে ও। তাই ওর প্রভাব প্রতিপত্তি অনেক। আর আমার কি পরিচয় বল? আমার স্বামীর নিজস্ব কোন পুঁজি নেই। সে এবং আমরা সম্পূর্ণরূপে তার ভাইয়ের উপর নির্ভরশীল। যদি আজকেই তারা আমাদের এখান থেকে বের করে দেয় তাহলে আমাদের আর যাওয়ার যায়গা থাকবে না!”

মানতাশা হতবাক হয়ে যায় এহেন কথা শুনে। হুসনেয়ারা বেগম চোখের জল মুছে বলেন,
“মোহাম্মদ বিন জাফরের উপর সম্পুর্ন নির্ভরশীল হওয়ায় আমার স্বামী এবং আমরা সবসময় তার আদেশ মেনে নিতে বাধ্য। তাই তো যখন তিনি আমাদের মেয়েকে নিজের ছেলের দ্বিতীয় পত্নী বানাতে চাইলেন আমরা তখন দ্বিমত করতে পারিনি। উমায়রাও রাজি ছিল না এই বিয়েতে কিন্তু আমাদের কিছু করার ছিল না। একপ্রকার বাধ্য হয়েই…”

মানতাশা উঠে নিজের ফুফুকে জড়িয়ে ধরে। হুসনেয়ারা বেগম মানতাশাকে বলে,
“তোর ফুফা অনেক কষ্টে তার ভাইকে মানিয়েছে তোকে এখানে থাকার অনুমতি দিতে। তাই, তুই এমন কোন কাজ করিস না যাতে কেউ ক্ষেপে যায়। যতটা পারিস চুপচাপ থাকবি। সালমা ভাবি অনেক ভালো। কিন্তু আমার ভয় এই হাফসাকে নিয়ে। তুই ওর থেকে দূরেই থাকিস। ও সবসময় আমার মেয়েকে জ্বালিয়ে মা*রে। আমি চাই না, ওর নজর তোর উপরেও পড়ুক। নাহলে তোর জীবন ও নরক করে দেবে।”

মানতাশার বুক অজানা আশংকায় ধক করে উঠল। সে এখানে এসেছিল একটু শান্তির খোঁজে। কিন্তু অশান্তি যেন তার পিছুই ছাড়তে চাইছে না। মানতাশা একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলে,
“ভাগ্য আমাকে এ কোন নতুন বিপদের মুখে ফেলল!”


রাতের খাবার মানতাশা নিজের কক্ষেই করে নিলো। এখন গেস্ট রুমেই অবস্থান করছে সে। ঘুমানোর পূর্বে দরজা লাগাতে যাবে এমন সময় এই বাড়ির একজন কর্মচারী এসে তাকে বলে,
“মহামান্যা, হাফসা বেগম আপনায় ডাকছে। আপনি দ্রুত তার কক্ষে উপস্থিত হন।”

“এত রাতে আমি কি করব?”

“সেটা তো আমি বলতে পারছি না। কিন্তু উনি আপনাকে যত দ্রুত সম্ভব যেতে বলেছেন।”

মানতাশা দুপুরে তার ফুফুর বলা কথাগুলো মনে করে ভাবলো হাফসাকে ক্ষেপানো তার জন্য ভালো হবে না। এজন্য চুপচাপ পা বাড়ালো হাফসার কক্ষের দিকে।

হাফসার কক্ষের কাছে গিয়ে মানতাশা যা দেখলো তাতে তার চোয়াল শক্ত হয়ে এলো। হাফসা নিজের পুরো কক্ষ কোন কর্মচারীকে দিয়ে নয় বরঞ্চ উমায়রাকে দিয়ে পরিস্কার করিয়ে নিচ্ছে। মানতাশা এগিয়ে এসে প্রতিবাদ করতে নিবে এর পূর্বেই উমায়রা চোখের ইশারায় তাকে চুপ থাকতে বলল। তাই মানতাশাও আর কিছু বলল না। কিন্তু ক্রোধে তার কান দিয়ে যেন ধোঁয়া বের হবার যোগাড়। হাফসা মানতাশাকে লক্ষ্য করে বলল,
“এই তো তুমি এসে গেছ। শোন, এই বাড়িতে কেউ ফ্রিতে থাকতে পারে না। আমার শ্বশুর মশাইয়ের সাথে কথা হয়েছে। তার সাথে পরামর্শ করেই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে, তুমি যদি এখানে থাকো তো আমার টুকিটাকি কাজও তোমায় করে দিতে হবে।”

মানতাশা শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। হাফসা একটা ময়লা পানিভর্তি বালতির দিকে ইশারা করে বলল,
“এখানে নোংরা পানি আছে। বাইরে গিয়ে এটা ময়লার ভাগাড়ে ফেলে এসো!”

“আমি?!”

হতবাক হয়ে শুধালো মানতাশা। আগে সে কোনদিনও এমন কাজ করে নি। না তো কখনো করবে বলে ভেবেছে। হাফসা রাগত সরে বলে,
“তুমি করবে না তো কি আমি করব? যদি এখানে থাকতে চাও তাহলে চুপচাপ যা বলছি তাই করো। নাহলে…”

হাফসা নিজের কথা সম্পূর্ণ করার আগেই উমায়রা মানতাশাকে অনুরোধের সুরে বলে,
“দয়া করে, হাফসা উখতুন(আপা) যা বলছে তাই করো।”

মানতাশা অন্য সময় হলে প্রতিবাদ কর‍ত। কিন্তু এখনো সে এখানে নতুন। তাই শুরুতেই কোন ঝামেলা করতে চাইছে না। তবে সবকিছু স্বাভাবিক ভাবে মেনে নেওয়ার মেয়েও সে নয়। সবকিছুর শেষ দেখে ছাড়বে। হাফসার এত বাড়বাড়ন্তর ইতি সে টানবেই–মনে মনে শপথ করে নিলো। অতঃপর হাফসার দিকে অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করে নোংরা পানিভর্তি বালতি নিয়ে বাইরের দিকে অগ্রসর হয়। হাফসা বেগম মানতাশার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে ফিচলে হেসে বলে,
“কিভাবে মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করতে হয় সেটা আমি খুব ভালো করেই জানি। ছোটবেলা থেকে রাজমহলের কূটনীতি দেখে বড় হয়েছি, কিভাবে কতৃত্ব বিস্তার করতে হবে সেটা আমার থেকে ভালো আর কে জানবে!”

মানতাশা বালতি নিয়ে যেতে যেতে হাফসাকে নানা গালমন্দ করতে থাকে। গালমন্দ করতে করতে বলে,
“নিজেকে যে কি মনে করে জানি না। মানতাশা এত সহজে সবকিছু মানবে না। এই হাফসা বেগমের সব অহংকার যদি দূর করতে না পারি তাহলে আমার নামও মানতাশা নয়। ইচ্ছে তো করছে এই সব পানি এভাবে ওনার মাথায় ঢেলে দেই।”

বলেই একদম গ্রিলের পাশে এসে দাঁড়িয়ে নিচে পানি ফেললো। কাকতালীয় ভাবে নিচেই দাঁড়িয়ে ছিল জাদ এবং এই সম্পূর্ণ পানি তার গায়ে পড়ে। নোংরা পানির গন্ধে জাদ নাক চেপে ধরে। উপরে তাকিয়ে মানতাশাকে দেখে ক্ষেপে হুংকার দিয়ে বলে,
“এসবের মানে কি?!”

মানতাশা বুঝতে পারে কতবড় সর্বনাশ করে ফেলেছে। জিভ কেটে বলে ওঠে,
“দুঃখিত। আমি বুঝতে পারিনি। গোসল করে নিন দূর্গন্ধ দূর হয়ে যাবে।”

বলেই সে দ্রুত স্থান ত্যাগ করে। মানতাশা যাওয়ার পরেই জাদ বলে,
“এই মেয়ে কি পাগল নাকি?”

এদিকে মানতাশা সম্পূর্ণ পরিস্কার পানি নিয়ে আসে এবং আবারও উপর থেকে তা জাদের মাথায় ঢেলে দিয়ে বলে,
“যান আপনাকে আবার পরিস্কার করে দিলাম।”

জাদ ফুসে উঠে কিছু বলতে যাবে তার আগেই মানতাশা আবারো চলে যায়। যায় ফোস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে বিড়বিড় করে বলে,
“আসলেই পাগল!”

চলবে ইনশাআল্লাহ ✨