সুখ অমৃত পর্ব-২০

0
115

#সুখ_অমৃত
#পর্ব_২০
#লেখিকাঃদিশা_মনি

মানতাশাকে সাথে নিয়ে পুনরায় নিজেদের বাড়িতে ফিরে আসে জাদ। মানতাশাকে বাড়িতে ফিরতে দেখে হাফসার অন্তরাত্না কেপে ওঠে। সে নিজের জন্য বিপদবার্তা মনে করে মানতাশাকে। তবুও দমে যায়না। ছুটে এসে মানতাশার গলা চেপে ধরে বলে,
“তুমি কেন ফিরে এসেছ এখানে? তোমার জন্য এসব কিছু হয়েছে। তুমি উমায়রা এবং সালমা বেগমের মৃত্যুর জন্য দায়ী।”

জাদ মানতাশাকে হাফসার থেকে সরিয়ে নিয়ে বলে,
“ব্যস, অনেক হয়ে গেছে ভাবি। আপনি এসব বলা বন্ধ করুন। এতদিন অনেক সত্য মিথ্যার খেলা চলেছে। কিন্তু আজ সব সত্যি সামনে আসবে।”

এমন সময় নিজের মাতৃহারা ছেলেকে কোলে নিয়ে সেখানে উপস্থিত হয় জাইন। তার সাথে সাথে মোহাম্মদ জাফরও আসে সেখানে। হুসনেয়ারা বেগম এখনো নিজের মেয়ের মৃত্যুর শোক কাটিয়ে উঠতে পারেন নি৷ তাই নিজের কক্ষে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন।

এদিকে মোহাম্মদ জাফরকে দেখেই তার দিকে এগিয়ে যায় জাদ। মোহাম্মদ জাফরের একদম কাছে গিয়ে তার উদ্দ্যেশ্যে বলে,
“নিশ্চয়ই এখন তুমি অনেক খুশি। তাই না আব্বু?”

মোহাম্মদ জাফর হচকচিয়ে যান। জাদের উদ্দ্যেশ্যে বলেন,
“তুমি কি বলছ টা কি? এখানে আমার খুশি হবার প্রসঙ্গ আসছে কোথা থেকে? আর তুমি কোন সাহসে এই মেয়েকে এই বাড়িতে নিয়ে এসেছ। ওর জন্য আমি আমার স্ত্রী এবং বৌমাকে হারিয়েছি৷ ওর ছায়াও আমি এই বাড়িতে পড়তে দেব না।”

“তুমি দয়া করে তোমার এই সব নাটক বন্ধ করো আব্বু। আজ আমি সবার সামনে তোমার মুখোশ খুলে দেব।”

বলেই জাদ একটা ভিডিও চালু করে। যেটা ছিল আবু সুফিয়ানের মৃত্যুর আগে দেওয়া স্বীকারোক্তি। যেখানে যে স্বীকার করেছে যে সেই উমায়রা এবং সালমা বেগমের খু**নি। মানতাশার কোন দোষ নেই এখানে। সে তো মানতাশাকেও জোরপূর্বক তুলে নিয়ে গেছিল। এসব বলে একটু থেমে সে মোহাম্মদ জাফরের অতীতের সত্যকেও সামনে তুলে আনেন। এমনকি তিনি এটাও বলেন যে, মোহাম্মদ জাফর কিভাবে এর পূর্বে আবু সুফিয়ানের বাবার দ্বারা সালমা বেগমকে পঙ্গু করে দিয়েছিলেন। এমনকি এবারও তিনিই আবু সুফিয়ানকে অনেক অর্থের লোভ দেখিয়ে সালমা বেগমকে খু*ন করতে বলেছিলেন।

এসব দেখে জায়িন, হাফসা সবাই হতবাক হয়ে যায়। হাফসা বিড়বিড় করে বলে,
“এটা কি হলো? এটা তো আমার আর আবু সুফিয়ানের মধ্যকার ডিল ছিল এখানে মোহাম্মদ জাফর কিভাবে ঢুকল?”

এরমধ্যেই পুলিশও বাড়িতে ঢুকে পড়ে মোহাম্মদ জাফরের হাতে হাতকড়া পড়ায়৷ জাদ অসহায় কন্ঠে নিজের বাবার উদ্দ্যেশে বলল,
“কেন করলেন এসব কিছু?”

মোহাম্মদ জাফরকে একটুও অনুতপ্ত মনে হলো না। বরং তিনি বেশ ক্ষোভ নিয়েই বললেন,
“আমি যা করেছি সেটা একদম ঠিক করেছি। তোমার মায়ের বাড়াবাড়ি এসবের জন্য দায়ী। অতীতে নিজের বাবার মৃত্যুর পর সে তার বাবার সব সম্পত্তি, সব ব্যবসা নিজে পরিচালনা করতে চেয়েছিল। সেই সময় তো তাকে পঙ্গু করে দমিয়ে রেখেছিলাম। ও আর এসব নিয়ে কথা তুলছিল না তাই আমিও ওকে আর মারার চেষ্টা করিনি। কিন্তু তোমার সাথে ঐ মানতাশা মেয়েটার বিয়ের পর ও আবার আমার বিপক্ষে কথা বলতে শুরু করে। যার ফলে আমার ভয় লাগতে শুরু করে যে..ও হয়তো আবার আমার থেকে এসব কিছু কেড়ে নিতে চাইবে। এজন্য আমি ওকে রাস্তা থেকে সরিয়ে দেওয়ার প্ল্যান করি..”

এটুকু বলে থেমে গিয়ে তিনি বলেন,
“আমি জানতাম, আবু সুফিয়ানের উদ্দ্যেশ্য মানতাশাকে নিজের করে পাওয়া। তাই আমি ওকে বলি যেতে যেতে সালমাকেও শেষ করে যেও।”

এরপর তিনি জাইনের দিকে তাকিয়ে বলেন,
“কিন্তু ওকে আমি উমায়রাকে মারতে বলিনি। উমায়রার গর্ভে তো আমার বংশধর বেড়ে উঠছিল। আমি কেন তাকে মা*রতে চাইবো বলো?”

জাইন ঘৃণা ভরা দৃষ্টিতে নিজের বাবার দিকে তাকিয়ে বলল,
“তোমাকে নিজের বাবা বলে পরিচয় দিতেও আমার নিজের প্রতি ঘৃণা লাগছে। তুমি আমার মা, আমার স্ত্রীর হত্যা**কারী। আমি জীবনে আর কখনো তোমার মুখদর্শন করতে চাইনা৷ তোমার জন্য আমি আর জাদ মাতৃহারা হয়েছি এমনকি এই নিষ্পাপ শিশুটাও..”

বলেই অশ্রু ফেলল জাইন। জাদ এসে নিজের ভাইকে সামলালো। পুলিশ ধরে নিয়ে গেল মোহাম্মদ জাফরকে।

হাফসা একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল এটা দেখে যে, এসব কিছুর মধ্যে তার নামটা জড়ায় নি। তার মানে আবু সুফিয়ান তার এসব কিছুর সাথে যুক্ত থাকার কথা কাউকে জানায় নি।

জাইন জাদকে জড়িয়ে ধরে বলল,
“এসব কি হয়ে গেল ভাই? আমাদের জীবনটা কিভাবে জানি এলেমেলো হয়ে গেল!”

জাদ জাইনকে বলে,
“তুই এত ভেঙে পড়িস না, ভাইয়া। তুই এত ভেঙে পড়লে তোর ছেলেকে কে সামলাবে?”

জাইন নিজেকে সামলানোর সর্বোচ্চ প্রয়াস করে।

★★★
নিজেদের ঘরের মধ্যে বিশ্রাম নিচ্ছে জাদ ও মানতাশা। মানতাশা জাদকে ইতিমধ্যে তাদের সন্তান আগমনের খুশির খবরটা শুনিয়ে দিয়েছে। যেই খবরটা এত বিষাদের মাঝেও জাদের মনে প্রশান্তির হাওয়া বইয়ে দিয়েছে। মানতাশাকে জাদ নিজের বুকে আগলে নিয়ে বলে,
“সবকিছুর জন্য আমি অত্যন্ত দুঃখিত। আমি যদি জানতাম, আমার অবর্তমানে এত কিছু হয়ে যাবে তো আমি কিছুতেই তোমায় ছেড়ে যেতাম না।”

মানতাশা বলে,
“সবকিছু আমার জন্য দুঃস্বপ্নের মতো ছিল। এক মুহুর্তের জন্যে তো আমার মনে হয়েছিল আমি বোধহয় আপনাকে চিরকালের মতো হারিয়ে ফেলব, আমাদের সন্তানকেও বোধহয় পৃথিবীর আলো দেখাতে পারব না। তবে মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ তায়ালার অশেষ রহমতে আমি আবার আপনাকে ফিরে পেয়েছি।”

জাদ মানতাশার কপালে চুমু খেয়ে বলে,
“এবার আর আমি এক মুহুর্তের জন্যেও তোমাকে কাছ ছাড়া করব না৷ তোমার এবং আমাদের অনাগত সন্তানের রক্ষার দায়িত্ব এখন শুধুমাত্র আমার।”

“আচ্ছা, বিপদের কালো মেঘ কি সত্যি আমাদের উপর থেকে সরে গেছে?”

“তুমি কি কোন বিষয় নিয়ে চিন্তিত?”

মানতাশা মনে করে হাফসা বেগম কিভাবে উমায়রাকে মে*রে ফেলার চেষ্টা করেছিল অতীতে। আচ্ছা এমন কি হতে পারে না যে হাফসা বেগমও কোনভাবে এসবের সাথে জড়িত? কিন্তু আবু সুফিয়ান তো সেরকম কিছু বলে যায়নি। কোন প্রমাণ ছাড়া তো সে হাফসা বেগমের দিকে আঙুলও তুলতে পারবে না। তাই জাদকে এই ব্যাপারে কিছু বলল না। শুধু একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলল,
“চিন্তা পুরোপুরি ভাবে মুক্ত হতে পারছি না। আমার মনে হচ্ছে, আকাশ থেকে কালো মেঘের ছায়া এখনো পুরোপুরি কাটে নি। যা আমাদের জীবনে একটা অশুভ ছায়ার মতো রয়ে গেছে।”

★★★
হাফসা বেগম নিজের কক্ষে বসে ছিল। দ্বিধাগ্রস্ত মনে অনেক কিছু ভাবছিল। এমন সময় তার এক বিশ্বস্ত ভৃত্য এসে বলে,
“আসতে পারি মহামান্য হাফসা বেগম?”

“এসো।”

ভৃত্য কক্ষে প্রবেশ করে। হাফসা বেগম বলে,
“কি বলতে চাও?”

ভৃত্য হাফসা বেগমের হাতে একটা চিঠি তুলে দিয়ে বলে,
“এটা আপনার জন্য।”

হাফসা বেগম চিঠিটা হাতে নিয়ে পড়তে শুরু করে। আর তাতেই যেন নিজের মনে জমা সব প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যায়। আবু সুফিয়ানের লেখা এই চিঠিতে সে মানতাশা ও জাদের প্রতি নিজের ঘৃণা অভিব্যক্ত করেছে। জাদের মুখোমুখি হবার আগেই সে বুঝেছিল তার পতন আসন্ন তাই তো তড়িঘড়ি করে এই চিঠিটা লিখে গুপ্তচর দ্বারা হাফসার কাছে পাঠানোর ব্যবস্থা করা।

হাফসা বেগম চিঠিটা পড়ে বলে,
“ধন্যবাদ, আবু সুফিয়ান। তুমি মৃত্যুর আগে আমার নাম লুকিয়ে আমাদের বিশ্বস্ততার পরিচয় দিয়েছ। এই চিঠিতে তুমি চেয়েছ, আমি যেন মানতাশা আর জাদকে ধ্বংস করতে পারি, এজন্য তুমি আমার নাম আড়ালে রেখেছ। কারণ তুমি চাওনি, তোমার মৃত্যুর পর ওরা সুখে থাকুক। তুমি কোন চিন্তা করো না, এই দায়িত্ব আমি খুব সুন্দর ভাবেই পালন করব। ঐ জাদ এবং মানতাশাকে আমি সুখে থাকতে দেব না, তাদের সকল সুখের অসুখ হবো আমি।”

বলেই একটা ভয়ংকর চাহনি দেয়।

চলবে….