সুগন্ধি ফুল পর্ব-৪৭

0
145

#সুগন্ধি_ফুল
#পর্ব_৪৭
#জান্নাত_সুলতানা

আবরাজ নিজের কেবিনে বসে। সামনে অনেক গুলো ফাইল। বেশ লম্বা সময় ধরে সে অফিসে আসে নি। আব্রাহাম এবং মিলন খান যদিও এদিক টা সামলে নিয়েছে। তবুও আবরাজ এর কাজের যেনো শেষ হচ্ছে না। আবরাজ ফাইল দেখতে দেখতে সাব্বির কেবিনে প্রবেশ করলো। হাতে টিফিন। আবরাজ দেখেই বুঝে গেলো বউ তার বাড়ি থেকে লাঞ্চ পাঠিয়েছে। হাতে মধ্যমা এবং তর্জনী আঙুলের ফাকে পেন স্পিনিং করতে ব্যাস্ত। সে খুব গভীর মনোযোগ দিয়ে কিছু ভাবছে। সাব্বির খাবারের বক্স টা নিয়ে গিয়ে সেন্টার টেবিলের ওপর রাখলো। এরপর এসে আবরাজ এর সামনে দাঁড়িয়ে বলে উঠলো,

-“বাড়ি থেকে খাবার এসছে স্যার।”

আবরাজ এর প্রতিক্রিয়া নেই কোনো। সে তখনও কিছু ভেবে চলছে। দৃষ্টি তার সাব্বির এর দিকে স্থির। সাব্বির ভরকে গেলো। জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিলো। বেচারার বউয়ের সাথে আজ ঝামেলা হয়েছে। এরপর জুনায়েদ এর ব্যবস্থা করলো। এখন আবার স্যারের এই মুড। মহা মুশকিল। কি যে ভাবছে স্যার সে-সব ভেবে সে হয়রান। একটু আগে বাসায় যাওয়া গেলে বউয়ের রাগ টা ভাঙাতে সুবিধা হতো। সাব্বির নিজে কে ধাতস্থ করে বললো,

-“স্যার আপনি কি কোনো কিছু নিয়ে চিন্তিত?”

-“বুঝলে সাব্বির, আই থিংক তোমার ম্যাম এর জব টা করা ইম্পর্ট্যান্ট। বাসায় থেকে কি জগাখিচুড়ি যে রাঁধে বলা যায় না।”

সাব্বির ভাবনায় পড়ে গেলো। কিসের কথা বলছে? সে যা ভাবছে এমন কিছুর ভয় কি স্যার ও পাচ্ছে?
যদিও আবরাজ খান ভয় পাওয়ার মতো মানুষ নয়। এতো দিনে সে এটা ঠিকই বুঝে গিয়েছে। আবরাজ গা থেকে ব্লেজার টা খুলে রাখলো। সাদা শার্টের ওপর কালো রঙের ওয়েস্ট কোট। শার্টে আবৃত থাকা শরীরের ভেতর হাতের পেশি গুলো ফুলেফেঁপে উঠছে। আবরাজ ওয়াশ রুমে যাওয়ার পর সাব্বির খাবার রেডি করতে ব্যাস্ত হলো। নিসন্দেহে স্যারের বউয়ের হাতের রান্না সুস্বাদু হবে। যদিও সাব্বিরের এখনো ফিজার হাতের রান্না খায় নি। তবে খাবার দেখে এটুকু অনুমান তো করাই যায়।
আবরাজ বেরিয়ে এসে সোফায় বসলো। সাব্বির চলে যাওয়ার জন্য উদ্যত হলো। আবরাজ তখন বলে উঠলো,

-“তোমার চোখমুখ এমন লাগছে কেনো? এনি থিং রং?”

সাব্বির কণ্ঠ খাদে নামিয়ে বললো,

-“স্যার তিহার সাথে একটু ঝগড়া হয়েছে রাতে।”

-“ভেরী ব্যাড সাব্বির। বউয়ের সাথে ঝগড়া নয়। শুধু রোমাঞ্চ হবে। অনলি থ্রিল। ভালোবাসা আদান-প্রদান হবে। গট ইট?”

পুরুষ টার বাচনভঙ্গি মনে হচ্ছে খুব দক্ষ সে এই বিষয়ে। কত সুন্দর করে পরামর্শ দিচ্ছে। ভাবখানা বড্ডো গুরুগম্ভীর। সাব্বির হতভম্ব। তবুও মাথা ঝাঁকিয়ে সায় দিলো আবরাজের কথায়।

———

বাড়িতে যখন আবরাজ ফিরলো ফিজা তখন শাশুড়ী আর মিষ্টির সাথে বসে গল্প করছে। মিষ্টি সন্ধ্যায় এসছে। আব্রাহাম গিয়ে নিয়ে এসছে। ছুটি পরেছে। আবার ভাইয়ের বিয়েতে তো সে থাকতে পারে নি। এসছে পর মায়ের সাথে ঘ্যান ঘ্যান করছে মেহরিন কে খান বাড়িতে নিয়ে আসার জন্য। ইলা বেগম ঠিকঠাক বুঝতে পারে না মেয়ে নিজের ভাবির জন্য এমন অস্থির হচ্ছে না-কি ভাইয়ের হয়ে চামচামি করছে। তবে ঠিক করলেন স্বামীর সাথে কথা বলবে। বাড়ির বউ আর ক’দিন ফেলে রাখবে পরের বাড়ি! আবরাজ বোনের সাথে কথা বলে রুমের দিকে গেলো। ফিজা তখনও বসে। আবরাজ নিজের ব্লেজার টা ফেলে গিয়েছে সোফায়। একজন সার্ভেন্ট সেটা নিতে এলে ফিজা খপ করে সেটা নিজের কাছে নিয়ে নিলো। জোর করে মুখে হাসি টেনে বলে উঠলো,

-“আমি রুমে যাওয়ার সময় নিয়ে যাব।”

সার্ভেন্ট মাথা নিচু করে চলে গেলো। আব্রাহাম একবার আঁড়চোখে ফিজার শক্ত করে ধরে রাখা ব্লেজার টার দিকে তাকিয়ে আবার দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলো। ফিজা গুটিগুটি পায়ে ওঠে রুমের দিকে অগ্রসর হলো। মা মেয়ের কথাবার্তা তখনও চলছে। আব্রাহাম ফোন নিয়ে বসে আছে। মিলন খান অনেক পরে এলো। এসে মেয়ের পাশে বসলেন। মেয়ের সাথে সময় নিয়ে আড্ডা দিলো। আব্রাহাম এরমধ্যে একবার ওঠে ডাইনিংয়ের দিকে গেলো। ইলা বেগম তখন বললেন,

-“আপার সাথে কথা বলে অনুষ্ঠানের ডেট ফিক্সড করে নিয়েন আপনি।”

মিলন খান মেয়ের থেকে দৃষ্টি ঘুরিয়ে স্ত্রীর দিকে দৃষ্টিপাত করলেন। তবে কিছু বললেন না তিনি। আপনমনে কিছু ভাবতে ভাবতে নিজের রুমের দিকে চলে গেলো।
মিষ্টি মায়ের কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়লো। বাবা-মা দুজনেই সৌখিন। তাদের মধ্যে কখনো সে নিজের এতটুকু বয়সে ঝগড়া ঝামেলা মন কষাকষি হতে দেখে নি। তবে মা ইলা মাঝেমধ্যে অভিমান করেন। মিলন খানের কাজ নিয়ে ভীষণ অসন্তুষ্টু থাকেন তিনি। সারাবছর শহরের বাহিরে, দেশবিদেশ ঘুরাঘুরি এ-সব নিয়ে তাহার একটু অভিমান হয় বটে। তবে মিলন খান স্ত্রীর মন বুঝে। সময় পেলে কত আহ্লাদীপানা যে করেন স্ত্রী কে নিয়ে তার হিসেব নেই। এই তো গতবছর কত বড়ো করে ওয়েডিং এনিভার্সারি সারপ্রাইজ দিলেন। প্রায় এমন সব সারপ্রাইজ তিনি স্ত্রী কে দিয়ে থাকেন।

—–

আবরাজের কোমরে জড়ানো শুভ্র টাওয়াল যেনো শুভ্র রঙের এক খন্ড মেঘ। উদর থেকে বুকের খাঁজ লক্ষ্য করতেই রমণীর হৃদয়জ কেঁপে উঠলো। দৃষ্টি সংবরণ করে সাথে নিজে কে ও আড়ালে নেওয়ার একরকম প্রয়াস করলো।

-“তুমি অফিস যাচ্ছো না কেনো?”

আজ ছয় মাসের অধিক সময় হয় ফিজা অফিস যাচ্ছে না। যখন আবরাজের সাথে জার্মানিতে চলে গেলো এরপর আর যাওয়া হয় নি। তবে মিলন খান তো ফিজার সাথে এব্যাপারে কথা বলেছেন। এবং ফিজার অনুপস্থিতিতে মেহরিন কে জব টা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু আজ হঠাৎ করে কেনো আবরাজ এমন প্রশ্ন করছে? ফিজা কিছু বলার আগেই আবারও পুরুষ টার গর্জন শোনা গেলো,

-“আনসার মি।”

সকালের কারণে এমনিতেই ফিজার রেগে ছিলো। এখন আবার চিল্লাচ্ছে! ফিজা নিজের হাতে থাকা ব্লেজার টা মুচড়ে ধরে ছুঁড়ে ফেললো বিছানায়। দৃষ্টি নত করে বললো,

-“মাসের শুরু তো সবেমাত্র। কাল থেকে জয়েন করবো।”

কণ্ঠ কেমন নিস্তেজ। আবরাজ তবুও এব্যাপার কিছু বললো না। সে কাপড় চেঞ্জ করে বেরিয়ে গেলো রুম থেকে। ফিজা ঘড়ি দেখলো। খাওয়ার সময় হয়েছে। অথচ তাকে বললো না পর্যন্ত একবার। এমনতো কখনো আবরাজ করে না। ফিজা মনে মনে কথা টা ভেবে একটু না অনেক টা হতভম্ব হয়ে গেলো। সে পরনির্ভরশীল হয়ে যাচ্ছে কি? এক্সপেকটেশন টা কি বেশি করে বসে আছে? যেটা করা আদৌও উচিৎ হয় নি। নিজের রাগ অভিমান মন থেকে ঠেলে বের করার এক প্রকার যুদ্ধে নেমে গেলো। চার বছর যে মানুষ টা তাকে অবহেলায়, অনাদরে আর মানসিক এক অশান্তিতে ভাসিয়ে নিজের মতো দূরে ছিলো সেই মানুষ টা কে নিয়ে সে একটু বেশি ভেবে বসে আছে। স্বপ্ন বুনছে। আদৌও তার ফিরা আসা কিংবা যাওয়া নিয়ে কোনো নিশ্চয়তা নেই। যখন তখন এই পুরুষ তার থেকে দূরে যেতে পারে। যেমন টা কিছু দিন আগে গিয়েছিল।
নিজের মনে এসব ভাবতে ভাবতে ফিজা নিচে নেমে এলো। সে যখন এলো ইলা বেগম তখন কিছু টা বিচলিত হলেন। সেভাবে বলে উঠলেন,

-“এতো লেট করলি যে?”

-“ঔষধ ছিলো একটা। খালি পেটে। ওটা খেয়ে একটু অপেক্ষা করতে হয়েছে।”

ফিজা একটা চেয়ারে বসতে বসতে জবাবে বললো। মিষ্টি আজ বাবা আর বড়ো ভাইয়ের পাশের চেয়ার দখল করেছে। যদিও আবরাজের পাশে আব্রাহামের বাঁ দিকের চেয়ার টা খালি। তবুও ফিজা অন্য চেয়ারে বসলো। ইলা বেগম ফিজার প্লেটে ভাত তুলে দিতে দিতে শাসানোর ভঙ্গিতে বললেন,

-“কি যে করিস আগে খেয়ে নিবি না? এখন বোস। সবার খাওয়া শেষ।”

মিলন খান ফিজার সাথে টুকটাক কথা বললো। খাওয়াদাওয়া শেষ কিছু সময় সবাই লিভিং রুমে বসলো। ফিজা খেয়ে একটু দাঁড়িয়ে রইলো সেখানে। এরপর শাশুড়ী কে বলে রুমে চলে এলো। আলমারি থেকে নিজের রাতের পোশাক বের করে নিয়ে ওয়াশ রুম ঢুকে গেলো। ড্রেস চেঞ্জ করে যখন বেরিয়ে এলো। আবরাজ তখন নিজের রাতের পোশাক পড়ে, কিছু ফাইল নিয়ে তখন সোফায় বসে। পা আড়াআড়ি ভাবে সেন্টার টেবিলের ওপর তুলে রেখেছে। হাতের পেন্সিল টা নৃত্য করছে আঙুলের ফাঁকে। ফিজা আয়নার সামনে দাঁড়ালো এসে। রাতের কিছু প্রসাধনী হাতে পায়ে লাগিয়ে নিলো। আচমকাই লিপস্টিকের ওপর দৃষ্টি স্থির হলো। সাদা রঙের লং গাউন তার পরনে। ওড়না নেই শরীরে। মনে এক অদ্ভুত বাসনা জাগ্রত হলো। লিপস্টিক টা হাতে নিয়ে অল্পস্বল্প গোলাপি রঙের ওষ্ঠদ্বয়ে ঢেকে লালে রঙিন করার জন্য উদ্যত হতেই পেছনে থেকে তৎক্ষনাৎ নিজের কোমরে শক্ত হাতের শীতল স্পর্শ পেলো। লিপস্টিক হাতে মুঠো করে ধরে রাখলো। ফিজা আয়নায় তাকাতেই আবরাজের নিষ্প্রভ দৃষ্টে যেনো ফিজা কে শাসাচ্ছে। হিমবাহের ন্যায় শীতল কণ্ঠ আবরাজ এক সময় বলে উঠলো,

-“তুমি কি চাচ্ছো, লিপস্টিক দিয়ে আমার সামনে ঘুরঘুর করবে আর আমি মাতাল হয়ে তোমার লিপস্টিক খেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ি?”

ফিজা হতভম্ব। হতবাক হয়ে কিছু বলতে ভুলে গেলো। সে তো এ-সব ভেবে লিপস্টিক লাগাতে আসে নি। আর না আগে কখনো এমন ভাবে লিপস্টিক লাগিয়েছে। ফিজা নিজের সর্বোচ্চ শক্তি প্রয়োগ করে নিজে কে ছাড়িয়ে নিলো। যদিও এটা পসিবল ছিলো না। তবে আবরাজ চেয়েছে বিধায় হয়েছে।
আবরাজ নিষ্প্রভ দৃষ্টে চেয়ে ফিজার মুখের দিকে। সাদা রঙের নাইট ড্রেস টা শরীরের সঙ্গে যেনো মিশে আছে। বেশ আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে ফরসা শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ। ফিজা ত্বরিতে নিজের হাতের লিপস্টিক রাখলো ড্রেসিং টেবিলের ওপর। নিজের অবাধ্য নরম মন কে আবার পাথরের ন্যায় শক্ত করতে বেশ কড়াকড়ি ভাবে শাসিয়ে নিলো। দ্রুত পা ফেলে পিছিয়ে যেতেই আবরাজের হাত নিজের কোমরে আবারও অনুভব করলো। চোখের দৃষ্টি যে ভয়ংকর। ফিজা এই দৃষ্টির ব্যাখা জানে। গলদেশ পুরুষ টার শক্ত হাতের স্পর্শ পেলো। তৎক্ষনাৎ নিজের হাত জোড়া সেই হাতের ওপর চলে গেলো। আবরাজ যেনো কয়েকশো বছরের তৃষ্ণার্ত এক চাতক পাখি। আবরাজ শরীরে জড়ানো রেশমের তৈরি একটা ঢিলেঢালা ড্রেসিং গাউন কোমরে যেটার সুতির বেল্ট সেটা টেনে খুলে নিলো। ফিজার হাতে সেটা পেঁচাতে ফিজার বুঝতে বাকি রইলো না আবরাজ খান আজ সবরকম প্রস্তুতি নিয়ে তবেই এসছে।

#চলবে….