সুগন্ধি ফুল পর্ব-৫৫+৫৬ এবং শেষ পর্ব

0
320

#সুগন্ধি_ফুল
#পর্ব_৫৫
#জান্নাত_সুলতানা

[পর্ব টা একটু রোমান্টিক, পড়তে না চাইলে স্কিপ করতে পারেন।]

-“আবরাজ।”

সকাল থেকে এই নিয়ে বউ তার এগারো বার ডাকলো তাকে। আবরাজ এবার পূরণ দৃষ্টিতে বউয়ের দিকে চাইলো। শীতল এই চাহনি ফিজার সর্বাঙ্গে কম্পন ধরাতে যথেষ্ট। তবুও পিটপিট করে তাকিয়ে আছে মেয়ে টা। গতকাল থেকে কেঁদেছে প্রচুর। যার ফলে চোখমুখের অবস্থা খুব ভয়াবহ। আবরাজ ঠোঁট গোল করে নিঃশ্বাস ফেললো। হঠাৎ হঠাৎ মেয়ে টা কি যে করে হয়তো নিজেও জানে না। সে অফিস পর্যন্ত যায় নি এই মেয়ের জন্য। অথচ সে বিকেল হতেই বিছানা জুড়ে শাড়ীর মেলা বসিয়ে তাকে ডেকে যাচ্ছে। সে যতবারই উত্তর করে ততবারই আবার চুপ করে যায়। আবরাজ বিরক্ত হচ্ছে না। তবে বউয়ের কোনো সমস্যা হচ্ছে কি-না ভেবে ভেবে আরও হয়রান হয়ে জবাব দিচ্ছে। এবারেও তাই হলো। সে বেশ শান্ত স্বরে বলে উঠলো,

-“কখন থেকে ডেকে যাচ্ছো। ফর হোয়াট?”

ফিজা আবারও ঠোঁট কামড়ে ধরে। আবরাজ একটু বেসামাল হয় কি? অবশ্যই হয়। বউয়ের এমন বাচ্চামিতে সে একটু নয় অনেক টা বেশি নিজের ওপর ব্যালেন্স হারিয়ে ফেলে। ফিজা একটা শাড়ী হাতে তুলে নিলো। পাতলা অর্গ্যানজা সিল্কের। বলাবাহুল্য আবরাজের দেওয়া প্রায় সবগুলো শাড়ী অর্গ্যানজা সিল্কের, শিফনের পাতলা শাড়ী এবং জর্জেটের পাতলা শাড়ী গুলোর মধ্যে একদম দেহের ভাঁজ স্পষ্ট করে দেওয়ার মতো মোলায়েম চকচকে। রঙ গুলো একে-অপরকে ছাপিয়ে আছে যেনো। ফিজার হাতের শাড়ির রঙটা পান্না সবুজের মতো গভীর কিন্তু হালকা ঝকঝকে। এমন শাড়ী গায়ে দিলে যেনো শরীর নিজেই আলো ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য মুখিয়ে বসে। পাড়ে রেশমি কাজ ও ছোট ছোট তামার রঙের বিটস দিয়ে সূক্ষ্ম নকশা। চলার সময় হালকা ঝনঝন শব্দ হবে এব্যাপার শাড়ী দেখে ফিজা শিওরিটি দিতে পারে। তাই এটা সে পড়বে না বলেই ঠিক করলো। এখন এই শাড়ী আবরাজ দেখলে নিশ্চয়ই তাকে এটা পড়তে বাধ্য করবে। ফিজা তাই দ্রুত হাতে সেটা আরেকটা শাড়ির নিচে ফেলে দিলো। তবে ফিজার কপাল কি আর এতো ভালো? প্রবাদ আছে না যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধ্যে হয়৷ ঠিক যেনো ফিজার এই মূহুর্তে প্রবাদ টার সাথে নিজের পরিস্থিতির মিল খুঁজে পেলো। আবরাজ ঠিক ওর সামনে এসে দাঁড়ালো। লাল টকটকে শাড়ী টার নিচ থেকে সেই সবুজ শাড়ী টা খুঁজে হাতে নিলো। ফিজার দিকে শাড়ী টা এগিয়ে দিয়ে বলে উঠলো,

-“টেক দিস।”

এটা নাও। মানে এটা পড়ে নাও। এটাই কি বলতে চাইছে এই পুরুষ? কিন্তু এটা যে ফরসা শরীরে বেশ চকচকে দেখাবে, মেয়েলী ভাজ প্রতিটি দৃষ্টিগোচর হবে। এর আগে যা শাড়ী পড়েছে প্রায়শই শাড়ী সব শরীরের রঙের সঙ্গে মিশে যেতো। কিন্তু সবুজ আর ফরসা শরীরে শাড়ী বেশ চোখে লাগবে। ফিজা তবুও শাড়ী টা হাতে নিলো। আবরাজ ঠোঁট কামড়ে ধরে বলে উঠলো,

-“নাউ, ক্যান আই হ্যাভ এ কিস?”

ফিজা প্রথমে বুঝতে পারে নি। সে তখনও শাড়ী নিয়ে ঘোরে আছে। তাই আবরাজের দিকে না তাকিয়ে বলে উঠলো,

-“ইয়াহ, শিওর। হোয়াই ন,,,

যখন মনে হলো কি নিয়ে কথা হচ্ছে। কি প্রসঙ্গে এমন কথা হলো তখনই মেয়ে টার মুখ ফ্যালফ্যাল হয়ে এলো। আবরাজ বাঁকা হাসলো। বউয়ের বোকামি সে বহুদিন পর দেখলো। কবে যে দেখে ছিলো ঠিক মনে নেই। তবে এমন ভুল মাঝেমধ্যে হলে মন্দ হয় না। নিজের অধরে বউয়ের অধর চেপে ধরে গভীর এক অধর চুম্বনে লিপ্ত হলো আবরাজ। ফিজার দম আঁটকে আসে। যখনই আবরাজ নামক পুরুষের এই শুষ্ক ঠোঁটের স্পর্শ তার নাজুক নরম ঠোঁট স্পর্শ করে তখনই তাকে ক্ষত-বিক্ষত করতে ভুলে না। আবরাজ সময় নিলো। নিজ থেকে ছাড়ার অভ্যাস এই পুরুষের ডিকশনারিতে বোধহয় নেই। না কর্ম ছাড়লো না নিজের বউ কে আর নাই নিজের শত্রুদের। দানবীয় হাতের বিচরণ যখন নিজের কোমরে ফিজার হাত টা তখন আবরাজের চুলের দিকে ঠিক ঘাড়ে খামচে ধরে আছে। আবরাজ যখনই তাকে আদুরে স্পর্শ করে সাথে থাকে তার সেই চিরচেনা অভ্যাস। বউ কে ক্ষত-বিক্ষত করতে পুরুষ টার ভালো লাগে। এবারও ব্যাতিক্রম হলো না। শেষ মূহুর্তে এসে শব্দ করে চুমু খেয়ে তবেই ছাড়লো। ছাড়ার সাথে সাথেই বউ কে জড়িয়ে ধরে বলে স্লো ভয়সে ফিসফিস করে বললো,

-“এখন একটু কাঁদো৷ রাতে প্রচুর কাঁদাব গড প্রমিজ, মিসেস আবরাজ খান।”

———

একই বাড়িতে থেকেও মেহরিন বোনের সাথে দেখা করতে পারছে না। কিছু টা ইচ্ছে করে আবার কিছু টা পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করে। প্রথমত সে জানে বোনের সাথে দেখা করলে সে এ-সব বলা থেকে নিজে কে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না। দ্বিতীয়ত বোনের জীবনে কি দুঃখ কম আছে? উঁহু, দীর্ঘ চার বছর স্বামী তাকে ফেলে দূরে ছিলো। এরপর যখন এলো তখন একটু সুখের আশা কি দেখা দিয়ে ছিলো সেটাও এখন অমাবস্যার চাঁদ। বিয়ের সাড়ে পাঁচ বছরে এসে মাতৃত্ব সাধ পেতেই যাচ্ছিলো সেটাও মরিচীকা মাত্র হয়ে ধরা দিলো। যার কোনো ভিত্তি নেই। মেহরিন এতো কিছু ভেবেছে কখনো? উঁহু, বোনের একতরফ কষ্ট সে বা কেউ উপলব্ধি করে নি। এখন সে কি একটু অনুমান করতে পারছে বোন তার ঠিক কতোটা কষ্ট ছিলো? সে-ও নিশ্চয়ই এই কষ্ট কখনোই বুঝতে পারতো না। যদি না তার-ও এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হতো।
গভীর চিন্তাভাবনা কিংবা নেগেটিভ পজিটিভ দিক কোনটাই মেহরিন করে না। সর্বক্ষণ চুপচাপ আর নিজের মতো থাকতে স্বাচ্ছদ্যবোধ করে। অথচ তার জীবনে জড়িয়ে যাওয়া বিশেষ মানুষ টা তাকে কত কিছু চিনতে সাহায্য করেছে। এটাও দুঃস্বপ্ন। মেহরিন ফ্লোরে বসে আছে। এলোমেলো পোশাকআশাক বিধস্ত, বিবরণ, মলিন হয়ে থাকা চেহারা। চোখ ফুলে আছে। নাদুসনুদুস মুখ। নিশ্চয়ই বাজে লাগে? একদম নয়। আব্রাহামের নিকট চমৎকার লাগে এই রমণীর এমন বিধস্ত রূপ কেও। সে আয়েশ করে বসে আছে বিশাল আকারের মাস্টার বেড রুম টার ঠিম মাঝের বেগুনি কার্পেটের ওপর ফেলে রাখা ধূসর রঙের সোফায়। পুরুষ টার চলাফেরায় রাজকীয় একটা ভাব সবসময় থাকে। যেমন টা আগে মেহরিন শুধু এবং শুধুই আবরাজ খানের অধীন ভাবলেও এই একই রকম ভাবসাব যে আব্রাহাম খানের মধ্যে ও বিদ্যমান থাকতে পারে সেটার ধারণা তার ছিলো না। আবরাজ খান কে নিয়ে সে মা এবং বোনের কাছেই বেশি জেনেছে। তবে স্বচক্ষে দেখার সৌভাগ্য হয়েছে আব্রাহাম খান কে।
ডান পা বাঁ পায়ের ওপর তুলে বসে আব্রাহাম। পুরুষ টার হাতে তখন সিগারেট। সব কিছু ঠিক ছিলো। এরমধ্যে এই সিগারেটের বর্ণনা করতে মেহরিনের একদমই ভালো লাগলো না। সে নিজের দৃষ্টিতে বিরক্তি প্রকাশ করে চক্ষুদ্বয় ঘুরিয়ে নিলো। তবে সামনে বসা পুরুষের একদম ভালো লাগলো না সেটা। আত্মসম্মান প্রখর কি-না এই পুরুষের! তার বউ তার দিকে তাকাবে। ড্যাবড্যাব করে তাকাবে। সারাদিন তাকিয়ে থাকবে। অবভিয়াসলি সে তাকানোতে মুগ্ধতা নিয়ে তাকাবে। তাকে দেখবে মন দিয়ে দেখবে। চোখে থাকবে স্নিগ্ধতা। সেই দৃষ্টিতে বিরক্ত কেনো আসবে? ছোট্ট একটা গোল পাত্র। আধসাদা, ধূসর ছাইয়ে ভরা। চারপাশে কয়েকটা দাগ। সময়ের ছোঁয়ায় কালচে হয়ে গেছে। পাত্রের কিনারায় আধপোড়া একটা সিগারেট পড়ে আছে। সেখানেই আব্রাহাম আবরাও আধখাওয়া সিগারেটে গুঁজে রাখলো। ছাইয়ের স্তূপে জড়িয়ে আছে বহুদিনের নীরবতা। অনেকদিন হয় পুরো একটা সিগারেট খাওয়া হচ্ছে না। ভালো লাগছে না কেনো জানি। আব্রাহাম গম্ভীর হয়ে বসে থেকেই তর্জনী আঙুল টা বাঁকিয়ে ইশারা করে মেহরিন কে ডাকলো,

-“কাম হেয়ার।”

মেহরিন চাইলো। দৃষ্টিতে কোনো জড়তা নেই। যার অর্থ সে আসবে না। আব্রাহাম ঠোঁট কামড়ে ধরলো। কি অদ্ভুত সে মেয়ে টার দৃষ্টি পড়তে পারে অথচ মেয়ে টার মন পড়তে জানে না। মেহরিন আসে না। আব্রাহাম ওঠে দাঁড়ালো। মেহরিনের সামনে এসে ঝুঁকে আচমকাই কোলে তুলে নিলো ওকে। মেহরিন চমকে গেলো তবে গলা জড়িয়ে ধরলো আব্রাহামের। আব্রাহাম ওকে কোলে নিয়ে সোফায় বসলো আবার। এরপর রয়েসয়ে পুরুষ টা বলে উঠলো,

-“চলো আমার একটা গেইম খেলি। যদি এভাবে বসে থেকে তোমার বিরক্তি চলে আসে তাহলে আমি তোমার সামনে বসে থাকবো, আর যদি বিরক্তি না আসলে তুমি আমার সামনে বসে থাকবে, ডিল ইজ ডান ফুলিশ গার্ল!”

মেহরিন চমকাবে না-কি থমকে যাবে? সে সেই হিসাব কষতে গিয়ে যখন চিন্তায় বিভোর আব্রাহাম তখন নিজের কাজে ব্যাস্ত। মেয়ে টার বিরক্ত নয়। লজ্জা ঘিরে ধরলো মূহুর্তে। গলায় রাখা হাত টা আস্তে আস্তে শীতল হয়ে এলো।

#চলবে…..

[ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।]

#সুগন্ধি_ফুল
#পর্ব_৫৬[অন্তিম পর্ব]
#জান্নাত_সুলতানা

-“আম্মু মেহরিন কোথায়? দেখেছ তুমি ওকে? আম্মু? মেইড? মেইড?”

আব্রাহাম পাগলের মতো অস্থির হয়ে রান্না ঘরের দিকে তাকিয়ে ডাকতে লাগলো। ইলা বেগম দ্রুত পায়ে নিজের রুম থেকে বেরিয়ে এলো। এতো ভোরে কি হয়েছে ভেবে তিনি এবং মিলন খান রুম থেকে বেরিয়ে এলো। আব্রাহামের গায়ে একটা শার্ট। যার অর্ধেক ইন করা তখনও। চুল এলোমেলো আর সদ্য ঘুম থেকে ওঠে এসছে। খুব বিধস্ত দেখাচ্ছে আব্রাহাম কে। ইলা বেগম অস্থির চিন্তিত স্বরে বলে উঠলো,

-“কি হয়েছে আব্বা? মেহরিন এতো সকালে নিচে আসবে কেনো? রাতে রুমে ছিলো না?”

মিলন খান গম্ভীর হয়ে একপাশে দাঁড়িয়ে। ছেলের মতিগতি বুঝে না। কিছুদিন ধরে অফিসে ঠিকঠাক কাজ করছে না। তারউপর মেয়ে টার মতামত না নিয়েই তো বিয়ে করে ছিলো। যদিও ভালোই চলছিলো সব কিছু। তাহলে হঠাৎ করে কি হয়ে গেলো? আব্রাহাম দূরে বাইরে গেলো। গেইটে সিকিউরিটি নেই আজ। দারোয়ান নামাজ থেকে ফিরেছেন মাত্র। সবাই আব্রাহামের পেছনে এসছে। আব্রাহাম দারোয়ান কে কে জিজ্ঞেস করলো,

-“আঙ্কেল গেইট খোলা ছিলো?”

-“হ্যাঁ বাবা মাফ করবেন। নামাজে যাওয়ার সময় আঁটকে গিয়েছিলাম। কিন্তু এখন তো খুলে দিয়েছে কেউ।”

বিনয়ী আচরণ আব্রাহামের তবুও রাগ হলো। সে কিছু বলতে গিয়েও পিছিয়ে এলো। সবাই কে এড়িয়ে দৌড়ে রুমে এলো। পুরো রম জুড়ে সব ঠিকঠাক। শুধু তার কিনে দেওয়া একটা ব্যাগ নেই। আব্রাহাম আলমারি খুলে দেখলো। সব ঠিকঠাক। শুধু মেহরিনের একাডেমিক কাগজপত্রের ফাইল টা নেই। আব্রাহাম তন্নতন্ন করে সব কিছু খুঁজে দেখলো। কিন্তু সব ঠিকঠাক। টাকাপয়সা গহনাগাঁটি সব যে যার যায়গায় আছে। শুধু যার জিনিসপত্র সেই মানুষ টির এই রুমে কোনো অস্তিত্ব নেই। আব্রাহাম থমকে গেলো। বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলো মিলন খান, ইলা বেগম, আবরাজ, ফিজা তারা সবাই ভেতরে প্রবেশ করলো। আবরাজ বললো,

-“আমি সাব্বির কে কল করে দিয়েছি। ইনফরমেশন পাওয়া যাবে আর্লি।”

ফিজা চিন্তিত মুখে একপাশে দাঁড়িয়ে। বোন তার চুপচাপ স্বভাবের। কথা কম বলে। ভীতু প্রকৃতির মেয়ে। মা বোন কে না বলে আগে সে কোথাও যেতো না। আর সেখানে আজ এতো ভোরে মেয়ে টা নিজের স্বামীর ঘর থেকে না বলে কোথাও চলে গেলো? ব্যাপার টা তাকে ভাবাচ্ছে। ঠিক তখনই আব্রাহাম নিচে হাঁটু ভেঙে বসে পরলো। দুই হাতে মুখ চেপে ধরে বলে উঠলো,

-“ও চলে গেছে ভাইয়া। আর আসবে না। ঠকিয়েছি আমি ওকে, কিন্তু ভালোবাসি আমি। প্লিজ ওকে এনে দাও। প্লিজ আর ওকে জোর করবো না কোনো কিছু নিয়ে। প্লিজ আমার শুধু ওকে চাই।”

বলতে বলতে বিলাপ করতে লাগলো আব্রাহাম। আবরাজের হাত একটু জড়িয়ে ধরে কাঁদছে সে। সবাই নির্বিকার। নারীর অভিমান ভয়ংকর হয়। যতক্ষণ তাকে সেই অভিমান থেকে দূরে রাখতে পারবে ঠিক ততক্ষণ। তারউপর শান্ত সহজসরল মানুষ গুলো হয় একরোখা। তারা হুটহাট কোনো ডিসিশন নিবে না সহজে রাগবে না, কাঁদবে না, অভিমান করবে না। যখনই এগুলো করবে তখন বুঝে নিতে হবে সে অল্পতে কিছু করে নি। তার ওপর গভীর প্রভাব পরেছে বিধায় সে এমন করেছে।

—–

সময় কত দ্রুতই না চলে। আমরা এটার জন্য অপেক্ষা তো করি তবে এটা আমাদের জন্য অপেক্ষা করে না। তেমনই অপেক্ষা করে বসে নেই এটা। এটার কাটা চলছে। টিকটিক করতে করতে ন্যানো সেকেন্ড, ন্যানো সেকেন্ড থেকে সেকেন্ড, সেকেন্ড থেকে মিনিট, মিনিট থেকে ঘন্টা, ঘন্টা থেকে দিন, দিন থেকে সপ্তাহ, সপ্তাহ পেরিয়ে মাস, মাস পেরিয়ে বছর, চলতেই থাকে এভাবে। এরমধ্যে কত কী হয়। কত কী বদলায়। শুধু বদলায় না সময়। মানুষ বদলায় মানুষের সময় বদলায়। শুধু স্মৃতি বদলায় না। প্রিয় মানুষের স্মৃতি যা কখনোই বদলানোর নয়। তবুও আমাদের জীবন যুদ্ধে এগিয়ে চলতে হয়। দৈনন্দিন জীবন আসছে যাচ্ছে আবার আসছে।

-“আব্রাহাম?”

আচমকাই নিজের নাম শুনে একটু চমকে উঠলো আব্রাহাম। হাত থেকে ছিটকে কলম টা ডেস্কের ওপর পড়লো। আবরাজের কোলে একটা বাচ্চা ছেলে। বয়স কত হবে? এই তো বছর হবে না। গোল গোল বড়ো বড়ো আঁখি পল্লব দিয়ে সে ড্যাবড্যাব করে দেখছে আব্রাহাম নামক পুরুষ কে। আব্রাহামের মুখে মৃদু হাসি ফুটে উঠলো। হাত বাড়িয়ে দিতে সে ঝাঁপিয়ে কোলে পড়লো। আব্রাহাম আদর করলো। এরপর বললো,

-“আমার কাছে থাক এখন। তুমি যাও ভাইয়া।”

আবরাজ ওর হাতে একটা ঔষধের শিশি দিয়ে বললো,

-“তাড়াতাড়ি খেয়ে নে। আর শোন আজ ডক্টর আঙ্কেলের সাথে দেখা কর।”

আব্রাহাম শিশি টা হাত নিয়ে পকেটে রাখলো। মাথা নাড়িয়ে বললো,

-“খেয়ে নেবো আমি। দেখাও করবো। তুমি যাও।”

আবরাজ দীর্ঘ শ্বাস ফেললো গোপনে। এরপর বেরিয়ে গেলো। ফিজা কাঁচের দেয়ালের ওপাশ থেকে দাঁড়িয়ে দেখলো সব টা। সুদর্শন পুরুষ আব্রাহাম। মুখে চাপদাড়ি। সর্বদা পরিপাটি। তবুও যেনো আগের মতো উজ্জ্বল নেই মানুষ টা। কেমন মলিন মানুষ টার চেহারা।
আজ আড়াই বছর হয় মেহরিন নেই। এই আড়াই বছরে আব্রাহাম এমন দিন নেই নিজের এই পরিস্থিতির কথা ভেবে ভেবে ডিপ্রেশড হয়ে হসপিটাল ভর্তি হয় নি। মানসিক যন্ত্রণা ঠিক কতটা হয়ে থাকে এটা সবাই কমবেশি অনুভব করতে পারে। হয়তো এটা মরণব্যাধি নয়। তবে ভেতর থেকে একটা মানুষের আত্মা ঠিকই মারা যায়। ফিজার চোখের কোলে জমে থাকা জল মুছে নেয় সে সাবধানে। এখানে তার-ও কিছু করার নেই। হয়তো নিয়তিতে এমন লেখা ছিলো। যখন ওর নিজের ও একটা সময় মনে হতো আবরাজ কে ছাড়াই হয়তো এই দোটানা জীবনের সমস্যা সমাধান হবে। তখনই সে সব কিছু খুঁটিয়ে দেখতে লাগলো। যা তার সামনে আবরাজ নামক পুরুষ টার খবরদারিতে প্রেজেন্ট করা হতো সে তার থেকে-ও বেশি নিজে খুঁটিয়ে দেখতো। আবরাজের খারাপ হওয়ার কারণ থেকে শুরু করে তৃণা কে মারার রিজন পর্যন্ত সে জেনেছে। তবেই না ভেঙে যাওয়া মন আবারও জুড়েছে এই পুরুষের প্রতি। কিন্তু মেহরিন? মেয়ে টা যে বড্ড বোকা। ও যে আব্রাহামের স্বার্থপরতা ছাপিয়ে ভালোবাসা টা দেখতে পায় নি৷ একটু খুঁটিয়ে দেখার চেষ্টা করে নি। এতে কি হলো? সবটাই ধূলিসাৎ ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছে।
আব্রাহাম ছেলে বেবি টাকে নিজের সর্বোচ্চ টা দিয়ে আদর করে যাচ্ছে। কেননা এই ছেলে বাচ্চা টার চেহারা ঠিক মেহরিনের মতো। নাদুস-নুদুস মুখখানা আব্রাহাম কে বারবার নিজের প্রিয়তমা অর্ধাঙ্গিনীর স্মরণ করিয়ে দেয়। সে উপলব্ধি করে তার মেহরিন তার সাথেই আছে। আদৌও আছে তো সে? কোথাও? কিন্তু কোথায়? বেঁচে আছে? কে জানে! আব্রাহাম বাচ্চা টাকে জড়িয়ে ধরে বিড়বিড় করে বলে,

-“তুমি এই দুনিয়ায় আমার না হও, পরকালে তুমি আমার হবেই।”

——-

-“আমি যেতে পারবো তো ভাইয়া। প্লিজ ভাবি তোমরা বাড়ি যাও।”

আবরাজ ফিজা কেউ কথা শুনে না। ফিজা ফারাজ কে নিয়ে, আবরাজ পেছনের সিটে বসে গেলো। আব্রাহাম শেষমেশ না পেরে গাড়ি স্টার্ট করলো। হসপিটালের সামনে গাড়ি রেখে ওরা ডক্টর চেম্বারে গেলো। ডক্টর চেম্বারে আছেন, বৃষ্টি চারদিকে। এরমধ্যে আবরাজের ফোন টা বাজতে লাগলো। আবরাজ ফোন রিসিভ করে কানে তুলে কিছু সময় চুপ থেকে বলে উঠলো,

-“ইডিয়েট। ননসেন্স। আমরা হসপিটাল আছি। তুমি আগে জানাও নি কেনো আমাকে? জাস্ট শাট আপ।”

ধমকে-ধমকে আবরাজ কল কেটে দিলো। এরপর আব্রাহাম কে উদ্দেশ্য করে বললো,

-“ফোন কই তোর?”

আব্রাহাম প্রথম দিকে ভাইয়ের কথায় কি উত্তর দিবে বুঝতে পারে না। বললো,

-“ওই ফারাজ কে দিয়েছিলাম, হয়তো কেবিনে।”

-“গাধা।”

এরপর একজন নার্স কে ডাকলো। ফিজা কিছু বুঝতে পারছে না। আবরাজ নার্স কে একটা কেবিন নম্বর জিজ্ঞেস করে সবাই কে নিয়ে সেদিকে গেলো। একটা ওটির সামনে দাঁড়িয়ে আছে মোহিতা বেগম সাব্বির। আর একটা ডক্টরের সাথে কথা বলছে একটা মেয়ে। পেছন থেকে দেখে আব্রাহামের বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠলো৷ বুকের বাঁ পাশে তীব্র ব্যাথায় মাথায় অসহ্য যন্ত্রণায় আব্রাহাম দুই হাতে মাথা চেপে ধরে নিজে বসে পড়লো। ফিজা আবরাজ দু’জনেই হতভম্ব। সাব্বির দৌড়ে আসে। ডক্টর ডাকতে থাকে আবরাজ। স্ট্রেচার নিয়ে আসে ওয়ার্ডবয়। এরপর কেবিনে নেওয়া হয়। কেবিনে নেওয়ার আগে আব্রাহাম ঝাপসা খুব পরিচিত প্রিয় কাঙ্খিত সেই রমণী কে দেখতে পেলো। নিজের ভ্রম না-কি বাস্তব ঠিকঠাক ঠাহর করতে পারলো না।

——-

একটা দুই বছরের বাচ্চা। মুখে অক্সিজেন মাস্ক। বেডে চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে সে। তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে সবাই। মিলন খান, ইলা বেগম, মোহিতা বেগম, ফিজা আবরাজ সাথে মেহরিন। সে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বেডে শুয়ে থাকা বাচ্চা টার দিকে। ফিজার রাগ হচ্ছে। তবে শ্বশুর শাশুড়ী আছে বিধায় সে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। আব্রাহাম কে নিয়ে এরমধ্যে সাব্বির কেবিনে এলো। ইনজেকশন দিয়ে তবে আব্রাহাম কে ঠিক করা হয়েছে। মেহরিন এবার বললো,

-“ওর নাম আরহা খান। আমি যেদিন খান বাড়ি থেকে বেরিয়ে আমার ফ্রেন্ড নিতুর কাছে বগুড়া চলে যাই সেদিনই চেক-আপ করে জানতে পারি ওর কথা। সেদিন ফিরে আসার জন্য মন টা বড্ড ছটফট করছিলো।”

-“তাহলে কেনো আসো নি? জানো কত খুঁজেছি তোমায়?”

মোহিতা বেগম ধমক দিয়ে বললো। মেহরিন আজ কাঁদছে না। কথাও বলছে একদম স্পষ্ট। আব্রাহাম এক পাশে মূর্তির ন্যায় দাঁড়িয়ে। মেহরিন একবার চাইলো সেদিকে। পরপরই আবার বলে উঠলো,

-“যেখানে ভালোবাসা নেই সেখানে দায়িত্ব চাপিয়ে দেওয়া যায় আম্মু? যদি এমন হতো তাহলে তুমি কেনো আমাদের ছেড়ে চলে যাও নি? শুধু দায়িত্বের জন্য? না-কি ভালোবাসা ছিলো বলে? ভালোবেসে ভালোবাসায় থেকে গিয়েছো। আমি কেনো থাকতাম? শুধু অন্যের স্বার্থ পূরণে? জানো আম্মু আমি না অনেক বোকা। তোমাদের ভালোবাসায় আমি বোকাই রয়ে গেলাম।”

পরিবেশ টা কেমন স্তব্ধ হয়ে গেলো। মেহরিন কোনো দিন এমন করে কথা বলে নি। মেয়ে টা সব সময় তো চুপচাপ আর স্বল্পভাষী। অথচ আজ? এক একটা কথা যেনো সবার হৃদয়ে এফোঁড়-ওফোঁড় করে দাগ কেটে গেলো।

——–

পরিস্থিতি বদলাতে থাকে। সুখ দুঃখ। সব মিলিয়ে। জন্মের পর এই প্রথম আরহা নিজের পরিবার কাছে পেলো। অতিরিক্ত জ্বর থেকে এই রাজধানীতে নিয়ে এসছিলো মেহরিন ওকে। চলে যাওয়ার এতো বছরে সে একটি বারও সে এই শহরে আসে নি। কিন্তু মেয়ের জন্য এবার আসতে হয়েছে। সে জানতো, এই শহরে এলে ঠিকই আব্রাহাম নামক পুরুষ টা তাকে খুঁজে নিবে। আর হলো ও তাই। কিন্তু ফিরে এসে এমন কিছু দেখবে সে কল্পনা ও হয়তো করে নি। তাকে মানুষ টা নিজের স্বার্থের জন্য বিয়ে করে ছিলো। যদি তাই হয় তবে আজ কেনো মানুষ টার এমন দশা? তবে কি আব্রাহাম নামক পুরুষ নিজের অনুভূতি বুঝতে ভুল করেছে? কে জানে। আরহার জ্বর এখন ভালো হয়েছে কিছু টা। সে ফারাজের সাথে বেশ বন্ধু পাতিয়েছ। সারাক্ষণ সেখানেই থাকে। এই-যে রাত-বিরেতে সেখানে ঘুমতে চলে গিয়েছে। মেহরিন বিছানায় শুয়ে এপাশ-ওপাশ করছে। আব্রাহাম নেই। ওয়াশ রুমে আছে। বেরিয়ে এসে আব্রাহাম লাইট অফ করে বিছানায় এলো। মেহরিনের সাথে তার টুকটাক কথা হয়েছে এই কয়দিনে। তবে জড়তা যেনো কাটছে না। কিংবা সে এখনো ঘোরে আছে। শোয়ার বেশ অনেক্ক্ষণ পর আব্রাহাম বলে উঠলো,

-“মেহুরানী? একটু জড়িয়ে ধরি?”

কণ্ঠ টা তখন ও কাঁপছে। মেহরিনের অন্ধকারে কোনো জবাব দিলো না। আব্রাহাম ভাবলো ঘুমিয়ে পড়েছে। কিন্তু অনেক্ক্ষণ পর মেহরিন বলে উঠলো,

-“অপেক্ষা করছেন কেনো? আগে তো এভাবে অনুমতি নিতেন না।”

কথার অর্থ বুঝতে সময় লাগলো না আব্রাহামের। সে আচমকাই মেহরিন কে খুব শক্ত করে আলিঙ্গন করলো৷ এর আগে এতো দৃঢ় গভীর আলিঙ্গন আব্রাহাম করেছে কি-না মেহরিনের মনে নেই। সে মনে করতে চাইলো না। আব্রাহাম এরমধ্যে বলে উঠলো,

-“এভাবে বলো না। আমি তোমাকে আগেও ভালোবাসতাম। শুধু বুঝতে পারিনি। তুমি যাওয়ার পর-ই সেটা প্রতি সেকেন্ড সেকেন্ড উপলব্ধি করেছি আমি।”

মেহরিন চুপ। আব্রাহাম জড়িয়ে ধরে আছে তখন ও। তবে সময় গড়াতে নিজের হাত দু’টো আব্রাহামের পিঠ আঁকড়ে ধরলো। আব্রাহাম একটু কেঁপে উঠলো কী? হ্যাঁ। নিজের প্রেয়সী কে পাওয়ার আনন্দে সে কাঁদছে। মেহরিনের ঠিক সেই মূহুর্তে মনে হলো সে সত্যি ভাগ্যবতী। আব্রাহাম সেদিন মিথ্যা কথা বলে নি। শী ইজ এ রিয়েলি লাকি গার্ল।

——

ফারাজ আরহা দু’জনেই ঘুমিয়েছে। ওদের একপাশে ফিজা ঘুমিয়ে, আবরাজ বসে বসে দেখছে ওদের। দৃষ্টিতে তার প্রশান্তি। এই মেয়ে টাকে সে কত অবহেলায় না করে ফেলে গিয়েছিল। সে কখনোই কল্পনা করে নি তার জীবনের সবচেয়ে গুরত্বপূর্ণ মানুষ টা এই রমণী হয়ে উঠবো। এটা যেমন অকল্পনীয় তেমন চমৎকার। জীবনে সবরকম পরিস্থিতি আসা প্রয়োজন। দুঃখ না এলে যেমন সুখের মূল্য বোঝা মুশকিল তেমনই মেনে না নিলে অশান্তি মেনে নিলেই শান্তি। ফিজা না চাইলে হয়তো কখনো তাদের পথ চলা এতো দীর্ঘ হতো না। সে মনেপ্রাণে চাইলো এই পথ চলা আমৃত্যু হোক। বেড এবং রুম তার দুইটাই বেশ বড়ো। সে-ও এক পাশে শুয়ে পড়লো। বউ কে জড়িয়ে ধরে বললো,

-“আবরাজ খানের সুগন্ধি ফুল, এভাবেই সুগন্ধি দিয়ে আবরাজ খানের লাইফ সুগন্ধিতে ভরিয়ে দেওয়ার জন্য বিশেষ ধন্যবাদ, মিসেস আবরাজ।”

ফিজা পিটপিট করে চাইলো। ফারাজ ভূপৃষ্ঠ হওয়ার পর থেকে ই সে অসুস্থ। এখনো সেই অসুস্থতা দূর হয় নি। তাই ক্লান্তিতে চোখ বন্ধ তবে মুখে রাজ্যের খুশির ছোঁয়া। পূর্ণতায় বুক ভরে সে নিঃশ্বাস টেনে নিলো। সেই সঙ্গে নাসারন্ধ্র পৌঁছাল কড়া পারফিউমের মিষ্টি এক গন্ধ। যেই সুগন্ধি পেয়ে সে চোখ বন্ধ রেখেও বলে দিতে পারে নিজের প্রিয় মানুষ টার উপস্থিতি।

#সমাপ্ত।

[লম্বা এই জার্নিতে সবার এতো ভালোবাসার জন্য কৃতজ্ঞতা। অনেক গ্যাপ দিয়ে গল্প দেওয়ার কারণে অনেক পাঠক হারিয়েছি আমি। তারপরও যারা মাঝপথে ছেড়ে যান তাদের প্রতি ভালোবাসা আর কৃতজ্ঞতা শেষ হওয়ার নয়। ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। আজকে অন্তত যারা এতোদিন সাথে ছিলেন তারা নিজের অনুভূতি প্রকাশ করুন।🫠]

#জান্নাত_সুলতানা