#সুপ্ত_প্রেমের_অনুরাগে🕊️
#পর্ব:তেরো
#তামান্না_ইসলাম_কথা
সন্ধ্যায় সেজে উঠেছে চৌধুরী বাড়ির আঙিনা। সকালের সেই মন মরা ভাব কেটে গিয়ে এখন ফুল, বেলুন আর ঝাড়বাতি দিয়ে সাজানো হয়েছে ড্রয়িংরুম। আর এই সব কিছু করেছে আদভিন। সকালের ইয়ানশিরার মৃত্যু বার্ষিকীর উপলক্ষে যা যা করা হয়েছিল তা সব কিছু আদভিন আশ্রমে দিয়ে আসে। আর সেখান থেকে ফিরেই আর্দ্র এবং রোদ্রর জন্মদিনের জন্য যতটুকু সম্ভব বাড়ি সাজিয়ে তুলেছে। আর্দ্র এবং রোদ্রর জন্মদিন খুব ছোট করে ঘরোয়া ভাবে করা হচ্ছে। শুধু পরিবারের মানুষ ছাড়া আর কেউ নেই।
“এখানে দুজনে নির্জনে সাজাবো প্রেমেরও পৃথিবী। পাখি,,,”
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে গান গাইতে গাইতে শাড়ির কুচি ঠিক করছিলাম। হঠাৎ করে পেটের মধ্যে হাতের শীতল স্পর্শ পেয়ে থেমে গেলাম। এই স্পর্শ যে আমার চেনা। ভুল বললাম। শুধু আমার না! বরং আমার শরীরের প্রতিটি ভাঁজের চেনা স্পর্শ এইটা।
“চলো দু’জনে কোন এক নির্জনে চলে গিয়ে আমাদের ভালোবাসার পৃথিবী গড়ে তুলি! যেখানে শুধু তুমি আমি আর আমার ভালোবাসার স্পর্শ।”
কথাটা বলেই আমার অনুমুক্ত পিঠে ঠোঁট ছুঁয়ে দিলো আদভিন। আচানক আদভিনের স্পর্শে কেঁপে উঠলাম। আমার হাত গিয়ে ঠেকলো আদভিনের হাতের উপর। সেভাবেই অতিবাহিত হলো কিছু সময়।
“তোমার মাঝে কি আছে বলতো? যেটা বারবার আমাকে তোমার প্রেমে ফেলে? পড়ি তো পড়ি একেবারে মুখ থুবড়ে পড়ি। যদি তুমি আমার কাছে না থাকতে তাহলে আমার কি হতো বলো তো!”
কথা গুলো বলে আদভিন তার দিকে আমাকে ঘুরিয়ে নিয়ে দু’হাত দিয়ে কোমর চেপে ধরলো। আদভিন ঘোর লাগা চোখে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। কিছুটা লজ্জা পেয়ে গেলাম তার চাহনিতে। কিন্তু পর মূহুর্তে লজ্জাকে সাইডে রেখে আদভিনের গলা জড়িয়ে ধরলাম দুহাত দিয়ে।
“সাবধানে মুখ থুবড়ে পড়বেন মশাই। পড়ে গিয়ে আবার দাঁত ভেঙে ফেলে দিয়েন না। একে তো কপালে বুড়ো ব্যাটা জুটেছে তার উপর যদি আবার দাঁত ভাঙ্গা থাকে তখন সবাই আমাকে ফুকলা দাঁতওয়ালার বউ বলবে। না বাবা না আমি এই অপবাদ নিতে পারব না।”
নিজের হাসি চেপে রেখে মুখটাকে দুঃখি দুঃখি ভাব করে কথাটা বললাম। আমার কথা শেষ হতেই আদভিন কপাল কুঁচকে কিছু সময় তাকিয়ে রইল। এরপর হুট করেই গালে ঠোঁট ছুঁয়ে দিলো।
🍁🍁🍁🍁🍁🍁
আর্দ্র এবং রোদ্রকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি আমি আর আদভিন ইয়ানশিরার ছবির সামনে। আর্দ্র এবং রোদ্র দু’জন কোল থেকে নেমে যাওয়ার জন্য। মাঝে মাঝে আর্দ্র আদভিনের চুল ধরে টেনে দিচ্ছে। ইয়ানশিরার হাস্যোজ্জ্বল ছবি দেখে আদভিনের চোখ দুটো ছল ছল হয়ে আছে। ছেলেদের না কি কান্না করতে নেয়। এইটা সমাজের তৈরি করা একটা প্রথা। কিন্তু আমি মনে করি প্রতিটি মানুষের কান্না করা প্রয়োজন। বিশেষ করে পুরুষের। সমাজ ছিঃ ছিঃ করে করুক না! সমাজ কি তাদের বুকের ভিতর বইতে থাকা ব্যাথা গুলো লাগাভ করে দিতে পারবে? তারা কি বুঝতে পারবে পুরুষের বুকে জমে থাকা এক আকাশ পরিমাণ কষ্ট? উঁহু বুঝবে না। তাই আমার মনে হয় পুরুষের কান্না করা উচিত।
“ইনু দেখ তোর ছেলে কেমন দুষ্টু হয়েছে। কি ভাবে আমার চুল টেনে ছিঁড়ে ফেলছে। ঠিক যেমন করে তুই আমার চুল ধরে টেনে দিতি। আমি তোর জন্য চকলেট না নিয়ে এলেই এভাবে আমার চুল গুলো ছিঁড়ে ফেলতি। আবার আমার সেই চুল গুলো আঁচড়ে দিয়ে থু থু করে দিতি। মনে আছে এসব তোর।”
কথা গুলো বলতে বলতে আদভিনের গলার স্বর ধরে আসছিল। এক হাতে আর্দ্রকে শক্ত করে ধরে অন্য হাত দিয়ে ইয়ানশিরার হাস্যোজ্জ্বল ছবি ছুঁয়ে দিলো। আদভিন ছবিতে হাত রাখতেই আর্দ্র এবং রোদ্র এক সাথে মাম্মা বলে উঠলো একসাথে। আদভিন আর্দ্রর মুখের দিকে তাকিয়ে কপালে চুমু খেলো।
🍁🍁🍁🍁🍁🍁
আর্দ্র এবং রোদ্রকে কোলে নিয়ে সিঁড়ি নামতে নামতে ড্রয়িংরুমের নিরবতা দেখে কপাল কুঁচকে যায় আমাদের দুজনের। আরো কয়েক সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামতেই নিচে দাঁড়িয়ে থাকা দুজন ব্যক্তিকে দেখে আদভিনের চোখ মুখ শক্ত হয়ে যায়। সামিনকে এখানে দেখে যতটা না রাগ হচ্ছে তার থেকেও বেশি অন্তুকে দেখে আমার গা গুলিয়ে উঠতে শুরু করল। একটা মানুষ কতটা জঘন্য হলে এভাবে বারবার দুটো বাচ্চার জন্য এভাবে উঠে পড়ে লেগেছে।
“আরে আমার বাচ্চাটা! শুভ জন্মদিন আমার বাবা। আসো বাবার কোলে আসো। বাবা তোমাদের জন্য কত গিফটস নিয়ে এসেছে।”
কথাটা বলেই আমার কোলে থাকা রোদ্রকে নিজের কাছে নিতে এগিয়ে আসে অন্তু। কিন্তু অন্তুকে আসতে দেখেই আমি রোদ্রকে শক্ত করে নিজের বুকে জড়িয়ে ধরে রাখলাম। আর আদভিন আর্দ্রক কোলে নিয়ে আমার সামনে এসে দাঁড়িয়ে যায়।
“তোকে আমি বারবার বারণ করছি অন্তু আমার বাচ্চার দিকে নজর দিবি না। আমার বাড়ি থেকে বের হয়ে যাবি এই মুহূর্তে। এন্ড ইউ সামিন! ভাইকে কি আবার গারদের পিছনে দেখতে চাও না কি সোজা উপরে?”
দাঁতে দাঁত চেপে প্রথম কথা গুলো অন্তুকে বললেও শেষ কথা গুলো অন্তুর পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা সামিনকে বললো আদভিন। কিন্তু আদভিনের কথা দু’জনেই যেন হেসে উড়িয়ে দিলো।
“আদি ভাইয়া আপনি আমাদের কিছুই করতে পারবেন না। আমাদের কিছু হলে তো আপনি নিজেই ফেঁসে যাবেন। কিন্তু সত্যি কথা কি জানেন? আমরা চাই আপনি ফেঁসে যান। এরপর আর্দ্র এবং রোদ্রকে আমরা নিয়ে নিবো। আর এই সব কিছু তখন আমাদের হবে।”
নিজ গালে হাত ঘষতে ঘষতে পিছন থেকে এগিয়ে এসে কথা গুলো বললো সামিন। সামিনের কথা শেষ হতেই আদভিন তার নাক বরাবর ঘুষি মারে। নাকের উপর ঘুষি পড়তেই ফিনিক হয়ে রক্ত পড়তে শুরু করলো। সামিন নিজের দুহাত দিয়ে নাক চেপে ধরে।
“আগের বার তোদের দুজনকে হসপিটালে পাঠিয়ে ছিলাম। কিন্তু এবার আর হসপিটালে না বরং নরকে পাঠিয়ে দিবো।”
কথাটা বলে অন্তু এবং সামিনের দিকে এগিয়ে যায় চাইলে আমি আদভিনের হাত ধরে আটকে দেয়। আদভিনের হাত ধরতেই সে রক্ত চক্ষু নিয়ে আমার দিকে তাকাতেই তার হাত ছেড়ে দিলাম।
মূহুর্তের মাঝেই একটা সুন্দর দিন বিষন্নতায় ভরে গেল। প্রতিটি মানুষের মুখে ফুটে উঠলো বিষন্নতার ছাপ। সোফায় ধপ করে বসে কান্নায় ভেঙে পড়ে আমার শাশুড়ি মা। আমি এক কোণে রোদ্রকে কোলে নিয়ে জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম।
🍁🍁🍁🍁🍁🍁
নিশু রাত। চারদিক নিস্তব্ধ, যেন শব্দও ঘুমিয়ে পড়েছে। শহরের আলো নিভে এসেছে ধীরে ধীরে, কেবল দূরে কোথাও একটা কুকুরের ডেকে ওঠা জানান দেয় রাত এখনো জাগছে। জানালার বাইরে অন্ধকার নেমে এসেছে ভারি চাদরের মতো, আর চাঁদের আলো ছুঁয়ে গেছে রাস্তাঘাট, ছাদ, আর নিঃসঙ্গ ব্যালকনি গুলোকে। এই মধ্যরাত চুপচাপ, গভীর, অথচ অদ্ভুত রকমের জীবন্ত। যেন রাতের বুক চিরে উঠে আসছে কোনো পুরোনো স্মৃতি, কোনো অজানা আবেগ, কিংবা হারিয়ে যাওয়া এক নামহীন অভিমান।
এক রাশ বিষন্নতা নিয়ে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে আছি। আর্দ্র এবং রোদ্র ঘুমিয়েছে অনেক আগেই। আর আমি! অন্ধকারে দাঁড়িয়ে কিছু খুঁজে চলার চেষ্টা করে চলেছি। এই অন্ধকারে শুধু অন্ধকার ফিরে আসবে। আলো আর আসবে না।
“আই অ্যাম রিয়েলি স্যরি তরু।”
আমার ভাবনার মাঝেই আমাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে কথাটা বললো আদভিন। আদভিনের কথার উত্তররে কিছু বললাম না। শুধু অভিমান গুলো চোখের নোনা জল হয়ে গড়িয়ে পড়তে শুরু করলো।
“আমাদের জীবন এমন কেন আদভিন? সুখেরা যখন একটু হাতছানি দেয় তখনই কেন বিষন্নতা ঘিরে ধরে আমাদের?”
“বিষন্নতা যে জীবনের আরেকটি অংশ। বিষন্নতা আছে বলেই সুখ আছে। বিষন্নতা এবং সুখ একে অপরের পরিপূরক। ঠিক আমাদের মতো।”
কথাটা বলেই আদভিন আমার কপালে চুমু দিলো। আদভিনের আদুরে ছোঁয়াতে চোখের অশ্রু গুলো যেন আরো বেসামাল ভাবে পড়তে শুরু করলো।
#চলবে