(অনুমতি ব্যতীত কপি করা নিষিদ্ধ।)
#সুপ্ত_প্রেমের_অনুরাগে🕊️
#পর্ব:৩
#লেখনীতে: তামান্না ইসলাম কথা
সকালের মিষ্টি রোদ এড়িয়ে মধ্যহ্ন প্রহরে আকাশে জমেছে কালো মেঘের পাঁয়তারা। এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তরে ছুটে চলেছে তারা। মাঝেসাঝে আকাশ ঢেকে চলেছে গুরুম গুরুম করে। সে-ই সাথে ঝড়ো বাতাস বয়ে চলেছে। জানালার পর্দা গুলো বারবার উড়ে উড়ে যাচ্ছে এবং শব্দ হচ্ছে। বাধ্য হয়ে জানালা বন্ধ করে দিতে হলো।
সময়টা গ্ৰীষ্মকাল হলেও রোদের পাশাপাশি মাঝে মাঝে বৃষ্টিও দেখা যায়। যেমনটা আজকের আকাশ দেখে অনুমান করা হচ্ছে। যদিও বৃষ্টির অনুমান কখনো সঠিক হয় না। মাঝে মাঝে আকাশ ঘন কালো মেঘ করে এসেও বৃষ্টি হয় না তো আবার কখনো অল্প মেঘেও বৃষ্টি হয়।
একটা নীল রঙের কাতান শাড়ি পড়ে বসে আছি আয়নার সামনে। শাড়িতে সোলানী রঙের সুতোর কারু কাজ করা। সকালে দেওয়া শাশুড়ি মায়ের দেওয়া গহনা আর হালকা মেকআপ দিয়ে পার্লার থেকে আসা মেয়েটি সাজিয়ে দিলো। কিন্তু এই সাজসজ্জা উপেক্ষা করে সকালের সেই কথাটা বারবার স্কুলের ঘন্টার মত টুং টুং করে বাজছে।
“তরু তোমার হলো? নিচে তোমার বাড়ি থেকে! মাশাআল্লাহ আমার তরু মা’কে তো অনেক মিষ্টি লাগছে।”
আমি যখন নিজের ভাবনাতে মজে ছিলাম তখনই আমার শাশুড়ি মা রুমে প্রবেশ করতে করতে কথাটা বললো। আমার কাছে এসে চোখের কোন থেকে কাজল নিয়ে নজর কাটা দিয়ে দিলো। শাশুড়ি মায়ের এহন কাজে মায়ের কথা মনে পড়ে গেল। কিছু দিন আগে যখন আমার চাচাতো বোন তুলিকে তার প্রেমিকের পরিবার থেকে দেখতে আসে সেদিন আমি সামান্য একটু মেকআপ করার পর মা এভাবে করে নজর কাটা দিয়েছিল।
“নিচে চলো! তোমার বাড়ি থেকে লোকজন এসেছে।”
“আমার মা এসেছে?”
শাশুড়ি মায়ের কথার প্রেক্ষিতে অশ্রু সিক্ত নয়নে তার দিকে তাকিয়ে উক্ত প্রশ্ন করলাম। শাশুড়ি মা হয়তো বুঝতে পারলো আমার মনের অবস্থা যার জন্য পরম মমতায় আমার মাথায় হাত রাখলেন।
” আমি কি মা না? না কি আমাকে মা বলে মেনে নেওয়া যায় না?”
“না! না! তেমন কিছু না। আসলে আমি মা’কে ছাড়া কখনো থাকিনি।”
শাশুড়ি মা’কে কথাটা বলে মাথা নিচু করে নিলাম। শাশুড়ি মা চমৎকার হেসে আমার বাহু ধরে উঠে দাঁড়িয়ে করালেন।
“আমি তোমার মনের অবস্থা বুঝতে পারছি তরু। মা হওয়ার আগে আমিও তো নিজের ঘর, মা-বাবা ছেড়ে এসেছি। মন খারাপ করে না একটু পরেই তোমরা ও বাড়িতে যাবে তখন মায়ের সাথে দেখা হবে।”
আমাকে নিয়ে রুম থেকে বের হতে হতে কথাটা বললো শাশুড়ি মা। আমি শুধু তার কথা শুনে যাচ্ছি কিছু আর বলছি না।
🍁🍁🍁🍁🍁🍁
নিচে নেমে আসতেই ড্রয়িং রুমে দেখি আমার চাচা সহ আরো কিছু আত্মীয় এসেছে। আর আমার কিছু অচেনা মুখ আছে যাদের আমি চিনি না। হয়তো আদভিনের আত্মীয় এরা। আমার আর আদভিনের বিয়েটা পারিবারিক ভাবেই হয়েছে। যার জন্য তেমন কোন মানুষ আমাদের বিয়েতে উপস্থিত ছিল না। কিন্তু এখন যেন মানুষের ঢল লেগে গিয়েছে। যা দেখে একটা শুকনো ঢুক গিলে নিলাম। এতো অচেনা মানুষের ভিড়ে আমি শুধু আমার পরিবারের মানুষকে খুঁজে চলেছি।
পরিবারের মানুষ? যারা কি-না আমাকে আর আমার মা’কে শুধু অত্যাচার করে গিয়েছে? আমাদের বাড়িতে থেকেও আমাদের থাকতে হয়েছে কাজের লোকের মতো। আমার মা’কে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত শুধু কথা শুনিয়ে গিয়েছে তারা আমার পরিবারের মানুষ? রক্তের সম্পর্ক হলেই সবাই পরিবার বা আত্মীয় হয় না।
ড্রয়িংরুম পেরিয়ে বাড়ির সামনের বাগানে আসতেই রিতিমত নির্বাক হয়ে গেলাম।
আদভিন পুরোপুরি ভাবে বাঙালি জামাই সেজে আছে। সাদা রঙের একটা পাঞ্জাবি আর ধুতি আছে। সে কি আজ নতুন করে বিয়ের আসরে বসতে যাচ্ছে? ছেলে মানুষ এমন করে সাজার কি দরকার?
” আদিকে আমি বলেছি ধুতি আর পাঞ্জাবি পড়তে। আমাদের বাড়ির এইটা ঐতিহ্য যে, বৌভাতের দিন ছেলেকে ধুতি আর পাঞ্জাবি পড়তে হবে। যদিও একটু অদ্ভুত কিন্তু এইটা এই বাড়ির প্রথা।”
কথাটা বলে বাগানে করে রাখা স্টেজে পেতে রাখা সোফায় বসিয়ে দিল শাশুড়ি মা। আমাকে বসিয়ে দেওয়ার পর পরই সেখানে আদভিন এসে গেল। তার কোলে সয়ন আছে। অয়নকে শশুর বাবা রাখছেন।
“আমার সয়ন নানু ভাইকে আমার কাছে দিয়ে তুমি তরুর পাশে বসো আদি। মেয়েটার মন খারাপ মায়ের জন্য।”
আদভিনের কোল থেকে সয়নকে শাশুড়ি মা নিজের কাছে নিতে নিতে কথাটা বললো। আবারো সেই”নানু ভাই” কথাটা মাথায় ঘুরপাক খেতে শুরু করলো। উনি বারবার কেন “নানু ভাই” বলেছে? আদভিনের কি কোন বোন আছে? উহু! কোথাও তো তাকে দেখলাম না। নিজের ছোট ছোট দুজন বাচ্চা রেখে তো কোন মা এভাবে থাকতে পারে না। তাহলে কেন “নানু ভাই” বলে সম্বোধন করছে?
” বউ ইউ আর লুকিং সো প্রিটি। আমার নীল প্রজাপতির মতো লাগছে। বউ গতরাতের কাজ আজকে করি?”
আমার পাশে বসে ফিসফিস করে কথাটা বললো আদভিন। আদভিনের কথা শুনে চোখ বড়ো বড়ো করে তার দিকে তাকালাম। সে-ই সাথে প্রশংসা শুনে লজ্জাও পেলাম। কিন্তু লজ্জার থেকেও আশেপাশের মানুষ কথা শুনে ফেললো না কি সে-ই ভয় পাচ্ছিলাম। লোকটার কি একটুও লজ্জা শরম নাই? মুখে যা আসে তাই বলে?
“অসভ্য বুড়ো ব্যাট একটা।”
“ঠিক আছে আজ রাতে না হয় একটু অসভ্যতামি করবো!”
সবার আড়ালে চোখ মেরে কথাটা বলে মুচকি হাসতে লাগল আদভিন। এদিকে আমার ইচ্ছে করছে নিজের চুল নিজে ছিঁড়তে। কোন কুলক্ষণে কথা বলতে গিয়েছিলাম!
🍁🍁🍁🍁🍁
সময়টা অপরাহ্ন প্রথমাংশ। দুপুরের সে-ই মেঘ অনেক আগেই কেটে গিয়েছে। এখন টিমটিমানি রোদ। কিন্তু গরমের তীব্রতা অনেক। সে-ই সাথে শাড়ি আর গহনার ভাড়ে আরো গরম লাগছে। আদভিন বাড়ির ভিতরে চলে গিয়েছে অনেক সময় আগে। আদভিনের আত্মীয় স্বজন চলে গিয়েছে কিছু সময় আগে। আর আমার পরিবার থেকে আসা অল্প কিছু মানুষজন নিচতলায় বসে আছে আর সেখানে শাশুড়ি মা বসে তাদের সাথে গল্প করছে। অয়ন সয়ন সেখানেই। চাচির কোলে সয়ন আর শাশুড়ি মায়ের কাছে অয়ন।
“তুমি উপরে আদভিনের কাছে যাও তরু। সে উপরে একাই আছে।”
সবার মাঝখানে বসে ছিলাম এর মাঝেই উক্ত কথা গুলো শাশুড়ি মা আমাকে বলতেই বাধ্য মেয়ের মতো সেখানে থেকে উঠে এলাম।
নিচ থেকে উপরের রুমে আসতেই অন্ধকার রুম দেখে কিছুটা অবাক হলাম। এমন সময় রুম অন্ধকার করে রাখার কোন হেতু আমি দেখি না।
“অসভ্য বুড়ো ব্যাটার কাজ দেখো! সম্পূর্ণ রুম অন্ধকার করে,,,”
রুমের লাইট জ্বালিয়ে দিতে দিতে কথাটা বলছিলাম। কিন্তু কথাটা শেষ করার আগেই সামনে জানালার পাশে বসে থাকা আদভিনকে দেখে কথা বন্ধ হয়ে গেল।
ধীরে পায়ে আদভিনের দিকে এগিয়ে যেতেই আদভিন আমার হাত ধরে তার বসিয়ে দিল।
“এইটা কি?”
“হুঁশ! কোন কথা হবে না। আমার কাজ করতে দাও।”
কথাটা বলে আদভিন তার হাতে থাকা আলতার কৌটা থেকে ব্রাশে আলতা নিয়ে আমার পায়ে দিতে শুরু করলো। আমি গালে হাত দিয়ে মুগ্ধ নয়নে সেই আলতা দেওয়া দেখে চলেছি। এর আগে কখনো নিজেকে এতোটা স্পেশাল মনে হয়নি। আলতা দেওয়া শেষ হতেই আদভিন আয়নার সামনে নিয়ে গিয়ে আগের গহনা খুলে তার নিয়ে আসা গহনা পড়িয়ে দিতে লাগল। আদভিনের এই ছোট ছোট কাজ আমার মুখে হাসি ফোটাতে বাধ্য করছে বারবার। আদভিনের এই আদুরে স্বভাবে রুম থেকে বের হয়ে দোতলার সিঁড়িতে চলে আসি। পিছন পিছন আদভিন ছিল। সিঁড়িতে বসতেই আমার খোলা রাখা চুল গুলো খুব আলগোছে পিছনে নিয়ে দিচ্ছে। জীবনে প্রথম এতোটা ভালো লাগায় কোন অন্য ভুবনে চলে গেলাম।
“মিসেস তরু রুমে চলুন এইটা প্রেম করার জায়গা না।”
চুল গুলো কানের কাছে গুজে দিয়ে ধীর কন্ঠে কথাটা বললো আদভিন। আদভিনের কথা শুনে লজ্জায় পড়ে গেলাম।
আদভিনদের বাড়িটা দুতলা বিশিষ্ট। একদম গ্ৰাউনফ্লোরে মস্ত বড়ো ড্রয়িংরুম। যেটা বাড়ির ভিতর থেকে বাইরের সৌন্দর্য উপভোগ করার সুন্দর পরিবেশ তৈরি করে। আর সবাই সেখানে বসে গল্প করে তাই উপরে তারা আসার চান্স খুব কম।
🍁🍁🍁🍁🍁🍁
“আর ইউ রেডী ফর ফার্স্ট নাইট মিসেস তরু?”
#চলবে