সুপ্ত প্রেমের অনুরাগে পর্ব-০৫

0
9

#সুপ্ত_প্রেমের_অনুরাগে🕊️
#পর্ব:পাঁচ
#তামান্না ইসলাম কথা

ভোরের আলো ফোটার সাথে সাথে ধীরে ধীরে জেগে উঠল শহর। পূর্ব আকাশে লালচে আভা ছড়িয়ে সূর্য তার প্রথম কিরণ ফেলল গাছের পাতায়, জানালার কাচে, আর ঘুম জড়ানো মানুষের মুখে। পাখিরা ডানায় ভর করে উড়তে শুরু করল, তাদের কূজনে ভরে উঠল চারপাশ। দূরের মসজিদ থেকে ভেসে এলো মোয়াজ্জেমের সুর, যেখানে বলা হচ্ছে কোরআন পড়তে যাওয়ার জন্য। যে সুরে যেন সকালটা আরও পবিত্র হয়ে উঠল। চায়ের দোকানে শুরু হলো প্রথম কাপে ধোঁয়া ওঠা চা তৈরির প্রস্তুতি। কেউ হাঁটতে বের হলো, কেউ ব্যস্ত হয়ে পড়ল অফিসের প্রস্তুতিতে। বাড়ির উঠোনে পানি ছিটিয়ে ফুলগাছগুলোকে জাগিয়ে তুলল এক গৃহিণী। শিশুরা চোখ মুছতে মুছতে মায়ের কোলে উঠে এলো। রাস্তায় হালকা যান চলাচল শুরু হলেও কোলাহল তখনও জমে ওঠেনি সব কিছুতেই একধরনের প্রশান্তির ছোঁয়া। সকালের এই মুহূর্তটা যেন নতুন শুরু, নতুন আশার প্রতিচ্ছবি। প্রতিটি আলো, প্রতিটি শব্দ, আর প্রতিটি নিঃশ্বাসে মিশে থাকে জীবনের নতুন সম্ভাবনা। এ এক অনন্য শান্ত ও সুন্দর সকাল।
সকালের মিষ্টি রোদ চোখে মুখে লাগতেই ঘুম ভেঙ্গে গেল। বরাবর সকালে ঘুম থেকে উঠার অভ্যাস থাকার জন্য আজকেও ব্যতিক্রম হলো না। কিন্তু আড়মোড়া ভেঙে উঠতে চেষ্টা করতেই প্রচন্ড পরিমানে ব্যর্থ হলাম। সাথে এইটাও অনুভব করলাম আমার সম্পূর্ণ শরীর ব্যাথা হয়ে আছে। ব্যাথার পরিমাণ বেশি থাকায় চোখ আবারো বন্ধ করে নিলাম। পায়ের দিকে ভার অনুভব হতেই চোখ খুলে উঠে বসার চেষ্টা করলাম। কিন্তু উঠে বসার পরপরই মনে হলো উঠে বসা একদম উচিত হয়নি। আদভিন আমার দিকে আছে আর সেও খাটের সাথে হেলান দিয়ে বসে আছে। তার গায়ে এখনো চাদর জড়ানো আছে। আদভিনকে দেখতেই লজ্জা করছে। সে-ই সাথে গতরাতের সব কিছু যেন চোখের সামনে ভেসে উঠছে।

“এভাবে লজ্জা পেয়ো না মেয়ে। তুমি লজ্জা পেলে আমার নিজেকে অসভ্য হতে ইচ্ছে করে। আর আমি অসভ্য হলে আমাকে কিন্তু সামলানো কষ্ট হয়ে যাবে বউ। আর আমারও কিন্তু নিজেকে সংযত করে রাখা দায় হয়ে যাবে!”

আমার কাছ ঘেঁষে বসে উক্ত কথা গুলো বললো আদভিন। আদভিনের কথা শুনে লজ্জার পরিমাণ আরো বেড়ে গেল। কান দিয়ে যেন গরম ধোঁয়া বের হতে শুরু করেছে। অসভ্য লোকটা এতো নির্লজ্জ কেন?

“অসভ্য বুড়ো ব্যাটা। আপনার লজ্জা করে না? মুখে কি কিছু আটকায় না আপনার?”

আদভানকে কথাটা বলে মুখে হাত দিয়ে ফেললাম। গতকাল বুড়ো ব্যাটা বলার জন্য আমাকে কম খেসারত দিতে হয়নি। এখনো আবারো সেই কথা বলে ফেললাম।

“নিজের বউয়ের কাছে কিছু বলতে এবং আদর করতে চাইলে মুখে কেন আটকাবে? আর আমি কেন লজ্জা পেতে যাব? বউ আমার, মুখ আমার তাহলে আটকাবে কেন? বউ শোনো না।”

শেষের কথাটা একটু ঢং করে বললো আদভিন। আদভিনের কথা শুনে বিরক্ত হচ্ছি আবার হাসিও পাচ্ছে। ছেলে মানুষ হয়ে এমন ঢং করতে হবে? নিজের হাসি আটকে রেখে চোখে মুখে বিরক্তের রেখে ফুটিয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম।

“বউ আমার না তোমার ঘুমন্ত মুখ দেখে প্রেম প্রেম পাচ্ছে।”

কথাটা বলেই আদভিন লজ্জা পাওয়ার অভিনয় করলো। এদিকে আদভিনকে এমন লজ্জা পেতে দেখে আমার নিজের লজ্জারা আমাকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে পালালো। আমি বেমালুম ভুলে গেলাম হাসির কথা। মনে হচ্ছে আমার কথা বলার শক্তি লোপ পেয়ে গেছে। একটা ছেলে এতো রং ঢং কি করে করতে পারে?

“তরু তুমি কি আমার হবে?”

আমার ভাবনার মাঝেই আমাকে তার দুই হাতর মাঝখানে বন্দি করে আমার দিকে ঝুঁকে কথাটা বললো। আদভিনের চোখে মুখে দুষ্টুমি, চোখ যেন কথা বলছে। নিজের ঠোঁট জিভ দিয়ে ভিজিয়ে নিয়ে খাটের সাথে আরেকটু সেঁটে বসলাম।

“সরেন তো অসভ্য বুড়ো ব্যাটা। আমার মতো অবলা মেয়ে পেয়ে মজা নিচ্ছে।”

আদভিনকে সজোরে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়ে কথা গুলো বলে ওয়াশরুমের দিকে চলে গেলাম। আদভিন আরো কিছু বলছিল কিন্তু আমি আর শুনিনি। অসভ্য লোকটা লজ্জায় ফেলতে সবসময় প্রস্তুত থাকে।

🍁🍁🍁🍁🍁🍁

দুপুরের পর থেকে উত্তাপ রোদ হাওয়ায় মিলিয়ে গিয়ে শুরু হয়েছে ঝুম বৃষ্টি। রোদের তাপে যেই গরম পড়েছিল তা এখন বৃষ্টির কারণে ছিটেফোঁটা নেই। গরম চলে গিয়ে হালকা ঠান্ডা ঠান্ডা শীতল পরিবেশ তৈরি হয়েছে। বৃষ্টি দেখেই মনটা নেচে উঠেছে। বহুদিন পর বৃষ্টির দেখা মিললো। আর সে-ই বৃষ্টিতে বৃষ্টি বিলাস না করলে মনটা খারাপ হয়ে যাবে। কিন্তু এই বৃষ্টি দেখেও ভিজতে পারছি না শুধু মাত্র অসভ্য বুড়ো ব্যাটার জন্য। এই বৃষ্টিতে তার গরম ধোঁয়া ওঠা চা লাগবে। বাধ্য হয়ে এখন চা নিয়ে যেতে হচ্ছে তার জন্য।

“কোথায় একটু বৃষ্টি বিলাস করবো তা না! এখন চা খাবে। তরু তোর জীবনের সব শখ পানিতে গেল বলে। আগে তো খুব করে ঠিক করেছিলি বরের সাথে বৃষ্টি বিলাস করবি। তুই যখন ঝুম বৃষ্টিতে ভিজে একাকার হয়ে যাবি তখন তোর বর একজোড়া নূপুর নিয়ে এসে তোর সামনে হাঁটু গেড়ে বসবে আর তোর পায়ে নূপুর পরিয়ে দিবে। কই দিলো তো? করেছিস তো এক বুড়ো ব্যাটাকে বিয়ে সে এখন চা খাবে! চা!”

নিজেই নিজেকে কথা গুলো বলতে বলতে রুমে ঢুকে চুপসে গেলাম। আদভিন আমার পড়ার রুমের বারান্দার ফ্লোরে বসে আছে। শুধু বসে না বরং আমার পছন্দের উপন্যাস নিয়ে বসে আছে। আমার রুমের দরজা খুলতেই বারান্দা দেখা যায় যার জন্য আদভিনকে দেখতে সমস্যা হয়নি। কিন্তু এই বৃষ্টিতে কি এই বই নিয়ে বসতে হলো?

“এই যে আপনার চা।”

মুখটা প্যাঁচার মতো করে চায়ের কাপ এগিয়ে দিয়ে কথাটা বললাম। আদভিন বই থেকে একটু মুখটা বের করে আবারো বইয়ে মন দিলো।

“তোমার জন্য চা আনো নি? যাই হোক না নিয়ে এসেই ভালো করেছো। আমার পাশে বসো।”

বইয়ের পৃষ্ঠা উল্টাতে উল্টাতে কথাটা বললো আদভিন। আদভিনের কথা শুনে চুপচাপ তার পাশে বসে পড়লাম। বৃষ্টির ঝিরি ঝিরি পানি এসে আদভিনের শার্ট ভিজিয়ে দিয়েছে কিছুটা। যেটা বুকের সাথে লেপ্টে আছে। এই বুকে কি আমি একটা রাত সম্পূর্ণ থেকেছি? আবারো ইচ্ছে করছে আদভিনের বুকে মাথা রাখতে। শুনতে ইচ্ছে করছে তার প্রতিটি হৃদস্পন্দন। আচ্ছা আমি বারবার এমন বেহায়া হয়ে যাচ্ছি কেন? লোকটার বউ আছে, বাচ্চা আছে। গতরাতে যেটা হয়েছে সেটা হওয়া একদম উচিত হয়নি। পুরুষ মানুষ নারীর নিকটবর্তী থাকলে গলে যাবেই। কিন্তু আমার উচিত ছিল নিজেকে সামলে রাখা। কিন্তু এই লোকটাকে কি করে এড়িয়ে চলবো? আদভিনের মাঝে কিছু একটা আছে যা আমাকে টানে।

“এভাবে তাকিয়ে আছো কেন? বর তোমার, মানুষ সম্পূর্ণ তোমার। তাই এতো কিছু না ভেবে চলে আসো যেখানে আসতে চাও।”

বইটা বন্ধ করে আমার দিকে তাকিয়ে কথা গুলো বললো আদভিন। আদভিনের কথা শুনে কিছুটা লজ্জাবোধ করলাম। কিন্তু নিজেকে সংযত করে নিলাম। আর মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে নিলাম এক ভুল বারবার না করার।

“অন্যের জিনিসে আমি নজর দেই না। আর আমার,,”

“এতো কথা না বলে আমার গা ঘেষে বসো। আর এই ওয়েদার ফিল করো।”

আমার কথা শেষ করার আগেই আদভিন তার দিকে আমাকে টেনে নিয়ে বুকে জড়িয়ে রাখলো। নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলাম কিন্তু হাতির মতো মানুষের সামনে আমার মতো মশা নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়া খুব কঠিন কাজ।

“আরে কামড়ে দিচ্ছ কেন? আমি কি রাতে তোমাকে কামড়ে দিয়েছি? অবশ্য ঠোঁট,,”

“অসভ্য লোক একটা।”

আদভিনের চেস্টে কামড়ে দিতেই আমাকে লজ্জায় ফেলতে কথা গুলো বলছিল। কিন্তু তার কথা রমানে বুঝতে পেরে নিজের ছটফট বন্ধ করে দিয়ে চুপ করে রইলাম।
গরম ধোঁয়া ওঠা চা সেই কখন ঠান্ডা হয়ে গিয়েছে। বৃষ্টির ফোঁটা এসে চায়ের কাপে পড়ছে। চায়ের মাঝে বৃষ্টির ফোঁটা পড়তেই চা লাফিয়ে উপরে উঠে আবার নিচে পড়ে যাচ্ছে। বাইরে ঝুম বৃষ্টি আর দুজন মানুষ সাথে কথা সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের মেঘ বলেছে যাব যাব বই। পরিবেশ আরো রঙিন করে তুলেছে।

🍁🍁🍁🍁🍁🍁

“বাবা ওরা আদ্র আর রোদ্রকে নিয়ে চলে গেছে।”

#চলবে