সুপ্ত প্রেমের অনুরাগে পর্ব-০৬

0
9

#সুপ্ত_প্রেমের_অনুরাগে
#পর্ব:ছয়
#তামান্না_ইসলাম_কথা

ঘন্টা খানেক বারান্দায় আদভিনের শরীর ঘেঁষে বসে থেকে শুধু আদভিনের হৃদস্পন্দন শুনে গিয়েছি। না চাইতেও অবাধ্য কিছু কাজ করেছি। এর জন্য অবশ্য আদভিন লজ্জাও দিয়েছে অনেক। হুমায়ূন আহমেদের বই রেখে নবীন লেখকদের একটা বই হাতে নিয়েছে আদভিন। এমন সময় শাশুড়ি মায়ের কল আসতে আদভিনকে বারান্দায় রেখে রুমে চলে আসি।

“হ্যাঁ মা বলো!”

“আদি! আদি ওরা আদ্র এবং রোদ্রকে নিয়ে চলে গেছে বাবা। তুই কিছু একটা কর। তোর বাবা আমি চেষ্টা করেও পারিনি ওদের রাখতে। ওদের ফিরিয়ে নিয়ে আয় বাবা।”

ওপাশ থেকে কি কথা হয়েছে আমি জানিনা। কিন্তু একটু আগের আদভিন এবং আমার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা আদভিন দুজনকেই যেন ভিন্ন মনে হচ্ছে।

” গেট রেডি, উই আর গোয়িং ব্যাক-রাইট নাউ।”

শক্ত কন্ঠে কথাটা বলে তাড়াতাড়ি করে রুম থেকে বের হয়ে গেল আদভিন। আমি কিছু বুঝে উঠার আগেই সে চলে গেল। এরপর মায়ের সাথে কি কথা হলো জানিনা কিন্তু মা শুধু মাথায় হাত রেখে দোয়া করে দিলেন।

“কি হয়েছে আদভিন? আমরা এই ভাবে কেনো বের হয়ে আসলাম?”

কৌতূহল নিয়ে আদভিনকে প্রশ্ন করলাম কিন্তু কোন উত্তর করছে না। তার মত করে গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছে। তীব্র ঝড় বৃষ্টির মাঝেই ফুল স্পীডে গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছে আদভিন। চোখ দুটো লাল হয়ে আছে। আদভিন আমাকে বই পড়ে শোনাচ্ছিল আর আমিও বৃষ্টির সাথে তার উপভোগ করছিলাম। হুট করেই শাশুড়ি মায়ের কল আসাতে আমাকে নিয়ে তাড়াতাড়ি করে বের হয়ে গেল তিনি। যখন শাশুড়ি মা ফোন করেছিলেন তখনই আদভিনের চোখে মুখের রং পাল্টে যায়। মূহুর্তের মাঝেই একজন মানুষ আরেক জনকে গালি দিয়ে উঠলো। কি হয়েছে তা জানতে চাইলে কিছু বলছে না। মা’কে জিজ্ঞেস করেছিলাম তাও কোন কিছু জানতে পারিনি।

“গাড়ি থেকে নামো।”

একটা ছিমছাম বাড়ির সামনে এসে গাড়ি থামিয়ে উক্ত কথা বললো আদভিন। বৃষ্টি তখনও চলমান কিন্তু আগের মতো না। আদভিনের কথা শুনে একেবার পাশে বসা আদভিনের দিকে তাকাতেই দেখি আদভিন গাড়ি থেকে অলরেডি নেমে গেছে। বৃষ্টি থাকায় গায়ে থাকা কালো শার্ট শরীরে লেপ্টে আছে।

“আমরা এখানে এসেছি কেন আদভিন? আর এইটা কার বাড়ি?”

আবারো আদভিনকে প্রশ্ন করলাম কিন্তু আগের মতো এবারো সে নিরুত্তর। সে নিজের মতো করে দরজায় নক করে চলেছে। নক করছে বললে ভুল হবে দরজা ধাক্কাচ্ছে। যে কোন সময় মনে হয় দরজা ভেঙে যাবে।

“আরে কি করছেন কি? এভাবে দরজা ধাক্কা দিচ্ছেন কেন? দরজা কি ভেঙে ফেলবেন?”

“চুপ একদম চুপ! কোন কথা বলবে না। এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে বলেছি এখানে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকবে।”

ধমকের সাথে আদভিন কথা গুলো বললো। আদভিনের ধমকে কিছুটা অবাক হলাম কিন্তু তার থেকেও বেশি ভয় পেয়ে গেলাম এমন হিংস্র হয়ে যেতে দেখে। অবাক এবং ভয় দুটোকে ছাপিয়ে মনের মাঝে খারাপ লাগা তৈরি হলো তবুও কিছু না বলে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলাম।

” আমি জানতাম তুই আসবি। কিন্তু এতো তাড়াতাড়ি চলে আসবি জানা ছিল না। তোর জন্যেই তো এতো কিছু করা।”

দরজাটা খুলে একজন ছেলে কথাটা বললো। ছেলেটার বয়স আদভিনের মতোই লাগছে। কিন্তু ছেলেটা আদভিনের মতো সাদা বিড়ালের মত না। এর গায়ের রং উজ্জল শ্যামলা।

“তোর সাহস হলো কি করে ওদের আমার বাড়ি থেকে নিয়ে আসার? তোকে বারবার বলেছিলাম না ওদের থেকে দূরে থাকতে? তাহলে তুই আমার বাড়ি থেকে ওদের কোন সাহসে নিয়ে এলি? তোর খুব সাহস হয়েছে তাই না? তোর সাহস আমিও আজকে দেখে নিবো।”

আচমকা ছেলেটার নাক বরাবর একের পর এক ঘুষি মারতে মারতে কথা গুলো বললো আদভিন। আদভিন আচমকা এমন কাজে ভয়ে ছিটিয়ে গেলাম। আর ছেলেটি কোন রকম প্রতিক্রিয়া করছে না। সে সমস্ত ঘুষির আঘাত হজম করে নিচ্ছে।

” অন্তু কোথায় রেখেছিস ওদের? বল কোথায় আমার ছেলেরা?”

কথাটা বলতে বলতে আবারো মুখে ঘুষি মারলো আদভিন। আদভিনের কথা শুনে ছেলেটা হাসতে শুরু করলো। আদভিনের কথা শুনে আমার মাথা যেন ঘুরতে শুরু করলো। আদ্র রোদ্র এই লোকের কাছে? আবার এই লোকটা হাসছে?

“তোর ছেলে? সত্যি তোর ছেলে?”

আদভিনের থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে অন্তু নামক লোকটা ফ্লোর থেকে সোফায় হেলান দিয়ে বসে আদভিনকে প্রশ্ন করলো। লোকটার কথা শুনে আদভিন আরো হিংস্র হয়ে গেল। কিন্তু আমার সব কিছু এলোমেলো হতে শুরু করলো। কি বলছে এই লোকটা? বিয়ে পরানোর আগ মুহূর্তে তো তুলি আমাকে বলেছিল আদভিনের দুজন বাচ্চা আছে। শুধু তুলি না বরং চাচীও বলেছিল তাহলে এই লোকটা এমন করে কথা বলছে কেন? আর কে এই লোক?

“হ্যাঁ আমার ছেলে। আদ্র রোদ্র আমার ছেলে। শুধু আমার ছেলে। ব্লাডি বিচ্ বল কোথায় রেখেছিস আমার ছেলেদের?”

“এই তো ওরা।”

লোকটাকে মারতে আবারো হাত উঠিয়ে ছিল আদভিন। কিন্তু তার আগেই একজন মহিলা আদ্রকে কোলে করে নিয়ে এসে উক্ত কথা বললো।

“তোকে শেষ বারের মতো করে আমি ওয়ার্নিং করছি আমার বাচ্চাদের থেকে দূরে থাকবি।”

কথাটা বলেই আদভিন মহিলার থেকে দুজনকে কোলে নিয়ে চলে আসতে গিয়েও থেমে গেল লোকটার কথা শুনে। সে-ই সাথে আমার মাথা ব্যাথা করতে শুরু করলো। কি হচ্ছে আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।

“ওরা আমার সন্তান। আমি আজ হোক বা কাল আমি ওদের আমার কাছে নিয়ে আসবোই। বাই হুক অর বাই ক্রোক।”

“ভুলেও এদিকে হাত দেওয়ার চেষ্টা করিস না। নয়তো আমি ভুলে যাব তুই কে।”

কথাটা বলেই আদভিন বের হয়ে গেল। বৃষ্টি এখন নেই বললেই চলে। হালকা ঝিরিঝিরি বৃষ্টি যা গায়ে লাগছে না। কিন্তু আমার কান এবং মস্তিষ্কে শুধু লোকটার কথা প্রতিধ্বনি তুলছে। আদ্র রোদ্র তার সন্তান মানে কি? উনিই বা কে? কি সম্পর্ক আদভিনের সাথে? এসব প্রশ্নের উত্তর আমি কোথায় পাব? এতো এতো প্রশ্নের মাঝে যেন আমি এক বুক সমুদ্রে ডুবে। কিন্তু কোথাও কিনারা নেই।

🍁🍁🍁🍁🍁🍁

সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে বহু আগেই। তবে আবহাওয়া খারাপ বিধায় চারদিকে অন্ধকার হয়ে গিয়েছে। দেখলে যেন মনে হয় মধ্যরাত হয়ে এসেছে। আদ্র এবং রোদ্রকে নিয়ে বাড়ি ফেরা হয়েছে মিনিট দশেক আগে। আর বাড়ি ফেরার পর থেকেই শাশুড়ি মা তাদের বুকে জড়িয়ে ধরে কান্না করছে। শশুর বাবা কাউকে ফোন করে যাচ্ছে। আর আদভিন? সে থমথম মুখ করে বাচ্চাদের দেখে যাচ্ছে।

“ইমেডিয়েটলি সমস্ত পেপার রেডি করতে বলো বাবা। আদ্র এবং রোদ্রকে নিয়ে আমি কোন কম্প্রোমাইজ করতে চাই না। আর না আমি ওদের হারাতে চাই। সো ইমেডিয়েটলি সব কিছু রেডি করো।”

শশুর বাবাকে কথা গুলো বলে রোদ্রকে নিজের কোলে নিয়ে কপালে চুমু দিলো। আমি শুধু চুপচাপ দাঁড়িয়ে সব কিছু দেখেই যাচ্ছি। আমার কি কিছু বলা উচিত সেটাও বুঝতে পারছি না। আদ্র রোদ্র দুজন সাত মাসের হওয়ায় তারা দুজনেই হামাগুড়ি দিতে পারে। ওরা দুজন কোলে থাকায় বারবার করে নেমে যাওয়ার জন্য ছটফট করতে লাগলে শাশুড়ি মা কোল থেকে নামিয়ে দিল।

” তরু, আদি তোমরা রুমে গিয়ে ড্রেস চেঞ্জ করে নাও। এভাবে ভেজা জামাকাপড়ে থাকা ঠিক না। তোমরা তাড়াতাড়ি করে ড্রেস চেঞ্জ করে নাও।”

আদভিনকে কথা গুলো বলে শাশুড়ি মা একজন কাজের মেয়েকে ডেকে রোদ্রকে নিতে বললে সে রোদ্রকে নিয়ে চলে গেল।

🍁🍁🍁🍁🍁🍁

“লোকটা কে আদভিন?”

আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের ভেজা চুল গুলো তোয়ালে দিয়ে মুছে নিচ্ছিল আদভিন। এমন সময় তাকে প্রশ্ন করতেই আমার দিকে ঘুরে তাকালো।

“কোন লোক?”

কপাল কুঁচকে আমাকে ফের প্রশ্ন করতেই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম। প্রশ্নের জবাবে ফের প্রশ্ন! কিন্তু আমার জানতে হবে সব কিছু।

“আদ্র, রোদ্রকে যে নিয়ে চলে গিয়েছিল।কে উনি? উনি কেন,,,,”

আমার কথা শেষ করার আগেই আদভিনের চোখের দিকে তাকাতে কথা গুলো গলায় আটকে গেল। প্রচন্ড পানি পিপাসা পেয়েছে কিন্তু পানি চাওয়ার মতো বা নিজেকে থেকে নেওয়ার মতো শক্তি যেন পাচ্ছি না। ভয়ে শুকনো ঢুক গিলে নিলাম।

” এই নাম যেন আমি তোমার মুখে না শুনি তরু। মায় ফার্স্ট এন্ড লাস্ট ওয়ার্নি।”

কথা গুলো বলেই রুম থেকে বের হয়ে গেল আদভিন। আর আমি শুধু তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতে থাকলাম। অনেক না জানা প্রশ্ন রয়ে গেছে। আমাকে খুব তাড়াতাড়ি সব কিছু বের করতে এবং আদভিনের থেকে মুক্তি পেতে হবে।

🍁🍁🍁🍁🍁🍁

“তুমি এই রুমে কি করছো তরু?

#চলবে