#সুপ্ত_প্রেমের_অনুরাগে🕊️
#পর্ব:নয়
#তামান্না_ইসলাম_কথা
সকাল সকাল চৌধুরী বাড়ির ড্রয়িংরুমে চাপা উত্তেজনা তৈরি হয়েছে। শাশুড়ি মা এবং শশুর বাবা মুখ গম্ভীর করে বসে আছে। আর আদভিন! শুধু রাগে সাপের মত ফুঁসে চলেছে। কিন্তু এদের এমন মনোভাবকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে নিজের মুখে বিশ্ব জয়ের হাসি এঁটে বসে আছে অন্তু এবং তার মা। শুধু তারা না বরং আরো একজন বসে আছে তাদের সাথে। সে হচ্ছে, সামিন। সামিনকে এখানে অন্তু এবং তার মায়ের সাথে দেখে প্রথমে অবাক হলেও গতকাল কফি শপের বলা কথাটা মনে হতেই সব কিছু বুঝতে পেরেছি। অবাক হলেও এখন কিছুটা ভয় হচ্ছে, যদি সামিন বলে দেয় আমার সাথে তার প্রেমের সম্পর্ক ছিল?
” আদি! ভাই আমার। আমি কতদিন পর এখানে তোদের বাড়িতে এলাম আর তুই আমাকে দেখে একটু খুশি হসনি?”
আদভিনের সামনের সিঙ্গেল সোফায় পায়ের উপর পা রেখে হাসি মুখে কথাটা বললো অন্তু।
“তোমাকে এখানে দেখে খুশি হওয়ার কিছু আছে অন্তু? তার থেকে ভালো, এখানে কেন এসেছো এইটা বলো!”
আদভিন কিছু বলার আগেই শশুর বাবা অন্তুকে প্রশ্ন করলো। শশুর বাবার কথা শুনে অন্তুর মুখের হাসি আরো চউড়া করে উঠে দাঁড়ালো।
” তোমাদের এখানে আসার কারণ বুঝতে পারছো না? আদি তুই কিছু বলবি না?”
“এতো হেঁয়ালি কেন করছো অন্তু? কি চায় তোমার?”
“আদ্র এবং রোদ্রকে।”
শাশুড়ি মায়ের কথা শুনে ঝটপট করে উত্তর দিলো অন্তু। অন্তু তখন আদ্র এবং রোদ্রর সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছে।
” তোকে বলেছি না আমার বাচ্চাদের থেকে দূরে থাকতে?”
আদভিন বসা থেকে উঠে অন্তুর কলার চেপে ধরে কথাটা বললো।
” তোর বাচ্চা!”
নিজের শার্টের কলার থেকে আদভিনের হাত ছাড়িয়ে নিতে নিতে কথাটা বললো অন্তু।
“অন্তু তুমি কি কিছু ভুলে যাচ্ছ না?”
শশুর বাবা শক্ত কন্ঠে প্রশ্ন করলো অন্তুকে। শশুর বাবার কথা শুনে আদভিনের থেকে সরে গিয়ে শশুর বাবার দিকে এগিয়ে গেল অন্তু।
“গতকাল একটা নোটিশ পেয়েছি। আইনি নোটিশ। কিন্তু আমি যদি বলি, আদ্র এবং রোদ্রর বায়োলজিক্যাল ফাদার আমি? আদ্র এবং রোদ্র আদভিনের না আমার সন্তান!”
কথা গুলো বলতে বলতে শশুর বাবার সামনে থেকে আদভিনের সামনে এসে দাঁড়িয়ে শেষ করলো। অন্তুর মুখের এই কথা শুনে আমার মাথা ঘুরে উঠলো। আদ্র এবং রোদ্র আদভিনের না অন্তুর সন্তান? এতো দিন কি আমি ভুল জানতাম? আর তারা অন্তুর সন্তান হলে এখানে কেন? আর অন্তুর সাথে কি সম্পর্ক।
” ওরা আমার সন্তান, আমার বোন ইয়ানশিরার সন্তান। তোর না অন্তু। তুই যা খুশি করে নিতে পারিস। কিন্তু তুই কখনো আদ্র এবং রোদ্রকে পাবি না।”
রাগে হাত মুঠি বদ্ধ ঘরে কথা গুলো বললো আদভিন। আদভিনের কথা শুনে অন্তু আদভিনের মুখমুখি হয়ে দাঁড়াল।
” আদ্র এবং রোদ্রকে আমার কাছেই নিয়ে যাব আদি। আর ওদের আমার কাছে নিয়ে গিয়ে আমি তোকে হারিয়ে দিবো। জিতে যাবে এই অন্তু।”
আদভিনকে কথা গুলো বলে বাড়ি থেকে বের হয়ে গেল অন্তু। অন্তুর পিছনে পিছনে চলে গেল সামিন। অন্তর মা কিছু বলতে চেয়েও কিছু না বলে চলে গেলেন। শাশুড়ি মা আদ্র এবং রোদ্রকে বুকে জড়িয়ে কান্না করছে। আদভিন কাউকে ফোন করতে করতে রুমের দিকে চলে গেল। আর আমি শুধু নিজের ভুলের জন্য নিজেকে দোষারোপ করতে শুরু করলাম। আমার একটা বার সব কিছু জানা উচিত ছিল। সেদিন কি মা নিজেও এই কথা বলতে চাইছিল?
🍁🍁🍁🍁🍁🍁
” কি রে সকাল সকাল এবাড়িতে? তোর বর বুঝি বের করে দিয়েছে?”
সদর দরজার সামনে আমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেই উক্ত কথা বললো তুলি। কিন্তু আমি তুলির কথার উত্তর না দিয়ে সোজা ঘরের ভিতর প্রবেশ করে গেলাম।
“মা কোথায় তুলি?”
“এই তো আমি! কি হয়েছে? এতো সকাল সকাল এবাড়িতে! কিছু হয়েছে তরু?”
রান্না ঘর থেকে কাপড়ে হাত মুছতে মুছতে এগিয়ে এসে প্রশ্ন করলো মা। মায়ের পিছন পিছন চাচীও এলো। তার মুখেও প্রশ্নের ভাঁজ। কিন্তু মুখে কিছু না বলে শুধু ভ্রু কুঁচকে দাঁড়িয়ে রইল।
“তুলি বিয়ের আগে তুই আমায় যেন কি বলেছিলি?”
তুলিকে প্রশ্ন করতেই সে কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে গেলো। হাতের আঙ্গুলে আঙ্গুল ঘষাঘষি করতে লাগলো। সে-ই সাথে চাচীও একবার তুলির দিকে তাকালো।
“আমি! আ,,”
“তুলি কি বলেছে? তুই তুলিকে জিজ্ঞেস করছিস কেন? বিয়ে ছিল তোর, তাহলে তুলি তোকে কি বলতে যাবে?”
তুলিকে কিছু বলতে না দিয়ে চাচী আমার সামনে এসে দাঁড়িয়ে কথা গুলো বললো। চাচীর চোখে মুখেও ভয়ের ছাপ স্পষ্ট।
“তুমি, তুলি কিছু বলোনি চাচী?”
“কি হয়েছে তরু? কি বলেছিল তোর চাচী?”
আমি চাচীকে প্রশ্ন করতেই মা এগিয়ে এসে আমাকে প্রশ্ন করলো। একবার চাচীর দিকে তো একবার মায়ের দিকে তাকিয়ে দু’জনকে দেখে নিলাম।
“মা আমি এবং আদি প্রথম যেদিন বাড়িতে এসেছিলাম তখন তোমাকে বলেছিলাম না আমাকে সতীন আর দুই সন্তান নিয়ে সংসার করতে হবে? আর তুমি কিছু বলার আগেই সেখানে আদভিন চলে আসায় কিছু বলতে পারোনি।”
“হ্যাঁ বলেছিলি। কিন্তু আমি তখন বুঝতে পারিনি যে, সতীন কোথা থেকে আসবে? আর আদ্র এবং রোদ্র ওদের মা তো জন্মের সময় মারা যায়। আদ্র, রোদ্র আদির বোন ইয়ানশিরার সন্তান।,”
মায়ের কথা শুনে আমি চাচী আর তুলির দিকে তাকালাম। তারা দুজনেই মুখ কাচুমাচু করে দাঁড়িয়ে আছে।
“চাচী আমি যতটুকু জানি চাচা এই বাড়ির অনেক কিছুই নিজের নামে করে নিয়েছে। আর তোমাদের জন্য একটা ফ্ল্যাট দেখেছে।”
” কি! কি বলছিস তুই? এসব,,,”
“আমি কি বলছি সেটা তুমিও জানো আর আমিও জানি। আর কেন এই কথা গুলো বলেছি সেটাও তুমি জানো। তুমি তো বুদ্ধিমতী তোমার জন্য আমার অল্প কথায় যথেষ্ট।”
চাচীকে আর কিছু বলতে না দিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে গেলাম। সময় তখন হয়তো এগারোটা। কিন্তু আকাশের মেঘ এবং অন্ধকার দেখে মনে হচ্ছে সন্ধ্যা। হয়তো একটু পরেই বৃষ্টি শুরু হবে।
আজ যতটা সময় যায় বৃষ্টি বিলাস করবো। মনের সুখ, আনন্দ সব এক করে ভিজবো।
এমন না যে, আদ্র এবং রোদ্রকে নিয়ে আমার সমস্যা ছিল। প্রথম দেখার পর থেকেই বাচ্চাদের প্রতি আমার দুর্বলতা তৈরি হয়ে যায়। নিজের সন্তানের মত এই কয়টা দিন রেখেছি। কিন্তু মনের মাঝে একটা খারাপ লাগা ছিল এইটা ভেবে যে, আমি অন্যের সংসারে এসে পড়েছি। অন্যের ভালোবাসাকে আমি নিজের করে পেয়েছি। সব থেকে বেশি খারাপ লাগতো, আমার স্বামীর মনে অন্য একজন থাকবে। কিন্তু এখন আর সে-ই খারাপ লাগা নেই। এখন আমি আদভিনকে নিজের বলতে পারবো।
🍁🍁🍁🍁🍁🍁
ঘড়ি কাটা টিকটিক করে জানান দিচ্ছে তার সময়। ঘড়ির কাটা তখন দুইয়ের ঘরে। ভেজা কালো শাড়িতে নিজেদের রুমে আসতেই স্তব্ধ হয়ে গেলাম। সম্পূর্ণ রুম অন্ধকার। সে-ই সাথে সিগারেটের তীব্র গন্ধ নাকে লাগছে। অন্ধকার হাতড়ে রুমের লাইট অন করতেই সামনে বিধ্বস্ত অবস্থায় বসে থাকা আদভিনকে দেখে বুকটা ধক করে উঠল। ফ্লোরে পা ছড়িয়ে বসে বসে সিগারেট খাচ্ছে। সম্পূর্ণ রুম সিগারেটের এ্যাশ দিয়ে একাকার করে রেখেছে। দ্রুত রুমের জানালা খুলে দিয়ে আদভিনের কাছে ছুটে গেলাম। এখনো এক হাতে জ্বলন্ত সিগারেট। অপর হাত রক্ত শুকিয়ে কালচে ভাবে জমাট বেঁধে আছে। বুঝতে বাকি নেই যে আবার কিছু একটা করেছে।
“আদভিন আপনার হাতে রক্ত কিসের!”
আদভিনের সামনে হাঁটু গেড়ে বসে প্রশ্ন করতেই চোখ তুলে আমার দিকে তাকালো। আদভিনের চোখের দিকে তাকাতে ভয় পেয়ে গেলাম।
“কি হয়েছে আপনার আদভিন? কোথায় গিয়েছিলেন আপনি?”
“মেরে হসপিটালে দিয়ে এসেছি ওদের। আমার বোন, আমার স্ত্রী নিয়ে নোংরা কথা বলার শাস্তি দিয়ে এসেছি আমি। তারই রক্ত লেগে আছে।”
ধরা গলায় প্রশ্ন করতেই শক্ত কন্ঠে উত্তর করলো আদভিন। আদভিনের কথা শুনে আঁতকে উঠলাম। বুঝতে বাকি নেই আদভিন অন্তু এবং সামিনকে মেরেছে।
“আপনি! আপনি সবকিছু জানেন?”
ভয়ে ভয়ে আদভিনকে প্রশ্ন করতেই আদভিন আমার চুলের মুঠি ধরে টেনে তার মুখের কাছে নিয়ে গেল। আচমকা চুলে ধরে টেনে ধরায় ব্যথা সহ্য করতে না পেরে চোখ খিচে বন্ধ করে নিলাম। দুজনের মাঝে দুরত্ব মাত্র দুই ইঞ্চি। আদভিনের গরম নিঃশ্বাস আমার মুখে পড়ছে।
” তোমার কি ধারনা তরু? আমি তোমার বিষয়ে কিছু জানিনা? তোমার অতীত নিয়ে আমার কিছু যায় আসে না। কিন্তু অতীত যদি সামনে আসে তাকে আমি সহ্য করবো না। জানে মেরে দিবো। তোমার বর্তমান এবং ভবিষ্যত শুধু আমি। এই আদভিন নিজেই তোমার প্রতিটি ছোঁয়ায় থাকবে।”
আদভিন দাঁতে দাঁত চেপে কথা গুলো বলে তার হাতে থাকা সিগারেট আমার হাতে চেপে ধরলো। জ্বলন্ত সিগারেট হাতে ধরায় সেখানে পুড়ে যেতে লাগলো। মনে হচ্ছে আমার হাত কেউ কেটে নিয়ে যাচ্ছে। প্রচন্ড জ্বালা করতে শুরু করলো। আদভিনেকে কিছু না বলে ব্যাথা সহ্য করে নিতে লাগলাম। কিন্তু আমার অবাধ্য চোখ থেকে টুপ টুপ করে অশ্রু গড়িয়ে যেতে লাগল।
” তুমি আমার তরু। এর থেকেও বেশি ব্যাথা আমার হচ্ছে।”
কথা গুলো বলে চোখের পাতায় ঠোঁট ছোঁয়া আদভিন। আদভিনের কথা এবং কাজে হচ্ছে করছে এখান থেকে পালিয়ে যায়। কিন্তু চুলের মুঠি শক্ত করে ধরায় ব্যাথা করছে অনেক।
“আদভিন ছাড়ুন আমাকে। আমার লাগছে।”
আদভিনের থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে নিতে কথাটা বললাম। কিন্তু হাতির মতো মানুষের সাথে আমার মতো চুনোপুটি কোন ভাবে পারা যে সম্ভব না।
“আমার লেগেছে যখন তুমি ঐ রাসকেলের সাথে ছিলেন।”
আদভিনের কথা শুনে চোখ মেলে তার চোখের দিকে তাকালাম। আদভিনের চোখ দুটো লাল হয়ে আছে। আর আমার চোখ বেয়ে শুধু নোনা জল গড়িয়ে পড়ছে। আদভিন তাহলে সেদিন আমাকে আর সামিনকে এক সাথে দেখেছিল। আদভিন কি সেখানেই উপস্থিত ছিল?
#চলবে