#সেই মেয়েটার উপাখ্যান
#পর্ব ৫০
ইদানিং রথীন এর সঙ্গে প্রতিদিনই প্রায় ফোনে কথা হচ্ছে প্রতাপ সান্যালের, রথীন এর ওপরে সুমনকে সরিয়ে দেবার সব দায়িত্ব চাপিয়ে দিয়ে মোটামুটি নিশ্চিন্ত আছেন সান্যাল মশাই। নবীন যদিও তাঁকে বার দুয়েক বলেছিলো তার আপত্তির কথা, প্রতাপ সান্যাল ধর্তব্যের মধ্যেও আনেন নি।
আহা! তুমি বুঝতে পারছো না নবীন, রথীন কে বিশ্বাস করে এই ব্যাপারে আমি একটুও ভুল করছি না! এটা তুমি ঠিক বলেছো যে সে একটুও বিশ্বাস যোগ্য নয়, কিন্তু এক্ষেত্রে তার নিজের স্বার্থ আছে! তার ভায়রা ভাইয়ের কাছে যাতে সে ছোটো না হয়ে যায় তাই এটা সে ঠিকমতো দায়িত্ব নিয়েই করবে!
নবীন একটু আপত্তি জানিয়েছিলো,
মিছিমিছি ছেলেটা কে সরাতে চাইছেন! বিয়ের আগে তো এমনই উঠে দাঁড়াবে না, তাকে সরিয়ে লাভ কি! মাঝখান থেকে পুলিশি ঝুট ঝামেলা!
সান্যাল মশাই মাছি তাড়ানোর ভঙ্গিতে হাত নেড়েছিলেন,
আরে! কি যে বলো! ওসব রথীন সামলে নেবে, কারণ যদি বিপদে পড়ে তাহলে তো ওর নামই প্রকাশ্যে আসবে, তাই না? আমাদের কি? আমি তো সরাতে চাইনি, ও নিজেই যেচে দায়িত্ব নিতে গেলে আমার আর কি করার আছে!
নবীন চিন্তিত ভঙ্গিতে হাত উল্টেছিলো,
কি জানি! যা ভালো বোঝেন তাই করুন তাহলে! তবে এটা কিন্তু ধামাচাপা দেওয়া সহজ হবে না স্যার, ছেলের যোগাযোগ ভালোই!
যদিও নবীনের কথাকে খুব বেশি আর গুরুত্ব না দিয়ে সান্যাল মশাই নাতনির বিয়ে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন। বিয়েতে সাহায্যের জন্যে ছোটো ছেলেকে পাওয়া সম্ভব ছিলো না, রতিকান্তর থাকা বা না থাকা সমান, তার কাছ থেকে সাহায্য পাওয়ার অপেক্ষা সান্যাল মশাই কখনো করেন নি, তাই বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে রতনকে তার অনিচ্ছা সত্বেও বিয়ের কাজে লাগিয়ে নিজেও সেখানে সশরীরে উপস্থিত থাকছিলেন। সেই জন্যেই বেশ কয়েকদিন হল কোর্টে যাওয়া বন্ধ করেছেন প্রতাপ সান্যাল, বিয়ে শেষ হওয়ার আগে সেখানে যাওয়ার কোনো সম্ভবনাও দেখা যাচ্ছে না আর।
বিয়ের দিন দশেক আগের এক সকালে ঘটনাটা ঘটলো। একটু বেলার দিকে পাড়ায় পিয়ন ডাক বিলি করে, প্রায় প্রতিদিনই সুকান্ত এবং প্রতাপ সান্যালের বিভিন্ন চিঠি পত্র আসে। আজও তাই যখন দরজায় চিঠি বলে পিয়ন কড়া নাড়ল, এবং বামুন বেশ কয়েকটা খাম হাতে নিয়ে দোতলায় উঠে এলো, তখন সান্যাল মশাই অতো গুরুত্ব দিলেন না। নিজের হাতের কাজকর্ম মিটিয়ে নিয়ে তিনি টেবিলের ওপরে রাখা চিঠিগুলো হাতে তুলে নিলেন।
বেশির ভাগই বিভিন্ন মামলা সংক্রান্ত চিঠি, সেগুলো উল্টে পাল্টে দেখতে দেখতে একটা নীল রঙের ইনল্যান্ড তাঁর হাতে পড়লো। চিঠিটা কলকাতার কোনো এক জায়গা থেকেই পোস্ট করা দিন তিনেক আগে, একটু ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে আঙুল ঢুকিয়ে সেটা খুলে ফেললেন প্রতাপ সান্যাল, খুলতেই তাঁর ভ্রু কুঁচকে গেল, তিনি সোজা হয়ে চেয়ারে উঠে বসলেন। সুন্দর গোটা গোটা অক্ষরে লেখা চিঠির বয়ান দেখে তিনি চমকে গেলেন,
শ্রদ্ধেয়,
প্রতাপ সান্যাল মহাশয়,
যে চিঠি আজ আপনাকে লিখছি, এটি বোধহয় আরও অনেক বছর আগেই আমার লেখা উচিত ছিলো। আসলে আমার ধারণা ছিলো আপনি উকিল মানুষ, বংশগত ওকালতি আপনাদের, তাই আপনি নিশ্চয়ই একজন বুদ্ধিমান এবং বিচক্ষণ ব্যক্তি। কিন্তু আপনি আমার সেই ধারণাকে এতো বছরে ভুল প্রমাণিত করেছেন বার বার, আপনার চোখের সামনে ঘটে যাওয়া একের পর এক ঘটনা আপনি সামান্য বিবেচনা করে দেখার চেষ্টাও কখনো করেন নি। যদি করতেন তাহলে না আজ আপনি নিজের উদ্যোগে নাতনির বিয়ে দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়তেন, না আমাকে এই চিঠি লিখতে হতো।
যে মেয়েটিকে আপনার বংশের সন্তান হিসেবে চিহ্নিত করে আপনি এতো বছর ধরে বড়ো করে তুলেছেন, সে যে রক্তের সম্পর্কে আপনার কেউ নয় এই তথ্য জানলে আপনি যে অত্যন্ত দুঃখ পাবেন এটা জানা থাকা সত্বেও আপনাকে বলতে আজ বাধ্য হলাম। আপনার বড়ো ছেলেটি যে একজন কুলাঙ্গার সেকথা আজ নতুন করে আপনাকে বলে আমি সময় নষ্ট করতে চাইনা। জানি আপনি যথেষ্টই ব্যস্ত মানুষ, আপনার সময়ের দাম আছে, তাই সরাসরি কাজের কথায় আসি।
আপনার পুত্র রতিকান্ত একজন অকর্মন্য সেতো আপনি নিজেই জানেন নিশ্চয়ই, কিন্তু সেই সঙ্গে যে সে একজন প্রতারক সেটা আপনার অগোচরেই রয়ে গেছে এতদিন। রতিকান্ত নিজে নপুংসক, সেই ব্যর্থতা ঢাকার জন্যে যে সে একজন গর্ভবতী মহিলাকে স্ত্রীর পরিচয় দিয়ে নিয়ে এসেছিলো এবং আপনার সঙ্গে প্রতারণা করেছিলো তা আপনি এতো বছরেও কখনো জানতে পারেন নি বা বলতে গেলে জানার চেষ্টাও করেন নি। অথচ একজন উকিল হিসেবে এটা আপনার মাথায় আসা উচিত ছিলো যে বিয়ের মাস খানেক আগে থেকেই যে বউ গর্ভবতী ছিলো সেই সন্তানের বাবা আদৌ আপনার ছেলে কিনা!
সেকথা না হয় বাদই দিলাম, এতগুলো বছরেও যখন কোনো বাবার তার সন্তানের প্রতি বিন্দুমাত্র ভালোবাসা থাকেনা, দায়িত্ব বোধ আসেনা এমনকি নিজের সন্তানের ভালো মন্দে তার কিছু যায় আসে না, তখন যে কেনো আপনার মতো বিচক্ষণ ব্যক্তির তা চোখ এড়িয়ে যায়, এটা বোঝা খুব মুশকিল! উল্টে তার গায়ের রঙে, চোখে মুখের ভাবে, রক্তের গ্রুপে আপনি সান্যাল বংশের ছাপ দেখতে পান। অথচ আপনার সামনে মুখে প্রকাশ না করলেও মনে মনে সবাই জানে মেয়েটি অত্যন্ত সুন্দরী, একদম তার মায়ের মতো! আপনাদের বংশ বনেদী নিশ্চয়ই তবে আপনারা কেউই অসাধারণ সুন্দর নন, না আপনাদের কারোর মেয়েটির মতো দুধে আলতা গায়ের রঙ আছে!
যে আপনি আপনার প্রথম পুত্র বধূ কে সচক্ষে দেখেছেন এবং তার সঙ্গে যে তার মেয়ের প্রভূত মিল আছে সেটা জানা সত্বেও, তার মধ্যে জোর করে বনেদী সান্যালদের ছাপ দেখতে যাওয়ার মতো মূর্খামি আপনার মতো মানুষের কাছ থেকে আশা করিনি।
যদি আমার তথ্য সম্বন্ধে আপনার কোনো সন্দেহ থেকে থাকে তাহলে আপনার পুত্র কে ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারেন, আশা করি বাবাকে জব্দ করে সত্যি কথা বলে দেওয়ার এই সুযোগ সে হাতছাড়া করবে না! আমি যদিও এক্ষেত্রে রতিকান্তের সমব্যথী, তার নপুংসক হওয়ার ক্ষেত্রে তার কোনো হাত নেই, এর জন্যে আপনিই দায়ী! আপনার একের পর এক আনা সুন্দরী মেয়ের বিয়ের প্রস্তাব ফিরিয়ে দেওয়ার কারণ আপনাকে বা বন্ধুদের কাউকেই জানানো তার পক্ষে সম্মানজনক ছিলো না কখনই, তাই অগত্যা তারই বা কি করার ছিলো আর! সে তার সামর্থ্য অনুযায়ী নিজের ব্যর্থতা ঢাকার প্রচেষ্টা হিসেবে নিষিদ্ধ পল্লীতে তার যাতায়াতের খবর সুকৌশলে ছড়িয়ে নিজের মাথার ওপর থেকে নপুংসক এর তকমা সরানোর চেষ্টা করেছিলো ঠিকই তবে সে চেষ্টা যে খুব বেশি ফলপ্রসূ হয়নি তা বলাই বাহুল্য! তবে হ্যাঁ, যে প্রতারণা সে তার দ্বিতীয় স্ত্রীর সঙ্গে করেছে তা সত্যিই ক্ষমার অযোগ্য! মেয়েটির পিতৃত্ব কে স্বীকার করে নিয়ে সে ইচ্ছাকৃত ভাবে তার দ্বিতীয় স্ত্রী কে বন্ধা প্রমাণিত করেছে সব সময়, তাকে করা আপনার স্ত্রীর হাজার অপমানেও সে নিজের মুখ খোলেনি!
এখন আপনি নিশ্চয়ই জানতে চাইবেন যে কেনো আপনার দ্বিতীয় পুত্রবধূ কখনো মুখ খোলে নি? আপনি হয়ত ভাবছেন যে সে মুখ খুললে আপনি তাকে বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দিতে পারেন এই ভয়ে সে চুপ করে ছিলো, কিন্তু আসল সত্য তা নয়! কারণ তার জানা ছিলো যে যদি তাকে বাপের বাড়ি পাঠানোর সিদ্ধান্ত আপনি নিতেন তাহলে তার বন্ধা হবার খবর পেয়েই নিতেন কিন্তু আপনি তাকে আপনার বাড়ির কাজের মহিলা হিসেবেই রাখতে চেয়েছিলেন। সে আসলে মা হারা শিশুটি কে বাঁচিয়ে রাখতে চেয়েছিলো আপনার বিষ দৃষ্টি থেকে, কারণ আপনার বাড়ির কাজের মহিলা মায়া তাকে মৃত্যুর আগে সব তথ্য দিয়ে গিয়েছিলো। যাইহোক, তার মুখ না খোলার জন্যে একটি শিশুর প্রাণ তো বেঁচেছিল তখন! আজ সে বড়ো হয়ে গেছে, এখন তাকে প্রাণে মারার চেষ্টা যে অনেকটা আপনার নিজের পায়েই কুড়ুল মারা হবে সেটা বুঝতে পারছেন আশা করি?
কয়েকটা পরামর্শ রইলো আপনার জন্যে, আশা করি নিজগুণে অধমের ধৃষ্টতা ক্ষমা করে দেবেন! দ্বিতীয় পুত্রবধূ কে বাড়ি থেকে তাড়ানোর চেষ্টা করে লাভ নেই, তার বিয়ে আইন সঙ্গত, সেই আপনার প্রথম এবং একমাত্র পুত্রবধূ, আপনার ছেলের আগের পক্ষের স্ত্রীর সঙ্গে তার বিয়ে হয়নি কখনো! সে মাথায় সিঁদুর এবং পেটে সন্তান নিয়েই আপনার বাড়িতে পা দিয়েছিলো, সে সিঁদুর সেই লোকটির পরানো, যে তার সন্তানের বাবা এবং মাঝরাস্তায় একা ফেলে পালিয়ে যাওয়া প্রেমিক! আর আপনার জ্ঞাতার্থে জানাই, আশার খুনের খবর সুকান্তর কাছে আছে! রতন কখন রাজসাক্ষী হয়ে যায় বলা মুশকিল, সে শুনছি ইতিমধ্যেই সুকান্তর কাছে তার বয়ান জমা দিয়েছে! তাই আপনার পুত্র বধূ এবং নাতনির( যদি আপনি এখনও তাকে নাতনি বলেই ভাবেন) কোনো ক্ষতি হলে সুকান্ত আপনাকে বিপদে ফেলতে পারে! আর রতনের কিছু হলে তো কথাই নেই, রেকর্ড করে রাখা বয়ান যেকোনো সময় প্রকাশ্যে আসতে পারে!
এবার আপনি হয়ত জানতে চাইবেন আমি কে? তার উত্তরে জানাই, আমি একজন নগন্য মানুষ, যে সেই বিগত বহু বছর ধরে আপনার মঙ্গল চেয়েই এসেছে সব সময়। আজও সেই চেষ্টাই করছি! একটি নাম গোত্রহীন মেয়েকে সান্যাল বাড়ির মেয়ের পরিচয়ে অর্ধেক সম্পত্তির মালিকানা দিয়ে শ্বশুরবাড়ি পাঠানোর মতো ভুল কাজ আপনি করতে যাচ্ছেন দেখে আর নির্লিপ্ত থাকতে পারলাম না! হাজার হোক আপনার নুন খেয়েছি তো, তাই চুপ করে থাকতে না পেরে সবটাই জানালাম, এবার আপনি কি করবেন সেটা আপনার ইচ্ছা!
অনেক কিছু লিখে ফেললাম, ভুল ত্রুটি মার্জনা করবেন! আশা করি আমাকে খুঁজে বার করতে সময় নষ্ট না করে প্রয়োজনীয় বিষয়ে দ্রুত ব্যবস্থা নেবেন।
ইতি
আপনার একজন প্রকৃত শুভাকাঙ্ক্ষী।
চিঠিটা হাত থেকে নিচে পড়ে গেলো, প্রতাপ সান্যাল বাম বুকে হাত চেপে কাঁপতে কাঁপতে চেয়ারে বসে পড়লেন, গলা দিয়ে ভাঙা আওয়াজ বেরোলো,
সরযূ!
সরযূ দোতলার বারান্দায় ছিলেন, ঘর থেকে আসা অস্বাভাবিক আওয়াজে দৌড়ে এসে ঘরের পর্দা সরিয়ে স্বামী কে ওই অবস্থায় বসে থাকতে দেখে চমকে গেলেন, তাঁর গলা দিয়েও একটা ভয়ের আওয়াজ বেরোলো। সরলা নিচে রান্নাঘরে বামুন ঠাকুরের সঙ্গে ছিলো, অদ্বিতীয়া নিজের ঘরে, পর পর দুটো বিভৎস আওয়াজ তাদের সবাইকেই প্রতাপ সান্যালের ঘর মুখী করলো।
তারা যখন দৌড়ে সান্যাল মশাইয়ের ঘরের সামনে পৌঁছালো ততোক্ষনে পাশের ঘরে থাকা রতন সেখানে পৌঁছে গেছে। রতন বুদ্ধিমান, ওই অবস্থায় পিসেমশাই কে বসে থাকতে দেখে আর পিসিকে কোনো কারণ জিজ্ঞেস না করেই সে পরপর দুটো ফোন করলো, প্রথমটা সান্যাল বাড়ির নিয়মিত চিকিৎসককে, দ্বিতীয়টা সুকান্ত কে। চিঠি ওখানেই পড়ে থাকলো, সে চিঠি কার, কোথা থেকে এসেছে, সেসব জানার সময় তখন কারোরই ছিলো না, তার থেকেও বড়ো ব্যাপার হলো যে ওই চিঠিই যে সান্যাল মশাইয়ের অসুস্থতার মূল কারণ তা উপস্থিত সকলের অজানাই থেকে গেলো, সান্যাল মশাই বলার মতো অবস্থায় ছিলেন না, অন্যরা চিঠি পড়ে দেখার মতো অবস্থায় ছিলো না।
চিকিৎসক কিছুক্ষনের মধ্যেই উপস্থিত হলেন, পেছন পেছন সুকান্তও। রতিকান্ত নিজের ঘরে বসে সব শুনলেও বাবাকে দেখতে আসার কোনো প্রয়োজন বোধ করলো না। চিকিৎসক সান্যাল মশাইকে দেখে চিন্তিত হলেন,
স্যার! কোনো কারণে খুব উত্তেজিত হয়ে গিয়েছিলেন নাকি! প্রেসার তো খুব বেশি!
সরযূ খাটের বাজু তে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন, বিরক্ত মুখে ডাক্তারের দিকে তাকালেন,
হবে না! প্রেসার তো বেশি থাকারই কথা! উত্তেজনা তো সব সময়, একে মারছে তো ওকে বাড়ি থেকে বার করে দিচ্ছে! সেই বিয়ে ঠিক হওয়া থেকে তো বাড়িতে তাণ্ডব করছে! আমাদের ধনেপ্রানে মারার চেষ্টা করছে সে!
সরলা বিরক্ত হয়ে শাশুড়ি কে হাত দেখালো,
আহ! মা! চুপ করুন! আপনার কি কখনো কান্ডজ্ঞান হবে না! বাবার এইরকম শরীরের অবস্থা আপনি তার মধ্যেই চিৎকার চেঁচামেচি করছেন!
সরযূ চুপ করে গেলেন, সুকান্ত ডাক্তারের সামনে এগিয়ে এলেন,
হাসপাতালে ভর্তি করবো নাকি? কি করা উচিৎ?
চিকিৎসক মাথা নাড়লেন,
নাহ! প্রেসার টা একটু বেশি, রেস্ট নিতে হবে একটু, আর কোনো রকম উত্তেজনা নয়! ঘরেই থাকুন, আমি দুবেলা এসে দেখে যাবো!
বামুন ঠাকুর কে সঙ্গে নিয়ে চিকিৎসক ব্যাগ হাতে বেরিয়ে যাওয়ার পরে সুকান্ত বাবার মাথার কাছে এসে দাঁড়ালেন, নিজের মনের মধ্যে তাঁর একটু হলেও বিবেক দংশন হচ্ছিলো। তিনি নিজেকেই বাবার উত্তেজনার কারণ হিসাবে চিহ্নিত করেছিলেন, তাঁর ধারণা ছিলো তাঁর জেদের জন্যেই বাবা অসুস্থ হয়েছেন। তিনি বাবার মাথার কাছে দাঁড়িয়ে বাবার উদ্দেশ্যে নরম গলায় বললেন,
বাবা! আমরা সবাই তোমাকে ভালোবাসি! তুমি মিছিমিছি জেদ করছো! এই বয়সে এতো জেদ ভালো নয়! দেখো তো কিরকম অসুস্থ হয়ে পড়লে! আমি তোমাকে রিকোয়েস্ট করছি, আর জেদ দেখিয়ে নিজের, সেই সঙ্গে পিয়ার ক্ষতি করোনা! তুমি তো রথীন দার কাছে শুনেছ আমি ওর রেজিস্ট্রির নোটিশ দিয়ে দিয়েছি, তোমার হাজার চেষ্টাতেও আমি সেটা ক্যান্সেল করবো না! মিছিমিছি নিজের শরীর খারাপ না করে এই বিয়েটা ক্যান্সেল করে দাও! চলো এই বাড়ি থেকেই পিয়ার বিয়েটা দিই সবাই মিলে, তুমি নিজে দাঁড়িয়ে কন্যাদান করো!
প্রতাপ সান্যালের উত্তরের জন্যে অপেক্ষা না করেই সুকান্ত পাংশু মুখে দরজার গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ভাইঝিকে ডাকলেন,
পিয়া এদিকে আয়! দাদুর কাছে বোস একটু!
অদ্বিতীয়া পায়ে পায়ে এগিয়ে এসে দাদুর পায়ের কাছে দাঁড়ালো, তাকে দেখেই সান্যাল মশাই এর মুখ রক্তাভ হলো নতুন করে। তিনি শুয়ে থাকা অবস্থা থেকে সোজা হয়ে উঠে বসলেন, দরজার দিকে আঙুল দেখিয়ে চিৎকার করে বললেন,
বেরিয়ে যাও! এই মুহূর্তে বেরিয়ে যাও আমার বাড়ি থেকে! আমি আর কোনোদিনও তোমার মুখ দর্শন করতে চাইনা!
অদ্বিতীয়া থতমত খেলো, দাদুর কথাতে তার চোখ জলে ভরে এলো তৎক্ষণাৎ! তাকে জলভরা চোখে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সুকান্ত বিরক্ত মুখে তার পাশে এসে দাঁড়ালেন, ভাইঝি কে জড়িয়ে ধরে বললেন,
এতো জেদ তোমার! ওইটুকু একটা মেয়ে, তার জীবনটাও নষ্ট করে দিতে চাইছো! অনেক বোঝালাম তোমাকে তবুও তুমি বুঝলে না! কি আর করা যাবে! শুধু একটাই আফসোস থেকে গেলো, একমাত্র নাতনির বিয়ে তুমি নিজের হাতে দিতে পারলে না!
কার নাতনি! কিসের নাতনি! ও আমার বংশের কেউ নয়! ওর সঙ্গে আমার কোনো রক্তের সম্পর্ক নেই!
মানে! তোমার কথায় একজন সায় দিচ্ছেনা বলে সে তোমার রক্ত, বংশের কেউ নয় বলে দিলে! নিজের নাতনিকে অস্বীকার করছো! সত্যি তুমি পারও বটে!
সজোরে চিৎকার করে ওঠা প্রতাপ সান্যাল কে হাত দেখিয়ে থামিয়ে দিয়ে বললেন সুকান্ত, সান্যাল মশাই থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে চেয়ারের সামনে মেঝেতে পড়ে থাকা চিঠির দিকে ইশারা করলেন,
পড়ো ওটা! দেখো কি লেখা আছে! কোথায় তোমার দাদা, ডাকো তাকে! বলো, আজ যদি সে না আসে আমার ঘরে তাহলে যেনো এই মুহূর্তে আমার বাড়ি ছেড়ে সে বেরিয়ে যায়! আমার সন্তানের প্রতি দুর্বলতার অনেক বড় বড় সুযোগ সে নিয়েছে, আর আমি কাউকে কোনো সুযোগ দেবো না!
সান্যাল মশাইয়ের আঙুলের দিকে লক্ষ্য করে, এতক্ষনে লাল সিমেন্টের মেঝেতে পড়ে থাকা নীল রঙের ইনল্যান্ড এর দিকে সকলের দৃষ্টি ঘুরলো। সুকান্ত এগিয়ে যাওয়ার আগেই রতন এগিয়ে গেলো, চিঠি হাতে তুলে খুলে ধরেই তার মুখের যে পরিবর্তন হলো, তা অন্যদের নজর এড়ালো না। সরলা স্তম্ভিত হয়ে শ্বশুর মশাইয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো, সরযূ এবং সরলা দুজনের পক্ষেই সে চিঠির বিষয়বস্তু পড়া সম্ভব ছিলো না, তাই সরযূ আর ধৈর্য্য রাখতে না পেরে চিৎকার করে উঠলেন,
কি বলছে তোর পিসেমশাই রতন! ওই মেয়ে আমাদের বংশের কেউ নয়! কি লেখা আছে ওতে? বল আমাকে তাড়াতাড়ি!
রতন পিসির কথার কোনো উত্তর দিলো না, চিঠি হাতেই ছুটে বেরিয়ে রতিকান্তের ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে হাঁফাতে হাঁফাতে বললো,
রতি! কি করেছিস তুই! এ কার মেয়েকে, কোন ভাগাড় থেকে নিজের মেয়ে বলে তুলে নিয়ে এসেছিলি? পিসেমশাই সব জেনে গেছেন! শিগগির ওঘরে চল, নাহলে আজ তোকে বাড়ি ছাড়া হতে হবে! পিসেমশাই তোকে বেরিয়ে যেতে বলছেন!
বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে হবে এই হুমকিতে রতিকান্ত সোজা হয়ে বিছানায় উঠে বসলো, এই হুমকি অগ্রাহ্য করার সাহস তার ছিলো না। সে কয়েক মুহূর্ত স্থির দৃষ্টিতে রতনের মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে চোয়াল শক্ত করলো,
আমার এতো বড়ো উপকারটা কে করলো শুনি! ওই সরলা মাগী নিশ্চয়ই!
ক্রমশ
#সেই মেয়েটার উপাখ্যান
#পর্ব ৫১
বাবার হুমকিতে রতিকান্ত পায়ে পায়ে এগিয়ে এসে বাবার ঘরে ঢুকলো, ঠিক কতো বছর পরে যে সে এ ঘরে পা দিলো তা বলা মুশকিল। তাকে ঘরে ঢুকতে দেখে সবাই অবাক হয়ে তাকালো, কি এমন লেখা আছে ওই চিঠিতে যে রতিকান্ত এঘরে আসতে বাধ্য হলো সেটাই সবার কাছে কৌতূহলের বিষয় ছিলো। তাকে ঢুকতে দেখেই সান্যাল মশাই রাগে থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে বললেন,
কুলাঙ্গার ছেলে! সারাজীবন আমাকে জ্বালিয়ে গিয়েছ তুমি! কি এমন অপরাধ করেছি আমি যে তুমি আমাকে এতো বড় শাস্তি দিলে? আমার অপরাধ তো একটাই, আমি পুত্র স্নেহে অন্ধ ছিলাম! তার পরিণতিতে তুমি এই রকম ভাবে আমাকে সবার সামনে ছোটো করে ফেললে আজ! আমার মান সম্মান, বংশ মর্যাদা সব কিছুকে তুমি ধুলোয় মিশিয়ে দিলে? একবারও ভাবলে না যে এর পরে আমি আর কোনোদিনও মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবো না! বলো আমাকে এসব কথা ঠিক কিনা!
রতিকান্ত ঘৃণার দৃষ্টিতে সরলার মুখের দিকে তাকালো,
এতগুলো বছর ধরে যা বলেছিস সব করেছি! বাইরে যাওয়া ছেড়েছি, বন্ধুবান্ধবদের বাড়িতে আসাও বন্ধ করেছিস, তাও মেনে নিয়েছি! সব সময় মুখ খোলার ভয় দেখিয়ে শাসিয়েছিস, তোর কথা মতো চলতে গিয়ে জীবন থেকে সব আনন্দ চলে গিয়েছে! শুধু একটা অনুরোধ করেছিলাম সেটুকুও ধরে রাখতে পারলি না শেষ পর্যন্ত! এতো কিছুর পরেও মুখটা বন্ধ রাখতে পারলি না শালি! হটাৎ করেই তোর শ্বশুরের সামনে সাধু সাজার ইচ্ছে হলো?
প্রতাপ সান্যাল চিৎকার করে উঠলেন,
খবরদার! আর একটাও বাজে কথা নয়! আমার বাড়িতে দাঁড়িয়ে তুমি বৌমাকে ওই রকম নোংরা ভাষায় কথা বলার সাহস কি করে পেলে? সে তোমার কুকীর্তি ফাঁস করেনি, সেতো এতো বছর ধরে সেসব ধামাচাপা দিয়েই রেখেছে দেখছি! তারও বিচার আমি করবো আজ! তোমার কুকীর্তি ফাঁস করেছে ওই চিঠি! পড়ে দেখো! রতনের হাতেই আছে!
রতিকান্ত চমকে তাকালো, রতনের হাত থেকে চিঠিটা কেড়ে নিলো, পড়তে পড়তে তার মুখের ভাবের পরিবর্তন হচ্ছিলো। চিঠিটা শেষ করে সে কয়েক মিনিট চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকলো, তারপরে বললো,
শালা, বিয়েটা হবার আগেই জানাজানি হলো এটা! প্রতাপ সান্যাল নিজে হাতে হাভাতে ঘরের মেয়েকে নিজের বংশের ভেবে কন্যাদান করলে যে আনন্দ টা পাওয়া যেতো সেটা আর হলো না তাহলে!
প্রতাপ সান্যাল গর্জে উঠলেন,
চুপ করো! আবার বড়ো বড়ো কথা বলছো!
রতিকান্ত কাঁধ ঝাঁকিয়ে বেপরোয়া ভঙ্গিতে বললো,
যা করেছি, বেশ করেছি! এসব প্রশ্নের উত্তর আমাকে না জিজ্ঞেস করে নিজেকে করো! তুমি তো জানতেই সে বিয়ের আগেই পোয়াতি ছিলো, তবু তার কথায় তুমি সেই বাচ্চা রাখতে গেলে কেনো? এখন সাধু সাজার চেষ্টা করছো? আসলে তুমি তো তখন ঐ বাচ্চার বদলেই তাকে বাড়ি থেকে টাকা দিয়ে তাড়াতে চেয়েছিলে! আমাকে তো জিজ্ঞেস করনি কখনো, বাচ্চাটা আমার কিনা বা আমি ওকে তাড়িয়ে দিতে চাই কিনা! সেও তো কম লোভী ছিলো না! দুজনে পরামর্শ করেই তো সে টাকা নিয়ে বাচ্চা রেখে পালিয়েছিল! না তুমি, না সে, দুজনের কেউই তো আমাকে কিছু জানাও নি, আমি আগ বাড়িয়ে তোমাকে কিছু বলতে যাবো কেনো! আমি নিশ্চিত, সেই এখন এসব লিখে জানিয়ে তোমাকে ব্ল্যাকমেল করে আরও কিছু টাকা নেওয়ার ধান্দা করছে! যখন তাকে টাকা দিয়ে বিদায় করেছিলে তখন ভাবো নি যে সে বেঁচে থাকলে তোমার এসব বিপদ আসতে পারে? অতো কাঁচা কাজ তুমি কি করে করলে প্রতাপ সান্যাল?
সরযূ চিৎকার করে উঠলেন আচমকা,
তুই কি করেছিস! কোন অজাত কুজাতের ঘরের বাচ্চা কে সান্যাল বাড়িতে তুলে এনেছিস! হে ভগবান! এ তুমি কি দিন দেখালে আমাকে! আমি প্রথম থেকেই বলেছি, এ কোনো ভদ্র বাড়ির মেয়ে নয়, কেউ আমার কথা বিশ্বাস করেনি তখন! কি তার রক্তের গ্রুপ! ছি ছি!! আমি তাই ভাবি, সান্যাল বাড়িতে মেয়ে হলো কি করে! আজ পর্যন্ত তো কখনো সান্যাল বাড়িতে মেয়ে জন্মায়নি! এসব কোনো বনেদী বাড়িতে হয়! ওই জন্যেই তো ওই রকম ভিখিরি বাড়ির ছেলেকে বেছে নিয়েছে সে! যেমন ঘরের মেয়ে তেমনই তো তার পছন্দ হবে!
সবাই স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়েছিলো, রতিকান্তের কথা শুনতে শুনতে আচমকাই অদ্বিতীয়া অজ্ঞান হয়ে কাকার গায়ে হেলে পড়লো। ভাইঝি কে পড়ে যেতে দেখে সুকান্ত তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলেন, এতক্ষন পরে সম্বিত ফিরে পেয়ে চিৎকার করে উঠলেন,
থামো তুমি! আর একটাও বাজে কথা বলবে না! তোমার ওই অসভ্য ছেলেকে বাঁচাতে আবার তুমি এই নিরীহ মেয়েটার নামে দোষ দিচ্ছ! সে নাহয় অজাত, কুজাতের মেয়ে, তোমার ছেলে তো বিরাট বংশের ছেলে! সে নাকি বনেদী সান্যাল দের বাড়িতে জন্ম নিয়েছে! সে কি করেছে? সব জেনেশুনে একটা শিশু কে মৃত্যু মুখে ঠেলে দিয়েছিলো সে, সে কি জানতো না যে তার বাবা ওই বাচ্চাকে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করবে! আসলে বাচ্চাটার বাঁচা মরায় তার কিছুই যায় আসেনি কখনো, তাই রতন দার কাছ থেকে সব কিছু শুনেও সে নির্বিকার ছিলো, একবারের জন্যেও তার মনে কোনো লজ্জার উদয় হয়নি। কে বলে বংশ, বনেদিয়ানা এসব মানুষের চরিত্র গঠন করে? যদি করতো তাহলে আমার সামনেই এতগুলো খুনি, মাতাল, চরিত্রহীন দাঁড়িয়ে থাকতো না!
প্রতাপ সান্যাল তখনও রাগে কাঁপছিলেন, সুকান্ত বাবার দিকে ঘুরলেন,
আমি কিন্তু ভীষণ খুশি হলাম আজ! পিয়ার মত মিষ্টি, শান্ত, বুদ্ধিমতি একটা মেয়েকে রতিকান্ত সান্যালের মতো মাতাল, ছোটলোকের মেয়ে বলে পরিচয় দিতে আমার লজ্জা লাগতো! সে বরং তোমার ছেলের মতো কুলাঙ্গার ছেলের সন্তান হওয়া থেকে মুক্তি পেলো। এবার তুমি কি করবে সেটা বলো? নিশ্চয়ই আর তুমি পিয়ার বিয়ে নিয়ে কিছু ভাববে না? এখন তোমার কাছে তিনটে উপায় আছে! এক তুমি সরাসরি সত্যি কথাটাই রথীন দা কে জানিয়ে দাও, নাহলে কোনো অজুহাত দেখিয়ে বিয়েটা বন্ধ করে দাও! অথবা তুমি যদি সম্পূর্ন ঘটনাটাই লুকিয়ে যেতে চাও তোমার বংশ মর্যাদা, সম্মানের কথা ভেবে তাহলে সবাই কে বলো তোমার নাতনি নিজের পছন্দে বিয়ে করতে চাইছে বলে তুমি তাকে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে বলেছো!
প্রতাপ সান্যাল চোখ বন্ধ করে কপালে হাত রেখে বিছানায় শুয়ে পড়লেন, ঠিক কোন পদ্ধতিটা তাঁর জন্যে সম্মানজনক সেটাই তিনি বুঝে উঠতে পারছিলেন না! সুকান্ত সরলার দিকে ঘুরলেন,
বৌদি! পিয়া কে ওর ঘরে নিয়ে যান! আমি আসছি!
সরলা অদ্বিতীয়া কে সঙ্গে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো, সরযূ বিকৃত মুখে খাটের বাজু ধরে দাঁড়িয়ে রইলেন, তাঁর ঘৃনা যে ছেলের প্রতিও সেটা তাঁর রতিকান্তের দিকে পেছন ফিরে দাঁড়িয়ে থাকা থেকেই বুঝতে পারা যাচ্ছিলো। রতিকান্ত মায়ের দিকে কিছুক্ষন চুপ করে তাকিয়ে থেকে যখন পেছন ফিরে ঘর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিলো তখন সরযূ চিৎকার করে উঠলেন,
কেনো এমন করলি তুই? বল! সারাজীবন তুই বাবাকে ছোটো করতে চেয়েছিস, আমি তাও তোর পাশে থেকেছি। কতোবার তোকে আড়ালে জিজ্ঞেস করেছি, তোকে ওই বউ কি দিয়ে বশ করে রেখেছে? তুই আমাকে বিশ্বাস করেও বলতে পারিস নি কখনো? সত্যি কথা বললে কি আমি ছাড়া কেউ জানতো? দিতাম ওকে ঘাড় ধরে বার করে বাপের বাড়ি পাঠিয়ে!
রতিকান্ত ঘুরে তাকালো, মায়ের দিকে জ্বলন্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
তুমি তো আমার থেকেও বড়ো ধান্দাবাজ, শুধু নিজের স্বার্থের কথা ভাবো! কোনো একটা অজুহাতে বউ কে তাড়াতে পারলে তোমার সংসার তোমারই থাকে তাই না? একটা কথা জেনে রেখো, ওই বউ ছিলো বলে যেভাবেই হোক না কেনো আমাকে কিছুটা হলেও ভদ্র হতে বাধ্য করেছিলো নাহলে তো আমি মাতাল হয়ে রাস্তায় পড়ে থাকতাম!
সরযূ তেড়ে উঠলেন,
বড্ড পিরীত তোর! এতদিন ধরে তোকে ধমকে চমকে ভয় দেখিয়ে রেখেছে তবু তারই সাফাই গাইছিস!
রতিকান্ত মাথা নাড়লো,
কিসের ধমকে চমকে? ও যদি বলেও দিত তাহলেও কি তুমি ওকে বাপের বাড়ি ফেরত পাঠাতে নাকি? তুমি এরকম বিনি পয়সায় ঝি কোথায় পেতে? তাইতো বাঁজা জেনেও রতনের বউয়ের মতো ফেরত পাঠাও নি তখন! বুঝতে তো পারোনি যে সে সূঁচ হয়ে ঢুকে ফাল হয়ে বেরোবে এমন! একটা কথা জেনে রেখো, সে নিজেকে বাঁচানোর জন্যে মুখ বন্ধ রাখেনি, বন্ধ রেখেছে ওই মেয়েকে বাঁচানোর জন্যে! সে মুখ খুললে যে ওই মেয়ে মরবেই এটা তার জানা ছিলো, মায়া তাকে তোমাদের সব কুকীর্তি বলে গিয়েছিলো!
সরযূ স্বামীর দিকে ঘুরে তাকালেন,
শোনো তোমার ছেলের কথা! আরে নিজের দোষ ঢাকতে না হয় একটা ভুল করেই ফেলেছিস, মেয়েটাকে নাহয় নিজের মেয়ে বলে বাড়িতে এনেই তুলেছিস, তা বাপ, মা কে আড়ালে একটু বলবি তো! সাপও মরতো আর লাঠিও ভাঙতো না! মেয়ে জন্মানোর পরে মরলে তো আর তোকে কেউ এসব দোষ দিতো না! যা হতো বউয়ের ঘাড়েই দিতিস নাহয়! মেয়েটাও মরতো এই বউটাও থাকতো, কেউ কিছু জানতেই পারতো না!
প্রতাপ সান্যাল গিন্নী কে থামিয়ে চিৎকার করে উঠলেন,
চুপ! একদম চুপ! একটা কাজ ঠিকমতো করতে পারে না, তার আবার বড়ো বড়ো কথা! মায়া কে মারতে অতো সময় লাগে? তোমার মারার আগেই তো সে সব উগরে দিয়েছে! আর এমন লোককে দিয়ে কাজ করালে, যাকে ঠেকাতে এখনো আমাকে লড়াই করে যেতে হচ্ছে! তোমার ঐ অকালকুস্মন্ড ভাইপো, কাজ তো করে উঠতে পারলোই না উল্টে ওই আশা কে দিয়ে আমাকে ফাঁদে ফেলতে চাইছিলো। সারাজীবন শুধু এক কথা, বউ নাকি ছেলে কে বশ করে রেখেছে! বারবার বলেছি বশ বলে কিছু হয়না, খোঁজ নাও আসল কারণের, তা পেরেছো কিছু জানতে? শুধু অন্যের দোষ দেখে বেড়ানো! নিজে কি করছিলে এতদিন? তোমার ঐ অপদার্থ বড়ো ছেলে কেনো তার বাঁজা বউয়ের কথাতে ওঠে বসে, সেটা জানতে এতো সময় লাগে! আজও তো পারতে না যদি না ওই চিঠি আমার হাতে এসে পড়তো!
সরযূ চুপ করে গেলেন, তাদের কথোপকথনের মধ্যেই সুকান্ত বিরক্ত হয়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে ভাইঝির ঘরে উপস্থিত হলেন। তাঁকে দেখেই খাটে শুয়ে থাকা অদ্বিতীয়া চোখ ভরা জল নিয়ে উঠে দাঁড়ালো, কাকার দিকে তাকিয়ে বললো,
ছোট কা! আজ থেকে তোমাকে এই নামে ডাকার অধিকারও হারিয়েছি, বলো তোমাকে আর ছোটো মা কে কি বলে ডাকবো?
সুকান্ত স্মিত হাসলেন, খাটের এক পাশে বসে পড়ে ভাইঝির মাথায় হাত রেখে বললেন,
মন খারাপ? কিন্তু আমার একটুও খারাপ লাগছে না! জানি না এটা কে করলো, কেনোই বা করলো, কি তার উদ্দেশ্য, হয়ত ক্রমশ সেটা প্রকাশ পাবে! তবে একটা কথা জানবি যা হয়েছে তোর ভালোই হয়েছে, তুই ওই শুভর সঙ্গে বিয়ে হওয়া থেকে বেঁচে গেলি! তুই সান্যাল বাড়ির কেউ নোস এটা জানার পরে তোর সম্বন্ধে আর বাবার কোনো উৎসাহ থাকবে না! আর একটা কথা, যেটা তোকে বলতে চেয়েও বলিনি আগের বার, সুমনও কিন্তু কোনো বিপদ হওয়ার আশঙ্কা থেকে বেঁচে গেলো, নাহলে তোর বিয়ে হয়ে গেলেও ওর বিপদের আশঙ্কা কিন্তু একটুও কমতো না!
অদ্বিতীয়া মলিন হাসলো,
বিশ্বাস করো সান্যাল বাড়ির মেয়ে নই বলে আমার কোনো দুঃখ হচ্ছে না! বাবা বলে যাকে ডাকতাম সেতো এমনিতেও আমার বাবা ছিলো না কখনো! বন্ধুদের কাছে তাদের বাবাদের গল্প শুনে ভাবতাম, আমার বাবাই কেনো এরকম! আর ঠাম্মা তো কখনই আমার ঠাম্মা হয়ে ওঠেনি! তবে দাদুভাই কে আমি ভালবাসতাম, ওনার কড়া শাসনের মধ্যেও স্নেহই দেখতে পেতাম, মনে হতো, হয়ত বনেদী বাড়ির ঐতিহ্য, সম্মান রক্ষা করতে গিয়েই তাঁকে কড়া হতে হয়েছে! আমার শুধু দুঃখ হচ্ছে তোমার আর ছোটো মার জন্যে, তোমরা আমার কেউ নও, এটা ভাবলেই বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠছে!
সরলা অদ্বিতীয়ার মাথায় হাত রাখলো,
মা তো মাই থাকে সব সময়, কোনো কিছুই মা আর সন্তানের সম্পর্ককে আলাদা করতে পারে না! আজ যদি তোমার মা ফিরেও আসেন তবুও আমি তোমার ছোটো মাই থেকে যাবো!
অদ্বিতীয়া সরলার হাতটা জড়িয়ে ধরলো,
যে মা তার সন্তানকে টাকার লোভে বিক্রি করে দেয়, সে কখনো মা হয়না ছোটো মা! সেই মার ফিরে আসা না আসা সমান! তার পরিচয় জানতে আমি একটুও আগ্রহী নই! তুমি যদি অনুমতি দাও তাহলে আজ থেকে তুমি আমার ছোটো মা নও শুধু মা!
সরলার চোখে জল নিয়ে অদ্বিতীয়া কে জড়িয়ে ধরলো, সুকান্ত হেসে সামনে এগিয়ে এলেন,
বাবা! তোরা তো আমার কথা ভুলেই গেলি দেখছি! একটু আগেই যে জানতে চাইছিলি তুই আমাকে কি বলে ডাকবি?
অদ্বিতীয়া কাকার দিকে তাকালো,
বলো কি বলে ডাকবো তোমাকে?
এটাও আবার তোকে বলে দিতে হবে? বাবা বলে ডাকবি! এতো কষ্ট করে বাবা হওয়ার একটা সুযোগ এলো, সেটুকুও দিতে চাসনা নাকি? আমি তোকে এতকাল মেয়ের মতো দেখেছি এবার সেটাকে কাগজে কলমে করতে চাই! আজ থেকে তুই রতিকান্ত নয় সুকান্ত সান্যালের মেয়ে!
ক্রমশ