সেই মেয়েটা চন্দ্রাবতী পর্ব-০৭

0
7

সেই মেয়েটা চন্দ্রাবতী
পর্ব ৭

চোখ খুলতে না খুলতেই আবার বন্ধ করে ফেলে মাহতাব। আলো চোখে লাগতেই মাথায় একটা ধাক্কা লেগেছে যেন। কয়টা বাজে কে জানে। মোবাইল বন্ধ হয়ে ছিল। এ বাসার চার্জারগুলো তার ফোনে সাপোর্ট করেনি। বাইরে বের হলে কাপড়, চার্জার সহ টুকটাক অনেককিছু কেনাকাটা করতে হবে। আজ সম্ভবত জয়েন করতে পারবে না। মাহতাব এখানে এসেছে উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক পদে যোগদানের জন্য। কখনো ভাবেনি শহর ছেড়ে এতদূর আসবে চাকরি করতে। চাকরি করা তো মাহতাবের পরিকল্পনাতেও ছিল না। তবু গত দেড় বছর ধরে ও চাকরির পড়া পড়েছে। কাকে প্রমাণ করার জন্য জানে না। হয়তো নিজেকে প্রমাণের জন্য। আইইএলটিস টোফেল দিয়েছে। দেশের বাইরে চলে যাবে ভেবেছে। যাওয়ার দরকার ছিল পরিচিত শহর ছেড়ে দূরে কোথাও। কিন্তু সেখানেও প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। বিদেশে যেতে যে টাকাটা প্রয়োজন, তা তো তাকে পরিবার থেকেই নিতে হবে। দাদাজান দিতেন। তাও তো ঘুরেফিরে একই কথা। বিদেশে চলে যাওয়ার পরিকল্পনা মাহতাবের এখনো আছে। স্কলারশিপ পেলেও বিমান ভাড়াসহ অনেকগুলো টাকার বিষয় আছে। চাকরি করা ছাড়া হাতে কিছু টাকা জমানো সম্ভব নয়। টিউশনি করানোর অভিজ্ঞতা নেই। ধৈর্যও না। ভীষণ ছটফটে চঞ্চল মাহতাবের জন্য দেড় বছর চাকরির পরীক্ষা দেওয়ার প্রস্তুতি নেওয়াই সহজ ছিল না। অনেকবার ধৈর্য চ্যুতি হয়েছে। ছোটোখাটো কর্পোরেট কোম্পানিতে ঢুকে যাবে ভেবেছে। তবু ঐ যে প্রতিযোগিতামূলক জায়গায় টিকে দেখানোর একটা অদ্ভুত চ্যালেঞ্জ নিয়েছে।

কড়া নাড়ার শব্দে ঘুম পুরোপুরি কেটে যায় মাহতাবের।

“কে?”

“আমি। রহমত সরকার।”

“মাহাতাব উঠে বসে।”

“রহমত সরকার মানে তার দাদার বন্ধু। গতকাল দেখা হয়নি। সম্ভবত তিনি ঘুমিয়ে পড়েছিলেন।”

নিজেকে একটু ধাতস্ত করে দরজা খুলে দেয় মাহতাব।

“আসসালামু আলাইকুম।”

“ওয়ালাইকুম সালাম। আমি তো কাল ভাবতেছিলাম ওয়াহিদ তোমার জন্য এত চিন্তা করতেছে কী জন্য। এত বড় ছেলে তুমি। হারাবা কোথায়। সকালে উঠে ঘটনা শুনে বুঝলাম ওয়াহিদ তার নাতিকে নিয়ে চিন্তা করার তো কারণ আছে। ট্রেন থেকে সব হারাও কিভাবে? কই ছিলা?”

মাহতাব ইতস্তত করে। পায়জামাটা লম্বায় বড়ো।অস্বস্তি লাগছে। খুঁচে দিতে ইচ্ছে করছে।

“কার পায়জামা পরছ? আমার নাকি?”

“জি। আপনারই মনে হয়।”

“লুঙ্গি পড়তে পারো না?”

মাহাতাব মনে মনে বলে কী শালা! আবার লুঙ্গির আলোচনা শুরু হবে নাকি! এই ফ্যামিলির কি লুঙ্গি নিয়ে কোন সমস্যা আছে? কিন্তু মুখে বলে,

“জি না। আপনাকে কি বলবো? দাদাই বলি? আমার দাদার বন্ধু আপনি। আমার আসলে লুঙ্গি পরার অভ্যাস নেই।”

“হুম। টিকতে পারবা তো? মনে তো হইতেছে বয়লার মুরগির মতো বড় হইছ। এইটা কিন্তু মফস্বল শহর।”

“জি পারবো। আর আপনারা তো আছেনই।”

” দরজায় দাড়িয়ে বিস্তারিত কথা হবে না। বাইরে আসো। রোদে বসে কথা বলি। আর শোনো বিছানা গুছিয়ে রাখবা। নিজের কাজকর্ম নিজে করতে হবে। গোসলের সময় আমার পায়জামা ভালো করে ধুয়ে দিবা।”

“আমি?”

“তো কে?”

“না মানে, বুয়া আসে না?”

“বুয়া তোমার কাপড় ধুইবে কেন? এখানে এমন কোনো বুয়া নাই। ঘর সংসারের কাজ করার জন্য আমেনার মা আসে। সে গৃহস্থালি কাজকর্ম করে। নিজের কাজ নিজে করবা।”

রহমত সরকার গিয়ে রোদে বসেন। জুয়েনা আমেনার মাকে দিয়ে চা নাস্তা পাঠিয়ে দিয়েছে। সকালের নাস্তা শ্বশুর শাশুড়ি রোদে বসে করেন। নাস্তার আয়োজন এ বাড়িতে বারোমাস একই থাকে। চিকন করে আলু কুঁচি করে ভাজি, আর রুটি। রুটি না খেলে ভাত, আলু ভাজি আর ডাল। মৃদুলা খাবার নিজে ঘ্যানঘ্যান করে মাঝেমাঝে ডিম ভাজি করায়, খিচুড়ি রান্না করায়। তবে দাদির চোখ এড়িয়ে। দাদির জীবনে আনন্দ নামক কিছু নেই, অন্য কারও আনন্দও ওনার ভালো লাগে না। খাবার নিয়ে আদিখ্যেতাও তাই ওনার বিরক্ত লাগে।
মাহতাব হাত মুখ ধুয়ে রহমত সরকারের সামনে আসে। নাহার বেগম আর রহমত সরকার দুটো চেয়ারে বসে আছেন। টি-টেবিলে খাবার রাখা। অপর পাশে একটা মোড়া দেওয়া।

“বস।”

মাহতাব বোঝে ওকে মোড়ায় বসতে বলেছে।

“কী ছ্যাড়া, তুমি মোড়াত বইতে পারো না? কোমরে বেদনা?”

নাহার বেগম প্রশ্ন করেন। মাহতাব মাথা নেড়ে না বোধক বুঝিয়ে মোড়ায় বসে।

“আদব কায়দা কিছু শিখছ? না আমার নাতনিগো মতো নাচ গান করা শিক্ষিত হইছ খালি?”

“জি?”

“মুরুব্বি দেখলে সালাম দেওন লাগে।”

“জি দিয়েছি তো।”

“কখন দিলা? শুনলাম না তো।”

মাহতাব রহমত সরকারের দিকে তাকায়। নাহার বেগম তা দেখে বলেন

“মুরুব্বি কি খালি পুরুষ মানুষ?”

“জি না। তা না। স্যরি। আসসালামু আলাইকুম দাদিমা।”

রহমত সরকার নাস্তা শুরু করেন।

“আমার স্ত্রীর মুখের ভাষা একটু কর্কশ গায়ে নিও না। তোমার জয়েন কবে?”

“হ। আমারই সব কর্কশ, তিতা।”

রহমত সরকার স্ত্রীর কথায় গা করেন না।

“৫ তারিখের ভেতর করতে হবে। আজ কিছু কেনাকাটা করে গুছিয়ে কাল জয়েন করব।”

“প্রথম চাকরি?”

“জি।”

***

মাহতাবের উঠতে দেরি হয়ে গিয়েছে। ফিরোজ সরকারের ক্লাস ছিল। তিনি বেরিয়ে গিয়েছেন। মৃদুলাও ক্লাসে চলে গিয়েছে। মাহতাবকে ধরে রহমত সাহেব দীর্ঘ সময় গল্প করলেন। একে তো মোটা আটার রুটি, চাবাতে চাবাতে মাহতাবের গাল ব্যথা। তারউপর রহমত সাহেবের দীর্ঘ কর্মজীবনের গল্প শোনা।
গালের সাথে মাহতাবের কানও শেষ। বোঝাই যাচ্ছে রহমত সরকার কর্মজীবনের গল্প করার জন্য অনেকদিন কাউকে পাননি। নতুন মানুষের কাছে পঞ্চাশ বছরের গল্প করার মতো দীর্ঘ রশদ ওনার আছে। স্বামীর গল্প শুরু হলে নাহার বেগম উঠে চলে গিয়েছেন। জুয়েনা নামক এক ভদ্রমহিলা এসেছিলেন। মাহতাব জানতে পেরেছেন তিনি চন্দ্র আর মৃদুলার মা। মহিলা রাশভারি। তেমন কথা বলতে আগ্রহী নন। শেষমেষ টিএনটিতে একটা ফোন আসায় রহমত সরকার ওঠেন, আর মাহতাবও রক্ষা পায়।
এখানে বাজারঘাট কিছুই চেনে না মাহতাব। পোশাকের যে হাল, হালে বাইরে বের হতে ইচ্ছে করছে না। ফোন বন্ধ এখনো। মাহতাবের মা যে বলেছিল, এক সপ্তাহ টিকে গেলে মেনে যাবেন। তখন মাহতাবের কিছুই মনে হয়নি। মনে হয়েছিল এক সপ্তাহ কেন, একমাস করে দেখাবে। বিদেশ যাওয়ার আগে পর্যন্ত করবে। অথচ এখনই মনে হচ্ছে ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি। নিজের পরিবারকেই সবচেয়ে জটিল মনে হতো মাহতাবের। এখন মনে হচ্ছে সব পরিবারেই নানা জটিলতা আছে। যেমন আপাতঃ স্বাভাবিক এই পরিবারও নানা অস্বাভাবিকতায় যেন মোড়া।

চন্দ্রকে মনে মনে খুব মিস করে মাহতাব। অল্প সময়ে মনে হয়েছে এই পরিবারের সবার সাথেই মিশে যাওয়া সহজ হবে যদি চন্দ্র সামনে থাকে। চন্দ্রের ভেতর কিছু একটা সহজ বিষয় আছে।আপন করে গ্রহণ করার সহজাত ক্ষমতা। ভাবতে ভাবতে ছাদের কিনারে এসে নিচে তাকিয়ে একটা জায়গা দেখে চোখ জুড়িয়ে যায়। পুকুরের এককোনায় দোলনা বসানো। এমন ভাবে যে দোলনায় পা দুলালে পানির ছোঁয়া পাওয়া যাবে। গাছের গায়ে একটা বাক্স বসানো, যাতে বই রয়েছে। আরও কাছ থেকে দেখতে পায়ে পায়ে নিচে নেমে আসে মাহতাব। দোলনা, বই সবকিছুর ভেতর একটা মেয়ালি যত্নের বিষয় আছে। মাহতাবের গল্প কবিতা পড়ার আগ্রহ নেই। তবু বাক্স খুলে বইগুলো দেখে। বেলা ভালোই হয়েছে। সূর্য এখন মাথার উপর। যদিও গাছের ছায়ায় এখানে সূর্যের আলো প্রবেশ করছে না। বরং পুকুরের ঠান্ডা বাতাসে ঠান্ডা লাগছে। চাদর আরও ভালো করে জড়িয়ে নেয় মাহতাব। পুকুরের অপরদিকে চোখ পড়তেই নজরে আসে পুকুরের ঘাট ধরে চন্দ্র হেঁটে আসছে। গত রাতের একদম বিপরীত সাজে। গলাবন্ধ সোয়েটারের সাথে সুতি শাড়ি পরেছে। মনে হচ্ছে বাইরে থেকে এসেছে। লম্বা চুল বেণী করা। চোখে ঘন করে কাজল। সিদে সাধা সাজ। হাতে প্যাকেট নিয়ে সিঁড়ি ঘরের দিকে যাচ্ছে। উপরে উঠবে?
ওকেই কি খুঁজতে উপরে উঠছে?

(চলবে)