সেই মেয়েটা চন্দ্রাবতী পর্ব-০৮

0
6

সেই মেয়েটা চন্দ্রাবতী
পর্ব ৮

চন্দ্রা ‘বাংলাবাজার সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়’ এর শিক্ষিকা। গত বছর যোগদান করেছে। যদিও ফিরোজ সাহেবের ইচ্ছে মেয়ে কলেজে শিক্ষাকতা করুক। নিবন্ধন পরীক্ষা দিয়েছে চন্দ্রা, পাশও করেছে। ভালো কলেজে চাকরি না হওয়া পর্যন্ত এখানেই চাকরি করবে ভেবে জয়েন করা। কিন্তু জয়েন করার পর চন্দ্রার কাছে কাজটা শিক্ষকতা বলতে যা বোঝায় অর্থাৎ পাঠদান করা, তারচেয়েও বেশি অন্য ভাবে চ্যালেঞ্জিং লাগে। এখানে অধিকাংশ ছাত্রী নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের। যাদের ভেতর শিক্ষার আলো প্রবেশ করলেও তা পুরোপুরি নয়। এখনো তারা ছেলে ও মেয়ের শিক্ষায় পার্থক্য করে। বেশিরভাগ মেয়েই বিয়ের জন্য পড়ছে। মানে ক্লাস নাইন, টেন পর্যন্ত পড়তে পড়তে বিয়ে হয়ে যায়। এরপর স্কুল ছেড়ে দেয়। স্কুলের গন্ডি পেরিয়ে কলেজে পৌঁছানো হয় না অনেকেরই। কেউ কেউ তো বোর্ডের পরীক্ষার আগেই ঝরে পড়ে। চন্দ্রা চেষ্টা করেছিল পড়ালেখায় ভালো এমন কিছু মেয়ের বাবা-মাকে পড়ালেখায় আগ্রহী করতে। কিন্তু তাদের কাছে এর গুরুত্ব বোঝানোটা এত সহজ নয়। তারা ছেলেদের পড়ানোর বিষয়ে আগ্রহী হলেও মেয়েদের নিয়ে নয়। তাদের জন্য মেয়েকে উচ্চশিক্ষিত করার পথ সহজও নয়। মফস্বলের সবজায়গার পরিবেশ ভালো নয়। চারদিকে ইভটিজিং, হাতে হাতে মোবাইল, কী পরিমাণ কিশোর প*র্ণগ্রাফিতে আসক্ত তা চন্দ্রা ওদের কাছাকাছি না আসলে হয়তো জানতেও পারতো না। সমবয়সী কিশোর ছাত্ররাই ছাত্রীদের উত্যক্ত করে। অহরহ প্রেমের সম্পর্কে জড়ানোর ঘটনাও কম নয়। শুধু পড়ালেখার দিকে মনোযোগ, এমন ছেলেমেয়ে অনেক কম। নতুন করে যুক্ত হয়েছে টিকটক সহ নানা অনলাইন প্ল্যাটফর্ম। যা এদের শূন্য থেকে তারকা বানিয়ে দেওয়ার স্বপ্ন দেখায়। তাই এখানে এদের পড়ালেখার দিকে মনোযোগ ধরে রাখা খুব মুশকিল।

চন্দ্রা চেষ্টা করে ক্লাসের পড়ালেখা আনন্দদায়ক করতে। পড়ালেখার বিষয়ে আগ্রহী করতে। কিন্তু পরিবেশ বৈরী হলে কিছুই সহজ হয় না। সব শিক্ষক একই মানসিকতা রাখেন না। কারও কারও কাছে এটা নিছকই চাকুরী। যেখানে ছয়ঘন্টা কোনোরকমে পার করতে পারলেই হয়। কেউ কেউ আছেন যারা সত্যি শিক্ষার আলো জ্বালাতে চান। তাদের মতো মানুষদের জন্য এখনো কিছু ছেলেমেয়ে এই পরিবেশ থেকে উঠে আসে। স্কুল থেকে চন্দ্রা আজ আগেই বের হয়েছে। বাসায় ফোন দিয়ে জানতে পেরেছে ফিরোজ সাহেব বের হয়ে গিয়েছেন। আগন্তুক মাহতাব বাড়িতেই আছে। মাহতাব কেন বাইরে কেনাকাটা করতে যেতে পারেনি বুঝতে পেরেছে চন্দ্র। আসার পথে টুকটাক কেনাকাটা করে এনেছে। অপরিচিত কারও জন্য অযথা খরচের টাকা চন্দ্রের নেই। মানবিকতার খাতিরে একটা ট্রাউজার, টিশার্ট আর গামছা এনেছে। তোয়ালের দাম বেশি।

“আমি এখানে।”

চন্দ্র ছাদের ইতি-উতি খুঁজে দেখছে দেখে পেছন থেকে বলে মাহতাব। চন্দ্র চমকে গিয়ে পেছনে তাকায়।

শীতের রোদ মধ্যদুপুরেও গায়ে লাগে না। আরাম আরাম উষ্ণতা ছড়ায়। মধ্যাহ্নে সূর্য মাথার উপর নিয়েও তাই মাহতাব চাদর গায়ে দাঁড়িয়ে আছে। রাতে ভালো করে খেয়াল না করলেও এখন চন্দ্রের মনে হয়, সামনে দাঁড়ানো ছেলেটা নিঃসন্দেহে সুপুরুষ। চাদর গায়ে জড়িয়ে, আপাত অদ্ভুত মিসফিটিং পোশাকেও যাকে চোখে লাগে, সে নিঃসন্দেহে সুপুরুষ। দ্রুত নিজেকে সামলে নিয়ে চন্দ্র বলে,

“ট্রাউজার আর টিশার্ট আছে। ঠিকঠাক পোশাক নাই দেখে বোধহয় বাইরে যাওয়া হচ্ছে না। কিন্তু বাইরে গিয়ে কেনাকাটা না করে আসলে তো হবে না।, চোখের আন্দাজে কিনলাম। চলবে কিনা দেখেন”

“আমাকে তুমি করে বলেন।”

“বয়সে আমার ছোটো জানি। কিন্তু এত বড়ো ছেলে মানুষকে তুমি করে বলতেও কেমন জানি লাগে।”

“আরে এক দেড় বছরের ছোটো বড়োকে গোণায় কে ধরে? আমার বেশকিছু ক্লাসমেট ছিল যারা ইয়ার ড্রপ করে আমার সাথে পড়েছে। ঢাকায় তো এখন সমবয়সীদের ভেতর আপনি উঠেই গিয়েছে। তুমি করে বলে ছোটোরাই।”

“আচ্ছা। এখানে এমন না।”

“ফর গড সেক, আপনি করে বলার কোনো দরকার নাই। আমিও আপু করে বলব না। বুঝতে পারছি অস্বস্তি কই। এমন আইবুড়ো ছেলে আপু করে ডাকলে বিরক্ত লাগারই কথা।”

“আইবুড়ো কথাটা যায় না। ধামড়া ছেলে বলা যায়। বাংলা দুর্বল তোমার। তবে ঠিক। এমনিতেই আমি নিজে আইবুড়োর লেবেল নিয়ে আছি। এর ভেতর আর আপু টাপু ডাক শুনে নিজেকে আরও বয়স্ক ভাবতে ইচ্ছে করে না।”

“আপনাকে বয়স্ক বলে কে!”

“বাদ দাও। ট্রাউজার, টিশার্ট দেখ। আমি গেলাম।”

***

মাহতাব জীবনে কোনোদিন গামছা ব্যবহার করেনি। ওর ধারণা ছিল গামছা জিনিসটা বাসাবাড়ি থেকে বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে। শ্রমজীবী মানুষরা রুমালের বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করেন ঠিক। কিন্তু এ বাড়িতে দেখছে লুঙ্গি, গামছা সব বহাল তবিয়তেই আছে। রহমত সরকার গায়ে তেল মেখে রোদে গামছা গায়ে দিয়ে বসে আছেন। বাড়ির কাজকর্ম করা ধনু এই ঠান্ডাতেও গামছা কোমরে লুঙ্গির বিকল্প হিসেবে বেঁধে রেখেছে। ফিরোজ সরকারও গামছা ব্যবহার করে এবিষয়ে মাহতাব নিশ্চিত। যাক জীবনে সব অভিজ্ঞতার দরকার আছে। গামছা দিয়ে গা মুছে মাহতাবের মনে হয়, জিনিসটা খারাপ না। নরম আরামদায়ক। কতরকম নরম তোয়ালের বিজ্ঞাপন মুখবই জুড়ে, নিজেরও আছে। তোয়ালের মতো না হলেও গামছা জিনিসটা খরাপ না, পানিও মুছে ভালো। ঠান্ডা পানি দিয়ে গোসল সেরে শীতে কাঁপতে কাঁপতে রোদে দাঁড়িয়ে এসব এলোমেলো ভাবনাই মাহতাব ভাবে।

ছাদটা গণ। মানে মাহতাব ছাদে শুধু থাকবে। কিন্তু ব্যবহার করবে বাড়ির লোকেরাই। সারাদিনই এটা সেটা ছাদে এনে রোদে ফেলা হচ্ছে, ঝাড়া হচ্ছে। বালিশ, কম্বল, লেপ। আচারের বয়াম। চালের গুঁড়ো। কাপড় তো আছেই। ছাদের বহুবিধ ব্যবহার দেখে মাহতাব অবাক হয়। ঢাকা শহরে ছাদে পারতপক্ষে ফ্ল্যাট বাসীরা নাকি যাওয়ারই সুযোগ পায় না। বন্ধ রাখে বাসার মালিক। কিছু বাসায় যারা ছাদে থাকে তারা ব্যক্তিগত সম্পদ ভেবে বন্ধ রাখে।

এই ছাদে কিছু ফুলের গাছও আছে। মৃদুলা নামের মেয়েটা একবার এসে পরিচিত হয়ে গিয়েছে। এই মেয়েটা চন্দ্রের বিপরীত মনে হলো মাহতাবের। চন্দ্র ধীরস্থির। মৃদুলা নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত। অল্প সময়ে নিজের বিষয়ে অনেককিছু জানালো। চন্দ্রের সাথে বেশ কথা হলেও চন্দ্রের বিষয়ে তেমন কিছুই জানতে পারেনি। এই যে চন্দ্র স্কুলে চাকুরি করে এটাও মৃদুলা জানালো।

***

দুপুরের খাবারও সাধারণ। টমেটো দিয়ে স্যুপের মতো করা হয়েছে। এটা নাকি খাট্টা। তেলাপিয়া মাছ ভাজা আর ফুলকপি ভাজি। মাহতাবের অবাক লাগে, এসব খাবার যিনি রান্না করেন, তার হাতের জাদু নাকি নতুন জায়গার প্রভাবে, যেমন খিদে পাচ্ছে তেমন খেতেও পারছে। খাওয়া নিচে সবার সাথে খেতে ডাকেনি। ধনু দিয়ে গিয়েছিল। বলেছে খাওয়া শেষে প্লেট বাটির ট্রে নিচে দিয়ে আসতে। ফিরোজ সরকার কলেজ থেকে ফিরে দেখা করে গিয়েছিলেন। বললেন বিকালে ওনার কিছু কাজ আছে তিনি মার্কেটে যেতে পারবেন না। মাহতাব কে ঠিকানা বুঝিয়ে দিলেন। বললেন মসজিদ মার্কেট বলে রিক্সা ঠিক করলে রিক্সাই নিয়ে যাবে। সেখানেই চলার মত কাপড়চোপড় পেয়ে যাবে। বাকিটা আস্তে ধীরে কিনে নিতে।
মাহতাব প্লেট বাটি নিয়ে নিচে এসে দেখে রান্নাঘরে মৃদুল দাঁড়িয়ে গল্প করছে আর জুয়েনা রান্নাঘর গুছিয়ে রাখছেন।

“তুমি এখানে যে?”

“প্লেট বাটি রাখতে আসলাম।”

মৃদলা এগিয়ে ট্রে নিতে গেলে জুয়েনা চোখের ইশারায় না করেন। মৃদুলা বের হয়ে যায়। জুয়েনা নিজেই উঠে গিয়ে নেন।

“শোনো ছেলে, এটা গৃহস্থ বাড়ি বলে বলছি না। এমনিতেই কারও ঘরে অনুমতি ছাড়া ঢোকা ঠিক না, সেখানে তুমি রান্নাঘর পর্যন্ত চলে আসলা কিভাবে? মহিলা মানুষ আছে, মেয়েছেলে আছে।”

মাহতাব বিব্রত হয়। এতক্ষণ খেয়াল করেনি। এখন বুঝেছে। হুট করে রান্না ঘরে চলে আসা জুয়েনার পছন্দ হয়নি।

“আমি বলছিলাম আম্মু। ট্রে কই রাখবে জিজ্ঞেস করছিল।”

চন্দ্র পেছন থেকে উত্তর দেয়।

“কেন তোর হাতে কি সমস্যা। তুই নিয়ে নিলেই তো হতো।”

“মাটি হাতে। মাটির হাতে ধরলে তুমিই রাগ করতা।”

চন্দ্র নিচে গাছের মাটি তৈরি করছিল। মাহতাবকে বাসার ভেতর ঢুকতে দেখেই না করবে ভাবছিল। মা যে এটা পছন্দ করবে না জানা কথা। ঠিকই আছে ঘরে অনেক সময় ওড়না গায়ে থাকে না। হুটহাট একটা বাইরের ছেলে ঘরে চলে আসা ভালো কথা না।

“আন্টি আমি স্যরি। বুঝতে পারিনি। টেবিলে রেখে যাওয়া দরকার ছিল।”

“ঠিক আছে যাও। কিছু মনে করো না। বাসাবাড়ির কিছু নিয়মকানুন থাকে। শোনো তোমাকে সবাই আমাদের দূরসম্পর্কের আত্মীয়ের ছেলে জানে। ভাড়া দাও, বা তোমাকে ভাড়াটিয়া রাখা হয়েছে এসব এখানে বলার দরকার নাই। কমবয়সী ছেলে তুমি, আব্বা না বললে এসব বিষয়ে আমি কোনোদিন রাজি হতাম না। খাওয়া শেষে প্লেটবাটি বাইরের ঘরে রেখে ডাক দিয়ে যাবা। না হলে আবার বিড়াল মুখ দিবে বাটিতে। ঐটায় আর খাওয়া যাবে না।”

“জি।”

মাহতাব বের হয়ে গেলে চন্দ্রও যেতে উদ্যত হয়।

“তুই দাঁড়া। জানিস তো ঘরে মৃদুলার মতো কমবয়সী মেয়ে আছে। ওড়না পরা নাও থাকতে পারে। আক্কেল নাই। তোর কথা তো বাদই দিলাম।”

“আমার কথা কেন বাদ দিলে? আমাকে দেখতে ভালো লাগে না? শোনো আম্মু যার নজর খারাপ, সে সবারদিকে খারাপ নজরে দেখে। কমবয়স, বেশিবয়স লাগে না। এর নজর খারাপ না। আর মৃদুলাকেও বলো গায়ে পড়ার অভ্যাস কম রাখতে।।সে নিজেই গিয়ে বন্ধুত্ব করতে উস্তাদ। বিপদ নিজেই ডেকে আনতে পারবে, কাউকে লাগবে না।”

“তুই খুব মানুষ চিনিস তাই না?”

“একটু তো চিনি।”

“কম চিন। বেশি চেনার কারণেই এত সমস্যা।”

***

চন্দ্র বাইরে এসে দেখে মাহতাব বাগানেই দাঁড়িয়ে আছে।

“থ্যাংক ইউ। আন্টিতো যে রেগে ছিলেন। ভয়ই পেলাম।”

“মাকে দেখতে রাগী মনে হয়। আসলে এতটা রাগী না। মানে সবার সাথে না। আমার সাথে সামান্য।”

“কেন?”

“প্রিয় মানুষের সাথে সব রাগ রাগ হয় না। কিছু অভিমানও। বাদ দিন। মার্কেটে যাচ্ছ না কেন?”

“আপনারাও যাবেন?”

“ভয় পাও?”

“না ভয় পাওয়ার কী।”

চন্দ্র কী ভেবে বলে,

“আচ্ছা, মৃদুলাকেও বলি। ফুচকা খেতে চাইলো কদিন। এক বাহানায় হয়ে যাবে। দাঁড়াও রেডি হয়ে আসি।”

(চলবে)