সেই মেয়েটা চন্দ্রাবতী পর্ব-০৯

0
8

সেই মেয়েটা চন্দ্রাবতী
পর্ব ৯

“মৃদু, ফুচকা খেতে যাবি? মসজিদ মার্কেটে যাই চল।”

“মৃদুলা ডাকো।”

“স্যরি, মৃদুলা, যাবি?”

“আমাকে ফুচকা খাওয়াতে চাইতেছ?”

“হুম।”

মৃদুলা চুপচাপ ভাবে। তারপর বিছানায় আধশোয়া থেকে উঠে দাঁড়ায়।

“যেতে পারি। কিন্তু মা আর দাদি যেতে দিবে? কেন জানি মা এখন বেশি কেয়ার করে। বেশি বেশি ভালোবাসা দেখায় আমাকে। তোমার অংশেরটাও যেন আমাকে দিতেছে।”

“বেশ তো। তুই তো একসময় বলতি মা আমাকে বেশি ভালোবাসা দেখায়। এখন ব্যালেন্স হয়ে যাচ্ছে।”

“তা কই? বাবাতো এখনো তোমাকে বেশি ভালোবাসে।”

“সেটাও তোর বেশি চাই।”

“চাই তো। তুমি ব্যালেন্সের কথা বললা? তোমার সবটা নিলেও যা হারাইছি তার সমান হবে না।”

“মৃদু!”

“মৃদু না, মৃদুলা। যাও মাকে বলো। রেডি হইতেছি আমি।”

***

চন্দ্র একটা হলুদ তাঁতের সালোয়ার কামিজ পরেছে। মৃদুলা সাদা। দু’জনই মাথায় ওড়না জড়িয়ে বের হয়েছে। মফস্বল এলাকায় অনেকেই মোটামুটি মুখ চেনা। সেজেগুজে খোলাচুলে মেয়ে বের হয়েছে, এটা মুরুব্বিদের চোখে পড়া মানে অযথা সমালোচনার মুখে পড়া। দাদীর চোখ এড়িয়ে বের হবে ভেবেছিল চন্দ্র, কিন্তু নাহার বেগম বসার ঘরেই ছিলেন।

“কই যাস তোরা?”

“মার্কেটে দাদি। একটু কেনাকাটা আছে।”

“এই বেলায় কিয়ের মার্কেট?”

“বিকালেই তো যায় মার্কেটে।”

“তোর কথা বাদ দে। তোরে কই না। তুই আর মাইয়া আছস? বেডা হওয়া বাকি রাখছস। বেডা মানুষের মতো চাকরি করছ, বাজারে বাজারে ড্যাং ড্যাং করস। ছোটটারেও তাল দিস না। একে তো নাচুনি বুড়ি, তারউপর ঢোলের বাড়ি। এমনেই মানুষ কয়, সরকার বাড়ির এক মাইয়া হইছে নর্তকী আরেকটা…”

“নর্তকী? কে মৃদুলা? নাচ গান শিখলেই নর্তকী হয়? আপনি এইভাবে কথা বলে কী সুখ পান? আর আমি কী? থামলেন কোন, বলে দেন।”

“খারাপ কী কইছি? নিজের তো বিয়াশাদী আর হইব না। ছোটোটারও না হোক চাস? যতই রঙচঙ মাইখা বাইর হও, তোমার গায়ে যে সিল পড়ছে। মাইনষের শখ হয় নাই বৌ বানাইতে। ঢঙ। আবার পরছস হইলদা জামা।”

“হলুদ জামায় কী সমস্যা?”

“হইলদা হইলো সাদা মানুষের রঙ। বইনরে পরাইছস বুড়া মানুষের মতো সাদা। নিজে পরছস হলুদ। লাভ নাই। বান্দরের গলায় মুক্তার মালা দিলেও বান্দরই থাকে।”

জুয়েনা বসার ঘরে এসে মৃদুলাকে বলেন,

“মৃদুলা, আমার সাথে কাল যাস মা। আমার বাজারে কাজ আছে।”

চন্দ্র ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে বের হয়ে যায় পেছন থেকে দাদীর কণ্ঠ শুনতে পায়,

জুয়েনাকে বলছেন,

“মেয়েরে যদি পার করতে চাও তাইলে লাগাম দাও।”

জুয়েনার উত্তরও কানে আসে,

“ঘোড়া নাকি যে লাগাম দেব? কথা শোনার হলে বহু আগেই শুনতো। যে কথা শোনার সে একবারেই শুনে। যে শুনবে না, তাকে কিছু করার নাই।”

“করার নাই বললেই হইলো? সরকার বাড়ির নাম আছে না।”

“বাড়ির নাম বদনাম হলে আর কী করবেন। মেরে কেটে ভাসিয়ে দেন। আমার কিছু বলার নেই।”

চন্দ্র দাঁতে ঠোঁট চেপে কান্না গিলে নেয়। দাদির রাগ, অভিমানটা সে কিছুটা হলেও বোঝে। কিন্তু মা কেন এমন করে। এক সময় দাদির বিষয়টাও বুঝতো না। বিচিত্র লাগতো। দাদির মন জুড়ে এত কেন ঘৃণার আবাস ভেবে মাঝে মাঝে চন্দ্র ভীষণ অবাক হতো। কিন্তু সময়ের সাথে চন্দ্র অনেক কিছুই বুঝতে পেরেছে। মাঝে মাঝে চন্দ্রের মনে হয় একটু কম বুঝলেই ভালো হতো।
কত মানুষ নিজেকে নিয়ে আফসোস করে যে সে কম বোঝে। নিজেকে নিয়ে রংতামাশা করে নিজেই টিউবলাইট ডাকে। চন্দ্রের মনে হয় এমন একটা টিউবলাইট হলেই ভালো হতো। জীবনে কম বোঝাটাও একটা আশীর্বাদ। সবকিছু বেশি বুঝে ফেললে নিজের জন্যই সমস্যা।

***

মাহতব গেটের বাইরে অস্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আধা ঘন্টা হয়ে গেল। চন্দ্র বলেছিল মাহাতাব রেডি হয়ে গেটের বাইরে থাকতে। একসাথে তারা বাড়ি থেকে বের হবে না। এমন ভাব করতে হবে যে গেটের বাইরে মাহতাবের সাথে দেখা হয়ে গিয়েছে। তারপর একই জায়গায় যাবে বলে তারা দুটো আলাদা রিক্সা করে রওনা দেবে। মাহাতাব মেনে নিয়েছে সহজে। দাদা আগেই বলেছিল মফস্বলের বিষয়টা মাথায় রাখতে। এখানে বাড়ির মেয়েদের সাথে হুট করে গায়ে পড়ে খুব বেশি কথা বলতে না। সামাজিকভাবে এগুলো ভালো চোখে দেখা হবে না। চন্দ্রের কথা তাই সহজেই বোঝে মাহতাব।

অবশেষে গেট খোলার শব্দ শুনতে পায়। চন্দ্র বের হয়ে আসছে বোধহয়। মৃদুলা সাথে নেই। যাবে না বোধহয়। তাহলে কি তারা দুজন একই রিক্সায় উঠবে? নাকি চন্দ্রও আর যাবে না? কিন্তু চন্দ্র পোশাক পাল্টে এসেছে। শীতের সরষে ফুলের মত উজ্জ্বল হলুদ রং এর সালোয়ার কামিজ। অদ্ভুত সুন্দর লাগছে। বড় বড় দুটো চোখ চন্দ্রের। গায়ের রংটা চাপা। কিন্তু এই রঙই ওকে যেন আরও মায়াবী বানিয়েছে। চন্দ্রের মিষ্টি সৌন্দর্যের জন্য যেন এই রংটাই যথাযথ। যা তার বড়ো বড়ো চোখ গুলোকে আরো সৌন্দর্য মন্ডিত করেছে। হাসিকে করেছে আরও বেশি নিখুঁত। কাজল টানা দুচোখে একরাশ মায়া আর পিঠ ছাপানো কালো চুল যেন কবিতার মত ছন্দময়। এক দেখায় চোখে লাগার মতো।

সুন্দর অনেক মেয়ের সাথে মিশেছে মাহতাব। তার ফ্রেন্ড সার্কেল নিতান্ত মন্দ নয়। অবশ্য যদি তাদেরকে ফ্রেন্ড বলা যায়। জীবনে একটা পর্যায়ে এসে মাহতাব বুঝতে পেরেছে একসাথে গল্প, আড্ডা দিয়ে ছবি তুললেই বন্ধু হয় না। একসাথে দিনের পর দিন লম্বা সময় কাটালেও সঙ্গী হওয়া যায় না। একসাথে জীবন কাটাবে বলে ওয়াদা করা মানুষেরাও অনেক সময় প্রেমিক হয়ে ওঠে না।
কিছু প্রেম ভালোবাসা রেস্তোরাঁর হলদে লাইটের নিচে গরম স্যুপ ঠান্ডা হতে হতে, আর গরম কফিতে চুমুক দিতে দিতেই শেষ হয়ে যায়। তা আর একটি নীড়ের একই ছাদের নিচে এসে শেষ হয় না।

***

চন্দ্র কাছাকাছি আসলে মাহতাবের কাছে মনে হয় চন্দ্রের চোখ দুটো ভেজা ভেজা। কাঁদছিল নাকি? বকা খায়নি তো? বাপরে এত বড়ো মেয়ে বাইরে যেতে চাইলে বকা খাবে নাকি!
নাকি মাহতাবের সাথে যাচ্ছে তা বুঝতে পেরে বকা দিয়েছে। মাহতাবের এখন বিব্রত লাগছে।

“কোনো সমস্যা?”

“না তো। কেন?”

“না মানে আপনার চোখগুলো ভেজা লাগছে। আমি কি কোন ঝামেলায় ফেলে দিলাম?”

“আপনি, মানে তুমি আমাকে কোনো ঝামেলায় ফেলে দাওনি। আমার জীবনটা এমনিতেই অনেক ঝামেলাময়। যাই হোক আমি আমি একটা রিকশা নিয়ে আগে আগে যাব। পেছনে আরেকটা রিকশা নিয়ে তুমি আসবে। মার্কেটের সামনে নেমে কথা হবে। এখন আর কথা না বাড়াই।”

“চন্দ্র দীঘির পাড়ে গিয়ে একটা রিকশায় ওঠে। তার পেছনে আরেকটা রিক্সায় মাহাতাব উঠে বসে। ছাদের উপর থেকে দাঁড়িয়ে পুরোটাই দেখে মৃদুলা। হুট করে ফুচকা খেতে যাওয়ার কথা শুনে তার ধারণা হয়েছিল কিছু একটা কারণ তো আছে। তাই চন্দ্রের সাথে যেতে সহজে রাজি হয়েছিল। দাদি আর মায়ের সাথে কথা বাড়িয়ে চন্দ্রের সাথে যায়নি। কেননা চন্দ্রের বাঁধন থেকে নিজেকে আস্তে আস্তে আলগা করে নিয়েছে অনেক আগেই। কেউ তা মুখে না বলেও সবাই টের পায়। বিশেষ করে জুয়েনা এখন মৃদুলাকে অনেক বেশি স্নেহের আঁচলে ঢেকে রাখেন। অনেক বেশি যত্ন করেন। কেন জানি এ বিষয়টা মৃদুলার ভালোই লাগে। চন্দ্র মা অন্তপ্রাণ না হলেও মায়ের নিজেকে সরিয়ে নেওয়া চন্দ্রের জন্য অবশ্যই কষ্টকর। যদিও জুয়েনা না নিজেকে সরিয়ে নেওয়ায় হয়তো ফিরোজ সরকার চন্দ্রকে একটু বেশিই আগলে রেখেছেন। যদিও সেটাও মৃদুলার ভালো লাগে না। চন্দ্রের আশেপাশে কোনো মায়ার আঁচল থাকুক তা কেন জানি মৃদুলার আর কাঙ্ক্ষিত না। অথচ বোনের উপর রাগ করার কারণটা হয়তো ছেলেমানুষি কারণ মনে হবে।

রাগ কথাটা হয়তো ঠিক নয়। বিতৃষ্ণাই বলা যায়। তবুও ছেলেমানুষি ঘৃণা থেকে নিজেকে আড়াল করতে পারে না মৃদুলা। তাই দাদি যখন অযথাই চন্দ্রকে কষ্ট দিয়ে কথা বলে একই সাথে মনে দুই রকম অনুভূতি হয় মৃদুলার। মস্তিষ্কের একটা অংশ খুশি হয়ে ভাবে, আঘাত করুক আরো বেশি করে আঘাত করুক চন্দ্রকে। আরেকটা অংশে পুরনো মৃদুলা জেগে উঠে। এসবের শেষ হোক চায়। চন্দ্র কষ্ট পায় জানে মৃদুলা কিন্তু চন্দ্র কি জানে মৃদুলাও ভালো নেই। আর মৃদুলা ভালো না থাকলে সে অন্য কাউকে ভালো থাকতে দিবে না।

(চলবে)