সেলাই মেশিন পর্ব-১৫ এবং শেষ পর্ব

0
390

সেলাই মেশিন
————-
(শেষ পর্ব)
————-
দুইদিন পরে পরিবারের সবাই মৌরিদের বাড়িতে এলো দাদির জিনিসপত্র ভাগ বাটোয়ারা করতে। দাদি যেহেতু সবার বাসায় ঘুরে বেড়াতেন, সবার বাসাতেই তার কিছু না কিছু জিনিস রয়ে গেছে। চাচা ফুফুরা সেগুলো নিয়ে এসেছেন । তবে দুই ফুফুর মুখ আজকেও অন্ধকার। কেউ কারো সাথে সরাসরি কথা বলছেন না, ভাববাচ্যে আলাপ চলছে। শাহেদাও তাদের দেখে তেমন পাত্তা দিলো না। তিনজনের মাঝে মনমালিন্য স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিলো।

বড় ফুফু দাদির ঘর থেকে যাবতীয় জিনিস এনে বসার ঘরে সবার সামনে রাখলো। ঘরটা ভরে গেলো দাদির পরিচিত গন্ধে। দাদির জিনিসপত্র মৌরির কত পরিচিত! মৌরি গোপনে চোখ মুছলো।

তেমন কিছু ছিল না দাদির। কতগুলো শাড়ি, ব্লাউজ, পেটিকোট। শীতলপাটি, পানের বাটা, নকশি কাঁথা, হালকা কিছু গহনা, রুপার চুলের কাঁটা, পায়ের নুপুর। বড় ফুফু আগেই বলে দিলেন মায়ের গহনা তারা দুই বোন নেবে। দাদির জমিজমা বিক্রির টাকা যিহেতু তারা কিছুই পায়নি, গহনা তারা পেতেই পারে। ছোট চাচা বাধ সেধে বললেন, “দুই ছেলের বৌকে হালকা পাতলা কিছু দেন বুবু, তাদের কাছেও কিছু স্মৃতি থাকলো।” শুনে বড় ফুফু কপাল কুঁচকে রাজি হলেন।

ফুফুরা শাড়িগুলো নিলো। শাহেদা আর মৌরির চাচী বললো তারা শাড়ি চায় না। পিতলের কারুকার্য করা সোনালী পানের বাটা শাহেদা নিলো, সাথে রুপার চুলের কাঁটা আর একটা চিকন সোনার আংটি । চাচী পেলো দাদির নাকফুল, রুপার নুপুর আর নকশি কাঁথা। স্বর্ণের চেইন আংটি কানের দুল দুই ফুফু কাড়াকাড়ি করে নিয়ে নিলো।

ছোটফুফু শেষে রাগ ঝেড়ে বলেই ফেললো, “বুবু, বালা জোড়ার খবর কিছু এখনও পাইলাম না। বালা কি আপনার কাছে রাখছেন নাকি? একটু মনে কইরা দেখেন তো।”
বড় ফুফু রেগে গিয়ে বললেন, “কতবার বললাম, ওই বালা আমি নেই নাই। মাথা এত খারাপ হয় নাই যে বালা নিয়ে ভুইলা যাবো। আমরা যখন সবাই মা-রে নিয়ে ব্যস্ত, তখন তো তুই আলমারির মধ্যে কী জানি খুজাখুজি করতেছিলি। মনে কইরা দেখ, বালা তোর নিজের কাছে রাখসোস নাকি।”
“আমি রাখলে কি আপনার কাছে খুঁজতাম? তাইলে বালা দুইটা কই গেলো? বাতাসে মিলায় গেছে?” ছোট ফুফু ঝাঁঝালো কণ্ঠে বললেন।

মৌরি দেখলো পরিস্থিতি খারাপ হয়ে যাচ্ছে। ও বললো, “ফুফু, আপনি একটু শান্ত হন। দাদির জিনিসপত্র খুঁজলে পাওয়া যাইবো।আমি খুইজা দেখতেছি।”
“আর কই খুঁজবি? আমরা সবাই অনেক তো খুঁজলাম। শাহেদা, তুমি দেখছো?” বড় ফুফু জানতে চাইলেন।
শাহেদা মুখ কালো করে বললো, “আমারে কতবার জিজ্ঞেস করলেন? আমি কিছুই জানি না।”

বাবা এবার বললেন, “আহারে, আপনারা একটু মাথা ঠান্ডা করেন তো। গত মাসে বেতন পাইতে দেরি হইছিলো। এইটা আবার মা-রে বলছিলাম। যখন ওনারে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেছিলাম, আমারে বললো এত টাকা খরচ হইতেছে আমার চিকিৎসা করতে, এক কাম কর, আমার বালা দুইটা বিক্রি কইরা চিকিৎসার খরচ চালা। আমি তখন বলছি চুড়ি বিক্রি করতে হইবো ক্যান? সব ব্যবস্থা হইয়া জৈব। আচ্ছা, আমাদের কাউরে কিছু না বইলা আবার চুড়ি বিক্রি কইরা দিলো নাতো?
“মা তো তোর বাসাতেই, এইখান থেইকা কেমনে বিক্রি করবো?” বড় ফুফু বিরক্ত হয়ে বললেন।
“আচ্ছা বুবু, মা যখন মারা গেলো, তুমি তো তার কাছেই ছিল, তার হাতে বালা দেখো নাই?” চাচা জানতে চাইলেন।
“না। বালা ছিল না।”
ছোট ফুফু আবার সন্দেহের চোখে বড় ফুফু আর শাহেদার দিকে তাকালেন। বাবা হাত উঁচিয়ে বললেন, “আপনারা শান্ত হন, চিন্তা কইরেন না। মায়ের সবকিছু মৌরি আবার ভালো কইরা খুঁজবো। মা কই কী রাখে, ও ভালো জানে। বালা পাওয়া গেলে আপনারা দুই বইন দুইটা বালা নিয়েন। এখন এইসব নিয়ে ক্যাচাল কইরেন না। দুইদিন পরে মৌরি চইলা যাইবো। এখন এইখানে যা আছে আপনারা ভাগ কইরা নেন।”

রুনু এতক্ষন চুপ ছিল। এবার তার মুখের বাঁধন খুললো। “আপনারাই তো সব নিলেন। আমার মা তো তেমন কিছুই পাইলো না।”
দুই ফুফু কটমট করে রুনুর দিকে তাকালো। শাহেদা মুখ বাঁকা করে রান্নাঘরে গেলো চায়ের আয়োজন করতে।
“তোর মা যা পাওয়ার পাইছে। তুই কিছু চাস?” ছোট ফুফু বললেন।
“আমি চামু ক্যান? দাদি আমারে আর ঝুনুরে কিছু দেয়ার কথা বলে নাই?”
বড় ফুফু তখন বললেন, “ওহ এখন মনে পড়ছে। মা কিছুদিন আমারে বলছে উনি মারা গেলো রুনু ঝুনুরে যেন তার দুইটা শাড়ি দেই। ওনার বিয়ার পরে কিছু রংচং বেনারসি শাড়ি কেনা হইছিলো, ওগুলা থেইকা দুইজনরে দুইটা দিতে বলছে।”
রুনু ঠোঁট উল্টে বললো, “ওই পুরান শাড়ি দিয়া আমি কি করমু? থাকে, লাগবো না। আপনারাই নেন। আচ্ছা ফুফু, দাদির তো মৌরি ছিল সবচেয়ে প্রিয় , তারে কিছু দিতে বলে নাই? সোনার গয়না?”
“না, গয়নার কথা কিছু বলে নাই। তয় বলছিলো ওনার পুরান সেলাই মেশিন যেন মৌরির দেয়া হয়।”
চমকে উঠলো মৌরি। অযত্নে ঘরের কোন পড়ে আছ্ ওই মেশিন। হল থেকে ফেরার পর এই বাসায় রাখা ছিল ওটা। মৌরি পরে আর তেমন ব্যবহার করার সুযোগ পায়নি, দাদির চোখের দৃষ্টিশক্তি কমে এসেছিলো বলে সেলাইয়ের কাজ পারতেন না। তারপর তো মৌরিও বিয়ে করে বিদেশে চলে গেলো। ওই মেশিন কি এতদিন পরে ভালো আছে?
মুচকি হাসি ফুটলো রুনুর মুখে। তাচ্ছিল্যের স্বরে বললো, “শেষ পর্যন্ত দাদি তার প্রাণের প্রিয় নাতিনরে সেলাই মেশিন দিলো?ওই জং ধরা মেশিন দিয়া আপা কি করবো? ও তো বিদেশে থাকে। ওই ভারী মিশন তো বিদেশেও নিতে পারবো না।”

রুনুর কথা যুক্তি সঙ্গত। মেশিন দিয়ে ও কি করবে? হয়তো এতদিনে অকেজো হয়ে গেছে ওটা। দাদি কী সত্যিই মেশিন ওকে দিতে বলেছেন নাকি ফুফু বানিয়ে বলছে?
শাহেদা ট্রে-তে করে চায়ের কাপ নিয়ে এসে বললো, “হ্যা, আমাকেও একবার বলছিলো, মৌরিকে যেন ওই সেলাই মেশিন দেয়া হয়। ওইটা নাকি মৌরির খুব কাজে লাগবো। মৌরি তো অনেক ভালো সেলাই পারে। ইউনিভার্সিটির হলে নাকি কত মানুষের জামা কাপড় সেলাই কইরা দিছে, চাকরিও করছে ওই সেলাইয়ের বিদ্যা দিয়া। মা বলছিলো, মেশিনটা ওর কাছে থাকলে ও বিদেশেও কত কিছু সেলাই করতে পারবো।”

বাবা অবাক হয়ে বললেন, “মা কী মনে কইরা ওই মেশিন মৌরিকে দিতে বললো বুঝতেছিনা। বিদেশে কি মানুষ কাপড় সেলাই কইরা পরে? সব তো রেডিমেড পাওয়া যায়। কি রে মৌরি, ঠিক বলছি না? নিবি সেলাই মেশিন?”
“না , এত ভারী সেমাইল মেশিন তো বিদেশে নেয়া সম্ভব না।” মৌরি জানালো।
“হুম, তাই তো। থাক, এইখানেই থাকুক। তুই যখন দেশে আসবি, ব্যবহার করিস।” বাবা বললেন।

ভাগ বাটোয়ারা শেষ হলো। সবাই অসন্তুষ্ট মুখে তাদের ভাগের সম্পদ নিয়ে চলে গেলো। এত অল্পতে কি কারো মন ভরে? মৌরি তার ভাগের সেলাই মেশিন নিজের ঘরে নিয়ে এসে ঝেড়ে মুছে পরিষ্কার করলো। কতদিন এই মেশিন ব্যবহার হয়নি! কে জানে চলবে নাকি। মেশিন মুছে পরিষ্কার করে টেবিলের ওপর রাখলো মৌরি।
রাতে খাটে শুয়ে মেশিনটার দিকে তাকিয়ে দেখছিলো মৌরি। দাদি হাতে ধরে সেলাই শিখিয়েছিলেন, কিভাবে কাপড় কাটতে হয়, কিভাবে সেলাই মেশিনে বিভিন্নরকম সেলাইকাজ করা যায়, সেলাইয়ে ভুল হলে কিভাবে শোধরাতে হয় -সব শিখেছিল দাদির কাছ থেকে। এক সময় সেলাইয়ের পাগলা নেশা ধরেছিল ওকে। এক প্রস্থ কাপড় কেটে সেলাই করে সুন্দর একটা পোশাক বানানোর মধ্যে সৃষ্টির আনন্দ কাজ করতো। ওই মেশিনে কত বন্ধুদের কাপড় সেলাই করে দিয়েছে! ইউনিভার্সিটির কোনো অনুষ্ঠানের আগে বান্ধবীদের কাপড় ঠিকঠাক করার লাইন লাগতো ওর রুমের সামনে। কী এক উৎসব তৈরি হতো ওই সেলাই মেশিনকে ঘিরে। মৌরি ঠিক করলো, যে যাই বলুক, ওই পুরানো মেশিনটা ও সাথে করে নিয়ে যাবে।

পরদিন আদনানকে ফোন করে নিজের সিদ্ধান্তের কথা জানালো। আদনান অবাক হয়ে বললো, “ওই সেলাই মেশিন আনলে তো লাগেজে আর কিছুই আনতে পারবে না, লাগেজের ওয়েট লিমিট মেশিনেই চলে যাবে।”
“আমার আর কিছু আনা লাগবে না। দাদির শেষ স্মৃতি আমার সাথে থাকুক। দাদি ওটা আমাকে উপহার দিয়ে গেছেন। আমি দুনিয়ার যেখানেই যাই, মেশিন আমার সাথে থাকবে । ”
“কী পাগলামি করছো মৌরি? ওটা নষ্ট নাকি সেটা আগে দেখো।”
“নষ্ট হলে হোক, নষ্ট মেশিন আমার ঘরে সাজিয়ে রাখবো।”

আদনান আর তর্কে গেলো না। ও বেশ কয়েকটা বই কিনে নিতে বলেছিলো মৌরিকে। বাংলাদেশে ওসব বইয়ের কপি সস্তায় পাওয়া যায়। মেশিন আনতে গিয়ে ওই বইগুলো আনা হবে না বুঝে গেলো। তারপরেও মৌরির আনন্দের জন্য মেশিন আনার ব্যাপারে আর আপত্তি করলো না।
মৌরি শেষপর্যন্ত লাগেজে কাপড় দিয়ে পেঁচিয়ে সেলাই মেশিন তার সাথে স্টকহোমে নিয়ে এলো।
নিজের ভুবনে ফিরে মৌরি ব্যস্ত হয়ে গেলো পড়ালেখা আর সংসার নিয়ে। সেলাই মেশিন সাজিয়ে রাখলো বসার ঘরে টেবিলের ওপর। মেশিনের পাশে অনেকগুলো ফুলদানি আর শোপিস রাখলো। বেশ নান্দনিক হলো দেখতে। ওটা সাজানোই থাকে, মেশিন নিয়ে সেলাই করতে আর বসা হয়না । শেষে আদনানের পাঞ্জাবি ঠিক করতে গিয়ে এক রবিবার সকালে মেশিন বের করতে হলো।

এই কয় বছরে আদনান মুটিয়েছে , আগের পাঞ্জাবি গায়ে ঢুকছে না। বিকেলে বাংলাদেশী কমিউনিটির আয়োজনে বৈশাখী অনুষ্ঠান। আদনান যে পাঞ্জাবি পরবে, মৌরি চেষ্টা করবে সেলাই খুলে সেটা একটু বড় করতে। কিন্তু মেশিন কাজ করবে কিনা, কে জানে।
মেশিন বের করে সেলাই করতে গিয়ে দেখা গেলো সেলাই ছেড়ে ছেড়ে আসছে। অনেকদিন ব্যবহার না করার ফল। মেশিনের ভেতরে ময়লা জমলে এমন হতে পারে, আবার ভেতরে তেল দেয়ার দরকার হলে এমন হয়।
মেশিনের টুকটাক মেরামতের কাজ মৌরি জানে, চাকরি করতে গিয়ে শিখেছিল। আদনানের টুলবক্স বের করে এনে মেশিন খুললো মৌরি। ভেতরের পার্টসগুলো পরিষ্কার করে তেল দিতে হবে।
মেশিন খুলে মৌরি চমকে দেখলো, ভেতরে খবরের কাগজের একটা দলা, চিকন রশি দিয়ে বাঁধা। বের করে ওটা খুলে মৌরির চোখ কপালে উঠে গেলো।

খবরের কাগজে পেঁচিয়ে সেলাই মেশিনের ভেতরে মৌরির জন্য দাদি লুকিয়ে রেখেছেন সোনার সেই দুইটা বালা!
(সমাপ্ত)