সে আমার অপরাজিতা পর্ব-০৯

0
129

#সে_আমার_অপরাজিতা
#পর্ব_৯
#সারা মেহেক

ভার্সিটিতে তুমুল দ্বন্দ্ব প্রতিদ্বন্দ্ব চলছে দু ডিপার্টমেন্টের মাঝে। তাদের এ মা’ রা’ মা’ রি’ কে পুঁজি করে ভার্সিটির রাজনৈতিক দলগুলো সুবিধা তুলছে। গুটিকয়েক ছেলেপুলে দীর্ঘদিনের পুষে রাখা ক্ষোভ মেটাচ্ছে এ ঝামেলাকে কেন্দ্র করে। ইতোমধ্যে বৃত্ত’দের দলের এক ছেলেকে খুব নির্মমভাবে জখম করেছে বিপরীত দলের ছেলেরা। বাদল সকাল থেকে বাড়িতে ছিলো। কিন্তু এ সংবাদ শোনার পর সে সাতপাঁচ না ভেবে গাড়ি নিয়ে ক্যাম্পাসে চলে এলো। জরুরি ভিত্তিতে সেই দলের ছেলেটিকে নিয়ে হাসপাতালে ছুটলো বাদল। বৃত্ত ছিলো অফিসে। ভার্সিটিতে চলমান এ পরিস্থিতির কথা শুনে সে-ও দ্রুত ছুটে এলো নির্ধারিত জায়গায়। ততক্ষণে সে পুলিশকে কল করে দিয়েছে।
সকল ডিপার্টমেন্টের সকল স্যার ম্যামরা যে যার মতো ছুটে পালিয়েছে। কেননা তারা জানে, ছাত্র রাজনীতির সামনে তাদের একটি কথাও চলবে না।
ক্যাম্পাসে পৌঁছানো মাত্রই বিন্দুর কথা মনে পড়লো বৃত্ত’র। চিন্তিত হয়ে উঠলো সে। প্রথমার্ধে সে ভেবেছিলো, হয়তো বিন্দু এখনও বাড়িতে আছে। কিন্তু পরক্ষণেই তার মনে পড়লো এতদিন বিন্দুর বাড়িতে থাকার কথা নয়। কেননা আজ জরুরি একটা লেকচার ক্লাস হওয়ার কথা ছিলো, যেখানে সকল শিক্ষার্থীর উপস্থিতি বাধ্যতামূলক করা হয়েছিলো। সে হিসেবে বিন্দু নিশ্চয়ই ক্যাম্পাসে চলে এসেছে। এ ভেবে বৃত্ত কল দিলো বিন্দুকে। কিন্তু বিন্দুর ফোন বন্ধ পেলো। তার চিন্তা তখন আকাশ ছুঁইছুঁই।
এদিকে বিন্দু বেরিয়ে পড়েছে তার ডিপার্টমেন্ট হতে। দুরুদুরু বুক নিয়ে দৌড়াচ্ছে সে। দূর হতে চিৎকার চেঁচামেচি আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। সে এই ভেবে স্বস্তি পেলো যে আশেপাশে কেউ নেই। কিন্তু আচানক কোথা থেকে যেনো একটি ছেলে দৌড়াতে দৌড়াতে এসে বিন্দুর সামনে পড়লো। ছেলেটির চোখেমুখে আতঙ্ক। নিজের প্রাণ নিয়ে প্রচন্ড ভীত সে। তীব্র আতঙ্কে ছেলেটি খেয়াল করলো না তার সামনেরজন ছেলে না মেয়ে। শুধু কাঁদতে কাঁদতে অনুনয় করে বললো,
” বাঁচান, বাঁচান আমাকে। ফারুক ভাই আমাকে জানে মে’ রে ফেলবে।”

ছেলেটির এরূপ আকুতি মিনতি দেখে বিন্দু ঘাবড়ে গেলো। এ মুহূর্তে তার মাথায় কিছুই এলো না। সে কিভাবে ছেলেটিকে সাহায্য করবে তা ভেবে পেলো না। তবে বুকে সাহস সঞ্চয় করে সামান্য ঝুঁকে দুরুদুরু বুকে জিজ্ঞেস করলো,
” আপনি কি কাউকে মে রে ছে ন?”

মেয়েলি কণ্ঠস্বর শুনে ছেলেটি চকিতে তাকালো। ভয়ার্ত কণ্ঠে বললো,
” না আপু। কাউকে মারিনি আমি। আমাকে হেল্প করুন প্লিজ।”

বিন্দু আর কথা বাড়ালো না। একটা শুকনো ঢোক গিলে ছেলেটির উদ্দেশ্যে হাত বাড়িয়ে বললো,
” আমাকে ধরে উঠে দাঁড়ান ভাইয়া। দ্রুত এ এরিয়া থেকে চলে যেতে হবে। ”

ছেলেটি আর একটি কথাও বললো না। বিন্দুর দিকে হাত বাড়িয়ে উঠতে নিলো। কিন্তু ততক্ষণে ফারুক নামের ছেলেটি লাঠিসোটা নিয়ে হাজির। তার পিছে হাজির আরোও দুটি ছেলে। তাদের প্রত্যেকের চোখেমুখে প্রতিহিংসাপরায়ণতার দেখা মিলছে। যেনো দশটা খু’ ন করতেও তারা কোনোরূপ দ্বিধাবোধ করবে না। ফারুকসহ বাকি দুজনকে দেখে সে ছেলেটির চেহারায় মৃ’ ত্যু ভয়ের দেখা মিললো। বিন্দুর মনে সৃষ্টি হলো আতঙ্ক। তার হৃৎস্পন্দন বেড়ে কয়েকগুণ হলো।
ফারুক সেই ছেলেটি দেখে গর্জন করে বললো,
” ধর শা’ লা’ কে। আজ ওকে মে’ রে’ ই ফেলবো। ”
বলেই সে লাঠি নিয়ে দৌড়াতে লাগলো। সাথে তার সহকারী দুটো ছেলেও দৌড়াতে লাগলো। তাদের দেখে বিন্দুকে ধাক্কা দিয়ে পালালো সেই ছেলেটি। বিন্দু ধাক্কা সামলাতে না পেরে পিঠের দিক করে পড়লো। এতক্ষণে তিনজনে বিন্দুর প্রায় নিকটে চলে এসেছে। বিন্দুর চোখেমুখে এখন তীব্র আতঙ্ক। যেনো এখনই মৃ’ ত্যু’ র মুখে ফেলে দিবে তাকে। প্রচণ্ড ভয়ে তার প্রতিবর্ত ক্রিয়া যেনো বন্ধ হয়ে এলো। চোখমুখ খিঁচে বন্ধ করে ফেললো সে।

ফারুক নামের ছেলেটি ততক্ষণে বিন্দুকে পেরিয়ে চলে গিয়েছে। কিন্তু তার পিছের দুটি ছেলে কি মনে করে বিন্দুর উপর চড়াও হলো। তন্মধ্যের একটি পাগলাটে গোছের ছেলে লাঠি উঁচিয়ে বিন্দুকে আক্রমণ করতে উদ্যত হলো। কিন্তু ততক্ষণে বৃত্ত সেখানে হাজির হলো। তার হাতেও একটি লাঠি ছিলো। সাতপাঁচ না ভেবে শক্ত হাতে লাঠি দিয়ে বাহু বরাবর মা’র লো সে। অকস্মাৎ আক্রমণে ছেলে দুটি হতভম্ব হয়ে পড়লো। এ পর্যায়ে তাদের চোখেমুখেও আতঙ্কের দেখা মিললো যখন তারা বৃত্তকে দেখলো। কেননা ক্যাম্পাসে রাজনৈতিক দলের নেতা হিসেবে বৃত্তকে সকলে ভয় পায়। ছেলে দুটিও তার ব্যতিক্রম নয়।
বৃত্তকে দেখা মাত্র ছেলে দুটি যেনো হাতে প্রাণ নিয়ে পালালো। বৃত্ত তাদের উদ্দেশ্যে বাঘের ন্যায় গর্জন করে বললো,
” তোদের প্রত্যেককে দেখে নিবো আমি। একজনও বাঁচবি না আমার হাত থেকে। ”
ছেলে দুটি প্রাণভয়ে পিছে ফিরেও তাকালো না৷ এদিকে ছেলে দুটি চলে যেতেই বৃত্ত চিন্তিত চাহনিতে আপাদমস্তক একনজর বিন্দুকে দেখে নিলো। জিজ্ঞেস করলো,
” ঠিক আছো তো বিন্দু?”

এমন টান টান উত্তেজনাপূর্ণ মুহূর্তের সম্মুখীন হয়ে বিন্দু না পারছে কাঁদতে না পারছে বৃত্তকে নিজের অন্তঃ অবস্থা বুঝাতে। সে শুধু চোখ বন্ধ করে হৃৎস্পন্দন স্বাভাবিক করার চেষ্টা করলো। অতঃপর লম্বা এক নিঃশ্বাস ছেড়ে বললো,
” হ্যাঁ, ঠিক আছি আমি। ”

” তোমাকে অ্যাটাক করেনি তো ওরা?”

” না ভাইয়া। আপনি আসার আগে এখানে আরেকজন ছিলো। তাকে মা’ র’ তে এসেছিলো কোনো কারণে।”

বৃত্ত স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। তবে খানিকটা শক্ত কণ্ঠে বললো,
” ক্যাম্পাসে এমন মা’ রা’ মা’ রি চলছে, জানার পরও ক্লাসে এসেছো কেনো? বিদ্যাসাগর হতে চাচ্ছো?”

বৃত্ত এমন কথার ধরণ বিন্দুর আত্মসম্মানে গিয়ে লাগলো। সে নিজের পূর্বাবস্থা ভুলে বৃত্তকে কড়া ভাষায় জবাব দিলো,
” শুনুন, নিজের জীবনের চিন্তা সবারই থাকে। কোনো মেয়েই জেনে-বুঝে মৃত্যুকূপে ঝাঁপ দিতে চাইবে না। আমি আজ বাড়ি থেকে সোজা ক্যাম্পাসে এসেছি। মারিয়াও ক্যাম্পাসে নেই যে আমাকে এ বিষয়ে কিছু বলবে।”

বৃত্ত তৎক্ষনাৎ বললো,
” তো আমার নাম্বার আছে না? আমাকে ফোন করতে পারতে। আর আমিও যে সেদিন তোমাকে ফোন দিয়েছিলাম তারপর তো কথাও বলোনি আমার সাথে।”

” কোন জ্ঞানে আপনার সাথে কথা বলবো আমি? আপনি আমার ভার্সিটির, এমনকি আমার ডিপার্টমেন্টের সিনিয়র ভাই। কারণে অকারণে আমাকে ফোন দেওয়া আপনাকেও মানায় না, আমাকেও মানায় না। এখন আমি ভার্সিটির অবস্থা কি তা জানার জন্য আপনাকে ফোন দিলে তা বেমানান হতো। আপনার চোখে বিষয়টা কেমন দেখাতো জানি না। কিন্তু আমার চোখে বিষয়টা প্রচন্ড দৃষ্টিকটু লাগতো। ”
বলেই সে নিজের অন্তঃক্রোধ দমাতে নত মস্তকে লম্বা নিঃশ্বাস ছাড়লো। অতঃপর মাথা উঁচু করে বৃত্তকে বললো,
” আজকে আমাকে এমন মুহূর্তে হেল্প করার জন্য ধন্যবাদ ভাইয়া। আপনার এ উপকার সারাজীবন মনে থাকবে। আর সকল ধরণের বেয়াদবির জন্য আপনার কাছে ক্ষমা চাচ্ছি। ”
বলেই সে বৃত্ত’র জবাবের অপেক্ষা না করে তার হোস্টেলের দিকে হাঁটা দিলো। পিছে বৃত্ত বিন্দুর এমন আচরণে খানিকটা ব্যথিত হলো। তবুও বিন্দুকে হোস্টেলে ঢোকার শেষ পর্যন্ত দেখলো সে। অতঃপর আরেকবার স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে ক্যাম্পাসের এ উত্তপ্ত পরিবেশ ঠাণ্ডা করতে উদ্যোগ নিলো। তবে ততক্ষণে পুলিশ এসে পরিবেশ পূর্বের তুলনায় বেশ খানিকটা স্থিতিশীল পর্যায়ে নিয়ে এসেছে।
পথিমধ্যে আশরাফের সাথে বৃত্ত’র দেখা হলো। আশরাফের হাতে একটি লাঠি। পুলিশের চোখে এখনও পড়েনি সে। তাই বেশ দাপটের সহিত বৃত্তকে বললো,
” কি মজনু সাহেব? আপনার লাইলিকে বদমাশের হাত থেকে বাঁচিয়ে এসেছেন? আপনার লাইলির কোনো ক্ষতি করেনি তো তারা?”
বলেই সে ক্রুর হাসি দিয়ে বললো,
” আপনার লাইলির ইজ্জতে হাত দেয়নি তো বদমাশরা?”
বলেই সে হো হো করে হাসতে লাগলো।
আশরাফের এমন বাজে ইঙ্গিতের কথা শুনে বৃত্ত’র র ক্ত গরম হয়ে এলো। মেজাজ পারদসীমা অতিক্রম করলো। দাঁতে দাঁতে চেপে প্রচণ্ড আক্রোশে আশরাফের শার্টের কলার চেপে ধরলো সে। বললো,
” মুখ সামলে কথা বল আশরাফ। তোর মুখের লাগাম একেবারেই নেই। যেদিন আমি তোর লাগাম টেনে ধরবো সেদিন আমার একদিন কি তোর একদিন।”

আশরাফও এবার শক্ত কণ্ঠে বললো,
” তুই যে দাপট দেখিয়ে বেড়াস, এ দাপট ক’দিন চলে আমিও দেখতে চাই। সময় সুযোগ বুঝে এমন জায়গাা হাত দিবো যে বাপ মায়ের নাম নিতে নিতে পালাবি।”

” সে সময় আসলেই বুঝা যাবে। আপাতত তুই তোর লিমিটের মধ্যে থাকবি। নাহয় আমার মেজাজ কখনও আমার নাগালের বাইরে চলে গেলে আমি এক সেকেন্ড সময়ও অপচয় করবো না। ”

বৃত্ত’র কথার প্রত্যুত্তরে আশরাফ কিছু বলতে যাবে ঠিক তখনই তারা পুলিশের উপস্থিতির টের পেলো। সাথে সাথে দুজন দুজনকে ছেড়ে যে যার মতো নিরাপদ স্থানে পালালো।

———–

সন্ধ্যায় বাড়িতে এসে ছাদে বসে বৃত্ত ও বাদল আজকের ঘটনা নিয়ে কিছু সময় আলোচনা করলো। এর মধ্যে হঠাৎ বিন্দুর কথা মনে পড়লো বৃত্ত’র। সে তৎক্ষণাৎ ফোন নিয়ে বিন্দুকে ফোন করতে উদ্যত হলো। কিন্তু অকস্মাৎ ক্যাম্পাসের সেই ঘটনা তার মনে পড়লো। মনে পড়লো বিন্দুর বলা প্রতিটি কথা। তখন বিন্দুর কথাগুলোয় মন খারাপ হলেও এখন এসব ভেবে রীতিমতো আত্মসম্মানে লাগলো তার। সে সাতপাঁচ না ভেবেই বাদলকে জিজ্ঞেস করে বসলো,
” আচ্ছা বাদল, তোকে কিছু জিজ্ঞেস করবো। পরামর্শ দিতে পারবি?”

বাদল খানিকটা সন্দেহপ্রবণ দৃষ্টিতে বৃত্তকে বললো,
” প্রেমঘটিত বিষয়ে কোনো পরামর্শ দিতে পারবো। বাদ বাকি যা জিজ্ঞেস করবে তা চেষ্টা করবো।”

বৃত্ত খানিকটা দমে গেলো। তবুও জিজ্ঞেস করলো,
” আচ্ছা, কোনো মেয়েকে ফোন করা, তার খোঁজখবর নেওয়া কি খারাপ দেখায়?”

বৃত্ত’র এহেন প্রশ্নে বাদলের সন্দেহ আরোও প্রবণ হলো। সে তৎক্ষনাৎ ভ্রু উঁচিয়ে সন্দেহজনক সুরে জিজ্ঞেস করলো,
” কি ব্যাপার ভাই? কোন মেয়েকে ফোন দিয়েছো তুমি?”
এ প্রশ্ন করতে না করতেই বাদলের মস্তিষ্কে চট করে বিন্দুর নাম খেলে গেলো। সে তৎক্ষনাৎ আশ্চর্যান্বিত কণ্ঠে বললো,
” বিন্দু! বিন্দু নামের ঐ জুনিয়রকে ফোন দিয়েছো তুমি?”

বৃত্ত কিছু বলতে যাবে এর পূর্বেই ছাদে বর্ষার আগমন ঘটলো। সে বিন্দুর নামটা শুনতে পেলো। অতি উৎসাহী হয়ে সে ভাইদের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে জিজ্ঞেস করলো,
” এই বিন্দুটা কে? বৃত্ত ভাইয়ের লাভার? নাকি ভাবী? নাকি গার্লফ্রেন্ড? নাকি তার বাচ্চার মা?”

বর্ষার শেষোক্ত কথাটি শুনে বিষম খেলো বৃত্ত ও বাদলসহ দুজনেই৷ বিস্ময়কর কণ্ঠে তারা বললো,
” ডাইরেক্ট বাচ্চার মা!”
#চলবে

®সারা মেহেক