#সে_আমার_অপরাজিতা
#পর্ব_১৩
#সারা মেহেক
আশরাফ বিন্দুকে জিজ্ঞেস করলো,
” কি ভাবছো এতো? দ্রুত গাড়িতে উঠে পড়ো। বৃষ্টি কমার নাম নেই একদম। ”
বিন্দু কোনোপ্রকার জবাব দিলো না৷ ব্যাগ হতে ফোন বের করে কল লিস্ট চেক করলো। তামিম ফোন দিয়েছে আরোও প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিট আগে। অর্থাৎ অনেকক্ষণ অতিবাহিত হয়ে গিয়েছে। বিন্দু এ মুহূর্তে তামিমকে কল করলো। দ্বিতীয়বার রিং হওয়ার পর তামিম কল রিসিভ করলো,
” হ্যাঁ, আপু কোথায় তুমি?”
বিন্দু চারপাশে একবার চোখ বুলিয়ে আমতাআমতা করে জবাব দিলো,
” আসছি। রাস্তায়। খালুকে ভর্তি করিয়েছিস?”
তামিমের কণ্ঠস্বর এবার পূর্বের চেয়ে কাতর হলো। সে কম্পনরত গলায় বললো,
” এখনও পারিনি আপু। কোনো সিট খালি নেই। না কেবিনে, না ওয়ার্ডে। তাই হসপিটালের বারান্দায় আছি। তুমি তাড়াতাড়ি আসো আপু। আমার খুব অসহায় লাগছে। কিছুই পারছি না আমি।”
তামিমের কথা শুনে বিন্দুর নয়নজোড়া পুনরায় অশ্রুসিক্ত হলো। সে এবার দৃঢ় হৃদয়ে সিদ্ধান্ত নিলো, যাই হোক না কেনো, এখন আশরাফের গাড়িতেই উঠতে হবে। তাই সে উল্টো হাতে অশ্রুজল মুছে আশরাফকে জিজ্ঞেস করলো,
” আমাকে সদর হাসপাতাল পর্যন্ত দিয়ে আসতে পারবেন ভাইয়া?”
আশরাফ ভ্রু কোঁচকালো। খানিকটা চিন্তিত হবার ভান করে জিজ্ঞেস করলো,
” এতো রাতে সদর হাসপাতালে কেনো? তুমি অসুস্থ? কিন্তু দেখে তো সুস্থ মনে হচ্ছে।”
” আমি অসুস্থ না। আমার খালু স্ট্রোক করেছে। এজন্য এই বৃষ্টির মাঝেও বের হয়েছি। আপনি যদি সদর হাসপাতাল পর্যন্ত একটু পৌঁছে দিয়ে আসতেন……….. অনেকক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে থাকার পরও কোনো রিকশা,অটো পাচ্ছি না। আসলে বৃষ্টি……।”
আশরাফ কথার মাঝে বিন্দুকে বাঁধা দিয়ে হাসিমুখে বললো,
” আরে সমস্যা নেই। আমি তো তোমাকে প্রথমেই লিফটের কথা বলেছিলাম। এখন জলদি গাড়িতে উঠে বসো। রাত অনেক হয়ে গিয়েছে। ”
বলেই সে সিটে বসে এগিয়ে ফ্রন্ট সিটের দরজা খুলে দিলো। বিন্দু কি মনে করে একবার আশেপাশে চাইলো। ভীষণ অস্বস্তি বোধ হচ্ছে তার। মাত্রই তো খালুর জন্য সকল প্রকার ঝুঁকি নিতে রাজি হলো! অথচ এখন কি যেনো ভেবে মনটা ভীষণ খচখচ করছে।
এভাবে কয়েক সেকেন্ড নিজের মনের সাথে লড়াই করে লম্বা নিঃশ্বাস ছেড়ে বিন্দু নিজ সিদ্ধান্তে অটল হলো। টং দোকান থেকে বেরিয়ে এগিয়ে এলো সে। কিন্তু যেই না সে গাড়িতে উঠতে যাবে অমনিই কোথা থেকে কেউ একজন এসে তার হাত চেপে ধরলো।
ঘটনার আকস্মিকতায় বিন্দু চট করে ঘাড় ফিরে চাইলো। তার হাত চেপে ধরা মানুষটি আর কেউ নয় বরং বৃত্ত। বিন্দু বিস্মিত হলো। অকস্মাৎ বৃত্তকে এখানে দেখে আশ্চর্যান্বিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
” আপনি এখানে কি করছেন?”
বৃত্ত কোনো জবাব দিলো না। আড় চোখে আশরাফের পানে একবার দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বৃষ্টির মাঝেই বিন্দুকে একপ্রকার টানতে টানতে নিজের গাড়ির নিকটে আনলো। গাড়ির ডোর হ্যান্ডেলের লক খুলে বিন্দুকে অনেকটা জোরপূর্বকই গাড়িতে বসালো। এর মাঝে বিন্দু বেশ ক’বার চেষ্টা করলো বৃত্তকে বাঁধা প্রদান করতে। কিন্তু বৃত্ত’র সাথে পেরে উঠলো না সে। ফলস্বরূপ ভীষণ বিস্মিত ও রাগান্বিত কণ্ঠে বললো,
” আমাকে এভাবে জোর করে গাড়িতে বসানোর মানে কি? ”
বৃত্ত কঠোর স্বরে বললো,
” চুপচাপ এখানে বসে থাকো। এক পা’ও নড়চড় যেনো না হয়। নয়তো পা ভেঙে এভাবেই গাড়িতে বসিয়ে রাখবো।”
বলেই সে বিন্দুর প্রত্যুত্তরের অপেক্ষায় না থেকে বিন্দুর দিকের ডোর লক করলো। নিজে গিয়ে গাড়ির পিছন হতে টিস্যু বক্স আর পাতলা একটা কম্বলের ন্যায় কাপড় আনলো। অতঃপর ড্রাইভিং সিটে বসে গাড়ি লক করে বিন্দুর দিকে টিস্যু বক্স ও কাপড়টা এগিয়ে দিয়ে বললো,
” টিস্যু দিয়ে যতটুকু পারো বৃষ্টির পানি মুছে নাও। আর শরীরের উপর এই কাপড়টা দিয়ে রাখো।”
বলেই সে গাড়ি স্টার্ট দিলো। বিন্দু বৃত্ত’র এহেন কথার বিপরীতে গিয়ে একগুঁয়েমি স্বরে বললো,
” আপনার আদেশ শোনার জন্য বসে নেই আমি।”
” তোমার শরীর দেখার জন্যও বসে নেই আমি। আমারও মনে হয় তুমি নিশ্চয়ই তোমার শরীর দেখানোর জন্য বসে নেই?”
বৃত্ত’র কথা শোনা মাত্র বিন্দু একনজর নিজের ভেজা কামিজের দিকে চাইলো। শরীরের প্রায় প্রতিটা ভাঁজ বোঝা যাচ্ছে। এ দেখে বিন্দু কয়েক মুহূর্তের জন্য হতবুদ্ধি হয়ে বসে রইলো। অতঃপর লজ্জাজনক এ পরিস্থিতি হতে নিজেকে রক্ষা করতে দ্রুততার সহিত কাপড়টা নিয়ে নিজের কাঁধের উপর দিয়ে যতটুকু সম্ভব ঢেকে নিলো। ইতস্ততার সহিত টিস্যু নিয়ে মুখের পানি পরিষ্কার করলো।
বাইরে এখনও ঝিরিঝিরি বৃষ্টি হচ্ছে। পুরোপুরি বৃষ্টি থামেনি। বৃত্ত জিজ্ঞেস করলো,
” কোথায় নিয়ে যেতে হবে তোমাকে? ”
বিন্দু একনজর বৃত্ত’র পানে চেয়ে বিদ্রুপের স্বরে বললো,
” আপনি আমাকে এমনভাবে এনে গাড়িতে উঠালেন মনে হলো আমি কোথায় যাবো তার সবটা জানেন।”
বৃত্ত বিন্দুর পানে চেয়ে বললো,
” দ্রুত বলো কোথায় যেতে হবে। এখন মোড় চেঞ্জ হয়ে গেলে অন্য রাস্তায় চলে যাবো। ”
” সদর হাসপাতালে যাবো। খালু স্ট্রোক করেছে।”
বিন্দুর কথায় বৃত্ত মোড় ঘুরালো এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই উদ্বিগ্নতার সুরে জিজ্ঞেস করলো,
” কেমন আছে খালু? কখন স্ট্রোক করেছে?”
” ঘণ্টাখানেক ছুঁইছুঁই। ”
” সে কি!এত দেরিতে হাসপাতালে যাচ্ছো কেনো তাহলে?”
বিন্দু পুনরায় বিদ্রুপের সুরে বললো,
” আমি কোনো ভিআইপি নই যে এই বৃষ্টির মাঝেও আমার জন্য গাড়ি এসে বসে থাকবে।”
বিন্দুর এহেন কথায় বৃত্ত ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বললো,
” তোমাকে পিক করার জন্য আমি সবসময় প্রস্তুত। আমার নাম্বার কি তোমার কাছে নেই?”
” আছে।”
” তাহলে? কল করোনি কেনো আমাকে?”
” এভাবে মানুষজনকে বিরক্ত করা আমার আদর্শের মধ্যে পড়ে না। ”
” এসব মুহূর্তের মধ্যে পড়েও আদর্শ! সিরিয়াসলি! আদর্শ ধুয়ে পানি খাও। আর তোমাকে কে বলেছে আমি বিরক্ত হবো?”
” আমি বলেছি আপনি বিরক্ত হবেন। আর আপনার সাথে আমার যত কম ইন্টারেকশন হবে আমি ততো বিপদ থেকে বেঁচে থাকবো। ”
বৃত্ত এবার হো হো করে হেসে উঠলো। বললো,
” আমার সাথে ইন্টারেকশন হলে তোমার বিপদ আসে?”
” জি। এতদিনে আমি অন্তত এতটুকু জেনে গিয়েছি যে আপনি আমার আশেপাশে থাকলেই আমার চারপাশে বিপদ ঘুরে। এজন্য আমি সবসময় আপনার কাছ থেকে দূরত্ব বজায় রেখে চলতে চাই।”
” এসব ভুয়া যুক্তি কি নিজ থেকে বানাও নাকি কেউ ব্রেইনওয়াশ করে?”
বিন্দু জবাব দিলো না। গাড়ির জানালার দিকে স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো। বৃত্ত বললো,
” শোনো, এতো ঘাড়ত্যাড়ামি আমার পছন্দ না। আমার রাগ তো কখনও দেখোনি। তাই বলে দিচ্ছি, কোনো কারণে আমাকে কখনও রাগাবে না। কারণ রেগে গেলে আমি নিজের নিয়ন্ত্রণে থাকি না। ”
বিন্দু তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বিড়বিড় করে বললো,
” আপনাকে রাগানোর জন্য তো আমি বসে আছি! আপনার সাথে যত পারা যায় তত কম দেখা করবো।”
বৃত্ত বিন্দুর কথা শুনে ফেলায় মৃদু হাস্যে বললো,
” আরেকটু আস্তে বলতে কথাগুলো। সবটাই তো শুনে ফেললাম। ”
বলেই সে ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়লো। বললো,
” কোনো অঘটন না ঘটলে তোমার সাথে প্রতিদিন দেখা হবে। এটা চাইলেও তুমি এভোয়েড করতে পারবে না। সে যতই অনিচ্ছায় হোক না কেনো।
আর একটা কথা বলে রাখি, এমন ধরণের বিপদে কখনও এসব অদ্ভুতুরে আদর্শকে ধরে রাখবে না৷ আজ বিপদের সময় এ আদর্শকে ধরে রাখতেই তো আরেক বিপদে পড়ছিলে। নিজে গিয়ে সাপের গর্তে পা দিচ্ছিলে।”
বিন্দু সরু দৃষ্টিতে বৃত্ত’র পানে চেয়ে জিজ্ঞেস করলো,
” এখানে সাপ কে জানতে পারি?”
বৃত্ত মেকি হাসি দিয়ে বললো,
” কিছুক্ষণ আগেই সাপের গাড়িতে পা রাখতে যাচ্ছিলে। আর এতটুকু জানো না, সাপ কে!”
” আপনার মতো জটিল মাথা নিয়ে ঘুরি না যে সাপ কে চিনে রাখবো।”
” চিনতে শিখো বিন্দু। কে শত্রু আর কে মিত্র এটা তোমার নিজ বুদ্ধি দিয়ে চিনে রাখতে হবে। আশরাফ কেমন তা সম্পর্কে তোমার সামান্যতম আইডিয়াও নেই। ”
” উনি আমার পূর্বপরিচিত নয় যে উনার চরিত্র, ব্যবহার সম্পর্কে চিনে রাখবো। আর উনি আমার বিপদের সময় এসে আমাকে সাহায্য করতে এসেছে। আমার তখন মনে হয়েছে উনার সাহায্য নেওয়া দরকার তাই নিতে গিয়েছিলাম। ”
” আচ্ছা, যা হওয়ার তা হয়েছে। এখন থেকে আশরাফের কাছ থেকে যতটা পারো ততোটা দূরত্ব বজায় রাখবে। ”
” দূরত্ব তো আপনার থেকে বজায় রাখা উচিত।”
বিন্দুর কথায় বৃত্ত বাঁকা হেসে বললো,
” পারবে না। আমি রাখতে দিবো না আমাদের মাঝে কোনো দূরত্ব। মনে রেখো,তুমি আমার কাছ থেকে যতটা পালানোর চেষ্টা করবে, ঠিক ততোটাই কাছে আসবে। খাতা কলমে লিখে রেখো। তাই এই ফ্যাক্ট মেনে নিও।”
বিন্দুর বেশ রাগ হলো এ কথায়। সে পুনরায় জানালার দিকে ফিরে দাঁতে দাঁত পিষে বিড়বিড় করে বললো,
” মানলাম না আপনার ফ্যাক্ট। আর কখনো মানবোও না।”
বৃত্ত হাসলো। কেনো যেনো তার কাছে বিন্দুর কথাগুলো ভীষণ বাচ্চামো মনে হচ্ছে। কেননা সে জানে, একই ডিপার্টমেন্ট, একই ক্যাম্পাসে থাকার পর বিন্দু চাইলেও কখনও বৃত্তর থেকে দূরত্ব বজায় রাখতে পারবে না৷ আর বৃত্তও কখনো এমনটা হতে দিবে না৷
বৃত্ত গাড়ি নিয়ে সদর হাসপাতালে পৌঁছালো। হাসপাতালের সামনে গাড়ি থামানোর সাথে সাথেই বিন্দু নেমে পড়লো। বৃত্ত’ও দেরি না করে গাড়ি থেকে নেমে পড়লো।
বিন্দু সোজা নিউরোলজি ডিপার্টমেন্টের ওয়ার্ডে গেলো। কিন্তু সেখানে তন্নতন্ন করে খুঁজেও পেলো না তার খালুকে। এদিকে তামিমও কল রিসিভ করছে না। বিন্দু এবার প্যানিকড হলো। বৃত্ত তার হেন অবস্থা দেখে তাকে শান্ত করার চেষ্টা করলো। ধীর কণ্ঠে বললো,
” প্যানিক হবে না বিন্দু। এখানে না থাকলেও অন্য ওয়ার্ডে আছে নিশ্চয়ই। চলো, জেনারেল ওয়ার্ডে যাই। ”
বিন্দু দেরি করলো না। প্রায় দৌড়ে জেনারেল ওয়ার্ডের দিকে ছুটলো। ওয়ার্ডের এক দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকে অস্থির দৃষ্টি দিয়ে তামিমকে খুঁজলো, তার খালা ও খালুকে খুঁজলো। কিন্তু কাউকে পেলো না। শেষে মনে হলো, তামিম বারান্দায় থাকার ব্যাপারে বলেছিলো। বিষয়টি মনে আসতেই বিন্দু অপর দরজা দিয়ে বেরিয়ে ব্যালকনিতে চলে এলো। এপাশ ওপাশ খুঁজে শেষমেশ তামিমকে দেখলো।
তামিমকে দেখা মাত্রই বিন্দু কাঁদতে কাঁদতে একনজর বৃত্ত’র দিকে চাইলো। অতঃপর…..
®সারা মেহেক
#চলবে