সে আমার মানসিক শান্তি পর্ব-৪০

0
272

#সে_আমার_মানসিক_শান্তি
#পর্ব_৪০
#লেখিকা_Fabiha_bushra_nimu

আয়াত বিছানায় বসে আছে। আব্রাহাম আয়াতের দিকে দৃষ্টিপাত করে রেখেছে। আব্রাহামের দৃষ্টি আয়াতের দিকে স্থীর তা দেখে, আয়াত লজ্জায় দু’হাতে নিজের মুখ আড়ালে করে নিল। আব্রাহামের দৃষ্টির আড়াল হতে, আব্রাহামের বুকেই মুখ লুকালো। আয়াতের কান্ড দেখে আব্রাহাম আলতো করে হাসলো। আয়াতের কপালে অধর ছুঁইয়ে দিয়ে, আয়াতকে নিজের দু’হাতে আবদ্ধ করে ফেলল। দরজায় কলিং বেল বাজতেই দু’জন সজাগ হলো। আব্রাহাম আয়াতকে নিজের থেকে, ছাড়িয়ে দরজা খুলতে চলে গেল। আয়াত কাল রাতে আব্রাহামের আনা ব্যাগ গুলো খুলে দেখতে লাগলো। সেখানে তার প্রয়োজনীয় জিনিস পত্র রয়েছে। অনেক গুলো হিজাব, চুলের ক্লিপ, দু’টো শাড়ি, কয়েকটা সালোয়ার কামিজ। ছোটখাটো আরো অনেক গুলো জিনিস রয়েছে। আব্রাহাম কিভাবে জানলো? জিনিস গুলো তার প্রয়োজন। আয়াতের ভাবনার মাঝেই আব্রাহাম রুমের মধ্যে প্রবেশ করল। আয়াতকে অবাক হতে দেখে বলল।

–এত অবাক হবার কিছু নেই। তুমি মুখে কথা রাখো কেনো? তোমার যে, প্রয়োজনীয় জিনিস গুলো ফুরিয়ে গিয়েছে। আমাকে বললেই পারো। সঠিক সময় মতো এনে দেই। কালকে দেখলাম ফেসওয়াশের কৌটা কেটে দুইভাগ করে ফেলেছো। সেখানে থেকে একটু একটু করে নিয়ে মুখে দাও। বলি কি আমার এতই দুর্দিন এলো। যে বউকে কৌটা কেটে মুখে ফেসওয়াশ মাখতে হবে।

–আমি তোমার মতো নাকি। অপচয় করা একদম ভালো কাজ না। আমি অপচয় করতে জানি না। তাই ফেসওয়াশ কৌটা কেটে আরো কিছু দিন ব্যবহার করি। এর মধ্যেও আলাদা একটা ব্যাপার আছে। এটা তুমি বুঝবে না।

–তুমি যে কথায় কথায় অভিমান করো। তোমার অভিমানের অপচয় হয় না। তোমার মতো মেয়ের কাছে থেকে অপচয় আশা করা যায় না। এর পরে থেকে অভিমান করলে, কম করে করবে। এত তোমার অভিমান গুলো অপচয় কম হবে। আব্রাহামের কথা শুনে, আয়াত ফুঁসে উঠলো। রাগান্বিত হয়ে বলল।

–তুমি যে আমাকে সময় দাও না। আমাকে আগের মতো ভালোবাসো না। তার বেলা কি হবে? তোমার সাথে কথা বলাই আমার ভুল হয়েছে। আর কখনো তোমার সাথে কথা বলবো না। এখনো বাসায় বসে থেকে কি করছো। তোমার কাজ ফুরিয়ে গেল। তাড়াতাড়ি কাজে যাও। বাসা থেকে বের হতে পারলে বাচোঁ। আল্লাহ জানে, আবার কোথাও বিয়ে করে বউ রেখে আসছো নাকি। বাহিরে যাবার এত কিসের তাড়া তোমার।

–ভালো কথা বললেই দোষ হয়ে যায়। আমার বউ কি দেখতে কম সুন্দর। যে আমাকে আরেকটা বিয়ে করতে হবে। আব্রাহামের কথা শুনে, আয়াত মুখ বাঁকালো। আয়াতের মুখ বাঁকানো দেখে আব্রাহাম শব্দ করেই হেসে উঠলো। আয়াতের মুখ বাঁকানোটা আব্রাহাম খুব সুন্দর ভাবে উপভোগ করে।

–তুমি আমার মুখ বাঁকানো টা উপভোগ করো। আর আমি তোমার হাসি উপভোগ করি। তোমার মুখের হাসি আমাকে এক আকাশ পরিমাণ শান্তি এনে দেয়। যে শান্তি পৃথিবীর কোথাও নেই। তুমি হসপিটালে যাবে না। কথাটা বলেই মুখটা মলিন করে ফেলল আয়াত। আজকে ভিষণ করে চাইছে। আব্রাহাম তার কাছে থাকুক। কিন্তু চাইলেই কি সব ইচ্ছে পূর্ণ হয়। আব্রাহামের আশায় কত মানুষ বসে থাকে। সে আব্রাহামের দায়িত্ব পালন করতে বাঁধা দিতে পারে না। তার খুশির থেকে মানুষের সুস্থ হওয়াটা বেশি জুরুরি। আয়াতকে চুপ হয়ে যেতে দেখে আব্রাহাম বলল।

–আজকে বাসায় আছি বলে, আমাকে সহ্য হচ্ছে না। আব্রাহামের কথা শুনে, আড়চোখে তাকালো আয়াত। আয়াতকে আড়চোখে তাকিয়ে থাকতে দেখে, আব্রাহাম হেসে বলল।

–চোখ দিয়ে খেয়ে ফেলবে নাকি। ওভাবে তাকিয়ে আছো কেনো? আমার বুঝি লজ্জা করে না। আব্রাহামের কথা শুনে আয়াত চোখ বড় বড় করে তাকালো। সেকেন্ডের মধ্যে নিজের দৃষ্টি অন্য দিকে ঘুরিয়ে নিল। আব্রাহাম আয়াতে শুয়ে দিল। তারপরে রেস্ট করতে বলে, বাহিরে চলে গেল। আয়াত বাহিরে উঁকি দিয়ে, পাশে থাকা আব্রাহামের ফোন হাতে তুলে নিল। ফোন হাতে নেওয়ার সাথে সাথে একটা মেসেজ আসলো। হিয়া দিয়ে সেভ করা।

“আব্রাহাম তুই কখন হসপিটালে আসবি? অনেক বেলা হয়ে গিয়েছে। এখনো হসপিটালে আসলি না। তোর কি শরীর খারাপ? তুই তো কোনোদিন এমন করিস না। আমি ফোন দিলে, তুই বিরক্ত হোস। তাই তোকে ফোন না দিয়ে, মেসেজ পাঠালাম। তোমার উত্তরের অপেক্ষায় থাকবো। হিয়া। ”

মেসেজটা পড়ে গা জ্বলে উঠলো আয়াতের, এই মেয়েটাকে একদম সহ্য করতে পারে না সে। আব্রাহামের সহপাঠী বলে, চুপচাপ সহ্য করে। যেদিন বেশি বাড়াবাড়ি করবে, সেদিন উচিৎ শিক্ষা দিয়ে দিব। আয়াতের ভাবনা মাঝেই আব্রাহাম খাবার নিয়ে রুমে প্রবেশ করল। আব্রাহামকে দেখে চোখ গোল গোল করে তাকালো আয়াত। আয়াতকে তাকিয়ে থাকতে দেখে আব্রাহাম বলল।

–এভাবে তাকানোর কোনো কিছু নেই। তোমার-ই বর সারাজীবন দেখতে পারবে। এখন অন্তত চোখটা নিচে নামাও। আর লক্ষী মেয়ের মতো খেয়ে নাও।

–তুমি আজকে হসপিটালে যাবে না?

–বউ যদি রাগ করে, হসপিটালে গিয়ে কি মন টিকবে? তাই আমি সাত দিনের জন্য ছুটি নিয়েছি। এই সাতদিন আমি তোমার সাথে থাকবো।

–তাহলে হসপিটালে রোগীদের দেখবে কে?

–হসপিটালে আরেকজন নতুন ডক্টর এসেছেন। উনি দেখবেন। উনার জন্যই সাতদিন ছুটি নিতে পারলাম। এখন খেয়ে ঘুমিয়ে নাও। বিকেলে তোমাকে নিয়ে, ঘুরতে যাব। আব্রাহামের কথা শুনে, আয়াতের চোখ মুখ চকচক করে উঠলো। কোনো কথা বলল না। চুপ খেয়ে নিল।

আয়াতের বাবা জরুরি তলব করে, আয়াতদের ডেকেছে। বিকেলে ঘুরে আব্রাহাম আর আয়াত শিকদার বাসায় গেল। ড্রয়িং রুমে সবাই মিলে বসে আছে। হয়তো কারো জন্য অপেক্ষা করছে। আব্রাহাম নীরবতা ভেঙে আয়াতকে উদ্দেশ্য করে বলল।

–তোমার ছোট চাচা কোথায়? এই বাসায় আসার পরে তাকে কোনোদিন দেখি নাই। শুধু তোমার চাচি আর চাচাতো ভাইকে দেখি। তোমার চাচা কি তোমাদের সাথে থাকে না।

–আমার চাচা আমাদের সাথেই থাকতো। কিন্তু চাচির সাথে ঝগড়া হবার পরে, চাচা আলাদা বাসায় থাকে। চাচার সাথে চাচির পড়ে না। চাচা চাঁচির কারনে ছেলেদের ওপরে, বাজে প্রভাব যেনো না পড়ে, তাই আব্বু চাচাকে আলাদা থাকতে বলেছে। আব্বুর সাথে চাচার যোগাযোগ আছে। আয়াতের কথায় আব্রাহাম ছোট করে উত্তর দিল ওহ্।

–তুমি হঠাৎ চাচার কথা জানতে চাইলে?

–উনাকে তোমাদের বাসায় কোনোদিন দেখি নাই। তাই জানতে ইচ্ছে হলো৷ আয়াত আর আব্রাহামের কথার মাঝে চৌধুরী বাড়ির সবাই চলে আসলো। মুহুর্তের মধ্যে আব্রাহাম চোয়াল শক্ত হয়ে আসলো। দু-চোখ রক্তিম বর্ন ধারণ করেছে। আব্রাহাম উঠে চলে যাবে। তখনই আয়াত আব্রাহামের হাত চেপে ধরে। কানের কাছে ফিসফিস করে বলল।

–তুমি যদি এখানে থেকে উঠে চলে যাও। তাহলে আব্বুর অসম্মান হবে। আমি চাই না। আমাদের জন্য আব্বু অসম্মান হোক। আয়াতের কথায় দমে গেল আব্রাহাম। জোরে জোরে শ্বাস নিয়ে, নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছে। আব্রাহামে দৃষ্টি ফ্লোরের দিকে বিদ্যমান। চৌধুরী বাড়ির কারো মুখ সে দেখতে চায় না। আবরার অসহায় দৃষ্টিতে আব্রাহামের দিকে তাকিয়ে আছে। সে জানে এ জীবনে আব্রাহামের থেকে মাফ পাবে না। আব্রাহাম একবার যখন তাদের থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছে। তারমানে মরে গেলে-ও তাদের দিকে ফিরেও তাকাবে না। ভাবতেই একটা দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এলো। সফিউল চৌধুরীর অসহায়ত্ব কণ্ঠ ভেসে আসলো।

–আব্রাহাম জানি অনেক বড় ভুল করেছি। তার ক্ষমা পাব কি না তা আমি জানিনা। তবে তোর সাথে যে অন্যায় গুলো আমি সেগুলো সংশোধন করতে চাই। তোর বাড়ি, তোর অফিস আমি তোকে ফিরিয়ে দিতে চাই। আমি যেনো তোকে দেখাশোনা করি। সেজন্য তোর বাবা-মা আমাকে অফিসটা দিয়েছিল। আমি যেনো কোনো কর্ম করে, আমার ছেলে সহ তোকে ভালোভাবে মানুষ করতে পারি। আমি তোর মাকে দেওয়া কথা রাখতে পারি নাই। টাকা আর সম্পদের নেশায় অন্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। এখন আমার সবকিছু আছে। কিন্তু মনে শান্তি নেই। আগে আমরা যখন সবাই মিলে, একসাথে থাকতাম। কিন্তু সুন্দর করে, আমাদের জীবন চলছিল। আমার টাকা পয়সা চাই না বাবা। আমার একটা সুন্দর সুখের পরিবার চাই। তুই আর আয়াত আমাদের বাসায় ফিরে চল। আমি ছলনা করে, তোর বাসা আমার নামে করে নিয়েছি। আমি তোকে কথা দিচ্ছি। আমি তোর বাসা তোকে ফিরিয়ে দিব। আয়াত আব্রাহামকে একটু বোঝাও না। আব্রাহাম যেনো আমাদের সাথে বাসায় ফিরে যায়।

বাবার কথা শুনে চমকে তাকালো আহনাফ। বাড়িটা তার বাবার নামে আছে। আর সে আব্রাহামকে মারা জন্য ছুটে চলেছে। আব্রাহামকে তো তার কোনো কাজেই লাগবে না। তার থেকে-ও তার বাবা দিগুন চালাক। এটা জানা ছিল না আহনাফের। আপাতত আব্রাহামের চৌধুরী বাড়িতে যাওয়াটা আটকাতে হবে। কথা গুলো ভাবতেই রাজ্যের চিন্তা এসে ভর করল মাথায়। তার বাবাকে খু*ন* করে হলে-ও, তার সব সম্পত্তি চাই। তার একটা পুরো রাজত্ব চাই। যেই রাজ্যে তার কথাই হবে শেষ কথা। আহনাফের কথার মাঝেই, আব্রাহামের রাগান্বিত কণ্ঠ স্বর ভেসে এলো।

–আয়াত কি বলবে? আমি যা বলবো। আয়াত তাই শুনতে বাধ্য। আয়াত যদি আমার কথার বাহিরে যায়। তাহলে আমার সাথে আয়াতের সংসার করার প্রয়োজন নেই। যে বাসায় মানুষকে মানুষ বলে মূল্যায়ন করা হয় না। সেই বাসায় আমি ফিরতে চাই না। আমার নতুন বউটা একটু শশুর শাশুড়ীর ভালোবাসা পাবার জন্য তোমাদের কাছে গিয়েছিল। তোমরা কি করেছিলে? ভরা লোকজনের মধ্যে আমাদের অপমান করেছিলে। খালা আয়াতকে অনেক অপমান করতো। আয়াত আমার মুখের দিকে তাকিয়ে, কখনো কোনোদিন কোনো অভিযোগ করতো না। পর কোনো দিন আপন হয় না। সেটা আপনি আমাকে সব সময় মনে করিয়ে দিয়েছেন খালু। আপনারা আপনাদের মতো ভালো থাকুন। আমাকে আমার মতো ভালো থাকতে দিন। আমি বেঁচে থাকতে, আয়াত কোনোদিন চৌধুরী বাড়িতে প্রবেশ করতে পারবে না। আয়াতকে যদি চৌধুরী বাড়িতে যেতেই হয়। তাহলে আমার সাথে সব সম্পর্ক শেষ করে যেতে হবে। এখন আয়াত সিদ্ধান্ত নিক। সে কি করবে? আব্রাহামের কথা শুনে, আয়াত চুপ করে বসে রইলো। আব্রাহাম প্রচন্ড পরিমানে রেগে আছে। এখন আব্রাহামের কথার ওপরে কথা বলার সাধ্যি তার নেই। সে আব্রাহামের কথা শুনতে বাধ্য। আজাদ শিকদার আব্রাহাম কিছু বোঝানোর চেষ্টা করতে চাইলে, আব্রাহাম আজাদ শিকদারের কাছে মাফ চেয়ে উঠে দাঁড়ালো। আয়াতকে উদ্দেশ্য করে, কঠিন কণ্ঠে বলল।

–তুমি কি আমার সাথে যেতে চাও। যদি আমার সাথে যাওয়ার ইচ্ছে থাকে। তাহলে আমার সাথে আসতে পারো। না হলে এখানে থাকো। আমি বাসায় চলে গেলাম। আয়াত একটা উত্তরও করল না। আয়াত বাবা-মাকে উদ্দেশ্য করে বলল বাবা-মা আসছি। বলেই আব্রাহামের পেছনে পেছনে চলে গেল। ড্রয়িং রুমে বসা প্রতিটি মানুষের মুখে হতাশার ছাপ। হতাশার ছাপ নেই একটি মানুষের মুখে সে হলো আহনাফ। সে মনে মনে অনেক খুশি হয়েছে। বুক ভারি করা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে সবাই নিজ নিজ বাসায় ফিরলো।

বাসায় এসেই আহনাফ রাগে গজগজ করতে লাগলো। আহনাফকে অস্থির হতে দেখে, আরোহী আহনাফের পাশে বসে বলল।

–কি হয়েছে? তোমাকে এমন অস্থির দেখাচ্ছে কেনো? আমাদের বাসায় তোমাকে কেউ কিছু বলেছে? বাবা-মার সামনে যাবার সাধ্যি আমার নেই। তাই তোমাদের সাথে যেতে পারি নাই। ও বাসায় কি হয়েছে?

–আরোহী বাড়িটা আব্রাহামের নামে নেই। বাবার ছলনা করে নিজের নামে লিখে নিয়েছে। আমরা এতদিন মরিচীকার পেছনে ছুটেছি। আমি আর বিলম্ব করতে চাইছি না। আজ রাতেই বাবাকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিতে চাইছি। কথা গুলো বলেই কাউকে ফোন করল। দু’জনের কথা শেষ হতেই হাসতে শুরু করলো আহনাফ।

চলবে…..