সে আমার শরৎফুল পর্ব-৩০+৩১

0
212

#সে_আমার_শরৎফুল #পর্ব৩০

#আরশিয়া_জান্নাত

তৃণার সময় কাটছে মহাব্যস্ততায়। ল্যাব রিপোর্ট জমা দেওয়া, পরীক্ষার প্রিপারেশন নেওয়ার জন্য ক্লাসের বাইরেও ঘন্টার পর ঘন্টা লাইব্রেরিতে কাটাতে হচ্ছে। এবছর সে একেবারে মাস্টার্স কমপ্লিট করে বের হবে। বিগত রেজাল্টগুলো সন্তোষজনক হলেও তৃণার টেনশন হচ্ছে খুব। সে চায় না শ্বশুড়বাড়িতে কম সিজিপিএ প্রকাশ করতে। তাই তার পরিশ্রমটা একটু বেশিই।

আজকাল ক্যাম্পাসটার জন্য বড্ড মায়া লাগে। জারুল গাছের নীচে বসে কত আড্ডা দিয়েছে, যেন এই তো সেদিন এসেছিল। অচেনা শহরটায় বাবার সঙ্গে ভর্তি পরীক্ষা দিতে। শুরুতে কত বিড়ম্বনায় পড়তে হয়েছিল, এডজাস্ট করতে সমস্যা হচ্ছিল। রুম পাওয়া নিয়েও কম ঝাক্কি পোহাতে হয়নি। তার উপর সিনিয়রদের নাকানি চুবানি তো আছেই।‌ অথচ এখন তারাই সবার সিনিয়র। এই চেনা রাস্তাটা দিয়ে রোজ ক্লাসে যেতে হবেনা, মামার দোকানের খিচুড়ি খাওয়া হবেনা। হলের সামনে যে কুকুরটা রোজ তার আশায় বসে থাকে তাকে আদর করে বনরুটি খাওয়ানো হবেনা। জীবনটা আসলেই দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে।

ফ্ল্যাস্ক থেকে পানি নিয়ে তৃণা গার্গেল করতে লাগলো। নাহ এই জীবনে সে শান্তি পাবেনা। এতো সাবধানতা অবলম্বনের পরো দু’দিন পরপর গলা ব্যথা, সর্দি কাশি তার লেগেই থাকে। ছোট থেকেই তার এই সমস্যা। তাকে সবসময় কুসুম গরম পানি পান করতে হয়। গরমের দিনে সবাই যখন ফুল স্পিডে ফ্যান ছেড়েও শান্তি পায়না, ও তখন ফ্যান অফ করে চাদর গায়ে জড়িয়ে ঘুমায়। যদি ভুলক্রমে ঘুমের মধ্যে গলা থেকে উড়না সরে, ব্যস সকালে গলা বন্ধ হতে দেরী নেই! এ ঘরের ফ্যানটার বিশেষ জোর নেই, তবুও সে ফ্যান থেকে দূরের বেডটাই চুজ করেছিল। এতে অন্যদের সুবিধাই হলো বটে!

তার মাঝেমধ্যে মনে হয় এসব সমস্যা নিয়ে পরের সংসার সামলানো কঠিন হবে। তার রুমমেটরা প্রায় মজা করে বলতো, তুই ফ্যানের হাওয়া সহ্য করতে পারিস না, দেখবি তোর বরের ফ্যানে হবেনা, এসি লাগবে! তখন কি করবি তুই?

তৃণার সোজাসাপ্টা জবাব ছিল, সে এসি রাখুক কি ফ্যান আমার কি? আমি কম্বল দিয়ে ঘুমাবো। এতে তার আপত্তি থাকলে বলবো আমার জন্য আলাদা ঘর রাখো।

এখন সেই জবাবটা নিজের কাছেই অসম্ভব মনে হয়। ইরহাম এর একটাই কথা- ঝগড়া হোক, মান অভিমান হোক, সংসার করতে গেলে বহু ঝড়ঝাপ্টা সহ্য করতে হবে স্বাভাবিক। তবে সেসবের মাঝে শর্ত একটাই, দুজনের কারোই বিছানা ত্যাগ করা যাবেনা। এই শর্ত দুজনকে মানতেই হবে।

তৃণা প্রতুত্ত্যরে বলেছিল, এটা কঠিন শর্ত। অনেক সময় দেখা যায় রেগে গেলে স্থান ত্যাগ করাই শ্রেয়। এতে অবস্থার অবনতি কম ঘটে।আমার তো মাঝেমধ্যে এমন রাগ উঠে, ২/৩দিনেও পড়েনা। তখন তো আমি সঙ্গ ছাড়তেই পারি!

ওসব অন্যদের বেলা,স্বামী স্ত্রীর মাঝে দূরত্ব থাকলে ৩য় আরেকজন থাকে ভুল বোঝাবুঝি বাড়াতে। শয়তান কখনোই চায়না একটা দম্পতি হালাল ভাবে একে অপরের প্রতি সম্মোহিত থাকুক। সে সবসময় ভেজাল লাগাতে প্রস্তুত থাকে। আর শোনো‌ শর্তটার গভীরতাও অনুধাবন করার চেষ্টা করো। আমি বলেছি যতোকিছুই হোক সেইজন্য বিছানা ত্যাগ করা যাবেনা। এর অর্থ ২টা দাড়ায়। ১ হলো দূরত্ব কোনোভাবেই বাড়তে দেওয়া যাবেনা। ২য়টা হলো সেটার স্থায়ীত্ব কম হতে হবে। মানে সবকিছু মিটমাট করে ফেলার চেষ্টা করতে হবে।

বলা সহজ, কার্যকর করা অতো সহজ যদি না হয়?

প্রচেষ্টা চালাতে দোষ কি?

আপনার যতো জ্ঞানী জ্ঞানী কথা!

ইরহাম তাকে বুকে জড়িয়ে মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলল, সেটা নয় তৃণা। আমরা সবাই বিয়ে নিয়ে খুব ফ্যান্টাসিতে ভুগি। আমরা ভাবি বিয়ে করলেই বুঝি একটা কেয়ারিং পার্টনার পেয়ে যাবো। যে আমাদের অনেক ভালোবাসবে, কেয়ার করবে। আমি যাই বলবো চুপচাপ মেনে নিবে। মুখে না বললেও সব বুঝে নিবে। রাগ করলে রাগ ভাঙাবে, বার্থডে, এনিভার্সেরি গ্র্যান্ড করে সেলিব্রেট করবে ইত্যাদি ইত্যাদি। আমরা এসব স্বপ্নে এতোটাই মশগুল থাকি, ভুলেই বসি বাস্তবতা ভিন্ন। সবাই সেসব করে না। আমরা সবাই ভিন্ন পরিবারে বেড়ে উঠি, একেকজনের মাইন্ড, পয়েন্ট অফ ভিউ একেকরকম। বিয়ের আগের জীবন আর পরের জীবন এক না। তাই আমি মনে করি প্রত্যেকের বিয়ের আগে এই বিষয়টার সম্পর্কে মিনিমাম স্টাডি করা উচিত। আসলেই বিয়ে মানে কি, এখানে কতটুকু এক্সপেক্ট রাখা উচিত, নিজে কতোটা ডেডিকেটেড হওয়া উচিত সেটা বোঝার মতো সক্ষমতা তৈরি করা উচিত। দুজনের সম্মিলিত প্রচেষ্টা ব্যতিত এটা সম্ভব না। একজন রেগে গেলে আরেকজনকে তখন পানি হতে হবে। দুজনে একসঙ্গে রেগে গেলে চলবেনা। তেমনি একজনই শুধু কম্প্রোমাইজ করবে, স্যাক্রিফাইজ করবে, ডেডিকেটেড হবে। অপরজন কিছুই করবেনা তাহলেও হবেনা। দুজনকেই দুজনের হেল্প করতে হবে, অপরজনের ডেডিকেশনকে মূল্যায়ন করতে হবে একটা সুন্দর সম্পর্ক গড়ার ক্ষেত্রে। তবেই দাম্পত্য জীবন সহজ হবে।

আপনি অনেককিছু চিন্তাভাবনা করেন! এতোকিছু ভাবা হয়নি আসলে…

জানো তৃণা, বৈবাহিক জীবনটা ৩টা ধাপে বিভক্ত। প্রথম ধাপে নতুনত্বের ছোঁয়া, মিষ্টি একটা সম্পর্ক থাকে‌। একে অপরের প্রতি তীব্র আকর্ষণ থাকে। সবকিছুই তখন সুন্দর এবং আবেগমিশ্রিত। ২য় ধাপে দায়িত্ব বাড়ে, সন্তানদের নিয়ে ব্যস্ততা বাড়ে। ভালোবাসাও আগের চেয়ে খানিকটা কম প্রকাশিত হয়। এই সময়টা বেশ জটিল বলা চলে। কেননা এইসময়টায় মানুষ অনেক সময় গোমরাহ হয়ে যায়। ভেবে বসে ভালোবাসা বুঝি শেষ। সব রং ফুরিয়ে গেছে। তাই এই সময়টায় একে অপরকে দয়া করে একটু ছাড় দিতে হয়। আকড়ে রাখতে হয়; আঁকড়ে থাকতে হয় দয়া করে মায়া করে। এই ধাপটা পার করলেই হলো, পরের ধাপটায় ১ম দুই ধাপের প্রভাব তীব্রভাবে প্রকাশ পায়। তখন সম্পর্কটা কেবল ভালোবাসা বা মায়া আলাদা আলাদা বিশেষণে বিশেষিত হয়না।। দুটো মিলেমিশে একাকার হয়ে একটা গাঢ় বন্ধনে পরিণত হয়।

তৃণা তখন ইরহামের গালে চুমু খেয়ে বলেছিল, আপনি অনেক ভালো ইরহাম। আপনার কথাগুলো সবসময় মনে রাখার চেষ্টা করবো। অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।

ইরহাম মুচকি হাসলো।

হ্যালো মা?

হুম বল?

কেমন আছ?

ভালো। তুই?

ভালো আছি মা। মা জানো আজকে আমি অনেক খুশি।

কি হয়েছে?

তুমি নানু হতে চলেছ মা! আমি কনসিভ করেছি,,,

পলি বেগম আনন্দিত গলায় বললেন, আলহামদুলিল্লাহ! এ তো খুশির খবর। তুই সাবধানে থাকবি, প্রথম কয়েকমাস বেশি কেয়ারফুল থাকতে হয়। কি কপাল আমার, এতো আনন্দের সময় তোকে বুকে নিতে পারছিনা!

তুমি চিন্তা করোনা,আমার শ্বশুড়শাশুড়ি অনেক ভালো। উনারা আমার অনেক যত্ন করেন। আর তোমার জামাইতো দিনে কতবার কল করবে কি খেতে ইচ্ছে করছে বলতে! আমি ভালো আছি মা, আমার জন্য দোআ করিও।

তোর বাবা খুব পাষাণরে মা। কতবার বলি যা হবার হয়ে গেছে। এখন অন্তত মেনে নাও। কিন্তু সে কানেও তুলেনা, তোর ফুফাতো ভাইয়েরা আছে আরো তাল দিতে। একটু নরম হয়ে আসলেই উস্কে দেয়,,,

তুমি ওসব তুলে আর বকা শুনিও না। ভাগ্যে যা আছে তাই হবে।

পলি বেগম দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, মন খারাপ করিস না। সব ঠিক হয়ে যাবে।

ফোন রেখে রিপা বসতেই তাহমিনা এসে বললো, বৌমা দেখ তো এবার হয়েছে কিনা?

রিপা শুটকির ভর্তাটা চেখে বললো, হুম আম্মু একদম পারফেক্ট হয়েছে।

যাক বাবা হলো অবশেষে। আয় তাহলে এবার গরম গরম ভাতটা খেয়ে নে।

রিপা শাশুড়িকে জড়িয়ে ধরে বললো, আম্মু তুমি শুটকির গন্ধ পছন্দ করোনা, অথচ আমার জন্য কত কষ্ট করে ভর্তা করলে! থ্যাঙ্ক ইউ সো মাচ।

শোনো মেয়ের কথা, এই সময়ে কিছু খেতে চাইলে মানা করতে আছে? তুই কোনো কিছু চেপে রাখিস না। যেটা খেতে ইচ্ছে করবে বলবি শুধু। সাধ্যমতো চেষ্টা করবো।

পুরনো কাগজপত্র বিক্রি করার উদ্দেশ্যে জমা করতেই একটা রিপোর্ট চোখে পড়ে রুমানার। রিপোর্টটা বেশিদিনের পুরনো নয় দেখে তিনি অবাকই হন। কেননা গত ১/২ বছরে কারোই এমন বিশেষ রোগ হয়নি যার জন্য টেস্ট করানোর প্রয়োজন পড়েছে। রিপোর্টটা খুলে পড়তেই তার পুরো শরীর থরথর করে কাঁপতে থাকে। তিনি দ্রুত রিপোর্টটা সরিয়ে ফেলেন।
রুমি এতো বড় কাজটা কিভাবে করলো! সে কিভাবে পারলো ডিএনএ টেস্ট করাতে?
আচ্ছা খামটা তো বন্ধ ছিল, তবে কি রুমি রিপোর্টটা চেক করতে ভুলে গেছে? নাকি ও সবটা জেনেও নিরব আছে?

রুমানা বেগম অস্থির ভাবে ঘামতে থাকেন। নাহ এই সত্যিটা বের হয়ে আসা ঠিক হবেনা। একদমই ঠিক হবেনা….

চলবে…

#সে_আমার_শরৎফুল #পর্ব৩১

#আরশিয়া_জান্নাত

ব্ল্যাক ব্লেজার পরিহিত একটা লোককে গেইটের ভেতর ঢুকতে দেখে রুমি দোতলার ছাদ থেকে কৌতুহলী দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। লোকটা চারদিকে চেয়ে কাউকে দেখতে না পেয়ে কি করবে বুঝতে পারছেনা। খানিকটা চেঁচিয়ে রুমি জিজ্ঞাসা করল, কে আপনি? কাকে চাই?

লোকটা সানগ্লাস খুলে উপরের দিকে তাকায় রুমি আর কাল বিলম্ব না করে দ্রুত নীচে এসে মাকে ডাক দেয়। উঠোনে গিয়ে বলে,
আস্সালামু আলাইকুম ফাহিম ভাইয়া। কেমন আছেন? আপনাকে আমি প্রথমে চিনতেই পারিনাই। আম্মা তাড়াতাড়ি আসো দেখো কে আসছে।

তুই রুমি না? ওহ মাই গড কত বড় হয়েছিস! কোন ক্লাসে এখন?

রুমি বললো, ভাইয়া আমি অনার্সে,, ২য় বর্ষ।

কি বলোস? আই কান্ট বিলিভ। তারপর
ফলমিষ্টি এগিয়ে দিয়ে বলল, এগুলো ভেতরে নে।

রুমানা বেগম এগিয়ে আসতেই ফাহিম তাকে কদমবুসি করে বলল, আস্সালামু আলাইকুম মামী কেমন আছেন?

আরেহ ফাহিম যে! ওয়ালাইকুমুস্সালাম, দেশে আসছো কবে? কত বছর পর দেখা।

এই তো মামী কয়েকদিন আগেই এসেছি। ভাবলাম আপনাদের দেখে যাই।

ভালো করেছ। আসো ভেতরে আসো। আপা দুলাভাই ভালো আছেন তো?

জ্বি ভালো আছেন।

এতোটা পথ জার্নি করে আসছো, হাতমুখ ধুয়ে নাও আমি ভাত দেই।

না মামী অসময়ে ভাত খাবোনা। আপনি অযথা ব্যস্ত হবেন না।

রুমানা তার কথা শুনলো না, ময়নার মাকে বলে ভাত তরকারী গরম করালো। ফল মিষ্টি সামনে দিলো। সাথে নানান গল্প চলতে থাকলো। ফাহিম ইরহামের মেজো ফুফু সাজেদার বড় ছেলে। স্কলারশীপে কানাডা গিয়েছিল বছর পাঁচেক আগে। পড়া শেষ করে সেখানেই এখন জব করছে। তাদের দেশেরবাড়ি পটুয়াখালী হওয়ায় আসা যাওয়া তুলনামূলক কম।

তৃণা বাড়ি এসেছে আজ দুইদিন হলো। এই দুইদিন সে বরাবরের মতো বেশীরভাগ ঘুমিয়েই কেটেছে। বিকেলে বসার ঘরে বসে সবাই চায়ের আড্ডায় বসলো। রিপার এখন ৭মাস চলে। শরীর অনেকটাই ভার হয়ে এসেছে। তৃণা বলল, মা বলো তো ভাবির ছেলে হবে নাকি মেয়ে?

তাহমিনা বললো, ভাবভঙ্গি দেখে তো মনে হচ্ছে মেয়ে হবে। আল্লাহ ভালো জানেন।

মেয়ে কিভাবে বুঝলে?

গর্ভে মেয়েরা কম জ্বালায়, মায়ের চেহারাও উজ্জ্বল থাকে। আরো টুকটাক কিছু লক্ষণ যা মুরুব্বিরা বলতো সেসব দেখে মনে হলো মেয়ে।

ওহ। এই ভাবি নাম ঠিক করেছ?

তোমার ভাইয়া বলে ছেলে হলে নাম রাখবে, রাইয়্যান, মেয়ে হলে নওরিন।

বাহ!

হ্যাঁ রে তাজু তোর ফ্রেন্ড তানজিনার কি খবর?

ভালোই আছে। ছোটু চল আমরা কোথাও হেঁটে আসি। ভাবি চটপটি খাবে নাকি ফুচকা?

তাহমিনা বলল,নাহ নাহ বাইরে থেকে ঐসব আনতে হবেনা। আমি রান্না করে দিবো নে। তোরা আসবার সময় দোকান থেকে ফুচকার প্যাকেট নিয়ে আসিস।

আচ্ছা।
তৃণা আর তানজিম বেরিয়ে পড়লো। হাঁটতে হাঁটতে দুই ভাইবোন অনেকটা পথ পেরিয়ে এলো। অবকাশ পার্কের বেঞ্চিতে বসে তৃণা বলল, ছোটু কি হয়েছে তোর?

তানজিম বললো, কই কিছু না তো।

আমার চোখ ফাঁকি দেওয়ার ট্রায় করে লাভ হবেনা জানিস তো!

ছোটু মাথা নীচু করে ফেলল।

তৃণা বললো, দুষ্ট বলদ রাখার চেয়ে শূন্য গোয়াল থাকা ভালো। কিছু মানুষ আছে যারা নিজেকে কুল বয় প্রমাণ করতে সিগারেট ফুঁকে, নেশা করে। ওরা যে কতটা বোকা নিজেও জানেনা। ওরা একাই কুল সেজে থাকেনা আশেপাশের গুলোকেও সেই পাঠ দিতে থাকে। আর ভালো ছেলেগুলো ওদের চক্করে খুব সহজেই পড়ে যায়।

আপুনী বিষয়টা তেমন না, আমি…

তৃণা হেসে বললো, আমি তোকে ভরসা করি ছোটু। কিন্তু তোর বয়সটা ভুল করবার। তোকে ভালোমন্দ বোঝানোর দায়িত্ব আমার। একটা ভিডিও দেখেছিলাম বুঝলি। সেখানে বললো বাবা-মা আমরা চুজ করি না। জীবনসঙ্গীও আমরা চুজ করিনা। কেননা এই দুটো আগে থেকে ডিসাইড করা থাকে। তবে একটা জিনিস আমরা নিজেরা পছন্দমতো চুজ করতে পারি। তা হলো বন্ধু। তাই বন্ধু নির্বাচনে আমাদের সতর্ক হওয়া উচিত। ওরা আমাদের জীবনে খুব গভীর প্রভাব রাখে।

হুম।

মন খারাপ করলি?

নাহ আপুনী। তুমি যা বলো আমার ভালোর জন্য বলো এটা আমি জানি। তোমার কথায় মন খারাপ করবো কেন!

তৃণা ভাইয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বললো, আমার লক্ষী ভাই!

আপুনী তুমি বসো আমি ঝালমুড়ি কিনে আনছি।

আচ্ছা।

হ্যালো,

হুম তৃণা বলো।

এখনো অফিসে?

নাহ মাত্র বের হয়েছি।

ওহ।

কি করছো?

বসে আছি।

বাসায় সবাই ভালো আছেন?

হুম ভালো। আপনি আসবেন না?

বৃহস্পতিবার আসবো।

আজ সবে সোমবার!

কি করবো বলো, চাকরী করতে হলে ছুটির দিনের খেয়াল যে রাখতেই হবে!

নাস্তা খেয়েছিলেন?

হ্যাঁ।

আব্বু বলছিল অনুষ্ঠানের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে।

হ্যাঁ আমাকে বলেছিলেন।

কি ভাবলেন?

এই মাসে সম্ভব না আসলে, কিছুদিনের মধ্যে আমাকে একবার জাপান যেতে হবে। আগামী মাসে ডেট ঠিক করলে ভালো হয়।

আচ্ছা! আব্বুকে বলবো।

তোমার জন্য কুরিয়ার পাঠিয়েছিলম, পেয়েছ?

হ্যাঁ।

পছন্দ হয়েছে?

আপনার দেওয়া কোনোকিছুই আমার অপছন্দ হয়না।

ইরহাম মুচকি হেসে বললো, এই তৃণা তুমি সবসময় এমন সুইট থাকবে? কোনো বিশেষ চাহিদা নেই, অল্পতেই তুষ্ট টাইপ মনোভাব। এতো কিউট কেন তুমি?

আমার শুধু একটা জিনিস চাই আপনার সময়,সেটা দিতেও আপনার নানা সমস্যা! অন্যকিছু নিয়ে কি করবো আমি?

আমি ভাবছি এখানে বাসা নিবো। তাহলে আর এই অভিযোগ করতে পারবেনা।

আচ্ছা,সাবধানে বাসায় যান।

আচ্ছা। রাখছি আল্লাহ হাফেজ।

আল্লাহ হাফেজ।

ফোন রেখে তৃণা মায়ের ঘরে গেল। তাহমিনা বললো, এই গয়নাগুলো দেখ তো কেমন?

ভাবির জন্য গড়ালে বুঝি?

হুম।

সুন্দর অনেক।

ওর পছন্দ হবে?

হবেনা কেন? তবুও জিজ্ঞাসা করে দেখো।

এই চেইনটা বানিয়েছি নতুন অতিথির জন্য।

তুমি অনেক ভালো মা! শাশুড়ি হিসেবেও অনেক ভালো। জানো আমার বান্ধবীদের শাশুড়িরা অনেক জাদরেল হয়। আমার তো ভয় লাগে,না জানি আমার শাশুড়ি কেমন!

বেয়াইন একটু গম্ভীর প্রকৃতির মানুষ। তবে খারাপ মনে হয় না। আর শোন মা, মানুষ যেমনই হোক আপন করে নিবি। একটা কথা কি জানিস রক্তের সম্পর্কের মানুষগুলোও কিন্তু সবসময় ভালো হয়না। তবুও আমরা তাদের ঘৃণা করিনা, ছেড়ে দেই না, মুখ ফিরিয়ে নেই না। কারণ যত কিছুই হোক ওরা আমাদের রক্ত। কিন্তু রক্তের বাইরের লোকদের বেলা আমরা এই ছাড় দিতে পারিনা। আপনজন দের সাতখুন মাফ করা গেলেও বাইরের জনের একটা ভুল আমাদের চোখে কাটার মতো বিঁধে। শুধুমাত্র এজন্যই শাশুড়ি কখনো মা হতে পারেনা, আবার ছেলের বৌ ও মেয়ে হতে পারেনা। আপন কে প্রমাণ করতে হয়না সে আপন, কিন্তু পরকে বারবার প্রমাণ করতে হয় সে পর না। আমার মতে সম্পর্ক বদলানোর দরকার কি? মেয়েকে মেয়ের মতো ভালোবাসবো, ছেলের বৌকে ছেলের বৌয়ের মতো। দুজন দুই সম্পর্কে থেকেই আমার কাছে অতি আদরের। রিপা আমাকে মায়ের মতো ভালোবাসুক আমি চাই না। মায়ের মতো কেউ হতে পারেনা। ও আমাকে শাশুড়ি ভেবেই ভালোবাসুক। আমার আপন হয়ে থাকুক ওতেই আমি সন্তুষ্ট। জীবন থেকে বেশি প্রত্যাশা রাখলেই হতাশ হতে হয়। প্রত্যাশা যত কম হবে মানুষ ততোই সুখী অনুভব করবে।

কঠিন তত্ত্ব!

নারে মা, জীবন থেকে পাওয়া শিক্ষা এটা। তোর শাশুড়ি কেমন তা তো গিয়ে সংসার করলেই বুঝবি। তবে আশা রাখিস না বেস্ট হবে। দোষেগুণে মানুষ। মানুষের অনেক সীমাবদ্দতার মধ্যে একটা হলো অন্যের দোষ সহজে চোখে পড়া। ভালোটা দেখতে গেলেই আমরা অন্ধ হয়ে যাই। নিজেকে এমনভাবে প্রস্তুত কর যেন ভালো হলেও যেটুকু সম্মান করার কথা ছিল খারাপ হলেও সেটুকুই বরাদ্দ থাকবে। তুই তোর জায়গা থেকে ত্রুটি রাখবি না। তুলনা করবিনা মায়ের সাথে। ভাগ্যের কথা আমরা বলতে পারিনা। তাই মেয়েদের দুইদিক ভেবেই মনোবল তৈরি করতে হয়, পরিস্থিতি মেনে নেওয়ার মানসিকতা রাখতে হয়।

হুম।

আরেকটা কথা মাথায় রাখিস, যে যেমন কর্ম করে সে তেমনি ফল ভোগ করে। এই দুনিয়ায় না হোক আখিরাতে হলেও ভালোর প্রতিদান পাবি। এটা কখনোই বিফলে যায়না।
তোর দাদীর এতো ছেলে-ছেলের বৌয়েরা থাকতে তিনি আমার হাতেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন। শেষ বয়সে আমি কোথাও গিয়ে এক রাত থাকতে পারিনাই। উনি আমাকে চোখের আড়াল হতে দিতেন না। এই নির্ভরশীলতা, মমতাবোধ একদিনে হয়নি মা। বহুবছর লেগেছে মানুষটার আপন হতে। কত খোঁটা শুনেছি, কত বকা শুনেছি। এমনো গেছে চোখের পানিতে ভাতের পানিতে মিশে একাকার হয়েছে। ননদ দেবরদের ফুটফরমায়েশও কম খাটতে হয়নি। পরের ঘর করা এতো সহজ না রে! কিন্তু এখন দেখ ওরা আমার জন্য জান দিতেও প্রস্তুত, বড় ভাবি বলতেই সবাই অজ্ঞান। ধৈর্য ধরে টিকে থাকতে হয় বুঝলি। সময় বদলাতে কতক্ষণ!

বুঝেছি।

দেখি চল বৌমাকে দেখাই ওর পছন্দ না হলে পরে বদলাতে হবে।

তৃণা তার মায়ের ঘরেই বসে রইলো। এই ঘরে বসে থাকতেও আলাদা শান্তি লাগে।

ঘুমের মাঝেই কপালে কারো স্পর্শ পেতেই তৃণার ঘুম হালকা হয়। সে ভাবে তার মা বুঝি আদর করছে। তাই হাত বাড়িয়ে মায়ের কোল জড়িয়ে ধরে। কিন্তু শাড়ির কোমল ছোঁয়ার বদলে জিন্সের ভারি কাপড়ের স্পর্শ অনুভব হতেই তৃণা চোখ মেলে চায়। ঘুমঘুম চোখে চেয়ে দেখে ইরহাম বসে আছে। তৃণা চোখ বন্ধ করে বলে, ঘুমের মধ্যেও শান্তি দিবেন না। এখন সবজায়গায় আপনাকে থাকতে হয়!

ইরহাম ভ্রু কুঁচকে তাকালো তৃণার দিকে। মেয়েটা তাকে দেখেও আবার ঘুমাচ্ছে! কপালে গাঢ় চুমু খেয়ে বললো, মহারাণী চোখ খুলুন। আমি স্বপ্ন নই,,,

তৃণা ঘুম জড়ানো গলায় বললো, ওটা সবসময় বলেন। চোখ খুললে দেখি আপনি নেই। তারচেয়ে অনুভবে থাকুন এটাই ভালো।

ইরহাম তৃণাকে তুলে বুকের মাঝে জড়িয়ে রাখলো। চুলে হাত বুলাতে বুলাতে বললো, তোমাকে ঘুমের মধ্যে কিডন্যাপ করলেও টের পাবেনা দেখছি! এ তো সাংঘাতিক ব্যাপার।

তৃণা এবার মুখ তুলে চাইলো। ইরহামকে দেখে চমকে উঠলো চিৎকার করে বললো, আপনি সত্যিই আপনি এসেছেন?

আল্লাহ আমার কান গেলো…

ওপস স্যরি! কখন এসেছেন আপনি? আপনার না শুক্রবার আসার কথা?

হুম। কিন্তু আপনাকে দেখার তর সইছিল না, তাই দুপুরে ছুটি নিয়েই চলে এসেছি। দুপুরের ঘুমও কারো এতো গাঢ় হয় আপনাকে না দেখলে জানতাম না।

হুহ! ঘুম তো ঘুমই। এখন সেটা রাতে হোক বা দুপুরে।

তাই নাকি?

হ্যাঁ। আপনি বসুন আমি ফ্রেশ হয়ে আসি।

আচ্ছা।

তৃণা ওয়াশরুমে গিয়ে হাত মুখ ধুয়ে এসে বলল, দুপুরে লাঞ্চ করেছিলেন?

ইরহাম বললো, ওসব ভাবতে হবেনা। আগে আমার সামনে বসো। মন ভরে দেখি।

বুঝেছি। আপনি বসুন আমি খাবার আনছি।

তৃণা বসো, ব্যস্ত হয়োনা। সবাই ঘুমাচ্ছে অযথা ঝঞ্ঝাট করোনা।

দরজা খুলেছিল কে? ছোটু?

হুম।

আচ্ছা। আপনি ফ্রেশ হয়ে বসুন আমি কাউকে ডাকবোনা। আমি নিজেই খাবার আনছি। আর কোনো কথা না।

তৃণা ঝটপট খাবারের থালা নিয়ে বেডরুমে এলো। নিন খাওয়া শুরু করুন।

ইরহাম খেতে বসে বললো, তুমি বুঝি রোজ আমাকে স্বপ্নে দেখো!

উহু বয়েই গেছে।

ইরহাম তরকারি মাখিয়ে এক লোকমা তৃণার মুখে তুলে বলল, এতোক্ষণ খুব ক্লান্ত লাগছিল। এখন আরাম লাগছে!

তাই না?

হুম।

এটা কিসের প্যাকেট?

খুলে দেখো।

আমার জন্য?

আমার কি আর কয়েকটা বৌ আছে?

তৃণা হেসে প্যাকেটটা খুলে দেখল নীল রঙের জামদানী শাড়ি।

নীল রঙের শাড়ি আনলেন!

হ্যাঁ। এই রঙটা তোমাকে অনেক মানায়। তাই ভাবলাম…

কিন্তু আমিতো সচরাচর নীল পড়িনা। মানায় বুঝলেন কিভাবে?

পড়োনা কে বলল? তুমি একবার নীল সাদার কম্বিনেশনের জামা পড়ে মিট করেছিলে না? কানে সাদা পাথরের দুল ছিল, চোখে কাজল দিয়েছিলে। হাতে মেবি ম্যাচ করে রেশমি চুড়িও ছিল।

আপনি সেদিন এতোকিছু কখন দেখেছিলেন? তখন তো তাকান নি ঠিকঠাক!

ইরহাম প্রসঙ্গ পাল্টে বলল, আজ একটু বাসায় যেতে হবে তোমাকে।

কেন?

মেজ ফুফু এসেছেন। তাই

আচ্ছা। এই শাড়িটা পড়বো তাহলে কি বলেন?

হুম।

তৃণা আয়নার সামনে দাড়িয়ে শাড়িটা গায়ে মেলে দেখতে লাগলো, আর ভাবতে লাগলো ইরহাম না দেখার ভান করে থাকলেও সব নোটিস করতো! ছুপে রুস্তম একটা!

চলবে,,,