সে আমার শরৎফুল পর্ব-৩৪

0
219

#সে_আমার_শরৎফুল #পর্ব৩৪

#আরশিয়া_জান্নাত

তৃণার জ্ঞান ফিরতেই সে চারদিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করে কোথায় আছে। রুমি তার শিয়রে বসা, একটু দূরেই রিপা আর তানজিম বসে আছে।
তৃণা দ্রুত উঠে বললো, ইরহাম কোথায়? উনি কেমন আছেন? আমাকে উনার কাছে নিয়ে চলো। ছোটু আম্মু কই? আব্বুকে কল কর না আমাদের তাড়াতাড়ি ঢাকা যেতে হবে তো।

রুমি তৃণাকে জড়িয়ে ধরে বলল, ভাবি শান্ত হও। তুমি অনেক অসুস্থ ভাবি। এমন করো না আল্লাহর দোহাই লাগে।

রুমি তুমি আমাকে শান্ত থাকতে বলছো কিভাবে? তোমার ভাইয়া মেডিক্যালে কি হালে আছেন আল্লাহ ভালো জানেন। ছোটু ভাই আমার উঠ না।আমি ঢাকা যাবো। আমার ভালো লাগছেনা। আমাকে উনার কাছে নিয়ে চল না। আল্লাহ আল্লাহ! প্লিজ আল্লাহ উনাকে সুস্থ করো।

তৃণার কান্না দেখে সবার চোখে পানি এসে যায়। রিপা তাকে আগলে বলে, আপু তুমি শান্ত হও। আম্মুরা সবাই ওখানে আছেন। এতো অস্থির হয়োনা প্লিজ।

ভাবি সত্যি করে বলো না উনি বেঁচে আছেন তো? তোমরা আমাকে ভোলাচ্ছ না তো? আমি উনার কাছে যাবো ভাবি।

আল্লাহর কাছে দোয়া করো আপু। উনি বেঁচে আছেন। তবে..

তৃণা আর বসলো না পার্সটা হাতে নিয়ে ঐ অবস্থাতেই বেরিয়ে পড়লো। তানজিম বলল, ভাবি আমি আপুনীর সাথে যাচ্ছি। সেজ চাচ্চুরা তো আছেই । তুমি চিন্তা করোনা। রুমি আপু ভাবিকে দেখে রেখো।

তৃণা মনে মনে বলল, আমি আপনার কাছাকাছি থাকতে চেয়েছি। সর্বদা আপনার সময় চেয়েছি। আপনার সংস্পর্শে শ্বাস নিয়ে বাঁচতে চাওয়া ব্যতীত কিছু চাইনি জানেন? আপনি আমাকে কাছে রাখেন নি ইরহাম। আমার ব্যাকুলতার ধার ধারেননি। সবসময় দূরে রেখেছেন। ভবিষ্যতের কথা বলে ভুলিয়ে রেখেছেন। কথা দিয়েছেন দূরত্বের সকল বিরহ ঘুচিয়ে দিবেন। অথচ এখন আপনি সেসব ভুলে আমাকে ছেড়ে যাওয়ার পায়তারা করছেন! আপনি কি ভাবছেন আমি আপনাকে এমনি এমনি ছেড়ে দিবো? আপনার কিছু হলে আমি আপনাকে কখনো ক্ষমা করবো না ইরহাম কখনোই না,,,,

হাসপাতালের করিডর পেরিয়ে ইরহামের কেবিনের সামনে এসেই থমকে যায় তৃণা। দরজার গোল গ্লাসে প্রিয় পুরুষটার ব্যান্ডেজে মোড়ানো ক্ষতবিক্ষত দেহটা দেখে বুকটা মোচড় দিয়ে উঠে। না জানি মানুষটার কত কষ্ট হচ্ছে,কিভাবে এতো ব্যথা পেয়েছে সে!

তৃণাকে দেখে তাহমিনা বেগম ছুটে আসেন।
তৃণা মায়ের বুকে কেঁদে উঠে। ভাঙ্গা স্বরে বলে, আম্মু উনার খুব কষ্ট হচ্ছে আম্মু। উনি অনেক ব্যথা পাচ্ছেন আম্মু!

আল্লাহ আল্লাহ কর, বিপদে এতো ধৈর্যহারা হয়না মা। শক্ত হ।

তৃণা ততক্ষণে আবার জ্ঞান হারিয়ে ফেলল।

রুমানা বেগম নিথর হয়ে জায়নামাযে পড়ে আছেন। স্বামীকে হারানোর পর ভদ্রমহিলা দীর্ঘদিন শোকে ছিলেন। তার মনে হয়েছিল এই পৃথিবীতে আর কেউ নেই, কোনোকিছু নেই বেঁচে থাকার মতো। নিজের ৩টা সন্তানের মায়াও ভুলতে বসেছিলেন প্রায়ই। বহুদিন পর স্বাভাবিক জীবনে ফিরছেন তিনি। এখন আবার সন্তানকে হারানোর শোক তিনি নিতে পারবেন না।বুকের ভেতর উথাল পাতাল করা সকল কু’ডাক উপেক্ষা করে তিনি একমনে রবের নিকট ফরিয়াদ করে যাচ্ছেন।
ইরহাম তার বাবার অনুরূপ। তার স্বভাব বৈশিষ্ট্য অনেকটাই মাস্টারসাহেবের সাথে মিলে। ঠান্ডা মেজাজের ধৈর্যশীল ছেলে। ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসি লেগেই থাকে, কথা কম বললেও যতটুকু বলে তাতে তাকে বিনয়ী খেতাব দিতে কেউ দু’বার ভাববেনা। ছেলেটা কত পরিশ্রম করে বাবার ঋণ শোধ করেছে,সংসার সামলাচ্ছে। সবেই তো জীবনটা গুছিয়ে এসেছিল এখনি এই বিপদ এলো!
রুমানার নিজের উপর রাগ হয়। মনে হয় তিনি কেন তার সন্তানদের আদরে আগলে রাখেন না, কেন সময়টা এমনি এমনি পার করেন? এই পৃথিবীতে কেউই যে স্থায়ী নয়, এই কথা অনুধাবন করেও কেন তিনি তার স্বামীর মতো করে সন্তানদের আদরে আহ্লাদে বুকে করে রাখেননি? ছেলেটাকে কোনোদিন আদর করে মাথায় হাত বুলিয়ে দেননি। অন্য মায়েদের মতো ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশও তেমন করেননা তিনি। চাপা স্বভাবের মানুষ হওয়ায় সবার সঙ্গে সহজে মিশতে পারেন না।গম্ভীর মানুষগুলোর মন যে আরো বেশি পুড়ে, তারা সেটা ঠিকঠাক প্রকাশ করতে পারেনা বলে লোকে তাদের নানারকম অপবাদ দেয়। নিষ্ঠুর নির্দয় বলতেও কুন্ঠাবোধ করে না। তাকে এই মুহূর্তে শান্ত অবস্থায় বসে থাকতে দেখলে কেউ হয়তো বুঝতেও পারবেনা তার একমাত্র ছেলে আইসিউতে মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করছে। অন্য কোনো মা হলে হয়তো এতক্ষণে মাতম বাজিয়ে তুলতো!

তাহমিনা হালকা নাশতা এনে বললো, আপা একটু কিছু মুখে দেন। কাল দুপুর থেকে না খেয়ে আছেন। এভাবে না খেয়ে থাকলে অসুস্থ হয়ে পড়বেন তো।

বুঝলেন বেয়াইন মাস্টারসাহেব একা গিয়ে শান্তি পাননি, তার অনুরূপ ছেলেটাকেও সঙ্গে নিতে চাইছেন। আমি কি করি বলেন তো?

এতো ভেঙ্গে পড়বেন না। আল্লাহই বিপদ দেয় তিনিই উদ্ধার করেন। ভরসা রাখেন সব ঠিক হয়ে যাবে।

তৃণা বৌমার কি অবস্থা? ও কোথায় এখন?

স্যালাইন দিয়ে রেখেছে। মেয়েটা বড্ড নরম মনের। জামাইকে এই অবস্থায় দেখে নিজেকে সামলাতে পারেনাই।

ওর কথা কি বলবো বোন। আমার ছেলের যে হাল হয়েছে কোনো শক্তপোক্ত মানুষ দেখলেও স্থির থাকতে পারবেনা। আচ্ছা আপা ডাক্তার কিছু বলছে আর? আমার ছেলে বাঁচবে তো?

জ্ঞান ফেরা অবদি অপেক্ষা করতে বলেছে।

ওহ!

রুমির ফোনে রিং পড়ছে তো পড়ছেই। তার কল রিসিভ করার কোনো‌ হোলদোল‌ নেই। সে রিপার জন্য খাবার তৈরিতেই ব্যস্ত। রিপা বললো, রুমি তোমার ফোনে কল বাজছে!

রুমি ফোনটা রিসিভ করতেই অপরপাশ থেকে বললো, রুমি কোথায় আছিস তুই? বাসায় কেউ নেই কেন?

ফাহিম ভাইয়া?

হ্যাঁ।

আপনি আবার এসেছেন কেন?

আমার মামার বাড়ি আমি যখন ইচ্ছা তখন আসতে পারি। তুই জিজ্ঞাসা করার কে?

ওকে আমি জিজ্ঞাসা করার কেউ না।

কোথায় তোরা?

ঢাকায়

ঢাকায় কেন?

ভাইয়া হাসপাতালে।

মানে কি! কি হয়েছে ওর?

এক্সিডেন্ট করেছে।

কোন মেডিক্যালে আছিস?

ঢাকা মেডিক্যালে।

আচ্ছা আমি আসছি।

বলেই ফাহিম ফোন রেখে দিলো।

ভাবি তুমি ঝাল কম খাও?

নাহ, মোটামুটি খাই।

ওকে।

রুমি একটা কথা বলবে?

কি কথা ভাবি?

তুমি ফাহিম ভাইকে পছন্দ করো?

নাহ।

আমার কিন্তু অন্যটা মনে হচ্ছে!

নাহ ভাবি তেমন নয়। ভাইয়ার পর ফাহিম ভাইয়ের সঙ্গে আমার বেশ সখ্যতা ছিল। উনি আমাকে অনেক স্নেহ করতেন এটা অস্বীকার করতে পারিনা। বিয়ের ব্যাপারটা না এলে আমি উনার সেই স্নেহমমতাকে আজীবন ভাইয়ের আদর বলেই ভাবতাম।

বুঝতে পেরেছি। আসলে এমনি হয় বুঝলে, কাজিনদের মধ্যে কেউ না কেউ প্রেমে পড়েই!
তবে আত্মীয়র মধ্যে আত্মীয়তা আমার ভালো লাগেনা।

হ্যাঁ একদম ঠিক। আব্বা বলতো ঘরের হাড়ির খবর যে জানে তার সঙ্গে সম্বন্ধ করতে নেই। এতে আগের মতো সম্মানবোধ থাকেনা।

তোমার বাবার কথা অনেক শুনি, উনি অনেক ভালো মানুষ ছিলেন। ওয়াসির মতে তিনি আদর্শ মানুষ!

দেখলে বুঝতে ভাবি। আব্বা আসলেই অনেক ভালো ছিল। উনার মহানুভবতা সম্পর্কে যদি জানতে সম্মানে মাথা নুইয়ে পড়তো,,,,

মন খারাপ করোনা রুমি, উনি ভালোই আছেন। ভালো মানুষদের প্রতিদান আল্লাহ দেয়।

ভাইয়ার মতো বললে, ভাইয়া বলে আব্বা জান্নাতেই আছেন। আমার ভাইয়াটাও এখন ভালো নেই। কত বড় একটা বিপদ এলো তার উপর। ভালো মানুষদের উপর বিপদ বেশি আসে। ওর উপর তো একটু বেশিই আসে। একবার কি হয়েছে জানো? আমি আর ভাইয়া একসঙ্গে স্কুলে যাচ্ছিলাম, আমি তখন অনেকটা ছোট। তো রাস্তায় এলোমেলোভাবে যাচ্ছি আর গল্প করছি। পেছন থেকে একটা মোটরসাইকেল আসছিল, ভাইয়া আমাকে বাঁচাতে গিয়ে নিজে রাস্তায় পড়ে গেল, হাত পা ছিড়ে রক্তাক্ত অবস্থা, ৩টা সেলাই করা লাগছে হাতে। ঐ আহত অবস্থায় ও আমাকে একবারো বকা দেয়নি। ওর হাত থেকে রক্ত ঝরছিল দেখে ভয়ে আমি কান্না করেছিলাম, ও একটুও কান্না করেনি। উল্টো আমাকে সরি বলে বারবার দেখছিল কোথাও ব্যথা পেয়েছি কি না। এরপর থেকে এখনো রাস্তায় একসঙ্গে থাকলে বা’পাশে রাখতে ভুলেনা। আর সবসময় পেছনে সামনে সতর্ক দৃষ্টি রাখে। ওর ধারণা আমি এখনো বাচ্চা আছি হা হা,,,

রিপা তাকিয়ে দেখে রুমি ঠোঁটে হাসি নিয়েও অঝোরে কাঁদছে। মেয়েটা বয়সে ছোট হলেও বেশ পরিপক্ক, এটা সে গত ৩দিনে খুব টের পেয়েছে। রুমিকে তার ভীষণ সাহসী বলেই মনে হয়। এই মেয়ে জীবনযুদ্ধে খুব সহজেই টিকে থাকবে।

ইরহামের অবস্থা এখন অনেকটাই শঙ্কামুক্ত। শরীরের বেশ কিছু জায়গায় সেলাই করতে হয়েছে, ৫ব্যাগ রক্তও লেগেছে। হাতের একপাশে গভীর জখম হয়েছে। তবে পায়ের অবস্থা বেশি খারাপ ডান পায়ের ফিমার ফ্র্যাকচার হয়েছে। হয়তো কয়েক মাস রেস্টে থাকতে হবে তাকে। সেসব নিয়ে কারো মাথা ব্যথা নেই। ইরহাম বেঁচে ফিরেছে এতেই সবাই আল্লাহর দরবারে শোকর‌।

চলবে….