#সে_আমার_শরৎফুল #পর্ব৩৭
#আরশিয়া_জান্নাত
বসার ঘরে পিনপতন নিরবতা। সবার দৃষ্টির কেন্দ্রবিন্দু পর্দার আড়ালে থাকা নারীটির দিকে। কেবল তৃণাই রুমির দিকে চেয়ে আছে। এই মুহূর্তে একমাত্র রুমি-ই শান্ত ভঙ্গিতে ডাইনিং এ বসে আছে। এমনভাবে মিষ্টি খাচ্ছে যেন এসব কিছু তাকে অবাক তো দূর মনোযোগ ও টানতে ব্যর্থ।
রুমানা বেগম স্পষ্ট গলায় বললেন, আপনারা কি শুনেছেন বা কার কাছে কেমন শুনেছেন আমি জানি না। তবে অনুমান করতে পারছি ভালোভাবে শুনেননি। রুমি আমাদের রক্তের মেয়ে না এটা সত্যি, তবে ওকে আমি কিংবা ওদের বাবা কখনোই পর ভাবিনি। না ওকে পালিতকন্যা বলে ভেবেছি। ও আমাদের সন্তান। এটাই এখন ধ্রুব সত্য। আর বাকি রইলো ওর জন্মের পরিচয়। ওর মা-বাবা দুজনেই উচ্চশিক্ষিত, ভালো বংশের মানুষ ছিলেন। ধর্মমতে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হবার পরই রুমির জন্ম হয়। এরপরো যারা ওকে জারজ বলে অভিহিত করে তাদের সম্পর্কে আমার কিছু বলার নেই।
একজন টিপ্পনী কেটে বললো, এতোই যখন ভালো পরিবারের মানুষ ছিল এতোসব কুৎসা রটলো কেন?
অনুমান নির্ভর বা কল্পনাপ্রবণ মানুষের মনের কথা আমি কি করে জানবো? সাধারণ ছন্দের বাইরে কিছু ঘটলেই যে তা পরিত্যাজ্য এমন মনোভাব রাখলে কয়জনকে সাফাই দেওয়া যায়?
কাশফাতের বাবা কবির সাহেব গম্ভীরস্বরে বললেন, এতো বড় বিষয়টা গোপন রাখা ঠিক হয়নি। আপনাদের আগেই সব বলা উচিত ছিল।
তাদের নিরবে প্রস্থান দেখে উপস্থিত সবাই বুঝে নিলেন বিয়েটা আর হচ্ছে না….
ওয়াজেদ সাহেব দাঁড়িয়ে বললেন, আমি আজ উঠি।
বেয়াই সাহেব খালি মুখে উঠবেন না। আপনি এখন আমাদের পর নন। আপনি দয়া করে বসেন। বৌমা নাস্তাপানির ব্যবস্থা করো।
ইরহাম দীর্ঘশ্বাস ফেলে সোফায় হেলান দিয়ে মাথার উপরে ঘূর্ণায়মান ফ্যানটার দিকে তাকালো। এতো ভালো সম্বন্ধটা ভেঙে গেছে এ নিয়ে তার এই মুহূর্তে বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা নেই। তার মনটা অস্থির কেবল এই ভেবেই রুমির উপর দিয়ে কি ঝড়টা যাচ্ছে। ও এতোবড় সত্যি মেনে নিবে কিভাবে? আজ সে বুঝতে পারছে কেন তার বাবা সবসময় বলতো, পুরো পৃথিবী যাই বলুক যাই করুক,ওদের কথায় তুই কখনো তোর ২ বোনের সঙ্গ ছাড়বিনা, ওদের মধ্যে বিভেদ করবিনা। আমার পরে তুই সবসময় ওদের ঢাল হয়ে থাকবি!
রুমানা নিজের ঘরে গিয়ে বসলেন। পুরনো ফটো অ্যালবামটা বের করে সম্মুখে রাখলেন। প্রিয়ার ছবিটা এখনো কি সুন্দর ঝকঝক করছে। ছবিটা তখন লেমনেটিং করে রেখেছিলেন তিনি, প্রিয় বান্ধবীর ছবি বলে কথা!
প্রিয়া! অতি চমৎকার একটা মেয়ে ছিল। সেই সময়ে অন্য পাঁচটা মেয়ের চেয়ে তার রুচিবোধ ছিল সবচেয়ে উন্নত। ধনী পরিবারের মেয়ে হওয়া সত্ত্বেও সে ছিল নিরহঙ্কারী। চঞ্চল প্রকৃতির মেয়েটা সবার সঙ্গে অল্পতেই মিশে যেত। গরীব ধনী কোনো বিভেদ করতো না। এই অতি রূপবতী মেয়েটার জন্য কত নামীদামি লোকের সম্বন্ধ এসেছিল। সেসব তুচ্ছ করে কেবল ভালোবাসার টানে ভার্সিটির সিনিয়র ভাই রাজীবকে গোপনে কাজী অফিসে বিয়ে করে। বিয়ের ৪ মাস পর ব্যাপারটা জানাজানি হয়ে যায়। ওদিকে রাজীব তখন শহরে নেই নিজের দেশের বাড়িতে গেছে জরুরি খবর পেয়ে। চিঠিপত্র বা টেলিগ্রাফ পাঠাবে সেই পথও ছিল না। প্রিয়ার বাবা মোস্তফা চৌধুরী নিজের মেধাবী মেয়ের এহেন বোকামো দেখে মহাবিরক্ত হন। তার মতে ছেলে প্রতারণা করে পালিয়েছে। এই ছেলে আর ফিরবেনা। প্রিয়া রাজীবের বন্ধু সহপাঠীসহ পরিচিত সবার কাছ থেকে ওর খবর নিতে থাকে। কিন্তু কেউ ই সলিড খবর বলতে পারেনা। দিন পেরিয়ে মাস হয়ে যায় রাজীব ফেরেনা, না কোনো খবর আসে। কাবিননামায় লেখা এড্রেস অনুযায়ী লোক পাঠায়, খবর নেওয়ার নানান চেষ্টা করে। কিন্তু কোনোভাবেই রাজীবের সন্ধান আর মেলেনা। সেই হতাশাময় প্রহরে আরেকটি দুঃসংবাদ হয়ে আসে গর্ভে অনাগত সন্তানের উপস্থিতি। সবাই সিদ্ধান্ত দেয় এই বাচ্চা রাখা যাবেনা। বিয়ের ব্যাপারে সবাই জানেনা যখন বাচ্চার ব্যাপারেও জানার দরকার নেই। তাছাড়া যে বাচ্চার বাবা কই আছে তার নিশ্চয়তা নেই, সে কি আদৌ ফিরবে তা নিয়েও বিস্তর সংশয়। এমতাবস্থায় নতুন অশান্তি ঘাড়ে তোলার মানে হয়না। কিন্তু প্রিয়া তাতে রাজী হয়না। বাপের বাড়ি থেকে পালিয়ে দূরে থাকা প্রিয় বান্ধবীর বাড়িতে আশ্রয় নেয়। ওর বিশ্বাস ছিল বাচ্চাসমেত বাড়িতে উপস্থিত হলে কেউ আর কিছু করতে পারবেনা, এরমধ্যে নিশ্চয়ই রাজীবের সন্ধানও মিলবে…
আম্মা আসবো?
রুমির ডাকে ধ্যান ভাঙে রুমানার, ধীর গলায় বললেন,
আয়
কি দেখছো আম্মা আমার মায়ের ছবি?
রুমানা শান্ত স্বরে বললো, তুই সব জানতি তাই না?
রুমি হেসে বললো, সত্যি কখনো চাপা থাকে না আম্মা। সেটা সূর্যের আলোর মতো ছড়িয়ে পড়ে এখন যতোই ঢেকে রাখো না কেন!
রুমি! তুই অবৈধ না…
বৈধ অবৈধ ঐসবের হিসাবনিকাশ করছিনা, সমাজের চোখে যা গোপন তাই অবৈধ! এখন তুমি তোমার বান্ধবীর হয়ে যতোই ওকালতি করো কেউ মানবেনা।
আমি মিথ্যের পক্ষে থাকিনা এটা তো জানিস?
রুমি অ্যালবামটা নিয়ে বললো, সেদিন সাজেদা ফুফুর সঙ্গে তোমার কথোপকথন সবটাই আমি শুনেছিলাম। উনার কথার যুক্তি আমি ফেলতে পারছিনা। একজনের মৃত্যু তে সবাই মরে যায়না, আমার মা মরেছে মানলাম তার আত্মীয়স্বজন কোথায়? কিংবা আমার বাবার পক্ষের লোকই বা কই? কেন তোমাদেরকেই এই পাপের বোঝা অর্পণ করা হয়েছে? তোমরাই বা কেন নিতে গেলে? এতো বছরে একবারও কেউ আসেনি কেন আমার খোঁজে? এসব কিছু কি প্রমাণ করেনা আমি এই সমাজের চোখে সাধারণ এতিম নই?
রুমানা বাকরুদ্ধ হয়ে বসে রইলেন। রুমি ফের বলল,
আম্মা জানো, আমি কিছু দিন আগেও ভীষণ প্রাউড ফিল করতাম, আমি তোমাদের সন্তান ভেবে। আমার আদর্শ বাবার কথা সবাই যখন বলে বুকটা গর্বে ভরে উঠতো। অথচ দেখো বাস্তবতা আমাকে নর্দমার কীটে পরিণত করেছে। আমার জন্ম নিয়ে সবাই প্রশ্ন তুলছে, আমি নিজেও জানিনা কে আমার আসল বাবা, সে কি আদৌ ভালো মানুষ ছিল? তাদের বিয়ে হয়েছিল নাকি আমি কারো নিষিদ্ধ আবেগের ভুল! আমার মা-যে তোমায় মিথ্যা বলেনি তারই বা কোনো প্রমাণ কি আছে? আজ কেউ নেই আম্মা যে আমাকে এই কঠিন বাস্তবতা থেকে বাঁচাবে, কেউ নেই যে এই কলঙ্কের কালী মুছতে পারবে। আমার প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিতে পারবে,,,
রুমি! চুপ কর আল্লাহর দোহাই লাগে! আমার মৃত বান্ধবীটার নামে এসব বলিস না। ও তেমন মেয়ে নয় যেমনটা তোরা সবাই ভাবছিস।
রুমি ম্লান হাসলো, ঠোঁটের কোণে করুণ হাসি রেখেই বললো, আম্মা একটা সত্যি বলি শুনবে? তুমি মুখে বললেও কোথাও না কোথাও তুমিও সন্দিহান ছিলে, তাই তো সবসময় আমার উপর কড়া নজরদারি করতে। ফুফুর মতো তোমার মনেও ভয় ছিল আমি আমার মায়ের মতো কিছু করে তোমার নাক কাটবো। যদি তুমি নিজের বান্ধবীর উপর শতভাগ আস্থা রাখতে পারতে তবে আমার উপরো আস্থা থাকতো…..
রুমানা ঠাঁই হয়ে বসে রইলো, উত্তর দেওয়ার মতো কোনো শব্দই তার মাথায় আসছেনা।। আজ তার মনে হচ্ছে রুমিকে যতোটা অবুঝ তিনি ভাবতেন রুমি ততোটা অবুঝ আর নেই। ও অনেক বেশি বুঝদার আর বুদ্ধিমতি। এই অতি বুদ্ধিমতি মেয়েদের জীবন কখনো সহজ হয়না। ওরা প্রতি পদে কষ্ট পায়। কেননা এই পৃথিবীতে যে যত বোকা হয় সে ততো সুখী হয়!
।
তৃণা ইরহামের কাঁধে হাত রেখে বলল, এতো ভেঙে পড়ছেন কেন? শক্ত হোন, নিজেকে সামলান।
ইরহাম তৃণার কোমড় জড়িয়ে কেঁদে ফেলল, তৃণা তার মাথায় হাত বুলিয়ে বললো, কিছু বদলায় নি ইরহাম। সব আগের মতোই আছে। রুমি আপনার ছোটবোন। আমাদের সবার আদরের বোন। অন্য কোনো কিছু মনে রাখার দরকার নেই।
রুমি অনেক ছোট তৃণা, ওর উপর দিয়ে এতো বড় ঝড় যাচ্ছে, আমার বোনটা নিজেকে সামলাবে কিভাবে? আমি ওকে কিভাবে হ্যান্ডেল করবো? আজকে আব্বাকে অনেক মনে পড়ছে তৃণা। উনি থাকলে আমাকে কিছু ভাবতে হতোনা। আমার খুব অসহায় লাগছে…
আমরা সবাই আছি তো। আমরাই ওকে সামলে নিবো। আল্লাহর উপর ভরসা রাখুন সব ঠিক হয়ে যাবে।
রুমি কোথায় জানেন? বিয়ে টাও ভেঙে গেল, ও এতো ধকল কিভাবে নিবে! আমি ওর ভাই হয়েও কিছু করতে পারলাম না।
মায়ের ঘরে আছে, তাছাড়া বিয়ে ভাঙলো কে বলল? যদি কাশফাত ভাইয়া সত্যিই ওকে ভালোবাসে তবে তিনি এসব তোয়াক্কা করবেন না। আর ভেঙে দিলেও সমস্যা নেই, ওর জীবনে যোগ্য কেউ নিশ্চয়ই আসবে, যে সত্যিটা জেনেই ওকে আপন করে নিবে। আপনাকে এখন শক্ত ঢাল হতে হবে, আমি আছি আপনার পাশে। আপনি কান্না থামান প্লিজ।
ইরহাম নিরবে তাকে আঁকড়ে রাখলো। তৃণা নিজেও জানেনা এই ঝড়টা কোথায় গিয়ে থামে, কি কিই বা লন্ডভন্ড হয় এই ঝড়ে!
চলবে,,,
#সে_আমার_শরৎফুল #পর্ব৩৮
#আরশিয়া_জান্নাত
ভোরের আলো জানলা গলে জায়নামাজে পড়ছে, রুমানা বেগম ফজরের নামাজ শেষ করে সেখানে ই বসে আছেন। রুমির একটা সুন্দর ভবিষ্যৎ এর চিন্তায় তারা কত কি করেছে। নিজের ছেলেমেয়েদের ও জানতে দেয়নি রুমি তাদের সন্তান না। ওরা যদিও কিছু টা বড় ছিল, কিন্তু এখনকার বাচ্চাদের মতো অল্প বয়সে এতোশত বুঝতে পারেনি। হাসপাতাল থেকে ছোট্ট একটা শিশুকে কোলে নিয়ে বাসায় ফেরার পর ওদের ছোটবোন এসেছে বলতেই ওদের আর কোনো প্রশ্ন ছিলনা। বোন পাওয়ার খুশিতেই ওরা মগ্ন ছিল। গ্রামের পাড়াপ্রতিবেশীদের মধ্যে বড়োরা বিষয় টা জানলেও উপজেলায় এসে বসতি স্থাপনের পর সময়ের সাথে ব্যাপারটা এক প্রকার চাপাই পড়ে যায়। ফয়েজ সাহেব শুধুমাত্র রুমির আসল পরিচয় গোপন রাখতেই গ্রামের বাড়িটা রেখে শহরের দিকে জায়গা কিনে বিল্ডিং করেন আজ থেকে ২১বছর আগে। রুমির বয়স এখন ২২ চলে। সে এখানেই বড় হয়েছে, তাদের সকলের আদরের মধ্যমণি হয়ে রয়েছে। রুমানা ব্যতীত কেউই তাকে কখনো জোরে বকা পর্যন্ত দেয়নি। ফয়েজ সাহেব তো তাকে নিজের আপন সন্তানের মতোই বুকে করে রেখেছিলেন সর্বদা। আসলে সত্যি এমনই হয়, এর দ্যুতি লুকিয়ে রাখা যায়না। একসময় না একসময় তা বেরিয়ে আসেই স্বতঃস্ফূর্তভাবে। একটুও ফাঁকফোকর রাখেনা।
রুমানা কিংবা ফয়েজ সাহেব চাইলেই এই সত্যিটা প্রকাশ রেখেই ওকে লালন পালন করতে পারেন। কিন্তু মেয়েদের জীবন অনেক নাজুক হয়। পালিত মেয়ে শুনলে অনেকেই নাক কুঁচকে নেয়, অবহেলার পাত্র হয়। তাছাড়া ওর বাবা-মায়ের বিতর্কিত সম্পর্কের পরিপ্রেক্ষিতে বিষয়টা গোপন রাখাই তখন শ্রেয় মনে হয়েছে। এ নিয়ে না তাদের কখনো অনুতাপ ছিল, না হবে। কিন্তু সাজেদার কথায় সেদিন রুমানা ভীষণ তটস্থ হয়েছিলেন। তিনি কোনোভাবেই চাইছিলেন না এটা প্রকাশ হোক। তাইতো ফাহিমকে রুমির জন্য তার এতো পছন্দ হওয়া সত্ত্বেও না বলেছিলেন। লাভের লাভ কি কিছু হলো? মাঝখানে ক্ষতবিক্ষত হতে হচ্ছে আজ, সারা পাড়া খবরটা রটেও গেছে হয়তো!
রুমির জন্য তার মনটা হাহাকার করে উঠছে। তিনি কিভাবে সামাল দিবেন তার এই ছোট্ট পাখিটাকে?
সারারাত বারান্দায় বসে থেকে শেষ রাতে বিছানায় গা এলিয়েছিল রুমি। তাই এই মুহূর্তে গাঢ় ঘুমের মাঝে কানে আসা রিংটোনটা বিশেষ পাত্তা পাচ্ছেনা। কিন্তু ফোনের অপরপ্রান্তের মানুষ টা বড্ড অস্থির। সে ক্লান্তিহীন ভাবে কল দিয়েই যাচ্ছে। যেন এখন রুমির গলা না শোনা অবধি তার স্বস্তি মিলবেনা।
রুমি অনেকটা বিরক্ত হয়ে ঘুমঘুম চোখে ফোনের স্ক্রিনে তাকালো। অচেনা নাম্বার দেখে কলটা রিসিভ করলোনা। রিং কেটে যেতেই দেখে নোটিফিকেশন বারে ৪৫টা মিসড কল উঠে আছে। এতোবার তাকে কল করবে এমন অচেনা মানুষ এই পৃথিবীতে তার কি আছে? ঘুমের রেশ কিছু টা কাটতেই আবার কল এলো।
হ্যালো আস্সালামু আলাইকুম কে বলছেন?
কি রে কখন থেকে কল করছি ধরিস না কেন?
ফাহিম ভাই? আপনি এতো ভোরে কল করবেন কে জানতো? তাছাড়া নাম্বার তো চিনিনা…
দরজা জানালা আটকে পর্দা দিয়ে রুম অন্ধকার করে ভাবছিস এখনো ভোর! এদিকে বেলা গড়িয়ে দুপুর হয়ে গেছে আর তুই পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছিস? ক্লাস ছিল না তোর আজ?
কেন ফোন করেছেন তাই বলুন,
রুমি তুই কি অসুস্থ?
নাহ তো
তোর গলা এমন শোনাচ্ছে কেন?
আমার সঙ্গে আপনি কখনো কলে কথা বলেননি, তাই হয়তো এমন মনে হচ্ছে।
আচ্ছা শোন কল করেছি একটা জরুরি কথা বলতে।
বলুন শুনছি,
তোর এনাইডি কার্ড হয়েছে না?নাকি এখনো বার্থ সার্টিফিকেটে চলিস?
আমার এনাইডি দিয়ে আপনার কাজ কি?
এতো প্রশ্ন না করে যা জিজ্ঞেস করছি আনসার দে।
২২ বছরের মেয়ের এনাইডি থাকবেনা?
তোর ২২ হয়ে গেছে নাকি? দেখে তো মনে হয়না।
ফাহিম ভাইয়া আপনি সত্যিই এসব বাজে আলাপ করতে আমার ঘুম ভাঙলেন? জানেন আমি সারারাত একরত্তি ঘুমাতে পারিনি। আমার চোখ জ্বালা করছে ঘুমে..
তোর হবু বর এমন বেআক্কেল হলে আমার কি করার? আমিতো ভাই এভাবে রাতবিরেতে কল করে নিজের বৌকে নির্ঘুম রাখতাম না।সে যাই হোক তোর এনাইডিটা আমার লাগবে। ঘুম থেকে উঠে ছবি তুলে পাঠাইস। ভুলিস না কিন্তু।
আমি আপনাকে কেন দিবো? কাজ কি আগে শুনি?
তুই কি ভাবছিস তোর এনাইডি দিয়ে আমি তোর জায়গা সম্পত্তি লুট করবো? নাকি তোর একাউন্ট হ্যাক করবো!
করতেই পারেন, ভরসা কি? তাছাড়া এনাইডি এখন বায়োমেট্রিক রিস্ক নিয়ে লাভ আছে?
এই রুমি কয় কোটি জমা করলি রে? মানছি বিশাল ধনী পরিবারে তোর বিয়ের আলাপ হয়েছে, তোর কাছে কয়দিন পর লাখ দশেক টাকা তোর কাছেহাতের ময়লা হয়ে যাবে। তাই বলে আমাকে সামান্য এনাইডির ছবি দিয়ে ভরসা করতে পারছিস না!
রাখছি ভাইয়া।
এই রাখছিস মানে! এই দাঁড়া…
রুমি ফোনটা রেখে ফোন সাইলেন্ট করে দিলো। মনমেজাজ এমনিই খারাপ তার উপর বাইক্কা আলাপ শুনতে কার ই বা ভালো লাগে!
।
চায়ের কাপটা টেবিলে রেখে তৃণা বললো, আগে ভালোমতো সুস্থ হয়ে উঠুন তারপর নাহয় কাজ করবেন!
ফিল্ডে যেতে না পারি অনলাইনে যতোটা সম্ভব একটু করতে হবেনা!
তৃণা খাটে বসে বললো, মডেল স্কুল থেকে কল এসেছে। আমি কি জয়েন করবো?
কেন করবেনা? তোমার ইচ্ছে হলে অবশ্যই করবে। সরকারি স্কুলের টিচার হবার চান্স কে হাতছাড়া করে?
আম্মার আপত্তি হবে?
আশা করছি হবেনা।
আচ্ছা!
তৃণা?
হুম?
তুমি কি কোনোকিছু নিয়ে চিন্তিত?
নাহ তেমনটা নয়, ভাবছিলাম একটা বিষয়ে।
ইরহাম ওর দিকে ফেরে বলল, আমাকে বলা যায়?
রুমি খুব স্বাভাবিক ভাব নিয়ে আছে, এটা আমাকে ভাবাচ্ছে। এমন নয়তো ও আমাদের সামনে ন্যাচারাল আছে কিন্তু ভেতরে ভেতরে কষ্ট পাচ্ছে?
আমিও সেটা ভাবছিলাম, কিন্তু কথাটা তুলে ওকে বিব্রত করতে চাইছি না। বলতে পারো আমরা একে অপরের কাছ থেকে মুখ লুকিয়ে বাঁচার চেষ্টা করছি।
হ্যাঁ সেটাই দেখছি, মা আজকাল বসার ঘরে বসেন না। খাবারটাও সবার সঙ্গে খেতে আসতে চান না। কিন্তু এটা তো সমাধান নয়। এরকম করে ব্যাপারটা আরো ঘোলাটে হচ্ছে!
আম্মা বরাবরই এমন করেন। এ আজ নতুন না। তবে আমার কথা বলা উচিৎ। আসলে কি বলবো বুঝিনা। মাথা শূন্য হয়ে যায়…
সময় টা যাক, সব ঠিক হয়ে যাবে।
তুমি এক কাজ করতে পারো, ওকে নিয়ে বাইরে কোথাও ঘুরে এসো। তুমি নিজেও ঘরবন্দি হয়ে গেছ। আমার যত্ন করতে করতে বাইরে কোথাও বেড়াতে পারছোনা,,
এভাবে বলার মানে কি ইরহাম? আপনার সেবা করতে পারছি, কাছাকাছি থাকতে পারছি এতেই আমি অনেক আনন্দিত।
ইরহাম ওর গালে হাত রেখে বলল, তুমি অনেক লক্ষী একটা মেয়ে।
তাই নাকি?
হুম। তোমার মতো বউ পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার।
এতো মাখন দিয়ে কাজ নেই। সুস্থ হলে আপনার সঙ্গে অনেক বেড়াবো। একটা ছুটির দিন বাদ দিবোনা।
হাহাহা..
আপনি কাজ শেষ করুন, আমি রান্না শেষ করে আসছি।
আচ্ছা
ইরহাম চায়ে চুমুক দিয়ে ফের কাজে ডুব দিলো।
কলেজ গেইটের সামনে কাশফাতকে দেখেও রুমি না দেখার ভান করে এগিয়ে গেল।
কাশফাত ওর সামনে দাঁড়িয়ে বললো, রুমি একটু দাঁড়াও জাস্ট ৫টা মিনিট দাও আমার কিছু কথা বলার আছে।
দেখুন অযথা সিন ক্রিয়েট করবেন না। আমি আপনার সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছুক না।
প্লিজ রুমি! জাস্ট ৫মিনিট।
রুমি তার দিকে তাকিয়ে বললো, কি বলার ঝটপট বলুন।
এখানে না, চলো কোথাও বসি?
রুমি কলেজের পাশের ক্যাফেটেরিয়ার দিকে তাকিয়ে বললো, ওখানে চলুন।
কাশফাত অপরাধীর মতো মাথা নত করে বললো, রুমি আমি দুঃখিত। আসলে সত্যিটা এমন হবে আমরা কেউ প্রস্তুত ছিলাম না।
দুঃখ প্রকাশ করার ফর্মালিটি করতে হবেনা। তাছাড়া আপনাদের কোনো ভুল তো দেখছিনা আমি! সরি হবার কি আছে?
বিয়ে ঠিক হবার পর ভেঙে যাওয়া একটা মেয়ের জন্য কতটা মর্মান্তিক আমি জানি। কিন্তু কি করবো বলো আমার পরিবার কিছুতেই রাজী হচ্ছেন না।
আপনি কি সান্ত্বনার বাণী আওড়াতে সময় চেয়েছেন? বিশ্বাস করুন আমার এটা লাগবেনা। আমি তাকদীরে খুব বিশ্বাস করি, বিয়ের আগমুহূর্তেও অনেকের বিয়ে ভেঙে যায়। তাদের তুলনায় আলহামদুলিল্লাহ আমি অনেক বেটার পজিশনে আছি। আংটি বদল আমার কাছে বিশেষ কিছু না। আমি এই ভেবে শোকরগুজার বিয়ের আসর অব্দি যেতে হয়নি। নয়তো আমার পরিবারের ভীষণ অপমান হতো। আর শুনুন পরিবারকে মানানোর চেষ্টা করা বন্ধ করে দিন। আমি চাই না আপনার সঙ্গে আমার বিয়ে হোক।
এখন আমাকে বুঝ দিতে মুখে এই কথা বলছো,আমার প্রতি কি তোমার একটুও অনুভূতি জন্মায়নি?
অন্যদের কেমন জানি না তবে আমি সহজে কারো প্রতি আসক্ত হতে পারিনা। আপনার সঙ্গে বিয়ের কথাবার্তা এগিয়েছে পরিবারের সম্মতিতে। এর মাঝে আবার নানান সমস্যায় আমরা সবাই জর্জরিত ছিলাম। কিছু বুঝে উঠবার আগেই বিয়ে ভেঙ্গে গেল, অনুভূতি জন্মানোর সময় কই?
কাশফাত বিমূঢ় হয়ে গেল রুমির কথায়। সে বুঝে উঠতে পারছেনা রুমি কি এসব মনের কথা বলছে নাকি মিথ্যা বলছে! কাশফাত কিছুক্ষণ নিরব থেকে বললো, আমি তোমাকে বুঝতে পারছিনা।
রুমি হাসলো। হেসে বলল, মেয়েদের বুঝতে হয় না, ওদের জাস্ট মন উজাড় করে ভালোবাসতে হয়। ওতেই আমরা তুষ্ট হয়ে যাই। কিন্তু দুঃখের বিষয় ছেলেরা তাদের বুঝতে গিয়ে খেঁই হারিয়ে ফেলে, ভালোবাসার আর সময় পায় না!
যাই হোক আশা করি আপনার সামনের জীবন অনেক সুন্দর হোক। ভালো থাকবেন।
রুমি বের হয়েই রিকশা নিলো। আজ সে রিকশায় ঘুরে বেড়াবে, এখুনি বাসায় ফিরবেনা।
চলবে,,