সে জন সোনা চিনে না পর্ব-০২

0
16

#সে_জন_সোনা_চিনে_না
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ২

— বাসর রাতে বর রেখে দুলাভাই এর সাথে কি হু?

— বাসর রাত আমার নাকি আপনার দুলাভাই?

ইফাত থতমত খেলো। যথেষ্ট ভদ্র গোছের এক নম্র ব্যাক্তি সে। চোখটা তুলে সচারাচর মহিলা মানুষ দেখা হয় না তারমধ্য বউ তাকে যথেষ্ট সন্দেহ করে। এই যে এখন একমাত্র শালীর সাথে কথা বলছে সম্মুখ বরাবর বসে আইসক্রিম খাচ্ছে তার একমাত্র বউ। সে ই ইফাতের হাতে ফোনটা দিলো যাতে দুপুরের সাথে কথা বলে। দুলাভাই মানুষ, তার উপর দুপুরের সাথে তার সখ্যতা যথেষ্ট। ইফাত তাকালো সন্ধ্যা’র দিকে। সন্ধ্যা চোখের ইশারায়ই যেন বলছে, “শালী’কে বুঝ দাও”। ইফাত ঢোক গিলে। ফিচেল স্বরে বলে,

— আমার বাসর তিন বাছরের উপর হলো চলমান। তুমি আমার বোন হও দুপুর। নতুন বর, তাই ফোন দিলাম। ভয় পেয়ো না আবার। দু’জন আজ গল্প করবে। নিজেদের জানার চেষ্টা করবে। আনডাসট্যান্ডিং থাকাটা সম্পর্কে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বুঝলে?

দুপুর মাথা নাড়ায়। বলে,

— দুলাভাই, শালী হই আমি আপনার। শালী মানে আধে ঘরওয়ালী কিন্তু আপা’কে নিয়ে আপনি আছেন চট্টগ্রাম এদিকে যে আপনার আধে ঘরওয়ালীকে কালো মানিক নিয়ে নিলো তাতে আপনার হেলদুল নেই। উল্টো বলছেন রিলেশন নিয়ে কথা। এই শিক্ষা আপনার সরকারি চাকরির? বাবা কি জানে আপনি আমাকে রিলেশনশিপ এর উপর লেকচার দিচ্ছেন?

ইফাত শশুরের কথা শুনে ঘামতে লাগে। তার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। তোতলানো স্বরে বলে,

— শশুর আব্বা ভালো আছে?

— নেই আবার?

— দুপু?

— হ্যাঁ, দুলাভাই। বলুন।

— তুমি খুশি তো বোন?

দুপুর পা নাড়লো। হাতের নখ গুলো দেখতে দেখতে বললো,

— খুশি কি না তা তো জানি না।

— এটা কেমন কথা দুপুর? তুমি খুশি কি না তা তুমিই জানো না?

— না তো।

— আচ্ছা, তাহলে বলো সদ্য বিয়ে করার পর তোমার অনুভূতি কি?

— অনুভূতি সহজ, সরল। জটিলতা নেই। না আছে কুটিলতা। যা আছে তা পাতা-লতা।

— মানে?

ইফতি হতভম্ব। এই দুপুরের কথার মারপ্যাঁচ ও বুঝে না। নিতান্তই সহজ এক পুরুষ সে। দুপুর উত্তর দিলো,

— অনুভূতি লতা-পাতার ন্যায় সহজ দুলাভাই। মানুষটাকে দেখে তাই মনে হলো এতক্ষণে। সহজ সরল একজন মানুষ। তবে এখানে কথা আছে?

— কি কথা? কি কথা?

ইফতি আঁতকে উঠেছে। চাপা হাসলো দুপুর। বললো,

— এক দেখায় কি মানুষ চেনা যায়? যায় না। তাই আগে দেখে নেই সে কেমন এরপর আপনাকে জানাব। কি চলবে না?

— হ্যাঁ। চলবে।

তাদের সংযোগ বিছিন্ন হলো। সন্ধ্যা কটমট করে বললো,

— তোমাকে বললাম কি আর তুমি করলে কি?

— কি করলাম?

অসহায় স্বর ইফতির। সন্ধ্যা নিরাশ হয়ে বলে,

— আমার কথা তো শুনে না তাই তোমাকে বললাম ওকে বুঝাও। বলো রুমে যেতে। নতুন বর রুমে বসা এদিকে ও ঠ্যাং ঠ্যাং করে বাড়ীতে ঘুরছে। মা-বাবা কিছু বলতে পারছে না। দাদী ঘুম নাহয় তো দাদীই বলতো। মায়ের সাথে ওর সম্পর্ক ততটা গভীর না তুমি তো জানো।

শেষ বেলায় সন্ধ্যার গলার স্বর কেঁপে উঠলো। ইফতি উঠে খাটে এলো। বউয়ের কাঁধে হাত রাখলো। মাথায় হাত রেখে বললো,

— চিন্তা করো না সন্ধ্যা।

— নিজেকে দায়ী মনে হয় জানো।

— তুমি দায়ী না সন্ধ্যা। তুমি অবুঝ ছিলে।

— আমিই দায়ী। আমিই। অতটাও অবুঝ ছিলাম না। আপন র’ক্তের বোন ও আমার অথচ…..

থেমে গেলো সন্ধ্যা। ইফতির হাত চেপে ধরলো। টলমলে চোখে তাকিয়ে বললো,

— আচ্ছা, ইফতি এরজন্যই কি আমি নিঃসন্তান?

ইফতির শরীরের র’ক্ত দ্রুত বেগে ছুটতে লাগলো। তার মনে হচ্ছে বুকের বা পাশে ব্যথা হচ্ছে। সন্ধ্যা’কে বুকে জড়িয়ে নিলো আলগোছে। শুধু বললো ক্ষীণ স্বরে,

— এ কথা দ্বিতীয় বার বলো না সন্ধ্যা। এই অধমের এক অমূল্য সম্পদ তুমি।

__________________

দুপুর টিভি দেখছিলো ড্রয়িং রুমে বসে। এদিকে বাবাও পারছে না এসে বলতে মেয়েকে রুমে যেতে। ওদিকে আবার নতুন জামাই একা ঘরে। জোর করে তিনিই রেখে দিয়েছেন৷ মেয়েটার সাথে অন্যায় তিনি করেন নি। একজন বাবা হিসেবে তার দায়িত্ব পালন করেছেন। এগিয়ে এলেন ধীর পায়ে। পাশে বসতেই দুপুর বললো,

— ঘুমাও নি কেন আব্বু?

— তুমিও তো ঘুমাও নি আম্মু।

— আমি তো এখনই যাব। দুলাভাই এর সাথে কথা বললাম মাত্র। ম্যাচ চলছিলো না এতক্ষণ তাই শেষ করলাম। এখন যাচ্ছি।

বাবা লজ্জা পেলেন। আসলেই তো। মেয়েটা ক্রিকেট পা’গল। তার সাথেই তো দেখে। আজ যে কেন এলেন না তিনি? মেয়েটা কি ভাবলো, ভাবলো নাকি যে বাবা তাকে পর করে দিয়েছে বা বিয়ে হয়েছে বলে তাকে স্বামী মুখী করতে ইচ্ছে করে আসে নি?
দুপুর টিভি বন্ধ করে উঠে দাঁড়ালো। আড়মোড়া ভেঙে বললো,

— ঘুমাতে যাও আব্বু।

— এই তো যাচ্ছি।

দুপুর রুমে চলে এলো। দরজা লাগাতেই মৃদু শব্দ হলো। বিছানা টানটান করা এরমানে নতুন বর বিছানায় আসে নি। দুপুর এদিক ওদিক তাকালো। কামড়ার কোথাও নেই সে। তার পরণে শাড়ী। তাকে এটাই পরতে বলা হয়েছিলো। খয়েরী সুতির শাড়ী বদলে এই বেগুনি শাড়ী পরেছিলো ও। ওটায় গা চুলকাচ্ছিলো কেমন।
আলমারি খুলে রাতের পোশাক নিলো দুপুর। তখনই বুঝলো নতুন বর বারান্দায়। ঠোঁট কামড়ে একবার ভাবলো ডাকবে কিন্তু কিছু একটা মনে হতেই আর ডাকা হলো না। বাথরুমে ঢুকে পরলো ও।

গোলাপি রঙের ওভার সাইজ টিশার্টার সামনে বিড়াট এক ফুল আঁকা। প্যান্ট ভর্তি কলার ছাপ। গলায় একটা স্কার্ফ ঝুলিয়ে বেরিয়ে এলো দুপুর। চুলগুলো বেণী করতে আয়নার সামনে দাঁড়াতেই পেছন থেকে পুরুষের গম্ভীর কণ্ঠে শোনা গেলো,

— জানালার পকেট গেট এত বড় কেন দুপুর? অনায়াসে মানুষ ঢোকা যাবে। এটা কাল ঠিক করাতে হবে। আপাতত তালা লাগিয়ে দিয়েছি।

হায় সর্বনাশ! নতুন বর নতুন শশুর বাড়ী থাকবে লজ্জা লজ্জা ভাব নিয়ে কিন্তু না সে এসেই হম্বিতম্বি দেখাচ্ছে। পকেট গেট নাকি বড়। কাকে ঢুকাবে দুপুর? কাকেই বা বের করবে ওখান দিয়ে?
শাহজেব এগিয়ে এলো। দুপুর দেখলো তার হাতে চাবি। নিজেকে ওয়ালেটের ভেতরে রাখলো তা। দুপুর ভাবলো, বাহ! এতটা সন্দেহ?
শাহজেব বিছানায় বসতে বসতে জিজ্ঞেস করলো ,

— ম্যাচ শেষ?

দুপুর যেন চমকালো। সে কি দেখেছে দুপুর ম্যাচ দেখছিলো? নিজেকে সামলে উত্তর দিলো দুপুর,

— জ্বি। আপনি দেখলেন কিভাবে?

— ক্রিকেট পা’গল মেয়ে টেস্ট ম্যাচ মিস করবে এটা ভাবলে তো আমি মহা বোকা।

দুপুরের আত্মায় কেমন একটা খচ করে খোঁচা লাগলো। নতুন বর এত খবর রাখে নাকি? নিজের মতো বেণী করে উঠলো সে। দুপুরে আজ ছাদে শাহজেবের সাথে তার ততটা কথা হয় নি। তিব্বি ছাদে চলে এসেছিলো। খেতে ডেকে নিয়ে গেলো তাদের।
দুপুর ঘুরে দাঁড়াতেই দেখলো তার সাদা ধবধবে বিছানার কোণায় চাঁদ উঠেছে। কালো চাঁদ। কালো!
এটা নিছক কোন সাধারণ রঙ নয় বরং সবচাইতে চাহিদা সম্পূর্ণ রঙ এটা। চিত্র শিল্পীকে জিজ্ঞেস করো কালোর চাহিদা কত, জিজ্ঞেস করো সেই কয়লার খনি ভাঙা কারিগরকে, বৃষ্টি বিলাসী ঐ মেয়েটাকে জিজ্ঞেস করে দেখো কালো আকাশ তার কতটা পছন্দ।
দুপুরের চোখ আটকালো কালো চাঁদের কলঙ্কে। ভ্রুর ওপর একটু তেছড়া ভাবে কাটা। কলঙ্ক বুঝি তার আশীর্বাদ সরূপ? ভ্রুর কাটা দাগটা তার পুরুষ সৌন্দর্য’কে বাড়িয়েছে হাজার গুন। দুপুরের বুকটা ধুকধুক করছে। সে মানছে শাহজেব কালো কিন্তু এই কালো চাঁদ যে তার চক্ষু শীতলকারী হবে তা জানা ছিলো না৷ মুখ ভর্তি চাপ দাঁড়ি আর গাম্ভীর্য ঐ মুখ খানা দুটোই দুপুরের হৃদপিন্ডের বারোটা বাজিয়ে দিচ্ছে।
শাহজেব তাকে কাছে ডাকলো। দুপুর বিড়াল পায়ে বিছানায় উঠে। শাহজেব তাকায় তার পানে। ‘কাকের ঠোঁটে কমলা’ মানুষ মিথ্যা বলে না। এই যে কমলা দুপুর তার কাছে। মনে হচ্ছে দুপুরের পরপরই আকাশ যেমন কমলা রঙ ধারণ করে দুপুরের রুপ ঠিক তেমনই। তার পুতুলের মতো গোল মুখটা ভরা মায়া। দেখলেই মন চাইবে একে আদর করে দিতে। শাহজেবের খুব করে মন চাইছে দুপুর’কে আদর দিতে। এই মেয়ে আদরের জন্য তৈরী। বাবা’র হাতে গড়ে উঠা এক অনন্য রূপবতী রাজকন্যা। শাহজেবের মনে হচ্ছে দুপুর হলো কোহিনূর। হিরের মতো চকচকে নিখুঁত তার গড়ন।

শাহজেব হাত বাড়াতেই দুপুর অনায়াসে তাতে নিজের হাত দিলো। শ্যামলা হাতের মুঠোয় তখন ধবধবে নরম বিড়াল হাতখানা। শাহজেব তাকিয়ে রইলো সেখানটায়৷ বললো,

— মন থেকে মেনেছো আমায় দুপুর?

— মন থেকে না মানতে কি বিয়ে হয়?

শাহজেব মৃদু হাসলো। দুপুরের হৃদকুঠুরিতে তখন ঠক ঠক আওয়াজ হলো। শাহজেবের দিকে তাকিয়ে দুপুরই প্রশ্ন করলো,

— আপনি কি শুধু বাবা’র অনুরোধে বিয়ে করেছেন শাহ?

শাহজেবের কানে যেন রস ঢালা হচ্ছে। তাকে কত মানুষ শাহ ডাকে। শাহজেব নামটা বড়। কিন্তু আজ পর্যন্ত এত সুন্দর করে কেউ ডাকে নি। কখনোই না৷
শাহজেব ওর হাতে ঠোঁট ছোঁয়ালো।
বললো,

— এত সুন্দর দুপুর পেতে অনুরোধের প্রয়োজন হয় না। প্রয়োজন হয় শুধু ইচ্ছের। আকাঙ্খার।

দুপুর চমকে প্রশ্ন করে,

— আমি আপনার আকাঙ্ক্ষা?

— সন্দেহ আছে কোন?

দুপুর কথা খুঁজে পায় না। আস্তে করে জিজ্ঞেস করে,

— আপনি কি ঐ বিষয়টা জানেন? আব্বু বলেছিলো?

শাহজেব অদ্ভুত ভাবে চোখে হাসে। বলে,

— ঘুমাবে না?

দুপুর তাকে চমকে দিয়ে বলে,

— কি অদ্ভুত দেখুন। আমাদের বাসর রাত অথচ ফুল নেই একটাও।

— দুপুর বেলা ফুল ফোটে? ফুল ফুটে সন্ধ্যায়।

— হ্যাঁ। এজন্যই আপার বাসরে ফুল ছিলো।

কপালে ভাজ ফেলে দুপুরের পানে চাইলো শাহজেব। কিছু একটা মনে করে এগিয়ে এলো। কালো চাঁদের ওষ্ঠাধর তখন স্থান পেলো দুপুরের মতো খড়খড়া রোদে ঝলসানো এক দাগহীন কপালে। ব্যাপারটা ঘটলো সেকেন্ডের ব্যবধানে। দুপুর চমৎকার ভাবে হাসলো। বললো,

— জানালা বন্ধ করে দেই?

শাহজেব না বুঝেই জিজ্ঞেস করলো,

— কেন?

— এক সাথে দুই চাঁদের সৌন্দর্য সামলানোর ক্ষমতা সৃষ্টিকর্তা আমার দৃষ্টিকে দান করেন নি।

#চলবে….