সে জন সোনা চিনে না পর্ব-০৩

0
13

#সে_জন_সোনা_চিনে_না
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ৩

বিছানার এক কোণায় ঘুমন্ত দুপুর। এ যেন নীল সমুদ্রে ডুব দেয়া কল্পনার সেই জলপরী। গোল মুখটাতে বেশ খানিক সময় তাকিয়ে রয় শাহজেব। তার যেন ঘোর লেগে যায়। বাইরে টুপুরটুপুর বৃষ্টি হচ্ছে। শব্দ শোনা যাচ্ছে। জানালা বন্ধ করে ঘুমালেও শাহজেব খুলে দিয়েছিলো। বাইরে থেকে ফুরফুরে বাতাস আসছে। দোল খাচ্ছে ঝুলন্ত পর্দা। সেদিকে বেশ সময় তাকিয়ে রয় ও। হাত রাখে ঘুমন্ত দুপুরের চুলে। এত লম্বা চুল মেয়েটার যা পূর্বে কখনো দেখা হয় নি। শাহজেব বেশ খানিকটা সময় নিয়ে সেই চুল হাতালো। হাতিয়ে পাতিয়ে সে দেখতেই লাগলো। গাল দুটো ছুঁয়ে দেখছে। গলায় হাত দিচ্ছে। ঘুমন্ত দুপুরের চোখ কুঁচকে যায়। সে মুখে মৃদু শব্দ করে। শাহজেব তা দেখে হাসে। চাপা হাসি। দুপুর এই পর্যায়ে জ্বালা সহ্য করতে না পেরে চোখ মেললো। আচমকা ঘুম ভাঙা তারউপর হঠাৎই চোখের সামনে পুরুষ অবয়ব দেখে সে ভালোই চমকালো। লাল চোখ দুটো দেখে শাহজেব বুঝলো ঘুমের মধ্যে চোখ টেনে খুলেছে দুপুর তাই কাত হয়ে শুয়ে দুপুরের চোখে হাত বুলিয়ে দিলো। দুপুর ততক্ষণে সামলেছে নিজেকে। চোখ বুজে ঘুম জড়ানো স্বরে ডেকেছে,

— হু..? শাহ।

মেদিনীতে তখন যেন চির দেখা গেলো। তার বুকে জেগে উঠলো এক ফুলের চারা। সেই চারা গাছে ফুটলো এক ফুল যার নাম দুপুরচণ্ডী। লাল দেখতে ফুলটা তখন প্রেম জাগ্রত করলো শাহ নামক পুরুষটার মনে। ধুপধাপ শব্দ করলো যেন এই ছোট্ট বুকটায়। তার ঘুমন্ত নারীর কণ্ঠে শোনা ডাক তারই জন্য। চার অক্ষরের নামটা সে দুই অক্ষরে এনেছে। এতেই যেন বুঝায় সে তার প্রেমের গভীরতা। শাহজেব কথা বললো না। দুপুর প্রতিক্রিয়া না পেয়ে পুণরায় চোখ বুজেছে। শাহজেব নিজেও চোখ বুজলো। তার কাল সকালেই বের হতে হবে। হঠাৎ বিয়েতে কি আর ছুটি মেলে?
.
পূর্ব দিগন্তে তখন দিবাকরের রাজত্ব। আজ ঝলমলে রোদ উঠেছে। রান্নাঘরে আয়োজন চলছে। নতুন জামাই বাড়ীর। নাস্তা কি রেখে কি করবে দুপুরের মা বুঝে উঠতে পারে না। ছুটে আসেন শাশুড়ীর কাছে। দাদী বউয়ের দিকে তাকিয়ে হাসতে হাসতে বললেন,

— বউ মা তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে তোমার বুঝি প্রথম মেয়ের জামাই এটা। আগে জামাই খাওয়াইসো না? রাঁধো যা আছে। এক কাজ করো গরু ভুনা করো। রুটি আর খিচুড়ি দুটোই করো। জামাই যেটা খুশি খাবে। ভর্তা রাখো পাঁচ পদের। পরে চা দিবা। পিঠা বানাও চার পাঁচ পদের সাথে তোমার হাতের ফিরনী। কি টেবিল ভরব না?

সায়রা তখন মাত্র বাড়ীতে পা রাখলো। কাল দুপুরের বিয়ের পরপরই ওকে জরুরি ভাবে বের হতে হলো। খালার শরীর খারাপ। এদিকে মা যে যাবে তার ও উপায় নেই আবার ভাইও যেতে পারবে না নতুন আত্মীয় রেখে। তারমধ্য জামাই ছিলো বাড়ীতে অগত্যা সায়রাই ছুটেছিলো রিক্সায় করে।
সায়রাকে দেখে যেন দুপুরের মায়ের বুকে পানি এলো। ছুটন্ত পায়ে এসে আগে সায়রাকে পানি দিলেন। সায়রা তাকে বারংবার বললো,

— ভাবী আস্তেধীরে। ঠিক আছে সব।

কপালে জমা বিন্দু বিন্দু ঘাম মুছতে মুছতে তিনি বললেন,

— ভালো করে দেখেছিস তো।

— হু।

— কেউ সন্দেহ করে নি তো আবার?

— কি যে বলো না ভাবী। চিন্তা করো না বুঝলে। এখন তো নতুন বর আছে বাড়ীতে।

মাথা নাড়ে দুপুরের মা। সায়রা মাথার হিজাব আলগা করতে করতে বললো,

— চলো দেখি রান্নার কি খবর।

ওদের রান্নার মাঝেই বাবা হাজির হলেন। দাদী ড্রয়িং রুমে বসেই হাক ছেড়ে ডাকলেন,

— বউমা? বউমা? মিরাজ এসেছে। হাতের বাজার ধরো।

শাশুড়ীর ডাকে হুরতার করে বেরিয়ে আসতেই মিরাজ সাহেব হাসিমুখে নিজেই এগিয়ে এলেন। বাজারের ব্যাগ বুঝিয়ে দিয়ে বললেন,

— গলদা চিংড়ি এনেছি। ভেজে টেবিলে দিও।

— জামাই কি থাকবে না আজ?

— অফিস ছুটি পেয়েছে বলে তো মনে হয় না। হঠাৎ হলো না সব।

— তাই তো। আমি তো দুপুরের জন্যও আয়োজন জুরে দিয়েছি।

— বাদ রাখো। টেবিল গোছাও। উঠেছে ওরা?

মা মাথা নাড়েন। মিরাজ সাহেব গিয়ে হাত মুখ ধু্চ্ছেন। রান্না ঘরে এসে সায়রা’কে কুনুই দিয়ে খোঁচা দিলো দুপুরের মা। সায়রা’র হাতে তখন মশলা মাখা। গরুর গোশতে একেবারে মশলা মেখে চুলায় বসিয়ে চারটা সিটি মা রবে। এত তারাতাড়ি নাহয় গরু রান্না সম্ভব না। ভাবীর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

— কিছু বলবে ভাবী?

— ঐ ওরা উঠবে না?

তার মুখে সংকোচের ছাপ। সায়রা প্রথমে বুঝলো না। পাশ থেকে জুঁই ধাক্কা দিয়ে বললো,

— খালাম্মায় আপার কতা কয়।

সায়রা’র মাথায় এলো। সকাল আটটা বাজে। বর-কনে উঠে নি। এটা অতি স্বভাবিক এক ব্যপার কিন্তু ঝামেলা তো একখানা আছে। সায়রা জুঁই’কে ধমকে বললো,

— রুটি বেল তারাতাড়ি জুঁইফুল নাহয় তোর কপালে দুঃখ আছে।

জুঁই তখনও হাসছে। সায়রা হাত ধুয়েমুছে দুপুরের দরজায় টোকা দিলো। পরপর তিন টোকা দিলেও কোন প্রতিক্রিয়া যখন এলো না তখন সামান্য লজ্জাই যেন পেলো। দাদী এতক্ষণ না দেখলেও এখন দেখলো। উঠে এসে হাঁক ছেড়ে ডাকলেন,

— ওরে দুপু রে উঠ। বেলা হইলো তো দাদি। স্বামী সোহাগ কত খাবি আর? উঠ এখন।

দাদীর গলা ফাটানো ডাক বাড়ীর প্রতিটা মানুষ শুনলো। সায়রা পদচারণ ঘুরালো। মা ছুটলো অন্যপাশে। জুঁই দুষ্ট হলেও চুপচাপ মাথা নুইয়ে এখন রুটি বেলছে। বেলে বেলে সায়রাকে দিচ্ছে। তাওয়াতে তা সেঁকে নিচ্ছে সায়রা।
দাদী’র গলা শোনার সেকেন্ডের মাথায় দরজা খুলেছে শাহজেব। দাদী’কে দেখেই সালাম দিলো। দাদী হাসি মুখে তাকিয়ে আছে। কালো রঙের রাজকুমার যেন দাঁড়িয়ে তার সম্মুখে। বুকে হাত বুলিয়ে দিলেন দাদী। ঘরে উঁকি দিয়ে দেখলেন দুপুর তখনও ঘুম। দাদী খিটমিট করে হেসে বললেন,

— কি নাতজামাই, আমার নাতিনকে কেমন দেখলা?

শাহজেব হাসিমুখে উত্তর দিলো,

— দেখতে দিলা কোথায় বুড়ি? চলে এলে বাগড়া দিতে।

— সারারাত নাতিন রাখছি তোমার কাছে। সকালে উইঠা বলো এই কতা?

শাহজেব হাসছে। দাদীর হাত ধরে বলে,

— পাঁচ মিনিট পর আসি দাদী? বউ তো ঘুম আমার। তাকে ডেকে তুলি?

পরাণ জুড়ানো কথা। দাদী মহা খুশি। কত সুন্দর কথা বলে ছেলেটা। দাদী তার বৃদ্ধ পা ফেলে চলে যেতেই শাহজেব দরজা লাগালো। বিছানায় থাকা তুষার কন্যার কাছে এসে ডাকলো,

— দুপুর, উঠে পরো সোনা।

দুপুর একটু হাত-পা নাড়লো অতঃপর উল্টো হয়ে শুয়ে রইলো। মুখে অস্পষ্ট জড়তা-সংকোচ কথা। শাহজেব আবার ডাকলো,

— ওঠো ফাস্ট। বের হব আমি। ছুটি পাই নি সোনা। চলে যাব।

‘চলে যাব’ কথাটা দুপুরের কানে না বরং হৃদয়ে লাগলো। সেথায় উদ্ভূত হলো এক ব্যাথা। চরম মাত্রার ব্যাথা। দুই চোখ খুলে উঠেই বলে উঠলো,

— কেন যাবেন?

— কাজ আছে না?

— কি কাজ?

— বরের সরকারি কাজ অথচ বউ জানে না।

দুপুর উঠে দাঁড়ালো। শাহজেবে’র ঠোঁটে হাসি। দুপুর তা দেখে জিজ্ঞেস করে,

— আজ দুপুরে আপনাকে পাব না?

— সম্ভব হবে না তো।

— রাতে?

— নট শিওর।

— কাল…পরসু?

— দুপুর, আসলে।

— ওহ। বুঝেছি।

দুপুর বাথরুমে যেতে পা বাড়াতেই শাহজেব বললো,

— কষ্ট পেলে?

— উহু। কাজ তো।

— আমি ফিরব।

— আচ্ছা। মুখ ধুয়ে আসছি।

শাহজেব এদিক ওদিক দেখছে। দুপুরের গোছানো সুন্দর একটা রুম। মেয়েটা চরম মেধাবী। শাহজেবে’র গর্ব হচ্ছে স্ত্রী’র উপর। দরজা খুলে ব্রাশ করতে করতে দুপুর জিজ্ঞেস করলো,

— আপনি ব্রাশ করেছেন?

— হ্যাঁ।

— কোথায় পেলেন?

— পাব কোথায়? তোমারটা নিলাম।

দুপুরের হাত থেমেছিলো সেকেন্ডের জন্য কিন্তু তা আবার সচল হলো। কুলি করে মুখ ধুতেই দেখলো শাহজেব দাঁড়িয়ে পেছনে। জিজ্ঞেস করলো,

— তুমি কি আবার রাগ করলে?

— রাগের কি আছে? যা আমার তা আপনার। যা আপনার তা আমার। তাই নয় কি?

— একদম তাই।
______________________

খেয়েদেয়ে বিদায় নিয়েছে শাহজেব। দুপুর ঘরে ঢুকে আবার ঘুম দিয়েছিলো। ওর সবটুকু বিশ্বাস ছিলো শাহজেব আসবে কিন্তু অপেক্ষা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘ হলেও শাহজেবের দেখা মিলে না। দুপুর পেরিয়ে বিকেল অতঃপর রাত। বারান্দায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করে দুপুর। ক্ষুদ্র শ্বাস ফেলে যায় সায়রার রুমে। সায়রা তখন বই পড়ছে। দুপুর’কে দেখে কাছে ডাকলো। দুপুর বসলো ফুপির কাছে। আনমনা হয়ে জিজ্ঞেস করলো,

— মানুষ মায়ায় আটকায় কেন ফুপি? আমরা কেন মায়া ভুলতে পারি না?

সায়রা’র মুখটা বিষন্নতার চাদরে ভরে গেলো। অদ্ভুত গলায় বললো,

— মায়া আটকাতে পারে না দুপুর। মায়া আটকাতে পারে না। আটকাতে পারে শুধু মোহ। মোহ কেটে গেলে মানুষও পাশ কেটে চলে যায়। পেছনে তাকায় না। দেখে না তারা একটা জলজ্যান্ত মানুষকে জীবিত কবর দিয়ে যাচ্ছে।

— কি বলছো ফুপি?

সায়রা চমকে গেলো। কি বলছিলো সে মাত্রই। দরজায় দেখলো মিরাজ সাহেব দাঁড়িয়ে। সায়রা লজ্জাই পেয়ে বসলো। গলা ঝেড়ে ভেতরে প্রবেশ করেন মিরাজ সাহেব। মেয়ের পাশে বসতেই বাবা’র বুকে মাথা রাখে দুপুর। মিরাজ সাহেব মেয়ের মাথায় হাত রাখেন। বলেন,

— শাহজেবে’র কাজ পরেছে আম্মু। আসবে আবার বললো।

— আচ্ছা।

বাইরে তখন তুমুল শব্দ হচ্ছে। প্রথমে না বুঝলেও বুঝলো এটা তাদেরই গেট। দুপুর খিচ খেয়ে রইলো। সায়রা সহ মিরাজ সাহেব উঠে ছুটে গেলেন বাইরে এদিকে দুপুর দৌড় দিলো নিজের রুমে। জান প্রাণ এক করা সেই দৌড়। টেবিলের কোনাটা লেগে পায়ের কনিষ্ঠ আঙুলের নখটায় চরম আঘাত লাগলো। গলগলিয়ে র’ক্ত পরছে সেখান থেকে। দুপুরের খেয়াল নেই তাতে। ওর মনে হচ্ছে এক মিনিটের ব্যবধানে থাকা রুমটার দূরত্ব আজ হাজার মাইল। দুপুর যেন দৌড়াচ্ছে অথচ পথ ফুরাচ্ছে না৷ ওর লুকাতে হবে। যেভাবেই হোক লুকাতে হবে। ধরা দেয়া যাবে না।

#চলবে….