সে জন সোনা চিনে না পর্ব-০৪

0
24

#সে_জন_সোনা_চিনে_না
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ৪

দরজায় জোরে জোরে ধাক্কা দেয়া হচ্ছে। দুপুর ভেতরে খিঁচ খেয়ে বসে আছে আলমারির ফাঁকা কোনায়। দরজার আঘাত ধীরে ধীরে তীব্র থেকেও তীব্রতর হচ্ছে। ওপাশ থেকে গম্ভীর কণ্ঠে শোনা যাচ্ছে,

— ভাবী, দরজা খুলুন। ভাই কথা বলবে আপনার সাথে।

দুপুরের শরীর জমে যাচ্ছে। বুকটা ওঠানামা করছে। সুন্দর মুখটা তখন ভয়ে বিমর্ষ রূপ ধারণ করেছে। কপাল গিয়ে দরদরিয়ে ঘাম ছুটছে। হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসছে। আজ কতদিন..কতদিন পর এভাবে ভাবী ডাক শোনা হচ্ছে তার। দুপুর মনে করতে পারে না। মাথাটা কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। হঠাৎ মনে পরলো এক সপ্তাহ। ঠিক গত সপ্তাহে এভাবে এসেছিলো তাসরিফ । তার কণ্ঠে বিশ্রী লাগে এই ভাবী ডাক। তিব্বি কত সুন্দর ভাবী ডাকলো গতকাল দুপুর’কে। দুপুরের ভালো লেগেছিলো। আদরের সাথে সম্মান থাকে সেই ডাকে। সুন্দর এক সম্পর্ক। এদিকে তামজিদ তাকে ভাবী ডাকে যখন দুপুর কলেজে পড়তো তখন থেকে। দুপুর তখন শুধু কাঁদতো। বাবা’কে বলার পর সেবার কতটাই না ঝামেলা বাঁধলো। তামজিদ গুন্ডাপান্ডা নিয়ে হাজির হয়ে যায় বাড়ীতে। ভয়ে কলিজা গলায় উঠে আসার উপক্রম দুপুরের। মিরাজ সাহেব বরাবরই ভদ্র শান্ত মানুষ। তার জীবনে কাজ কাম করে যথেষ্ট সম্মান অর্জন করেছেন তিনি। দিন শেষে সম্মান অর্জন করার থেকে সেই সম্মান টিকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।

দরজার ওপর পাশ থেকে দুপুর এবার বাবা’র কণ্ঠ শুনতে পায়। তামজিদ’কে চলে যেতে বলছে। দাদী ধমকাচ্ছে। তামজিদ ঠান্ডা স্বরে মিরাজ সাহেবকে উদ্দেশ্য করে বললো,

— চাচা, ভাবীকে দরজা খুলতে বলুন।

— ওর খোলার হলে তো খুলতোই। তুমি এখন যাও।

তামজিদে’র ফর্সা মুখটায় বিরক্তির ছাপ। আর্কষণীয় তার মুখের ভঙ্গি। চোয়াল ভর্তি দাঁড়ি গুলো চুলকে ভাব হীন হয়ে বললো,

— ভবীকে দেখেই চলে যাব।

দাদী ধমকে উঠলেন,

— এই ছেমড়া যা। বাইর হ এইখান থেইকা।

তামজিদে’র রাগে দপদপ করা মাথাটা একটু ঝুকলো।কণ্ঠে তখনও তেজ অথচ যথাযথ শান্ত হয়ে বললো,

— আপনি আস্তে কথা বলুন আম্মা।

— খবরদার আম্মা ডাকবি না তামজিদ। যা বাইর হ এইখান থেইকা। কোন কাজকাম নাই। মন চাইলেই টোলাইতে আসস এই বাড়ী।

দুপুরের মা তামজিদ’কে দেখেই ভয় পেয়ে যান। সায়রা তাকে বুঝিয়ে এখানে আসতে আসতে তামজিদ এবার জোরে ধাক্কা দিলো দরজা। দুপুর খুলে না। রাগে ফেটে পরে ভয়ংকর এক গা’লি দিয়ে জোরে লাথি মা’রতেই ছিটকিনি কিছুটা নড়ে উঠে। দুপুর বিরবির করে ডাকে,

— শাহ।

চিরাচরিত নায়কের মতো শাহ আসে না। দুপুর যেই শাহ এর জন্য পথ চেয়ে বসে আসে সেই শাহ নিজের কাজ রেখে এইখানে এই মূহুর্তে আসতে পারে না। শাহ’রা হয় দায়িত্বশীল। যত্নবান। কর্মোদ্যম পুরুষ। তারা মা’রামারি হাতাহাতি এ-সব করে না। এই যে দুপুর এখন খুব করে চাইছে তামজিদ’কে থামাতে শাহ আসুক, তামজিদ’কে তাড়িয়ে দিক অতঃপর দুপুরের চোখের পানি মুছে তাকে বুকে আগলে নিক কিন্তু বাস্তবতায় শাহ আসে না। এখানে তার ভূমিকা নেই। দুপুর আগের মতোই টলমল পায়ে উঠে দাঁড়ায়। দরজা তামজিদ ভেঙে ফেলবে। দুপুর এটা জানে। আগের বার থাই ভেঙে এলো ভেতরে। দুপুর’কে ঘুম থেকে ডেকে তুললো। আজ হয়তো একাই এসেছে। এতটুকু ভদ্রতা তামজিদ দেখায়। গুন্ডাপান্ডা বাইরে রেখে বাড়ীতে ঢুকে। দুপুর ভাবে তামজিদ নিজেই তো বড় গুন্ডা। তামজিদ শেষ লাথি মা’রার আগেই দেখলো দুপুর দরজা খুলেছে। মাথা ওরনায় মুড়িয়ে দরজা ধরে দাঁড়িয়ে আছে। দুপুর দেখলো ওর অসহায় বাবা’কে। মানুষটার কপালে ঘাম। সাদা পাঞ্জাবী ভিজে তার দেহে লেপ্টে আছে। বুঝা যাচ্ছে এতক্ষণ যাবৎ সে তামজিদ’কে আটকানোর চেষ্টা করেছে। একবার না বরং বারবার করেছে এবং ব্যর্থ হয়েছে। তার চোখে মুখে অসহায়ত্বের ছাপ। দুপুর ভাবে সে কি করবে? বাবা’র কষ্ট দেখলে তার নিজের এই রূপ জ্বালিয়ে দিতে মন চায়। যেই রূপ ধ্বংস করে সেই রূপ জ্বালিয়ে দেয়া উচিত। যেই রূপ বাবা’কে অসহায় করে তুলে সেই রূপ অবশ্যই ধ্বংস হওয়া উচিত।

তামজিদ শক্ত চোয়ালে সালাম দিয়ে ফোন এগিয়ে দিলো। বললো,

— ভাই হোল্ডে এক ঘন্টা ধরে ভাবী। কথা বলুন।

দুপুর তাকিয়ে আছে। তামজিদ ফোনটা হাতের মুঠোয় দিয়ে এবার শক্ত কণ্ঠে বলে,

— হ্যালো বলুন ভাবী। ভাই অপেক্ষা করছে।

মাটির পুতুলটা ফোন কাঁপা কাঁপা হাতে কানে তুলে। নীচু স্বরে সালাম জানায়৷ ওপাশ থেকে দীর্ঘ শ্বাস ফেলার শব্দ হয়। বেশ খানিকটা সময় চুপ থেকে তাসফিক বলে,

— ওয়ালাইকুমস সালাম জান।

দুপুরের হাঁটু কাঁপা ধরলো। তার পুরো দেহ কাঁপছে। ফোনের ওপাশে থাকা মানুষটাও যেন তা টের পাচ্ছে।
দুপুর চুপ করে থাকায় তাসফিক বেশ ঠান্ডা স্বরে জিজ্ঞেস করে,

— ভালো আছো?

দুপুর চুপ করে পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ওপাশ থেকে মোলায়েম স্বরে ডাক পড়ে,

— জান?

তাসরিফে’র হাতে আচমকা টান পড়ে। তাকিয়ে দেখে সায়রা দাঁড়িয়ে। এতক্ষণে থাকা শক্ত চোয়াল তার নরম হলো। লাল চোখ দুটো সহসা শান্ত হলো। এতক্ষণ সমুদ্রে উত্তাল ঢেউ উঠানো তাসরিফ এখন ঠান্ডা নদীর মিঠা পানি। সায়রা ভাইঝির দিকে তাকিয়ে দেখলো ও পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পা থেকে মাথা কাঁপছে। সায়রা ফোন নিলো ওর হাত থেকে। দুপুর চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। তাসরিফ একদম চুপ করে আছে। সায়রা ফোন কাটলো। তাসরিফে’র হাত ধরে টেনে বাইরে নিচ্ছে ও। এত শক্তপোক্ত ত্রিশ ছুঁইছুঁই পুরুষটাকে টেনে সরানো সহজ নয় একান্তই তাসরিফ নিজে ছুটছে সায়রা’র পিছু নাহয় কার সাধ্য তাকে টেনে সরায়?
দরজার বাইরে এনে তাসরিফ’কে ধাক্কা দিয়ে ছাড়লো সায়রা। আঙুল তুলে শাসিয়ে বললো,

— লজ্জা হয় না তোমার? হয় লজ্জা? নির্লজ্জ কোথাকার! কেন এসেছো? তাফালিং কাকে দেখাও তুমি? বেয়াদব কোথাকার!

তাসরিফ মাথাটা একদম নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। তার সামনে খুব কম মানুষ গলা তুলে কথা বলে। বাপ,ভাই বাদে মূলত কারোই সাহসটা নেই। মা তো কখনো কণ্ঠ তুলে ধমকটাও দেয় না। এই যে সাতাশ বছরের তাসরিফ। পিটানো দেহে নারী দেহে কম্পন সৃষ্টি করা এক পুরুষ যার চারপাশে তীক্ষ্ণ নজর বিদ্যমান সেই পুরুষটাকে সায়রা ধমকাচ্ছে। পুরুষটা নজর ঝুকিয়ে রেখেছে। একটা টু শব্দও করছে না৷ সায়রা ঝাঁঝাঁলো স্বরে পুণরায় বললো,

— দুপুরের সাথে এভাবে উঁচু স্বরে কথা বলবে না তাসরিফ। খবরদার বলে দিলাম। তোমার বাবা দুটো মানুষ রূপি জা নো য়া র পুষেছেন ঘরে। একটা বাংলাদেশ আরেকটা মালোশিয়ায় জা নো য়া র পানা দেখাচ্ছে। ভালো হও বুঝলে।

ঘাড় কাত করে তাসরিফ। সায়রা দেখে। অবাক হয়। এ যেন স্কুল পড়ুয়া এক বালক’কে তার ম্যাডাম বকছে হোমওয়ার্ক না করার দায়ে। বালক অন্যায় মেনেছে। অপরাধবোধ যেন তাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে।
ম্যাডাম যেমন জানে বালক আগামী কালও হোমওয়ার্ক করবে না ঠিক তেমন সায়রাও জানে তাসরিফ শুধরাবে না৷ ফোঁস করে শ্বাস ফেলে। তার গলা শুকিয়ে এসেছে। না জানি ভেতরে দুপুরটার কি অবস্থা? রাগে ফেটে পড়ে সায়রা। শেষ বার শুধায়,

— ভালো হও তাসরিফ। পৃথিবীটা ছোট। কৃতকর্মের ফল ঘুরেফিরে নিজের কাঁধেই আসে।

সায়রা পা ঘুরায়। ভেতরে ঢুকতে নিবে তার আগেই গা ঝিমঝিম করানো কণ্ঠে ডাকে তাসরিফ,

— য়রা?

সায়রা’র পা থামে। আবার! আবার এই ছেলে তাকে য়রা ডাকছে। ঘুরে তাকাতেই দেখে আগের ন্যায় ঝুকানো মাথা। সায়রা তাকিয়ে থাকে। তাসরিফ কথা বলতে পারে না৷ সায়রা’র তীক্ষ্ণ দৃষ্টি তাকে কথা বলার ভোকাল কর্ডে যেন ছেদ করেছে।
সায়রা আর দাঁড়ায় না। ও ছুটে যায় দুপুরের কাছে। এদিকে উদাস তাসরিফ বেরিয়ে আসে। লোহার গেট পেরিয়ে বাইরে এসে জিপে উঠে। সামনের জন বুঝে তাদের ভাই এর মন খারাপ অথবা ভীষণ রেগে আছে। জিপ ছাড়তেই গলা ছেড়ে গান ধরে তাসরিফ,

‘যে জন প্রেমের ভাব যানেনা…
তার সঙ্গে নাই লেনাদেনা
খাটি সোনা ছাড়িয়া
যে নেয় নকল সোনা
সে যন সোনা চেনে না
খাটি সোনা ছাড়িয়া
যে নেয় নকল সোনা
সে যন সোনা চেনে না’

______________________

বিয়ের এক সপ্তাহে পাড় হলো। দুপুর আজও জানালা খুলে অপেক্ষাকৃত তার শাহ এর আগমনের। এই এক সপ্তাহ তার ভালো কাটে নি। প্রতিটা ক্ষণে ক্ষণে তার বুক পুড়েছে। অন্তর জ্বলেছে। দুপুরের হয়েছে ভীষণ জ্বালা। বুক ফাটে তো মুখ ফুটে না সেই অবস্থা। চারদিন হলো কথা হচ্ছে না শাহ’র সাথে। বিয়ের দ্বিতীয় দিন সেই যে গেলো মানুষটা আর ফিরলো না। দুপুরের সাথে কথা হলো সেদিন। জানালো খুব ব্যস্ততা যাচ্ছে। নতুন একটা ট্রেনিং এ গিয়েছে শাহজেব। সরকারি ট্রেনিং যা হাতছাড়া করবে না শাহজেব। দুপুর বুঝে। চুপ থাকে অথচ ওর অন্তর জানে কতটা জ্বলছে সে ভেতর ভেতর। মনে পরলো সেদিনকার কথা যখন তাসরিফ চলে গেলো। দরজা বন্ধ করে ধপ করে মেঝেতে বসে পরলো। কেন জানি ওর মনে পরে শাহজেবে’র কথা। ঠেলেঠুলে উঠে তন্নতন্ন করে ফোন খুঁজে। কল লাগায়। চারবার রিং হলেও যখন শাহজেব ধরলো না তখন নতুন নতুন বিবাহিত মনটা ঠিক ঠমক ধরলো। অভিমান জমলো না অথচ কালো মেঘের আড়ালে ঢাকা পরলো উজ্জ্বল মুখ।
দুপুর তখন গুটিয়ে গেলো। গা এলিয়ে দিলো মেঝেতে৷ ঠান্ডায় কোমড়ের হাড়ে ব্যথা করে অথচ দুপুর খেয়াল করে না৷ কাটায় কাটায় দুই ঘন্টা পাড় হলো। সায়রা কতবার ডাকলো দুপুর উত্তর করে না। যাকে সে ডেকে ম’রছে তার দেখা নেই এদিকে পুরো দুনিয়া তাকে ডেকে যাচ্ছে। দুপুরের দৃষ্টি ফোনের দিকে।
দুই ঘন্টা আট মিনিট পর ফোন বাজলো। শাহ নামটা দেখা যাচ্ছে সেখানে। দুপুর ফোন তুলে। কথা বলে না৷ ওপাশ থেকে শান্ত স্বরে শোনা যায়,

— আসসালামু আলাইকুম, দুপুর।

দুপুর মনে মনে উত্তর করে। ওপাশের মানুষ বুঝে। মানে দোষ তার তাই তো অনুযোগ করে,

— সোনা, মিটিং এ ছিলাম৷ এমডি এসেছে। আমাকে কাজ বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন। জানো তো ট্রেনিং এ যাচ্ছি। হাতের কাজ কলিগকে বুঝিয়ে দিলাম। উপসচিব আসবেন আজ।

কত সুন্দর। কত সহজ-সরল ভাবে তাকে ব্যাখা করা হচ্ছে। কে পারবে কথা না বলে থাকতে? দুপুর তো পারে না৷ একদমই না।

শাহজেব জিজ্ঞেস করলো,

— দুপুর, মন খারাপ?

— উহু।

— আমার কিন্তু ভীষণ মন খারাপ?

— কেন?

— এই যে আজ আমার বাগনে দুপুরচন্ডী ফুটলো না।

— আছে নাকি?

— হ্যাঁ তো।

— কোথায়?

— বুকের মাঝখানে।

— ফাইজলামি করছেন?

— তোমার তাই মনে হচ্ছে?

দুপুর চুপ করে। শাহজেব বলে,

— আমার বুকের দুপুর তো আজ উঠে নি কিন্তু গাছে থাকা দুপুরচন্ডী কিন্তু ফুটেছে। ছয়টা গাছ লাগিয়েছিলাম।

— সবগুলোয় ফুল ফুটলো?

— ফুটলো তো। ঠিক ফুটলো। আমার মন ভালো করতে তারা ফুটে।

— আপনার দুপুর পছন্দ?

— খুব।

— দুপুর অপেক্ষা করবে শাহ। তার অপেক্ষা দীর্ঘ না করার অনুরোধ রইলো।

#চলবে….