সে জন সোনা চিনে না পর্ব-০৫

0
16

#সে_জন_সোনা_চিনে_না
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ৫

মালোশিয়ার এক বিলাসবহুল কামড়ায় নরম গদিতে গা এলিয়ে আছে এক শুভ্র রঙা পুরুষ। বয়স ত্রিশ হলেও তা যেন নামমাত্র এক সংখ্যা। বয়সের ছাপ মুখে তার এক ভিন্ন দ্যুতি ছড়িয়েছে। শক্ত চোয়ালে তার এক তীক্ষ্ণ হাসি যা অদৃশ্য। তামজিদ তার হাতে থাকা সিগারেট ঠোঁটে গুজলো। পরণে থাকা বাথরোবটার ফিতা খুলতে খুলতে উঠে দাঁড়ালো। ডান হাতটা কপালে ঘষতে ঘষতে বললো,

— আজকাল ভীষণ জ্বালাচ্ছো পাখি। ভীষণ! তুমি জানো তোমাকে কতটা চাই আমি অথচ তুমি বেখবর উদাসীন এক পাখি। আমাকে উগ্র হতে তুমিই বাধ্য করো জান। ভীষণ বাধ্য করো। এই যে বাধ্য হয়ে অবাধ্য হই আমি এর দায় কে নিবে দুপুর?

তামজিদ বাথরোব খুলে গায়ে সাদা নরম শার্ট জড়ালো। বুকের কাছটায় দুটো বোতাম খোলা। ফর্সা বুকটার কিঞ্চিৎ দৃশ্যমান। সিগারেটের ধোঁয়া উড়াতে উড়াতে ফোন হাতে তুললো। ডায়াল করলো বাংলাদেশী নাম্বারে।

উদাম গায়ে আর্ধ শরীর কাঁথায় ঢাকা তাসরিফে’র। পিঠে তার সামান্য ক্ষত। কাল রাতে একা ড্রাইভ করার সময় কেউ পেছন থেকে আঘাত করেছে। তাসরিফ গাড়ি থামায় নি। থামালেই তো বিপদ। ফার্মেসীর কাছে এসে নিজেই ড্রেসিং করানোর পর গাড়ি তল্লাশি করলো। দেখা মিললো ছোট্ট অথচ ধারালো এক ছু ‘ ড়ি। কেউ হয়তো মা রতে চেয়েছিলো কিন্তু ব্যর্থ হয়েছে। নিশানা ছুটে গিয়েছে তার৷ তাসরিফে’র পিঠ ব্যথায় টনটন করছে। ফোনটা হাতে তুলতেই দেখলো ভাই লিখা। অন্য কেউ হলে হয়তো রিসিভ করা হতো না। ভাইয়ের ফোন বলে চট করেই তুললো। সালাম দিতেই তামজিদ বললো,

— কি অবস্থা?

— এই তো ভাই।

— ঘুমচ্ছিস?

— উঠব এখন।

— ওহ্ আচ্ছা শোন। আমার সন্দেহ আব্বা বা তোর উপর হা ম লা হতে পারে। নতুন মাল পাঠাচ্ছি দেশে। বর্ডার ক্রস করতে পারলেই ঝামেলা শেষ।

— বর্ডার ক্রসে ঝামেলা হবে না তো?

— নতুন চিনিস তোর ভাইকে?

— এবার তো মাল বেশি।

— তোর থেকে তিন বছরের অভিজ্ঞতাও বেশি আমার।

— জ্বি ভাই।

— তৌসিফে’র সাথে কথা বলে রাখছি এখন। রাতে তুই নিজ থেকে ফোন দিবি। নিজে উপস্থিত থাকবি। তৌসিফ থাকাতে অবশ্য সমস্যা হবে না।

— তৌসিফ তালুকদার?

— হ্যাঁ।

— আচ্ছা ভাই।

— শোন।

— শুনছি।

— দুপুরের বাবা’র দিকে খেয়াল রাখবি একটু। শশুর আব্বা একটু সরল মানুষ। মানুষের কথায় পড়ে ভুলভাল কাজ করলে তো সমস্যা। তারমধ্যে দুপুর ঠিকঠাক কথা বলে না।

— ভাবী তো শুরু থেকেই এমন ভাই।

— নরম মানুষ তোর ভাবী। ভয় পায়। পাঁচটা বছর ধরে দেখে দেখে রাখছি। চোখের মনি সে আমার।

— হুম।

— রাখছি তাহলে। আম্মার সাথে কথা বলব একটু।

সালাম দিয়ে তাসরিফ ফোন রাখলো। উঠে বসার চেষ্টা করলো। পিঠে টান লাগতেই ওর মনে হলো জান বেরিয়ে যাচ্ছে। মুখে ব্যথাকাতুর শব্দ তুলে তাসরিফ। এই মূহুর্তে মনে পরে সায়রা’র কথা। গতকাল দেখা হলো অথচ মাথা নিচু থাকায় দেখতে পেলো না। মেয়েটা যে কেন বুঝে না। যেমন ফুপু তেমন ভাইজি। ভাইজি অবশ্য নরম সরল অথচ ফুপু’র পা থেকে মাথার চুল তেজে ভরপুর। কাল তো তাসরিফ ভাবলো সায়রা এক চটকানা মা রবে। আল্লাহ জানে মেয়েটার মনে দয়া হয়েছিলো বুঝি তাই হাত তুলে নি।
তাসরিফ মৃদু হাসে। আনমনে বলে,

— কবে আমার ঘরে উঠবে য়রা। তিনটা বছর ধরে তোমাকে পটাচ্ছি। নানাভাবে বুঝাচ্ছি। তুমি কোন ভাবেই মানছো না য়রা। কেন মানছো না? এখন তুমি থাকলে অন্তত পিঠে নরম হাত তো বুলাতে। একটু আদর করে খায়িয়ে তো দিতে। তুমি কেন বুঝো না য়রা বয়স শুধু মাত্রই সংখ্যা। যেই সমাজের ভয়ে তুমি রাজি হচ্ছো না সেই সমাজ যে একদিন তোমাকেই দোরগোড়ায় দাঁড় করাবে তা কি তুমি জানো না?

__________________

দুপুর তার শাহ’কে বেশি অপেক্ষা করাতে না করলেও তার শাহ তাকে অপেক্ষা করাচ্ছে। খুব করে অপেক্ষা করাচ্ছে। এই যে দুপুর নাওয়া খাওয়া বাদ দিয়ে রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকে কই শাহ তো আসে না। গতকাল শাশুড়ী আম্মা ফোন দিলো। দুপুরের সাথে ঘন্টাখানিক কথা বললো। কথা শেষ হতেই আবার শশুর আব্বা ফোন দিলো। দুপুর বিরক্ত হয় না। তার ভালো লাগে নতুন সম্পর্ক গুলো। শশুড় আব্বা জানালো আজ আসবেন দেখা করতে। সেই থেকে দুপুর তাদের অপেক্ষায়। যদিও জানে আসতে দুই ঘন্টা আরো বাকি। কিছু একটা ভেবে দুপুর রান্নাঘর ঢুকলো। সব রান্না শেষ। রোস্টটা দুপুর নিজ হাতে করেছে। মায়ের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

— ডেজার্ট আইটেম কি আম্মু?

— সেমাই আর পুডিং করলাম। তোর আব্বু রসমালাই আর দই এনেছে সাথে মিষ্টি।

— ওহ।

বলে দুপুর নিজ থেকেই ফিন্নি রান্না করলো। ওর মা বাধা দিলো না। দুপুরের মা একটু খুশিই হলেন। তার মেয়েটার ভবিষ্যত কি হবে তিনি জানেন না শুধু চাইছেন শাহজেব ওকে নিয়ে যাক এখান থেকে। তাদের ছোট্ট একটা সংসার হোক।

— ভাবী? ভাবী?

দুপুরের হাত থেমে গেলো। তিব্বি’র কণ্ঠ। মানে তারা চলে এসেছে। মাথায় ওরনা টেনে দুপুর চুলা নেভালো। বেরিয়ে আসতে আসতে তিব্বি ওর হাত জড়িয়ে ধরে উচ্ছসিত কণ্ঠে বলে উঠলো,

— ভাবী আমি তোমাকে কত মিস করেছি তুমি জানো। কবে থেকে বলছিলাম আমাকে এখানে নিয়ে আসতে কিন্তু কেউ রাজি হয় নি। তুমি এবার আমাদের সাথে চলবে ঠিক আছে?

দুপুর হাসলো। তাজদাড় নামের ছোট্ট তিব্বিটা তখনও কথা বলে যাচ্ছে। তিব্বির হাত ধরেই দুপুর এগিয়ে এলো। দরজার বাইরে থাকা শশুর, শাশুড়ীর সাথে বাবা আর মা তখন কথা বলছে। তারা ভেতরে ঢুকা মাত্রই শাশুড়ী দুপুরকে জড়িয়ে ধরে। বেশ কিছুক্ষণ ওভাবেই জড়িয়ে রাখলেন তিনি। দুপুরের কপালে চুমু দিয়ে বেশ প্রশংসা করে বললেন,

— আমার মেয়ে, মাশা আল্লাহ কত সুন্দর দেখাচ্ছে।

দুপুর’কে তিনি আর হাতছাড়া করলেন না। নিজের সাথে জড়িয়েই রাখলেন। তিব্বি এদিক ওদিক ঘুম ঢুকলো দুপুরের রুমে। গোছানো রুমটায় এদিক ওদিক ঘুরলো কিছুক্ষণ অতঃপর দেখলো বিছানায় ফোন রাখা৷ তিব্বি ফোনটা হাতে তুলে অনায়সে তা খুলে নিলো। নিজে নিজেই অবাক হলো। এই যুগে এসে ফোনে লক নেই। মিচকে হাসি দিয়ে সরাসরি ভাইকে ফোন দিলো। এক লাফে বিছানায় উঠলো। শাহজেব হঠাৎ দুপুরের থেকে ভিডিও কল পেয়ে অবাকই হলো। এই প্রথম এভাবে কল দিয়েছে দুপুর। শার্টের কলার ঠিক করে একটা টিস্যু দিয়ে মুখটা মুখে ফোন রিসিভ করলো। ওমনিই বেয়াকুফ বনে গেলো যেন। তিব্বি শুয়ে আছে হাত পা ছড়িয়ে দুপুরের বিছানায়। শাহজেবে’র কাপলে ভাজ পড়ে। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে জিগ্যেস করে,

— তুই এভাবে শুয়ে আছিস কেন?

— নরম বিছানা ভাইয়া৷ মজা লাগছে।

— ভাবী কোথায় তোর?

— মা ভাবীকে শক্ত করে ধরে রেখেছে ভাই। ছাড়ছেই না। আমার তো মনে হচ্ছে ভাবী দম বন্ধ হয়ে ম রে টরে যাবে। তুমি কি দেখবে? আমি কি দেখাবো?

শাহজেব বিরক্ত হয়ে বললো,

— মা কেন ধরে রেখেছো? এমনিতেই তো গরম।

— সুন্দর মানুষ যে তাই বোধহয়।

— কে?

— কে আবার? আমার ভাবী। দেখোনি তুমি?

শাহজেব হালকা কাঁশি দিলো। তখনই তিব্বি চিৎকার করে ডাকলো,

— ভাবী তুমি দাঁড়িয়ে আছো কেন? বসো। তারাতাড়ি এসো।

দুপুর আসলো। বসলো তবে এমন ভাবে যাতে শাহজেব ওকে দেখতে না পায়৷ শাহজেবে’র ভেতরটা যেন হাহাকার করে উঠে। সম্মুখে ওর স্ত্রী বসা অথচ দেখা যাচ্ছে না। ধবধবে ফর্সা হাতটা দেখা যাচ্ছে। কাটা চামচে করে ফল তিব্বির মুখে তুলে দিচ্ছে। তিব্বিটাও কতবড় শয়তান। খাচ্ছে তো খাচ্ছে তা আবার ভাইকে দেখাচ্ছে। শাহজেবে’র ভেতর ছটফট করে উঠে। চাইলেই মুখ ফুটে বলতে পারছে না যে, ‘একটু তাকাও দুপুর, একটু দেখি’। চাইলেই বলা যাচ্ছে না। ছোট ভাই আছে। মান ইজ্জতের ব্যাপার-স্যাপার। শাহজেব ক্ষুদ্র শ্বাস ফেললো। তিব্বি খেতে খেতে বললো,

— ভাইয়া, ভাবী কাসটার্ড বানিয়েছে। আনতে গেলো৷ খাব এখন৷ রাখছি তাহলে। ওহ শুনো না, ভাবী’র আঁচলে মুখ মুছব আজ আমি।

খট করে ফোনটা কেটে গেলো। শাহজেবে’র মাথাটায় ধপ করে আগুন জ্বলে উঠলো। ছোট বেলা থেকেই ঝামেলাটা হচ্ছে। মায়ের আঁচলে মুখ মুছার অভ্যাস শাহজেবে’র। তা দেখে ছোট্ট তিব্বিও মুখ মুছতে চাইতো। কথা হলো সবার আগে কেন শাহজেব মুছবে তা মেনে নিতে পারে না তিব্বি। তার কথা সে আগে মুছবে অথচ এই দাবি তার আজও পূরণ হয় নি। দেখা যায় শাহজেব এখন বাসায় থাকে না কিন্তু তখন আবার তিব্বি এসব আবদারও করে না। তার যত আবদার শাহজেব সামনে থাকলে।
হিংসায় জর্জরিত শাহজেব একের পর এক কল দিচ্ছে। তিব্বি শয়তানী হেসে ফোন কেটে দিচ্ছে। কোন ভাবেই ভাইয়ের কল ধরবে না সে৷ এদিকে শাহজেব হাতের কাজ ফেলে এভাবে অস্থির হওয়ার ওর কলিগ জিগ্যেস করে,

— স্যার কোন সমস্যা হয়েছে?

শাহজেব ইশারায় বুঝায় হ্যাঁ সমস্যা হয়েছে। বেচারা এখন কি করবে? মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে তার স্যারের সামনে। কি সমস্যা তা জিগ্যেস করার সুযোগ পাচ্ছে না সে। শাহজেব না পেরে ফোন দিলো মা’কে। রিসিভ হতেই মা গদগদ কণ্ঠে বললেন,

— হ্যাঁ, কাল্লু আব্বা, এই তো তোর শশুর বাড়ীই আছি।

শাহজেবে’র মাথা চক্কর দিলো দুটো। মা তাকে ছোট্ট থেকে আদর করে কাল্লু ডাকে। আদরের ডাক এটা কিন্তু কার কার সামনে ডাকলো এই নামে? হায়! তিব্বি কিসের ফালুদা খাচ্ছে? ফলের নাকি তার ভাইয়ের ইজ্জতের?
শাহজেব দম আটকে বললো,

— পাশে দুপুর আছে?

— হ্যাঁ। বউ মার হাতের ফালুদা এত মজা।

— ফোনটা ওকে দাও তো।

এত মানুষের সামনে দুপুরকে ফোন দেয়ায় শাহজেবই লজ্জা পাচ্ছে। দুপুর সালাম দিতেই শাহজেব বললো,

— কোন ভাবেই আঁচলে তিব্বি’কে মুখ মুছতে দিবে না।

টুং করে তখন শব্দ হয় ফোনে। শাহজেব দেখে দুপুরের আঁচলে মুখ মুছার সময় ছবি তুলেছে তিব্বি। সেই ছবি বিশ্রী হয়েছে দেখতে। খুব বিশ্রী। শাহজেবের নজরে হাস্যোজ্জ্বল ছবিটি জঘন্য লাগলো। মনে মনে বললো,

— কষিয়ে দুটো থাপ্পড় আমি তোর জন্য তুলা রাখলাম তিব্বি।

কলিগটা তখনও বলদের মতো তাকিয়ে আছে। সে বুঝতে পারছে না কি হচ্ছে।
.
মেহমানদের সাথে যখন আড্ডা চলছে তখন দরজায় বেল বাজে। দুপুরের বুকে খচ করে উঠে। কে এলো? তাসরিফ নয় তো? সায়রা ভাইঝির দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে বললো,

— আমি দেখছি।

দুপুরের শাশুড়ী বললো,

— দেখো ওর মামা শশুর আসার কথা। বিয়ের দিন তো জ্যামে আটকে আসতে পারলো না৷

সায়রা মাথা নেড়ে চলে গেলো। মনে মনে ভাবলো তাসরিফ হলে আজ কলার চেপে দুটো চড় বসাবে গালে। বড্ড বেয়াদব হয়েছে এটা৷ ওদের জ্বালায় অতিষ্ট এখন সায়রা। মন চায় সব ছেড়ে গ্রামে চলে যেতে। এই শহর তাদের জন্য না। না ছিলো আর না আছে। এই শহরে শুধু কান্নারা থাকে। হাসিদের জন্য এখানে জায়গা নেই। যা আছে তা মিথ্যা। শুধু মিথ্যা।
দরজা খুলতেই পাঞ্জাবী পরা শ্যামবর্ণের সুন্দর পুরুষটাকে দেখে থমকালো সায়রা। পুরুষটা তাকে দেখে নি এখনও। কত হবে এই পুরুষের বয়স? বত্রিশ? হ্যাঁ, তাই তো। সায়রা থেকে দুই বছরের বড় সে। সায়রা যখন এইটে তখন সে এসএসসি দিলো। গোল্ডেন পেয়ে মিষ্টি বিলি করলো। কত দিন, কত ইচ্ছে, কত সুন্দর মূহুর্ত,কত আশা, কত আকাঙ্খা, কতশত স্মৃতি সায়রা খুঁজলো। মানসপটে তা ঝাপসা না আবার স্বচ্ছও না।
পুরুষটা নিজেও যখন তাকালো একদম থমকে গেলো। অস্পষ্ট স্বরে শুধু ডেকে উঠলো তার হৃদয়,

— সারা?

সায়রা চোয়াল শক্ত করে। মুখে হাসি ফুটায়। বলে,

— সায়রা আমার নাম বেয়াই সাহেব। ভেতরে আসুন।

মাহমুদ দাঁড়িয়ে আছে পাথরের ন্যায়। তার কপালে ঘাম। হাত দুটো পাথর হয়ে আছে নিশ্চিত নাহয় কেন নাড়ানো যাচ্ছে না?

#চলবে….