#সে_জন_সোনা_চিনে_না
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ৭
— শশুর বাড়ী আমার প্রথম রাত দুলাভাই অথচ আপনি ফোন দিলেন। এসব মানায় আপনাকে? আমার স্বামী নেই তা নাহয় মানলাম কিন্তু আপনার তো বউ আছে? বউ কোথায় আপনার? নাকি বউ রেখে শালীর সাথে কথা বলতে মন টানছে?
দুপুরের একের পর এক ছুঁড়ে দেয়া প্রশ্নে ইফাত থতমত খেয়ে গেলো। নিজের বুকের বা পাশে একটা হাত রেখে ঢোক গিলে বললো,
— তুমি এসব কি বলছো দুপু?
— তো, ভুল বলেছি? আপনি দেন নি আমাকে কল? আপা জানে এই আধ রাতে তার প্রাণের স্বামী আমাকে ফোন দিয়ে জ্বালাতন করছে?
ফাটা গলায় ইফাত এক প্রকার চিৎকার করে উঠে,
— আমি তোমাকে জ্বালাচ্ছি? হায় হায় কি বলছো দুপুর?
দুপুর মিটিমিটি হাসে। বলে,
— তো? মিথ্যা বলছি আমি?
— তুমি চাইছো আমি যাতে নিজ থেকে ফোন রেখে দেই কিন্তু আমি তো বোকা না দুপুর যে তোমার কথায় ফোন রাখব। তোমার সাথে আমার গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে।
ইফাতের কণ্ঠ গুরুত্বপূর্ণ গুরুত্বপূর্ণ অনুভূতি দিচ্ছে তাই দুপুর দুষ্টামি বাদ দিলো। নিজেও নড়েচড়ে বসলো। পা দুটো ভাজ করে বললো,
— শুনছি দুলাভাই।
ইফাত ছোট্ট একটা দম ফেলে বললো,
— তামজিদ মনে হয় দেশে ফিরবে দুপুর। শোনো বোন আমার, ভয় পাবে না কিন্তু। এখন তোমার বর আছে। আমার মনে হয় শাহ’কে সব জানানো দরকার। তাকে বুঝিয়ে বলো। আমরা সবাই চাই তুমি আগের দুপু হয়ে যাও যাকে আমরা খুব করে মিস করছি।
— সব বলে দিব?
ইফাত থমকালো। বুকের ভেতর শূন্যতা অনুভব করলো। ওর কাছে দুপুর নিতান্তই এক ছোট বাচ্চা। সন্তান নেই তাতে কি ইফাতের মনে হয় দুপুর তার মেয়ের মতো। সমাজের চোখে বিষয়টা হাস্যকর হতেই পারে কিন্তু ইফাত তো জানে তার কাছে তার দুপু কি। নিজেকে সামলে ইফাত বললো,
— সব বলে দিবে দুপু কিন্তু অবশ্যই রাখবে এখানে তোমার ভুল নেই। তুমি কোন ভাবেই দোষী না। সঠিক পথে চলতে গিয়ে মানুষ কতবার মুখ থুবড়ে পড়ে কিন্তু এরমানে কি এটা যে ওটা সঠিক পথ না?
— না।
— তাহলে তুমি ভয় পাবে না।
দুপুর কিছুক্ষণ থেমে থাকে অতঃপর বলে,
— কিন্তু আমার ভয় হচ্ছে দুলাভাই।
ইফাত তো জানে তার দুপুটা ভয় পাচ্ছে কিন্তু কি করবে ও। ইফাত চাইছে দুপুর শশুর বাড়ী থাকুক অথবা শাহ নিজের কোয়াটারে ওকে নিয়ে যাক। শাহ’র সাথে ওর গুরুত্বপূর্ণ কিছু আছে দুপুরকে নিয়ে। ইফাত আস্তে করে বললো,
— আমার দুপুর তো সাহসী। সে ভয় পায় না।
— আপনার দুপুর না দুলাভাই। আপনার হলো সন্ধ্যা। বউয়ের কাছে যান তো। ঘুমাব আমি।
— এই তোমার আপা কথা বলবে তোমার সাথে।
— ঘুমাতে যাচ্ছি আমি। পরে কথা বলব দুলাভাই। আল্লাহ হাফেজ।
সন্ধ্যা অধীর আগ্রহে তাকিয়ে আছে। বোনের সাথে কথা বলবে কিন্তু দুপুর কোন ভাবেই কথা বলবে না৷ ও কথা বলতে ইচ্ছুক না। দীর্ঘ শ্বাস ফেলে সন্ধ্যা। উঠে যেতে নেয়। পেছন থেকে হেচকা টানে ওকে নিজের কোলে আনে ইফাত। জড়িয়ে ধরে কাঁধে মাথা রাখে। পিঠে গাল লাগিয়ে আবদার ধরে,
— বাইরে যাবে পাখি?
— মাথা খারাপ হলো তোমার? কটা বাজে?
— বাজুক।
— কোন দরকার নেই।
— আছে। বোরকা পরে নাও ঝটপট।
ইফাত উঠে লুঙ্গির নিচে টাউজার পরে লুঙ্গি খুললো। বাইকের চাবি হাতে নিয়ে ডাকলো,
— সন্ধ্যা? কাম ফাস্ট।
সন্ধ্যা বেরিয়ে এলো। মলিন মুখে তার উজ্জ্বলতা ঠিক তখন ফিকে এক সন্ধ্যার মতো। ইফাত হাসলো। বললো,
— মুখ খানায় একটু হাসি ফুটাও, এই স্বামী নামক অপদার্থ তা দেখে বুক জুড়াক।
সন্ধ্যা ওর বুকে আলতো কিল দিয়ে বেরিয়ে গেলো৷ ওর ঠোঁটে হাসি। মানুষ পা গল হয় কিন্তু কতটা? ইফাতের মতো এতটা? বাচ্চা নেই তবুও তার অভিযোগ নেই। আচ্ছা, সে কি মনে করে সন্ধ্যা কিছু বুঝে না বা জানে না? সন্ধ্যা তো সব জানে। বুঝে। মানুষটা কেন অভিযোগ করে না?
______________________
এই আধ রাতে গায়ে নতুন এক শাড়ি জড়িয়েছিলো এখন সুন্দর করে সাজতে বসেছে দুপুর । ঠিক নতুন বউ সাজলো।চুলগুলো ছেড়ে দিয়ে মাঝখান বরাবর সিঁথি কেটে দুইভাগ করে পেছনে ইয়া বড় এক হাত খোঁপা করে রুম জুড়ে পায়চারি করলো কতক্ষণ। দুটো ছবি তুলে ফট করে শাহ’র হোয়াটসঅ্যাপে পাঠিয়ে দেখলো দুটো নীল দাগ। যাক তীর নিশানায় লেগেছে। এবার নিষ্ঠুর পুরুষটার বুক জ্বলুক। সুন্দরী বউ পালা কি মুখের কথা? বউ পালতে হবে আগলে আগলে। মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে। দিনে কম করে দশবার ফোন দিবে। বউ খেলো, গোসল করলো, ঘুরলো ফিরলো, ঘুমালো এসবের খবর নিবে। কিন্তু নাহ৷ শাহ এসব করে না৷ উল্টো দিনের পর দিন তার পাত্তা পাওয়া যাচ্ছে না। দুপুর যে চাতকের ন্যায় তাকিয়ে থাকে ফোনটার দিকে তা কেন শাহ বুঝে না। কালো চাঁদ তাকে কেন গুরুত্ব দিচ্ছে না? দুপুর হতাশ হয়ে আয়নায় দেখলো নিজেকে। নিজের সৌন্দর্য দেখে নিজেই অবাক হয় মাঝেমধ্যে। মানুষ এত সুন্দর কেন হয়? এই সৌন্দর্যকে কাছে পেয়ে শাহ হেলাফেলা করছে অথচ কেউ একজন এই সৌন্দর্যের জন্য দুপুরে’র জীবন নরকে পরিনত করেছিলো।
ফোনটা বেজেই চলছে। দুপুর দেখলো শাহ লিখা সেখানে। ঠোঁটে হাসি ফুটলো। যাক শাহ তাকে বউ কাকে বলে তা বুঝেছে? বউ এর রূপ দেখে নিশ্চিত পুরুষ সত্তা তার হু হু করছে। গুনগুন করে গাইলো,
‘যে জন প্রেমের ভাব জানে না
তার সঙ্গে নাই লেনাদেনা
আসল সোনা ছাড়িয়া সে নেয় নকল সোনা
সে জন সোনা চিনে না’
ফোন ধরে না দুপুর। পা দুটো গুটিয়ে তাতে থুতনি ঠেকিয়ে রাখে। এই পর্যন্ত আটবার ফোন দিলো শাহজেব অথচ দুপুর ধরছে না৷ ম্যাসেজও আসছে। সেখানে ‘সোনা, ময়না, জাদু’ নানা নামে দুপুরকে ডেকে ফোন তুলতে বলছে শাহ কিন্তু দুপুর ধরবে না। বারো বার যদি দেয় তাহলে তেরো বারের সময় ফোন ধরবে বলে ভাবলো দুপুর। তাও কথা বলবে বুঝে বুঝে। একদম মেপে মেপে। দুপুরকে স্বামী হীনতায় ভুগানোর শাস্তি এটা।
ঠিক তেরো বার ফোন বাজতে ফোন তুলে দুপুর। রিসিভ করে কানে লাগাতেই শোনা যায় গম্ভীর পুরুষ গলার উঁচু নিচু শ্বাস ফেলার ছন্দ। নিশ্চিত মানুষটা অস্থির। সে বুঝেছে বউ তাকে শাস্তি দিচ্ছে। শাহ মিনিট দুই চুপ থাকলো অতঃপর গম্ভীর কণ্ঠ খাদে ফেলে ডেকে উঠলো,
— দুপুর?
ইশ! বুকে ঝড় তোলা সেই ডাক। দুপুরের আত্মায় টান লাগে। উত্তর করে ছোট করে,
— জ্বি।
— খুব কষ্ট হচ্ছে সোনা।
………………
— শোনে না, তুমি এভাবে সেজেছো কেন? তোমার রূপে পা গল করবে আমাকে একদিন।
দুপুর কথা বলে না। শাহ বিচলিত হয়। বলে,
— কথা বলবে না?
দুপুর তবুও কথা বলে না৷ শাহ আস্তে করে জিজ্ঞেস করে,
— শাস্তি দিচ্ছো?
একা একাই শাহ কথা বললো কিছুক্ষণ৷ দুপুর টু শব্দ করে না৷ অভিমান জমেছে না বুকে সেগুলো আগে গলবে তারপর দুপুর কথা বলবে। শাহ আদুরে স্বরে বলে,
— খুব শিঘ্রই ফিরব। তোমার হক পাওনা আমার কাছে দুপুর। সবটা উশুল করা বাকি।
দুপুর শিহরিত হয়। বুক ধুকপুক করে। খট করে ফোন কেটে দেয়। গা এলিয়ে দেয় বিছানায়। চোখে ভেসে উঠে পাঁচ বছর পূর্বের কিছু স্মৃতি যখন সদ্য কলেজে ভর্তি হলো ও।
কলেজের প্রথম দিন দুপুর বাবা’র ধরে গেলো। বাড়ী থেকে মোটামুটি দূরত্ব তবে ততটাও না৷ প্রথম দিনই কেউ একজনের সাথে দুপুর ধাক্কা খায়। তাকিয়ে দেখে একটা ছেলে। তার নাম তাসরিফ। চেয়ারম্যান বাড়ীর ছোট ছেলে। তার বাবার কলেজ সেটা। দুপুরকে ধমক দিয়ে বলে,
— চোখ খোলা রেখে চলবে মেয়ে।
দুপুর গাল ফুলিয়ে বলে,
— সেইম টু ইউ।
তাসরিফ অবাক হয়। কত বড় বেয়াদব এই মেয়ে। মুখে মুখে কথা বলে। ধমকে বলে,
— মুখে মুখে কথা বলো তুমি। বেয়াদব!
— মানুষ তো মুখে মুখেই কথা বলে৷ নাকি নাকে মুখে কথা বলে?
তাসরিফ রেগে তাকালেও পেছন থেকে পুরুষ কণ্ঠে হাসি শোনা যায়। দুপুর গলা উঁচু করে তাকাতেই দেখে সুন্দর একজন পুরুষ। চেয়ারম্যানের বড় ছেলে সে। পড়াশোনা শেষ করে রাজনীতি করছে সাথে বাবার ব্যাবসা বানিজ্য দেখছে। দুপুর যদিও চিনতো না কিন্তু তামজিদ হাসতে হাসতে পরিচয় দিলো। এটাও বললো,
— একদম ঠিক বলেছে। মানুষ মুখে মুখেই কথা বলে৷
এই তো এতটুকুই কথা হলো। তামজিদ সেদিন ফিরেও তাকায় নি কিন্তু তার ভয়ংকর জ্বালা শুরু হলো দ্বিতীয় দিন থেকে যখন দুপুর প্রথম একা কলেজে গেলো।
লোক লাগিয়ে পাহারা দেয়াতো ও। নিজে থেকেছে আড়ালে। দুপুর প্রথম প্রথম তো কিছুই বুঝলো না কিন্তু ছয়মাস পর যেদিন তামজিদ ডেকে পাঠালো সেদিন থেকে শুরু হলো দুপুরের জীবনের এক নাম না জানা অধ্যায়। সেই অধ্যায় আজও চলমান। শেষ আদো হবে কি না দুপুর জানে না।
দুপুর ঘামছে। তার মনে হচ্ছে সে অন্ধকার এক কামড়ায়। সেখানে ‘জান’ বলে কেউ ডাকছে। দুপুর কাঁদছে। ফট করে চোখ খুলে দুপুর। দেখে সত্যিই রাত। ওর ভেতর ফেটে কান্না পায়। হু হু করে কেঁদে উঠে। হাতড়ে ফোন খুঁজে কল লাগায় শাহ’কে। ভোর হতে তখন দুই ঘন্টা বাকি। শাহ চমকে উঠে। ফোন রিসিভ হতেই কানে বিঁধে দুপুরের ভেতর ফাটা কান্না। শাহজেব ডাকলো,
— দুপুর?
দুপুর উত্তর করে না। শুধু কাঁদে। কাঁদতে কাঁদতে ফোনটা কানে জড়ায় শক্ত করে। তীব্র বেদনায় জর্জরিত হয়ে ডেকল উঠে,
— শাহ?
— হ্যাঁ, সোনা। বলো শাহ শুনছি।
— আমার কোন দোষ নেই শাহ৷ আমার দোষ নেই৷ দুপুর খারাপ না৷ আপনি কি বিশ্বাস করেন?
— আমি তোমাকে নিজের থেকেও বেশি বিশ্বাস করি দুপুর। কান্না থামাও সব ঠিক আছে।
— আপনি কি করছেন?
শাহ কি বলবে খুঁজে পেলো না৷ মেয়েটা ঠিক নেই বুঝলো খুব করে। কথা স্বাভাবিক করতে বললো,
— আমি ভাবছিলাম আমাদের কয়টা বাবু হবে?
— বাবু? কয়টা হবে?
— চারটা। বাকিটা তুমি যা বলো।
— বেশি হয়ে যাবে না?
— একদমই না৷ আমরা পালব৷ বুড়ো বয়সেও দুটো রাখব। বুড়ো বুড়ি শেষ বয়সে তাদের নিয়ে নতুন সংসার গড়ব।
দুপুর কান্না থামায় হালকা। জিজ্ঞেস করে ঠোঁট উল্টে,
— আমরা কবে সংসার শুরু করব শাহ?
— খুব শিঘ্রই দুপুর। কোন এক দুপুরে তোমার আঙিনায় আমি শাহ উপস্থিত হব নত মস্তিষ্কে।
— আমি তখন আঁচল টেনে আপনার কপাল মুখে দিব।
— খুব করে অপেক্ষায় আছি দুপুর।
দুপুর শুনছে তার না হওয়া সংসারের কথা। ভোরের আলো ফুটছে অথচ টোনাটুনির কথা ফুরায় না। একসময় দুপুর ঘুমিয়ে যায়। শাহ দেখলো আজান হচ্ছে। উঠে ওযু করে নামাজ পড়ে রান্না ঘরে এলো। দুটো ডিম সেদ্ধ করতে করতে ভাবলো দুপুরকে এখানে আনলে কেমন হয়?
#চলবে….]