সে জন সোনা চিনে না পর্ব-০৯

0
22

#সে_জন_সোনা_চিনে_না
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ৯

এলোমেলো শাড়ীতে বিছানায় ঘুমন্ত এক রমণী। হাঁটু পর্যন্ত উঠা শাড়ী দিয়ে তার নরম, মসৃণ লোভনীয় পা জোড়া দৃশ্যমান। এলোমেলো এই নারী দেহের দৃশ্য প্রেমিক পুরুষকে জ্বালাতন করলো। খুব করে নাড়িয়ে দিলো তার প্রেমিকসত্তা। খুব করে চেয়ে চেয়ে দেখলো সে। চোখ জুড়িয়ে যাওয়ার মতো দৃশ্য অথচ গলাটা পর্যন্ত শুকিয়ে যাচ্ছে। এক দুই পা করে এগিয়ে এলো শাহজেব৷ দরজাটার পাল্লাটা আটকে দিয়ে শব্দহীন ভাবে। ক্লান্ত পা দুটো টেনে আনলো বিছানা অব্দি। ঐ ফর্সা গালে হাত দিয়ে গিয়েও নিজেকে গুটিয়ে নিলো। সাহস হলো না এই কালো হাতটা দিয়ে ওমন গাল ছুঁয়ে দিতে। ঢোক গিলে শাহ। গুটিয়ে নেয় নিজ হাত। পা ঘুরিয়ে চলে যায় বাথরুমে। প্রায় আধ ঘন্টা লাগিয়ে গোসল করে খালি গায়ে ফিরে আসে। পরণে থাকা লুঙ্গিটা কোমড়ে পেঁচিয়ে উঠে আসে বিছানায়। দুপুরের ধবধবে ফর্সা পেটটা তখন চোখের সামনে দৃশ্যমান হয়ে শাহ’কে যেন ভেঙাচ্ছে। চোখ বন্ধ করে আস্তে ধীরে সেথায় হাত রাখে শাহ। গায়ে কাটা দিয়ে উঠে ততক্ষণাৎ। ঝট করে হাত সরিয়ে নিয়ে থম ধরে বসে থাকে।
বাইরে ঘুটঘুটে অন্ধকার। আকাশে সেই অন্ধকার চিরে উঁকি দিয়েছে চাঁদ। চাঁদের আলোয় মায়াবী দেখালো দুপুরকে। দুপুরের এক অদ্ভুত ইচ্ছে আছে। ওর ইচ্ছে হলো দুপুরে বাসর করা অথচ আফসোস মেয়েটার বাসর হলো না। বিয়ের প্রথম রাতে শাহ চাইলেও ততটা কাছে টানতে পারে নি দুপুরকে। দুপুরের মোহরানা শোধ করা হয় নি সেদিন তাই তো এত কাছে, এত সহজে পেয়েও সেদিন ততটা গভীরে যেতে পারে নি সে। এই আফসোস তার অনেকদিনের। আজ শাহ প্রস্তুতি নিয়ে এসেছে। সুযোগ পেলে সে সৎ ব্যবহার করবে। সাহস করে পুণরায় দুপুরের পেটে হাত রেখে আঙুল নাড়তেই ঘুমের মধ্যে নড়ে উঠে দুপুর। শাহ’র আজ একটুও খারাপ লাগলো না দুপুরকে আজ জ্বালাতন করতে। দুপুর হঠাৎ করে চোখ খুলে। শক্ত হয়ে আসে ওর শরীর। বুঝার চেষ্টা বা ইচ্ছে করার পূর্বেই কানে বিঁধে শাহ’র পুরুষালী স্বর,

— মোহরানা তোমার কাপড়ের মাঝে রেখে দিয়েছি।

অতঃপর দুপুর আর কথা বলার সুযোগ পায় না। সে ভেসে যায় এই অন্ধকার আতলে সাথে যায় শাহজেব। রাত দুপুরে দুপুরের বাসর দেখে আকাশে থাকা চাঁদ হাসে। জানালা দিয়ে আসা বাতাস দুপুরের বুকে অদ্ভুত ভাবে আঘাত করে। আজ দুপুর ম’রে যাক শুধু হ ত্যা কারীটা তার শাহ হোক তাহলেই হলো। আফসোস থাকবে না তার। এই একমাত্র পুরুষ যার চোখে কামনার পূর্বে ভালোবাসা দেখেছে দুপুর। কি হতো সেদিন দুপুরকে ছুঁয়ে দিলে? দুপুর তো ফিরিয়ে দিতো না কিন্তু না সে ফেরালো বরং দুপুরকে। ছুঁয়েও দেখেনি ততটা। অথচ দুপুর জানেই না ঘুমন্ত দুপুরকে নিগূঢ় ভাবে দেখেছে তার শাহ। ছুঁয়েছে তার গাল, গলা। এদিকে আজ তার সৌন্দর্য ভরা বদলে ডুবে গেলো এক কৃষ্ণ রঙা পুরুষের হাত।

আকাশের রং বদলাতে লাগলো। তিমির কেটে দেখা যাচ্ছে মৃদু মৃদু আলোর ঝলকানি৷ ভোরের শুরুটা আজ দুপুরের কাছে ভিন্ন। এক উষ্ণ বুকে সে শুয়ে আছে। চোখে মুখে তীব্র কাতরতা। মন খারাপ তার উপচে উপচে পড়ছে। এতটা দিন গড়ালো অথচ যার দেখা দুপুর পেলো না আজ তাকে এত কাছে পেয়ে দুপুর মোমের পুতুলের মতো গলে গেলো। গলে যাওয়া পুতুলটাকে দুই হাতে সামলে নিলো তার শাহ। দুপুর কৃতজ্ঞতা সরূপ চোখ দুটো ভরে আসে। শাহ’র বুকে দুপুর আজ ঠিক দুপুর চণ্ডীর মতোই ফুটেছে। তাকে ফুটাতে সর্বোচ্চ ত্যাগ তিতিক্ষা তার শাহই করেছে। এই খবর কি আর দুপুর রাখে?
চোখ বুজে নেয় দুপুর। তার বদ্ধ চোখে নরম স্পর্শ পায় সে। আরামে আরামে একসময় ঘুমের রাজ্যে বিচরণ করে ও। শাহ নিজের হাতটা বেশ খানিকটা সময় বুলালো দুপুরের মাথায়। সোনায় গড়ানো এক নরম পুতুলকে আজ যথেষ্ট কাছে টেনেছে সে। তাদের ভালোবাসার এক নতুন অধ্যায় যেন রচনা হয়েছে এখানে। শাহ দুপুরের কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলে,

— এই কালো চাঁদে এমন কি পেলে দুপুর যে আমার সান্নিধ্য পেতে এতটা মরিয়া হয়ে উঠলে?

দুপুর নড়েচড়ে আবারও ঘুমায়। তবে উঠে যায় শাহ। ফজরের আজান হচ্ছে।
.
দুপুরের ঘুম ভাঙলো আজ দেড়ীতে। শরীর মুচড়ে উঠতে গিয়েই সারা দেহ ঝনঝন শব্দে বাজতে লাগলো। কালো চাঁদ দূর আকাশেই সুন্দর। যত কাছে আসবে এদের কলঙ্কে তোমাকে যত রাঙাবে তুমি ততই পুড়বে। ছাই হবে। ঝলসে যাবে। দুপুর নিজের মাঝে আজ এক বিরাট পরিবর্তন লক্ষ করলো। বিয়ের এতদিন পর নিজেকে বিবাহিত মনে হলো। গায়ে কাপড় টেনে আস্তেধীরে উঠে এদিক ওদিক তাকালো। নাহ কামড়ায় শাহ নেই। শাহ’কে দুপুরের কাছে আলাদিনের যাদুর চেরাগ মনে হয়। যাকে পাওয়া দুষ্কর। আবার পাওয়া গেলেও আটকে রাখা মুশকিল। সে ধোয়ার মতো মিলিয়ে যায়। দুপুর তখন দু’চোখে খুঁজেও পায় না। ক্লান্ত হয়ে যায়। শাহ’কে নিয়ে দুপুরের গবেষণা শুরু হয়েছিলো ঠিক বিয়ের কবুল পড়ার পর থেকে যা এখন পর্যন্ত চলমান।
মুখ হাত ধুয়ে দুপুর ঘর গোছালো। শাহ’র ঘামে ভেজা শার্ট প্যান্ট যা বাথরুমে পেয়েছে সব ধুয়েছে ও। মেঝেটা সহ ঝাড়ু দিয়ে অতঃপরই বালতি ভর্তি কাপড় নিয়ে রুম থেকে বের হলো। দেড়ী হলেও আজ ততটা না। এই তো আধ বেলা মাত্র। এগারোটা বেজে পাঁচ মিনিট। দুপুর ড্রয়িং রুম পেরিয়ে উঠানে এলো। রান্না ঘর থেকে শাশুড়ী দেখেই হাক ছেড়ে ডাকলেন,

— বউ মা? বউ মা? আগে খেয়ে যাও মা।

— আসছি মা।

ভেজা চুলের গামছাটা খুলে চুল ঝাড়লো দুপুর। কাপড় গুলো একে একে তারে মেলে দিলো। পাশে তাকাতেই দেখলো লম্বা গাছটা ভর্তি দুপুর চন্ডী ফুটেছে। গাল ভরে হাসে দুপুর। চোখ ভর্তি তার দুষ্টামি। গুনগুন করে গান গায় কিছুক্ষণ। কাপড় সব মেলতে গিয়ে ওর মনে হয় শাহ’র কাপড় থেকে আলাদা ঘ্রাণ বের হয়। দুপুর অবাকই হলো। একই পাউডার দিয়ে কাপড় ধোয়া হয়েছে তাহলে কেন ভিন্ন ঘ্রাণ আসবে। লাজলজ্জা ভুলে শার্টের কাছে নাক নিয়ে শুঁকতে যেতেই ধরা খেলো ও। পেছন থেকে ভারী পুরুষালী স্বর শোনা গেলো,

— এত সুন্দর বউ রেখে অবশ্যই পরকীয়া করি না আমি দুপুর। তাছাড়া ধোয়া শার্ট শুঁকে কি ই বা পাবে বলো?

হায়! গেলো তো দুপুর। নিজের হায়ার সবটুকু ত্যাগ করে ও মুখ ঘুরিয়ে তাকালো। আকাশের দিকে একবার তাকিয়ে চুলগুলো ঝাড়া দিয়ে গামছা মেলে দিলো তারে। মেদহীনা কোমড় বাকিয়ে হেঁটে চলে যেতে নিলেই শাহ গম্ভীর কণ্ঠে বললো,

— বাজারের ব্যাগ নিয়ে যাও।

দুপুর অবশ্য খেয়াল করে নি। পেছনে ঘুরে ব্যাগ নিতেই যেন পেটে টান খেলো তবুও ব্যাগটা নিয়ে যখন যাবে তখন শাহ ওর মাথার ঘোমটা টেনে দিলো। গালে গাল লাগার উপক্রম। শাহ আস্তে করে বললো,

— একটু ঢেকে থাকবে তো নাকি।

লজ্জায় দুপুর চোখ ঝাপটায়। দ্রুত বেগে ভেতরে ছুটে। শাহ হেসে নিজেও ভেতরে ঢুকে। গরমে অবস্থা কাহিল তার। দুপুর এখনও খায় নি। শাশুড়ী ওকে আদুরে ধমক দিলেন। খেতে বসালেন নিজের কাছে। দুপুর খেতে খেতে জিজ্ঞেস করে,

— তিব্বি আসে নি?

— এলো বলে।

শাহ ফ্যান ছেড়ে শার্ট খুলে আলনায় ঝুলালো। দুপুর আড় চোখে দেখছে তাকে। প্যান্ট খুলে লুঙ্গি পরে সোফায় গা এলিয়ে বসা মাত্রই মা শরবত দিয়ে গেলেন। দুপুর ঢোক গিলে। কালো চাঁদ হবে অসুন্দর কিন্তু নাহ এই কালো চাঁদ তো ভয়ংকর সুন্দর। দুপুরের চোখ তাকে যত দেখে ততই যেন চোখের হাহাকার বাড়ে বৈ কমে না৷ দুপুর অনাহুত হয়ে যায়। খাওয়া আর হয় না। মনে হয় সদ্য প্রেমে পড়া এক প্রেমিকা তার প্রেমিক দেখে খাওয়া ভুলেছে। শাশুড়ী এবার জোরেই ধমক দিলেন। কঠিন ভাবে বললেন,

— ধরে একদম বাপের বাড়ী দিয়ে আসব কিন্তু। খাবি না এরপর অসুস্থ হয়ে পরে থাকবি তো।

ঠোঁট উল্টে দুপুর কোনমতে শেষ করলো। দেখলো শাহ উঠে রুমে গিয়েছে। শাশুড়ী দুপুরকে ঠেলে রুমে পাঠাতে পাঠাতে বললেন,

— শাহ’র কাছাকাছি থাকবে মা৷ যতক্ষণ স্বামী বাসায় থাকে স্ত্রীর উচিত তার কাছাকাছি থাকা।

দুপুরকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই তিনি পাঠালেন রুমে। দুপুর এক দুই পা ফেলে রুমে ঢুকলো। দেখলো শাহ আলমারি খুলে কিছু করছে। দুপুর সোজা বিছানায় গিয়ে বসলো। পা ঝুলিয়ে মনোযোগ দিয়ে নিজের পায়ের আঙুল দেখছে। পায়ের এক আঙুলে একটা আন্টি পরা যেটা কাল রাতে সোহাগের সময় শাহ তাকে পরিয়েছে। দুপুর এই ছোট্ট যত্নেই তো আবেগ আপ্লূত হয়েছে। ভুলে গিয়েছে এত দিনের উপেক্ষা। অপেক্ষা। ওর ভাবনার মাঝেই শাহ এসে দাঁড়ালো কাছাকাছি। ছোট্ট একটা ব্যাগ এগিয়ে দিলো ওকে। দুপুর লজ্জা পেয়ে মাথা নাড়ে। শাহ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে,

— কেন?

— কি হবে?

— কি হবে মানে? পড়াশোনা করছো না এখন।

— আমি তো শুধু পরীক্ষা দেই। যাই না তো ক্লাসে।

শাহ জানপ্রাণ অবাকই হচ্ছে। ওর ভাবনা বহুদূর। জোর করার তো প্রশ্নই উঠে না। শাহ নিজেই এক গ্লাস পানি নিয়ে বসলো। দুপুরের গালে হাত দিয়ে নিজের মুখ বরাবর করলো। দুই গাল নিজের হাতের মাঝে নিয়ে কপালের মধ্যে একটা ছোট চুমু দিলো। বললো,

— আমরা পরিবার বড়ো করব তবে আমাকে একটু সময় দাও। অনেকটা গোছানো বাকি আমার। তোমাকে নিয়ে আমার পরিকল্পনা অনেক দুপুর। তুমি যেভাবে ভাবছো আসলে সবটা তেমন না। আমাকে ভালোবাসো আগে এরপর নাহয় ভালোবাসার চিহ্ন আনো।

— আমি ভালোবাসি আপনাকে।

অকপটে দুপুরের এক স্বীকারোক্তি। শাহ হতাশ হলো। এই মেয়েটা ভিন্ন। একটু অন্যরকম। দুপুররা হয়ই এমন। সহজ, সরল, স্নিগ্ধ এবং নরম। শাহ ওকে শুধু ব্যথার ঔষধটা খায়িয়ে বললো,

— ঘুমাবে একটু?

— মাত্র উঠেছি।

শাহ ওর কপালে হাত দিয়ে দেখলো। হালকা গরম। অসন্তুষ্ট গলায় বললো,

— বাইরে রোদের মধ্যে কি করছিলে?

— কাপড় শুকচ্ছিলাম।

— আর যেও না।

দুপুর কথা বলে না। তাকিয়ে থাকে শাহজেবে’র দিকে। শাহ মৃদু হাসে। এই মেয়ে কি দেখে এত ওর মাঝে? এত সুন্দর একটা মেয়ে অথচ সে দেখে শাহ’র মতো কালো পুরুষকে। শাহ দুপুরের মুগ্ধ দৃষ্টি দেখে বিগলিত হাসে। দুই হাতে টেনে নেয় নিজের বুকে। মাথার ভেজা চুলে হাত বুলিয়ে বলে,

— আমার বুকে অবশেষে দুপুরচন্ডী ফুটলো। এই ভর দুপুরে আরেকবার ফুল ফোটাব নাকি?

________________________

মিরাজ সাহেব হতবাক হয়ে বসে আছেন। তাদের বাড়ীর চৌকাঠ মাড়িয়েই একে একে চেয়ারম্যান আর তার স্ত্রী প্রবেশ করেছে। পেছনে আরো দু’জন ব্যাক্তি। এদেরও চিনেন তিনি। চেয়ারম্যানের ভাই এদের মধ্যে একজন। সবার শেষে ঢুকলো তাসরিফ। পরণে সাদা ধবধবে পাঞ্জাবি। মুখে গম্ভীর্যতা। দাদী ওদের মতি গতি বুঝে গেলেন। এর আগেও একবার এসেছিলো তারা। সায়রাকে বিয়ে করতে চায় তাসরিফ। এদিকে এই বিয়েতে কেউ রাজি না৷ না সায়রা আর না পরিবারের কেউ। তারমধ্যে তামজিদ যা করেছে দুপুরের সাথে, সবটা মিলিয়ে বিষিয়ে উঠেছে সকলে।
তারা নিজেরাই বসলেন সবাই। দুপুরের মা দৌড়ে গিয়ে সায়রা’র কাছে সব বললেন। সায়রা নিজেকে এতটা বছর সাহসী প্রমান করে এসেছে। আজ এই মূহুর্তে ওর সব তালগোল পাকিয়ে গেলো। দুপুর বাসায় নেই। তাসরিফ কোন না কোন ভাবে এটা জেনেছে। ছেলেটা চতুর। মাহমুদ’কে সায়রা ভালোবাসে না। কোন পিছু টান নেই ওর। মাহমুদ এমন এক অতীত যেই অতীত সায়রা কখনো ফিরে আসুক তা চায় না। মাহমুদের মতো পুরুষরা মনে রাখার যোগ্য না। তারা মানুষ ঠকাতে জানে। সায়রা ভাবে মাহমুদ তাকে ঠকায় নি বরং সে নিজেকে নিজে ঠকিয়েছে। এত কিছুর মাঝেও তাসরিফ’কে বিয়ে করতে মন টানছে না। ছেলেটা ওর থেকে তিন বছরের ছোট। না সমাজ মানে না মানে সায়রা। কিন্তু গতরাতের তাসরিফে’র প্রতিটা হুমকি বার্তা দেয় যে দুপুর’কে নিয়ে তামজিদ যেকোনো কঠিন সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারে। সায়রা চোখ বুজে কিছু ভাবলো অতঃপর সোজা হেঁটে বেরিয়ে এলো দুপুরের মায়ের সাথে। আসতে আসতে কানে বাঝলো তাসরিফে’র কণ্ঠ। সায়রা’র মায়ের সাথে কথা বলছে ও।

— আম্মা, আপনি রাগ করবেন না। য়রা আসুক। আগে ওর কথা শুনুন।

তাসরিফে’র ঠান্ডা কণ্ঠ। সায়রা ঢোক গিলে। মিরাজ সাহেব বোনকে দেখেই এগিয়ে গিয়ে হাত চেপে ধরে। ভরসার স্বরে বলে,

— তুই না করে দে সায়রা। ভাই আছি তো। কি আর করবে ওরা? মে-রে ফেললে ফেলুক। আমার দুই মেয়ে পাড় করেছি তো। তুই আমার ছোট বোন৷ তোকে আমি নরকে ঠেলব না৷

সায়রা ভাইয়ের হাতটা শক্ত করে ধরে এগিয়ে আসতেই তাসরিফে’র বাবা হাসি মুখে বললেন,

— এখানে আসো মা।

সায়রা যায় না৷ দেখে একে একে সবাইকে। মুখে গাম্ভীর্য নিয়ে বসা তাসরিফে’র মা। নিশ্চিত মহিলা ছেলের বউ হিসেবে চায় না সায়রা’কে। স্বাভাবিক যদিও ব্যাপারটা। তাসরিফ হয়তো জোর করে এনেছে। সায়রা দেখলো কাজি সহ এসেছে ওরা। চেয়ারম্যান সাহেব উঠে দাঁড়ালেন। সায়রা’কে উদ্দেশ্য করে বললেন,

— তোমার ভাই আর মা কিছুতেই রাজি হচ্ছে না মা। তুমি তাদের জানিয়ে দাও তুমি রাজি৷

সায়রা তাকালো মাথা নীচু করে বসা তাসরিফে’র দিকে। ছেলেটার মাথা নিচু হলেও সায়রা জানে আজ ভয়ংকর কিছু হবে। সাদা পাঞ্জাবির পায়জামার কোমড়ে গোঁজা পি স্ত লটার জায়গা সামান্য উঁচু। কি করবে আজ এরা? কাকে মা’রবে? সায়রা বৃদ্ধ মায়ের দিকে তাকিয়ে থাকে। মা চিন্তায় চোখ মুখ শুকিয়ে আছেন। এতক্ষণে মুখ খুলে তাসরিফ,

— বিয়েতে দেড়ী হচ্ছে য়রা। কাজি সাহেব অপেক্ষা করছেন।

মিরাজ সাহেব থেকে সায়রা হাত ছুটালো। মিরাজ সাহেব হতবাক হয়ে গেলেন। বোনের হাত ধরে বলে উঠলেন,

— কোথায় যাচ্ছিস?

— একটা ঝামেলা থেকে সবাইকে মুক্তি দিতে।

মিরাজ সাহেব মানেন না। বোনের হাত শক্ত করে ধরে রাখেন। সায়রা অসহায় চোখে ভাইকে দেখে অতঃপর চোখের ইশারায় কথা বলে। ভাই হিসেবে অক্ষম হয়ে হাত ছাড়েন মিরাজ সাহেব। চেয়ারম্যান সাহেব নিজে জায়গা করে দিলেন তাসরিফে’র কাছে। খুব অল্প সময়ের মধ্যে বিয়েটা হয়ে গেলো। তাসরিফে’র মুখ হাসিহাসি। সায়রা একই ভঙ্গিতে বসে আছে। দুপুরের মা কি করবেন বুঝলেন না। টেবিল ভর্তি করে নাস্তা দিলেন৷ মিষ্টি আনলেন। তার মাথায় আপাতত আর কিছু ঢুকলো না। সায়রা তাসরিফে’র দিকে না তাকিয়েই জিজ্ঞেস করে,

— উঠব আমি নাকি আরো লাগবে?

— সারাজীবনের জন্য লাগবে।

মলিন হাসে সায়রা। ওর ভাবভঙ্গি দেখে তাসরিফ চিন্তিত হয়। তিন বছরের ভালোবাসা এই সায়রা। অনেক ধৈর্য ধরে রেখেছে সে। আজ মোক্ষম সুযোগ ছিলো যা লুফে নিয়েছে সে। সবাই নাস্তা খেলেও ছুঁয়ে দেখলো না তাসরিফে’র মা৷ এদিকে তাসরিফে’র ভেতর খচখচ করছে। সায়রা যে ভালো কিছু ভাবছে না এটা ও খুব করে বুঝে যাচ্ছে। একদিকে তার সুখে বুক ভাসছে অন্যদিকে চিন্তায় মাথা ছিড়ে যাচ্ছে। সায়রা মা’কে জড়িয়ে ধরে কপালে চুমু খেলো। আস্তে করে বললো,

— আমি ভালো আছি মা। তুমি ভালো থেকো।

বৃদ্ধা হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন। সায়রা তাকে থামায় না। ভাই আর ভাবীকে বিদায় জানিয়ে পা বাড়ায় অচিনপুরের উদ্দেশ্যে। তাসরিফ ওর হাত মুঠ করে ধরে। সায়রা মনে মনে হাসে। তার হাসির শব্দ নেই আছে শুধু বুক ভাঙা আর্তনাদ।

#চলবে…..