সে জন সোনা চিনে না পর্ব-১১+১২

0
11

#সে_জন_সোনা_চিনে_না
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ১১

— আমার সতীন কি করছে?

দুপুরের প্রশ্নে শাহ নিজের বুকে তাকিয়ে প্রতিত্তোরে বললো,

— বুকে ঘুমাচ্ছে আমার।

— ওহ তাই নাকি? তার টানেই বুঝি নতুন বউ রেখে চলে গেলেন?

— সত্যি বলতে তার টানেই আসা। সে ছাড়া আমি অচল।

— সে কি আমার থেকেও সুন্দর?

শাহ হাসে শব্দহীন। বুকে থাকা অস্তিত্বে হাত বুলায় সন্তপর্ণে। বলে,

— তুমি যে কতটা সুন্দর দুপুর তা আমি ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না৷ কখনোই না। তোমার পায়ের আঙুল থেকে চুল পর্যন্ত আমার কাছে ভালো লাগে৷ ভীষণ ভালো লাগে। আমি অভিভূত হয়ে দেখি তোমাকে। প্রথম যেদিন তোমাদের বাসায় ছিলাম রাতভর দেখেছি তোমাকে। সকাল হতে ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখেছি। তুমি তো ঘুম। আমি যেন বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না এত সুন্দর মেয়ে মানুষ হয়৷ এত ফর্সা, এত নরম, এতটা তুলতুলে কেউ হয় জানা ছিলো না৷ তোমায় দেখেছি প্রথমে। এই তুমি জিজ্ঞেস করছো আমার বুকে যে আছে সে সুন্দর কি না? উত্তরে অবশ্য বলব, সে দেখতে কালো। আমার মতোই কালো। কথায় বলে না, ‘রতনে রতন চিনে শিয়ালে চিনে মুরগী’। আমি কালো মানিক কালোই চিনেছি।

দুপুর এদিকে চুপ করে আছে। শিয়ালে মুরগী চিনে কথাটায় ভুলভাল আছে৷ প্রবাদটা তো একটু ভিন্ন। দাঁত দিয়ে নখ কাটতে কাটতে বললো,

— অপজিট এটরাক্স। কথাটা শুনেন নি?

— শুনেছি তো।

— তাহলে তো কালো মানুষ সাদাতে মজবে। যেমন আপনি।

— আমি ব্যাতিক্রম বুঝলে দুপুর। সাদা, কালো দুটোই চালাতে হয়। দুই বউকে সমাধিকার দেই আরকি।

— থামুন এবার।

— সতীন নিয়ে না এত আগ্রহ তাহলে এখন কেন ভালো লাগছে না?

— জানি না কিন্তু এই দুষ্টামি আর ভালো লাগছে না৷

— দুষ্টামি না তো এটা৷

— শাহ…..

শাহ থামলো। দুপুরের কণ্ঠে কিছু একটা ছিলো। কি ছিলো তা ও জানে। নারীজাতির স্বভাব ছিলো। দুষ্টামিতেও তারা সতীন মানতে চায় না। শাহ আস্তে করে বললো,

— পরে আমার দোষ দিও না কিন্তু।

— ফোন রাখছি….

— না না৷ মাত্র রাত হলো। আজ আধ রাত জাগব তোমার সাথে।

— কারণ?

— বউ রেখে এলাম৷ প্রথমে তো কষ্ট ছিলোই কিন্তু এবার কষ্টটা বেশি। আদর সোহাগের বউ আমার। বুকের ভেতর হাহাকার করে বুঝলে। সারাদিন তো কাজে কেটে যায় রাত হলেই আমার দশা হয় খারাপ। মন চায় ছুটে আসি তোমার কাছে।

— তাহলে নিয়ে চলুন আপনার কাছে।

— দেখছি এ বিষয়টা তবে তার আগে প্রমিজ করো সতীনের সাথে ঝগড়া করবে না৷ দু’জন মিলেমিশে থাকবে।

খট করে ফোনটা কেটে গেলো৷ দুপুর কেটে দিয়েছে। শাহ হেসে ফেলে। তার বুকে থাকা কালো দুপুরের সতীনের গায়ে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে,

— তুমি আজ বোবা বলে দুপুর চাইলেও ঝগড়া করতে পারবে না। ও এমনিতেও মিষ্টি একটা মেয়ে। ঝগড়া বিবাদ ওর দ্বারা সম্ভব না৷ আগেভাগে জানিয়ে রাখছি নাহয় তোমাকে দেখে হাজার প্রশ্ন করবে।

দুপুর মন খারাপ করে বসে আছে তখনই দরজায় টোকা পড়ে। দুপুর বলে,

— খোলা তো।

তিব্বি ভেতরে ঢুকে। দুপুর ইশারায় কাছে ডাকতেই লাফ দিয়ে খাটে উঠে৷ আবদার জুড়ে দেয়,

— কিছু খাওয়াও ভাবী৷ পেটে চু চু করছে।

— নুডলস খাবে?

— খাব মানে আঙুল চাটব আমি।

দুপুর উঠে যেতে যেতে বললো,

— আজ ঘুমাও নি এখনও। তোমার ভাই শুনলে দিবে নে।

— ভাইকে কে বলবে?

— তাও ঠিক।

দুপুর নুডলস চড়ালো। তিব্বি ভাবীর আঁচল টেনে ধরে জিজ্ঞেস করে,

— তোমার মন খারাপ ভাবী?

— হ্যাঁ।

মাথাটা ঠিক বাচ্চাদের মতো নাড়লো দুপুর। তিব্বি ভাবীর হাতটা বুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদো কাঁদো মুখ করে বলে,

— কেন? আম্মু বকেছে তোমাকে শাশুড়ীদের মতো? তুমি কিন্তু শাবানা সাজবে না ভাবী৷ আমরা প্রতিবাদ করব৷ আমি আছি তোমার সাথে। এখনই পুলিশ ডাকব।

দুপুর হতবাক হয়ে প্রশ্ন করে,

— নিজের মা’কে পুলিশ দিয়ে ধরাবে?

— না না কি বলো।

— তাহলে?

— ভাইকে ডাকব৷ বিচার বসাব। শাশুড়ী বিরোধী আন্দোলন করব আমরা। তুমি ভিক্টিম আমি সাপোর্টার৷ বাবাকেও দলে নিতে হবে ভাবী৷ বাবা হবে আই উইটনেস।

— ওওও। তোমার ভাই কি হবে?

— বিচারক।

দুপুর ফিক করে হেসে ফেললো৷ নুডলস তখন তৈরী। দুপুর তা বাটিতে বাড়ছে। তিব্বি হাত নেড়ে নেড়ে তখনও বলছে,

— এটা কোন কথা না কিন্তু ভাবী৷ আমরা এ বিষয়ে আলোচনা করব।

— হু চলো।

ওরা বসলো খাটের উপর। নিজের ভাইয়ের জায়গাটা মে’রে দিলো তিব্বি৷ ভাবীর পাশে ভাবীর সাথেই খাচ্ছে সে। দুপুরের ফোনে ছবি তুলে হোয়াটস অ্যাপে পাঠিয়ে নিচে লিখলো, ‘নাইট ডেট উইথ মাই ক্রাশ’ সাথে দুটো লাব ডাব ইমোজি। শাহ’র ফোনে কট করে শব্দ হতেই ও চেক দিলো সাথে সাথে হিংসায় জ্বলজ্বল করে উঠে ঐ কালো মনির দুটো চোখ। রাগে চোয়াল শক্ত হলো। কপালে আঙুল ঘঁষে মা’কে ফোন দিতে চাইলো কিন্তু তার ব্যাক্তিতের সাথে ব্যাপারটা বেশ দৃষ্টিকটু। শাহ’র ঘুম উড়ে গেলো৷ বউ কাছে আনতেই হবে। রাতবিরেত এই তিব্বি গিয়ে তারই বিয়ে করা বউয়ের সাথে সময় কাটাবে এসব মানবেই না শাহজেব৷ কিছুতেই না৷

____________________

চেয়ারম্যান বাড়ীতে আজ সকাল সকাল বিশাল আয়োজন। বাড়ীতে নতুন বউ। চেয়ারম্যান সাহেব নিজে টেবিলে আছেন। পত্রিকায় তার সম্পূর্ণ দৃষ্টি। তাসরিফ ভোরে উঠে কোথায় জানি গিয়েছিলো। ফিরেছে খানিক আগে। পশ্চিম দিকের দরজাটা বন্ধ। সাহস করেও কেউ টোকা দেয় নি। তাসরিফে’র মা রান্নাঘরে বুয়াদের কাজ বুঝাচ্ছেন। তার বেশ ভুষাই বলে দেয় সে এই বাড়ীর একমাত্র কর্তী। গায়ের কাপড় আর গহনা গুলো নিজের গর্ব করে যেন বলে, আমরা এই বাড়ীর গিন্নীর শরীরে আছি। আঁচলে প্রাচীন আমলের মতো বিড়াট চাবির গোছা। তার নড়চড়ে সেগুলো ঝনত ঝনত শব্দ করে মাঝেমধ্যে।

তাসরিফ বিছানায় বসা তখন৷ বাথরুম থেকে আস্তেধীরে পা ফেলে বের হচ্ছে সায়রা। দ্রুত পায়ে এগিয়ে এসে ওকে ধরে বিছানায় আনে তাসরিফ। কপালে গালে হাত ছুঁয়ে দেখে তাপমাত্রা। গলার দিকটায় বিশ্রী দাগটা শুরুতেই চোখের নজর কাড়ছে। সায়রা একদম চুপচাপ আছে। তাসরিফ ওর পেঁচিয়ে থাকা চুলগুলো খুলে নরম তয়লা দিয়ে চেপে চেপে মুছছে। এমনি সময় খুব বেশি কথা না বলা তাসরিফ বউ এর সামনে খুব কথা বলছে। চুলগুলো যত্ন করে মুছতে মুছতে বলছে,

— আপনি হলেন একটা পুতুল, বুঝলেন য়রা। আপনাকে আমি নিজের হাতে সাজিয়ে গুছিয়ে রাখব। আপনার এখন থেকে কোন কাজ নেই। মাথার চুল থেকে পায়ের নখ সবটা আমি করব ঠিক আছে। এখন আপনি বলুন তো আমি কি এখানে খাবার আনব নাকি বাইরে গিয়ে খাবেন? আপনার কষ্ট হবে এমন কোন কাজই এখানে হবে না য়রা। বললাম না আপনাকে পুতুল বানিয়ে রাখব আমি৷

গলার স্বর সায়রা’র চেপে চেপে আসছে। ফ্যাচফ্যাচে কণ্ঠে বলে উঠে,

— শুধু শয্যাশায়ী হলেই হবে তাই তো? এতটুকু কষ্ট কি আর কষ্ট?

তাসরিফের বুকটায় মোচড় খেলো। চঞ্চল কণ্ঠে ভাটা পড়লো। পেছন থেকে সামনে এসে সায়রা’র গাল দুটো নিজের হাতে নিয়ে বললো,

— আপনি ভুল ভাবছেন য়রা। গতরাতে তো আমি….

সায়রা’র মুখটা দেখে তাসরিফ কথাটুকু গিলে নেয়৷ নিজের ঠোঁট দুটো চেপে ধরে। তার চোখ জ্বলছে কিন্তু কেন? এই চোখ বিনাকারণে কেন জ্বলবে? কারণ তো অবশ্য অনেক বড়। সায়রা গতরাতে তাকে বাঁধা দেয় নি কিন্তু সায়ও দেয় নি। তাসরিফ কি তাহলে খুব বেশি ভুল করে ফেললো? তার পুতুলটাকে সে কষ্ট কখনোই দিতে পারে না৷ ভেজা চুলগুলো নেড়েচেড়ে চিরুনী চালায় তাসরিফ। সায়রা’র পরণে থাকা আনারকলির ওরনাটা দিয়ে আস্তে করে মাথা ঢাকে। সকাল সকাল সে যা পেরেছে কিনে এনেছে। খোলা ছিলো না কিছুই।পরিচিত বন্ধুর অনলাইন ব্যাবসা। তার থেকেই আপাতত যা পেরেছে এনেছে। সায়রা’র মুখে দুটো হাত বিচরণ করছে। আলতো করে মুখটায় ক্রিম লাগাচ্ছে। গলার লাল দাগটায় মলম লাগাচ্ছে। তাসরিফ আস্তে করে বলে,

— ব্যথা আছে য়রা?

সায়রা নির্বাক। তার ভেতরে কিছুর চাপা আর্তনাদ যা কেউ শুনতে পায় না৷ এত কাছাকাছি থাকা তাসরিফও না। তাসরিফ অপলকভাবে দেখছে সায়রা’কে। মন তো পড়া যায় না কিন্তু এই দুটো যে মানুষের বড় শক্র। মনের খবরের সমাচার হয় এই চোখের পর্দায় যা মনের মানুষ পড়ে নেয় খুব সহজে। ঝামেলাহীনভাবে।
.
সায়রা’কে নিয়ে টেবিলে উপস্থিত হয় তাসরিফ। চেয়ারম্যান সাহেব হাসিমুখে বললেন,

— তামজিদটা থাকলে ঘরটা ভরা লাগতো আমার। বউমা এটা নিজের বাড়ী মনে করবে না বরং এটা তোমারই বাড়ী। মেয়ে নেই আমার বুঝলে মা। তোমাকে মেয়ে ডেকে স্বাদ মেটাব।

সায়রা টু শব্দ ব্যায় করে না৷ আরেকজনের মেয়ের জীবন কয়লা করা মানুষের বাপ কি না চায় মেয়ের পিতা হতে? আচ্ছা এরা কি আদৌ জানে মেয়ে কি? একটা মেয়ে তার মা-বাবার কতটা আদরের তা কি এরা জানে? বুঝে একটুও? সায়রা’র মন বলে না বুঝে না৷ বুঝলে আজ দুপুরটা ভালো থাকতো। চার পাঁচ বছর তার নষ্ট হতো না।
টেবিল ভর্তি নাস্তা৷ তাসরিফ সায়রা’র প্লেট সাজালো। সায়রা ছুঁয়েও দেখছে না৷ তাসরিফে’র মা স্বামীকে বেড়ে খাওয়াচ্ছেন। তিনি আছেন চাপা এক ভয়ে। গতকালের কান্ডটা তো আর ছোট না৷ আশেপাশের দুই চারজন মহিলাদের সাথে সায়রা আর তার পরিবার নিয়ে কটুকথা বলছিলেন তিনি। বুড়ো বয়সে তার ভাই আর মা মিলে তাসরিফে’র ঘাড়ে ঝুলিয়েছে সায়রাকে সহ নানান ভাবে হেয় করেছেন। তিনি জানতেন সায়রা শুনছে কিন্তু কোন ভাবেই বুঝেন নি এতদূর গড়াবে। যদি তাসরিফ জানে তাহলে সে মা আর বোন মানবে না৷ এই মেয়েটার জন্য সে পা গ ল ছিলো। তিনি নিজে সাক্ষী।
তাসরিফ আস্তে করে জিজ্ঞেস করে,

— খাচ্ছেন না কেন য়রা? এগুলো পছন্দ না? আমি কি অন্য কিছু আনব?

সায়রা এক পলক ওর দিকে তাকিয়ে উঠে যায়। আস্তে ধীরে হেঁটে হেঁটে রুমে চলে যায় ও। তাসরিফের গলাটায় শুধু ঢোক গেলা হচ্ছে। তার বুকের ভেতর যেমন শান্তি তেমনই একটা খুঁতখুঁত করা কাজ করছে। হঠাৎ ই বলে উঠে,

— ওহ শিট! ও এগুলো খাবে কিভাবে? আমি কেন বুঝলাম না? ওর তো গলায় ব্যথা। ওর জন্য স্যুপ করতে হবে।

মা-বাবাকে উপেক্ষা করে তাসরিফ রান্না ঘরে গিয়ে নিজে রান্না করলো। রুমে গিয়ে দরজা আটকে দিতেই চেয়ারম্যান সাহেব বললেন,

— তাসরিফে’র পা গ লা মি দেখে আমি শুধু ভাবছি তামজিদ দেশে ফিরে এবার দুপুরকে বিয়ের পর কোন উন্মাদনাই না দেখাবে।

তখনই ফোন আসে তার। বড় ছেলের ফোন পেয়ে তারাতাড়ি ফোন ধরলেন চেয়ারম্যান সাহেব। ওপাশ থেকে কিছুই শোনা গেলো না অবশ্য। চেয়ারম্যান সাহেব স্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে উচ্ছসিত কণ্ঠে বললেন,

— শুনছো, তামজিদ ফিরছে শিঘ্রই।

#চলবে…..

#সে_জন_সোনা_চিনে_না
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ১২

দুপুর বাড়ী ফিরেছে গভীর রাতে। শশুর আর তিব্বি রাত করে দিয়ে গেলো। শাশুড়ী নামক মহিলাটা দুপুরকে জড়িয়ে ধরে যখন কাঁদলেন দুপুর তখন একদমই চুপসে গিয়েছিলো। তার ভেতরে অদ্ভুত এক খারাপ লাগা কাজ করেছিলো তখন। সব ভেঙেচুরে কান্না আসছিলো। দুপুর বরাবরই শান্ত মেয়ে। কান্নাটাও শান্তই থাকে তার। ভেতরের খারাপ লাগা ফুপি বাদে তেমন কেউকে বলা হয় না। ইদানীং খারাপ লাগা নামক তীরটা গিয়ে লেগেছে শাহ’র উপর। বাসায় এসে তার মনটা খুব খারাপ হলো। ফুপির সাথে তাসরিফে’র বিয়ে হয়েছে কথাটা দাদীর কাছে শুনেই মনটা উদাস হয়ে গেলো। দুপুর অবশ্য কাউকে কিছু বললো না। চুপ করে রুমে এসে দরজা লাগিয়ে খাটে পিঠ ঠেকিয়ে মেঝেতে বসলো। মাথাটায় অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছে তখন। বাইরের কালো নিকেষ অন্ধকারে তখন নিজেকে দেখে দুপুর। কেন জানি অন্ধকার মানেই আতঙ্ক মনে হয় তার কাছে। চোখের সামনে দেখা মিলে কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত মূহুর্ত।
সেবার সপ্তাহ খানিক নিজের কটেজে তামজিদ আটকে রাখলো দুপুরকে। দুপুর তখন ফুলের ঐ নরম কলিটা ছিলো যাতে আকর্ষণ থাকে প্রতিটি মৌমাছির।তাসরিফ অবশ্য বিষাক্ত এক মৌমাছি ওর নিকট। অন্ধকার ঘরে যখন গম্ভীর কণ্ঠে ‘দুপুর’ ডাকটা কানে আসতো তখন চারপাশ কেমন ঝমঝম শব্দ শুরু করে দিতো। দুপুর তখন অন্ধকার ঘরে হাঁটুতে মাথা গুজে বসা। আচমকা ক্যাটক্যাটে একটা শব্দ কানে আসতেই ভয়ে গুটিয়ে যায় ও। কাঠের দরজা ঠেলে ভেতরে তখন ঢুকে তামজিদ। হাতে খাবারের প্লেট। রুমের আলো জ্বালাতেই যেন চোখ দুটো জ্বলে উঠে দুপুরের। টানা বিশ বাইশ ঘন্টা সময় ধরে অন্ধকারে ও। তামজিদ দরজাটা আবার বন্ধ করে এগিয়ে আসে বিছানার কাছে। অতি আদুরে স্বরে বলে,

— খাবে পাখি উঠো ফাস্ট।

দুপুর তখন চোখ মেলতে অক্ষম। তীব্র আলোক ছটা চোখে বিঁধছে ফলার মতো। কপাল কুঁচকে হাত রাখে চোখের উপর। তামজিদ অবাক হয়ে তাকিয়েই থাকে। মেয়েটাকে দূর থেকে যতটা সুন্দর দেখায় সামনে যেন সেই সৌন্দর্য বাড়ে কয়েকশো গুন। এত সৌন্দর্য বয়ে বেড়ানো তো কঠিন। খুব কঠিন। ঠিক ততটাই কঠিন যতটা কঠিন হলে তামজিদ পা গল হয়েছে। পা গল হয়ে তুলে এনে বন্দী করেছে। পা দুটো যেন অবশ হয়ে আসতে চায় তার। এত সুন্দর হাতের আঙুলই বা কোথায় দেখেছে সে? কোথাও না। দুপুর নামক মেয়েটার মতো সুন্দর সে দেখেনি। কখনোই না। কোথাও না৷ তার অবশ হওয়া পা দুটো ঠেলে বসলো দুপুরের পাশে। বুঝা মাত্রই দুপুর সরে বসে। তামজিদের নিকট বিষয়টা অবশ্য ভালো ঠেকলো না। হাত বাড়িয়ে সে ধরতে চায় দুপুরকে কিন্তু তার আগেই দুপুর উঠে দাঁড়ালো। রাগে আর কান্নায় গাল দুটো গোলাপি হয়েছে তার। তামজিদের বেশ লাগলো দেখতে। মন চাইলো ঐ গালটায় আদর দিতে। নিজের মনোবাসনা পূরণে তৎপর হতেই দুপুর দুই হাতে ধাক্কা দিলো ওকে। তামজিদ’কে অবাক করে দিয়ে আঙুল তুলে শাসিয়ে বললো,

— আটকে রেখেছেন কেন? লজ্জা করে না আপনার। চেয়ারম্যানের ছেলে হয়ে এসব বখাটেপনা দেখান। আপনার বাবা না কত বড় বড় কথা বলে? এই নমুনা তার? আপনার মতো ছেলে?

বলেই দরজার দিকে দৌড়ে গিয়ে লক মোচড়ালো। অবাক দুপুর খেয়ালই করলো না সেটা তালাবদ্ধ বাইরে থেকে। তামজিদ আয়েশ করে বিছানায় বসে ডাকলো,

— এখানে এসো পাখি। খাবে তুমি।

দুপুর পেছনে ঘুরে দেখে নিশ্চিত হয়ে বসা তামজিদ। ওর কান্না পেলো। অনেক কান্না পেলো। বাড়ীতে সবাই চিন্তায় আছে ওর জন্য কিন্তু দুপুর তো এখানে আটকে। কিভাবে পালাবে ও? কি ই বা চাইছে তামজিদ তখনও অস্পষ্ট ওর নিকট। তামজিদ নিজেই উঠে এলো। দুপুরের হাত ধরতে চাইলেই দুই পা পিছালো দুপুর। কোনমতে বলে উঠলো,

— ধরাধরি করতে চান কেন? কি চান আপনি?

— আসো তুমি খাবে। ক্ষুধা পেয়েছে না দুপুর। এসো।

— বোকা মনে হচ্ছে আমাকে? খাওয়াবেন এরপর বলি বানাবেন? আমার আপনাকে সহ্য হয় না। ধরবেন না খবরদার বলে দিলাম।

তামজিদ সেদিন সত্যিই ধরলো না। শুধু ভয় দেখালো,

— তোমার দাদী বাইরে হাঁটতে বেরিয়েছে দুপুর। যদি না খাও খালের পানিতে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিবে কেউ।

দুপুর ভয়ে ভয়ে শুধু ডাল দিয়ে খেয়ে নিলো। ক্ষুধার কাছে সবাই হার মানে। সবাই। তাই তো গ্রোগাসে গিলে দুপুর। তামজিদ শুধু ওকে দেখে। নিজের বিছানায় তার পছন্দের মানুষ। পছন্দ থেকে ভালোবাসাই বটে অথচ ক্ষমতাবান তামজিদ দমিয়ে রেখেছে নিজের প্রবৃত্তি। অপেক্ষায় আছে রমনী মানবে। তার কাছেই আসবে৷
কিন্তু কোন ভাবেই বিগত চার দিন ধরে আটকে রেখে যখন তামজিদ দেখলো ফলাফল শূন্য তখন যেন পৌরষত্বেই আঘাতটা লাগলো। এলাকায় ততদিনে ছড়িয়ে গিয়েছে মিরাজ সাহেবের ছোট মেয়ে নিখোঁজ। কেউ বললো, ‘পালিয়ে গিয়েছে’। কেউ বললো,’ আগুন ধরানো রূপ, মিরাজ সামলে রাখবে না?’। তাদের প্রতিত্তোরে কেউ আবার বললো, ‘এই বাধভাঙ্গা রূপ সামলাবেই না কিভাবে?’
কত মানুষ কত কথা বললো। কেউ স্বান্তনার বাণী শোনালো কেউ টিটকারি মা’রলো। মিরাজ সাহেব ছোট মেয়ের শোকে হাসপাতালে বিছানা নিলেন। স্ত্রী মেয়ের শোক বুকে নিয়ে মাথায় নিলেন স্বামীর চিন্তা। বাড়ীতে বৃদ্ধ শাশুড়ী। একা হাতে এদিক ওদিক দৌড়াল সায়রা। চট্টগ্রাম বসে সন্ধ্যা আর ইফাত এদিক ওদিক খোঁজ লাগালো। ফলাফল শূন্য। চেয়ারম্যানের বাড়ী থেকে অফিস সায়রা’র পদচারণ তখন। তাসরিফে’র সাথে দেখা সাক্ষাৎ কথা শুরু। তাসরিফ তখন মনে মনে শুধু ভাবে, ‘বিচার কার কাছে দিচ্ছো বোকা মানুষ। বিচারকই তো চোর’। আসলেই তো চোর যদি সাহায্যকারীই হয় তাহলে সেই মূহুর্তে কি করা উচিত। যাকে সাহায্যকারী ভেবে সায়রা জুতার তলা খসাচ্ছে সেই তো মূল হোতা।
রাতের খাবার নিয়ে তাসরিফ সেদিন কটেজে যখন ঢুকলো তখন দেখলো চারপাশে অন্ধকার। দারোয়ানকে জিজ্ঞেস করতেই জানলো তামজিদ এখানেই আছে। গতকাল রাত থেকেই সে এখানে। তাসরিফে’র কপালে ভাজ পড়ে। দ্রুত পা ফেলে ভেতরে ঢুকে ও। দুপুরকে আটকে রাখা রুমটা ভেতর থেকে বন্ধ। বেশ কিছুক্ষন দরজায় দাঁড়িয়ে থেকে সরে যায় ও। পকেট থেকে ফোন বের করে ভাইকে ফোন করতেই রিসিভ হয় তা। তাসরিফ জানায়,

— ভাই রাতের খাবার এনেছি।

— হু।

ব্যাস এতটুকুই। দরজাটা খোলার শব্দে তাসরিফ একটু এগিয়ে আসে। আবছা অন্ধকারে অল্প খোলা দরজার ভেতরে তাসরিফ সেদিন খুব অল্প কিছু দেখে। ফ্লোরে সাদা, নীল মিশ্রিত কলেজ ড্রেস পড়ে আছে। মাথাটা নামিয়ে আস্তে করে সরে দাঁড়ায় ও। তামজিদ ওর থেকে খাবার নিয়ে প্লেটে বাড়তে বাড়তে জিজ্ঞেস করে,

— ওখানে খবর কি?

— এলাকায় জানাজানি হয়ে গিয়েছে। পুলিশ আর আমাদের এখানে দৌড়াচ্ছে ভাবীর ফুপি। ওনার বাবা হাসপাতালে। বাড়ীতে শুধু দাদী আছেন।

তামজিদ ভাবে কিছু একটা অতঃপর বলে,

— চলে যা তাহলে।

তাসরিফ একবার চাইলো ভাইকে জিজ্ঞেস করবে কিছু কিন্তু কেন জানি সেই সাহসটা হলো না তার। একদমই হলো না।
খাবার নিয়ে দুপুরকে দিতেই আতঙ্কিত দুপুর প্লেটে হাত দিলো। তামজিদ ওর দিকেই মনোযোগ দিয়ে তাকিয়ে আছে। সাত আট দিনে মেয়েটার মুখ চোখ কেমন হয়ে আছে। ডান গালে বৃদ্ধ আঙুল দিয়ে আদর করে তামজিদ বলে,

— মাথা ব্যথা আছে?

দুপুর আতঙ্কে মাথা নাড়ে দু’বার। মুখে খাবার তুলে। ওর আতঙ্কিত মুখটা ভালো লাগে না তামজিদে’র। অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে শুধু। খাওয়া হতে নিজ হাতে মাথা টিপে দেয়।
এর কত পরে গিয়ে ছাড়া হলো দুপুরকে। সেই কলেজ ড্রেসটাই গায়ে পরতে হলো তার। যেভাবে এসেছিলো ঠিক সেভাবেই তামজিদ ওকে বিদায় দিলো। শুধু বদলে গেলো পোশাকের আড়ালে থাকা ছোট্ট একটা মেয়ের জীবন। চঞ্চলা পা দুটো নিভে গেলো দপ করে। উড়ন্ত পাখিটার পাখা খুব করে ছেঁটে দিলো তামজিদ। ঘর থেকে বের করার আগে হঠাৎ ই জড়িয়ে ধরে তামজিদ। বুকের মাঝে আগলে নেয়। মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে,

— আমার কাছেই ফিরে এসো দুপুর। আমি চাইলেই তোমার ক্ষতি করতে পারতাম কিন্তু আমি করি নি। তোমার মতো পবিত্র ফুলকে অপবিত্র আমি করি নি। আমার বিশ্বাসের সম্মান রেখো। এখন থেকে তুমি শুধু আমাকেই পাবে৷ ছাড় দিচ্ছি কিন্তু ছেড়ে দিচ্ছি না দুপুর। তুমি নিজের ইচ্ছায় আমার বউ হবে। আমি অপেক্ষায় থাকব তোমার।

তামজিদ হয়তো জানে দুপুর পবিত্র অথচ গোটা এলাকা ছড়িয়ে গেলো দুপুর ফিরেছে চৌদ্দ রাত পর বাড়িতে। কতটা নির্মম এই সমাজ হতে পারে তা তামজিদ দেখিয়েছিলো দুপুরকে। হয়তো ভেবেছিলো সম্মান বাঁচাতে মেয়েটা ছুটে আসবে তাকে বিয়ে করতে। চিৎকার করে জানাবে সমাজকে,

— আমাকে উনি খারাপ ভাবে ছোঁয় নি৷ আমি ওনাকে বিয়ে করব। চেয়ারম্যানের বড় ছেলেই আমাকে নিয়েছিলো।

কিন্তু তামজিদে’র সেই কল্পনা কল্পনাই রয়ে গেলো। দুপুরটা সরে গেলো আড়ালে। সবার থেকে দূরে। ছাড় সে তখনও পায় নি মাঝেমধ্যেই বরং বাড়িতে উপস্থিত হয়ে সোজা দুপুরের ঘরে ঢুকতো সে। বিয়ের প্রস্তাব দিয়েও কোনবারই হ্যাঁ উত্তর পায় নি। মালোশিয়ায় তাদের ব্যাবসা দেয়ার পর থেকে একটু রেহাই পেলো যদিও দুপুর কিন্তু তাসরিফটা বাসায় এসে এসে ফোনটা কানে ধরিয়ে দিবে।

এই আধ রাতে গুমড়ে কেঁদে উঠে দুপুর। উঠে বসে হাউমাউ করে কাঁদে ও। ডাকতে থাকে সায়রা’কে। মায়ের আদর যত্ন তো এই সায়রাই তাকে করতো। নিজের সেই চৌদ্দ রাতের কথা তো দুপুর তাকেই জানিয়েছিলো। ফোন হাতড়ে দুপুর কল দিলো শাহজেবকে। মাঝরাতে সহ সকল এলোমেলো সময়ে কল দেয়া দুপুরের কাজ। শাহ চমকালো না বরং ফোন ধরে খুব স্বাভাবিক ভাবেই কথা বলতে চাইলো কিন্তু সম্ভব হলো না অবশ্য। দুপুর ফোন কানে নিয়ে হাউমাউ করে কাঁদছে আর বলছে,

— আমার বাচ্চা লাগবে শাহ। আমার বাচ্চা লাগবে।

শাহ তাজ্জব বনে যায়। মুহুর্তে সামলায়। স্বভাবসুলভ ঠান্ডা স্বরে বলে,

— আচ্ছা। এবার আমার কাছে নিয়ে আসব এরপর সুন্দর একটা বেবি হবে আমাদের।

আকুল হয়ে দুপুর জিজ্ঞেস করে,

— কবে? কবে নিবেন শাহ?

— কবে আসতে চাও?

— এখনই।

— এখন? রাত তিনটা পাঁচ বাজে যে?

— খুব রাত?

— না অবশ্য না৷ আসব নাকি?

— আসবেন বলছেন?

— তুমি বলো।

— কাল তো অফিস আছে আপনার।

— শুক্রবার আসি?

— বৃহস্পতিবার রাতে আসা যাবে না?

— এত উতলা বুঝি?

— হু।

— লজ্জা পাচ্ছে আমার দুপুর চণ্ডী?

— একটু একটু।

— আচ্ছা। এখন ঘুমাও তো একটু সোনা। আমি কথা বলছি। ভয়ের কিছু নেই।

দুপুর ঘুমিয়ে গেলো পাঁশ মিনিটে। শাহ ক্ষুদ্র শ্বাস ফেলে।
দুপুর হয়তো ভাবছে একটা বাচ্চা সবটার সমাধান দিবে অথচ সে কি জানে আড়ালে লুকিয়ে কে আছে? আজ দেশের মাটিতে এই রাত তিনটা পাঁচ মিনিটেই তো বিমান বন্দরে একটা মালোশিয়া ফেরত বিমান অবতরণ করলো।

#চলবে…