#সে_জন_সোনা_চিনে_না
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ১৭
একা বাড়ীতে সায়রা বসা নিজের কামরায়। একা ঘরে বসে থাকার মেয়ে সায়রা না অথচ পৃথিবীটা আজ-কাল তার নিকট সংকীর্ণ ঠেকছে। মনমানুষিকতা বিগড়ে যা তা অবস্থা। খোলা জানালা দিয়ে বাইরে দৃষ্টি দিতেই দেখলো অপরূপ প্রকৃতির অগাধ সৌন্দর্য। মেঘ জমাট বেঁধে আছে। বর্ষণ হবে হবে ভাব৷ এদিকে সায়রা’র মনের মেঘ গুলো শুধু জমাট ই বাঁধে। সেই কত বছর ধরে জমাট বেঁধে যাচ্ছে অথচ বর্ষণ হলো না এই অব্দি। কখনো এই চোখ দুটি কাঁদে না। হাজার কষ্টেও সায়রা কিভাবে জানি বেঁচে থাকে। মন বলে, এমন সায়রা হাজার হাজার। চোখের সামনেই আছে অথচ দেখা যায় না। বাইরে থেকে সায়রা’রা হয় খুব কঠিন, শক্ত, মাথা উঁচু করে সবাইকে ডিঙিয়ে জীবন যুদ্ধ করা নারী অথচ প্রতিটি সায়রা নিজে জানে তারা কতটা ভঙ্গুর, নমনীয় এবং ক্লান্ত। লড়াই করতে করতে একসময় হাতটাও যেন বলে, ‘এবার রেয়াই দাও, আমরা ক্লান্ত আর লড়াই করতে পারব না’। সায়রা তবুও অ’স্ত্র ধরে রাখে। লড়াই করার চেষ্টা করে। বিয়ের বয়স সীমা সমাজ ধরে বেঁধে দিয়েছে। গণ্ডীর বাইরে পা ফেলা বড়ই দায়। সেই সমাজে সায়রা মাথা উঁচু করে এতটা বছর বেঁচে ছিলো। মাহমুদ নামক ব্যক্তির নাম মন থেকে মুছলেও মস্তিষ্কে তো ছিলো। কখনো এই সমাজ বা কেউ তাকে বলার সাহস করে নি সায়রা’র চরিত্রে সমস্যা আছে। বিন্দু মাত্র কথা তোলার সাহস তারা পায় নি৷ কেউ একটা বললে তার মুখে দশ কথার তুল্য চড় সায়রা নিজ মুখে দিয়েছে। এই সমাজে বাঁচার এক অলিখিত নিয়ম, ‘দশজন যেই শব্দে কথা বলবে নিজের স্বর তাদের দশগুণ উঁচুতে তুলে কথা বলবে, তাহলেই তুমি টিকে থাকবে’। সায়রা এই নিয়ম মেনেই চলেছে। অথচ তাসরিফটা তার জীবনের সুতাটা টেনে ধরে মোড় ঘুরিয়ে ফেললো। সায়রা’র মতো মানুষটা সাধারণ কিছু মহিলা তাকে নিয়ে বলা কথায় জীবন থেকে মায়া হারিয়ে ফেললো।
সিলিং এর দিকে নজর যেতেই সায়রা’র মুখটা বিমূর্ত হয়। সেই রাতেই রুমের ফ্যান তাসরিফ খুলেছে। আর লাগায় নি। সায়রা’র মন বলে, এই ঘরে ফ্যান লাগাবে না আর তাসরিফ। সে ভয় পেয়েছে। ওর চোখে ভয় জিনিসটা দেখেছে সায়রা। সাতাইশ বছরের পুরুষ অথচ সায়রা’র মনে হয় ছোট ছেলে এই তাসরিফ। মন, দেহ কোনোটারই টান সে তাসরিফ থেকে পায় না অথচ তাসরিফ কাছে টানছে সেই প্রথম রাত থেকে। সায়রা বাঁধা দেয় না। এক তরফা ভালোবাসা কঠিন জিনিস। তিনটা বছর পিছু নিয়েছে, কিছুটা পাওনা তো তার অবশ্যই আছে।
আনমনা হয়ে সায়রা উঠে দাঁড়ালো। পরণের শাড়ীটা কিছুটা কুঁচকে আছে। এগিয়ে এসে দাঁড়ালো জানালার কাছে। আকাশে তখন মেঘ ক্রমশই বাড়ছে। ঘ্রাণ আসছে মাটির। একটা কাজের মেয়ে এসে ডেকে গেলো একবার খেতে। সায়রা উত্তর করে নি৷ তার ভালোলাগে না এসব। বেঁচে থাকা প্রতিটি মূহুর্ত হলো এক একটা রত্ন৷ জীবন উপভোগ করা উচিত। গুমরে কত মানুষ ম’রে অথচ তাদের উচিত জীবনকে মায়া করা। একটা মাত্র জীবন একে হেলায়-ফেলায় কাটালে চলবে? এত সুন্দর জীবনটার প্রতিই মায়া যখন হারিয়ে যায় তখন মানুষ হয় জীবন্ত লা’শ। নিজেকে সায়রা সেভাবেই দেখে। মুখটাও আজ-কাল ফ্যাকাশে দেখায়। মনে মনে সায়রা ভাবে, তার রোগ হয়েছে। ম র ণ রোগ। এই রোগ হওয়ার প্রথম উপসর্গ হলো মুখ ফ্যাকাসে হওয়া।
দরজার নবটা খুব ধীরে শব্দহীন খোলার চেষ্টা করে তাসরিফ তবুও সে ব্যর্থ। একটু শব্দ হলোই। ভেবেছিলো সায়রা’কে ঘুমন্ত পাবে কিন্তু ও জেগে। ক্লান্ত পা দুটো টেনে এগিয়ে গেলো ও৷ হাসপাতালে তামজিদে’র অবস্থা ভালো না৷ ঘুমের ইনজেকশন দিয়েই রেখেছে। অবস্থা বেগতিক। এই পর্যন্ত দুইবার জেগেছে। দুইবারই ‘দুপুর’ নামটা উচ্চারণ করেছে। ‘ভালোবাসা’ শব্দটার আসলে ব্যাখা হয় না। যারা দেয় তারা দেয় নিজ অভিজ্ঞতা থেকে। এই শব্দের বিশ্লেষণ হবে সবার ভিন্ন ভাবে। এই যে অপেক্ষা, এটা যেমন ভালোবাসা, ঠিক তেমনই অধৈর্য হওয়াও ভালোবাসা। কাউকে জানপ্রাণ উজাড় করে চাওয়া যেমন ভালোবাসা, ঠিক তেমনই ভালোবাসা হলো কাউকে নিজের করে পেতে কাউকে খু ন করা। ন্যায় অন্যায় ভালোবাসা বুঝে না৷ ভালোবাসা শুধু দুটো শব্দ চিনে, ‘প্রেমিক-প্রেমিকা’। তারা কাছাকাছি তো পূর্ণতা। তারা বিচ্ছিন্ন তো ধ্বংস।
আস্তে ধীরে এগিয়ে এসে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে তাসরিফ। সায়রা ঠাই দাঁড়িয়ে। অনুভূতিহীন এক জড় পদার্থ যেন। আলিঙ্গন ধীরে ধীরে গভীর হলো। কাঁধটাকে উন্মুক্ত করার চেষ্টা করলো তাসরিফ। লাভ অবশ্য হলো না। ওভাবেই মাথা দিয়ে রাখলো ও। সারাটা দিনের ক্লান্তি মুছার জন্য এহেন কিছু মূহুর্তে যথেষ্ট। পেটটা দুই হাতে জড়িয়ে রেখে অস্পষ্ট কণ্ঠে গুঙিয়ে উঠলো। মৃদু জড়ানো গলায় বললো,
— খুব ক্লান্ত লাগছে য়রা।
— ঘুমাও গিয়ে।
— হুম।
ছাড়ে না তাসরিফ। শক্ত করে পেছন থেকে তখনও জড়িয়ে রাখে। সায়রা বাইরে তাকিয়ে রইলো। তাসরিফ ছাড়লো মিনিট দশ পর। নিজের দিকে ঘুরালো সায়রা’কে। কপালে কপাল ঠেকিয়ে বললো,
— আমার সব এলোমেলো হয়ে গেলো সায়রা৷ কি থেকে কি হলো। ভাবীর বিয়ে কখন দিলেন আপনারা সায়রা?
— আরেকজনের বউকে ভাবী ডাকছো?
তাসরিফ সোজা হয়ে দাঁড়ায়। বলে,
— তাকে কখনো নাম ধরে ডাকিনি।
— বয়সে তোমার থেকে খুব ছোট। চাইলেই ডাকতে পারো।
তাসরিফ কথা ঘুরিয়ে বললো,
— তোমার ভাই এখন ঠিক আছেন।
— ম রে গেলে ভালো হতো।
— এসব বলতে নেই য়রা।
— আচ্ছা, তোমাদের পি স্ত ল গুলো লাইসেন্স করা?
— হ্যাঁ, কিন্তু আপনি কেন জিজ্ঞেস করছেন?
— আগে বলো, যে কেউ ব্যবহার করতে পারবে?
— না য়রা। কি ভাবছেন আপনি?
তাসরিফ উদ্ধিগ্ন গলায় প্রশ্ন করলো। সায়রা এক গাল বাকিয়ে হাসে। তা দেখে তাসরিফে’র বুকে ভয় জাগলো৷ ও ব্যস্ত হয়ে সায়রা’র হাত টানলো। সোজা রুমের ভেতরে নিয়ে খাটে বসালো। নিজে বসলো হাঁটু ভেঙে ওর পায়ের কাছে। সায়রা’র কোলের কাছে হাত দুটো নিয়ে বললো,
— আপনি কি করতে চাইছেন য়রা? এসব কেন ভাবছেন? আপনার ভাই ঠিক আছে এখন৷ মাত্র দেখে এসেছি। আপনি যাবেন? আমি নিয়ে চলি? এ..এখন যাবেন য়রা? উঠুন।
বলেই কুঁচকানো শাড়ীটা নিজের হাতে ঠিক করতে লাগলো তাসরিফ। সায়রা তাকিয়ে দেখছে ওকে। দেখতে দেখতে বললো,
— তিনটা বুলেট লাগবে আমার। একটা পি স্ত ল ম্যানেজ করে দিতে পারবে?
তাসরিফে’র বুকটা এবার ধরাস করে উঠে। তিনটা বুলেট দিয়ে কি করবে কি মেয়ে? একটা শুকনো ঢোক গিলে তাসরিফ বলে উঠলো,
— এসব মাথা থেকে বের করুন য়রা৷ এসব কথা বলবেন না।
— ভাই, ভাবী আর মা। শুধু এই তিনজনকে কাউকে দিয়ে মা র তে হবে। ওদের জন্য জীবনটা কষ্টের হয়ে যাচ্ছে। আমার ভাই যে কি এক পাপ করলো দুপুরটাকে পয়দা করে। ইশ! আফসোস হয় বুঝলে তাসরিফ। ছোট থেকেই চোখে লাগার মতো সুন্দর ছিলো। আচ্ছা, তুমি কি জানো ছোট বেলায় ওর সাথে কি হয়েছিলো? সেই ঘটনা তো তোমাকে বলা হয় নি। শুনবে নাকি?
তাসরিফ দেখলো অদ্ভুত ভাবে হাত নেড়ে কথা বলছে সায়রা। এভাবে হাত নেড়ে কথা বলার অভ্যাস ওর নেই। সায়রা মনোযোগ টানার জন্য তাসরিফে’র মুখটা নিজের দিকে করলো। বললো,
— তখন ওর সাত বছর বুঝেছো। আমাদের বাসায় আমার বাবার বন্ধু এসেছিলো। বন্ধুর সাথে ছিলো তার ছেলে। আমার ভাইয়ের বয়সেরই। দুপুর তখন ধীরে ধীরে ফুটছিলো। সদ্য সাতে পা দেয়া ছোট্ট একটা বাচ্চা। ও আমার বাচ্চা। আমি এটাই বলি সবাইকে। যখন থেকে ও হলো তখন থেকে। ওর মা থেকে বেশি আমাকে ভালোবাসতো বুঝলে। এখনও বাসে। সেই ছেলে দুপুরকে খেলার ছলে কাছে টেনে হাতের ক্ষুধা মিটাতে চাইছিলো। তুমি জানো, দুপুর ওসব না বুঝলেও সন্ধ্যা কিন্তু বুঝতো। মায়ের কোলে কোলে বড় হওয়া মেয়ে। মা সবই বুঝাতো কিন্তু আমার দুপুর? ওকে কে বুঝাবে? আমি তখন ছিলাম না৷ বাসায় এসে দেখি আমার ছোট্ট দুপুর খাটে ঘুমাচ্ছে। চোখ মুখ লাল। এত সুন্দর চামড়ায় লাল লাল দাগ৷ ফুলে ফুলে উঠেছে শরীরে। ফ্রকটা খুলেও দেখলাম। দরজা আটকে ঘুম থেকে তুলে সবটা শুনেছি৷ আমি অপারগ কিছুই করতে পারি নি৷ দুপুর যখন ব্যথা পেয়ে কাঁদছিলো তখনই সন্ধ্যা দৌড়ে ভয়ে নিজের মায়ের কাছে গেলো কিন্তু কিছুই বলে নি। দোষ কাকে দিব আমি? সন্ধ্যাও ছোট কিন্তু বুঝতো। দুপুর যখন ছুটে গেলো মায়ের কাছে তখন নাকি ভাবী দুটো চড় দিয়ে চুপ করিয়ে দিলো। এসব জানাজানি হলে মুখ থাকবে না৷ শশুড়ের বন্ধুর ছেলের নামে এসব কথা মানায়? দুপুরের বাবার বয়সী লোকটা। ছোট্ট দুপুরটার সেই কি জ্বর রাতে। আমি সারারাত জেগে মাথায় পানি দিলাম। ভাই জেনেছিলো পরদিন। ভাবীর সাথে তুমুল ঝগড়াও বেঁধেছিলো।
তাসরিফ চুপ করে আছে। সায়রা আচমকাই উত্তেজিত হলো। তাসরিফে’র হাতটা শক্ত করে ধরে বললো,
— ছোট থেকেই ওর সৌন্দর্য ওর কাল হয়েছিলো তাসরিফ৷ তোমার ভাই তাতে কলঙ্ক যোগ করেছে। তুমি… তুমি যখন ফোন নিয়ে যেতে ওর মুখটা র’ক্তশূণ্য হয়ে যেতো। তোমরা কেন এমন করতে? এই বয়সে আমার মা নিজের ত্রিশ বছর বয়সী মেয়ের বিয়ে দেখলো তাও কি না তুমি পি স্ত ল দেখিয়ে বিয়ে করেছো? আমার ভাই, ভাবী তারা আতঙ্কেই ম রে যাবে। একেবারে মে রে ফেলো। আমি বলছি কোন কেস করব না৷ ওদের মে রে ফেলো। মে রে ফেলো!
তাসরিফ উঠে দাঁড়ালো। সায়রা ছটফট করছে। শক্ত করে নিজের বুকে চেপে ধরে তাসরিফ থামাতে চাইছে। বারবার বলছে,
— সব ঠিক আছে য়রা, তুমি শান্ত হও। প্লিজ এমন করো না। য়রা, প্লিজ….
বুকের মধ্যেই জ্ঞান হারিয়ে ফেললো সায়রা৷ অতীত বলতে বলতে গিয়ে ক্লান্ত সে। নেতিয়ে যাওয়া শরীরটা তাসরিফ বুকে চেপে চুপ করে বসে রইলো। সায়রা’র এহেন রূপ সে দেখতে পারছে না৷ কি হচ্ছে সায়রা’র? ও তো এমন মেয়ে না। তাসরিফ জানে সায়রা’কে সঠিক ভাবে বিয়ে সে করে নি কিন্তু কি করবে ও? তিনটা বছর তো কম না। বয়সের বাহানায় সায়রা তাকে দেখেও দেখে না। তাসরিফ কি করেছে? শুধু সুযোগ বুঝে নিজের ভালোবাসা লুফে নিয়েছে।
_________________________
সারা বাড়ী একা একা টইটই করছে দুপুর। নিজের মতো করে ভাত, মাছ, ডাল রেঁধেছ। ঘর বাড়ী ঝাড়ু দিয়ে মুছেছে। বন্ধ ঘরটার কাছে এসে কৌতূহল হলো কিছুটা কিন্তু শাহ না করায় সেই দিকে ততটা যাচ্ছে না অথচ কোথায় গিয়ে ভেতর ভেতর একটা চাপা আগ্রহ সেই বন্ধ ঘরটাকে ঘিরে। দুপুর গিয়ে ভেজা কাপড়গুলো বারান্দায় মেলে দিলো। শোনা গেলো ফোন বাজছে। দৌড়ে আসে দুপুর। শাহ দিয়েছে নিশ্চিত! দেখা গেলো শাহ না দিলেও দিয়েছে তিব্বি। দুপুর বিছানায় বসে ফোন তুলে। অপর পাশ থেকে তিব্বি উদাস গলায় বলে উঠলো,
— আমাকে রেখে ভাইয়ের কাছে কেন গিয়েছো ভাবী?
— তুমি চলে এসো আন্টিকে নিয়ে।
— পরীক্ষা চলছে না? মাকে বললে পিটাবে আমাকে। আর এখন ওখানে এলে তোমার বর আমাকে দুটো ডান্ডার বারি দিয়ে ঠান্ডা করে দিবে।
— ইশ! কি যে বলো না তুমি? তোমার ভাই এত শান্ত অথচ তুমি তার বদনাম করছো?
— শান্ত না ভাবী সুনামি বুঝেছো। দেখেনি আমাকে সেদিন কিভাবে ধমকালো?
— আরে বাবা, ওটা তো আদরের শাসন।
— নিজের বরের হয়ে সাফাই গাইছো ভাবী? তোমাকে আপন মনে করি আমি।
— আপনই তো আমি।
— আচ্ছা, শুনো তুমি মনোযোগ দিয়ে। ভাইকে আঁচল দিবে না মুখ মুছতে। কোন কাজও করে দিবে না৷ বলবে এতদিন যেভাবে ছিলো ওভাবে যাতে থাকে।
— আচ্ছা।
— এত সহজে মেনে গেলে?
— সকালেই তো মুখ মুছে গেলো। তার কাজও সব করা শেষ আজকের মতো তাই আর চিন্তা নেই।
— কলটা আগে দেয়া উচিত ছিলো তাহলে।
— মিস করে গেলে।
পাশ থেকে মা তিব্বিকে এবার নিয়ে তিনবার পিঠে চড় লাগালো। শেষটা জোরে হওয়াতে তিব্বি মুচড়ে উঠলো। বললো,
— ভাবী, তোমার শাশুড়ী কথা বলবে।
মা কল ধরতেই বললেন,
— কেমন আছিস মা?
— আলহামদুলিল্লাহ। ভালো। আপনাদের খুব মিস করছি।
— আহারে আমার মেয়েটা একা হাতে সব করছে। শোন কিচ্ছু করবি না। শাহজেবকে বলে বুয়ার ব্যাবস্থা করছি আমি।
— না না। উনি আমাকে বলেছিলো কিন্তু আমিই না করেছি৷ দু’জনের কাজ আমি একাই পারব।
— তবুও….
— আচ্ছা প্রয়োজন হলে আমি বলব। আন্টি, একটা কথা জিজ্ঞেস করি?
— হ্যাঁ হ্যাঁ বল আম্মু।
— উনি কি কি পছন্দ করেন খেতে?
— শাহজেব? তোর উনিকে শুধু ভর্তা দিবি নানান পদের। বাঙালী খাবারই বেশি পছন্দ করে ও।
দুপুর মাথা নাড়ে। আজ সে বাকিটা সময় ভর্তা বানাবে। কাজে লেগে পড়লো দুপুর। কোমড়ে আঁচল গুজে আলু থেকে শুরু করে ডিম ভর্তা করলো। ঘরে আরো কিছু থাকলে দুপুর তারও ভর্তা করতো। তার শাহ’র পছন্দ বলে কথা।
গোসল সেরে দুপুর ফোন তুললো হাতে। বাসায় ফোন দেয়া দরকার। মনের ভেতর কেমন একটা লাগে মাঝেমধ্যেই। আতঙ্কে থাকতে থাকতে এখন আতঙ্কই লাগে সবসময়। এখানে ভয় নেই কোন দুপুর জানে। এই ঠিকানা কেউ জানে না৷
ফোন কেউ রিসিভ করে না৷ দুপুরের চিন্তা আরো বাড়ছে। চার বারের সময় মিরাজ সাহেবই ফোন ধরলেন। দুপুর শ্বাস আটকে ডাকলো,
— বাবা?
— মা।
— কণ্ঠ ভারী লাগে কেন?
— ঠান্ডা লাগছে সামান্য।
— আশ্চর্য! এই গরমে ঠান্ডা লাগলো কিভাবে?
— ঘামে ভিজে এই অবস্থা। আম্মু, বাবার কথা শোন।
— বলো শুনছি। বাবা?
— হ্যাঁ।
— আমার খুব চিন্তা হচ্ছে?
— কেন মা?
— জানি না কিন্তু বুকে কেমন জানি লাগছে।
— নতুন জায়গা যে তাই এমন লাগছে মা। বাবা কি বলি শুন, তুমি আপাতত কোন ভাবেই এখানে এসো না। আমি তোমার মা আর দাদুকে নিয়ে চট্টগ্রাম যাব ভাবছি।
— দুলাভাই এর কাছে?
— না মা। ওখানে কোথাও বাসা ভাড়া নিব।
— বাবা?
— বলো।
— ওনারা কি এসেছিলো?
মিরাজ সাহেবের কণ্ঠ চেপে চেপে আসছেন৷ চোখটা বুজতে বুজতে বললেন,
— উহু। ওরা টেরই পায় নি মা। টের পেলেই বা কি? আমার দুপুরকে এখন আর পাবে না। আমি ম রে গেলেও শান্তি পাব এখন।
— এসব কথা বলবে না বাবা৷ আমার খারাপ লাগে।
— বলব না।
— ফুপিকে রেখে যাবে?
— ওরা তো দিবে না।
— তাসরিফ ভাই ফুপিকে ভয় পায়।
— তোমার ফুপি খুব স্ট্রং বুঝেছো।
— হু।
— রাখি তাহলে মা?
— আচ্ছা।
ফোনটা রেখেই স্ত্রীর পানে তাকালেন মিরাজ সাহেব। এখান থেকে সোজা চট্টগ্রামের পথ ধরবেন তারা। মেয়েটা এখন ভালো থাকবে। চিন্তা নেই আর।
#চলবে…..
#সে_জন_সোনা_চিনে_না
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ১৮
গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে শাহজেব। তার মুখের শব্দ ক্ষীণ অথচ চোখের দৃষ্টিতে খেলা করছে এক গুচ্ছ শব্দ। দুপুর চুপ করে বসে আছে। ওর হাতটা শাহজেবে’র হাতের মাঝে। গভীর ভাবে সেই হাতটাই দেখছে এতক্ষণ যাবৎ। দুপুর এবার ক্ষুদ্র শ্বাস ছাড়লো। এভাবে কতক্ষণ বসে থাকা যায়? আবার ভাবলো শাহ থাকলে এভাবে থাকতেও ওর কষ্ট নেই কিন্তু শাহ এসেছে থেকে না খেয়ে এভাবে বসা। দুপুর এবার শাহজেবে’র দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করলো। অন্য হাতটা দিলো শাহ’র হাঁটুতে। শাহ প্রতিক্রিয়াহীন বসা। দুপুর আস্তে ডাকলো,
— শাহ?
উত্তর আসে না। দুপুর ছোট্ট একটা দম নিয়ে বললো,
— এসেছেন থেকে এভাবে বসে আছেন শাহ। উঠুন এবার।
শাহ অনড়ভাবে বসেই আছে। দুপুর নিজের লাল হওয়া হাতটা এক পলক দেখে শাহ’র হাঁটু থেকে সরিয়ে হাতটা রাখলো গালে। দাঁড়ি ভর্তি গালে এক হাত রেখে আন্তরিক ভাবে বললো,
— একটু লাল হয়েছে শাহ৷ সামান্য একটু ব্যাপার। আপনি বিগত একটা ঘন্টা ধরে হাত ধরে বসে আছেন৷ খাচ্ছেনও না৷ ফ্রেশ হবেন তো শাহ। উঠুন৷
— সামান্য ব্যাপার?
— হ্যাঁ, শাহ। খুবই সামান্য এটা।
— কিভাবে হলো?
দুপুর বলতে লাগলো,
— ভাতের পানি ঝড়াতে গিয়ে হাতে লেগেছে কিছুটা।
এটা নিয়ে দুইবার দুপুর জানালো কিভাবে হাতে লাল দাগ পড়েছে কিন্তু শাহ’কে বুঝানো যাচ্ছে না। সে প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে না৷ দুপুর হাতটা ছাড়ালো ধীরে ধীরে। শাহ একই ভঙ্গিতে বসা৷ দুপুর এবার দুই হাতে ওর মুখটা ধরলো৷ নিজের দিকে মুখটা ফিরিয়ে কপালে হাত বুলালো। হাসি মুখে বললো,
— আপনি বার্নাল লাগালেন তো শাহ৷ দেখুন এখন ঠিক আছে আগের থেকে।
— দাগটাতো যাচ্ছে না দুপুর।
— একদিনে চলে যাবে? থাকবে না একটু?
দুপুর হাসছে। শাহ সেটা দেখে ওকে টেনে নিজের কোলে তুললো। দুপুর তাকিয়ে আছে ওর দিকে। শাহ ওর পিঠ চেপে ধরে। দুপুর মৃদু স্বরে ডাকে,
— শাহ?
শাহ’র ঘর্মাক্ত বুকে তখন লেপ্টে নিলো দুপুরকে। দুপুর চুপ করে রইলো কিছু সময়৷ শাহ ওর সামান্য হাত পোড়া নিয়ে এতটা থমকে যাবে দুপুর ভাবে নি। শাহ কখনোই বউ অন্ত পা গ ল স্বামী না৷ সে সাধারণ পুরুষ যার ধ্যান জ্ঞানে দায়িত্ব, পরিবার আর কিছু না। এই যে মাঝেমধ্যে দুপুরের রাত বিরাতে ফোন গুলো সে সুন্দর মতো গ্রহণ করে দুপুরের তাতেই হয়। মাঝেমধ্যে ছোট তিব্বির সাথে যখন হিংসে করে তখন তাতে গভীর পা গ লা মো দেখে দুপুর। সব ছাপিয়ে তার আজকের গম্ভীর হওয়াটা যেন একটু ভিন্ন। দুপুর ক্ষুদ্র শ্বাস ফেলে। শাহ’র বুক থেকে সরে বললো,
— গোসল করবেন এবার শাহ। উঠুন৷
শাহ দুপুর’কে ধরেই উঠে দাঁড়ালো। তার মুখের ভাবসাব এখনও ঠিক হয় নি। দুপুর ঠেলে গোসলে পাঠালো ওকে। দুপুর ভেবেছিলো শাহ ওকে লজ্জা দিতে অন্তত হাতটা ধরে ভেতরে টানবে কিন্তু ওকে অবাক করে দিয়ে এমন কিছুই হলো না। দুপুর গিয়ে টেবিলে খাবার সাজালো। নজরটা ঘুরে ফিরে বন্ধ রুমটায় যায়। দুপুরের ভেতর চাপা এক আগ্রহ প্রকাশ পেলেও ও কথা বলে না। শাহ আসতেই ভাত বেড়ে দেয়। শাহ ভাতের প্লেটটা নিয়ে সহজ ভাবেই বললো,
— বসে যাও।
— আপনাকে আগে….
— আগে পরে না দুপুর। দু’জন মানুষ আমরা একসাথে না খেলে ভালো লাগে বলো?
দুপুর মাথা নাড়ে। বসা মাত্রই শাহ ওর প্লেট সরায়৷ দুপুরকে অবাক করে দিয়ে ভর্তা দিয়ে মেখে আগে ওর মুখে তুলে। দুপুর খাচ্ছে, শাহ বলে,
— এত ভর্তা আজ?
— আপনার পছন্দ তাই।
মুখের খাবার গিলে উত্তর করে দুপুর। শাহ মুখে তুলে দুপুরের দিকে তাকালো। ইশারায় বললো, খুব ভালো হয়েছে। দুপুর হাসে। শাহ’র পছন্দ হয়েছে শুনেই তার সকল খাটাখাটুনি যেন স্বার্থক।
দুপুর গেলো শাহ’র পিছু পিছু। গায়ে শার্ট জড়াচ্ছে শাহ। দুপুর অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে,
— এখন কোথায় যাবেন শাহ?
শাহ সামান্য হাসে। সেই কালো মুখটায় হাসিটা বেশ মানালো। দুপুরকে কাছে টেনে কপালে ওষ্ঠ ছোঁয়ায় ও। লহু স্বরে বলে,
— আজ দুপুরটা নাহয় দুপুরচন্ডী না ফুটুক। এক দুপুর তো আপনাকে কষ্ট করতেই হবে দুপুর। সেই কষ্টের কারণটাও আপনি৷ আমি তো শুধুমাত্র ক্ষুদ্র এক মানুষ।
দুপুর প্রথম কথায় লজ্জা পেতে পেতে শেষ কথা গুলো না বুঝে তাকিয়ে রইলো। শাহ ওর গালে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো,
— আজ থেকে আপনার ভাত রান্না করা নিষেধ করা হলো দুপুর। সেটা আমি করব৷ আপনি একা, বুয়া রাখার সাহস করতে পারছি না৷
— আপনি শুধু শুধু….
ঠোঁটটা নিজের আঙুল দিয়ে চুপ করালো শাহ। তার চোখের গভীরতা দুপুর দেখলেও বুঝলো না৷ শাহ হাতটা টেনে নিজের চোখের সামনে নিয়ে গভীর ভাবে চুম্বন করলো। দুপুর মিহিয়ে গেলো তখন। শাহ ওর কোমল গালটায় আঙুল বুলাতে বুলাতে বললো,
— আজকের জন্য মাফ করে দিলাম দুপুর।
বলেই গায়ের শার্ট খুলতে লাগলো। দুপুর অবাক হয়ে প্রশ্ন করে,
— অফিস যাবেন না শাহ?
— যাব তো কিন্তু…
দুপুর মাথা নামিয়ে নিলো। নিজের কৃষ্ণ রঙা খালি দুধে আলতা দুপুরকে মিলিয়ে নেয় শাহ। বুকে নিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,
— ঘুমাও। আজ এটাই তোমার শাস্তি দুপুর।
এতটা কাছে টেনে যখন শাহ ঘুমাতে বললো দুপুর তখন ভীষণ অবাক হলো তবে মুখে কিছু বললো না৷ ক্ষুদ্র শ্বাস ফেলে উন্মুক্ত বুকটায় চোখ বুজলো।
_______________________
হাসপাতালে প্রচন্ড গন্ডগোল করছে তামজিদ। কিছুতেই থাকবে না এখানে অগত্যা তার সকল চিকিৎসা বাসায় করাবে বলে রিলিজ করিয়ে বাসায় আনা হয়েছে। সবার ধ্যান তামজিদে থাকায় কেউ টের পায় নি এলাকা থেকে ততক্ষণে বিদায় নিয়েছে মিরাজ সাহেব। বৃদ্ধ মা এবং স্ত্রী নিয়ে তিনি বাড়ী ত্যাগ করেছেন। বাসায় এসেই গোসল করে তামজিদ। খালি গায়ে পানির নিচে ঠাই দাঁড়িয়ে থাকে। দেয়াল জুড়ে সামনে আয়না। সেখানে দাঁড়িয়ে নিজেকে খুব করে দেখলো ও। অসুস্থতার ছাপ কিছুটা মুখে অথচ রূপ তার কম না৷ পুরুষ ন্যায় সুঠাম দেহ, চোয়াল ভর্তি দাঁড়ি, হাটা, চলা সবটাই যেন ঈর্ষনীয় তবুও কেন দুপুর তাকে চাইলো না? কেন দুপুরের একটাবার মনে হলো না তামজিদ ওর যোগ্য? কোন দিক থেকে তামজিদ পিছিয়ে? সৌন্দর্য, টাকা পয়সা, ক্ষমতা, ভালোবাসা.. কি চাই আর তার? তামজিদকে শুধু একটাবার বলেই দেখতো। ওর সকল খায়েশ তামজিদ পূরণ করতো। এই যে মেয়েটার তেজে ভরপুর দুপুর পছন্দ তাই তো মালোশিয়ার বাড়ীটায় রুমের পাশে রুফ করেছে তামজিদ। রুফটা নিজ হাতে সাজিয়েছে অব্দি। কে থাকবে এখন সেখানে? দুপুর তো নেই। তামজিদের মস্তিষ্ক দপদপ করে। চিড়বিড় করে উঠে যেন। দুই হাতে মাথা চেপে ধপ করে বসে পরে ও। চোখ দুটোয় ফুটে উঠে হিংস্রতা। দুপুর চাই তার। এই ভরা দুপুরে তার সাথে দুপুরের থাকার কথা ছিলো।
নিজ হাতে সেভিং রেজার চেপে ধরে ও। বর্ণহীন পানিতে তখন ধীরে ধীরে লাল রঙটা ফুটে উঠে। সেদিকে এক ধ্যানে চেয়ে রইলো তামজিদ। বিরবির করে বললো,
— তুমি কোথায় জান? আমার কথা কি মনে পরে না? একটুও না? তুমি কি ভালো আছো? আমাকে ভুলে গিয়েছো?
নিজে নিজেই শরীর মুছে হাতে গজ পেঁচায় তামজিদ। ভেজা চুলটা তখনও শুকায় নি৷ ড্রয়ার খুলে পি স্ত ল টা কোমড়ে গুজে বেরিয়ে আসে রুম থেকে। মা দেখেই হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসলেন। বললেন,
— কোথায় যাও আব্বু?
— একটু বাইরে।
— তোমার শরীর ভালো না। খাবে এখন। বাবা আমার এখন না।
— শশুর আব্বুকে দেখতে যাচ্ছি মা। ওনাকে বাসায় আনার কথা এতদিনে।
— আচ্ছা যেও৷ খেয়ে নাও।
— আগে দেখে আসতে হবে মা। দুপুরকে যখন ফেরত আনব তখন কি উত্তর দিব? তার বাবার খেয়াল রাখি নি। রাগের মাথায় শ্যুট করেছি। এখন দেখাশোনা তো করতে হবে।
তামজিদ বেরিয়ে গেলো। জোরে জোরে পা ফেলে হাঁটছে ও। বাড়ীটায় পৌঁছাতে সময় লাগলো না। চাবি দিয়ে মেইন দরজা খুলে ভেতরে যেতেই কপাল কুঁচকে গেলো তার। জনমানবহীন একটা বাড়ী। কেউ নেই এখানে। প্রতিটা ঘর খুঁজলো। ডাকলো,
— দাদী? দাদী? তুমি কোথায়? দাদী?
বৃদ্ধার উত্তর আসে না। তামজিদ মিরাজ সাহেবের রুমে ঢুকে গলা উঁচিয়ে ডাকে,
— আম্মা? আম্মা আপনি কোথায় আম্মা?
কেউ নেই। চারপাশে কেউ নেই। তামজিদের অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে। ও টলমল পায়ে দুপুরের রুমে গিয়ে ধপ করে বিছানায় পড়ে গেলো। বালিশটায় মুখ গুজে মৃদু গুঙিয়ে উঠলো। মুখ দিয়ে আসা লালায় বালিশ ভিজছে তখন। ঘন্টা খানিক ওভাবেই পড়ে রয় অসুস্থ এক তাগড়া যুবকের দেহ। সেই দেহের ভেতর থাকা ছোট্ট হৃদয়টায় তীব্র ব্যথা। প্রেম হারানোর ব্যথা। এই ব্যথা মানুষকে কতটা পীড়া দেয় তা তামজিদের হাড় গুলো সহ টের পাচ্ছে যেন।
বেশ খানিকটা সময় পর ও উঠে দাঁড়ালো। হাতে নিলো দুপুরের একটা বালিশ৷ বেরিয়ে এলো সেখান থেকে। এলোমেলো হাঁটছে রাস্তায়। আড় চোখে তাকিয়ে রইলো বেশ কিছু মানুষ। এতো চেয়ারম্যানের বড় ছেলে। কি দাম্ভিক একটা যুবক, সে কেন এভাবে রাস্তায় হাটছে? পা গ লে র বেশে থাকা তামজিদ’কে দেখে ছোট্ট বাচ্চারা বেশ আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে রইলো। হাতে একটা গোলাপি বালিশ নিয়ে এদিক ওদিক ভটকাচ্ছে তামজিদ। আশ্চর্য! সে কেন বাড়ী খুঁজে পাচ্ছে না?
.
— ব্যাগ গোছানো হয়েছে য়রা?
সায়রা চুপচাপ খাটে বসা ছিলো। তাসরিফ একা একাই ব্যাগপত্র গোছাচ্ছে। ভাই হিসেবে তার দায়িত্ব ছিলো এতটুকু করা যে তামজিদ অন্তত বাসায় আসা পর্যন্ত এখানে থাকবে। এখন যেহেতু এসেছে তাই আর এখানে থাকবে না তাসরিফ। বেরিয়ে যাবে এখান থেকে। ভাই থাকা অবস্থায় সায়রা এখানে ভালো থাকবে না। এমনিতেও বিয়ের পর থেকে সায়রা’র মতিগতি ও বুঝে না। আগের তেজ নেই। বাসি ফুলের মতো কিছুটা যেন ছুঁলেই ঝড়বে। তাসরিফ তা হতে দিবে না৷ ও ওর আগের সায়রা চায় যে খুব করে রেগে থাকে, মাঝেমাঝে আদর করে শাসন করে, তেজে ভরপুর হয়ে থাকে।
আড় চোখে গালর দাগটাও দেখে নেয় ও। চাপা নিঃশ্বাস ফেলে আলগোছে। ব্যাগ রেখে এগিয়ে যায় সায়রা’র কাছে। পাশে বসে হাতটা ধরতেই সায়রা তাকালো ওর দিকে। তাসরিফ সেই দৃষ্টিতে ঘাবড়ে গেলেও বুঝতে দিলো না বরং বললো,
— বাসা ভাড়া নিয়েছি য়রা। আপনি আর আমি থাকব সেখানে। আপনি যেভাবে মন চাইবে থাকবেন৷ যা যা লাগবে শুধু আমাকে বলবেন য়রা৷ আমি সব এনে দিব।
— কিসের কাজ করো তুমি?
থতমত খায় তাসরিফ। উত্তরে বলে,
— বাবার ব্যবসা সামলাই আর…
— আর মানুষকে হুমকি ধমকি দেই।
— আপনি ভুল ভাবছেন।
— তোমাদের পাপের টাকা আর কত গিলব কে জানে? জান দেখেছো আমার? কই মাছের। ম রেও ম রি না৷
— য়রা!
তাসরিফ দাঁড়িয়ে গেলো। তার দেহটা কাঁপছে রাগে। সায়রা চাপা হাসে। বলে,
— য়রা য়রা ডেকে কি প্রমান করতে চাও?
— বোঝেন না আপনি?
সায়রা মাথা দুলায়। বলে,
— খু নী হাজার প্রেমিক হোক না কেন দিন শেষে সে খু নী ই থাকে।
— আমার বুকে ছুড়িঘাত করে খুব শান্তি পান আপনি?
— খুউব।
সায়রা উঠে বাইরে এলো। রুমে পানি নেই। টেবিল থেকে পানির জগটা নিতেই কানে এলো,
— আমার সংসার ভাঙতে এসেছো তুমি? আমার ছোট ছেলেকে কেড়ে নিবে? ওকে নিয়ে এখন আলাদা থাকবে।
সায়রা চেয়ারে বসে পানি পান করলো। তাকালো দাঁড়িয়ে থাকা শাশুড়ীর দিকে। সায়রা’র মুখে হাসি যা দেখে ভড়কালেন তিনি। আচমকা হাতের কাঁচের গ্লাসটা তার পায়ের কাছে ছুঁড়ে মা রে সায়রা। ভয়ে দুই পা পিছিয়ে গেলেন তিনি। সায়রা এগিয়ে এসে কাঁচের টুকরো নিজের হাতে নিলো। চিৎকার করে ডাকলো,
— তাসরিফ! তাসরিফ!
মহিলা এতে আরো ভড়কে গেলেন। তাসরিফ যেন দৌড়ে এলো একপ্রকার। হতভম্ব হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
— কি হয়েছে য়রা?
দাঁত মুখ খিঁচে সায়রা বলে,
— তোমার মায়ের সংসার ভাঙতে এসেছি এসেছি? তোমাকে নাকি আলাদা করছি? অ্যই, এক্ষণ তোমার মা’কে বলো তার কোন ** সংসার যে আমি ভাঙতে আসব?
তাসরিফ তাকালো মায়ের দিকে। সায়রা যে গালি দিলো তা যেন শুনলো না। সায়রা পুণরায় বলে উঠলো শাশুড়ীর দিকে তাকিয়ে,
— কি ভেবেছেন আপনার কথা শুনে আমি আবার ফাঁ সি দিব? সেদিন মহিলা দিয়ে কথা শুনিয়ে আমার মাথা আউট করে দিয়েছেন তাই বলে আজও বলবেন আমি বিষ খাব? পিছু টান নেই এখন আর। ম রা র প্রশ্ন উঠে না।
একটু থেমে আবার বললো,
— আমাকে কথা শোনানোর আগে নিজের দিকে তাকাবেন৷ শুধু পয়দা করেই বসে আছেন৷ শিক্ষা দিতে পারেন নি একটা ছেলেকেও।
সায়রা হাতের কাঁচ ফ্লোরে ছুঁড়ে চলে গেলো সেখান থেকে। তাসরিফ তাকিয়ে আছে ওর মায়ের দিকে। মা যেন মহা সমুদ্রে পড়লেন৷ ছেলেকে কি উত্তর দিবেন তিনি?
তখনই দরজায় দু’জন লোক সহ চেয়ারম্যান সাহেব বাড়ীতে ঢুকলেন৷ তামজিদ বাড়ী হারিয়ে রাস্তায় হাঁটছিলো। দু’জন তাকে নিয়ে চেয়ারম্যানের অফিসে গিয়েছিলো। তামজিদ বাড়ীতে এসেছে। বগলদাবা করা গোলাপি সেই বালিশ। মা’কে দেখেই বললো,
— মা, ওরা তো কেউ বাড়ীতে নেই। পালিয়ে গেলো বোধহয়। জিনিস পত্র কিছুই তো নেয় নি।
বেশ শান্ত কথা তার। তাসরিফ দাঁড়ালো না সেখানে। ও গেলো সায়রা’র কাছে। জীবনটা এত অগোছালো হলো কেন?
তামজিদকে ধরে মা কাঁদলেন কিছুক্ষণ। খেতে বসালে ও ডাকলো,
— তাসরিফ? তাসরিফ? সায়রা’কে নিয়ে খেতে আয়।
নিজ হাতে পাঁচ প্লেট ভাত বাড়লো ও। তখনও আসে নি তাসরিফ। তামজিদ বাবা’র দিকে তাকিয়ে আলতো হেসে বললো,
— দুপুর এলে ছয় প্লেট ভাত বাড়তে হবে বাবা।
চেয়ারম্যান সাহেব কিছু বলার মতো পেলেন না৷ তামজিদ আবার ডাকলো,
— অ্যই তাসরিফ খেতে আয়….
ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলো তাসরিফ বের হচ্ছে হাতে লাগেজ৷ পেছনে সায়রা। কপাল কুঁচকে ও জিজ্ঞেস করলো,
— কিরে কোথায় যাচ্ছিস?
তাসরিফ থামলো। আস্তে করে বললো,
— সায়রা’কে নিয়ে আলাদা থাকব ভাই৷
চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো তামজিদ। ভাইয়ের দিকে এগিয়ে আসতে আসতে বললো,
— পা গ ল হলি? হানিমুনে যা তাহলে। ঘুরেফিরে চলে আসবি৷ আলাদা থাকব এটা কেমন কথা?
— এখানে একটু সমস্যা হচ্ছে।
— কি সমস্যা? আশ্চর্য! দুপুরের চিন্তায় বাঁচতে পারছি না আমি এরমধ্যে তুই নতুন কথা বলিস।
— এখানে প্রাইভেসি পাচ্ছি না আমি ভাই।
— ক..কি বলিস তুই? ওও হ্যাঁ, ঐ..ঐদিন তো আমি ইচ্ছে করে করি নি। আ..আমার মাথা ঠিক ছিলো না৷
তামজিদে’র কথা গুলো আটকে আটকে এলো। তাসরিফ পুণরায় বললো,
— এছাড়াও বাড়ীতে সায়রা থাকায় আম্মুর সমস্যা হচ্ছে ভাই। তাই আমিই আলাদা হয়ে যাচ্ছি।
— কি সমস্যা? কি বলছিস তুই?
চেয়ারম্যান সাহেবও উঠে দাঁড়ালেন। তামজিদের মা তখন ঘামছেন সমানে। তাসরিফ সায়রা’কে নিয়ে তখন পা বাড়ালো সামনে। দৌড়ে গিয়ে ছোট ভাইয়ের পা ঝাপটে ধরে তামজিদ। কাঁপা কাঁপা গলায় বলে উঠে,
— যাস নে তাসরিফ। ভাই না তুই আমার? দুপুর নেই ভাই, আমার বুক জ্বলে যাচ্ছে। তুই ও ছেড়ে গেলে ম রে যাব আমি৷ আমাকে মে রে যা তাসরিফ। একা রেখে যাস না।
তাসরিফ তারাতাড়ি বসে ভাইকে জড়িয়ে ধরে। ছোট ভাইয়ের বুকে চোখ বুজে গেলো অবধ্য প্রেমিকটার। সায়রা গিয়ে টেবিল থেকে গ্লাস নিয়ে তামজিদের মুখে ছিটালো। মা কেঁদে উঠলেন। চেয়ারম্যান সাহেব হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। তাসরিফ ভাইকে বুকে চেপে উঠতে চাইলো। সায়রা সাহায্য করলো। তামজিদে’র মুখ দিয়ে তখন সাদা সাদা ফ্যানা বের হচ্ছে।
#চলবে….